সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আমাদের তরুণেরা কেবল মাদকাসক্ত নয়, কল্পনীয়-অকল্পনীয় কত রকমের, কত সব অপরাধে লিপ্ত, তার খবর জানার উপায় নেই। মাঝে মাঝে যা উন্মোচন ঘটে, তাতে চমকে উঠতে হয়। যেমন গতবারের দুর্গাপূজায় সাম্প্রদায়িক হামলা করা হয়েছিল। পূজায় হামলা আগেও হয়েছে; কিন্তু গতবার হয়েছে বহু স্থানে, কমপক্ষে ১৬টি জেলায়। এমনটি আগে কখনো ঘটেনি। এমনকি পাকিস্তান আমলেও নয়।
দুর্গাপূজা অনেকটা সর্বজনীন উৎসব, হিন্দুদেরই; কিন্তু মুসলমানদের জন্যও যেতে কোনো নিষেধ নেই। তারাও যায়, ঘুরে ঘুরে আয়োজন দেখে। কোথায় মূর্তি কত সুন্দর, আরতি কীভাবে হচ্ছে, বাজনা-বাদ্য কেমন বাজছে, প্রসাদ বিতরণ কী ধরনের—এসব কৌতূহল তরুণদের থাকে। কিন্তু গত বছর দেখা গেছে পূজামণ্ডপে হামলা করেছে তরুণেরাই। ছাত্ররাও। কেবল যে ছাত্ররা তা-ই নয়, আক্রমণকারীদের কেউ কেউ ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত, যে ছাত্রলীগ মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বলে দাবি করে থাকে। আবার এটাও লক্ষ করার বিষয় বৈকি যে শুধু মণ্ডপ ভাঙচুর করাই হয়নি, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের বসতবাড়ি এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও আক্রান্ত হয়েছিল, ঘটেছিল অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন।
বলা হয়েছিল এর পেছনে ষড়যন্ত্র আছে। থাকতেও পারে। তবে থাকলেও সেই ষড়যন্ত্রের রহস্য যে উন্মোচিত হবে—এমন আশা ভ্রান্ত। বহুল আলোচিত সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত রিপোর্ট এখনো যে দাখিল করা হয়নি, ১০২ বার তারিখ পিছিয়েছে এবং সময় চলে যাচ্ছে প্রায় ১১ বছর; তাতে রহস্য উন্মোচনের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার কারণ থাকে না, উৎসাহ জাগে না। স্বৈরাচার এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল ডা. শামসুল আলম খান মিলনের প্রাণত্যাগে। ৩২ বছর পার হয়ে গেছে; কিন্তু মিলন হত্যার বিচার হয়নি। মিলনের মা বলেছিলেন, ‘আমি বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহ যদি বিচার করেন, করবেন।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক হত্যার বিচার খুব সহজে হয় না।...মানুষ যাদের মিলনের হত্যাকারী মনে করে, তারা তো এ দেশের সংসদে বসেছে। সরকারের অংশ হিসেবে যদি তারা কাজ করে, তাহলে কার বিচার কে করবে?’ তাই তো! কার বিচার কে করে?
একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী যে অন্যায়টা বাংলাদেশে করে গেছে, তার তুলনা তো আধুনিক ইতিহাসে বিরল। স্থানীয় অপরাধীদের কয়েকজনের বিচার হয়েছে, কিন্তু মূল অপরাধ করেছে যে পাকিস্তানিরা, তাদের বিচার তো হয়নি। তাদের মধ্যে যে ১৯৩ জনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা গেছে, এমনকি তাদেরও তো বিচারের আওতায় আনতে পারিনি আমরা। ন্যায়বিচার ব্যবস্থাপনার আশাটা তখন থেকেই দুর্বল হয়ে গেছে, তারপর যে সবল হবে—এমন সম্ভাবনা আর দেখা দেয়নি।
কুমিল্লা থেকেই গত বছর সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হয়েছিল। রাতের অন্ধকারে যে যুবক চুপিসারে পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআনের কপি রেখে এসেছিল, শেষ পর্যন্ত সে ধরা পড়েছে। কিন্তু কেন সে এ কাজ করল, সঙ্গে আর কারা ছিল তা জানা গেল না। যুবকটি মানসিকভাবে অসুস্থ, সে নেশাখোর—প্রচারিত এসব তথ্য তদন্তকে সাহায্য করেছে বলে তো মনে হয় না।
কিন্তু বড় প্রশ্নটা হলো, তরুণেরা কেন এই আক্রমণে যুক্ত হতে গেল? তাদের তো বাধা দেওয়ার কথা। হামলাকারীদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়াটাই তো ছিল তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত। তবে কেন এই বিপথগামিতা? চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে মুসলিম ভাইদের ডাক দিয়েছিল হৃদয় হোসেন নামে এক তরুণ, ছাত্রলীগের কর্মী সে। তার মা একসময় ছিলেন হাজীগঞ্জ পৌরসভার নারী ওয়ার্ড কমিশনার। রংপুরের পীরগঞ্জে যে হামলা হয়েছিল তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল সৈকত মণ্ডল। সে রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্রলীগের একজন নেতা। পীরগঞ্জে হামলাটা হয়েছে অত্যন্ত গরিব জেলেপাড়ায়। বাড়িঘর, কাগজপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মানুষগুলো আশ্রয়হীন তো বটেই, পরিচয়হীনও হয়ে গেছে।
তা ছাত্রলীগের কর্মী মানেই যে আদর্শবাদী পরোপকারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী হবে, এমন কোনো কথা এখন আর নেই। এখন এমন খবর বিস্ময়ের সৃষ্টি করে না যেমনটা একটি দৈনিকে পড়েছি, ‘ছিনতাইয়ের সময় হাতেনাতে আটক ছাত্রলীগ নেতা।’ হাতেনাতে কিন্তু পুলিশ ধরেনি, ধরেছে জনতা। ছিনতাই বুঝলাম, তাই বলে দুর্বল সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘবদ্ধ হামলায় নেতৃত্বদান? কিন্তু দিয়েছে তো!
এর কারণ খুঁজতে হবে বিদ্যমান ব্যবস্থার ভেতরেই। এই ব্যবস্থা মানুষকে ক্ষমতা দেয় না; তাই অল্পস্বল্প ছিটেফোঁটা ক্ষমতা যে যখন যেখানে পায়, সেটা প্রয়োগ করে প্রবল বেগে। আক্রমণকারী তরুণেরা ক্ষমতা চায়। ক্ষমতা পাবে—এ আশাতেই সরকারি দলের সঙ্গে তারা যুক্ত হয়। সেটা না পেয়ে ছিনতাইয়ে নামে, সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হয়।
নিজেদের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটি করে ভরসা করে তাদের কোনো শাস্তি হবে না। কারণ তারা সরকার-সমর্থক। আর যে জনতা ওই সব হামলায় শামিল হয়, তারা তো ক্ষমতাবঞ্চিত অবস্থাতেই থাকে। সে জন্য যখন কোনো উন্মত্ত গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, তখন তারা মনে করে এবার ক্ষমতা পেয়েছে এবং ওই ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারবে। লাগায়ও। ভাবে, শত্রু পাওয়া গেছে। শত্রু যে তাদের চেয়েও দুর্বল যে মানুষগুলো তারা নয়, শত্রু যে আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, যা তাদের ক্ষমতাহীন করে রেখেছে, সেই শিক্ষাটা দেওয়ার মতো কোনো সাংস্কৃতিক আয়োজন তো সমাজে নেই।
সাম্প্রদায়িক হামলার পেছনে আরও বড় একটা কারণ রয়েছে সেটা হলো, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার জন্য। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ছিল। কথা ছিল সমাজ হবে ইহজাগতিক, রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। সমাজে ইহজাগতিকতার চর্চা চলবে এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। ধর্ম থাকবে, অবশ্যই থাকবে; কিন্তু ধর্ম হবে যার যার, রাষ্ট্র সবার। যাকে আমরা গণতন্ত্র বলি, সেখানে পৌঁছাতে হলে প্রথম যে পদক্ষেপটি গ্রহণ আবশ্যক, সেটি হলো এই ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু সেই পদক্ষেপ আমরা নিতে পারিনি। আমরা পিছিয়ে এসেছি।
এখন তো দেখা যাচ্ছে প্রগতিশীলেরাও আর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন না। বড়জোর বলেন অসাম্প্রদায়িকতার কথা, ভেতর থেকে সংকোচ এসে তাঁদের থামিয়ে দেয়। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপস করে। এদিকে ধর্ম ব্যবসায়ীদের তৎপরতার তো কোনো অবধি নেই। মাদ্রাসায় শিক্ষিত দরিদ্র মানুষদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করার চেষ্টা ক্রমেই বেগবান হচ্ছে। একটি গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে যে জঙ্গিদের সংগঠনগুলো উত্তরবঙ্গের চরাঞ্চলে বঞ্চিত মানুষদের দলে টানছে; টানাটা সহজও বটে। ক্ষমতাহীন মানুষ ক্ষমতার সামান্যতম আশায়ও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। সচ্ছল পরিবারের ছেলেরাও যে জঙ্গি হয়, তার পেছনেও ওই ক্ষমতাপ্রাপ্তির প্রত্যাশাটা থাকে।
ওদিকে ধর্মকে ব্যবহার করে যারা রাজনৈতিক শক্তি সংগ্রহ করে, আসলে যারা ধর্মবণিকই, তারা ঠিকই প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন দেশের সর্বত্র রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগে সামাজিক মিলনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, কিন্তু সেই চাহিদা উপেক্ষা করে যদি মধ্যপ্রাচ্যের আর্থিক সাহায্যে আদর্শ মসজিদ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি নেওয়া হয়, তাহলে বুঝতে কি কোনো অসুবিধা থাকে যে সাংস্কৃতিক হাওয়াটা কোন দিকে বইছে? পীর সাহেবদের কেউ কেউ রাজনীতি করেন। অতীতের মতো এখনো করে থাকেন। যেমন রাজারবাগের পীর। তাঁর মুরিদেরা তো আছেনই; তিনি একটি দৈনিক ও একটি মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করে থাকেন বলে ঢাকা শহরের দেয়ালে দেয়ালে লেখা দেখা যায়। মাসব্যাপী তিনি সুন্নি সম্মেলন করে থাকেন। কিন্তু সম্প্রতি এক মামলার ফলে বেরিয়ে এসেছে ধর্মীয় আচ্ছাদনে এবং অবৈধ উপায়ে তিনি প্রভূত সম্পত্তি সংগ্রহ করেছেন। এ রকম কাজ অন্য পীরদেরও কেউ কেউ নির্বিঘ্নে করে থাকেন বলে ধারণা করাটা মোটেই বেঠিক নয়।
ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির চর্চার ক্ষেত্রে অগ্রসর ও নির্ভরযোগ্য ভূমিকা পালন করার কথা বামপন্থীদের। কিন্তু আমাদের বামপন্থীরা সুবিধা করতে পারছে না। তার একটা বড় কারণ কিন্তু এই যে, তাদের প্রতিহত করার জন্য রাষ্ট্রশাসক বুর্জোয়াদের সবাই ঐক্যবদ্ধ। কারণ বুর্জোয়ারা জানে যে বামপন্থীদের নিজেদের ভেতর যত পার্থক্যই থাকুক, সবাই তারা পুঁজিবাদবিরোধী।
ভারতের রাজনীতি-প্রবাহ বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য তো করছেই না, উল্টো বৈরিতাই করে চলেছে। ভারতের সঙ্গে পানিবণ্টন, অসম বাণিজ্য এবং সীমান্ত সংঘর্ষের অবসান না ঘটে উল্টো বৃদ্ধিই পেয়েছে, তাতেও আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতা উৎসাহ পাচ্ছে।
তরুণদের দেশপ্রেমিক ও সৃষ্টিশীল করে তোলার জন্য যে সাংস্কৃতিক কাজ দরকার, সেটা বাংলাদেশে এখন নেই। উন্নতির হুকুমদারিতে সংস্কৃতি দমিত হচ্ছে। আর তার কুফল সবচেয়ে গভীরভাবে বহন করছে তরুণ সমাজ।
আমাদের তরুণেরা কেবল মাদকাসক্ত নয়, কল্পনীয়-অকল্পনীয় কত রকমের, কত সব অপরাধে লিপ্ত, তার খবর জানার উপায় নেই। মাঝে মাঝে যা উন্মোচন ঘটে, তাতে চমকে উঠতে হয়। যেমন গতবারের দুর্গাপূজায় সাম্প্রদায়িক হামলা করা হয়েছিল। পূজায় হামলা আগেও হয়েছে; কিন্তু গতবার হয়েছে বহু স্থানে, কমপক্ষে ১৬টি জেলায়। এমনটি আগে কখনো ঘটেনি। এমনকি পাকিস্তান আমলেও নয়।
দুর্গাপূজা অনেকটা সর্বজনীন উৎসব, হিন্দুদেরই; কিন্তু মুসলমানদের জন্যও যেতে কোনো নিষেধ নেই। তারাও যায়, ঘুরে ঘুরে আয়োজন দেখে। কোথায় মূর্তি কত সুন্দর, আরতি কীভাবে হচ্ছে, বাজনা-বাদ্য কেমন বাজছে, প্রসাদ বিতরণ কী ধরনের—এসব কৌতূহল তরুণদের থাকে। কিন্তু গত বছর দেখা গেছে পূজামণ্ডপে হামলা করেছে তরুণেরাই। ছাত্ররাও। কেবল যে ছাত্ররা তা-ই নয়, আক্রমণকারীদের কেউ কেউ ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত, যে ছাত্রলীগ মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বলে দাবি করে থাকে। আবার এটাও লক্ষ করার বিষয় বৈকি যে শুধু মণ্ডপ ভাঙচুর করাই হয়নি, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের বসতবাড়ি এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও আক্রান্ত হয়েছিল, ঘটেছিল অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন।
বলা হয়েছিল এর পেছনে ষড়যন্ত্র আছে। থাকতেও পারে। তবে থাকলেও সেই ষড়যন্ত্রের রহস্য যে উন্মোচিত হবে—এমন আশা ভ্রান্ত। বহুল আলোচিত সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত রিপোর্ট এখনো যে দাখিল করা হয়নি, ১০২ বার তারিখ পিছিয়েছে এবং সময় চলে যাচ্ছে প্রায় ১১ বছর; তাতে রহস্য উন্মোচনের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার কারণ থাকে না, উৎসাহ জাগে না। স্বৈরাচার এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল ডা. শামসুল আলম খান মিলনের প্রাণত্যাগে। ৩২ বছর পার হয়ে গেছে; কিন্তু মিলন হত্যার বিচার হয়নি। মিলনের মা বলেছিলেন, ‘আমি বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহ যদি বিচার করেন, করবেন।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক হত্যার বিচার খুব সহজে হয় না।...মানুষ যাদের মিলনের হত্যাকারী মনে করে, তারা তো এ দেশের সংসদে বসেছে। সরকারের অংশ হিসেবে যদি তারা কাজ করে, তাহলে কার বিচার কে করবে?’ তাই তো! কার বিচার কে করে?
একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী যে অন্যায়টা বাংলাদেশে করে গেছে, তার তুলনা তো আধুনিক ইতিহাসে বিরল। স্থানীয় অপরাধীদের কয়েকজনের বিচার হয়েছে, কিন্তু মূল অপরাধ করেছে যে পাকিস্তানিরা, তাদের বিচার তো হয়নি। তাদের মধ্যে যে ১৯৩ জনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা গেছে, এমনকি তাদেরও তো বিচারের আওতায় আনতে পারিনি আমরা। ন্যায়বিচার ব্যবস্থাপনার আশাটা তখন থেকেই দুর্বল হয়ে গেছে, তারপর যে সবল হবে—এমন সম্ভাবনা আর দেখা দেয়নি।
কুমিল্লা থেকেই গত বছর সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হয়েছিল। রাতের অন্ধকারে যে যুবক চুপিসারে পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআনের কপি রেখে এসেছিল, শেষ পর্যন্ত সে ধরা পড়েছে। কিন্তু কেন সে এ কাজ করল, সঙ্গে আর কারা ছিল তা জানা গেল না। যুবকটি মানসিকভাবে অসুস্থ, সে নেশাখোর—প্রচারিত এসব তথ্য তদন্তকে সাহায্য করেছে বলে তো মনে হয় না।
কিন্তু বড় প্রশ্নটা হলো, তরুণেরা কেন এই আক্রমণে যুক্ত হতে গেল? তাদের তো বাধা দেওয়ার কথা। হামলাকারীদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়াটাই তো ছিল তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত। তবে কেন এই বিপথগামিতা? চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে মুসলিম ভাইদের ডাক দিয়েছিল হৃদয় হোসেন নামে এক তরুণ, ছাত্রলীগের কর্মী সে। তার মা একসময় ছিলেন হাজীগঞ্জ পৌরসভার নারী ওয়ার্ড কমিশনার। রংপুরের পীরগঞ্জে যে হামলা হয়েছিল তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল সৈকত মণ্ডল। সে রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্রলীগের একজন নেতা। পীরগঞ্জে হামলাটা হয়েছে অত্যন্ত গরিব জেলেপাড়ায়। বাড়িঘর, কাগজপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মানুষগুলো আশ্রয়হীন তো বটেই, পরিচয়হীনও হয়ে গেছে।
তা ছাত্রলীগের কর্মী মানেই যে আদর্শবাদী পরোপকারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী হবে, এমন কোনো কথা এখন আর নেই। এখন এমন খবর বিস্ময়ের সৃষ্টি করে না যেমনটা একটি দৈনিকে পড়েছি, ‘ছিনতাইয়ের সময় হাতেনাতে আটক ছাত্রলীগ নেতা।’ হাতেনাতে কিন্তু পুলিশ ধরেনি, ধরেছে জনতা। ছিনতাই বুঝলাম, তাই বলে দুর্বল সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘবদ্ধ হামলায় নেতৃত্বদান? কিন্তু দিয়েছে তো!
এর কারণ খুঁজতে হবে বিদ্যমান ব্যবস্থার ভেতরেই। এই ব্যবস্থা মানুষকে ক্ষমতা দেয় না; তাই অল্পস্বল্প ছিটেফোঁটা ক্ষমতা যে যখন যেখানে পায়, সেটা প্রয়োগ করে প্রবল বেগে। আক্রমণকারী তরুণেরা ক্ষমতা চায়। ক্ষমতা পাবে—এ আশাতেই সরকারি দলের সঙ্গে তারা যুক্ত হয়। সেটা না পেয়ে ছিনতাইয়ে নামে, সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হয়।
নিজেদের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটি করে ভরসা করে তাদের কোনো শাস্তি হবে না। কারণ তারা সরকার-সমর্থক। আর যে জনতা ওই সব হামলায় শামিল হয়, তারা তো ক্ষমতাবঞ্চিত অবস্থাতেই থাকে। সে জন্য যখন কোনো উন্মত্ত গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, তখন তারা মনে করে এবার ক্ষমতা পেয়েছে এবং ওই ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারবে। লাগায়ও। ভাবে, শত্রু পাওয়া গেছে। শত্রু যে তাদের চেয়েও দুর্বল যে মানুষগুলো তারা নয়, শত্রু যে আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, যা তাদের ক্ষমতাহীন করে রেখেছে, সেই শিক্ষাটা দেওয়ার মতো কোনো সাংস্কৃতিক আয়োজন তো সমাজে নেই।
