বিভুরঞ্জন সরকার
১৯৯৬ সালে সাপ্তাহিক চলতিপত্র নামে আমার সম্পাদনায় একটি পত্রিকা বের হয়। পত্রিকাটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। চলতিপত্র অফিসে একদিন আনোয়ার কবির এসে আমার হাতে একটি লেখা দিলেন। বেশ বড় লেখা। পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপার অনুরোধ করে বললেন, ‘অনেক খেটেখুটে লেখাটি তৈরি করেছি। ছাপলে চলতিপত্র আলোচনায় আসবে এবং কাটতিও বাড়বে।’
সাংবাদিক আনোয়ার কবির আমার পূর্ব পরিচিত। কিন্তু ওকে দেখে আমার কেমন শিশু শিশু লাগত। তবে সাংবাদিকতায় ওর অনুসন্ধানী মনোভাব আমি পছন্দ করতাম। আনোয়ার কবির বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সবগুলোতেই পরিশ্রমের ছাপ আছে। জনকণ্ঠসহ কয়েকটি কাগজে চাকরি করলেও এখন তিনি পেশা বদল করেছেন। আনোয়ার কবির এখন ইসলামি ফাউন্ডেশনে একটি ভালো চাকরি করছেন।
চলতিপত্রে ছাপার জন্য যে বিষয়ে লিখেছেন, সেটা ওর পক্ষে লেখা সম্ভব কি না, তা নিয়ে আমার মনে একটু সংশয় দেখা দিল।
বিষয়টি ছিল ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের ক্যু এবং তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে। ইন্টারেস্টিং বিষয় নিঃসন্দেহে। কিন্তু কবির এতসব তথ্য পেলেন কোথায়? কেউ কি তাঁকে দিয়ে লেখাটি লিখিয়ে নিয়েছেন? কবিরই বা লেখার এমন একটি বিষয় বেছে নিলেন কেন?
আমি কবিরকে বললাম, ‘আপনার লেখাটি আমি ছাপব। তবে তার আগে আমাকে বলতে হবে লেখাটি লেখার জন্য আপনি যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তাদের দু-একজনের সঙ্গে আমাকেও পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। কথা বলিয়ে দিতে হবে।’
কবির রাজি হলেন। একদিন সকালে এ পথ, ও পথ ঘুরিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমের বাসায়। ইব্রাহিম সাহেব এখন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান বা প্রধান।
তাঁর সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় থাকার কোনো কারণ ছিল না। বলতে দ্বিধা নেই, প্রথম দেখায় এবং আলোচনায় ইব্রাহিম সাহেবকে আমার ভালোই লেগেছিল। তাঁকে চৌকস এবং জানাবোঝা একজন মানুষ বলেই মনে হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমি আনোয়ার কবিরের লেখাটি চলতিপত্রে ছাপার সিদ্ধান্ত নিই। বুঝতে পারি তাঁর মতো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেই কবির লেখাটি তৈরি করেছে।
এর মধ্যে কবির আমার সঙ্গে জেনারেল নাসিম, জেনারেল আয়েনউদ্দিনসহ আরও কয়েকজনের কথা বলিয়ে দেন। ওই ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে এরা জড়িত থাকায় সামরিক বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
চলতিপত্রে লেখাটির প্রথম কিস্তি ছাপার পরই আমার ওপর শুরু হলো নানামুখী চাপ। সেনাবাহিনীর অনেকেই লেখাটিকে ভালোভাবে নিতে পারেননি। কারণ, লেখায় সেনাবাহিনীর ভেতরের দ্বন্দ্ব-বিরোধের খবর যেভাবে প্রকাশ পাচ্ছিল, সেগুলো হজম করা কারও কারও পক্ষে সহজ ছিল না। এক সন্ধ্যায় এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে দেখা হলো জাসদ নেতা কাজী আরিফের সঙ্গে। তিনি আমাকে সাবধান থাকতে বললেন।
আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। আরিফ ভাই বলেছিলেন, আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া হতে পারে। ভয়ে আমার কাঁপাকাঁপি অবস্থা। কোথাও কি পালিয়ে যাব? আনোয়ার কবিরও হুমকি পেয়ে কয়েক দিনের জন্য গা-ঢাকা দিলেন।
আমি কী করি? আমি কি পালিয়ে বাঁচতে পারব? পরদিন সকালেই চলতিপত্রের ফোন বেজে উঠল। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদর দপ্তর থেকে আমাকে চায়ের দাওয়াত দিয়ে তৈরি থাকতে বলা হলো। গাড়ি আসবে আমাকে নিয়ে যেতে।
আধা ঘণ্টার মধ্যেই একটা জিপ গাড়ি এসে উপস্থিত হলো চলতিপত্র অফিসের সামনে। এক বুক ভয় নিয়ে নতুন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চললাম আমি। গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে নিয়ে আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হবে, না খারাপ ব্যবহার করা হবে, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কারও সঙ্গে যে পরামর্শ করব, তারও সুযোগ পাইনি। রাগ হচ্ছিল আনোয়ার কবিরের ওপর। ওর জন্যই তো আমাকে এসব হ্যাপা পোহাতে হচ্ছে।
ঘটনা এখন থেকে প্রায় ২৫ বছর আগের। তখনো ঢাকা এমন জ্যামের শহরে পরিণত হয়নি। ফলে গন্তব্যে পৌঁছতে ১৫ / ২০ মিনিটের বেশি সময় লাগল না।
ওই সংস্থা সম্পর্কে নানা কথা শুনেছি। তাদের ‘পাওয়ার’ সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। শুধু শুনেছি যে, তারা প্রবল ক্ষমতাধর।
মনে মনে ভাবি, গণতান্ত্রিক শাসন আমলে নিশ্চয়ই আগের শাসন আমলের মতো পরিস্থিতি নেই। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে গাড়ি থেকে নামলাম। আমাকে দুই বা তিনতলার একটি কক্ষে নেওয়া হলো। শীততাপনিয়ন্ত্রিত একটি ছিমছাম কক্ষ। লম্বা একটি টেবিল। একপাশে একটি মাত্র চেয়ার। বিপরীত দিকে পাঁচটি চেয়ার লাগানো। পেছনে বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি। ছবিটি দেখে মনের মধ্যে সাহস ফিরে পেলাম। ভেতর থেকে আমার অন্তরাত্মা যেন বলছে, ‘তুই এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? তুই তো কোনো দোষ করিসনি। তুই তোর পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছিস। এরাও এদের দায়িত্বই পালন করছে। এখানে ভয়ভীতির কিছু নেই।’
আমি ঢুকে রুমটি খালি দেখতে পাই। তবে সেটা মুহূর্তের জন্য। প্রায় আমার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য দরজা দিয়ে রুমে ঢুকলেন পাঁচজন কর্মকর্তা। সামনের একক চেয়ারটিতে আমাকে বসতে বলে তাঁরা উল্টো দিকের পাঁচ চেয়ারে পাঁচজন বসলেন। হাসি মুখে আমাকে স্বাগত জানালেন। একে একে পাঁচজনই নাম বলে করমর্দন করলেন।
শুরু হলো আমার পরিচিতি নিয়ে হালকা কিছু প্রশ্ন দিয়ে। বাড়ি কোথায়, বাবা-মা, ভাইবোন, লেখাপড়া, আমার স্ত্রী-সন্তান ইত্যাদি।
আমার মনে হলো, না, ভয়ের কিছু হয়তো নেই। নাশতা পরিবেশন করা হলো। স্যান্ডউইচ অবশ্যই ছিল, আরও আইটেম ছিল। কিন্তু এখন মনে করতে পারছি না। কোমল পানীয় ছিল আমার প্রিয় ‘কোক’। গরম পানীয় হিসেবে চা না কফি পরিবেশন করা হয়েছিল, সেটাও মনে নেই। তবে কফি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। নাশতার ফাঁকে টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছে। আমি যায়যায়দিনের চাকরি কেন ছাড়লাম, কীভাবে, কেন চলতিপত্র বের করলাম, কারা টাকা দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে ইত্যাদি। ভারতে আমার আত্মীয়স্বজন আছেন কি না, কত দিন পরপর ইন্ডিয়া যাই ইত্যাদি প্রশ্নও বাদ গেল না।
তারপর উঠল আসল প্রসঙ্গ। তাদের সবার হাতেই একটি করে ফাইল। ফাইল খুলে বের করা হলো চলতিপত্রের একটি কপি। আনোয়ার কবিরের লেখাটি বের করে একজন সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘এই লেখাটি আপনি কেন ছাপলেন? এটা কি আমাদের সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন বা ক্ষতিগ্রস্ত করবে না?’
আমি বললাম, ‘যে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে, তারই তথ্যভিত্তিক একটি নির্দোষ প্রতিবেদন এটা। ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল, তার বিবরণ। কাউকে হেয় করা, কারও বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য উপস্থাপন করা, কারও প্রতি বিদ্বিষ্ট হওয়ার মতো কিছু লেখাটিতে নেই বলেই এটা আমি ছেপেছি। দেশবাসীকে সত্য তথ্য জানানো ছাড়া এটা ছাপার আর কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই।’
একজন এবার একটু রূঢ়ভাবেই বললেন, ‘বিভু বাবু (বাবু শব্দটার ওপর মনে হলো একটু বেশি জোর পড়েছিল), কাজটি আপনি ভালো করেননি। সেনাবাহিনীর কোনো কিছু লেখার আগে আপনার উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেওয়া।’
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরেকজন বললেন, ‘দেশে এখন গণতান্ত্রিক শাসন না থাকলে আপনার অবস্থা কী হতো, আপনি কি তা অনুমান করতে পারেন?’
এটা কি ভয় দেখানো, নাকি আর কিছু? আমি বলি, ‘দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে বলেই তো এটা ছাপার সাহস করেছি।’
বয়সে সবচেয়ে তরুণ কর্মকর্তাটি বললেন, ‘আপনি সাহস না, দুঃসাহস দেখিয়েছেন। এটা ছাপা আপনাকে বন্ধ করতে হবে।’
আমার ভয় ততক্ষণে কিছুটা কেটেছে। কথাবার্তা ও আচার-আচরণে আমি বুঝে গেছি যে, বড় কোনো বিপদ বা ঝামেলা আমার সামনে অপেক্ষা করছে না। সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা নিয়ে আনোয়ার কবিরের লেখাটি ছাপা বন্ধ করলেই আমার আর কোনো অসুবিধা থাকবে না।
তবে আমি লেখাটি ছাপার পক্ষে। তাই বললাম, ‘দেখুন, যেহেতু লেখাটির প্রথম কিস্তি ছাপা হয়েছে, সেহেতু পরের কিস্তিগুলোও আমি ছাপতে চাই। না ছাপলে পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগবে। নানা গুজব ছড়াবে, যেগুলো বরং বেশি ক্ষতির কারণ হতে পারে।’
তা ছাড়া এই লেখায় ক্ষতিকর কোনো উপাদান আছে বলে আমি মনে করি না। এক কর্মকর্তা এক ঢোক কোমল পানীয় মুখে চালান করে স্বাভাবিকভাবেই বললেন, ‘আপনার মনে করাটাই তো শেষ কথা হতে পারে না বিভু বাবু। আমাদেরও কথা আছে এবং সেটা আপনাকে বিবেচনায় নিতে হবে। আপনি লেখাটি ছাপা বন্ধ করুন।’
শেষের বাক্যটি তিনি উচ্চারণ করলেন নির্দেশের মতো করে। আমার ভালো লাগল না। কিছুটা নীরব মুহূর্ত কাটল। কী বলা বা করা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে এক কর্মকর্তা বললেন, ‘আপনার সিদ্ধান্ত আমাদের জানা দরকার। সময় নষ্ট করবেন না প্লিজ।’
আমার শিরদাঁড়া একটু শক্ত হলো বলে অনুভব করলাম। খুব ভাবনা-চিন্তা না করেই বললাম, ‘লেখাটি ছাপা বন্ধ করতে হলে আপনাদের লিখিত নির্দেশনা থাকতে হবে। আমরা পাঠকদের জানিয়ে দেব যে, আপনাদের নির্দেশে ছাপা বন্ধ করা হলো।’
একযোগে সবাই ‘না’ সূচক মাথা দোলাতে থাকলেন। ‘আমরা কোনো লিখিত দেব না এবং লেখাটিও আপনার ছাপা বন্ধ করতে হবে। আমরা নিশ্চিত লেখাটি সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে’—বললেন একজন।
আমি বলি, ‘আপনারা পুরো লেখাটি একবার পড়ে দেখুন। সেদিন যা ঘটেছে এবং ঘটনার পেছনে কার কী ভূমিকা, তার বাইরে কিছুই লেখা হয়নি এতে। আপনারা পুরো লেখাটি ছাপার পর কোনো পয়েন্টে ভিন্নমত অথবা অন্য ব্যাখ্যা দিয়ে আরেকটি লেখা দিতে পারেন। আমি সেটাও ছেপে দেব।’
কর্মকর্তারা নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কিছু শলাপরামর্শ করলেন। তারপর আমাকে বলা হলো, ‘আমরা এ ব্যাপারে আপনাকে আর চাপাচাপি করব না।’ কিন্তু লেখাটি ছাপা অব্যাহত থাকলে আমার যে সমস্যা হতে পারে, সেটাও বারবার আমাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো। সমস্যা কিছু হলেও আমি লেখাটি ছেপে পরিণতি দেখতে চাই।
কর্মকর্তারা আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছিলেন না। আবার আমাকে শাসাতেও পারছিলেন না। দেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায়। এখন সংবাদপত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক কিছু করলে ফল ভালো হবে না মনে করেই আমার প্রতি এক ধরনের উদারতা দেখানো হয়েছে বলে আমার ধারণা।
সময় গড়িয়ে যায়। কিন্তু কথা শেষ হয় না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুই ঘণ্টার বেশি সময় চলে গেছে। আমি এটা বুঝে গেছি যে, আমার জন্য বড় কোনো ভয় অপেক্ষা করছে না। কিছুটা মুহূর্ত নীরব কাটে। তাঁরাও কিছু বলেন না, আমিও কিছু বলি না।
হঠাৎ একজন কর্মকর্তা আবার বলেন, ‘লেখাটি ছাপা বন্ধ করুন মি. সরকার। বেশি সাহস দেখানো ভালো হবে না। লেখক আনোয়ার কবিরের জন্যও ভালো হবে না।’
আমি আমার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করি, ‘আপনারা লেখাটি না ছাপার একটি লিখিত নির্দেশ দিলেই আমি সেটা পাঠকদের জানিয়ে লেখাটি ছাপানো বন্ধ করব। সবচেয়ে ভালো হবে, এই লেখা ছাপা বন্ধ হলে এ নিয়ে কোনো ভিন্ন বক্তব্য থাকলে আপনারা যদি সেটা লিখিত আকারে দেন, তাহলে সেটাও আমি ছেপে দেব।’
‘এটাই আপনার শেষ কথা?’ —জানতে চান একজন।
আমি ভয়ে ভয়ে বলি, ‘হ্যাঁ।’
একজন একটু রুষ্ট স্বরে বলেন, ‘ইন্ডিয়ায় আপনার আত্মীয়-স্বজন কারা আছেন? বছরে কয়বার যান ইন্ডিয়ায়?’
আমি জানাই, ‘আমার তেমন কোনো নিকটাত্মীয় ভারতে নেই। ১৯৭১ সালে বিনা পাসপোর্টে ভারতে গিয়ে নয় মাস ছিলাম। তারপর পাসপোর্ট-ভিসা করে মাত্র একবার কলকাতা গিয়েছি।’ আমি বুঝতে পারি না, এর সঙ্গে ভারতে আমার আত্মীয় থাকা-না থাকা এবং যাওয়া-আসার কী সম্পর্ক থাকতে পারে!
আমাকে একা বসিয়ে রেখে কর্মকর্তারা একযোগে ভেতরে যান। আমার মনে হয়, নিজেদের মধ্যে কিছু শলাপরামর্শ করার জন্যই তাঁরা ভেতরে যান। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসেন একজন। তিনি বলেন, ‘লেখা না ছাপার জন্য আমরা লিখিত কোনো নির্দেশনা দেব না। তবে পরে আমাদের বক্তব্য লিখিত জানানো হবে। সেটা অবিকৃতভাবে আপনাকে ছাপতে হবে।
আমি হাঁফ ছাড়লাম। তাহলে এবারের মতো বিপদ কাটল।
আমাকে লাঞ্চের আমন্ত্রণ জানানো হলো। কিন্তু আমি তখন ওই অফিস থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছিলাম। তাই দুপুরে খাওয়ার প্রস্তাবে রাজি হলাম না। আমি বিদায় নিতে চাইলাম। আমাকে গাড়িতে করে আবার চলতিপত্র অফিসে পৌঁছে দেওয়া হলো।
আনোয়ার কবিরের লেখাটি নিয়মিত ছাপা হতে থাকল। জেনারেল নাসিম কোন প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীকে ‘মুভ’ করাতে চেয়েছিলেন, সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের কার কী ভূমিকা ছিল—এই বিষয়গুলো পাঠক জানতে পারেন। সেনাবাহিনীর ভেতরের খবর সাধারণত জানার উপায় থাকে না। সেদিক দিয়ে আনোয়ার কবিরের লেখাটি ব্যতিক্রম। তাই সেটা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে আমি আনোয়ার কবিরকে কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে বলি। কবির সেটা করেন।
কবিরের লেখাটি ছাপা শেষ হওয়ার পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি দীর্ঘ ব্যাখ্যামূলক লেখা পাঠানো হয় মেজর জেনারেল আবদুল মতিনের নামে। ওই লেখাও চলতিপত্রে পুরোটাই ছাপা হয়েছিল। এই জেনারেল মতিনই এক-এগারোর ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দীনের সময় অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে সামনে এসেছিলেন।
পেছনে ফিরে তাকালে কত কথা মনে পড়ে। স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে কত ছবি। অনেক কথা আবার ভুলেও গেছি। স্মৃতির গুদামঘরটা বুঝি এমনই। নতুন মালের জায়গা করে দেওয়ার জন্য পুরাতন কিছু বের করে দেয়।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
১৯৯৬ সালে সাপ্তাহিক চলতিপত্র নামে আমার সম্পাদনায় একটি পত্রিকা বের হয়। পত্রিকাটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। চলতিপত্র অফিসে একদিন আনোয়ার কবির এসে আমার হাতে একটি লেখা দিলেন। বেশ বড় লেখা। পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপার অনুরোধ করে বললেন, ‘অনেক খেটেখুটে লেখাটি তৈরি করেছি। ছাপলে চলতিপত্র আলোচনায় আসবে এবং কাটতিও বাড়বে।’
সাংবাদিক আনোয়ার কবির আমার পূর্ব পরিচিত। কিন্তু ওকে দেখে আমার কেমন শিশু শিশু লাগত। তবে সাংবাদিকতায় ওর অনুসন্ধানী মনোভাব আমি পছন্দ করতাম। আনোয়ার কবির বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সবগুলোতেই পরিশ্রমের ছাপ আছে। জনকণ্ঠসহ কয়েকটি কাগজে চাকরি করলেও এখন তিনি পেশা বদল করেছেন। আনোয়ার কবির এখন ইসলামি ফাউন্ডেশনে একটি ভালো চাকরি করছেন।
