ফারুক মেহেদী
তিনি যখন তাদের কাছে গেলেন, কেমন যেন অপার্থিব এক দৃশ্যের অবতারণা হলো! ওরা যেন মুখিয়ে ছিল কেউ একজন এসে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু একটা বলুক, একটু মায়ার স্পর্শ দিক। মা-বাবার মতো আদরমাখা চাহনি দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলুক, ‘মারে, আর কষ্ট দিস না নিজেকে। যাদের মনে তোদের জন্য স্নেহের লেশমাত্র নেই; কেনই-বা তাদের জন্য নিজের জীবনকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাবি!’ পিতৃ–মাতৃতুল্য অভিভাবকদের পেয়ে তারা যেন অভিমান ভেঙে খুশিতে বাঁধভাঙা কান্নায় চারপাশ ভারী করল। এক অন্যরকম আবেগঘন পরিবেশের জন্ম হলো। তারা যেন প্রাণ ফিরে পেল! অমূল্য এ দৃশ্য কি দাম দিয়ে কেনা যাবে? না, যায় না। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা অমূল্য এক পরশপাথর। তাকে কোনো দামেই কেনা সম্ভব নয়। দীর্ঘ জীবনের ভালো কাজ, ইতিবাচক ভাবমূর্তিই তিল তিল করে এ পরশপাথরের আদল তৈরি করে।
সেটি যে কত অমূল্য, তা বোঝা যায় যেকোনো সংকটে। যেমনটি দেখা গেছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত অনশনকারী শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙানোর পর্বটিতে। প্রায় তিন বছর আগে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নিভৃতে দিন কাটছে লেখক ও অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন হক দম্পতির। তাঁরা দূর থেকে দেখছেন ছাত্রীদের সামান্য কয়েকটি দাবির প্রেক্ষাপটে কী অমানবিক কাণ্ডই না ঘটে চলেছে কয়েক যুগ কাটিয়ে আসা তাঁদের প্রিয় ক্যাম্পাসে। ড. ইয়াসমীন হকও নিশ্চয় নিজেকে খুব অপরাধী ভাবছেন। যে ছাত্রী হলের তিনি প্রভোস্ট ছিলেন, অন্তত ২০ বছর আগে যেখানে ইন্টারনেট চালু করে দিয়েছিলেন, সেখানে আজ ২০ বছর পর উন্নত ওয়াইফাই, খাবারের মান বাড়ানো, আর তাঁরই মতো আরেক প্রভোস্টের অশোভন আচরণের প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে তাঁর প্রিয় ছাত্রীরা মৃত্যুর মুখোমুখি। এটা নিশ্চয়ই তাঁর মনোবেদনার কারণ!
এ কয়দিনে অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে এসেছে। নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীরাও অনেক কিছু বুঝতে পেরেছেন এ সংকটের মুখোমুখি হয়ে। সেটি হলো ক্লাসে পড়ালেই সবাই শিক্ষক হতে পারেন না। মোটা মোটা বই পড়ালেই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার অমূল্য পরশপাথরের দেখা পাওয়া যায় না! ক্যাম্পাসে এত এত পিতৃ-মাতৃতুল্য শিক্ষককে এত দিন ধরে তাঁরা চিনতেন, যারা এ সংকটে পাশে থাকেনি। শুধু তা-ই নয়; আন্দোলনে উল্টো প্রতিপক্ষ ধরে নিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা তাঁদের অপমান করা হয়েছে দাবি করে ক্ষমা চাওয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে দলাদলির পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে শ্রদ্ধাভঙ্গ করছেন! শিক্ষার্থীরা নিজেদের ন্যায্য দাবি জানাতে গিয়ে তাঁদেরই সামনে পুলিশি হামলার শিকার হয়েছেন, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, শটগানের গুলি খেয়েছেন; অথচ তাঁদের কোনো সমবেদনা পাননি! অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অভিভাবক উপাচার্য দূরের কথা শিক্ষকেরাও তাঁদের দেখতে যাননি। ঘটনা পরম্পরায় উপাচার্যবিরোধী এক দফা আন্দোলন শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা এ দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন। সারা দেশ, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ তাঁদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে। অথচ ক্যাম্পাসে তাঁদের প্রিয় শিক্ষকেরা প্রতিনিয়ত তাঁদের সমালোচনায় মুখর থেকেছেন। গণমাধ্যমে দোষারোপ করে বিবৃতি দিচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে অসহায় বোধ হতে লাগল। হতে পারে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ড. খলিলুর রহমান, ড. মিরাজউদ্দিন মণ্ডল, ড. শাহীন আকতার, ড. রেজাই করিম খন্দকার, ড. জয়নাল আবেদীন, ড. গৌর গোবিন্দ গোস্বামীরা আজ ক্যাম্পাসে নেই। তাই বলে অন্যরা কি তবে পাষাণ হয়ে গেছেন? শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির পক্ষে কথা বলার মতো কেউ অবশিষ্ট নেই? এটা স্পষ্ট হলো, যখন সত্যিই শিক্ষার্থীদের পাশে কাউকে পাওয়া গেল না।
আন্দোলনের একপর্যায়ে একজন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে সবাই স্মরণ করতে থাকল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যখন তাঁর নামটি আসছিল ঘুরেফিরে, তখন তিনি একটি লেখা লিখে নিজের মনের কষ্ট প্রকাশ করলেন। তখনো মোটাদাগে ক্যাম্পাসের বেশির ভাগ শিক্ষক নির্বিকার। তাঁরা ইনিয়ে-বিনিয়ে উপাচার্যেরই পক্ষে সাফাই গেয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে থাকেন। এভাবে মার খেতে থাকে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অত্যন্ত স্পর্শকাতর সত্বাটি। পবিত্র সম্পর্কের ভিতের নড়বড়ে চিত্রটি আরও স্পষ্ট হতে দেখা যায়! শিক্ষার্থীরা যখন বুঝতে পারলেন, শিক্ষকেরা আসলে তাঁদেরই দোষারোপ করছেন, তখন তাঁরা আর তাঁদের সহযোগিতা করছিলেন না। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ক্যাম্পাসের এত এত শিক্ষকের মধ্যে এমন কাউকেই পাওয়া গেল না, যিনি শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়েছেন, যাকে তাঁরা শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করতে পারেন। এমন কাউকে এ কদিনে পাওয়া যায়নি, যাঁকে বিনয়ের সঙ্গে তাঁরা অভিভাবক মেনে অভিমান ভাঙতে পারেন!
যেভাবেই হোক, সরকারের শীর্ষ মহলের অনুরোধে বা যেকোনো পর্যায়ের পরামর্শেই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত ত্রাতা হয়ে সংকটে পানি ঢালতে পারলেন একমাত্র ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমীন হক দম্পতি! তার মানে শিক্ষার্থীদের গুডবুকে আর এমন কেউ ছিল না, যাকে শ্রদ্ধাভরে মানা যায়, যার কথা শুনে আন্দোলন কিংবা অনশন ভাঙা যায়! সকাল বেলা যখন এ দৃশ্য দেখছি, তখন ভেতরটা অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে গেল! মনে হলো—আহা, শক্ত মনোবলের আবেগী শিক্ষার্থীদের জীবনটা তাহলে রক্ষা পেল! উপাচার্য মহোদয় চেয়ারের নেশায় বুঁদ হয়ে বসে আছেন! কোনো নীতি-নৈতিকতা নয়; সরকার না বললে তিনি পদত্যাগ করবেন না! সরকারের কোর্টে বল দিয়ে তিনি নির্ভার! সরকারের যেন আর কোনো কাজ নেই! তিনি যেন সরকারের সব কাজ বাদ দিয়ে তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত রাখার ব্যবস্থা করেছেন! এমন এক পরিস্থিতি যে, কেউ শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে এগিয়ে আসছে না। সাত দিন পার হয়ে গেল, তাঁদের দাবি মানা দূরের কথা, তাঁরা যে না খেয়ে, অভুক্ত থেকে থেকে বিপন্নপ্রায় অবস্থায়—সেদিকে কারও নজর নেই।
শেষে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল দম্পতি সারা রাত পাবলিক বাসে চড়ে ভোরবেলায় ক্যাম্পাসে গিয়ে অনশনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ালেন। প্রিয় শিক্ষকদের পেয়ে সে কী বাঁধভাঙা কান্না শিক্ষার্থীদের! অবসরে যাওয়ায় ক্যাম্পাসের সাথে তাঁদের আর কোনো সংশ্লেষ নেই। তারপরও কী এক অদ্ভুত ভালোবাসার টানে তাঁরা সেখানে ছুটে গেলেন! আর শিক্ষার্থীরাও তাঁদের কাছে পেয়ে যেন বেঁচে থাকার প্রেরণা পেলেন!
