জাহাঙ্গীর আলম, ঢাকা
মানব ইতিহাসের যুগে যুগে বিপ্লব এসেছে। পরিবর্তনের স্বপ্নে বিভোর মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু বলতে গেলে অধিকাংশ বিপ্লবের স্মৃতি দ্রুতই মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে, অথবা ঝাপসা বিভ্রান্তিকর ইতিহাসের পাঠ দিতে শুরু করেছে। মানুষ মনে রেখেছে শুধু সেসব বিপ্লব, যেসব শুধু সত্যিকারের পরিবর্তন এনেছে, পুরোনোকে উচ্ছেদ করে নতুনকে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করতে পেরেছে।
অবশ্য আধুনিককালের বিপ্লবের শর্ত ও গতিপথ বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। যেমন ২০২২ সালের শেষের দিকে ইতিহাসবিদ এবং বৈদেশিক নীতির নিবন্ধকার অ্যাডাম টুজ ‘জেইজেইস্ট’ বা যুগের/কালের বৈশিষ্ট্যকে নথিবদ্ধ করেছিলেন এভাবে—বিশ্ব এখন একটি ‘পলিক্রাইসিস’ বা বহুমাত্রিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। এটি এমন একটি সময় যখন ‘সংকট এবং অভিঘাতগুলো ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে একটি সূত্রে গাঁথা। এগুলোর সামগ্রিক অভিঘাত বিভিন্ন অংশের মোট যোগফলের চেয়ে বেশি।’
বিস্তৃতি ও ব্যাপকতার দিক থেকে আধুনিককালের চেয়ে কম গতিশীল ও জটিল হলেও ইতিহাসে কিন্তু এমন যুগ বারবার এসেছে। এর কিছু আমরা মনে রাখি; কারণ, সেই পরিস্থিতিগুলো বিরাজ করত একটি সফল বিপ্লবী পরিবর্তনের আগে। অন্য যুগগুলো সেভাবে কারও স্মরণে নেই; কারণ, সেই বিপ্লবে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন অর্জিত হয়নি। যদিও মানুষ বড় ধরনের অস্থিরতা ও অভিঘাতের ভেতর দিয়ে গেছেন, কিন্তু আগের ব্যবস্থাই আবার জগদ্দল হয়ে বসেছে।
এই সময়গুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জি এম ট্রেভেলিয়ানের পর্যবেক্ষণগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেখিয়েছেন, ইতিহাসের আমূল বাঁকবদলের শর্ত তৈরি হওয়ার পরও কেন বিপ্লব ব্যর্থ হয়।
১৮৪৮ সালের ঘটনাকে ট্রেভেলিয়ান উল্লেখ করেছেন এমনই একটি ব্যর্থ বাঁক হিসেবে। যদিও সে বছর ইউরোপজুড়ে রাজনৈতিক গোলযোগ দেখা দিয়েছিল। তবে ১৭৮৯ (ফরাসি বিপ্লব) বা ১৯৪৫ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি)-এর সন্ধিক্ষণের মতো এটি তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি।
তবু ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার ক্লার্কের একটা মনুমেন্টাল কাজ বলা যেতে পারে এটিকে: রেভল্যুশনারি স্প্রিং: ইউরোপ আফ্লেম অ্যান্ড দ্য ফাইট ফর আ নিউ ওয়ার্ল্ড। এই বইয়ে ১৮৪৮–৪৯ বিপ্লবের শর্ত ও গতিপ্রকৃতি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন তিনি। এই একটি বছরের বিপ্লবের পরিণতি দীর্ঘমেয়াদি ও গভীর প্রভাব রেখেছে ইউরোপের পরবর্তী ইতিহাসে।
এই বই পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেবে এবং বুঝতে সহায়তা করবে যে, কেন কিছু সংকট (অবশ্যই বহুমাত্রিক) শেষ পর্যন্ত একটি পরিণতির দিকে নিয়ে যায়, আর কিছু সংকটের মধ্যে এমন পরিবর্তনের শর্ত থাকে না। যাঁরা বিপ্লবের সুফল পেতে চান বা বিপ্লবকে বুঝতে চান, তাঁদের অবশ্যই ইতিহাসের এসব ব্যর্থ বা বেহাত বিপ্লবের প্রতিটি মুহূর্ত, ঘটনা ও ইঙ্গিতকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি।
ক্লার্কের ৮৩২ পৃষ্ঠার বইটি ধরেই ইতিহাসের বাঁকবদলের চিত্র ও বিশ্লেষণ বোঝার চেষ্টা করা যাক। কারণ, এই বইয়ে লেখক সময়ের দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতাগুলোর ওপর বিশদভাবে আলোকপাত করেছেন, যা পরবর্তী সময়ে একটি বিপ্লবকে সম্ভব করেছে।