চলতিপত্রে ছাপার জন্য যে বিষয়ে লিখেছেন, সেটা ওর পক্ষে লেখা সম্ভব কি না, তা নিয়ে আমার মনে একটু সংশয় দেখা দিল।
বিষয়টি ছিল ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের ক্যু এবং তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে। ইন্টারেস্টিং বিষয় নিঃসন্দেহে। কিন্তু কবির এতসব তথ্য পেলেন কোথায়? কেউ কি তাঁকে দিয়ে লেখাটি লিখিয়ে নিয়েছেন? কবিরই বা লেখার এমন একটি বিষয় বেছে নিলেন কেন?
আমি কবিরকে বললাম, ‘আপনার লেখাটি আমি ছাপব। তবে তার আগে আমাকে বলতে হবে লেখাটি লেখার জন্য আপনি যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তাদের দু-একজনের সঙ্গে আমাকেও পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। কথা বলিয়ে দিতে হবে।’
কবির রাজি হলেন। একদিন সকালে এ পথ, ও পথ ঘুরিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমের বাসায়। ইব্রাহিম সাহেব এখন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান বা প্রধান।
তাঁর সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় থাকার কোনো কারণ ছিল না। বলতে দ্বিধা নেই, প্রথম দেখায় এবং আলোচনায় ইব্রাহিম সাহেবকে আমার ভালোই লেগেছিল। তাঁকে চৌকস এবং জানাবোঝা একজন মানুষ বলেই মনে হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমি আনোয়ার কবিরের লেখাটি চলতিপত্রে ছাপার সিদ্ধান্ত নিই। বুঝতে পারি তাঁর মতো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেই কবির লেখাটি তৈরি করেছে।
এর মধ্যে কবির আমার সঙ্গে জেনারেল নাসিম, জেনারেল আয়েনউদ্দিনসহ আরও কয়েকজনের কথা বলিয়ে দেন। ওই ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে এরা জড়িত থাকায় সামরিক বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
চলতিপত্রে লেখাটির প্রথম কিস্তি ছাপার পরই আমার ওপর শুরু হলো নানামুখী চাপ। সেনাবাহিনীর অনেকেই লেখাটিকে ভালোভাবে নিতে পারেননি। কারণ, লেখায় সেনাবাহিনীর ভেতরের দ্বন্দ্ব-বিরোধের খবর যেভাবে প্রকাশ পাচ্ছিল, সেগুলো হজম করা কারও কারও পক্ষে সহজ ছিল না। এক সন্ধ্যায় এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে দেখা হলো জাসদ নেতা কাজী আরিফের সঙ্গে। তিনি আমাকে সাবধান থাকতে বললেন।
আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। আরিফ ভাই বলেছিলেন, আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া হতে পারে। ভয়ে আমার কাঁপাকাঁপি অবস্থা। কোথাও কি পালিয়ে যাব? আনোয়ার কবিরও হুমকি পেয়ে কয়েক দিনের জন্য গা-ঢাকা দিলেন।
আমি কী করি? আমি কি পালিয়ে বাঁচতে পারব? পরদিন সকালেই চলতিপত্রের ফোন বেজে উঠল। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদর দপ্তর থেকে আমাকে চায়ের দাওয়াত দিয়ে তৈরি থাকতে বলা হলো। গাড়ি আসবে আমাকে নিয়ে যেতে।
আধা ঘণ্টার মধ্যেই একটা জিপ গাড়ি এসে উপস্থিত হলো চলতিপত্র অফিসের সামনে। এক বুক ভয় নিয়ে নতুন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চললাম আমি। গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে নিয়ে আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হবে, না খারাপ ব্যবহার করা হবে, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কারও সঙ্গে যে পরামর্শ করব, তারও সুযোগ পাইনি। রাগ হচ্ছিল আনোয়ার কবিরের ওপর। ওর জন্যই তো আমাকে এসব হ্যাপা পোহাতে হচ্ছে।
ঘটনা এখন থেকে প্রায় ২৫ বছর আগের। তখনো ঢাকা এমন জ্যামের শহরে পরিণত হয়নি। ফলে গন্তব্যে পৌঁছতে ১৫ / ২০ মিনিটের বেশি সময় লাগল না।
