সোনম সাহা
ভোরবেলা সারিতে দাঁড়িয়ে ভিড় ঠেলে লোকাল বাসে করে মেয়েটা কাজে যায়। দূরের পথ, অফিস শেষে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। তাই মেয়েটার কাঁধের ব্যাগে থাকে টিফিন বাটি, জলের ফ্লাস্ক, ভাঁজ করা ছাতা আর পিপার স্প্রের বোতল। প্রতিবেশীরা মেয়েটার মাকে ভয় দেখিয়ে বলেছিল, ফেরার পথে যদি কোনো বিপদ হয়, কে বাঁচাবে? ভয় পেয়ে মেয়েটা কিন্তু চাকরি ছাড়েনি; বরং নিজের চেষ্টায় যেমন শিখে নিয়েছে প্রতিরক্ষার কৌশল, তেমনি নিয়েছে পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব। ছেলেসন্তান নেই বলে ভীষণ আফসোস করা পরিবারে সেই মেয়েটাই আজ সবচেয়ে আস্থার জায়গা।
অথবা, সেই গিন্নিবান্নি মিসেস দত্ত/চৌধুরী/গোমেজ/বড়ুয়া, নাম যা-ই হোক না কেন, পড়ালেখার পাট চুকিয়ে তরুণী বয়সে সংসার করতে শুরু করেছিলেন যিনি। মেয়ে হয়ে জন্মেছিলেন বলে পরিবার যার কাছে কিছু আশা করেনি কখনো, সঠিক সময়ে পাত্রস্থ করে নিজেদের কাঁধের সামাজিক বোঝা নামিয়ে দায়িত্ব পালনের শ্লাঘায় ভুগেছে কেবল। আর নিজ কন্যাকে দিয়েছে অন্য পরিবারের ভালো বউ হওয়ার দায়। পেশার ঘরে তাকে লিখতে হয় ‘গৃহিণী’। সংসারে তার অবদানকে টাকার অঙ্কে দেখা হয় না কখনো, জিডিপিতে তার অবদান যোগ করা হয় না। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার অনুপস্থিতি তার অস্তিত্বকে প্রবলভাবে মনে করিয়ে দেয়।
বছর ঘুরে দুর্গোৎসব এসেছে। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় আবাহন করছে দেবী দুর্গাকে। চারদিকে উৎসবের আমেজ। এরই মধ্যে মহালয়ার ভোরে দেবী দুর্গার মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়ে গেছে। পুরাণের সেই গল্পগুলো চিরকালীন। অতএব ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সবারই কমবেশি জানা।
দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মহিষাসুর, যে অমরত্বের আশায় শিবের কাছে এই বর চেয়েছিল, যেন কোনো নর, অসুর বা দেবতার হাতে সে বধ না হয়। মহিষাসুরের কল্পনাতেও ছিল না কোনো নারী তথা দেবীর হাতে সে বধ হতে পারে। তাই বর চাইবার সময় নারীকে অনুল্লেখের তাচ্ছিল্য করেছিল আর যথাকালে সে পরাজিত হয়েছিল সকল দেবতার সামষ্টিক শক্তির আধার দেবী দুর্গার কাছে।
দুর্গার রুদ্রমূর্তির সঙ্গে আমাদের অমিল লাগে না ফরিদপুরের সেই কিশোরীদের মুখ, যারা অপহরণকারীদের হাত থেকে তাদের সহপাঠীকে উদ্ধারই শুধু করেনি, অপহরণকারীদের আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে।
দুর্গা মাহাত্ম্যের এই কাহিনি পড়লে মনে হয়, এই দুর্গা আর এই মহিষাসুর—দুই-ই আমাদের চেনা। আমাদের এই প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ঠিক যেন মহিষাসুরের মতো করেই চিন্তা করে। এই সমাজের ভাবনায় নারীর সক্ষমতা স্থান পায় না, নারীর সাধ্য ও সম্ভাবনা থাকে তার কল্পনার বাইরে। আর এই সমাজের নারীরা ঠিক দেবী দুর্গার মতো করেই সেই ভ্রান্তিকে দূর করে প্রতিদিন নানান বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে, প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে পরাজিত করে সমাজের সংকীর্ণ চিন্তাকে, বদলে দেয় সমাজের লিখে দেওয়া উপসংহার।