ধরা যাক ইউরোপের ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের কথা: এই বিপ্লবের শর্ত তৈরির ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটিই ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বিপ্লবের বছরের আগের দশকগুলোতে অভূতপূর্ব শিল্পায়ন ইউরোপকে বদলে দিয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধাগুলোর অসম বণ্টনের সমস্যা প্রকট হচ্ছিল এবং যারা এটি থেকে সামান্যতম হলেও উপকৃত হয়েছিল, তাদের আবার মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। কারিগর, শিল্পী ও দোকানদারেরা তাঁদের মর্যাদা এবং উপার্জন—দুটোরই ক্রমাবনতি দেখছিলেন। দরিদ্র এবং শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন; কারণ, নতুন শহরে বসবাসের অবস্থা ছিল অত্যন্ত বাজে এবং কাজের পরিবেশ ছিল শোষণমূলক, স্বৈরাচারী।
তখনো কৃষকেরা ইউরোপীয় সমাজের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী। তারা ব্যাপক চাপের মধ্যে পড়েছিল: বাণিজ্যিক কৃষি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছিল। সামন্তদের বা বড় উদ্যোক্তাদের হাতে চলে যাচ্ছিল সাধারণ কৃষিজমি। এই প্রবণতা কৃষির বেসরকারীকরণ বা বাণিজ্যিকীকরণকেই উৎসাহিত করেছে। চাষের নতুন কৌশল বৃহৎ কৃষকদের হাতে চলে গিয়েছিল, তাদের হাতেই ছিল নতুন কৃষিপ্রযুক্তি। এই নতুন কৌশল এবং প্রযুক্তি সাধারণ কৃষকদের নাগালের বাইরে ছিল; বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপে অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি সামন্তীয় বিশেষাধিকার তখনো বজায় রেখেছিলেন।
তবে একমাত্র উপাদান হিসেবে নিম্নবিত্তের অসন্তোষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিস্থিতিকে বিপ্লবের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। ক্লার্ক যেমন লিখেছেন, দারিদ্র্য ‘মানুষকে সমন্বিত কর্মে চালিত করার চেয়ে বরং “বাক্শক্তিহীন” এবং নিষ্ক্রিয় করার সম্ভাবনা বেশি’। যদি জনদুর্ভোগ এবং বিপ্লবের মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র থাকতই, তাহলে সবচেয়ে খারাপ বস্তুগত অবস্থা যেসব জায়গায় বা অঞ্চলে ছিল বা রয়েছে, সেখানে বড় বিপ্লব সংঘটিত হতো। এই যুক্তি অনুযায়ী ১৮৪৮ সালে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ দেখার দেওয়া কথা—কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি।
বিপ্লবের শর্ত সম্পর্কে ক্লার্কের যুক্তি হলো, বিপ্লব সাধারণত বিস্তৃত ব্যাপার, এটি শাসনব্যবস্থার সঙ্গে শ্রেণিনির্বিশেষে অসন্তোষ ও সংঘাতের ফলাফল। ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত এটি কেবল ঘনীভূত হতে শুরু করেছিল। যদিও ওই সময় ইউরোপীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল, তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই শ্রেণির আয়তন ও সম্পদ বৃদ্ধি করছিল। মধ্যবিত্তের অসন্তোষ যতটা না অর্থনৈতিক উদ্বেগ থেকে উদ্ভূত, তার চেয়ে বেশি তারা রাজনৈতিক, সামাজিক অধিকার এবং পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ ছিল।
সমাজের শীর্ষ স্তরে ছিল ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীরা। তারা বিপুল জমির মালিক, যারা সদ্য অভিজাত হয়ে উঠেছিল, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইতিমধ্যে ক্রমবর্ধমানসংখ্যক পেশাদার, বণিক এবং হোয়াইট-কলার শ্রমিকেরা আরও সমৃদ্ধ, শিক্ষিত হয়ে উঠছিল। তথ্যপ্রবাহের সুফল তারা ভোগ করছিল, তারা অনেক কিছু জানত। কিন্তু ইউরোপের বেশির ভাগ অঞ্চলে এই গোষ্ঠীর সদস্যদের ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। এমনকি মর্যাদাপূর্ণ সরকারি এবং সামাজিক অবস্থান থেকেও তারা বঞ্চিত ছিল।
ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদও ব্যাপক অসন্তোষের কারণ হয়েছিল। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের সাম্রাজ্যগুলোতে এই জাতীয়তাবাদ বিশেষভাবে বাধার মুখে পড়েছিল। কারণ, এসব অঞ্চলে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা জাতিগত, ধর্মীয় এবং ভাষাগত বিষয়গুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। সেই এলাকাগুলোতে স্বায়ত্তশাসন, এমনকি স্বাধীনতার দাবি জোরদার হচ্ছিল; বিশেষ করে বর্তমান হাঙ্গেরি ও চেকোস্লোভাকিয়া (পরবর্তী সময়ে) ও বিভিন্ন স্লাভ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা স্থিতিশীলতাকে ভয়াবহ হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল।
১৮৪০-এর দশকে, ইউরোপজুড়ে একটি ধারণা ছিল যে এখানে আর কোনো রাজনৈতিক সম্ভাবনা নেই। যেমন ক্লার্ক এক বেলজিয়ান চরমপন্থীর পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেছেন তাঁরই ভাষায়, ‘কোনো জাতি বা সরকার জানত না, তারা কোথায় যাচ্ছে।’ কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ফলে সৃষ্ট বহুমুখী সংকট স্পষ্ট হলেও বিপ্লব তখনো অনিবার্য হয়ে ওঠেনি। ক্লার্ক যেমন লিখেছেন, বিপ্লব দুটি পর্যায়ে আবির্ভূত হয়: ধীরে ধীরে এবং এরপর হঠাৎ করে।
১৮৪৮ সালের ক্ষেত্রে, দুটি প্রধান অনুঘটক অবশেষে বিপ্লবের জন্ম দেয়। প্রথমটি ছিল: অর্থনৈতিক সংকট। ১৮৪৫ সালের শুরুতে, ইউরোপে কয়েক মৌসুম ফসল মার খায়। বিশেষভাবে ইউরোপের বেশির ভাগ অঞ্চলজুড়ে আলুর ফলন-বিপর্যয়ের প্রভাব ছিল বিধ্বংসী। আলুর ফলন বিপর্যয়ের কারণে নেমে আসে অর্থনৈতিক মন্দা এবং সেই সঙ্গে অর্থনীতি নিয়ে জনমনে আতঙ্ক। কৃষিতে এই সামগ্রিক বিপর্যয়ের কারণে কিছু জায়গায় ভয়াবহ খাদ্যঘাটতি এবং এমনকি দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল আয়ারল্যান্ডে।
দ্বিতীয় অনুঘটকটি আঘাত হেনেছিল ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ফরাসি শ্রমিকদের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমেই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা রাজা লুই ফিলিপ এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া গুইজোতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহ রাজতন্ত্রের পতন ঘটায় এবং দ্বিতীয় ফরাসি প্রজাতন্ত্র (সেকেন্ড রিপাবলিক) গঠনের দিকে চালিত করে।
অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের তৎকালীন চ্যান্সেলর ক্লেমেন্স ভন মেটারনিক যেমন ঘটনার এক দশক আগেই বলেছিলেন, ‘ফ্রান্স যখন হাঁচি দেয়, তখন ইউরোপে সর্দি লাগে!’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন, রেডিও বা এমনকি ব্যাপক সাক্ষরতার অভাব সত্ত্বেও, ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইউরোপজুড়ে ব্যাপক বিদ্রোহ শুরু হয়। যে শাসনব্যবস্থাগুলোকে সুরক্ষিত এবং চিরস্থায়ী বলে মনে হয়েছিল, একের পর এক সেগুলোর পতন ঘটে বা তারা ছাড় দিতে বাধ্য হয়। অথচ এত দিন ভাবা হতো এই ব্যবস্থা বদলাবার নয়!
ক্লার্ক লিখেছেন, ‘গণমানুষের উত্থান মহাদেশজুড়ে ব্রাশফায়ারের মতো ছড়িয়ে পড়ে, শহর থেকে শহরে জ্বলে ওঠে।’ বার্লিন, প্রাগ, ভিয়েনা, বুদাপেস্ট, মিউনিখ, মিলান, ভেনিস এবং অন্যান্য ইউরোপীয় শহর তখন উত্তাল। এসব শহরের চেহারা দেখেই মানুষ বুঝে ফেলেছিল বিপ্লব আসন্ন।
বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর মানুষ অভিভূত ও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কিন্তু মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে রাজতান্ত্রিক একনায়কত্ব ইউরোপের সমস্ত অঞ্চলে আবার ফিরে আসে। অথচ সব কটিকে ১৮৪৮ সালের বসন্তে বিতাড়িত করা হয়েছিল।
১৮৪৮-এর এই বসন্ত বিপ্লবের শর্ত, বিকাশ, বিজয় এবং বিজয়-পরবর্তী পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, ইউরোপের এই বিপ্লবের ব্যর্থতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল আন্দোলনকারীদের মধ্যকার দুর্বলতা। আন্দোলনকারীরা পুরোনো ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে একটি নতুন ব্যবস্থা গড়া যায়, সে সম্পর্কে তাদের মধ্যে ঐকমত্য ছিল না। পুরোনো ব্যবস্থার পতনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে গভীর বিভাজন স্পষ্ট হতে থাকে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণি মূলত একটি উদারনৈতিক ব্যবস্থা চেয়েছিল, কিন্তু পুরোনোটিকে সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপন করার জন্য একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তারা চায়নি। তারা শুধু এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা চেয়েছিল, যেখানে তাদের অংশগ্রহণ থাকবে এবং অভিজাতদের বিশেষ সুবিধা দেবে না। তবে তারা সর্বজনীন ভোটাধিকার এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের পক্ষে শ্রমিকদের দাবির প্রতি সদয় ছিল না; বরং দুই প্রস্তাবই তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল। কৃষকেরা রাজনৈতিক সংস্কারে কম আগ্রহী ছিল, বরং তারা সম্পত্তি রক্ষার নিশ্চয়তা চেয়েছিল। পূর্ব ইউরোপের বেশির ভাগ অংশসহ যেখানে কৃষিই প্রধান পেশা, সেখানে সামন্তীয় বিশেষাধিকার এবং জমির মালিকানা বিলুপ্তির মাধ্যমে নিজেদের সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষিত করেছিল কৃষকেরা।
১৮ শতকের ফরাসি বিপ্লবের স্মৃতি দ্বারা তাড়িত হয়ে রাজারা ১৮৪৮ সালে অধিকতর মধ্যপন্থী দাবিগুলোর প্রতি নমনীয়তা দেখাতে শুরু করেন, কিছু ক্ষেত্রে দ্রুতই সেগুলো মেনে নেন। উদাহরণস্বরূপ, সংবিধান প্রণয়ন এবং অনেক সামন্ততান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা দূর করতে সম্মত হন রাজারা। এর ফলে উদারপন্থী এবং কৃষকেরা অনেকাংশে সন্তুষ্ট হয়। এই পরিবর্তনগুলো অবশ্য আন্দোলনের কর্মীদের (অ্যাকটিভিস্ট) এবং কট্টরপন্থীদের সন্তুষ্ট করেনি। এই গোষ্ঠীগুলো কেবল পূর্ণ গণতন্ত্রীকরণই নয়, ন্যূনতম মজুরি, বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং কাজের অধিকারের মতো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারও নিশ্চিত করার দাবিতে অনড় থাকেন।
লেখক: আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
মানব ইতিহাসের যুগে যুগে বিপ্লব এসেছে। পরিবর্তনের স্বপ্নে বিভোর মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু বলতে গেলে অধিকাংশ বিপ্লবের স্মৃতি দ্রুতই মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে, অথবা ঝাপসা বিভ্রান্তিকর ইতিহাসের পাঠ দিতে শুরু করেছে। মানুষ মনে রেখেছে শুধু সেসব বিপ্লব, যেসব শুধু সত্যিকারের পরিবর্তন এনেছে, পুরোনোকে উচ্ছেদ করে নতুনকে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করতে পেরেছে।
অবশ্য আধুনিককালের বিপ্লবের শর্ত ও গতিপথ বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। যেমন ২০২২ সালের শেষের দিকে ইতিহাসবিদ এবং বৈদেশিক নীতির নিবন্ধকার অ্যাডাম টুজ ‘জেইজেইস্ট’ বা যুগের/কালের বৈশিষ্ট্যকে নথিবদ্ধ করেছিলেন এভাবে—বিশ্ব এখন একটি ‘পলিক্রাইসিস’ বা বহুমাত্রিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। এটি এমন একটি সময় যখন ‘সংকট এবং অভিঘাতগুলো ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে একটি সূত্রে গাঁথা। এগুলোর সামগ্রিক অভিঘাত বিভিন্ন অংশের মোট যোগফলের চেয়ে বেশি।’
বিস্তৃতি ও ব্যাপকতার দিক থেকে আধুনিককালের চেয়ে কম গতিশীল ও জটিল হলেও ইতিহাসে কিন্তু এমন যুগ বারবার এসেছে। এর কিছু আমরা মনে রাখি; কারণ, সেই পরিস্থিতিগুলো বিরাজ করত একটি সফল বিপ্লবী পরিবর্তনের আগে। অন্য যুগগুলো সেভাবে কারও স্মরণে নেই; কারণ, সেই বিপ্লবে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন অর্জিত হয়নি। যদিও মানুষ বড় ধরনের অস্থিরতা ও অভিঘাতের ভেতর দিয়ে গেছেন, কিন্তু আগের ব্যবস্থাই আবার জগদ্দল হয়ে বসেছে।
এই সময়গুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জি এম ট্রেভেলিয়ানের পর্যবেক্ষণগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেখিয়েছেন, ইতিহাসের আমূল বাঁকবদলের শর্ত তৈরি হওয়ার পরও কেন বিপ্লব ব্যর্থ হয়।
১৮৪৮ সালের ঘটনাকে ট্রেভেলিয়ান উল্লেখ করেছেন এমনই একটি ব্যর্থ বাঁক হিসেবে। যদিও সে বছর ইউরোপজুড়ে রাজনৈতিক গোলযোগ দেখা দিয়েছিল। তবে ১৭৮৯ (ফরাসি বিপ্লব) বা ১৯৪৫ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি)-এর সন্ধিক্ষণের মতো এটি তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি।
তবু ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার ক্লার্কের একটা মনুমেন্টাল কাজ বলা যেতে পারে এটিকে: রেভল্যুশনারি স্প্রিং: ইউরোপ আফ্লেম অ্যান্ড দ্য ফাইট ফর আ নিউ ওয়ার্ল্ড। এই বইয়ে ১৮৪৮–৪৯ বিপ্লবের শর্ত ও গতিপ্রকৃতি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন তিনি। এই একটি বছরের বিপ্লবের পরিণতি দীর্ঘমেয়াদি ও গভীর প্রভাব রেখেছে ইউরোপের পরবর্তী ইতিহাসে।
এই বই পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেবে এবং বুঝতে সহায়তা করবে যে, কেন কিছু সংকট (অবশ্যই বহুমাত্রিক) শেষ পর্যন্ত একটি পরিণতির দিকে নিয়ে যায়, আর কিছু সংকটের মধ্যে এমন পরিবর্তনের শর্ত থাকে না। যাঁরা বিপ্লবের সুফল পেতে চান বা বিপ্লবকে বুঝতে চান, তাঁদের অবশ্যই ইতিহাসের এসব ব্যর্থ বা বেহাত বিপ্লবের প্রতিটি মুহূর্ত, ঘটনা ও ইঙ্গিতকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি।
ক্লার্কের ৮৩২ পৃষ্ঠার বইটি ধরেই ইতিহাসের বাঁকবদলের চিত্র ও বিশ্লেষণ বোঝার চেষ্টা করা যাক। কারণ, এই বইয়ে লেখক সময়ের দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতাগুলোর ওপর বিশদভাবে আলোকপাত করেছেন, যা পরবর্তী সময়ে একটি বিপ্লবকে সম্ভব করেছে।
ধরা যাক ইউরোপের ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের কথা: এই বিপ্লবের শর্ত তৈরির ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটিই ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বিপ্লবের বছরের আগের দশকগুলোতে অভূতপূর্ব শিল্পায়ন ইউরোপকে বদলে দিয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধাগুলোর অসম বণ্টনের সমস্যা প্রকট হচ্ছিল এবং যারা এটি থেকে সামান্যতম হলেও উপকৃত হয়েছিল, তাদের আবার মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। কারিগর, শিল্পী ও দোকানদারেরা তাঁদের মর্যাদা এবং উপার্জন—দুটোরই ক্রমাবনতি দেখছিলেন। দরিদ্র এবং শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন; কারণ, নতুন শহরে বসবাসের অবস্থা ছিল অত্যন্ত বাজে এবং কাজের পরিবেশ ছিল শোষণমূলক, স্বৈরাচারী।
তখনো কৃষকেরা ইউরোপীয় সমাজের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী। তারা ব্যাপক চাপের মধ্যে পড়েছিল: বাণিজ্যিক কৃষি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছিল। সামন্তদের বা বড় উদ্যোক্তাদের হাতে চলে যাচ্ছিল সাধারণ কৃষিজমি। এই প্রবণতা কৃষির বেসরকারীকরণ বা বাণিজ্যিকীকরণকেই উৎসাহিত করেছে। চাষের নতুন কৌশল বৃহৎ কৃষকদের হাতে চলে গিয়েছিল, তাদের হাতেই ছিল নতুন কৃষিপ্রযুক্তি। এই নতুন কৌশল এবং প্রযুক্তি সাধারণ কৃষকদের নাগালের বাইরে ছিল; বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপে অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি সামন্তীয় বিশেষাধিকার তখনো বজায় রেখেছিলেন।
তবে একমাত্র উপাদান হিসেবে নিম্নবিত্তের অসন্তোষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিস্থিতিকে বিপ্লবের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। ক্লার্ক যেমন লিখেছেন, দারিদ্র্য ‘মানুষকে সমন্বিত কর্মে চালিত করার চেয়ে বরং “বাক্শক্তিহীন” এবং নিষ্ক্রিয় করার সম্ভাবনা বেশি’। যদি জনদুর্ভোগ এবং বিপ্লবের মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র থাকতই, তাহলে সবচেয়ে খারাপ বস্তুগত অবস্থা যেসব জায়গায় বা অঞ্চলে ছিল বা রয়েছে, সেখানে বড় বিপ্লব সংঘটিত হতো। এই যুক্তি অনুযায়ী ১৮৪৮ সালে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ দেখার দেওয়া কথা—কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি।
বিপ্লবের শর্ত সম্পর্কে ক্লার্কের যুক্তি হলো, বিপ্লব সাধারণত বিস্তৃত ব্যাপার, এটি শাসনব্যবস্থার সঙ্গে শ্রেণিনির্বিশেষে অসন্তোষ ও সংঘাতের ফলাফল। ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত এটি কেবল ঘনীভূত হতে শুরু করেছিল। যদিও ওই সময় ইউরোপীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল, তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই শ্রেণির আয়তন ও সম্পদ বৃদ্ধি করছিল। মধ্যবিত্তের অসন্তোষ যতটা না অর্থনৈতিক উদ্বেগ থেকে উদ্ভূত, তার চেয়ে বেশি তারা রাজনৈতিক, সামাজিক অধিকার এবং পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ ছিল।
সমাজের শীর্ষ স্তরে ছিল ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীরা। তারা বিপুল জমির মালিক, যারা সদ্য অভিজাত হয়ে উঠেছিল, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইতিমধ্যে ক্রমবর্ধমানসংখ্যক পেশাদার, বণিক এবং হোয়াইট-কলার শ্রমিকেরা আরও সমৃদ্ধ, শিক্ষিত হয়ে উঠছিল। তথ্যপ্রবাহের সুফল তারা ভোগ করছিল, তারা অনেক কিছু জানত। কিন্তু ইউরোপের বেশির ভাগ অঞ্চলে এই গোষ্ঠীর সদস্যদের ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। এমনকি মর্যাদাপূর্ণ সরকারি এবং সামাজিক অবস্থান থেকেও তারা বঞ্চিত ছিল।
ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদও ব্যাপক অসন্তোষের কারণ হয়েছিল। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের সাম্রাজ্যগুলোতে এই জাতীয়তাবাদ বিশেষভাবে বাধার মুখে পড়েছিল। কারণ, এসব অঞ্চলে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা জাতিগত, ধর্মীয় এবং ভাষাগত বিষয়গুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। সেই এলাকাগুলোতে স্বায়ত্তশাসন, এমনকি স্বাধীনতার দাবি জোরদার হচ্ছিল; বিশেষ করে বর্তমান হাঙ্গেরি ও চেকোস্লোভাকিয়া (পরবর্তী সময়ে) ও বিভিন্ন স্লাভ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা স্থিতিশীলতাকে ভয়াবহ হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল।
১৮৪০-এর দশকে, ইউরোপজুড়ে একটি ধারণা ছিল যে এখানে আর কোনো রাজনৈতিক সম্ভাবনা নেই। যেমন ক্লার্ক এক বেলজিয়ান চরমপন্থীর পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেছেন তাঁরই ভাষায়, ‘কোনো জাতি বা সরকার জানত না, তারা কোথায় যাচ্ছে।’ কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ফলে সৃষ্ট বহুমুখী সংকট স্পষ্ট হলেও বিপ্লব তখনো অনিবার্য হয়ে ওঠেনি। ক্লার্ক যেমন লিখেছেন, বিপ্লব দুটি পর্যায়ে আবির্ভূত হয়: ধীরে ধীরে এবং এরপর হঠাৎ করে।
১৮৪৮ সালের ক্ষেত্রে, দুটি প্রধান অনুঘটক অবশেষে বিপ্লবের জন্ম দেয়। প্রথমটি ছিল: অর্থনৈতিক সংকট। ১৮৪৫ সালের শুরুতে, ইউরোপে কয়েক মৌসুম ফসল মার খায়। বিশেষভাবে ইউরোপের বেশির ভাগ অঞ্চলজুড়ে আলুর ফলন-বিপর্যয়ের প্রভাব ছিল বিধ্বংসী। আলুর ফলন বিপর্যয়ের কারণে নেমে আসে অর্থনৈতিক মন্দা এবং সেই সঙ্গে অর্থনীতি নিয়ে জনমনে আতঙ্ক। কৃষিতে এই সামগ্রিক বিপর্যয়ের কারণে কিছু জায়গায় ভয়াবহ খাদ্যঘাটতি এবং এমনকি দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল আয়ারল্যান্ডে।
দ্বিতীয় অনুঘটকটি আঘাত হেনেছিল ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ফরাসি শ্রমিকদের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমেই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা রাজা লুই ফিলিপ এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া গুইজোতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহ রাজতন্ত্রের পতন ঘটায় এবং দ্বিতীয় ফরাসি প্রজাতন্ত্র (সেকেন্ড রিপাবলিক) গঠনের দিকে চালিত করে।
অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের তৎকালীন চ্যান্সেলর ক্লেমেন্স ভন মেটারনিক যেমন ঘটনার এক দশক আগেই বলেছিলেন, ‘ফ্রান্স যখন হাঁচি দেয়, তখন ইউরোপে সর্দি লাগে!’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন, রেডিও বা এমনকি ব্যাপক সাক্ষরতার অভাব সত্ত্বেও, ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইউরোপজুড়ে ব্যাপক বিদ্রোহ শুরু হয়। যে শাসনব্যবস্থাগুলোকে সুরক্ষিত এবং চিরস্থায়ী বলে মনে হয়েছিল, একের পর এক সেগুলোর পতন ঘটে বা তারা ছাড় দিতে বাধ্য হয়। অথচ এত দিন ভাবা হতো এই ব্যবস্থা বদলাবার নয়!