ওই সংস্থা সম্পর্কে নানা কথা শুনেছি। তাদের ‘পাওয়ার’ সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। শুধু শুনেছি যে, তারা প্রবল ক্ষমতাধর।
মনে মনে ভাবি, গণতান্ত্রিক শাসন আমলে নিশ্চয়ই আগের শাসন আমলের মতো পরিস্থিতি নেই। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে গাড়ি থেকে নামলাম। আমাকে দুই বা তিনতলার একটি কক্ষে নেওয়া হলো। শীততাপনিয়ন্ত্রিত একটি ছিমছাম কক্ষ। লম্বা একটি টেবিল। একপাশে একটি মাত্র চেয়ার। বিপরীত দিকে পাঁচটি চেয়ার লাগানো। পেছনে বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি। ছবিটি দেখে মনের মধ্যে সাহস ফিরে পেলাম। ভেতর থেকে আমার অন্তরাত্মা যেন বলছে, ‘তুই এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? তুই তো কোনো দোষ করিসনি। তুই তোর পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছিস। এরাও এদের দায়িত্বই পালন করছে। এখানে ভয়ভীতির কিছু নেই।’
আমি ঢুকে রুমটি খালি দেখতে পাই। তবে সেটা মুহূর্তের জন্য। প্রায় আমার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য দরজা দিয়ে রুমে ঢুকলেন পাঁচজন কর্মকর্তা। সামনের একক চেয়ারটিতে আমাকে বসতে বলে তাঁরা উল্টো দিকের পাঁচ চেয়ারে পাঁচজন বসলেন। হাসি মুখে আমাকে স্বাগত জানালেন। একে একে পাঁচজনই নাম বলে করমর্দন করলেন।
শুরু হলো আমার পরিচিতি নিয়ে হালকা কিছু প্রশ্ন দিয়ে। বাড়ি কোথায়, বাবা-মা, ভাইবোন, লেখাপড়া, আমার স্ত্রী-সন্তান ইত্যাদি।
আমার মনে হলো, না, ভয়ের কিছু হয়তো নেই। নাশতা পরিবেশন করা হলো। স্যান্ডউইচ অবশ্যই ছিল, আরও আইটেম ছিল। কিন্তু এখন মনে করতে পারছি না। কোমল পানীয় ছিল আমার প্রিয় ‘কোক’। গরম পানীয় হিসেবে চা না কফি পরিবেশন করা হয়েছিল, সেটাও মনে নেই। তবে কফি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। নাশতার ফাঁকে টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছে। আমি যায়যায়দিনের চাকরি কেন ছাড়লাম, কীভাবে, কেন চলতিপত্র বের করলাম, কারা টাকা দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে ইত্যাদি। ভারতে আমার আত্মীয়স্বজন আছেন কি না, কত দিন পরপর ইন্ডিয়া যাই ইত্যাদি প্রশ্নও বাদ গেল না।
তারপর উঠল আসল প্রসঙ্গ। তাদের সবার হাতেই একটি করে ফাইল। ফাইল খুলে বের করা হলো চলতিপত্রের একটি কপি। আনোয়ার কবিরের লেখাটি বের করে একজন সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘এই লেখাটি আপনি কেন ছাপলেন? এটা কি আমাদের সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন বা ক্ষতিগ্রস্ত করবে না?’
আমি বললাম, ‘যে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে, তারই তথ্যভিত্তিক একটি নির্দোষ প্রতিবেদন এটা। ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল, তার বিবরণ। কাউকে হেয় করা, কারও বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য উপস্থাপন করা, কারও প্রতি বিদ্বিষ্ট হওয়ার মতো কিছু লেখাটিতে নেই বলেই এটা আমি ছেপেছি। দেশবাসীকে সত্য তথ্য জানানো ছাড়া এটা ছাপার আর কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই।’
একজন এবার একটু রূঢ়ভাবেই বললেন, ‘বিভু বাবু (বাবু শব্দটার ওপর মনে হলো একটু বেশি জোর পড়েছিল), কাজটি আপনি ভালো করেননি। সেনাবাহিনীর কোনো কিছু লেখার আগে আপনার উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেওয়া।’
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরেকজন বললেন, ‘দেশে এখন গণতান্ত্রিক শাসন না থাকলে আপনার অবস্থা কী হতো, আপনি কি তা অনুমান করতে পারেন?’
এটা কি ভয় দেখানো, নাকি আর কিছু? আমি বলি, ‘দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে বলেই তো এটা ছাপার সাহস করেছি।’
বয়সে সবচেয়ে তরুণ কর্মকর্তাটি বললেন, ‘আপনি সাহস না, দুঃসাহস দেখিয়েছেন। এটা ছাপা আপনাকে বন্ধ করতে হবে।’
আমার ভয় ততক্ষণে কিছুটা কেটেছে। কথাবার্তা ও আচার-আচরণে আমি বুঝে গেছি যে, বড় কোনো বিপদ বা ঝামেলা আমার সামনে অপেক্ষা করছে না। সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা নিয়ে আনোয়ার কবিরের লেখাটি ছাপা বন্ধ করলেই আমার আর কোনো অসুবিধা থাকবে না।
তবে আমি লেখাটি ছাপার পক্ষে। তাই বললাম, ‘দেখুন, যেহেতু লেখাটির প্রথম কিস্তি ছাপা হয়েছে, সেহেতু পরের কিস্তিগুলোও আমি ছাপতে চাই। না ছাপলে পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগবে। নানা গুজব ছড়াবে, যেগুলো বরং বেশি ক্ষতির কারণ হতে পারে।’
তা ছাড়া এই লেখায় ক্ষতিকর কোনো উপাদান আছে বলে আমি মনে করি না। এক কর্মকর্তা এক ঢোক কোমল পানীয় মুখে চালান করে স্বাভাবিকভাবেই বললেন, ‘আপনার মনে করাটাই তো শেষ কথা হতে পারে না বিভু বাবু। আমাদেরও কথা আছে এবং সেটা আপনাকে বিবেচনায় নিতে হবে। আপনি লেখাটি ছাপা বন্ধ করুন।’
শেষের বাক্যটি তিনি উচ্চারণ করলেন নির্দেশের মতো করে। আমার ভালো লাগল না। কিছুটা নীরব মুহূর্ত কাটল। কী বলা বা করা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে এক কর্মকর্তা বললেন, ‘আপনার সিদ্ধান্ত আমাদের জানা দরকার। সময় নষ্ট করবেন না প্লিজ।’
আমার শিরদাঁড়া একটু শক্ত হলো বলে অনুভব করলাম। খুব ভাবনা-চিন্তা না করেই বললাম, ‘লেখাটি ছাপা বন্ধ করতে হলে আপনাদের লিখিত নির্দেশনা থাকতে হবে। আমরা পাঠকদের জানিয়ে দেব যে, আপনাদের নির্দেশে ছাপা বন্ধ করা হলো।’
একযোগে সবাই ‘না’ সূচক মাথা দোলাতে থাকলেন। ‘আমরা কোনো লিখিত দেব না এবং লেখাটিও আপনার ছাপা বন্ধ করতে হবে। আমরা নিশ্চিত লেখাটি সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে’—বললেন একজন।
আমি বলি, ‘আপনারা পুরো লেখাটি একবার পড়ে দেখুন। সেদিন যা ঘটেছে এবং ঘটনার পেছনে কার কী ভূমিকা, তার বাইরে কিছুই লেখা হয়নি এতে। আপনারা পুরো লেখাটি ছাপার পর কোনো পয়েন্টে ভিন্নমত অথবা অন্য ব্যাখ্যা দিয়ে আরেকটি লেখা দিতে পারেন। আমি সেটাও ছেপে দেব।’
কর্মকর্তারা নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কিছু শলাপরামর্শ করলেন। তারপর আমাকে বলা হলো, ‘আমরা এ ব্যাপারে আপনাকে আর চাপাচাপি করব না।’ কিন্তু লেখাটি ছাপা অব্যাহত থাকলে আমার যে সমস্যা হতে পারে, সেটাও বারবার আমাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো। সমস্যা কিছু হলেও আমি লেখাটি ছেপে পরিণতি দেখতে চাই।
কর্মকর্তারা আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছিলেন না। আবার আমাকে শাসাতেও পারছিলেন না। দেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায়। এখন সংবাদপত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক কিছু করলে ফল ভালো হবে না মনে করেই আমার প্রতি এক ধরনের উদারতা দেখানো হয়েছে বলে আমার ধারণা।
সময় গড়িয়ে যায়। কিন্তু কথা শেষ হয় না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুই ঘণ্টার বেশি সময় চলে গেছে। আমি এটা বুঝে গেছি যে, আমার জন্য বড় কোনো ভয় অপেক্ষা করছে না। কিছুটা মুহূর্ত নীরব কাটে। তাঁরাও কিছু বলেন না, আমিও কিছু বলি না।