সাম্প্রদায়িক হামলার পেছনে আরও বড় একটা কারণ রয়েছে সেটা হলো, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার জন্য। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ছিল। কথা ছিল সমাজ হবে ইহজাগতিক, রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। সমাজে ইহজাগতিকতার চর্চা চলবে এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। ধর্ম থাকবে, অবশ্যই থাকবে; কিন্তু ধর্ম হবে যার যার, রাষ্ট্র সবার। যাকে আমরা গণতন্ত্র বলি, সেখানে পৌঁছাতে হলে প্রথম যে পদক্ষেপটি গ্রহণ আবশ্যক, সেটি হলো এই ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু সেই পদক্ষেপ আমরা নিতে পারিনি। আমরা পিছিয়ে এসেছি।
এখন তো দেখা যাচ্ছে প্রগতিশীলেরাও আর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন না। বড়জোর বলেন অসাম্প্রদায়িকতার কথা, ভেতর থেকে সংকোচ এসে তাঁদের থামিয়ে দেয়। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপস করে। এদিকে ধর্ম ব্যবসায়ীদের তৎপরতার তো কোনো অবধি নেই। মাদ্রাসায় শিক্ষিত দরিদ্র মানুষদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করার চেষ্টা ক্রমেই বেগবান হচ্ছে। একটি গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে যে জঙ্গিদের সংগঠনগুলো উত্তরবঙ্গের চরাঞ্চলে বঞ্চিত মানুষদের দলে টানছে; টানাটা সহজও বটে। ক্ষমতাহীন মানুষ ক্ষমতার সামান্যতম আশায়ও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। সচ্ছল পরিবারের ছেলেরাও যে জঙ্গি হয়, তার পেছনেও ওই ক্ষমতাপ্রাপ্তির প্রত্যাশাটা থাকে।
ওদিকে ধর্মকে ব্যবহার করে যারা রাজনৈতিক শক্তি সংগ্রহ করে, আসলে যারা ধর্মবণিকই, তারা ঠিকই প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন দেশের সর্বত্র রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগে সামাজিক মিলনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, কিন্তু সেই চাহিদা উপেক্ষা করে যদি মধ্যপ্রাচ্যের আর্থিক সাহায্যে আদর্শ মসজিদ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি নেওয়া হয়, তাহলে বুঝতে কি কোনো অসুবিধা থাকে যে সাংস্কৃতিক হাওয়াটা কোন দিকে বইছে? পীর সাহেবদের কেউ কেউ রাজনীতি করেন। অতীতের মতো এখনো করে থাকেন। যেমন রাজারবাগের পীর। তাঁর মুরিদেরা তো আছেনই; তিনি একটি দৈনিক ও একটি মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করে থাকেন বলে ঢাকা শহরের দেয়ালে দেয়ালে লেখা দেখা যায়। মাসব্যাপী তিনি সুন্নি সম্মেলন করে থাকেন। কিন্তু সম্প্রতি এক মামলার ফলে বেরিয়ে এসেছে ধর্মীয় আচ্ছাদনে এবং অবৈধ উপায়ে তিনি প্রভূত সম্পত্তি সংগ্রহ করেছেন। এ রকম কাজ অন্য পীরদেরও কেউ কেউ নির্বিঘ্নে করে থাকেন বলে ধারণা করাটা মোটেই বেঠিক নয়।
ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির চর্চার ক্ষেত্রে অগ্রসর ও নির্ভরযোগ্য ভূমিকা পালন করার কথা বামপন্থীদের। কিন্তু আমাদের বামপন্থীরা সুবিধা করতে পারছে না। তার একটা বড় কারণ কিন্তু এই যে, তাদের প্রতিহত করার জন্য রাষ্ট্রশাসক বুর্জোয়াদের সবাই ঐক্যবদ্ধ। কারণ বুর্জোয়ারা জানে যে বামপন্থীদের নিজেদের ভেতর যত পার্থক্যই থাকুক, সবাই তারা পুঁজিবাদবিরোধী।
ভারতের রাজনীতি-প্রবাহ বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য তো করছেই না, উল্টো বৈরিতাই করে চলেছে। ভারতের সঙ্গে পানিবণ্টন, অসম বাণিজ্য এবং সীমান্ত সংঘর্ষের অবসান না ঘটে উল্টো বৃদ্ধিই পেয়েছে, তাতেও আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতা উৎসাহ পাচ্ছে।
তরুণদের দেশপ্রেমিক ও সৃষ্টিশীল করে তোলার জন্য যে সাংস্কৃতিক কাজ দরকার, সেটা বাংলাদেশে এখন নেই। উন্নতির হুকুমদারিতে সংস্কৃতি দমিত হচ্ছে। আর তার কুফল সবচেয়ে গভীরভাবে বহন করছে তরুণ সমাজ।
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
৭ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
৭ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
৭ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
৮ ঘণ্টা আগে