রজত কান্তি রায়
উত্তর–দক্ষিণে দেখলে এই রাস্তাটা ক্রুশের মতো। ক্রুশের মাথার দিকে এক ও দুই নম্বর সড়কের মাঝামাঝিতে একটি চিকেন ফ্রাইয়ের দোকান। শুক্রবারের অলস সন্ধ্যা। আকাশে মেঘ। সুস্বাদু চিকেন ফ্রাই খেয়ে বেরোতে গিয়ে আটকে গেলাম ঝুম বৃষ্টিতে। সঙ্গে আড়াই বছরের ছেলে। হাতে চিকেন ফ্রাইয়ের ঠোঙা। বৃষ্টিতে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বাপ–ছেলে গল্প করতে করতে উদাস হয়ে যাই। সন্ধ্যার বড় বড় ফোঁটায় পড়া বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ আমাদের নাকে ঢোকে, মুরগি ভাজার গন্ধকে টেক্কা দিয়ে। আমরা সন্ধ্যার রাস্তা দেখি। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য চেষ্টারত মানুষ দেখি। নিয়ন আলো লেপটে থাকা লাইটপোস্ট দেখি। আমরা আরও উদাস হয়ে যেতে যেতে সংবিৎ ফিরে পাই।
কেউ একজন আমাকে ডাকে, স্যার, একটা চা খাইবেন? বাসায় বাজার নাই।
বর্ষার ঘনায়মান সন্ধ্যার অন্ধকার ঠেলে গোলাপি ছাতার প্রেক্ষাপটে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি শিশু মুখ। আমি আমার আড়াই বছরের ছেলের হাত খুঁজে শক্ত করে ধরে ফেলি। শিশুটির ডান হাতের কনুইতে ঝোলানো একটি নীল প্লাস্টিকের বালতি। হাতে ধরা গোলাপি ছাতা। বালতিতে ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের কাপ। বাম হাতে চায়ের ফ্লাস্ক। সম্ভবত সেটির ওজন তার চেয়ে বেশি। সামনে দাঁড়ানো শিশুটি বলে, ‘স্যার, একটা চা খান। বাসায় বাজার নাই।’
তীব্র হর্ন বাজিয়ে যেতে যেতে ধাবমান বাইক কাদাজল ছিটিয়ে যায়। শিশুটির গোলাপি ছাতা আমাদের রক্ষা করে কাদাজল থেকে। জানতে চাই, নাম কী?
–স্যার, সবুজ।
–বাসা কই?
–রূপনগর।
–রূপনগর! এত দূর এলে কীভাবে?
–বাসে স্যার। একটা চা খান।
প্রবল আকুতি নিয়ে সবুজ তাকায় আমার চোখের দিকে। আমি চোখ সরিয়ে নিই। সেকেন্ডকে ভাঙতে ভাঙতে সিদ্ধান্ত নিতে থাকি চা খাব কি না। ক’টাকা একটা চায়ের দাম? পাঁচ বা দশ টাকা? সবুজ আবার বলে, ‘স্যার, বাসায় আম্মা আছে। ভাইরে সামলায়।’
বলি, ‘বাবা?’
–মারা গেছে ছোটবেলায়।
–মা কী করে?
–মাইনসের বাড়িত কাম করে। কাপড় ধোয়, ঘর মোছে। বড় ভাইয়ের সাথে স্যার মাঝে মাঝে চা বেচি।
পরিচয় গাঢ় হয় আমাদের। সবুজেরা তিন ভাই। সবুজ মেজ। বড় ভাইয়ের নাম শরিফ। ছোটটির নাম শাহিন। শাহিন একেবারে ছোট। তার মা তাকে দেখে রাখে। শরিফের বয়স ১৩/১৪ বছর। সবুজের বয়স সাকল্যে ১০ হবে কি না সন্দেহ। রূপনগরের একটি অনানুষ্ঠানিক প্রাইমারি স্কুলে সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। শরিফ পড়ে না। রূপনগরের কোনো এক ২৯ নম্বর সড়কের ১১ নম্বর বাসাটা তাদের, দোতলায়। সবুজ জানতে চায়, এই জাদুর শহরে আমার নিজের বাড়ি আছে কি না। জানাই, ভাড়া বাসায় থাকি। ভাড়া কত, সে জানতে চায়। বলি। সে নিশ্চুপ থাকে।
চিকেন ফ্রাইয়ের দোকানের সামনে বলে একটি চিকেন বল স্টিকের অর্ডার করি। একটি স্টিকে চারটি বল থাকে। সবুজকে দিতেই সে একটি খেয়ে বাকি তিনটি বলসহ প্যাকেটটি ডান হাতে থাকা ছোট নীল প্লাস্টিকের বালতিতে রেখে দেয়। আমার ছেলে তাকিয়ে থাকে সবুজের দিকে। সবুজ তার গাল টিপে দেয়। আমি অনুমতি নিই ছবি তোলার। সবুজ হেসে পোজ দেয়। সঙ্গে কঠোর সাবধানবাণী, ফেসবুকে দিবেন না স্যার। মা দ্যাখব।
তাকে অভয় দিই। পরিচয় দিয়ে বলি, কোনো সমস্যা আছে? সবুজ নিরুত্তর থাকে। আমি আবার ছবি তুলি। সে হেসে পোজ দেয়। বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা গাঢ় হতে থাকে। বৃষ্টির ফোঁটার আকার বড় হতে থাকে। আমার অস্বস্তি বাড়তে থাকে। ক’টাকা দেব তাকে? দশ, বিশ, এক শ? সবুজ বলে চলে তার ভাইদের কথা। তার মায়ের কথা। কিন্তু বাসায় বাজার না থাকার কথা আর বলে না। আমার ছেলের সঙ্গে খেলতে চায় সে। খেলতে খেলতে আবার সাবধান করে দেয়, ফেসবুকে যেন তার ছবি না দিই। তার বড় ভয়, মা যদি দেখে ফেলে। বলি, দেব না। বিশ টাকা বের করে দিই তাকে। কোনো কথা না বলে সে পকেটে রাখে টাকা। তারপর মিলিয়ে যায় আষাঢ়ী সন্ধ্যার আবছা আঁধারে।
বৃষ্টি ধরে এসেছে। সবুজ মিলিয়ে গেছে পাশের গলিতে। যাওয়ার আগে সে পাশের দোকানটিতে এক কাপ চা বিক্রির চেষ্টা করেছিল। একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ি। সুদূরের কোনো কালো মেঘ থেকে ধেয়ে আসা জল আমার চোখ ভিজিয়ে দেয়। আমি আমার ছেলের হাত ধরে থাকি শক্ত করে। এই সান্ধ্য বৃষ্টিতে জেগে ওঠেন গালিব। বলেন—
সিনে কা দাগ হ্যায় ও নালা কি লব তক না গ্যায়া
খাক কা রিযক হ্যায় ও কাতরা কি দরিয়া না হুয়া
যে আর্তনাদ ঠোঁটে এল না সে বুকে দাগ কেটে বসে
যে জলবিন্দু নদীতে পৌঁছাল না মাটি শুষে নেয় তাকে
(অনুবাদ: জাভেদ হুসেন)
আমি দুঃখিত সবুজ। যে পথে তোমার জীবনের গল্প তৈরি হয়, আমি সেই পথের গল্প শিকারি। তোমার বেঁচে থাকার আর্তনাদ আমার বুকে দাগ কেটে বসে ঠিকই। কিন্তু শিকারিদের শিকারও তো করতে হয়।
উত্তর–দক্ষিণে দেখলে এই রাস্তাটা ক্রুশের মতো। ক্রুশের মাথার দিকে এক ও দুই নম্বর সড়কের মাঝামাঝিতে একটি চিকেন ফ্রাইয়ের দোকান। শুক্রবারের অলস সন্ধ্যা। আকাশে মেঘ। সুস্বাদু চিকেন ফ্রাই খেয়ে বেরোতে গিয়ে আটকে গেলাম ঝুম বৃষ্টিতে। সঙ্গে আড়াই বছরের ছেলে। হাতে চিকেন ফ্রাইয়ের ঠোঙা। বৃষ্টিতে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বাপ–ছেলে গল্প করতে করতে উদাস হয়ে যাই। সন্ধ্যার বড় বড় ফোঁটায় পড়া বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ আমাদের নাকে ঢোকে, মুরগি ভাজার গন্ধকে টেক্কা দিয়ে। আমরা সন্ধ্যার রাস্তা দেখি। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য চেষ্টারত মানুষ দেখি। নিয়ন আলো লেপটে থাকা লাইটপোস্ট দেখি। আমরা আরও উদাস হয়ে যেতে যেতে সংবিৎ ফিরে পাই।
কেউ একজন আমাকে ডাকে, স্যার, একটা চা খাইবেন? বাসায় বাজার নাই।
বর্ষার ঘনায়মান সন্ধ্যার অন্ধকার ঠেলে গোলাপি ছাতার প্রেক্ষাপটে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি শিশু মুখ। আমি আমার আড়াই বছরের ছেলের হাত খুঁজে শক্ত করে ধরে ফেলি। শিশুটির ডান হাতের কনুইতে ঝোলানো একটি নীল প্লাস্টিকের বালতি। হাতে ধরা গোলাপি ছাতা। বালতিতে ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের কাপ। বাম হাতে চায়ের ফ্লাস্ক। সম্ভবত সেটির ওজন তার চেয়ে বেশি। সামনে দাঁড়ানো শিশুটি বলে, ‘স্যার, একটা চা খান। বাসায় বাজার নাই।’
তীব্র হর্ন বাজিয়ে যেতে যেতে ধাবমান বাইক কাদাজল ছিটিয়ে যায়। শিশুটির গোলাপি ছাতা আমাদের রক্ষা করে কাদাজল থেকে। জানতে চাই, নাম কী?
–স্যার, সবুজ।
–বাসা কই?
–রূপনগর।
–রূপনগর! এত দূর এলে কীভাবে?
–বাসে স্যার। একটা চা খান।
প্রবল আকুতি নিয়ে সবুজ তাকায় আমার চোখের দিকে। আমি চোখ সরিয়ে নিই। সেকেন্ডকে ভাঙতে ভাঙতে সিদ্ধান্ত নিতে থাকি চা খাব কি না। ক’টাকা একটা চায়ের দাম? পাঁচ বা দশ টাকা? সবুজ আবার বলে, ‘স্যার, বাসায় আম্মা আছে। ভাইরে সামলায়।’
বলি, ‘বাবা?’
–মারা গেছে ছোটবেলায়।
–মা কী করে?
–মাইনসের বাড়িত কাম করে। কাপড় ধোয়, ঘর মোছে। বড় ভাইয়ের সাথে স্যার মাঝে মাঝে চা বেচি।
পরিচয় গাঢ় হয় আমাদের। সবুজেরা তিন ভাই। সবুজ মেজ। বড় ভাইয়ের নাম শরিফ। ছোটটির নাম শাহিন। শাহিন একেবারে ছোট। তার মা তাকে দেখে রাখে। শরিফের বয়স ১৩/১৪ বছর। সবুজের বয়স সাকল্যে ১০ হবে কি না সন্দেহ। রূপনগরের একটি অনানুষ্ঠানিক প্রাইমারি স্কুলে সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। শরিফ পড়ে না। রূপনগরের কোনো এক ২৯ নম্বর সড়কের ১১ নম্বর বাসাটা তাদের, দোতলায়। সবুজ জানতে চায়, এই জাদুর শহরে আমার নিজের বাড়ি আছে কি না। জানাই, ভাড়া বাসায় থাকি। ভাড়া কত, সে জানতে চায়। বলি। সে নিশ্চুপ থাকে।
চিকেন ফ্রাইয়ের দোকানের সামনে বলে একটি চিকেন বল স্টিকের অর্ডার করি। একটি স্টিকে চারটি বল থাকে। সবুজকে দিতেই সে একটি খেয়ে বাকি তিনটি বলসহ প্যাকেটটি ডান হাতে থাকা ছোট নীল প্লাস্টিকের বালতিতে রেখে দেয়। আমার ছেলে তাকিয়ে থাকে সবুজের দিকে। সবুজ তার গাল টিপে দেয়। আমি অনুমতি নিই ছবি তোলার। সবুজ হেসে পোজ দেয়। সঙ্গে কঠোর সাবধানবাণী, ফেসবুকে দিবেন না স্যার। মা দ্যাখব।
তাকে অভয় দিই। পরিচয় দিয়ে বলি, কোনো সমস্যা আছে? সবুজ নিরুত্তর থাকে। আমি আবার ছবি তুলি। সে হেসে পোজ দেয়। বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা গাঢ় হতে থাকে। বৃষ্টির ফোঁটার আকার বড় হতে থাকে। আমার অস্বস্তি বাড়তে থাকে। ক’টাকা দেব তাকে? দশ, বিশ, এক শ? সবুজ বলে চলে তার ভাইদের কথা। তার মায়ের কথা। কিন্তু বাসায় বাজার না থাকার কথা আর বলে না। আমার ছেলের সঙ্গে খেলতে চায় সে। খেলতে খেলতে আবার সাবধান করে দেয়, ফেসবুকে যেন তার ছবি না দিই। তার বড় ভয়, মা যদি দেখে ফেলে। বলি, দেব না। বিশ টাকা বের করে দিই তাকে। কোনো কথা না বলে সে পকেটে রাখে টাকা। তারপর মিলিয়ে যায় আষাঢ়ী সন্ধ্যার আবছা আঁধারে।