দূর থেকে যখন এই দৃশ্য দেখলাম, মনে হলো এই জন্যই তো তাঁরা আজ আমাদের সবার প্রিয় শিক্ষক! যারা শিক্ষার্থীদের আত্মসম্মানবোধ নিয়ে ভাবেন, যারা তাঁদের মনের ভাষা পড়তে পারেন, যারা শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানের মতো মায়ায় জড়াতে পারেন; তাঁরাই তো সত্যিকারের শিক্ষক। জাফর ইকবাল স্যারের সাড়া দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ সংবেদনশীলতাই প্রকাশ পেল। তিনি শিক্ষার্থীদের এক নিমেষেই বোঝাতে সক্ষম হলেন—তাঁরা অন্তত এটুকু করে দেখাতে পেরেছেন যে, তাঁদের এ আন্দোলনে বাকি ৩৪-৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ঘুম হারাম হয়ে গেছে! তাঁরা অন্তত এ শিক্ষাটা পেয়েছেন যে, চেয়ার মানুষকে কতটা নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত প্রাণিতে পরিণত করতে পারে! ক্ষমতা আর পদের জন্য মানুষ কতটা স্বার্থপর, আর বেপরোয়া হতে পারে—এটাই এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে। জাফর ইকবাল স্যার শিক্ষার্থীদের এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, তাঁদের ওপর যা হয়েছে, এটা রীতিমতো দানবীয়, অমানবিক এবং চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা।
অনশন ভাঙানোর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমীন হক দম্পতি তাঁদের মানবিকতা, ব্যক্তিত্ব ও গ্রহণযোগ্যতায় অনন্য নজির স্থাপন করে একটি জটিল সংকটের সমাধান করেছেন। সবাইকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় কী না হয়! জোর করে তা কেউ পেতে পারে না। স্যারের সাবেক ছাত্র হিসেবে আজ আমরা সত্যি গর্বিত। আন্দোলন কী হলো, কে জয়ী হলো—এ হিসাব করার চেয়ে আমার মনে হচ্ছে এখানে নিজেদের মহানুভবতা দিয়ে মানবতাকে জয়ী করেছেন তাঁরা। নীতি-নৈতিকতার পার্থক্য বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন। দানব চেনাতে পেরেছেন—এটিই বা কম কীসে?
লেখক: আজকের পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও সাবেক শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
তিনি যখন তাদের কাছে গেলেন, কেমন যেন অপার্থিব এক দৃশ্যের অবতারণা হলো! ওরা যেন মুখিয়ে ছিল কেউ একজন এসে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু একটা বলুক, একটু মায়ার স্পর্শ দিক। মা-বাবার মতো আদরমাখা চাহনি দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলুক, ‘মারে, আর কষ্ট দিস না নিজেকে। যাদের মনে তোদের জন্য স্নেহের লেশমাত্র নেই; কেনই-বা তাদের জন্য নিজের জীবনকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাবি!’ পিতৃ–মাতৃতুল্য অভিভাবকদের পেয়ে তারা যেন অভিমান ভেঙে খুশিতে বাঁধভাঙা কান্নায় চারপাশ ভারী করল। এক অন্যরকম আবেগঘন পরিবেশের জন্ম হলো। তারা যেন প্রাণ ফিরে পেল! অমূল্য এ দৃশ্য কি দাম দিয়ে কেনা যাবে? না, যায় না। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা অমূল্য এক পরশপাথর। তাকে কোনো দামেই কেনা সম্ভব নয়। দীর্ঘ জীবনের ভালো কাজ, ইতিবাচক ভাবমূর্তিই তিল তিল করে এ পরশপাথরের আদল তৈরি করে।
সেটি যে কত অমূল্য, তা বোঝা যায় যেকোনো সংকটে। যেমনটি দেখা গেছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত অনশনকারী শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙানোর পর্বটিতে। প্রায় তিন বছর আগে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নিভৃতে দিন কাটছে লেখক ও অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন হক দম্পতির। তাঁরা দূর থেকে দেখছেন ছাত্রীদের সামান্য কয়েকটি দাবির প্রেক্ষাপটে কী অমানবিক কাণ্ডই না ঘটে চলেছে কয়েক যুগ কাটিয়ে আসা তাঁদের প্রিয় ক্যাম্পাসে। ড. ইয়াসমীন হকও নিশ্চয় নিজেকে খুব অপরাধী ভাবছেন। যে ছাত্রী হলের তিনি প্রভোস্ট ছিলেন, অন্তত ২০ বছর আগে যেখানে ইন্টারনেট চালু করে দিয়েছিলেন, সেখানে আজ ২০ বছর পর উন্নত ওয়াইফাই, খাবারের মান বাড়ানো, আর তাঁরই মতো আরেক প্রভোস্টের অশোভন আচরণের প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে তাঁর প্রিয় ছাত্রীরা মৃত্যুর মুখোমুখি। এটা নিশ্চয়ই তাঁর মনোবেদনার কারণ!
এ কয়দিনে অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে এসেছে। নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীরাও অনেক কিছু বুঝতে পেরেছেন এ সংকটের মুখোমুখি হয়ে। সেটি হলো ক্লাসে পড়ালেই সবাই শিক্ষক হতে পারেন না। মোটা মোটা বই পড়ালেই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার অমূল্য পরশপাথরের দেখা পাওয়া যায় না! ক্যাম্পাসে এত এত পিতৃ-মাতৃতুল্য শিক্ষককে এত দিন ধরে তাঁরা চিনতেন, যারা এ সংকটে পাশে থাকেনি। শুধু তা-ই নয়; আন্দোলনে উল্টো প্রতিপক্ষ ধরে নিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা তাঁদের অপমান করা হয়েছে দাবি করে ক্ষমা চাওয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে দলাদলির পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে শ্রদ্ধাভঙ্গ করছেন! শিক্ষার্থীরা নিজেদের ন্যায্য দাবি জানাতে গিয়ে তাঁদেরই সামনে পুলিশি হামলার শিকার হয়েছেন, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, শটগানের গুলি খেয়েছেন; অথচ তাঁদের কোনো সমবেদনা পাননি! অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অভিভাবক উপাচার্য দূরের কথা শিক্ষকেরাও তাঁদের দেখতে যাননি। ঘটনা পরম্পরায় উপাচার্যবিরোধী এক দফা আন্দোলন শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা এ দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন। সারা দেশ, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ তাঁদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে। অথচ ক্যাম্পাসে তাঁদের প্রিয় শিক্ষকেরা প্রতিনিয়ত তাঁদের সমালোচনায় মুখর থেকেছেন। গণমাধ্যমে দোষারোপ করে বিবৃতি দিচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে অসহায় বোধ হতে লাগল। হতে পারে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ড. খলিলুর রহমান, ড. মিরাজউদ্দিন মণ্ডল, ড. শাহীন আকতার, ড. রেজাই করিম খন্দকার, ড. জয়নাল আবেদীন, ড. গৌর গোবিন্দ গোস্বামীরা আজ ক্যাম্পাসে নেই। তাই বলে অন্যরা কি তবে পাষাণ হয়ে গেছেন? শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির পক্ষে কথা বলার মতো কেউ অবশিষ্ট নেই? এটা স্পষ্ট হলো, যখন সত্যিই শিক্ষার্থীদের পাশে কাউকে পাওয়া গেল না।
আন্দোলনের একপর্যায়ে একজন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে সবাই স্মরণ করতে থাকল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যখন তাঁর নামটি আসছিল ঘুরেফিরে, তখন তিনি একটি লেখা লিখে নিজের মনের কষ্ট প্রকাশ করলেন। তখনো মোটাদাগে ক্যাম্পাসের বেশির ভাগ শিক্ষক নির্বিকার। তাঁরা ইনিয়ে-বিনিয়ে উপাচার্যেরই পক্ষে সাফাই গেয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে থাকেন। এভাবে মার খেতে থাকে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অত্যন্ত স্পর্শকাতর সত্বাটি। পবিত্র সম্পর্কের ভিতের নড়বড়ে চিত্রটি আরও স্পষ্ট হতে দেখা যায়! শিক্ষার্থীরা যখন বুঝতে পারলেন, শিক্ষকেরা আসলে তাঁদেরই দোষারোপ করছেন, তখন তাঁরা আর তাঁদের সহযোগিতা করছিলেন না। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ক্যাম্পাসের এত এত শিক্ষকের মধ্যে এমন কাউকেই পাওয়া গেল না, যিনি শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়েছেন, যাকে তাঁরা শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করতে পারেন। এমন কাউকে এ কদিনে পাওয়া যায়নি, যাঁকে বিনয়ের সঙ্গে তাঁরা অভিভাবক মেনে অভিমান ভাঙতে পারেন!
যেভাবেই হোক, সরকারের শীর্ষ মহলের অনুরোধে বা যেকোনো পর্যায়ের পরামর্শেই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত ত্রাতা হয়ে সংকটে পানি ঢালতে পারলেন একমাত্র ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমীন হক দম্পতি! তার মানে শিক্ষার্থীদের গুডবুকে আর এমন কেউ ছিল না, যাকে শ্রদ্ধাভরে মানা যায়, যার কথা শুনে আন্দোলন কিংবা অনশন ভাঙা যায়! সকাল বেলা যখন এ দৃশ্য দেখছি, তখন ভেতরটা অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে গেল! মনে হলো—আহা, শক্ত মনোবলের আবেগী শিক্ষার্থীদের জীবনটা তাহলে রক্ষা পেল! উপাচার্য মহোদয় চেয়ারের নেশায় বুঁদ হয়ে বসে আছেন! কোনো নীতি-নৈতিকতা নয়; সরকার না বললে তিনি পদত্যাগ করবেন না! সরকারের কোর্টে বল দিয়ে তিনি নির্ভার! সরকারের যেন আর কোনো কাজ নেই! তিনি যেন সরকারের সব কাজ বাদ দিয়ে তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত রাখার ব্যবস্থা করেছেন! এমন এক পরিস্থিতি যে, কেউ শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে এগিয়ে আসছে না। সাত দিন পার হয়ে গেল, তাঁদের দাবি মানা দূরের কথা, তাঁরা যে না খেয়ে, অভুক্ত থেকে থেকে বিপন্নপ্রায় অবস্থায়—সেদিকে কারও নজর নেই।
শেষে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল দম্পতি সারা রাত পাবলিক বাসে চড়ে ভোরবেলায় ক্যাম্পাসে গিয়ে অনশনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ালেন। প্রিয় শিক্ষকদের পেয়ে সে কী বাঁধভাঙা কান্না শিক্ষার্থীদের! অবসরে যাওয়ায় ক্যাম্পাসের সাথে তাঁদের আর কোনো সংশ্লেষ নেই। তারপরও কী এক অদ্ভুত ভালোবাসার টানে তাঁরা সেখানে ছুটে গেলেন! আর শিক্ষার্থীরাও তাঁদের কাছে পেয়ে যেন বেঁচে থাকার প্রেরণা পেলেন!
দূর থেকে যখন এই দৃশ্য দেখলাম, মনে হলো এই জন্যই তো তাঁরা আজ আমাদের সবার প্রিয় শিক্ষক! যারা শিক্ষার্থীদের আত্মসম্মানবোধ নিয়ে ভাবেন, যারা তাঁদের মনের ভাষা পড়তে পারেন, যারা শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানের মতো মায়ায় জড়াতে পারেন; তাঁরাই তো সত্যিকারের শিক্ষক। জাফর ইকবাল স্যারের সাড়া দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ সংবেদনশীলতাই প্রকাশ পেল। তিনি শিক্ষার্থীদের এক নিমেষেই বোঝাতে সক্ষম হলেন—তাঁরা অন্তত এটুকু করে দেখাতে পেরেছেন যে, তাঁদের এ আন্দোলনে বাকি ৩৪-৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ঘুম হারাম হয়ে গেছে! তাঁরা অন্তত এ শিক্ষাটা পেয়েছেন যে, চেয়ার মানুষকে কতটা নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত প্রাণিতে পরিণত করতে পারে! ক্ষমতা আর পদের জন্য মানুষ কতটা স্বার্থপর, আর বেপরোয়া হতে পারে—এটাই এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে। জাফর ইকবাল স্যার শিক্ষার্থীদের এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, তাঁদের ওপর যা হয়েছে, এটা রীতিমতো দানবীয়, অমানবিক এবং চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা।
অনশন ভাঙানোর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমীন হক দম্পতি তাঁদের মানবিকতা, ব্যক্তিত্ব ও গ্রহণযোগ্যতায় অনন্য নজির স্থাপন করে একটি জটিল সংকটের সমাধান করেছেন। সবাইকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় কী না হয়! জোর করে তা কেউ পেতে পারে না। স্যারের সাবেক ছাত্র হিসেবে আজ আমরা সত্যি গর্বিত। আন্দোলন কী হলো, কে জয়ী হলো—এ হিসাব করার চেয়ে আমার মনে হচ্ছে এখানে নিজেদের মহানুভবতা দিয়ে মানবতাকে জয়ী করেছেন তাঁরা। নীতি-নৈতিকতার পার্থক্য বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন। দানব চেনাতে পেরেছেন—এটিই বা কম কীসে?
লেখক: আজকের পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও সাবেক শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
১৯ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
১৯ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
২০ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
২০ ঘণ্টা আগে