ফারুক মেহেদী
আপনি হয়তো ভাবছেন, এই তো সেদিনের কথা। তাকে যখন প্রথম দেখেছিলেন। নিসর্গের কোনো এক অচেনা পথে হেঁটে যাচ্ছেন দূরে, তার সঙ্গে পরম নির্ভরতায়। সে আপনাকে রাঁধাচূড়া আর কাঁঠালচাপা চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে! পথজুড়ে যেন জারুলের মন মাতাল করা ফুলের সমারোহ। এই তো সেদিনের কথা, মাত্র ২০ বছর আগের জীবন্ত সব ছবি জ্বলজ্বল করছে আপনার স্মৃতিতে!
এরপর সে আপনার জীবনে এল চিরদিনের সঙ্গী হয়ে। কত বৃষ্টিভেজা দুপুরে ইচ্ছেমতো ভিজেছেন। কত পূর্ণিমায় রাতভর সে আপনার চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়েছে—আপনি কিছুই ভোলেননি। আপনাদের প্রেম ও অনুরাগের মধুর দিনগুলো এখনো হয়তো অজান্তে উঁকি দেয় নাগরিক জীবনের নিত্য ধুলোমাখা সন্ধ্যায়! এই মাঝবয়সেও নিজেকে হয়তো কখনো রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার অমিত আর আপনার তাকে লাবণ্য ভেবে ক্লান্ত জীবনে আনন্দের উপলক্ষ খোঁজেন!
এবার নিজের আধা জীবনের রোমান্টিক খাতাটি বন্ধ করে আপনার পেছনের জানালাটি একটু খুলুন। কিছু কি দেখা যায়? হ্যাঁ, খোলা বারান্দায় বেতের চেয়ারে একা বসে আছেন আপনার সত্তরোর্ধ্ব বাবা।
একসময় দাপুটে সরকারি কর্মকর্তা, এখন অবসরজীবনে বারান্দায় বসে সকাল-বিকেল আকাশ দেখেন। তিনিও হয়তো মনে করতে চান তাঁর নীল ধ্রুবতারাকে! তাঁর মনের পানকৌড়িকে খুঁজে ফেরেন আনমনে! কিন্তু চিনতে পারেন না! কী যেন খুঁজতে চান, বলতে চান। খেই হারিয়ে ফেলেন। সব চেনা যেন অচেনা লাগে!
হয়তো উল্টো আপনাকেই প্রশ্ন করে বসবেন: তুমি কে? আমার বাসায় কেন এসেছো? তুমি কি আমার অফিসের পিয়ন? একটু আগেই তিনি হয়তো গরম ধোঁয়া ওঠা চা পান করেছেন। অথচ আপনাকে বলছেন, কত দিন তিনি চা খান না! আপনি হয়তো তাঁকে একটু বাইরে হাঁটিয়ে নিয়ে আসতে চান। তিনি আপনাকে বলে বসতে পারেন: মাত্র তো রিকশায় করে শাহবাগ ঘুরে এসেছেন। আপনার মায়ের জন্য শাড়ি কিনেছেন। এরপর সিনেমা দেখে বাসায় ফিরেছেন। অথচ আপনার মা মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। আর গত ২০ বছরেও সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছেন বলে মনে হয় না!
আপনি যদি তাঁকে সংশোধন করে বলতে চান: এটা কী করে হয়? আপনি তো এক মাস ধরে নিজের রুম আর বারান্দা ছাড়া কোথাও যাননি। এমন কথা বললে তিনি আপনার সঙ্গে তর্কে জড়াবেন, চিৎকার-চেঁচামেচি করবেন। উল্টো আপনাকেই মিথ্যে প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে যাবেন। মেজাজ চড়ে যাবে। প্রেশার হাই হয়ে যাবে। তিনি আপনার বাবা। আপনি স্বাভাবিকভাবেই ভাবছেন, এটা হয়তো বয়সেরই দোষ। তাই এমন উল্টাপাল্টা বলেন। আসলে এটা কি স্রেফ বয়সের কারণ, নাকি রোগ? মাঝবয়সেও আপনি হয়তো সব মনে করতে পারছেন। কিন্তু আপনার যখন আপনার বাবার মতো সত্তরোর্ধ্ব বয়স হবে, তখন আপনারও হয়তো চেনাজানা সব অচেনা লাগবে।
সেই আপনার ভেতরের অমিত লাবণ্য চরিত্রগুলোও কেমন বয়সে ক্লিষ্ট, জীর্ণ হয়ে যাবে!
কিছুদিন ধরে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। দেখলাম, দেশে বর্তমানে বয়স্ক বা প্রবীণ মানুষের সংখ্যা গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণের সংখ্যা বাড়ছে। আর যতই প্রবীণ বাড়ছে, তাঁদের নিঃসঙ্গতা বা ভুলে যাওয়া রোগও বাড়ছে। এটাই উদ্বেগের বিষয়। আজ বিশ্ব আলঝেইমার্স দিবস। আলঝেইমার্সের অপর নাম ডিমেনশিয়া বা ভুলে যাওয়া রোগ। ভাবছি, আজ এটা নিয়েই লিখব। শুধু এই ডিমেনশিয়া বা ভুলে যাওয়া রোগ নিয়েই লিখব তা নয়; বরং এর যে অর্থনৈতিক ক্ষতি—এর নানান দিকও তুলে ধরার চেষ্টা করব।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, কিছু বয়স্ক মানুষ সবকিছুতে প্রতিক্রিয়া দেখান। তাঁরা নিজের স্মৃতি, মেধা, দক্ষতা অগ্রাহ্য করে অনিয়ন্ত্রিত, অস্বাভাবিক আচরণ করেন। মূলত এমন বয়স্ক মানুষজন মস্তিষ্ক রোগে আক্রান্ত হন। ধীরে ধীরে এটি বেড়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুরুর দিকে তা ধরা পড়ে না। স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া এই রোগের প্রথম লক্ষণ। শর্ট টার্ম মেমোরি বা স্বল্প মেয়াদে স্মৃতিবিভ্রাট ঘটায়। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তরা ১০ মিনিট আগের ঘটনাও ভুলে যান। এঁরা সাধারণ একটি চা বানানো, রান্নার রেসিপি কিংবা ব্যাংক কার্ডের তথ্যও ভুলে যেতে পারেন। আর যখন-তখন ঘর থেকে একা বের হয়ে কোথাও গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা এ রোগের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সর্বশেষ তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি হালনাগাদ গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বে ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষ ভুলে যাওয়া রোগ বা ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন। আর ২০৩০ সালে এ সংখ্যা হবে ৭ কোটি ৮০ লাখ, যা ২০৫০ সালে হতে পারে ১৩ কোটি ৯০ লাখ। ভুলে যাওয়া রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা পশ্চিমা বিশ্বেই সবচেয়ে বেশি বা ২ কোটি ১০ লাখ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৬৫ লাখ আর ২০১৫ সালের এক হিসাবে বাংলাদেশে এ সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। তবে গবেষকেরা মনে করেন, ২০৫০ সালে বাংলাদেশে ডিমেনশিয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ২০-২২ লাখে। গত ২০ বছরে এ রোগে মৃত্যুর হারও বেড়েছে ব্যাপক হারে। সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে বিশ্বে ডিমেনশিয়ায় ১৬ লাখ মানুষ মারা গেছেন।
পর্যালোচনায় জানা যায়, এ ধরনের রোগের এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ওষুধ বা কার্যকর চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। এটা পুরোপুরি পরনির্ভরশীলতা এবং অক্ষমতা। ফলে এর মূল চিকিৎসা হলো মোটিভেশন, ব্যক্তিগত আদর-যত্ন আর সার্বক্ষণিক পরিচর্যা। এ রকম একজন লোকের সঙ্গে কারও না কারও যুক্ত থাকতে হয়। না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে।
ডব্লিউএইচওর গবেষণা থেকে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালে ভুলে যাওয়া রোগ বা ডিমেনশিয়ার বৈশ্বিক খরচ ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ কোটি ২৬ লাখ কোটি টাকা।
ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে এর পেছনে খরচ হবে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। আর যদি কেয়ার গিভার বা পরিচর্যা খাতে খরচ বাড়ে, তাহলে এই অঙ্ক ২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়নে পৌঁছাতে পারে। একজন সাধারণ ডিমেনশিয়া রোগীর বাৎসরিক খরচ প্রায় ১৬ হাজার ডলার, একটু জটিল হলে ২৭ হাজার ডলার আর মারাত্মক জটিল হলে ৩৬ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে। সুতরাং বলা যায়, এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি রোগ।
গড় আয়ু বাড়ার ফলে বাংলাদেশে যেহেতু এ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, এ খাতে জরুরি ভিত্তিতে মনোযোগ দরকার। বিশেষ করে সরকারের মনোযোগই বেশি দরকার। কারণ, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত পরিবারে এ ধরনের রোগী থাকলে তাদের পক্ষে এত খরচ বহন করা সম্ভব হয় না। অথচ বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো নীতিমালা বা কৌশলপত্র তৈরি হয়নি। যেহেতু নীতিমালা নেই, সুতরাং এ খাতে সরকারি কোনো বরাদ্দও নেই। বেসরকারি পর্যায়েও দু-একটি সংগঠন ছাড়া খুব বেশি কাজ হচ্ছে বলে জানা যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানলাম, ডিমেনশিয়াসহ বয়স্ক মানুষকে নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করছে চ্যারিটি সংগঠন স্যার উইলিয়াম বেভারিজ ফাউন্ডেশন। সম্প্রতি এর কান্ট্রি ডিরেক্টর মেজর জেনারেল (অব.) জীবন কানাই দাসের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ হয়। তিনি জানান, বাংলাদেশে জরুরি ভিত্তিতে এ খাতের জন্য নীতিমালা করা দরকার। এর পরই এ রোগের ডায়াগনোসিস, বিশেষ পরিচর্যা, নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ এবং রোগীদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা কী হতে পারে, তা নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। তখন এ খাতে সরকারের অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি সামনে আসবে। আর বেসরকারি সংগঠনগুলোও তখন কীভাবে প্রবীণ মানুষের সেবায় নিজেরা যুক্ত হতে পারে, তার একটা পথ বের হবে। মোটকথা, বয়স্ক মানুষকে কোনোভাবেই নিঃসঙ্গতায়, অবহেলায় বা অযত্নে রাখা যাবে না। কারণ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম রীতি মেনেই প্রবীণ হবে। তাঁদের সুরক্ষা না দিলে, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও এ বোধ তৈরি হবে না।
বিষয়টি নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হলো সত্যি-ই তো, আমরা আজ মাঝবয়সী হলেও ক্রমেই প্রবীণের পথে হাঁটছি। ভুলে যাওয়া রোগ আমাদের যে কারও হতে পারে। একদিন আমিও চেনা মানুষ, চেনাজানা সব পথ ভুলে হারিয়ে যেতে পারি কোনো দূর অজানায়! যুগ যুগের প্রিয় হাতের স্পর্শও অচেনা লাগতে পারে! এ জীবন কি আমরা কেউ চাই?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আপনি হয়তো ভাবছেন, এই তো সেদিনের কথা। তাকে যখন প্রথম দেখেছিলেন। নিসর্গের কোনো এক অচেনা পথে হেঁটে যাচ্ছেন দূরে, তার সঙ্গে পরম নির্ভরতায়। সে আপনাকে রাঁধাচূড়া আর কাঁঠালচাপা চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে! পথজুড়ে যেন জারুলের মন মাতাল করা ফুলের সমারোহ। এই তো সেদিনের কথা, মাত্র ২০ বছর আগের জীবন্ত সব ছবি জ্বলজ্বল করছে আপনার স্মৃতিতে!
এরপর সে আপনার জীবনে এল চিরদিনের সঙ্গী হয়ে। কত বৃষ্টিভেজা দুপুরে ইচ্ছেমতো ভিজেছেন। কত পূর্ণিমায় রাতভর সে আপনার চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়েছে—আপনি কিছুই ভোলেননি। আপনাদের প্রেম ও অনুরাগের মধুর দিনগুলো এখনো হয়তো অজান্তে উঁকি দেয় নাগরিক জীবনের নিত্য ধুলোমাখা সন্ধ্যায়! এই মাঝবয়সেও নিজেকে হয়তো কখনো রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার অমিত আর আপনার তাকে লাবণ্য ভেবে ক্লান্ত জীবনে আনন্দের উপলক্ষ খোঁজেন!
এবার নিজের আধা জীবনের রোমান্টিক খাতাটি বন্ধ করে আপনার পেছনের জানালাটি একটু খুলুন। কিছু কি দেখা যায়? হ্যাঁ, খোলা বারান্দায় বেতের চেয়ারে একা বসে আছেন আপনার সত্তরোর্ধ্ব বাবা।
একসময় দাপুটে সরকারি কর্মকর্তা, এখন অবসরজীবনে বারান্দায় বসে সকাল-বিকেল আকাশ দেখেন। তিনিও হয়তো মনে করতে চান তাঁর নীল ধ্রুবতারাকে! তাঁর মনের পানকৌড়িকে খুঁজে ফেরেন আনমনে! কিন্তু চিনতে পারেন না! কী যেন খুঁজতে চান, বলতে চান। খেই হারিয়ে ফেলেন। সব চেনা যেন অচেনা লাগে!
হয়তো উল্টো আপনাকেই প্রশ্ন করে বসবেন: তুমি কে? আমার বাসায় কেন এসেছো? তুমি কি আমার অফিসের পিয়ন? একটু আগেই তিনি হয়তো গরম ধোঁয়া ওঠা চা পান করেছেন। অথচ আপনাকে বলছেন, কত দিন তিনি চা খান না! আপনি হয়তো তাঁকে একটু বাইরে হাঁটিয়ে নিয়ে আসতে চান। তিনি আপনাকে বলে বসতে পারেন: মাত্র তো রিকশায় করে শাহবাগ ঘুরে এসেছেন। আপনার মায়ের জন্য শাড়ি কিনেছেন। এরপর সিনেমা দেখে বাসায় ফিরেছেন। অথচ আপনার মা মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। আর গত ২০ বছরেও সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছেন বলে মনে হয় না!
আপনি যদি তাঁকে সংশোধন করে বলতে চান: এটা কী করে হয়? আপনি তো এক মাস ধরে নিজের রুম আর বারান্দা ছাড়া কোথাও যাননি। এমন কথা বললে তিনি আপনার সঙ্গে তর্কে জড়াবেন, চিৎকার-চেঁচামেচি করবেন। উল্টো আপনাকেই মিথ্যে প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে যাবেন। মেজাজ চড়ে যাবে। প্রেশার হাই হয়ে যাবে। তিনি আপনার বাবা। আপনি স্বাভাবিকভাবেই ভাবছেন, এটা হয়তো বয়সেরই দোষ। তাই এমন উল্টাপাল্টা বলেন। আসলে এটা কি স্রেফ বয়সের কারণ, নাকি রোগ? মাঝবয়সেও আপনি হয়তো সব মনে করতে পারছেন। কিন্তু আপনার যখন আপনার বাবার মতো সত্তরোর্ধ্ব বয়স হবে, তখন আপনারও হয়তো চেনাজানা সব অচেনা লাগবে।
সেই আপনার ভেতরের অমিত লাবণ্য চরিত্রগুলোও কেমন বয়সে ক্লিষ্ট, জীর্ণ হয়ে যাবে!
কিছুদিন ধরে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। দেখলাম, দেশে বর্তমানে বয়স্ক বা প্রবীণ মানুষের সংখ্যা গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণের সংখ্যা বাড়ছে। আর যতই প্রবীণ বাড়ছে, তাঁদের নিঃসঙ্গতা বা ভুলে যাওয়া রোগও বাড়ছে। এটাই উদ্বেগের বিষয়। আজ বিশ্ব আলঝেইমার্স দিবস। আলঝেইমার্সের অপর নাম ডিমেনশিয়া বা ভুলে যাওয়া রোগ। ভাবছি, আজ এটা নিয়েই লিখব। শুধু এই ডিমেনশিয়া বা ভুলে যাওয়া রোগ নিয়েই লিখব তা নয়; বরং এর যে অর্থনৈতিক ক্ষতি—এর নানান দিকও তুলে ধরার চেষ্টা করব।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, কিছু বয়স্ক মানুষ সবকিছুতে প্রতিক্রিয়া দেখান। তাঁরা নিজের স্মৃতি, মেধা, দক্ষতা অগ্রাহ্য করে অনিয়ন্ত্রিত, অস্বাভাবিক আচরণ করেন। মূলত এমন বয়স্ক মানুষজন মস্তিষ্ক রোগে আক্রান্ত হন। ধীরে ধীরে এটি বেড়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুরুর দিকে তা ধরা পড়ে না। স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া এই রোগের প্রথম লক্ষণ। শর্ট টার্ম মেমোরি বা স্বল্প মেয়াদে স্মৃতিবিভ্রাট ঘটায়। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তরা ১০ মিনিট আগের ঘটনাও ভুলে যান। এঁরা সাধারণ একটি চা বানানো, রান্নার রেসিপি কিংবা ব্যাংক কার্ডের তথ্যও ভুলে যেতে পারেন। আর যখন-তখন ঘর থেকে একা বের হয়ে কোথাও গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা এ রোগের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সর্বশেষ তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি হালনাগাদ গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বে ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষ ভুলে যাওয়া রোগ বা ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন। আর ২০৩০ সালে এ সংখ্যা হবে ৭ কোটি ৮০ লাখ, যা ২০৫০ সালে হতে পারে ১৩ কোটি ৯০ লাখ। ভুলে যাওয়া রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা পশ্চিমা বিশ্বেই সবচেয়ে বেশি বা ২ কোটি ১০ লাখ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৬৫ লাখ আর ২০১৫ সালের এক হিসাবে বাংলাদেশে এ সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। তবে গবেষকেরা মনে করেন, ২০৫০ সালে বাংলাদেশে ডিমেনশিয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ২০-২২ লাখে। গত ২০ বছরে এ রোগে মৃত্যুর হারও বেড়েছে ব্যাপক হারে। সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে বিশ্বে ডিমেনশিয়ায় ১৬ লাখ মানুষ মারা গেছেন।
পর্যালোচনায় জানা যায়, এ ধরনের রোগের এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ওষুধ বা কার্যকর চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। এটা পুরোপুরি পরনির্ভরশীলতা এবং অক্ষমতা। ফলে এর মূল চিকিৎসা হলো মোটিভেশন, ব্যক্তিগত আদর-যত্ন আর সার্বক্ষণিক পরিচর্যা। এ রকম একজন লোকের সঙ্গে কারও না কারও যুক্ত থাকতে হয়। না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে।
ডব্লিউএইচওর গবেষণা থেকে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালে ভুলে যাওয়া রোগ বা ডিমেনশিয়ার বৈশ্বিক খরচ ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ কোটি ২৬ লাখ কোটি টাকা।
ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে এর পেছনে খরচ হবে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। আর যদি কেয়ার গিভার বা পরিচর্যা খাতে খরচ বাড়ে, তাহলে এই অঙ্ক ২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়নে পৌঁছাতে পারে। একজন সাধারণ ডিমেনশিয়া রোগীর বাৎসরিক খরচ প্রায় ১৬ হাজার ডলার, একটু জটিল হলে ২৭ হাজার ডলার আর মারাত্মক জটিল হলে ৩৬ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে। সুতরাং বলা যায়, এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি রোগ।
গড় আয়ু বাড়ার ফলে বাংলাদেশে যেহেতু এ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, এ খাতে জরুরি ভিত্তিতে মনোযোগ দরকার। বিশেষ করে সরকারের মনোযোগই বেশি দরকার। কারণ, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত পরিবারে এ ধরনের রোগী থাকলে তাদের পক্ষে এত খরচ বহন করা সম্ভব হয় না। অথচ বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো নীতিমালা বা কৌশলপত্র তৈরি হয়নি। যেহেতু নীতিমালা নেই, সুতরাং এ খাতে সরকারি কোনো বরাদ্দও নেই। বেসরকারি পর্যায়েও দু-একটি সংগঠন ছাড়া খুব বেশি কাজ হচ্ছে বলে জানা যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানলাম, ডিমেনশিয়াসহ বয়স্ক মানুষকে নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করছে চ্যারিটি সংগঠন স্যার উইলিয়াম বেভারিজ ফাউন্ডেশন। সম্প্রতি এর কান্ট্রি ডিরেক্টর মেজর জেনারেল (অব.) জীবন কানাই দাসের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ হয়। তিনি জানান, বাংলাদেশে জরুরি ভিত্তিতে এ খাতের জন্য নীতিমালা করা দরকার। এর পরই এ রোগের ডায়াগনোসিস, বিশেষ পরিচর্যা, নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ এবং রোগীদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা কী হতে পারে, তা নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। তখন এ খাতে সরকারের অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি সামনে আসবে। আর বেসরকারি সংগঠনগুলোও তখন কীভাবে প্রবীণ মানুষের সেবায় নিজেরা যুক্ত হতে পারে, তার একটা পথ বের হবে। মোটকথা, বয়স্ক মানুষকে কোনোভাবেই নিঃসঙ্গতায়, অবহেলায় বা অযত্নে রাখা যাবে না। কারণ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম রীতি মেনেই প্রবীণ হবে। তাঁদের সুরক্ষা না দিলে, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও এ বোধ তৈরি হবে না।
বিষয়টি নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হলো সত্যি-ই তো, আমরা আজ মাঝবয়সী হলেও ক্রমেই প্রবীণের পথে হাঁটছি। ভুলে যাওয়া রোগ আমাদের যে কারও হতে পারে। একদিন আমিও চেনা মানুষ, চেনাজানা সব পথ ভুলে হারিয়ে যেতে পারি কোনো দূর অজানায়! যুগ যুগের প্রিয় হাতের স্পর্শও অচেনা লাগতে পারে! এ জীবন কি আমরা কেউ চাই?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
২১ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
১ দিন আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
১ দিন আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
১ দিন আগে