উপসম্পাদকীয়
মহামান্য হাইকোর্ট নদীকে ‘জীবন্তসত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০১৩ সালে ৩৫০৩ / ২০০৯ নম্বর রিট পিটিশনের রায়ে নদ-নদী সংরক্ষণ বিষয়ে হাইকোর্ট বিশেষ নির্দেশনা জারি করেন। সংবিধানের ১৮ (ক) ধারায় উল্লেখ আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নদীকে দেশের রক্তজালিকার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘মানবদেহের রক্ত সঞ্চালন জালিকা বাধাগ্রস্ত হলে যেমন মানবদেহ বিপন্ন হয়; তেমনি এ দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয়, জলাধার অবৈধ দখল হলে দেশে বিপর্যয় ঘটে।’ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রধানমন্ত্রীর এই চিন্তাকে তাঁর ‘নদী-দর্শন’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। নদী নিয়ে সংবিধান, বিচার বিভাগ কিংবা প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ সব অঙ্গীকার ও ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও দেশের নদীগুলো প্রতিদিন খুন হচ্ছে সবার সমানে। সংবিধান, হাইকোর্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রীর নদী-চিন্তাকে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না।
দেশের প্রতিটি নদী এখন হয় নিহত, নয় মুমূর্ষু। মরণযন্ত্রণায় কাতর। যদিও বিস্ময়করভাবে রাষ্ট্রীয় নথিতে নদ-নদীর সংখ্যা বেড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০৫ সালে ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ শিরোনামে একটি বিশাল বই প্রকাশ করে। সেখানে ২৩০টি নদ-নদীর বিবরণ ছিল। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ‘বাংলাদেশের নদ-নদীর সংজ্ঞা ও সংখ্যা’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করে ২০২৩ সালে। নতুন এই রাষ্ট্রীয় প্রকাশনায় ১ হাজার ৮টি নদ-নদীর বিবরণ আছে, মানে প্রায় ২০ বছরে রাষ্ট্র ৭৭৮টি নদ-নদীর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে।
কতগুলো নিহত ও নিখোঁজ এর কোনো হদিস নেই। উল্লিখিত রাষ্ট্রীয় দুই নথি আমাদের কী জানায়? বহুবিধ তথ্যদানের পাশাপাশি নদী নিয়ে আমাদের অবহেলা ও উদাসীনতাকেও প্রকাশ করে এই সব রাষ্ট্রীয় দলিল। বাংলাদেশের অন্যতম প্রায় সব নদ-নদী নিয়েই গণমাধ্যমে যেসব খবর আসে, সেই সব আমাদের বিষণ্ন ও ক্ষুব্ধ করে। বুড়িগঙ্গা, পদ্মা, কর্ণফুলী, সোমেশ্বরী, যাদুকাটা, শীতলক্ষ্যা, হালদা, তিতাস, যমুনা, সুরমা, ব্রহ্মপুত্র কিংবা যেকোনো নদী নিয়েই কেবল দখল, দূষণ কিংবা দুর্নীতির খবর।
এই লেখাটি পৃথিবীর অন্যতম নদী হালদাকে নিয়ে। হালদা নামে দেশে দুটি নদী আছে। সুনামগঞ্জের ছাতকে একটি এবং অন্যটি চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়িতে প্রবাহিত। আমরা কথা বলব দ্বিতীয় হালদাকে নিয়ে। প্রতিটি নদীর অবিস্মরণীয় সব পরিবেশগত অবদান আছে। বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য-থালা এবং জীবনজীবিকা সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করা নদী হালদা। কারণ হালদা নদীর রেণুপোনা দিয়েই মূলত গড়ে উঠেছে দেশের মৎস্য-অর্থনীতির ভিত।
দেশের প্রাণিজ আমিষ ও মৎস্য-অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রাখা হালদা নদীর সঙ্গেও চলমান নির্দয় আচরণ থামানো যাচ্ছে না। ‘হালদার “স্বাস্থ্য খারাপ” তিন খালের বর্জ্যে’ শিরোনামে দৈনিক আজকের পত্রিকা ৭ নভেম্বর একটি বিশেষ প্রতিবেদন ছেপেছে। প্রতিবেদনটি জানায়, কুয়াইশ খাল, কৃষ্ণ খাল ও কাটাখালী খালের বর্জ্যে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে হালদা। কৃষ্ণ খাল হাটহাজারীর পশ্চিম কুয়াইশের অনন্যা আবাসিক এলাকার পূর্ব পাশে হালদায় মিশেছে।
কুয়াইশ খাল হাটহাজারীর শিকারপুর ইউনিয়নের লালাচন্দ্র বিল হয়ে হালদায় মিশেছে এবং কাটাখালী খাল হাটহাজারীর চিকনদণ্ডীর বড়দীঘির দক্ষিণপাড়া হয়ে হালদায় মিশেছে। চট্টগ্রাম নগরসহ স্থানীয় গৃহস্থালি ও পোলট্রিবর্জ্যে দূষিত হচ্ছে হালদা নদী। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা এই নদীর এ দশা কেন? পরিবেশমন্ত্রী কিংবা মৎস্যমন্ত্রী কী জবাব দেবেন? চট্টগ্রামের জনপ্রতিনিধিরা এই নদীর জন্য কী করেছেন? স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং প্রশাসন কী করছে? কেন সবার সামনে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই নদী খুন হচ্ছে? কেন কোনো জবাবদিহি নেই?
সংবিধান এবং হাইকোর্টের রায় লঙ্ঘন করে হালদাকে দূষিত করার ক্ষমতা অভিযুক্তরা পায় কোথায়? প্রধানমন্ত্রীর নদী-দর্শনকে তোয়াক্কা না করে হালদার চারধারে কীভাবে বিপজ্জনক বাণিজ্য টিকে থাকছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের অবশ্যই খুঁজতে হবে। নদীর প্রতি কোনো অন্যায়, অবিচার, উদাসীনতা এবং দায়িত্বহীনতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী ইশতেহারে নদী বাঁচানোর সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করতে হবে। হালদা নদীর দখল ও দূষণের সঙ্গে কোনো প্রার্থীর ন্যূনতম সম্পর্ক প্রমাণিত হলে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হোক। হালদা যাঁরা খুন করেন, তাঁদের ভোট দেব না—এই হোক নতুন প্রজন্মের অঙ্গীকার।
বিভিন্ন ঋতুতে একটা লম্বা সময় হালদাপারের জেলেজীবন থেকে হালদাকে পাঠ করার সামান্য কিছু অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। দেখেছি ঘোর অমাবস্যা এবং ভরা পূর্ণিমায় জোয়ার-ভাটার খেলা। ডিম সংগ্রহ ঋতুতে একবার ঝড়জলের ভেতর প্রচণ্ড বজ্রপাতের রাতে হালদায় থাকার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল। এর আগে দীর্ঘ অনাবৃষ্টিকাল আর গ্রামে গ্রামে শঙ্কিত জেলেদের ভয়ার্ত সেই সব চেহারার ঝলকানি এখনো স্মৃতিতে তড়পায়।
নদীর ‘কুমের’ সুরক্ষা, জলের ‘জো’ আসার জন্য অপেক্ষা কিংবা পানির জন্য মানত বহু জটিল সব প্রতিবেশবিদ্যা শিখেছিলাম তখন। হালদা নদী সুরক্ষায় হালদাপারের জেলেদের লোকায়ত নদী ও মৎস্যবিজ্ঞানকে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নচিন্তায় যুক্ত করা হয়নি। এমনকি একটুখানি সম্মান বা স্বীকৃতিও দেওয়া হয়নি; বরং বহিরাগত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই নদীকে ছিন্নভিন্ন করেছেন নিজেদের বাণিজ্য আর একতরফা মুনাফার জন্য। রাষ্ট্রও দারুণভাবে এই ক্ষতবিক্ষত নদীটিকে আগলে দাঁড়ায়নি।
অথচ মুমূর্ষু শরীরে সব রক্তদাগ সামলে এখনো এই নদী দেশের মৎস্য খাতের উল্লেখযোগ্য রেণুপোনার জোগান দিয়ে চলেছে। আর ভোক্তা হিসেবে দেশের নানা প্রান্তে বসে আমরা সেই সব রেণুপোনা থেকে বড় হওয়া মাছেদের গোগ্রাসে গিলছি। ভোক্তা হিসেবেও আমরা হালদা নদী বাঁচানোর কোনো দায় অন্তরে অনুভব করিনি। তাহলে কীভাবে আমরা মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার কথা বলব?
হালদার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন একজন মনজুরুল কিবরিয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক গবেষণা, সামাজিক কর্মসূচি, প্রচারাভিযান, লেখালেখি, সচেতনতা নানাভাবে হালদাকে বাঁচাতে তৎপর আছেন। পোলট্রি ও গৃহস্থালি বর্জ্যের দূষণ, নদীর বাঁক কাটা এবং ভাঙন ঠেকাতে যত্রতত্র পাথর ফেলে হালদাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে বলে মনে করেন হালদার এই গবেষক। তাঁর গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ জানায়, ২০২৩ সালে এই নদী থেকে ১৮ হাজার কেজি কার্পজাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে।
নদ-নদীর বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্ট্যে বাংলাদেশকে ১৭টি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। হালদা হলো পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের নদী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীটির শনাক্তকরণ নম্বর দিয়েছে ১৬। প্রায় ১০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী মানিকছড়ির বাটনাতলী পাহাড় থেকে জন্ম নিয়ে ফটিকছড়ি হয়ে হাটহাজারী, রাউজান হয়ে কর্ণফুলীতে মিশেছে। অনেকে বলেন, বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ি গ্রাম সালদার পাহাড়ি ঝরনা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদাছড়া থেকে একসময় হালদা নাম পায়।
হালদাপারের জীবনসংগ্রাম নিয়ে ‘হালদা’ নামে সিনেমা বানিয়েছেন তৌকীর আহমেদ। আজাদ বুলবুলের গল্প থেকে সিনেমার কাহিনিটি নেওয়া হয়েছে। সিনেমার নিবারণ জেলের কথা কি আমাদের মনে আছে? হাসু, বদিউজ্জামাল কিংবা মনু মিয়ার কথা? সিনেমার হালদার এই মানুষেরা হালদাপারেও আছেন।
হালদার বিরূপ কঠিন পরিণতি এই মানুষদের জীবনে প্রতিদিন অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অনাবৃষ্টি, তীব্র তাপপ্রবাহ সামগ্রিকভাবে নদীতে ‘জো’ আসার পরিবেশ তৈরিতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। সময়মতো তীব্র ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাত না হওয়ায় বহু মা মাছ প্রসবযন্ত্রণায় পেট ফেটে মারা যায়। প্রাকৃতিকভাবে ডিম নিষিক্তকরণে সমস্যা বাড়ছে। হালদা ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো জোয়ার-ভাটার নদীতে কার্পজাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে না।
বিপুল ঐশ্বর্যের এই নদীকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে। হালদাকে বাঁচাতে হাটহাজারীর বিদ্যুৎ প্রকল্প কিংবা এশিয়ান পেপার মিল বন্ধ করা গেছে। তাহলে দখল ও দূষণের মাস্তানি থেকে কেন হালদাকে রক্ষা করা যাচ্ছে না? হালদা মরলে দুয়েকজন প্রভাবশালী লুটেরার লাভ হতে পারে, কিন্তু ক্ষতি আমাদের সবার।
