পৃথিবীর অনেক দেশেই সেলফোনের ব্যাপক প্রসার হয়েছে, কোটি কোটি মানুষের সেখানে জীবিকার স্থান। কিন্তু এ কথা সত্যি, উন্নত দেশগুলোতে এখন মানুষ কথা না বলে ফেসবুকে বা অন্যান্য মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত বার্তা দিয়ে তাদের কাজটি সেরে নেয়। মানুষ সৃষ্টিশীল জীব এবং পরস্পরের আদান-প্রদানের মাধ্যমই তার বিকাশ ঘটে।
মামুনুর রশীদ
একদিন ভোরবেলা জাকারবার্গ লক্ষ করলেন যে পৃথিবীতে একটা ছোট্ট দেশে তাঁর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা হচ্ছে। সামনের ফ্লোরটায় দেখলেন দেশটা ছোট বটে, কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। আর এই দেশের জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। ফেসবুকে দেখতে পেলেন অসংখ্য বার্তা—সবই রাজনৈতিক এবং ছবিতে এ বিষয়ে বিপুল জনগণের উপস্থিতি। সাম্প্রতিককালে কিংবা অতীতে কোনো গণ-আন্দোলনে এত লোকের উপস্থিতি তিনি কোথাও দেখেননি। এ আন্দোলনে যারা উপস্থিত হয়েছিল তাদের বয়স দশ থেকে পঁচিশ কিংবা ছাব্বিশ বছর। তাদের চোখেমুখে বিক্ষোভ, দুনিয়াটাকে বদলানোর একটা আকাঙ্ক্ষা। এই দেশটা সম্পর্কে তিনি খোঁজখবর নিতে লাগলেন। এ দেশে সেলফোন ব্যবহার করে প্রায় ১১ কোটি মানুষ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি হলেও বাংলাদেশ থেকে আয় হচ্ছে অনেক দেশের চায়ে বেশি। বিশেষ করে ফেসবুক।
ফেসবুক ট্রলের দিক থেকে বাংলাদেশ বোধ হয় সবচেয়ে বেশি তৎপর। কোনো একটি মন্তব্য বা লেখা পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তার মানে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এতই সক্রিয় যে মনে হয় এ দেশের মানুষ ঘুমায় না, বিশ্রাম করে না বা কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে না। সব সময়ই ফেসবুকটাকে খোলা রেখে তাদের প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে যায়। ফেসবুকে তরুণ-তরুণীদের ভালোবাসার কথা, প্রেমের কথা, জন্মদিনের শুভেচ্ছা, বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা, নতুন বন্ধু খোঁজা কিংবা বন্ধুত্বের অবসান— এসবই থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিশেষ করে জুলাই মাসে এসব কমে গিয়ে বা একেবারে অনুপস্থিত থেকে এক সরকারপ্রধানের পতন এবং পতন-পরবর্তী গুজব ও সংবাদে ভরে থেকেছে।
জাকারবার্গ মাঝে মাঝে বড় বিষণ্ন হয়ে পড়েন। কারণ, তাঁর ফেসবুকটা অধিকাংশ সময় গুজব রটনার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। সেই সঙ্গে চলে প্রতিশোধস্পৃহা, চরিত্র হনন এবং টানাপোড়েনে কুৎসা রটনা। কিন্তু এবারে গুজব, চরিত্র হনন এসব তো আছেই, সেই সঙ্গে নানা ধরনের হুমকি, হুঁশিয়ারি এবং প্রতিশোধের কথাও উঠে এসেছে। ব্যবহারকারীদের মধ্যে শিশু-কিশোর এবং যুবকেরাই সবচেয়ে বেশি। বয়স্ক লোকেরা ধীরে ধীরে এই স্থান থেকে সরে যাচ্ছেন। অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের ফেসবুক ব্যবহার না করার জন্য নানা উপদেশ, ভর্ৎসনা এবং অনুৎসাহিত করে থাকেন। কিন্তু এবারে সেসব কোনো কাজে আসেনি।
সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটল যখন দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলো। জাকারবার্গ তখন খুবই দুঃখিত হলেন যে এত বড় বাজার তাঁর হারিয়ে গেল। ইন্টারনেটের ভিন্ন পথও তরুণেরা ঠিক খুঁজে বের করল, ইন্টারনেট আবার চালুও হলো। তখন দেখা গেল ফেসবুকে রীতিমতো প্লাবন ঘটে যাচ্ছে। এই মহাপ্লাবনে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন তাঁদের পতন হলো এবং যাঁরা ছাত্র তাঁরা বিজয়ী হলো।
হঠাৎ ফেসবুক একটা গণ-অভ্যুত্থানে দারুণ ভূমিকা পালন করেছে। আর এই ঘটনা দেখে জাকারবার্গ মহাখুশি।
কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী অভিভাবক প্রায়ই ফেসবুককে গালমন্দ করে থাকেন। এটি নাকি মানুষকে দায়িত্বহীন করে দেয়। যার যা খুশি লিখে সমাজে একটা অপাঘাত সৃষ্টি করে। এইসব গালমন্দকারী লোকগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া দরকার, ফেসবুক সমাজ পরিবর্তনে কতটা কাজ করতে পারে।
বাংলা ভাষায় একটি প্রচলিত শব্দ হচ্ছে ‘কিন্তু’। এই ‘কিন্তু’ শব্দটা রাজা রামমোহন রায়ের বাবার খুব অপছন্দ ছিল। রাজা রামমোহন রায় কথার মধ্যে ‘কিন্তু কিন্তু’ বলতেন। একদিন তাঁর বাবা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘কখনো কিন্তু কিন্তু বলবে না, এই বদভ্যাস তুমি ত্যাগ করো।’ কিন্তু এই ‘কিন্তু’ বলা লোকটি জীবনেও ‘কিন্তু’ বলা বন্ধ করেননি। এই ‘কিন্তু’র সুযোগে দুটি কথা বলতে চাই। কাজী নজরুল ইসলাম অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহসের কথা বলেছেন। অসংকোচটি ন্যায়, সত্য, যুক্তি এসবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের যে সাহস—তার কথা বলেছেন। কিন্তু বাংলা ভাষাটা একবার শিখলে যেকোনো সময়ে যেকোনো মন্তব্যও যুক্তির ধার ধারে না এবং নৈতিকতার ধার ধারে না, মিথ্যা প্রকাশে যার কোনো ভয় নেই, সেই অসংখ্য প্রকাশের কথা কি তিনি বলেছেন?
এ কথা বলব না যে ফেসবুকে কিছু মতামত, ইংরেজিতে যা বলা হয় ‘পোস্ট’ তা যুক্তিসংগত নয় অথবা নতুন কোনো তথ্য দিয়ে বন্ধুদের মননশীল করে তোলে না—এমন কথা বলছি না। কিন্তু গুজবনির্ভর মিথ্যাও কখনো যে দ্রুত সত্যে পরিণত হয় তা-ও ফেসবুকের অন্তরে নিক্ত থাকে।
আমার একটি নাটক আছে, যা মঞ্চে এখনো চলছে, নাম ‘কহে ফেসবুক’। নাটকে ফেসবুক প্রজন্ম এমন একটি সমাজ নির্মাণ করছে, যেখানে একজন অভিভাবক ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ফেসবুকটিকে অভিপ্রায় প্রকাশ করছেন নানানভাবে। তাঁর সহকর্মীর প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন, ‘ফেসবুকে টাকার অভাব হয় না। পৃথিবীর কোটি কোটি লোক এখানে টাকা লগ্নি করে। কিন্তু আমি ফেসবুক কিনতে চাচ্ছি অন্য কারণে। তা হলো ফেসবুক কিনে আমি তা বন্ধ করে দেব। আমার মতো কোটি কোটি পিতা কোটি কোটি অভিভাবক এই ফেসবুকের যন্ত্রণায় জীবনের অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছে।’ কথাটা কি সত্যি? হয়তো সত্য নয়। কারণ, ফেসবুক আমাদের কাছে কিছু নতুন তথ্য নিয়ে আসে। কিন্তু সেই তথ্য কতটা সত্য, কতটা যৌক্তিক— এই বিবেচনা বোধ যদি মানুষ হারিয়ে ফেলে তাহলে আবারও ‘কিন্তু’র আমদানি করতে হয়।
কিন্তু কী দাঁড়াল? আমার বই পড়া জ্ঞানার্জন, মানুষে মানুষে মেলামেশা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে দিন-রাত আমার হাতের আঙুলটি পড়ে থাকছে ফেসবুকের ওপর। জাকারবার্গ এমন ব্যবস্থা করেছেন যে মিনিটে নয়, প্রতিটি সেকেন্ডে ফেসবুকের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। নতুন নতুন কথা আসছে, বাহারের সব গুজব আসছে। বন্ধু ও শত্রুর হাত প্রসারিত হচ্ছে এবং আমার বিবেচনা বোধকে ভোঁতা করে দিয়ে সব কিছুকেই যেন আমার বুদ্ধি ও হৃদয় গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছে। সেই সঙ্গে কাছের ইন্টারনেটের নানান সুযোগ মানুষের দীর্ঘদিনের গবেষণা, সাধনা এবং উচ্চাঙ্গের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের উপাদান উপেক্ষিত হয়ে কয়েক লাইনে তার জবাব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। জ্ঞান প্রসারিত
হওয়ার সুযোগ যেমন একদিকে কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে মানুষও সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণ হচ্ছে।
জাকারবার্গ হয়তো জানেন না, তিনি যে সুযোগ সৃষ্টি করেছেন যাতে ভুয়া আইডি খোলার সুযোগ রেখেছেন এবং সেখান থেকে কত ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যে সৃষ্টি হতে পারে। কত লোকের মৃত্যু হতে পারে, কত লোক কারাবরণ করতে পারে, কত পরিবার ধ্বংস হতে পারে, তা তিনি জানেন না। প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির কালে ফেসবুক আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে তার অবসান ঘটবে না, বিতর্ক চলতেই থাকবে। আর যতক্ষণ না মানুষ তাতে রাক্ষস থেকে মর্ত্যের মানুষ হিসেবে প্রত্যাবর্তন করবে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই সেলফোনের ব্যাপক প্রসার হয়েছে, কোটি কোটি মানুষের সেখানে জীবিকার স্থান। কিন্তু এ কথা সত্যি, উন্নত দেশগুলোতে এখন মানুষ কথা না বলে ফেসবুকে বা অন্যান্য মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত বার্তা দিয়ে তাদের কাজটি সেরে নেয়। মানুষ সৃষ্টিশীল জীব এবং পরস্পরের আদান-প্রদানের মাধ্যমই তার বিকাশ ঘটে। মানুষের স্পর্শ জীবনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানুষে মানুষে উষ্ণতা বিনিময় না হলে পৃথিবীতে কোনো ঘটনাই ঘটে না। এ দেশে ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার ফলে মানুষ পথে নেমেছিল বলেই একটা অভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছে। ঘরে বসে থাকলে, শুধু ফেসবুকে বিনিময় হলে এটি সম্ভব হতো না।
কিন্তু জাকারবার্গ কী করতেন বা বিল গেটস কী করতেন? তাঁদের বিবেক বারবার নাড়া দেয়। নানা ধরনের কল্যাণমূলক কাজে তাঁরা যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু অজান্তেই যে ঘটনা ঘটে গেছে, তা থেকে ফেরার কি কোনো উপায় আছে? হ্যাঁ, উপায় একটাই—মানুষ যখন অপ্রয়োজনে কোনো মন্তব্য দেবে না, গুজবকে নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অর্জন করবে, ন্যায়-অন্যায় বোধকে বোঝার যথার্থ ক্ষমতা অর্জন করবে, তখন এই ফেসবুককে তারা অন্যভাবে ব্যবহার করতে
শুরু করবে। কিন্তু সেটা কি কোনো উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া সম্ভব? নাহ্, সেটি সম্ভব নয়।
অনুন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থার প্রেসক্রিপশনটাও আসে ওই ওদের দেশ থেকেই। তাই মানুষের মানবিক বিকাশ একটা পর্যায়ে গিয়ে রুদ্ধ হয়ে যায়। মানুষ নানান ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভক্ত হয়ে যায়। এ বিভক্ত মানুষ ফেসবুক আশ্রিত হয়ে নিজের কথাকেই অত্যন্ত সংকীর্ণতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চায়। এই অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহসকে যদি যৌক্তিক না করা যায় তাহলে যে সভ্যতা বিনাশী হয়ে পড়বে!
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
একদিন ভোরবেলা জাকারবার্গ লক্ষ করলেন যে পৃথিবীতে একটা ছোট্ট দেশে তাঁর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা হচ্ছে। সামনের ফ্লোরটায় দেখলেন দেশটা ছোট বটে, কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। আর এই দেশের জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। ফেসবুকে দেখতে পেলেন অসংখ্য বার্তা—সবই রাজনৈতিক এবং ছবিতে এ বিষয়ে বিপুল জনগণের উপস্থিতি। সাম্প্রতিককালে কিংবা অতীতে কোনো গণ-আন্দোলনে এত লোকের উপস্থিতি তিনি কোথাও দেখেননি। এ আন্দোলনে যারা উপস্থিত হয়েছিল তাদের বয়স দশ থেকে পঁচিশ কিংবা ছাব্বিশ বছর। তাদের চোখেমুখে বিক্ষোভ, দুনিয়াটাকে বদলানোর একটা আকাঙ্ক্ষা। এই দেশটা সম্পর্কে তিনি খোঁজখবর নিতে লাগলেন। এ দেশে সেলফোন ব্যবহার করে প্রায় ১১ কোটি মানুষ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি হলেও বাংলাদেশ থেকে আয় হচ্ছে অনেক দেশের চায়ে বেশি। বিশেষ করে ফেসবুক।
ফেসবুক ট্রলের দিক থেকে বাংলাদেশ বোধ হয় সবচেয়ে বেশি তৎপর। কোনো একটি মন্তব্য বা লেখা পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তার মানে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এতই সক্রিয় যে মনে হয় এ দেশের মানুষ ঘুমায় না, বিশ্রাম করে না বা কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে না। সব সময়ই ফেসবুকটাকে খোলা রেখে তাদের প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে যায়। ফেসবুকে তরুণ-তরুণীদের ভালোবাসার কথা, প্রেমের কথা, জন্মদিনের শুভেচ্ছা, বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা, নতুন বন্ধু খোঁজা কিংবা বন্ধুত্বের অবসান— এসবই থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিশেষ করে জুলাই মাসে এসব কমে গিয়ে বা একেবারে অনুপস্থিত থেকে এক সরকারপ্রধানের পতন এবং পতন-পরবর্তী গুজব ও সংবাদে ভরে থেকেছে।
জাকারবার্গ মাঝে মাঝে বড় বিষণ্ন হয়ে পড়েন। কারণ, তাঁর ফেসবুকটা অধিকাংশ সময় গুজব রটনার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। সেই সঙ্গে চলে প্রতিশোধস্পৃহা, চরিত্র হনন এবং টানাপোড়েনে কুৎসা রটনা। কিন্তু এবারে গুজব, চরিত্র হনন এসব তো আছেই, সেই সঙ্গে নানা ধরনের হুমকি, হুঁশিয়ারি এবং প্রতিশোধের কথাও উঠে এসেছে। ব্যবহারকারীদের মধ্যে শিশু-কিশোর এবং যুবকেরাই সবচেয়ে বেশি। বয়স্ক লোকেরা ধীরে ধীরে এই স্থান থেকে সরে যাচ্ছেন। অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের ফেসবুক ব্যবহার না করার জন্য নানা উপদেশ, ভর্ৎসনা এবং অনুৎসাহিত করে থাকেন। কিন্তু এবারে সেসব কোনো কাজে আসেনি।
সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটল যখন দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলো। জাকারবার্গ তখন খুবই দুঃখিত হলেন যে এত বড় বাজার তাঁর হারিয়ে গেল। ইন্টারনেটের ভিন্ন পথও তরুণেরা ঠিক খুঁজে বের করল, ইন্টারনেট আবার চালুও হলো। তখন দেখা গেল ফেসবুকে রীতিমতো প্লাবন ঘটে যাচ্ছে। এই মহাপ্লাবনে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন তাঁদের পতন হলো এবং যাঁরা ছাত্র তাঁরা বিজয়ী হলো।
হঠাৎ ফেসবুক একটা গণ-অভ্যুত্থানে দারুণ ভূমিকা পালন করেছে। আর এই ঘটনা দেখে জাকারবার্গ মহাখুশি।
কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী অভিভাবক প্রায়ই ফেসবুককে গালমন্দ করে থাকেন। এটি নাকি মানুষকে দায়িত্বহীন করে দেয়। যার যা খুশি লিখে সমাজে একটা অপাঘাত সৃষ্টি করে। এইসব গালমন্দকারী লোকগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া দরকার, ফেসবুক সমাজ পরিবর্তনে কতটা কাজ করতে পারে।
বাংলা ভাষায় একটি প্রচলিত শব্দ হচ্ছে ‘কিন্তু’। এই ‘কিন্তু’ শব্দটা রাজা রামমোহন রায়ের বাবার খুব অপছন্দ ছিল। রাজা রামমোহন রায় কথার মধ্যে ‘কিন্তু কিন্তু’ বলতেন। একদিন তাঁর বাবা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘কখনো কিন্তু কিন্তু বলবে না, এই বদভ্যাস তুমি ত্যাগ করো।’ কিন্তু এই ‘কিন্তু’ বলা লোকটি জীবনেও ‘কিন্তু’ বলা বন্ধ করেননি। এই ‘কিন্তু’র সুযোগে দুটি কথা বলতে চাই। কাজী নজরুল ইসলাম অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহসের কথা বলেছেন। অসংকোচটি ন্যায়, সত্য, যুক্তি এসবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের যে সাহস—তার কথা বলেছেন। কিন্তু বাংলা ভাষাটা একবার শিখলে যেকোনো সময়ে যেকোনো মন্তব্যও যুক্তির ধার ধারে না এবং নৈতিকতার ধার ধারে না, মিথ্যা প্রকাশে যার কোনো ভয় নেই, সেই অসংখ্য প্রকাশের কথা কি তিনি বলেছেন?
এ কথা বলব না যে ফেসবুকে কিছু মতামত, ইংরেজিতে যা বলা হয় ‘পোস্ট’ তা যুক্তিসংগত নয় অথবা নতুন কোনো তথ্য দিয়ে বন্ধুদের মননশীল করে তোলে না—এমন কথা বলছি না। কিন্তু গুজবনির্ভর মিথ্যাও কখনো যে দ্রুত সত্যে পরিণত হয় তা-ও ফেসবুকের অন্তরে নিক্ত থাকে।
আমার একটি নাটক আছে, যা মঞ্চে এখনো চলছে, নাম ‘কহে ফেসবুক’। নাটকে ফেসবুক প্রজন্ম এমন একটি সমাজ নির্মাণ করছে, যেখানে একজন অভিভাবক ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ফেসবুকটিকে অভিপ্রায় প্রকাশ করছেন নানানভাবে। তাঁর সহকর্মীর প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন, ‘ফেসবুকে টাকার অভাব হয় না। পৃথিবীর কোটি কোটি লোক এখানে টাকা লগ্নি করে। কিন্তু আমি ফেসবুক কিনতে চাচ্ছি অন্য কারণে। তা হলো ফেসবুক কিনে আমি তা বন্ধ করে দেব। আমার মতো কোটি কোটি পিতা কোটি কোটি অভিভাবক এই ফেসবুকের যন্ত্রণায় জীবনের অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছে।’ কথাটা কি সত্যি? হয়তো সত্য নয়। কারণ, ফেসবুক আমাদের কাছে কিছু নতুন তথ্য নিয়ে আসে। কিন্তু সেই তথ্য কতটা সত্য, কতটা যৌক্তিক— এই বিবেচনা বোধ যদি মানুষ হারিয়ে ফেলে তাহলে আবারও ‘কিন্তু’র আমদানি করতে হয়।
কিন্তু কী দাঁড়াল? আমার বই পড়া জ্ঞানার্জন, মানুষে মানুষে মেলামেশা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে দিন-রাত আমার হাতের আঙুলটি পড়ে থাকছে ফেসবুকের ওপর। জাকারবার্গ এমন ব্যবস্থা করেছেন যে মিনিটে নয়, প্রতিটি সেকেন্ডে ফেসবুকের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। নতুন নতুন কথা আসছে, বাহারের সব গুজব আসছে। বন্ধু ও শত্রুর হাত প্রসারিত হচ্ছে এবং আমার বিবেচনা বোধকে ভোঁতা করে দিয়ে সব কিছুকেই যেন আমার বুদ্ধি ও হৃদয় গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছে। সেই সঙ্গে কাছের ইন্টারনেটের নানান সুযোগ মানুষের দীর্ঘদিনের গবেষণা, সাধনা এবং উচ্চাঙ্গের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের উপাদান উপেক্ষিত হয়ে কয়েক লাইনে তার জবাব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। জ্ঞান প্রসারিত
হওয়ার সুযোগ যেমন একদিকে কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে মানুষও সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণ হচ্ছে।
জাকারবার্গ হয়তো জানেন না, তিনি যে সুযোগ সৃষ্টি করেছেন যাতে ভুয়া আইডি খোলার সুযোগ রেখেছেন এবং সেখান থেকে কত ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যে সৃষ্টি হতে পারে। কত লোকের মৃত্যু হতে পারে, কত লোক কারাবরণ করতে পারে, কত পরিবার ধ্বংস হতে পারে, তা তিনি জানেন না। প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির কালে ফেসবুক আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে তার অবসান ঘটবে না, বিতর্ক চলতেই থাকবে। আর যতক্ষণ না মানুষ তাতে রাক্ষস থেকে মর্ত্যের মানুষ হিসেবে প্রত্যাবর্তন করবে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই সেলফোনের ব্যাপক প্রসার হয়েছে, কোটি কোটি মানুষের সেখানে জীবিকার স্থান। কিন্তু এ কথা সত্যি, উন্নত দেশগুলোতে এখন মানুষ কথা না বলে ফেসবুকে বা অন্যান্য মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত বার্তা দিয়ে তাদের কাজটি সেরে নেয়। মানুষ সৃষ্টিশীল জীব এবং পরস্পরের আদান-প্রদানের মাধ্যমই তার বিকাশ ঘটে। মানুষের স্পর্শ জীবনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানুষে মানুষে উষ্ণতা বিনিময় না হলে পৃথিবীতে কোনো ঘটনাই ঘটে না। এ দেশে ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার ফলে মানুষ পথে নেমেছিল বলেই একটা অভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছে। ঘরে বসে থাকলে, শুধু ফেসবুকে বিনিময় হলে এটি সম্ভব হতো না।
কিন্তু জাকারবার্গ কী করতেন বা বিল গেটস কী করতেন? তাঁদের বিবেক বারবার নাড়া দেয়। নানা ধরনের কল্যাণমূলক কাজে তাঁরা যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু অজান্তেই যে ঘটনা ঘটে গেছে, তা থেকে ফেরার কি কোনো উপায় আছে? হ্যাঁ, উপায় একটাই—মানুষ যখন অপ্রয়োজনে কোনো মন্তব্য দেবে না, গুজবকে নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অর্জন করবে, ন্যায়-অন্যায় বোধকে বোঝার যথার্থ ক্ষমতা অর্জন করবে, তখন এই ফেসবুককে তারা অন্যভাবে ব্যবহার করতে
শুরু করবে। কিন্তু সেটা কি কোনো উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া সম্ভব? নাহ্, সেটি সম্ভব নয়।
অনুন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থার প্রেসক্রিপশনটাও আসে ওই ওদের দেশ থেকেই। তাই মানুষের মানবিক বিকাশ একটা পর্যায়ে গিয়ে রুদ্ধ হয়ে যায়। মানুষ নানান ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভক্ত হয়ে যায়। এ বিভক্ত মানুষ ফেসবুক আশ্রিত হয়ে নিজের কথাকেই অত্যন্ত সংকীর্ণতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চায়। এই অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহসকে যদি যৌক্তিক না করা যায় তাহলে যে সভ্যতা বিনাশী হয়ে পড়বে!
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
৫ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
৫ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
৫ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
৫ ঘণ্টা আগে