হঠাৎ একজন কর্মকর্তা আবার বলেন, ‘লেখাটি ছাপা বন্ধ করুন মি. সরকার। বেশি সাহস দেখানো ভালো হবে না। লেখক আনোয়ার কবিরের জন্যও ভালো হবে না।’
আমি আমার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করি, ‘আপনারা লেখাটি না ছাপার একটি লিখিত নির্দেশ দিলেই আমি সেটা পাঠকদের জানিয়ে লেখাটি ছাপানো বন্ধ করব। সবচেয়ে ভালো হবে, এই লেখা ছাপা বন্ধ হলে এ নিয়ে কোনো ভিন্ন বক্তব্য থাকলে আপনারা যদি সেটা লিখিত আকারে দেন, তাহলে সেটাও আমি ছেপে দেব।’
‘এটাই আপনার শেষ কথা?’ —জানতে চান একজন।
আমি ভয়ে ভয়ে বলি, ‘হ্যাঁ।’
একজন একটু রুষ্ট স্বরে বলেন, ‘ইন্ডিয়ায় আপনার আত্মীয়-স্বজন কারা আছেন? বছরে কয়বার যান ইন্ডিয়ায়?’
আমি জানাই, ‘আমার তেমন কোনো নিকটাত্মীয় ভারতে নেই। ১৯৭১ সালে বিনা পাসপোর্টে ভারতে গিয়ে নয় মাস ছিলাম। তারপর পাসপোর্ট-ভিসা করে মাত্র একবার কলকাতা গিয়েছি।’ আমি বুঝতে পারি না, এর সঙ্গে ভারতে আমার আত্মীয় থাকা-না থাকা এবং যাওয়া-আসার কী সম্পর্ক থাকতে পারে!
আমাকে একা বসিয়ে রেখে কর্মকর্তারা একযোগে ভেতরে যান। আমার মনে হয়, নিজেদের মধ্যে কিছু শলাপরামর্শ করার জন্যই তাঁরা ভেতরে যান। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসেন একজন। তিনি বলেন, ‘লেখা না ছাপার জন্য আমরা লিখিত কোনো নির্দেশনা দেব না। তবে পরে আমাদের বক্তব্য লিখিত জানানো হবে। সেটা অবিকৃতভাবে আপনাকে ছাপতে হবে।
আমি হাঁফ ছাড়লাম। তাহলে এবারের মতো বিপদ কাটল।
আমাকে লাঞ্চের আমন্ত্রণ জানানো হলো। কিন্তু আমি তখন ওই অফিস থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছিলাম। তাই দুপুরে খাওয়ার প্রস্তাবে রাজি হলাম না। আমি বিদায় নিতে চাইলাম। আমাকে গাড়িতে করে আবার চলতিপত্র অফিসে পৌঁছে দেওয়া হলো।
আনোয়ার কবিরের লেখাটি নিয়মিত ছাপা হতে থাকল। জেনারেল নাসিম কোন প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীকে ‘মুভ’ করাতে চেয়েছিলেন, সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের কার কী ভূমিকা ছিল—এই বিষয়গুলো পাঠক জানতে পারেন। সেনাবাহিনীর ভেতরের খবর সাধারণত জানার উপায় থাকে না। সেদিক দিয়ে আনোয়ার কবিরের লেখাটি ব্যতিক্রম। তাই সেটা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে আমি আনোয়ার কবিরকে কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে বলি। কবির সেটা করেন।
কবিরের লেখাটি ছাপা শেষ হওয়ার পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি দীর্ঘ ব্যাখ্যামূলক লেখা পাঠানো হয় মেজর জেনারেল আবদুল মতিনের নামে। ওই লেখাও চলতিপত্রে পুরোটাই ছাপা হয়েছিল। এই জেনারেল মতিনই এক-এগারোর ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দীনের সময় অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে সামনে এসেছিলেন।
পেছনে ফিরে তাকালে কত কথা মনে পড়ে। স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে কত ছবি। অনেক কথা আবার ভুলেও গেছি। স্মৃতির গুদামঘরটা বুঝি এমনই। নতুন মালের জায়গা করে দেওয়ার জন্য পুরাতন কিছু বের করে দেয়।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
২০ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
২০ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
২১ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
২১ ঘণ্টা আগে