বাংলাদেশের মোট ভূমির ২০ শতাংশ উপকূলীয় এলাকায়। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত এ অঞ্চলের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ থাকে সবচেয়ে বেশি। যুগের পর যুগ ধরে পানিতে লবণাক্ততার সমস্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারীস্বাস্থ্য। এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ভুগছে জরায়ুর সমস্যায়। এ কারণে অনেকে বিতাড়িত হচ্ছেন পরিবার থেকে।
অথচ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে তার বাস্তবায়ন ও সুফল সম্পর্কে ইতিবাচক কোনো সংবাদ এই মুহূর্তে নেই। উপকূলীয় নারীদের স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করে এমন কিছু সংস্থা জানিয়েছে, উপকূলীয় নারীদের স্বাস্থ্য, বিশেষ করে প্রজননস্বাস্থ্য দিন দিন চরম ঝুঁকির মুখে পড়ছে। জলবায়ুসংকটে বাংলাদেশের উপকূলীয় নারীদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হারাচ্ছেন তাদের জরায়ু।
উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা যেসব অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত, সেগুলোর মধ্যে চিংড়ি পোনা ধরা ও মাছের ঘেরে কাজ করা অন্যতম। পোনা সংগ্রহের কাজে এ এলাকার কয়েক লাখ নারী ও শিশু নিয়োজিত। লবণাক্ত পানিতে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি অনেক বেশি। দেশের উপকূলের জলবায়ুসংকটের ফলে সৃষ্ট সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্রজননস্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হন এখানকার নারীরা। উপকূলীয় লাখ লাখ নারীর জীবনের এক চরম বাস্তবতা এটাই। জরায়ুসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে পুকুরে নেমে গোসল না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সুযোগের অপ্রতুলতা রয়েছে উপকূলীয় নারীদের ক্ষেত্রে। যাদের অসুস্থতার মাত্রা বেড়ে যায়, তাদের নিতে হয় উন্নত চিকিৎসা। এর ব্যয় মেটানোর ভয়ে অনেকে চিকিৎসা না নিয়েই দিন কাটান।
বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, উপকূলে এমনও কিছু অঞ্চল রয়েছে, যেখানে ৫০০ থেকে ৭০০ ফুট গভীর নলকূপ থেকেও লবণাক্ত পানি ওঠে। কিছু বাড়ির আঙিনায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য বসানো হয়েছে পানির ট্যাংক। তবে বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে তা যথেষ্ট নয়। এমনও গ্রাম আছে, যেখানে মাত্র দুটি বড় পুকুর পুরো গ্রামের মানুষের খাওয়ার পানির জোগান দেয়। নারী ও শিশুরা প্রতি সপ্তাহে একবার পাত্র নিয়ে সেই পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করে। এলাকাগুলোর নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সুযোগ সীমিত বলে কাপড়ের ন্যাকড়া ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। যেগুলো আবার পরিষ্কার করতে হয় সেই লবণাক্ত পানি দিয়েই। এখান থেকে জরায়ুর স্থানচ্যুতি, জরায়ু ক্যানসার, পাকস্থলীর দুরারোগ্য নানা সমস্যা এবং ত্বকের বিভিন্ন রোগের সূত্রপাত ঘটছে। তাদের মাসিকের সময়, মাতৃত্বকালে এবং প্রসবোত্তর সময়ে নানা সমস্যায় ভুগতে হয়। ফলে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে গর্ভপাত ও শিশুমৃত্যুর হার।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আশরাফি বিনতে আকরাম। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তাঁর ‘নারীর যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যে লবণাক্ততার প্রভাব: বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর একটি গবেষণা’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। তাতে উঠে এসেছে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে মেনোরেজিয়া বা অতি ঋতুস্রাব, লিউকেরিয়া বা সাদা স্রাব এবং যোনি ও জরায়ুতে চুলকানির মতো সমস্যায় ভুগছে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা। এর ফলে ঘটছে বিবাহবিচ্ছেদ ও বহুবিবাহের ঘটনা। এ অঞ্চলে গর্ভপাত অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে গর্ভপাতের জন্য অনেক কারণ উল্লেখযোগ্য। তবে গবেষকেরা দেশের অন্য সব এলাকার বাসিন্দাদের তুলনায় উপকূলীয় মানুষের মধ্যে এর সংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখতে পেয়েছেন। তাঁদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ।
লৈঙ্গিক সমতা অর্জনে নারীর যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার সুরক্ষায় বিনিয়োগও অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করা হয়। উপকূলীয় নারীদের নিয়ে কাজ করছে এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘প্রেরণা’। এর নির্বাহী পরিচালক শম্পা গোস্বামী জানিয়েছেন, বাজেটে উপকূলীয় নারীদের জন্য আলাদাভাবে কোনো বরাদ্দ থাকে না। মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে উপকূলীয় নারীদের মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মেনোপজ হওয়ার তথ্য পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। জরায়ু কেটে ফেলা, ক্যানসার, ঋতুচক্রের সমস্যার পাশাপাশি এই সমস্যা নারীদের জন্য ভয়ংকর বলে উল্লেখ করেন। জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত কাজের জন্য যে বরাদ্দ আসে, তার বেশির ভাগ ব্যয় হয় অবকাঠামো উন্নয়নে। অর্থাৎ এই বরাদ্দেও নারীদের স্বাস্থ্য গুরুত্ব পায় না।
নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি খুলনা ও সাতক্ষীরায় একটি প্রকল্প চালু করা হয়। উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর, বিশেষত নারীদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লবণাক্ততা মোকাবিলায় অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি শীর্ষক এ প্রকল্পটি খুলনা জেলার ৩টি ও সাতক্ষীরা জেলার ২টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটির মেয়াদকাল এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু প্রকল্পটির অর্জন সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের অকাল গর্ভপাত, প্রজননতন্ত্রের সমস্যা, ঋতুচক্রজনিত সমস্যাসহ জরায়ু কেটে ফেলার মতো সমস্যা দিন দিন ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এটি কেবল উপকূলের নারীর স্বাস্থ্যহানি ঘটাবে না; জাতীয় অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
যেসব সমস্যা বাড়ছে
� অকাল গর্ভপাত
� প্রজননতন্ত্রের সমস্যা
� ঋতুচক্রজনিত সমস্যা
� জরায়ু কেটে ফেলা
� ক্যানসার
� অকাল মেনোপজ
� অতি ঋতুস্রাব, সাদা স্রাব
� যোনি ও জরায়ুতে চুলকানি
তথ্যসূত্র: জলবায়ুর সংকটে বাংলাদেশের উপকূলীয় নারীরা হারাচ্ছেন তাঁদের জরায়ু, মিফতাহুল জান্নাত চৌধুরী, ব্র্যাক, ২৬ নভেম্বর, ২০২৩।
নারীর যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যে লবণাক্ততার প্রভাব: বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর একটি গবেষণা, আশরাফি বিনতে আকরাম, সহযোগী অধ্যাপক, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ৪ ডিসেম্বর ২০২৩।