ক্লার্ক লিখেছেন, ‘গণমানুষের উত্থান মহাদেশজুড়ে ব্রাশফায়ারের মতো ছড়িয়ে পড়ে, শহর থেকে শহরে জ্বলে ওঠে।’ বার্লিন, প্রাগ, ভিয়েনা, বুদাপেস্ট, মিউনিখ, মিলান, ভেনিস এবং অন্যান্য ইউরোপীয় শহর তখন উত্তাল। এসব শহরের চেহারা দেখেই মানুষ বুঝে ফেলেছিল বিপ্লব আসন্ন।
বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর মানুষ অভিভূত ও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কিন্তু মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে রাজতান্ত্রিক একনায়কত্ব ইউরোপের সমস্ত অঞ্চলে আবার ফিরে আসে। অথচ সব কটিকে ১৮৪৮ সালের বসন্তে বিতাড়িত করা হয়েছিল।
১৮৪৮-এর এই বসন্ত বিপ্লবের শর্ত, বিকাশ, বিজয় এবং বিজয়-পরবর্তী পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, ইউরোপের এই বিপ্লবের ব্যর্থতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল আন্দোলনকারীদের মধ্যকার দুর্বলতা। আন্দোলনকারীরা পুরোনো ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে একটি নতুন ব্যবস্থা গড়া যায়, সে সম্পর্কে তাদের মধ্যে ঐকমত্য ছিল না। পুরোনো ব্যবস্থার পতনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে গভীর বিভাজন স্পষ্ট হতে থাকে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণি মূলত একটি উদারনৈতিক ব্যবস্থা চেয়েছিল, কিন্তু পুরোনোটিকে সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপন করার জন্য একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তারা চায়নি। তারা শুধু এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা চেয়েছিল, যেখানে তাদের অংশগ্রহণ থাকবে এবং অভিজাতদের বিশেষ সুবিধা দেবে না। তবে তারা সর্বজনীন ভোটাধিকার এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের পক্ষে শ্রমিকদের দাবির প্রতি সদয় ছিল না; বরং দুই প্রস্তাবই তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল। কৃষকেরা রাজনৈতিক সংস্কারে কম আগ্রহী ছিল, বরং তারা সম্পত্তি রক্ষার নিশ্চয়তা চেয়েছিল। পূর্ব ইউরোপের বেশির ভাগ অংশসহ যেখানে কৃষিই প্রধান পেশা, সেখানে সামন্তীয় বিশেষাধিকার এবং জমির মালিকানা বিলুপ্তির মাধ্যমে নিজেদের সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষিত করেছিল কৃষকেরা।
১৮ শতকের ফরাসি বিপ্লবের স্মৃতি দ্বারা তাড়িত হয়ে রাজারা ১৮৪৮ সালে অধিকতর মধ্যপন্থী দাবিগুলোর প্রতি নমনীয়তা দেখাতে শুরু করেন, কিছু ক্ষেত্রে দ্রুতই সেগুলো মেনে নেন। উদাহরণস্বরূপ, সংবিধান প্রণয়ন এবং অনেক সামন্ততান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা দূর করতে সম্মত হন রাজারা। এর ফলে উদারপন্থী এবং কৃষকেরা অনেকাংশে সন্তুষ্ট হয়। এই পরিবর্তনগুলো অবশ্য আন্দোলনের কর্মীদের (অ্যাকটিভিস্ট) এবং কট্টরপন্থীদের সন্তুষ্ট করেনি। এই গোষ্ঠীগুলো কেবল পূর্ণ গণতন্ত্রীকরণই নয়, ন্যূনতম মজুরি, বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং কাজের অধিকারের মতো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারও নিশ্চিত করার দাবিতে অনড় থাকেন।
লেখক: আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
৪ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
৪ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
৪ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
৪ ঘণ্টা আগে