দেবী দুর্গার প্রতিমায় দশখানা হাতের কল্পনা তাই আমাদের আশ্চর্য করে না। আমরা তো দেখি, আমাদের মেয়েদের, মায়েদের; যারা সংসারের দশ রকম দায়িত্ব একই সঙ্গে সামলে নেন নির্ভুল—বছরের পর বছর। দুর্গার রুদ্রমূর্তির সঙ্গে আমাদের অমিল লাগে না ফরিদপুরের সেই কিশোরীদের মুখ, যারা অপহরণকারীদের হাত থেকে তাদের সহপাঠীকে উদ্ধারই শুধু করেনি, অপহরণকারীদের আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে। আমাদের মেয়েরা কঠিন মাটিতে কোমল প্রাণ সঞ্চার করা শৈল পুত্রীসম।
ওল্ড টেস্টামেন্টে আছে, ‘আমার আদলে আমি (বা আমরা) মানুষকে সৃষ্টি করব। মানুষ হবে ঠিক আমার মতো।...এরপর ঈশ্বর নিজের মতোই মানুষ সৃষ্টি করলেন। মানুষ হলো তার ছাঁচে গড়া জীব। ঈশ্বর তাদের পুরুষ ও নারীরূপে সৃষ্টি করলেন।’ (অধ্যায় ১, ২৬-২৭) সে রকম দুর্গাকেও পুরাণে স্তব করা হয়েছে শক্তি, বুদ্ধি, মেধা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দীপ্তি, ধৃতি, স্থিতি, ধী, দয়া, ক্ষমা, মায়া, তৃপ্তি, তুষ্টি, পুষ্টি ও শান্তি রূপে। আর বলা হয়েছে, সব সৃষ্টির মাঝে দুর্গার যেসব গুণ বিরাজমান, সেই সব গুণের আরাধনা আর প্রণতিই দুর্গার আরাধনা। তাই পুলিশ কিংবা আর্মির ইউনিফর্ম গায়ে যে মেয়েটি শান্তি রক্ষা করে, যে মেয়েটি বিমান ওড়ায়, সেবা দেয়, চিকিৎসা দেয়, যে মেয়েটি শিক্ষার আলো ছড়ায় অথবা শ্রম দিয়ে পরিবার তথা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে, সোনার মেডেল জিতে দেশের মান রাখে, মেধা ও জ্ঞান দিয়ে নোবেল জিতে দেশের নাম উজ্জ্বল করে, যে মেয়েটা দেশ চালায় কিংবা সংসার; তারা প্রত্যেকে দেবী দুর্গারই গুণ ধারণ করে আছে, তারা প্রত্যেকে দুর্গার মতো শক্তিময়ী। এই নারীশক্তির স্বীকৃতি ও সম্মানই প্রকৃত অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় তাকে শক্তিরূপে সংস্থিত করবে জগতে। এই উৎসবের প্রকৃত মাহাত্ম্য এখানেই।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ভোরবেলা সারিতে দাঁড়িয়ে ভিড় ঠেলে লোকাল বাসে করে মেয়েটা কাজে যায়। দূরের পথ, অফিস শেষে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। তাই মেয়েটার কাঁধের ব্যাগে থাকে টিফিন বাটি, জলের ফ্লাস্ক, ভাঁজ করা ছাতা আর পিপার স্প্রের বোতল। প্রতিবেশীরা মেয়েটার মাকে ভয় দেখিয়ে বলেছিল, ফেরার পথে যদি কোনো বিপদ হয়, কে বাঁচাবে? ভয় পেয়ে মেয়েটা কিন্তু চাকরি ছাড়েনি; বরং নিজের চেষ্টায় যেমন শিখে নিয়েছে প্রতিরক্ষার কৌশল, তেমনি নিয়েছে পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব। ছেলেসন্তান নেই বলে ভীষণ আফসোস করা পরিবারে সেই মেয়েটাই আজ সবচেয়ে আস্থার জায়গা।
অথবা, সেই গিন্নিবান্নি মিসেস দত্ত/চৌধুরী/গোমেজ/বড়ুয়া, নাম যা-ই হোক না কেন, পড়ালেখার পাট চুকিয়ে তরুণী বয়সে সংসার করতে শুরু করেছিলেন যিনি। মেয়ে হয়ে জন্মেছিলেন বলে পরিবার যার কাছে কিছু আশা করেনি কখনো, সঠিক সময়ে পাত্রস্থ করে নিজেদের কাঁধের সামাজিক বোঝা নামিয়ে দায়িত্ব পালনের শ্লাঘায় ভুগেছে কেবল। আর নিজ কন্যাকে দিয়েছে অন্য পরিবারের ভালো বউ হওয়ার দায়। পেশার ঘরে তাকে লিখতে হয় ‘গৃহিণী’। সংসারে তার অবদানকে টাকার অঙ্কে দেখা হয় না কখনো, জিডিপিতে তার অবদান যোগ করা হয় না। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার অনুপস্থিতি তার অস্তিত্বকে প্রবলভাবে মনে করিয়ে দেয়।
বছর ঘুরে দুর্গোৎসব এসেছে। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় আবাহন করছে দেবী দুর্গাকে। চারদিকে উৎসবের আমেজ। এরই মধ্যে মহালয়ার ভোরে দেবী দুর্গার মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়ে গেছে। পুরাণের সেই গল্পগুলো চিরকালীন। অতএব ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সবারই কমবেশি জানা।
দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মহিষাসুর, যে অমরত্বের আশায় শিবের কাছে এই বর চেয়েছিল, যেন কোনো নর, অসুর বা দেবতার হাতে সে বধ না হয়। মহিষাসুরের কল্পনাতেও ছিল না কোনো নারী তথা দেবীর হাতে সে বধ হতে পারে। তাই বর চাইবার সময় নারীকে অনুল্লেখের তাচ্ছিল্য করেছিল আর যথাকালে সে পরাজিত হয়েছিল সকল দেবতার সামষ্টিক শক্তির আধার দেবী দুর্গার কাছে।
দুর্গার রুদ্রমূর্তির সঙ্গে আমাদের অমিল লাগে না ফরিদপুরের সেই কিশোরীদের মুখ, যারা অপহরণকারীদের হাত থেকে তাদের সহপাঠীকে উদ্ধারই শুধু করেনি, অপহরণকারীদের আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে।
দুর্গা মাহাত্ম্যের এই কাহিনি পড়লে মনে হয়, এই দুর্গা আর এই মহিষাসুর—দুই-ই আমাদের চেনা। আমাদের এই প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ঠিক যেন মহিষাসুরের মতো করেই চিন্তা করে। এই সমাজের ভাবনায় নারীর সক্ষমতা স্থান পায় না, নারীর সাধ্য ও সম্ভাবনা থাকে তার কল্পনার বাইরে। আর এই সমাজের নারীরা ঠিক দেবী দুর্গার মতো করেই সেই ভ্রান্তিকে দূর করে প্রতিদিন নানান বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে, প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে পরাজিত করে সমাজের সংকীর্ণ চিন্তাকে, বদলে দেয় সমাজের লিখে দেওয়া উপসংহার।
দেবী দুর্গার প্রতিমায় দশখানা হাতের কল্পনা তাই আমাদের আশ্চর্য করে না। আমরা তো দেখি, আমাদের মেয়েদের, মায়েদের; যারা সংসারের দশ রকম দায়িত্ব একই সঙ্গে সামলে নেন নির্ভুল—বছরের পর বছর। দুর্গার রুদ্রমূর্তির সঙ্গে আমাদের অমিল লাগে না ফরিদপুরের সেই কিশোরীদের মুখ, যারা অপহরণকারীদের হাত থেকে তাদের সহপাঠীকে উদ্ধারই শুধু করেনি, অপহরণকারীদের আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে। আমাদের মেয়েরা কঠিন মাটিতে কোমল প্রাণ সঞ্চার করা শৈল পুত্রীসম।
ওল্ড টেস্টামেন্টে আছে, ‘আমার আদলে আমি (বা আমরা) মানুষকে সৃষ্টি করব। মানুষ হবে ঠিক আমার মতো।...এরপর ঈশ্বর নিজের মতোই মানুষ সৃষ্টি করলেন। মানুষ হলো তার ছাঁচে গড়া জীব। ঈশ্বর তাদের পুরুষ ও নারীরূপে সৃষ্টি করলেন।’ (অধ্যায় ১, ২৬-২৭) সে রকম দুর্গাকেও পুরাণে স্তব করা হয়েছে শক্তি, বুদ্ধি, মেধা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দীপ্তি, ধৃতি, স্থিতি, ধী, দয়া, ক্ষমা, মায়া, তৃপ্তি, তুষ্টি, পুষ্টি ও শান্তি রূপে। আর বলা হয়েছে, সব সৃষ্টির মাঝে দুর্গার যেসব গুণ বিরাজমান, সেই সব গুণের আরাধনা আর প্রণতিই দুর্গার আরাধনা। তাই পুলিশ কিংবা আর্মির ইউনিফর্ম গায়ে যে মেয়েটি শান্তি রক্ষা করে, যে মেয়েটি বিমান ওড়ায়, সেবা দেয়, চিকিৎসা দেয়, যে মেয়েটি শিক্ষার আলো ছড়ায় অথবা শ্রম দিয়ে পরিবার তথা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে, সোনার মেডেল জিতে দেশের মান রাখে, মেধা ও জ্ঞান দিয়ে নোবেল জিতে দেশের নাম উজ্জ্বল করে, যে মেয়েটা দেশ চালায় কিংবা সংসার; তারা প্রত্যেকে দেবী দুর্গারই গুণ ধারণ করে আছে, তারা প্রত্যেকে দুর্গার মতো শক্তিময়ী। এই নারীশক্তির স্বীকৃতি ও সম্মানই প্রকৃত অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় তাকে শক্তিরূপে সংস্থিত করবে জগতে। এই উৎসবের প্রকৃত মাহাত্ম্য এখানেই।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রবাদ আছে, দুঃসাহসে দুঃখ হয়। কিন্তু বাগেরহাটের প্রজাপতি স্কোয়াড দুঃসাহসে ভর করে আলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমাদের সমাজ বাস্তবতায় বাল্যবিবাহ রুখে দেওয়া এখনো যে কতটা কঠিন কাজ, তা কারও অজানা নয়। সেই কঠিন কাজই করে চলেছে বাগেরহাটের কিশোরীরা। প্রজাপতি স্কোয়াড নামে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পেয়েছে তার
৩ দিন আগেগাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে নিহত হয়েছে ৩৪ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষ। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন বা ওএইচসিএইচআর এ তথ্য জানিয়েছে। তাদের
৩ দিন আগেআপনি শিক্ষিত ও সচেতন একজন মানুষ। সম্পর্কের একটি সুন্দর পর্যায়ে আছেন। তবে আপনার সঙ্গীর যে সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন, তা কিন্তু বড় ধরনের আবেগীয়
৩ দিন আগেশওকত আরা খন্দকার ওরফে ঝর্ণা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ঘর-সংসার সামলে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে।
৩ দিন আগে