প্রতিবছর ১৪ জুন ‘বিশ্ব রক্তদাতা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মূলত যাঁরা মানুষের জীবন বাঁচাতে স্বেচ্ছায় ও বিনা মূল্যে রক্তদান করেন, তাঁদের দানের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি দিতে, সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করার জন্য দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটি এ বছরও পালিত হচ্ছে যথাযোগ্য মর্যাদায়।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় রক্তদাতার সংখ্যা এখনো নিতান্তই কম।

দেশে বছরে ৮ থেকে ৯ লাখ ব্যাগ রক্তের চাহিদা থাকে। কিন্তু রক্ত সংগ্রহ হয় ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ ব্যাগ। এ ছাড়া সংগ্রহকৃত রক্তের মাত্র ৩০ শতাংশ আসে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের থেকে।

বর্তমানে স্বেচ্ছায় রক্তদানে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে নারীরাও অংশ নিচ্ছেন সমানতালে। তবে রক্ত যেমন একদিকে জীবন রক্ষা করে, অন্যদিকে সঠিকভাবে রক্তদাতা নির্বাচিত না করে রক্ত নিলে কিংবা সঠিক নিয়ম মেনে না চললে জীবন বিপন্নও হতে পারে।

নারীদের রক্তদানের উপকারিতা
রক্ত দেওয়া নিয়ে অনেক নারীর মনে ভীতি ও ভ্রান্ত ধারণা আছে। অনেকেই ভাবেন, রক্ত দিলে বোধ হয় শরীর খারাপ হয়। এটি ভ্রান্ত ধারণা। আসলে রক্ত দিলে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। শরীর শুকিয়ে যায় না বা শক্তিও নিঃশেষ হয়ে যায় না; বরং রক্তদানের বিভিন্ন উপকার আছে।

• রক্তদানের মাধ্যমে আপনি অন্যের জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে পারেন।
• গবেষণা বলছে, নিয়মিত রক্তদানের ফলে কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি কমে।
• বছরে তিনবার রক্ত দিলে অস্থিমজ্জার রক্তকণিকা উৎপাদনব্যবস্থা আরও সক্রিয় হয় এবং নতুন লোহিত রক্তকণিকা তৈরির হার বাড়ে।
• যাঁদের রক্তে আয়রন জমার প্রবণতা আছে, রক্তদান তাঁদের জন্য ভালো।
• রক্ত দিলে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে, কখনো রক্তচাপও নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে হৃদ্‌রোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
• দেহে হেপাটাইটিস বি, সি, এইচআইভি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়ার জীবাণু আছে কি না, রক্তদান উপলক্ষে বিনা খরচে অনেকেরই তা জানা হয়ে যায়।
• রক্ত দিলে যে ক্যালরি খরচ হয়, তা ওজন কমানোর ক্ষেত্রে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
• এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

রক্ত দেওয়ার জন্য কিছু শারীরিক যোগ্যতা মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়। কেননা, শারীরিক সক্ষমতা ছাড়া রক্তদান করলে রক্তদাতার নিজের প্রাণ সংকটের আশঙ্কা থেকে যায়।
 
যেসব নারী রক্ত দিতে পারবেন

• ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী যেকোনো শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ এবং সক্ষম নারী রক্ত দিতে পারবেন।
• যাঁদের ওজন ৫০ কেজি বা তার বেশি (কখনো সর্বনিম্ন ওজন ৪৫ কেজিও ধরা হয়)।
• কোনো নারী একবার রক্ত দেওয়ার চার মাস পর আবার রক্ত দিতে পারবেন। 

যেসব নারী রক্ত দেবেন না

• যাঁদের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম। রক্ত দেওয়ার জন্য হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ন্যূনতম ১১ গ্রাম বা ডেসিলিটার হতে হবে।
• যাঁদের রক্তচাপ ও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক নয়।
• যাঁদের শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ, যেমন হাঁপানি বা অ্যাজমা আছে।
• সন্তান জন্মদানের এক বছরের মধ্যে রক্ত দেওয়া যাবে না।
• রক্তবাহিত রোগ, যেমন হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’, জন্ডিস, এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি আছে যেসব নারীর। এ ছাড়া টাইফয়েড, ডায়াবেটিস, চর্মরোগ, বাতজ্বর, হৃদ্‌রোগ থাকলেও রক্ত দেওয়া উচিত নয়।
• যাঁরা অন্তঃসত্ত্বা এবং যাঁদের ঋতুস্রাব চলছে, তাঁরা রক্ত দেবেন না।
• কেমোথেরাপি ও হরমোন থেরাপি নিচ্ছেন, অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদি সেবন করছেন তাঁরা রক্ত দেবেন না।
•  যাঁদের বিগত ছয় মাসের মধ্যে বড় কোনো দুর্ঘটনা বা অস্ত্রোপচার হয়েছে, তাঁরা রক্ত দেবেন না।

আরও যা লক্ষ রাখতে হবে

• অতিরিক্ত ঋতুস্রাব যাঁদের হয়, তাঁরা বিশেষ সতর্ক থাকবেন এবং নিয়মিত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পরীক্ষা করবেন। হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক থাকলে তাঁরা 
  রক্ত দিতে পারবেন। তবে ঋতুচক্রের যেকোনো সমস্যায় স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
• রক্তদাতা নারীর নিয়মিত পর্যাপ্ত খাবার খেতে হবে এবং পানি পান করতে হবে। খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত ফল, সবজি ও প্রাণিজ আমিষ এবং আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাবেন। গরু, খাসি ও মুরগির মাংস, প্রাণীর অঙ্গ, যেমন গিলা, কলিজা, গোর্দা, কিডনি ইত্যাদি, পেয়ারা, আপেল, তরমুজ, খেজুর, বেদানা, কলা, আঙুর, কিশমিশ এবং বিভিন্ন শুকনা ফল, নানা রকম বাদাম, লালশাক, কচুশাক, মিষ্টিকুমড়া প্রভৃতি আয়রনের সমৃদ্ধ উৎস।

লেখক: রক্তরোগ ও রক্ত ক্যানসার বিশেষজ্ঞ, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল