এম আব্দুল আলিম
একদা বৈষয়িক তাগিদে, মানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্যে কয়েক অক্ষর পড়েছিলাম এবং কয়েক পাতা লিখেছিলাম ত্রিশোত্তর কালের কবিদের বিচ্ছিন্নতা-নিঃসঙ্গতা নিয়ে। প্রথমে বাংলা একাডেমি তা বই আকারেও বের করেছিল, পরে প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। সে কাজ করতে গিয়ে দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক, মনস্তত্ববিদ, সমাজতাত্ত্বিকদের এ বিষয়ক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে একটু অনুসন্ধানও চালিয়েছিলাম। সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটা তিনটি ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহুমাত্রিক আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা দেখে মনে হলো— পুঁজিবাদের দৈত্য কীভাবে পারিবারিক, সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে, তা নিয়ে দু-চারটি বাক্য লিখি।
০১.
সাধারণভাবে বিচ্ছিন্নতার (Alienation) অর্থ হলো, সম্পূর্ণ বা সম্যক ছিন্ন, পৃথককৃত। দর্শনে বিচ্ছিন্নতা বলতে বোঝায়, কোনো কিছুর গুণ বা শক্তিকে তার মূল আধার নিরপেক্ষভাবে স্বকীয় সত্তা হিসেবে প্রতিপন্ন করা। এটি এমন এক অনুভূতি, যা মানুষকে সম্পূর্ণ একা করে ফেলে, সমাজ-সংসার কোনো কিছুকেই সে আত্মীয় বলে মনে করে না। হেগেল ও ফয়েরবাখ ধর্মাশ্রিত ভাবধারা থেকে এর ব্যাখ্যা করলেও মার্কস ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন আর্থসামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। মার্কস বলেছেন, পুঁজিবাদের উৎকট শোষণ এবং আর্থ-সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে মানুষ বিচ্ছিন্নতার জ্বালা ভোগ করে। শ্রমবিচ্ছিন্নতার সূত্র ধরে মার্কস এর নানামাত্রিক ব্যাখ্যাও দাঁড় করিয়েছেন। এরপর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচ্ছিন্নতার ব্যাখ্যা করেছেন হার্বাট মারকুইস, এরিখ ফ্রম, ফ্রয়েড, কিয়ের্কেগার্ড, এডমন্ড হুসের্লে, জ্যাঁ পল সার্ত্র, হাইডেগার প্রমুখ চিন্তাবিদ। বিচ্ছিন্নতার বহুমাত্রিক রূপকে তাঁরা সাজিয়েছেন প্রকৃতিবিচ্ছিন্নতা, পরিবারবিচ্ছিন্নতা, সমাজবিচ্ছিন্নতা, ঈশ্বরবিচ্ছিন্নতা, মূল্যবোধবিচ্ছিন্নতা, প্রেমবিচ্ছিন্নতা, সত্তাবিচ্ছিন্নতা প্রভৃতিভাবে। এখানে সংক্ষিপ্তরূপে তুলে ধরব পরিবারবিচ্ছিন্নতা, সমাজবিচ্ছিন্নতা এবং প্রেমবিচ্ছিন্নতাকে।
০২.
সভ্যতার বিকাশের এক স্তরে পরিবার প্রথার উদ্ভব হলে মানুষ পারিবারিক বন্ধনে মিলেমিশে বসবাস শুরু করে। পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে বাস করে মানুষ একে অপরের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী এবং অন্যান্য আত্মীয়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা পরিবার মানুষের জীবনে আস্থা ও নির্ভশীলতার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। আন্তরিকতা, সৌহার্দ্য এবং অপরের প্রতি মমত্ববোধের কারণে মানুষ সুসংহত পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে জীবন যাপন করতে থাকে। কিন্তু ধনতান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশের ফলে জীবন-জীবিকার তাগিদ পরিবার প্রথাকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়। পুঁজিবাদী সমাজের অবক্ষয়ের ফলে মানুষের পারিবারিক বন্ধন ভেঙে পড়ে। ফলে পরিবারের সদস্যদের একের সঙ্গে অপরের সম্পর্কে ফাটল ধরে। পুঁজিবাদের প্রবল প্রতাপে একান্নবর্তী পরিবারের সুস্থির ও সুনিশ্চিত আশ্রয় তছনছ হয়ে যায়। কর্মের তাগিদে রক্তসম্পর্কের আপনজনের কাছ থেকে মানুষ দূরে চলে যায়। পারিবারিক জীবনে নানামুখী জটিলতা ব্যক্তিকে অসহনীয় যন্ত্রণা দেয়, ফলে তার মনে বাসা বাঁধে নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা। নিঃসঙ্গ মানুষ পরিবারের প্রতি কোনো দায়িত্ব উপলব্ধি করে না, এমনকি পুঁজিবাদী সভ্যতার নির্মম বাস্তবতায় পরিবারের কোনো সদস্য মৃত্যুবরণ করলে মানুষ তার খোঁজ রাখারও সময় পায় না। মূলত পারিবারিক সম্পর্কের টানাপড়েন মানুষকে বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত করে। পরিবার বিচ্ছিন্নতাজাত সমস্যা বর্তমান যুগের মানুষের নিঃসঙ্গতার জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
০৩.
মানুষ প্রকৃতির প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে এবং জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সভ্যতার বিকাশের এক পর্যায়ে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করে। ব্যক্তির নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সমাজ হয়ে ওঠে এক নির্ভরশীল সংগঠন। ব্যক্তির ওপর ব্যক্তির আস্থা সৃষ্টি হয় এ সমাজের মাধ্যমে। তবে পুঁজিবাদের ব্যাপক প্রসারে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে মানুষের সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হয়। তা ছাড়া এ যুগের সমাজ ব্যক্তির দায়িত্ব নিতে পারছে না, পারছে না ব্যক্তির প্রত্যাশা পূরণ করতে। তাই ব্যক্তি নিরাপত্তাহীন হয়ে সমাজের সঙ্গে অন্বয় স্থাপন করতে পারছে না। ধনতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থায় সামাজিক নানা মূল্যবোধে ফাটল ধরেছে। এর ফলে সমাজের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে বিচ্ছিন্নতা। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ গড়ে তুলেছিল সমাজ, কিন্তু সেই সমাজ যখন ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হয়ে উঠল, তখন সমাজের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হলো। সমাজে বিদ্যমান অপর সব মানুষের সঙ্গে ব্যক্তি নিজেকে মেলাতে পারল না—পারল না বিশ্বাস স্থাপন করতে। সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষের কাছে সমাজ পরিণত হলো এক গুরুত্বহীন প্রতিষ্ঠানে। এমতাবস্থায় সমাজ ব্যক্তির প্রতিপক্ষে পরিণত হলো। মূলত সমাজের সব মানুষ, সামাজিক ঐতিহ্য এবং দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছেদ-বিযুক্তিই হলো সমাজবিচ্ছিন্নতা। পণ্যযুগে মানুষের মনুষ্যত্বের চরম অধঃপতন, মানুষের সঙ্গে মানুষের কৃত্রিম তথা যান্ত্রিক সম্পর্ক, শ্রম-বৈষম্য, তথ্যপ্রযুক্তির চরম উন্নতি, ব্যক্তির চরম আত্মকেন্দ্রিকতা এবং জগৎসংসারের নানা অভিঘাতে সৃষ্ট বিপর্যয়ের ফলে মানুষ সমাজ থেকে দূরে চলে গেছে এবং তার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা দানা বেঁধেছে। এ অবস্থায় সমাজস্থ প্রতিটি মানুষই নিরতিশয় একাকিত্ব, গভীর অনিশ্চয়তা, তীব্র উৎকণ্ঠা ও দুর্মর নিঃসঙ্গতাবোধে আক্রান্ত হয়ে পরস্পর থেকে হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন, এবং এভাবে কেটে যায় সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে সঙ্গতির সুর তাল লয়। সে হয়ে পড়ে নির্জন নিঃসঙ্গ একাকী মানুষ।
০৪.
সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে প্রেম মানুষকে একে অপরের সঙ্গে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দিয়েছে। প্রেমের ফলে মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। প্রেম মানুষকে দিয়েছে পরিবার ও সমাজ সৃষ্টির প্রেরণা; মানুষকে পরস্পরের সঙ্গে নির্ভরশীল হওয়ার ক্ষেত্রেও প্রেম গুরুত্বপূর্র্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে সভ্যতার অভিশাপ ও পুঁজিবাদের অভিঘাতে ক্রমে মানুষের আবেগ, অনুভূতি ভোঁতা হয়ে আসে। সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রেমে ফাটল ধরে। প্রেমের পবিত্র রূপ যায় হারিয়ে—মানুষের আকর্ষণ বাড়ে দেহজ প্রেমের দিকে। আধুনিক কালে মানুষের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবোধকে কেন্দ্র করে যে প্রেমের উন্মেষ ঘটেছিল, ধনতান্ত্রিক সমাজে সে প্রেম সংকটকবলিত হয়। পুঁজিবাদের দোর্দণ্ড প্রতাপে আবেগ-অনুভূতি হারিয়ে মানুষ যন্ত্রে পরিণত হওয়ায় তার মধ্যে সৃষ্টি হয় প্রেমবিচ্ছিন্নতা। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরিবার ও সমাজ মানুষকে যেভাবে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ করেছিল, ধনতান্ত্রিক সমাজের বহুবিধ সংকটে সে প্রেমে সন্দেহ ও সংশয় দেখা দেয়। পরিবার এবং সমাজ থেকে মানুষ যত দূরে সরে যায়, তার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ততই বেড়ে যায়। এ যুগে প্রেমিক-প্রেমিকা এমনকি যুগলের প্রেমেও ফাটল সৃষ্টি হয়। পুঁজিবাদের অদৃশ্য দৈত্য মানুষের হৃদয় থেকে প্রেমকে হরণ করে নিয়ে গেছে। এ কালে দাম্পত্যপ্রেমে দেখা দিয়েছে দুর্মর সন্দেহ ও গভীর অবিশ্বাস, বাৎসল্যপ্রেম বাণিজ্যিক মূল্যচেতনায় নিপতিত হয়েছে প্রবল চাপের মুখে। যুগলের বিচ্ছিন্নতা মানুষের চেতনায় সৃষ্টি করেছে নির্বেদ আর নিঃসঙ্গতা। প্রেমবিচ্ছিন্নতার ফলে মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রেমের আধারের প্রতি সৃষ্টি হয় অবিশ্বাস ও সন্দেহ। প্রেমবিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা ব্যক্তিমানুষকে গভীর বেদনায় নিমজ্জিত করে তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এক কথায় প্রেমবিচ্ছিন্নতা এ কালের সমাজে ব্যাপক সমস্যা সংকট সৃষ্টি করেছে।
০৫.
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত তিনটি ঘটনার সঙ্গে পুঁজির গভীর যোগসূত্র রয়েছে। তারা প্রত্যেকেই অঢেল টাকার মালিক। পুঁজিবাদের দৈত্য তাদের হৃদয় থেকে প্রেমকে হরণ করে নিয়ে গেছে। ফলে দাম্পত্যজীবনে তারা সুখ পায়নি। তাই পরিবার, সমাজ, প্রেম তথা সব মূল্যবোধকে তারা বিকিয়ে দিয়েছে ভোগের কাছে। ফলে বিচ্ছিন্নতা-নিঃসঙ্গতা স্থায়ীভাবে বাসা করেছে তাদের মধ্যে। দাম্পত্যপ্রেম তাদের স্বস্তি দিতে পারেনি; একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা তাদের নিত্যসঙ্গী। প্রত্যেকেই তারা অসুখী, তাদের হৃদয় হাহাকারে পূর্ণ।
একদা বৈষয়িক তাগিদে, মানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্যে কয়েক অক্ষর পড়েছিলাম এবং কয়েক পাতা লিখেছিলাম ত্রিশোত্তর কালের কবিদের বিচ্ছিন্নতা-নিঃসঙ্গতা নিয়ে। প্রথমে বাংলা একাডেমি তা বই আকারেও বের করেছিল, পরে প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। সে কাজ করতে গিয়ে দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক, মনস্তত্ববিদ, সমাজতাত্ত্বিকদের এ বিষয়ক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে একটু অনুসন্ধানও চালিয়েছিলাম। সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটা তিনটি ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহুমাত্রিক আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা দেখে মনে হলো— পুঁজিবাদের দৈত্য কীভাবে পারিবারিক, সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে, তা নিয়ে দু-চারটি বাক্য লিখি।
০১.