বৃষ্টি ধরে এসেছে। সবুজ মিলিয়ে গেছে পাশের গলিতে। যাওয়ার আগে সে পাশের দোকানটিতে এক কাপ চা বিক্রির চেষ্টা করেছিল। একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ি। সুদূরের কোনো কালো মেঘ থেকে ধেয়ে আসা জল আমার চোখ ভিজিয়ে দেয়। আমি আমার ছেলের হাত ধরে থাকি শক্ত করে। এই সান্ধ্য বৃষ্টিতে জেগে ওঠেন গালিব। বলেন—
সিনে কা দাগ হ্যায় ও নালা কি লব তক না গ্যায়া
খাক কা রিযক হ্যায় ও কাতরা কি দরিয়া না হুয়া
যে আর্তনাদ ঠোঁটে এল না সে বুকে দাগ কেটে বসে
যে জলবিন্দু নদীতে পৌঁছাল না মাটি শুষে নেয় তাকে
(অনুবাদ: জাভেদ হুসেন)
আমি দুঃখিত সবুজ। যে পথে তোমার জীবনের গল্প তৈরি হয়, আমি সেই পথের গল্প শিকারি। তোমার বেঁচে থাকার আর্তনাদ আমার বুকে দাগ কেটে বসে ঠিকই। কিন্তু শিকারিদের শিকারও তো করতে হয়।
ভোরের আলো ফোটার আগেই রাজধানীর আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন শ্রমজীবীদের হাটে জড়ো হন শত শত শ্রমজীবী মানুষ। বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ও নারী শ্রমিকেরা এই হাটে প্রতিদিন ভিড় করেন একটু কাজ পাওয়ার আশায়। তবে দিন যত যাচ্ছে, তাঁদের জীবনের লড়াই ততই কঠিন হয়ে উঠছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি তাঁদের জীবনকে দুর্বিষ
২০ দিন আগেফেলুদার দার্জিলিং জমজমাট বইয়ে প্রথম পরিচয় দার্জিলিংয়ের সঙ্গে। তারপর অঞ্জন দত্তের গানসহ আরও নানাভাবে হিল স্টেশনটির প্রতি এক ভালোবাসা তৈরি হয়। তাই প্রথমবার ভারত সফরে ওটি, শিমলা, মসুরির মতো লোভনীয় হিল স্টেশনগুলোকে বাদ দিয়ে দার্জিলিংকেই বেছে নেই। অবশ্য আজকের গল্প পুরো দার্জিলিং ভ্রমণের নয়, বরং তখন পরিচয়
২৩ দিন আগেকথায় আছে না—‘ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরেমেঘ দেখলেই ডরায়’! আমার হইছে এই অবস্থা। বাড়িতে এখন বাড়িআলী, বয়স্ক বাপ-মা আর ছোট মেয়ে। সকাল থেকে চার-পাঁচবার কতা বলিচি। সংসার গোচাচ্ছে। আইজকা সন্ধ্যার দিকে ঝড় আসপি শুনতিছি। চিন্তায় রাতে ভালো ঘুমাতে পারিনি...
২৬ মে ২০২৪প্রতিদিন ভোরে ট্রেনের হুইসেলে ঘুম ভাঙে রাকিব হাসানের। একটু একটু করে গড়ে ওঠা রেলপথ নির্মাণকাজ তাঁর চোখে দেখা। এরপর রেলপথে ট্রেন ছুটে চলা, ট্রেন ছুঁয়ে দেখা—সবই হলো; কিন্তু এখনো হয়নি চড়া। রাকিবের মুখে তাই ভারতীয় সংগীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লার বিখ্যাত গান। ‘আমার বলার কিছু ছিল না, চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