বিজ্ঞাপনে বিপুল অর্থ ব্যয় করা আ.লীগ সংশ্লিষ্ট অন্তত ১০টি ফেসবুক পেজ গায়েব

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ২৭
আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ৪৬

ফেসবুক থেকে ‘উধাও’ হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামধারী বেশ কয়েকটি পেজ। ফেসবুকের মালিক প্রতিষ্ঠান মেটার অ্যাড লাইব্রেরির আগস্টের প্রতিবেদন থেকে অন্তত এমন ১০টি পেজ খুঁজে পেয়েছে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ। পেজগুলো বর্তমানে ‘আনপাবলিশড’ অবস্থায় আছে বা ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে। মেটার অ্যাড লাইব্রেরির আগস্টের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত ৩০০টি পেজ পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এসব পেজের মধ্যে মোট আনপাবলিশড বা ডিলিট করে দেওয়া পেজের সংখ্যা ৫৮ টি। 

আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের পেজগুলোর মালিকানায় ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য, সংসদ সদস্যের ছেলে এবং আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। কিছু পেজ থেকে গুজব, প্রোপাগান্ডা ছড়াত। এসব পেজের বিজ্ঞাপন বাবদ গত আগস্টেই সর্বোচ্চ ২২ হাজার থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন ১২ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে (বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান ডলার বিনিময় হার অনুযায়ী)। 

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। যদিও এ অভ্যুত্থানের সূচনা জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে। রাজপথের এ আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। পক্ষে–বিপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সক্রিয় ছিল উভয়পক্ষই। আগস্টের শুরু থেকে এ সক্রিয়তা আরও ব্যাপক হয়। এ ব্যাপকতার প্রমাণ পাওয়া যায় মেটার অ্যাড লাইব্রেরির আগস্টের প্রতিবেদন থেকে। 

এ মাসে ফেসবুক বিজ্ঞাপনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে ‘ক্যাপ–ক্যাম্পেইন অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রাম (Cap–Campaign Advocacy Program)’ নামের একটি পেজ। পেজটির ইউটিউব চ্যানেল থেকে জানা যায়, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যে ক্যাম্পেইন অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রামের যাত্রা। চ্যানেলটিতে দেওয়া ছবির সঙ্গে আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকার মিল রয়েছে। ক্যাম্পেইন অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রাম গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ প্রজন্মকে ভোট দিতে আগ্রহী করতে পপ গায়িকা মিলার ‘গো ভোট’ গান নিজেদের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করে। 

আগস্টে ফেসবুক বিজ্ঞাপনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে ক্যাপ–ক্যাম্পেইন অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রাম নামের পেজটি। ছবি: মেটা অ্যাড লাইব্রেরি পেজটি আগস্টের ১ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের পেছনে সর্বোচ্চ ব্যয় করেছে। এ ব্যয়ের পরিমাণ ১ হাজার ৮৩৯ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যা ২ লাখ ২০ হাজার ৬৮০ টাকা। কোটা আন্দোলন চলাকালে পেজটি থেকে ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের স্বাক্ষর সংবলিত একটি বিজ্ঞপ্তির ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখে, ‘সার্বিক স্বার্থে ৭ দিনের জন্য সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। বিজ্ঞপ্তিটি ভুয়া শনাক্ত করে সেদিনই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ। 

আগস্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় করেছে ‘Once Again Sheikh Hasina’ নামের একটি পেজ। পেজটি ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের পেছনে ব্যয় করেছে ১ হাজার ৫৭২ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬৪০ টাকা।

তৃতীয় সর্বোচ্চ, ১ হাজার ৭৫ ডলার বা ১ লাখ ২৯ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পেজ থেকে। 

‘আনপাবলিশড’ বা ডিলিট করা পেজগুলোর একটি চালাতেন সাবেক ডাক এবং টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তাঁর পেজ থেকে আগস্টে বিজ্ঞাপনের পেছনে ব্যয় করা হয়েছে ২১৩ ডলার বা ২৫ হাজার ৫৬০ টাকা। 

শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর গত ১৪ আগস্ট রাজধানীর নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন পলক। এর আগে ৬ আগস্ট তাঁকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পুরোটা সময় ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন জুনাইদ আহমেদ পলক। এমনকি আন্দোলন চলাকালে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ থাকাকালীনও ফেসবুকে তাঁকে সক্রিয় দেখা গেছে। এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছিলেন, গুজব প্রতিরোধে মানুষকে সঠিক তথ্য জানাতে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থাকছেন। 