মহামান্য হাইকোর্ট নদীকে ‘জীবন্তসত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০১৩ সালে ৩৫০৩ / ২০০৯ নম্বর রিট পিটিশনের রায়ে নদ-নদী সংরক্ষণ বিষয়ে হাইকোর্ট বিশেষ নির্দেশনা জারি করেন। সংবিধানের ১৮ (ক) ধারায় উল্লেখ আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নদীকে দেশের রক্তজালিকার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘মানবদেহের রক্ত সঞ্চালন জালিকা বাধাগ্রস্ত হলে যেমন মানবদেহ বিপন্ন হয়; তেমনি এ দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয়, জলাধার অবৈধ দখল হলে দেশে বিপর্যয় ঘটে।’ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রধানমন্ত্রীর এই চিন্তাকে তাঁর ‘নদী-দর্শন’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। নদী নিয়ে সংবিধান, বিচার বিভাগ কিংবা প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ সব অঙ্গীকার ও ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও দেশের নদীগুলো প্রতিদিন খুন হচ্ছে সবার সমানে। সংবিধান, হাইকোর্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রীর নদী-চিন্তাকে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না।
দেশের প্রতিটি নদী এখন হয় নিহত, নয় মুমূর্ষু। মরণযন্ত্রণায় কাতর। যদিও বিস্ময়করভাবে রাষ্ট্রীয় নথিতে নদ-নদীর সংখ্যা বেড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০৫ সালে ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ শিরোনামে একটি বিশাল বই প্রকাশ করে। সেখানে ২৩০টি নদ-নদীর বিবরণ ছিল। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ‘বাংলাদেশের নদ-নদীর সংজ্ঞা ও সংখ্যা’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করে ২০২৩ সালে। নতুন এই রাষ্ট্রীয় প্রকাশনায় ১ হাজার ৮টি নদ-নদীর বিবরণ আছে, মানে প্রায় ২০ বছরে রাষ্ট্র ৭৭৮টি নদ-নদীর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে।
কতগুলো নিহত ও নিখোঁজ এর কোনো হদিস নেই। উল্লিখিত রাষ্ট্রীয় দুই নথি আমাদের কী জানায়? বহুবিধ তথ্যদানের পাশাপাশি নদী নিয়ে আমাদের অবহেলা ও উদাসীনতাকেও প্রকাশ করে এই সব রাষ্ট্রীয় দলিল। বাংলাদেশের অন্যতম প্রায় সব নদ-নদী নিয়েই গণমাধ্যমে যেসব খবর আসে, সেই সব আমাদের বিষণ্ন ও ক্ষুব্ধ করে। বুড়িগঙ্গা, পদ্মা, কর্ণফুলী, সোমেশ্বরী, যাদুকাটা, শীতলক্ষ্যা, হালদা, তিতাস, যমুনা, সুরমা, ব্রহ্মপুত্র কিংবা যেকোনো নদী নিয়েই কেবল দখল, দূষণ কিংবা দুর্নীতির খবর।
এই লেখাটি পৃথিবীর অন্যতম নদী হালদাকে নিয়ে। হালদা নামে দেশে দুটি নদী আছে। সুনামগঞ্জের ছাতকে একটি এবং অন্যটি চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়িতে প্রবাহিত। আমরা কথা বলব দ্বিতীয় হালদাকে নিয়ে। প্রতিটি নদীর অবিস্মরণীয় সব পরিবেশগত অবদান আছে। বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য-থালা এবং জীবনজীবিকা সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করা নদী হালদা। কারণ হালদা নদীর রেণুপোনা দিয়েই মূলত গড়ে উঠেছে দেশের মৎস্য-অর্থনীতির ভিত।
দেশের প্রাণিজ আমিষ ও মৎস্য-অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রাখা হালদা নদীর সঙ্গেও চলমান নির্দয় আচরণ থামানো যাচ্ছে না। ‘হালদার “স্বাস্থ্য খারাপ” তিন খালের বর্জ্যে’ শিরোনামে দৈনিক আজকের পত্রিকা ৭ নভেম্বর একটি বিশেষ প্রতিবেদন ছেপেছে। প্রতিবেদনটি জানায়, কুয়াইশ খাল, কৃষ্ণ খাল ও কাটাখালী খালের বর্জ্যে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে হালদা। কৃষ্ণ খাল হাটহাজারীর পশ্চিম কুয়াইশের অনন্যা আবাসিক এলাকার পূর্ব পাশে হালদায় মিশেছে।
কুয়াইশ খাল হাটহাজারীর শিকারপুর ইউনিয়নের লালাচন্দ্র বিল হয়ে হালদায় মিশেছে এবং কাটাখালী খাল হাটহাজারীর চিকনদণ্ডীর বড়দীঘির দক্ষিণপাড়া হয়ে হালদায় মিশেছে। চট্টগ্রাম নগরসহ স্থানীয় গৃহস্থালি ও পোলট্রিবর্জ্যে দূষিত হচ্ছে হালদা নদী। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা এই নদীর এ দশা কেন? পরিবেশমন্ত্রী কিংবা মৎস্যমন্ত্রী কী জবাব দেবেন? চট্টগ্রামের জনপ্রতিনিধিরা এই নদীর জন্য কী করেছেন? স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং প্রশাসন কী করছে? কেন সবার সামনে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই নদী খুন হচ্ছে? কেন কোনো জবাবদিহি নেই?
সংবিধান এবং হাইকোর্টের রায় লঙ্ঘন করে হালদাকে দূষিত করার ক্ষমতা অভিযুক্তরা পায় কোথায়? প্রধানমন্ত্রীর নদী-দর্শনকে তোয়াক্কা না করে হালদার চারধারে কীভাবে বিপজ্জনক বাণিজ্য টিকে থাকছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের অবশ্যই খুঁজতে হবে। নদীর প্রতি কোনো অন্যায়, অবিচার, উদাসীনতা এবং দায়িত্বহীনতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী ইশতেহারে নদী বাঁচানোর সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করতে হবে। হালদা নদীর দখল ও দূষণের সঙ্গে কোনো প্রার্থীর ন্যূনতম সম্পর্ক প্রমাণিত হলে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হোক। হালদা যাঁরা খুন করেন, তাঁদের ভোট দেব না—এই হোক নতুন প্রজন্মের অঙ্গীকার।
বিভিন্ন ঋতুতে একটা লম্বা সময় হালদাপারের জেলেজীবন থেকে হালদাকে পাঠ করার সামান্য কিছু অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। দেখেছি ঘোর অমাবস্যা এবং ভরা পূর্ণিমায় জোয়ার-ভাটার খেলা। ডিম সংগ্রহ ঋতুতে একবার ঝড়জলের ভেতর প্রচণ্ড বজ্রপাতের রাতে হালদায় থাকার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল। এর আগে দীর্ঘ অনাবৃষ্টিকাল আর গ্রামে গ্রামে শঙ্কিত জেলেদের ভয়ার্ত সেই সব চেহারার ঝলকানি এখনো স্মৃতিতে তড়পায়।
নদীর ‘কুমের’ সুরক্ষা, জলের ‘জো’ আসার জন্য অপেক্ষা কিংবা পানির জন্য মানত বহু জটিল সব প্রতিবেশবিদ্যা শিখেছিলাম তখন। হালদা নদী সুরক্ষায় হালদাপারের জেলেদের লোকায়ত নদী ও মৎস্যবিজ্ঞানকে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নচিন্তায় যুক্ত করা হয়নি। এমনকি একটুখানি সম্মান বা স্বীকৃতিও দেওয়া হয়নি; বরং বহিরাগত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই নদীকে ছিন্নভিন্ন করেছেন নিজেদের বাণিজ্য আর একতরফা মুনাফার জন্য। রাষ্ট্রও দারুণভাবে এই ক্ষতবিক্ষত নদীটিকে আগলে দাঁড়ায়নি।
অথচ মুমূর্ষু শরীরে সব রক্তদাগ সামলে এখনো এই নদী দেশের মৎস্য খাতের উল্লেখযোগ্য রেণুপোনার জোগান দিয়ে চলেছে। আর ভোক্তা হিসেবে দেশের নানা প্রান্তে বসে আমরা সেই সব রেণুপোনা থেকে বড় হওয়া মাছেদের গোগ্রাসে গিলছি। ভোক্তা হিসেবেও আমরা হালদা নদী বাঁচানোর কোনো দায় অন্তরে অনুভব করিনি। তাহলে কীভাবে আমরা মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার কথা বলব?
হালদার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন একজন মনজুরুল কিবরিয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক গবেষণা, সামাজিক কর্মসূচি, প্রচারাভিযান, লেখালেখি, সচেতনতা নানাভাবে হালদাকে বাঁচাতে তৎপর আছেন। পোলট্রি ও গৃহস্থালি বর্জ্যের দূষণ, নদীর বাঁক কাটা এবং ভাঙন ঠেকাতে যত্রতত্র পাথর ফেলে হালদাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে বলে মনে করেন হালদার এই গবেষক। তাঁর গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ জানায়, ২০২৩ সালে এই নদী থেকে ১৮ হাজার কেজি কার্পজাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে।
নদ-নদীর বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্ট্যে বাংলাদেশকে ১৭টি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। হালদা হলো পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের নদী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীটির শনাক্তকরণ নম্বর দিয়েছে ১৬। প্রায় ১০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী মানিকছড়ির বাটনাতলী পাহাড় থেকে জন্ম নিয়ে ফটিকছড়ি হয়ে হাটহাজারী, রাউজান হয়ে কর্ণফুলীতে মিশেছে। অনেকে বলেন, বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ি গ্রাম সালদার পাহাড়ি ঝরনা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদাছড়া থেকে একসময় হালদা নাম পায়।
হালদাপারের জীবনসংগ্রাম নিয়ে ‘হালদা’ নামে সিনেমা বানিয়েছেন তৌকীর আহমেদ। আজাদ বুলবুলের গল্প থেকে সিনেমার কাহিনিটি নেওয়া হয়েছে। সিনেমার নিবারণ জেলের কথা কি আমাদের মনে আছে? হাসু, বদিউজ্জামাল কিংবা মনু মিয়ার কথা? সিনেমার হালদার এই মানুষেরা হালদাপারেও আছেন।
হালদার বিরূপ কঠিন পরিণতি এই মানুষদের জীবনে প্রতিদিন অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অনাবৃষ্টি, তীব্র তাপপ্রবাহ সামগ্রিকভাবে নদীতে ‘জো’ আসার পরিবেশ তৈরিতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। সময়মতো তীব্র ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাত না হওয়ায় বহু মা মাছ প্রসবযন্ত্রণায় পেট ফেটে মারা যায়। প্রাকৃতিকভাবে ডিম নিষিক্তকরণে সমস্যা বাড়ছে। হালদা ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো জোয়ার-ভাটার নদীতে কার্পজাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে না।
বিপুল ঐশ্বর্যের এই নদীকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে। হালদাকে বাঁচাতে হাটহাজারীর বিদ্যুৎ প্রকল্প কিংবা এশিয়ান পেপার মিল বন্ধ করা গেছে। তাহলে দখল ও দূষণের মাস্তানি থেকে কেন হালদাকে রক্ষা করা যাচ্ছে না? হালদা মরলে দুয়েকজন প্রভাবশালী লুটেরার লাভ হতে পারে, কিন্তু ক্ষতি আমাদের সবার।
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
৮ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
৮ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
৯ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
৯ ঘণ্টা আগে