সাধারণভাবে বিচ্ছিন্নতার (Alienation) অর্থ হলো, সম্পূর্ণ বা সম্যক ছিন্ন, পৃথককৃত। দর্শনে বিচ্ছিন্নতা বলতে বোঝায়, কোনো কিছুর গুণ বা শক্তিকে তার মূল আধার নিরপেক্ষভাবে স্বকীয় সত্তা হিসেবে প্রতিপন্ন করা। এটি এমন এক অনুভূতি, যা মানুষকে সম্পূর্ণ একা করে ফেলে, সমাজ-সংসার কোনো কিছুকেই সে আত্মীয় বলে মনে করে না। হেগেল ও ফয়েরবাখ ধর্মাশ্রিত ভাবধারা থেকে এর ব্যাখ্যা করলেও মার্কস ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন আর্থসামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। মার্কস বলেছেন, পুঁজিবাদের উৎকট শোষণ এবং আর্থ-সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে মানুষ বিচ্ছিন্নতার জ্বালা ভোগ করে। শ্রমবিচ্ছিন্নতার সূত্র ধরে মার্কস এর নানামাত্রিক ব্যাখ্যাও দাঁড় করিয়েছেন। এরপর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচ্ছিন্নতার ব্যাখ্যা করেছেন হার্বাট মারকুইস, এরিখ ফ্রম, ফ্রয়েড, কিয়ের্কেগার্ড, এডমন্ড হুসের্লে, জ্যাঁ পল সার্ত্র, হাইডেগার প্রমুখ চিন্তাবিদ। বিচ্ছিন্নতার বহুমাত্রিক রূপকে তাঁরা সাজিয়েছেন প্রকৃতিবিচ্ছিন্নতা, পরিবারবিচ্ছিন্নতা, সমাজবিচ্ছিন্নতা, ঈশ্বরবিচ্ছিন্নতা, মূল্যবোধবিচ্ছিন্নতা, প্রেমবিচ্ছিন্নতা, সত্তাবিচ্ছিন্নতা প্রভৃতিভাবে। এখানে সংক্ষিপ্তরূপে তুলে ধরব পরিবারবিচ্ছিন্নতা, সমাজবিচ্ছিন্নতা এবং প্রেমবিচ্ছিন্নতাকে।
০২.
সভ্যতার বিকাশের এক স্তরে পরিবার প্রথার উদ্ভব হলে মানুষ পারিবারিক বন্ধনে মিলেমিশে বসবাস শুরু করে। পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে বাস করে মানুষ একে অপরের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী এবং অন্যান্য আত্মীয়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা পরিবার মানুষের জীবনে আস্থা ও নির্ভশীলতার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। আন্তরিকতা, সৌহার্দ্য এবং অপরের প্রতি মমত্ববোধের কারণে মানুষ সুসংহত পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে জীবন যাপন করতে থাকে। কিন্তু ধনতান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশের ফলে জীবন-জীবিকার তাগিদ পরিবার প্রথাকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়। পুঁজিবাদী সমাজের অবক্ষয়ের ফলে মানুষের পারিবারিক বন্ধন ভেঙে পড়ে। ফলে পরিবারের সদস্যদের একের সঙ্গে অপরের সম্পর্কে ফাটল ধরে। পুঁজিবাদের প্রবল প্রতাপে একান্নবর্তী পরিবারের সুস্থির ও সুনিশ্চিত আশ্রয় তছনছ হয়ে যায়। কর্মের তাগিদে রক্তসম্পর্কের আপনজনের কাছ থেকে মানুষ দূরে চলে যায়। পারিবারিক জীবনে নানামুখী জটিলতা ব্যক্তিকে অসহনীয় যন্ত্রণা দেয়, ফলে তার মনে বাসা বাঁধে নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা। নিঃসঙ্গ মানুষ পরিবারের প্রতি কোনো দায়িত্ব উপলব্ধি করে না, এমনকি পুঁজিবাদী সভ্যতার নির্মম বাস্তবতায় পরিবারের কোনো সদস্য মৃত্যুবরণ করলে মানুষ তার খোঁজ রাখারও সময় পায় না। মূলত পারিবারিক সম্পর্কের টানাপড়েন মানুষকে বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত করে। পরিবার বিচ্ছিন্নতাজাত সমস্যা বর্তমান যুগের মানুষের নিঃসঙ্গতার জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
০৩.
মানুষ প্রকৃতির প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে এবং জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সভ্যতার বিকাশের এক পর্যায়ে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করে। ব্যক্তির নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সমাজ হয়ে ওঠে এক নির্ভরশীল সংগঠন। ব্যক্তির ওপর ব্যক্তির আস্থা সৃষ্টি হয় এ সমাজের মাধ্যমে। তবে পুঁজিবাদের ব্যাপক প্রসারে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে মানুষের সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হয়। তা ছাড়া এ যুগের সমাজ ব্যক্তির দায়িত্ব নিতে পারছে না, পারছে না ব্যক্তির প্রত্যাশা পূরণ করতে। তাই ব্যক্তি নিরাপত্তাহীন হয়ে সমাজের সঙ্গে অন্বয় স্থাপন করতে পারছে না। ধনতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থায় সামাজিক নানা মূল্যবোধে ফাটল ধরেছে। এর ফলে সমাজের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে বিচ্ছিন্নতা। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ গড়ে তুলেছিল সমাজ, কিন্তু সেই সমাজ যখন ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হয়ে উঠল, তখন সমাজের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হলো। সমাজে বিদ্যমান অপর সব মানুষের সঙ্গে ব্যক্তি নিজেকে মেলাতে পারল না—পারল না বিশ্বাস স্থাপন করতে। সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষের কাছে সমাজ পরিণত হলো এক গুরুত্বহীন প্রতিষ্ঠানে। এমতাবস্থায় সমাজ ব্যক্তির প্রতিপক্ষে পরিণত হলো। মূলত সমাজের সব মানুষ, সামাজিক ঐতিহ্য এবং দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছেদ-বিযুক্তিই হলো সমাজবিচ্ছিন্নতা। পণ্যযুগে মানুষের মনুষ্যত্বের চরম অধঃপতন, মানুষের সঙ্গে মানুষের কৃত্রিম তথা যান্ত্রিক সম্পর্ক, শ্রম-বৈষম্য, তথ্যপ্রযুক্তির চরম উন্নতি, ব্যক্তির চরম আত্মকেন্দ্রিকতা এবং জগৎসংসারের নানা অভিঘাতে সৃষ্ট বিপর্যয়ের ফলে মানুষ সমাজ থেকে দূরে চলে গেছে এবং তার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা দানা বেঁধেছে। এ অবস্থায় সমাজস্থ প্রতিটি মানুষই নিরতিশয় একাকিত্ব, গভীর অনিশ্চয়তা, তীব্র উৎকণ্ঠা ও দুর্মর নিঃসঙ্গতাবোধে আক্রান্ত হয়ে পরস্পর থেকে হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন, এবং এভাবে কেটে যায় সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে সঙ্গতির সুর তাল লয়। সে হয়ে পড়ে নির্জন নিঃসঙ্গ একাকী মানুষ।
০৪.
সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে প্রেম মানুষকে একে অপরের সঙ্গে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দিয়েছে। প্রেমের ফলে মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। প্রেম মানুষকে দিয়েছে পরিবার ও সমাজ সৃষ্টির প্রেরণা; মানুষকে পরস্পরের সঙ্গে নির্ভরশীল হওয়ার ক্ষেত্রেও প্রেম গুরুত্বপূর্র্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে সভ্যতার অভিশাপ ও পুঁজিবাদের অভিঘাতে ক্রমে মানুষের আবেগ, অনুভূতি ভোঁতা হয়ে আসে। সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রেমে ফাটল ধরে। প্রেমের পবিত্র রূপ যায় হারিয়ে—মানুষের আকর্ষণ বাড়ে দেহজ প্রেমের দিকে। আধুনিক কালে মানুষের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবোধকে কেন্দ্র করে যে প্রেমের উন্মেষ ঘটেছিল, ধনতান্ত্রিক সমাজে সে প্রেম সংকটকবলিত হয়। পুঁজিবাদের দোর্দণ্ড প্রতাপে আবেগ-অনুভূতি হারিয়ে মানুষ যন্ত্রে পরিণত হওয়ায় তার মধ্যে সৃষ্টি হয় প্রেমবিচ্ছিন্নতা। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরিবার ও সমাজ মানুষকে যেভাবে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ করেছিল, ধনতান্ত্রিক সমাজের বহুবিধ সংকটে সে প্রেমে সন্দেহ ও সংশয় দেখা দেয়। পরিবার এবং সমাজ থেকে মানুষ যত দূরে সরে যায়, তার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ততই বেড়ে যায়। এ যুগে প্রেমিক-প্রেমিকা এমনকি যুগলের প্রেমেও ফাটল সৃষ্টি হয়। পুঁজিবাদের অদৃশ্য দৈত্য মানুষের হৃদয় থেকে প্রেমকে হরণ করে নিয়ে গেছে। এ কালে দাম্পত্যপ্রেমে দেখা দিয়েছে দুর্মর সন্দেহ ও গভীর অবিশ্বাস, বাৎসল্যপ্রেম বাণিজ্যিক মূল্যচেতনায় নিপতিত হয়েছে প্রবল চাপের মুখে। যুগলের বিচ্ছিন্নতা মানুষের চেতনায় সৃষ্টি করেছে নির্বেদ আর নিঃসঙ্গতা। প্রেমবিচ্ছিন্নতার ফলে মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রেমের আধারের প্রতি সৃষ্টি হয় অবিশ্বাস ও সন্দেহ। প্রেমবিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা ব্যক্তিমানুষকে গভীর বেদনায় নিমজ্জিত করে তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এক কথায় প্রেমবিচ্ছিন্নতা এ কালের সমাজে ব্যাপক সমস্যা সংকট সৃষ্টি করেছে।
০৫.
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত তিনটি ঘটনার সঙ্গে পুঁজির গভীর যোগসূত্র রয়েছে। তারা প্রত্যেকেই অঢেল টাকার মালিক। পুঁজিবাদের দৈত্য তাদের হৃদয় থেকে প্রেমকে হরণ করে নিয়ে গেছে। ফলে দাম্পত্যজীবনে তারা সুখ পায়নি। তাই পরিবার, সমাজ, প্রেম তথা সব মূল্যবোধকে তারা বিকিয়ে দিয়েছে ভোগের কাছে। ফলে বিচ্ছিন্নতা-নিঃসঙ্গতা স্থায়ীভাবে বাসা করেছে তাদের মধ্যে। দাম্পত্যপ্রেম তাদের স্বস্তি দিতে পারেনি; একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা তাদের নিত্যসঙ্গী। প্রত্যেকেই তারা অসুখী, তাদের হৃদয় হাহাকারে পূর্ণ।
সিসা একটি নরম ধাতু। এটি ঈষৎ নীলাভ ধূসর বর্ণের। এর পারমাণবিক সংখ্যা ৮২। ধাতুটি এতটাই নরম যে একটি ছুরির সাহায্যে একে কাটা যায়। সিসা কিন্তু মারাত্মক ক্ষতিকর বিষ। এই বিষের ভেতরেই বাস করছে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ। বাংলাদেশের বাতাসে যেমন সিসার উপস্থিতি দেখা গেছে, তেমনি মাটিতে-পানিতেও পাওয়া গেছে...
১০ মিনিট আগেঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী পরিচয়ে দ্রুত অস্ত্রোপচারে সহায়তা করার কথা বলে পাপিয়া আক্তার রোগীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। তিনি যে ‘ভুয়া’ ছাত্রী, সেটি বুঝতে পেরে চিকিৎসকেরা তাঁকে আটক করেন। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। হয়তো তাঁর শাস্তিও হবে। পাপিয়া শুধু অচেনা রোগী ও তাদের স্বজনদের নয়, তাঁর স্বামীকেও ধোঁকা...
২০ মিনিট আগেএখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১ দিন আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১ দিন আগে