ওই সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষের প্রতি ক্ষোভ জানিয়ে পলক বলেন, ফেসবুক সরকারের কথা শুনছে না। ফেসবুক, ইউটিউব তারা বাংলাদেশের আইন কোনোভাবেই মানছে না, দেশের ধর্মীয় মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা কোনো কিছুকেই তারা সম্মান দেখাচ্ছে না। তারা তাদের নিজেদের পলিসি গাইডলাইন, প্রাইভেসি সেটিংস নিজেরাই ভঙ্গ করছে।

অ্যাড লাইব্রেরি থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, জুনাইদ আহমেদ পলকের পেজটি থেকে ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে গত ৩০ আগস্ট পর্যন্ত বিজ্ঞাপনের পেছনে ২৭ হাজার ৭৭ ডলার (৩২ লাখ ৪৯ হাজার ২৪০ টাকা) ব্যয় করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তির নামে পরিচালিত বিভিন্ন পেজ থেকে আগস্টে বিজ্ঞাপনের পেছনে ১০০ ডলার বা এর চেয়ে কম ব্যয় করা হয়েছে। ১০০ ডলার বা তার কম ব্যয় করা এ ধরনের ৫টি পেজ ‘আনপাবলিশড’ বা ডিলিট করা হয়েছে।

এসব পেজের মধ্যে আছে— একাদশ জাতীয় সংসদে মাগুরা–১ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর, নারায়ণগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের নামে খোলা পেজ, বরিশালের সাবেক মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহর নামে খোলা পেজ, শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ–সভাপতি আলহাজ্ব মোবারক আলী সিকদারের নামে খোলা পেজ এবং কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শরীফ উদ্দিন রিমনের নামে খোলা পেজ।

এর মধ্যে সাবেক মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহর নামে খোলা পেজটি থেকে ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে গত ৩০ আগস্ট পর্যন্ত বিজ্ঞাপনের পেছনে ৩ হাজার ৭২৬ ডলার (৪ লাখ ৪৭ হাজার ১২০ টাকা) ব্যয় করা হয়েছে। একই সময়ে শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ–সভাপতি আলহাজ্ব মোবারক আলী সিকদারের নামে খোলা পেজ থেকে বিজ্ঞাপনের পেছনে ১ হাজার ৭১২ ডলার (২ লাখ ৫ হাজার ৪৪০ টাকা) ব্যয় করা হয়েছে। একই সময়ে সাইফুজ্জামান শিখরের নামে খোলা পেজ থেকে ব্যয় করা হয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৯২০ টাকা। 

জুনাইদ আহমেদ পলকের পেজ থেকে ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে গত ৩০ আগস্ট পর্যন্ত বিজ্ঞাপনের পেছনে ৩২ লাখ ৪৯ হাজার ২৪০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ছবি: মেটা অ্যাড লাইব্রেরিএ ছাড়া আওয়ামী লীগ মিডিয়া সেল, ‘ডিএএও–ডিফেন্ডিং অ্যাগেইনস্ট অল অডস (DAAO–Defending Against All Odds)’ নামের দুটি পেজও ‘আনপাবলিশড’ বা ডিলিট করা হয়েছে। ‘ডিএএও–ডিফেন্ডিং অ্যাগেইনস্ট অল অডস’ নামের পেজটির ইউটিউব ও এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসব অ্যাকাউন্টে আওয়ামী লীগের সমর্থনে বিভিন্ন সময় পোস্ট দেওয়া হয়েছে। এই পেজ দুটিতেও আগস্টে ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের পেছনে ১০০ ডলার বা এর চেয়ে কম ব্যয় করা হয়েছে। 

আগস্টে ‘আনপাবলিশড’ বা ডিলিট করে দেওয়া অন্যান্য পেজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পেজের নাম হচ্ছে— ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’, ‘Smart Bangladesh’, ‘পথ হারাবে না বাংলাদেশ’, ‘সেই রাজাকার এই রাজাকার’, ‘আমার দেশ আমার অহংকার’, ‘প্রথম বাংলাদেশ’, ‘Aamrai Bangladesh–আমরাই বাংলাদেশ’, ‘Positive Bangladesh’, ‘মিস্টার ১০ পারসেন্ট–Mr.10 Percent’, ‘আবার দশ ট্রাক–Abar 10 Truck’, ‘আহ্বান–Ahoban’, ‘ইসলামের আলো–Light of Islam’ ইত্যাদি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত