জাহীদ রেজা নূর
‘আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’—এই উচ্চারণ শুনে যাঁরা অন্য আর সব বিবেচনা বাদ দিয়ে শুধু সমালোচনা করতে থাকেন, তাঁদের জন্যই এই লেখা। প্রথমেই বলে রাখি, অকারণে এই শব্দগুলো উচ্চারণ করার ঘোরতর বিরোধী আমি। ইদানীং ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যাওয়া একটি ভিডিও ক্লিপ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, কত সহজে এই শব্দ তিনটিকে অসহায় অর্থহীন বানিয়ে দেওয়া সম্ভব। একজন ম্যাজিস্ট্রেট, একজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং একজন চিকিৎসক যেভাবে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন, তাতে কষ্ট পেয়েছি আমরা অনেকে। তাঁদের কথাবার্তা শোভন ছিল না। বুঝতে কষ্ট হয়নি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও আশপাশের পরিবেশই তাঁদের মুখে এই ভাষা তুলে দিয়েছে।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয় দিতে হলো কেন? কিংবা ক্ষমতায় কে কার চেয়ে বড়, তা নিয়ে ঝগড়াটা বাধল কেন? এমন কোনো ঘটনা তো ছিল না এটি, যার সহজ সমাধান খুব কঠিন ছিল? তিনজনই শিক্ষিত মানুষ। তিনজনই তাঁদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে পারতেন। একজন চিকিৎসক ফ্রন্টলাইনার, ওই পুলিশ কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেটের মতোই। তিনি যদি তাঁর পরিচয়পত্রটি না এনে থাকেন, তাহলে তাঁকে বিনীতভাবে সেটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া চলে। তিনি কোনো পাপিয়ার বংশধর কি না, সে প্রশ্নটি এখানে আসার কোনো কারণ নেই। তেমনি, চিকিৎসকও বিনয়ের সঙ্গে বলতে পারতেন, তিনি আইডি কার্ড আনতে ভুল গেছেন, ভবিষ্যতে কথাটি মনে রাখবেন। কিন্তু চিকিৎসক হতে পারেননি বলেই তাঁকে পুলিশে চাকরি নিতে হয়েছে, এ ধরনের অবান্তর কথা বলার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু তাঁরা তিনজন মিলে যে যাঁর ক্ষমতা দেখানোর শীর্ষভূমিতে পৌঁছে গেলেন। এই পুরো বিষয়টির সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়া বা না হওয়ার সম্পর্ক কী?
আরও আগে আরেকটি প্রশ্ন—দেশটার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু যেসব পরিবার, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার যেসব পরিবারের হাতে, রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতির সেবকসহ দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাঁদের প্রভাব রয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কি একটা কথা আমরা বলি? একটি বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকেরা তাঁদের ন্যায্য বেতনের দাবিতে মিছিল করলে পুলিশ তাতে গুলি চালিয়েছিল। তাতে মারা গেছেন পাঁচজন শ্রমিক। ফেসবুকে ঝড় উঠেছিল কিছুটা, কিন্তু তারপর সব চুপচাপ। অথচ দেখুন, ভণ্ড মামুনুল হকের পেছনে দাঁড়িয়ে গেল কত মানুষ! তাঁর আচরণকে জায়েজ করার জন্য উঠেপড়ে লাগল কত মানুষ! তার চেয়েও বড় বিস্ময় হলো, মামুনুল এ পর্যন্ত যে কথাবার্তা বলেছেন ওয়াজ-মাহফিল বা ধর্মীয় সভায়, তার মধ্যে সংবিধান ও ইসলামবিরোধী অনেক উপাদানই খুঁজে পাওয়া যায়; কিন্তু কেউই তা নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি। একজন নারীকে নিয়ে রিসোর্টে যাওয়াটা নিয়েই ব্যাপক বিনোদন পেয়েছে মানুষ। এবং বিয়ে করা স্ত্রী নাকি মানবিক বিয়ে করা স্ত্রী, না কোনো শহীদুল ভাইয়ের স্ত্রী—এ নিয়েই হাস্যরস ছড়িয়েছে।
শঙ্কার জায়গাটা এখানেই। মামুনুলের অপরাধ ধর্ম-ব্যবসা। মামুনুলের অপরাধ সংবিধান বিরোধিতা। শুধু মামুনুল কেন, ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে যারা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায়, সংবিধানবিরোধী কথা বলে, কাড়ি কাড়ি টাকা কামিয়ে আয়কর দেয় না, তাদের চিহ্নিত করার জন্য তো কোনো নারীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আছে কি নেই, সেটা বিবেচ্য নয়। নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে এরা যে কুকথা ছড়ায়, তার বিরুদ্ধেই তো আমরা। নারীর সম্মান ভূলুণ্ঠিত করছে এরা—সেটাই তো আমরা প্রমাণ করতে চাই। তাদের আসল অপরাধের জায়গাটা তো চিহ্নিত করা দরকার। তাদের অপরাধের জায়গা অন্যত্র—সেটাই আমরা চিহ্নিত করতে পারিনি। একটু ভেবে দেখুন তো, নারী ইস্যুতে ব্যাকফুটে না গেলে এই মামুনুলের আস্ফালন কি এখনো দেখতে হতো না?
আমরা চিহ্নিত করতে পারছি না, কোথায় কে কোন অপরাধ করছে। ধর্মকে ভাঙিয়ে খাচ্ছে যারা, সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তাদের অপরাধ ধরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে সরকারের খুব একটা আছে কি না, সেটা জানি না। কিন্তু এরই ফাঁক দিয়ে এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা সবার অগোচরে একটি পুরো প্রজন্মকে ভ্রান্ত বা বকধার্মিকে পরিণত করতে সমর্থ হলো। কী করে তা সম্ভব হলো? এটা কি এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের সাফল্য কেবল, আমাদের ব্যর্থতা বলে কিছু নেই?
এই প্রশ্নটির জবাব পেলেই ‘আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ কথাটির গুঢ়ার্থ বুঝতে পারব আমরা। কেন এই শব্দগুলোকে আমাদের ক্লিশে মনে হওয়া শুরু হলো, কেন ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দ দুটিকে নিয়েও আমরা হাসাহাসি করি—তা বোঝার চেষ্টা করতে পারব। এবং সেটা বুঝতে পারলেই আমাদের চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠবে একটি ছবি, যাতে দেখা যাবে এরই মধ্যে আমরা আমাদের স্বাধীন করা জমির একটা অংশ ছেড়ে দিয়েছি ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাতে, আরেকটি অংশ ছেড়ে দিয়েছি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চৈনিক বামদের হাতে। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের মাঝখানে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা অতি দ্রুত সুবিধাবাদী মানুষে পরিণত হয়েছেন। এবং তখন মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের গাল দিয়ে নিজের অবস্থান পোক্ত করে তুলতে চাইছেন। এ কারণেই ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’রাও তাঁদের পূর্ব প্রজন্মের বীরত্বের সম্মান রাখতে পারছেন না।
কথাগুলো খুব সহজে লিখে ফেলা যায়, কিন্তু খুব সহজে তা কারও মনে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া যায় না। এই ভয়ানক সত্যটি এতটাই অপ্রকাশ্য যে, দেখতে পাওয়া যায় না বললেই চলে। দেশপ্রেমহীন মানুষ অন্য অনেক লেবাসে ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের সর্বস্তরে। এবং এদের প্রভাবেই নিজেদের চিন্তাধারা পরিবর্তিত করে নিচ্ছেন আপাত-উদারপন্থী মানুষ। লক্ষ করে দেখবেন, ফেসবুকে আজকাল ‘প্রগতিশীল’ শব্দটিকেও পচিয়ে ফেলা হচ্ছে। শব্দটি এখন গালাগালে রূপান্তরিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। আরও একটু লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, এক শ্রেণির মানুষ এরই মধ্যে আমাদের সংস্কৃতি-উৎসবগুলো নিয়ে কটাক্ষ করতে শুরু করেছে, ছায়ানট নিয়ে যা ইচ্ছে তা-ই বলা শুরু করেছে। এদেরই দেখবেন করপোরেট দুনিয়ার অন্যায় কাজগুলো নিয়ে চুপ থাকতে, ওয়াজে সংবিধানবিরোধী কথাবার্তাকে অগ্রাহ্য করতে।
কেন এমনটা হলো? এটা কি হঠাৎ করেই আমাদের দেশে আবির্ভূত হয়েছে? এর পেছনে কি কোনো কার্যকারণ নেই?
বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই এই প্রক্রিয়া চলছিল, সেটা মেনে নেওয়া উচিত। তার আগে ইতিহাস ঘুরে এসে দেখতে হবে, ধার্মিক বাঙালি কী করে পাকিস্তান লাভের পর অসম্প্রদায়িক বাঙালিতে পরিণত হলো। একজন ধার্মিক মানুষ একই সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক থাকতে পারল তখন, কিন্তু স্বাধীনতার পর কেন তাদের ধর্মহীন হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হলো? ধর্মনিরপেক্ষতার মানে ধর্মহীনতা—এই চিন্তাধারা কারা ঢুকিয়ে দিল সাধারণ ধর্ম পালনরত মানুষের মাথায়? ধর্মনিরপেক্ষতার মানে তো খুবই সরল—রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে অন্য ধর্মের ওপর বসাবে না, এই দেশ সকল ধর্মের মানুষের সঙ্গে একই আচরণ করবে। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস। কিন্তু সে বিশ্বাসের কারণে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করতে পারবে না। সমাজের কোনো ক্ষেত্রেই ধর্মের কোনো অগ্রাধিকার থাকবে না। এটাই তো অন্যভাবে দেখলে অসাম্প্রদায়িকতা।
তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম যে সংশয়টি হাজির করা হলো, সেটা ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্ম ব্যবসায়ীরা এই ধর্মনিরপেক্ষতাকে নাস্তিকতা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। এবং ইতিহাসগতভাবে দীর্ঘকাল পরাধীন থাকায় বাঙালি চরিত্রে যে বেশকিছু অপমানকর অনৈতিকতা জন্ম হয়েছে, তারই প্রভাবে সুবিধাবাদী বাঙালি একাত্তরে পরাজিত ধর্ম ব্যবসায়ী ও চৈনিক বামদের খপ্পরে পড়ল। ইতিহাসসংলগ্ন কেউ ভুলে যাবে না, সে সময় সাহসী তরুণদের একটি দল সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে জাসদ বলে একটি রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময় দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্তের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। এমনকি তাঁর দলের মানুষেরাও দ্রুত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছিলেন। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান একা হয়ে পড়ছিলেন। তাঁর ভাষণগুলো শুনলেই বোঝা যাবে, তিনি তখন কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনগণের ওপর আস্থা রাখতে চাইছিলেন।
এরপরের ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যাবে—মোশতাক, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ধর্ম ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তানে কীভাবে পরিণত করেছিল। রাজনীতিতে ধর্মকে আবার টেনে আনার উৎসটাই তো চিহ্নিত করা সবচেয়ে জরুরি এখন। বেশি উদাহরণ দেব না, ‘আকলমন্দকে লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়’।
মোশতাক তাঁর প্রশাসনে কাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন? একাত্তর সালে অধিকৃত বাংলাদেশের চিফ সেক্রেটারি ছিলেন শফিউল আজম, মোশতাক তাঁকে পাকিস্তান থেকে নিয়ে এসে করেন কেবিনেট সেক্রেটারি। একাত্তরের স্বরাষ্ট্রসচিব সালাউদ্দিনকে ডেকে এনে দেওয়া হলো স্বরাষ্ট্র সচিবেরই পদ। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা তবারক হোসেনকে মোশতাক করলেন পররাষ্ট্র সচিব। মোশতাক ক্ষমতায় ছিলেন ৮২ দিন। দেশকে মিনি পাকিস্তানে পরিণত করার জন্য সবচেয়ে বড় দুটি ‘কীর্তি’ ছিল তাঁর, একটি হচ্ছে জেলহত্যা, অন্যটি ১৫ আগস্টের খুনিদের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বিচার বন্ধ করে দেওয়া।
মওলানা ভাসানী যে কখনোই শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থানকে সুনজরে দেখেননি, তার প্রমাণ তিনি দিয়েছিলেন মোশতাক সরকারকে আশীর্বাদ করে। তারও আগে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ‘বাংলাদেশ বেতার’কে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ বানানো আর ‘জয় বাংলা’র জায়গায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ দিয়েই কলুষিত পথে হাঁটার শুরু।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতিকে জটিল করে তুলতে চেয়েছেন। তিনি কাদের নিয়েছিলেন তাঁর মন্ত্রিসভায়? তিনি ভালো করেই জানতেন আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি বা মোজাফফর ন্যাপের নেতারা তাঁর তৈরি দলে যোগ দেবেন না। তাই তিনি ডান-বাম দুদিকেই হাত বাড়ান। কাকে পান? পান মুসলিম লীগারদের, জামায়াতিদের আর ভাসানী ন্যাপের লোকদের।
যে কট্টর বামপন্থীরা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল, তাদেরও প্রশ্রয় দিলেন জিয়াউর রহমান।এবং বললেন, ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’। এর ফল কী হলো, তা নিয়েই আগামী সংখ্যায় লিখব এবং ‘আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ শব্দ তিনটি যে মূলত গর্বের বিষয়, সেটা নিয়েও কথা বলব।
‘আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’—এই উচ্চারণ শুনে যাঁরা অন্য আর সব বিবেচনা বাদ দিয়ে শুধু সমালোচনা করতে থাকেন, তাঁদের জন্যই এই লেখা। প্রথমেই বলে রাখি, অকারণে এই শব্দগুলো উচ্চারণ করার ঘোরতর বিরোধী আমি। ইদানীং ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যাওয়া একটি ভিডিও ক্লিপ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, কত সহজে এই শব্দ তিনটিকে অসহায় অর্থহীন বানিয়ে দেওয়া সম্ভব। একজন ম্যাজিস্ট্রেট, একজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং একজন চিকিৎসক যেভাবে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন, তাতে কষ্ট পেয়েছি আমরা অনেকে। তাঁদের কথাবার্তা শোভন ছিল না। বুঝতে কষ্ট হয়নি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও আশপাশের পরিবেশই তাঁদের মুখে এই ভাষা তুলে দিয়েছে।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয় দিতে হলো কেন? কিংবা ক্ষমতায় কে কার চেয়ে বড়, তা নিয়ে ঝগড়াটা বাধল কেন? এমন কোনো ঘটনা তো ছিল না এটি, যার সহজ সমাধান খুব কঠিন ছিল? তিনজনই শিক্ষিত মানুষ। তিনজনই তাঁদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে পারতেন। একজন চিকিৎসক ফ্রন্টলাইনার, ওই পুলিশ কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেটের মতোই। তিনি যদি তাঁর পরিচয়পত্রটি না এনে থাকেন, তাহলে তাঁকে বিনীতভাবে সেটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া চলে। তিনি কোনো পাপিয়ার বংশধর কি না, সে প্রশ্নটি এখানে আসার কোনো কারণ নেই। তেমনি, চিকিৎসকও বিনয়ের সঙ্গে বলতে পারতেন, তিনি আইডি কার্ড আনতে ভুল গেছেন, ভবিষ্যতে কথাটি মনে রাখবেন। কিন্তু চিকিৎসক হতে পারেননি বলেই তাঁকে পুলিশে চাকরি নিতে হয়েছে, এ ধরনের অবান্তর কথা বলার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু তাঁরা তিনজন মিলে যে যাঁর ক্ষমতা দেখানোর শীর্ষভূমিতে পৌঁছে গেলেন। এই পুরো বিষয়টির সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়া বা না হওয়ার সম্পর্ক কী?
আরও আগে আরেকটি প্রশ্ন—দেশটার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু যেসব পরিবার, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার যেসব পরিবারের হাতে, রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতির সেবকসহ দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাঁদের প্রভাব রয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কি একটা কথা আমরা বলি? একটি বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকেরা তাঁদের ন্যায্য বেতনের দাবিতে মিছিল করলে পুলিশ তাতে গুলি চালিয়েছিল। তাতে মারা গেছেন পাঁচজন শ্রমিক। ফেসবুকে ঝড় উঠেছিল কিছুটা, কিন্তু তারপর সব চুপচাপ। অথচ দেখুন, ভণ্ড মামুনুল হকের পেছনে দাঁড়িয়ে গেল কত মানুষ! তাঁর আচরণকে জায়েজ করার জন্য উঠেপড়ে লাগল কত মানুষ! তার চেয়েও বড় বিস্ময় হলো, মামুনুল এ পর্যন্ত যে কথাবার্তা বলেছেন ওয়াজ-মাহফিল বা ধর্মীয় সভায়, তার মধ্যে সংবিধান ও ইসলামবিরোধী অনেক উপাদানই খুঁজে পাওয়া যায়; কিন্তু কেউই তা নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি। একজন নারীকে নিয়ে রিসোর্টে যাওয়াটা নিয়েই ব্যাপক বিনোদন পেয়েছে মানুষ। এবং বিয়ে করা স্ত্রী নাকি মানবিক বিয়ে করা স্ত্রী, না কোনো শহীদুল ভাইয়ের স্ত্রী—এ নিয়েই হাস্যরস ছড়িয়েছে।
শঙ্কার জায়গাটা এখানেই। মামুনুলের অপরাধ ধর্ম-ব্যবসা। মামুনুলের অপরাধ সংবিধান বিরোধিতা। শুধু মামুনুল কেন, ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে যারা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায়, সংবিধানবিরোধী কথা বলে, কাড়ি কাড়ি টাকা কামিয়ে আয়কর দেয় না, তাদের চিহ্নিত করার জন্য তো কোনো নারীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আছে কি নেই, সেটা বিবেচ্য নয়। নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে এরা যে কুকথা ছড়ায়, তার বিরুদ্ধেই তো আমরা। নারীর সম্মান ভূলুণ্ঠিত করছে এরা—সেটাই তো আমরা প্রমাণ করতে চাই। তাদের আসল অপরাধের জায়গাটা তো চিহ্নিত করা দরকার। তাদের অপরাধের জায়গা অন্যত্র—সেটাই আমরা চিহ্নিত করতে পারিনি। একটু ভেবে দেখুন তো, নারী ইস্যুতে ব্যাকফুটে না গেলে এই মামুনুলের আস্ফালন কি এখনো দেখতে হতো না?
আমরা চিহ্নিত করতে পারছি না, কোথায় কে কোন অপরাধ করছে। ধর্মকে ভাঙিয়ে খাচ্ছে যারা, সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তাদের অপরাধ ধরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে সরকারের খুব একটা আছে কি না, সেটা জানি না। কিন্তু এরই ফাঁক দিয়ে এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা সবার অগোচরে একটি পুরো প্রজন্মকে ভ্রান্ত বা বকধার্মিকে পরিণত করতে সমর্থ হলো। কী করে তা সম্ভব হলো? এটা কি এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের সাফল্য কেবল, আমাদের ব্যর্থতা বলে কিছু নেই?
এই প্রশ্নটির জবাব পেলেই ‘আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ কথাটির গুঢ়ার্থ বুঝতে পারব আমরা। কেন এই শব্দগুলোকে আমাদের ক্লিশে মনে হওয়া শুরু হলো, কেন ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দ দুটিকে নিয়েও আমরা হাসাহাসি করি—তা বোঝার চেষ্টা করতে পারব। এবং সেটা বুঝতে পারলেই আমাদের চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠবে একটি ছবি, যাতে দেখা যাবে এরই মধ্যে আমরা আমাদের স্বাধীন করা জমির একটা অংশ ছেড়ে দিয়েছি ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাতে, আরেকটি অংশ ছেড়ে দিয়েছি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চৈনিক বামদের হাতে। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের মাঝখানে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা অতি দ্রুত সুবিধাবাদী মানুষে পরিণত হয়েছেন। এবং তখন মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের গাল দিয়ে নিজের অবস্থান পোক্ত করে তুলতে চাইছেন। এ কারণেই ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’রাও তাঁদের পূর্ব প্রজন্মের বীরত্বের সম্মান রাখতে পারছেন না।
কথাগুলো খুব সহজে লিখে ফেলা যায়, কিন্তু খুব সহজে তা কারও মনে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া যায় না। এই ভয়ানক সত্যটি এতটাই অপ্রকাশ্য যে, দেখতে পাওয়া যায় না বললেই চলে। দেশপ্রেমহীন মানুষ অন্য অনেক লেবাসে ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের সর্বস্তরে। এবং এদের প্রভাবেই নিজেদের চিন্তাধারা পরিবর্তিত করে নিচ্ছেন আপাত-উদারপন্থী মানুষ। লক্ষ করে দেখবেন, ফেসবুকে আজকাল ‘প্রগতিশীল’ শব্দটিকেও পচিয়ে ফেলা হচ্ছে। শব্দটি এখন গালাগালে রূপান্তরিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। আরও একটু লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, এক শ্রেণির মানুষ এরই মধ্যে আমাদের সংস্কৃতি-উৎসবগুলো নিয়ে কটাক্ষ করতে শুরু করেছে, ছায়ানট নিয়ে যা ইচ্ছে তা-ই বলা শুরু করেছে। এদেরই দেখবেন করপোরেট দুনিয়ার অন্যায় কাজগুলো নিয়ে চুপ থাকতে, ওয়াজে সংবিধানবিরোধী কথাবার্তাকে অগ্রাহ্য করতে।
কেন এমনটা হলো? এটা কি হঠাৎ করেই আমাদের দেশে আবির্ভূত হয়েছে? এর পেছনে কি কোনো কার্যকারণ নেই?
বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই এই প্রক্রিয়া চলছিল, সেটা মেনে নেওয়া উচিত। তার আগে ইতিহাস ঘুরে এসে দেখতে হবে, ধার্মিক বাঙালি কী করে পাকিস্তান লাভের পর অসম্প্রদায়িক বাঙালিতে পরিণত হলো। একজন ধার্মিক মানুষ একই সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক থাকতে পারল তখন, কিন্তু স্বাধীনতার পর কেন তাদের ধর্মহীন হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হলো? ধর্মনিরপেক্ষতার মানে ধর্মহীনতা—এই চিন্তাধারা কারা ঢুকিয়ে দিল সাধারণ ধর্ম পালনরত মানুষের মাথায়? ধর্মনিরপেক্ষতার মানে তো খুবই সরল—রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে অন্য ধর্মের ওপর বসাবে না, এই দেশ সকল ধর্মের মানুষের সঙ্গে একই আচরণ করবে। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস। কিন্তু সে বিশ্বাসের কারণে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করতে পারবে না। সমাজের কোনো ক্ষেত্রেই ধর্মের কোনো অগ্রাধিকার থাকবে না। এটাই তো অন্যভাবে দেখলে অসাম্প্রদায়িকতা।
তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম যে সংশয়টি হাজির করা হলো, সেটা ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্ম ব্যবসায়ীরা এই ধর্মনিরপেক্ষতাকে নাস্তিকতা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। এবং ইতিহাসগতভাবে দীর্ঘকাল পরাধীন থাকায় বাঙালি চরিত্রে যে বেশকিছু অপমানকর অনৈতিকতা জন্ম হয়েছে, তারই প্রভাবে সুবিধাবাদী বাঙালি একাত্তরে পরাজিত ধর্ম ব্যবসায়ী ও চৈনিক বামদের খপ্পরে পড়ল। ইতিহাসসংলগ্ন কেউ ভুলে যাবে না, সে সময় সাহসী তরুণদের একটি দল সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে জাসদ বলে একটি রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময় দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্তের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। এমনকি তাঁর দলের মানুষেরাও দ্রুত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছিলেন। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান একা হয়ে পড়ছিলেন। তাঁর ভাষণগুলো শুনলেই বোঝা যাবে, তিনি তখন কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনগণের ওপর আস্থা রাখতে চাইছিলেন।
এরপরের ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যাবে—মোশতাক, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ধর্ম ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তানে কীভাবে পরিণত করেছিল। রাজনীতিতে ধর্মকে আবার টেনে আনার উৎসটাই তো চিহ্নিত করা সবচেয়ে জরুরি এখন। বেশি উদাহরণ দেব না, ‘আকলমন্দকে লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়’।
মোশতাক তাঁর প্রশাসনে কাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন? একাত্তর সালে অধিকৃত বাংলাদেশের চিফ সেক্রেটারি ছিলেন শফিউল আজম, মোশতাক তাঁকে পাকিস্তান থেকে নিয়ে এসে করেন কেবিনেট সেক্রেটারি। একাত্তরের স্বরাষ্ট্রসচিব সালাউদ্দিনকে ডেকে এনে দেওয়া হলো স্বরাষ্ট্র সচিবেরই পদ। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা তবারক হোসেনকে মোশতাক করলেন পররাষ্ট্র সচিব। মোশতাক ক্ষমতায় ছিলেন ৮২ দিন। দেশকে মিনি পাকিস্তানে পরিণত করার জন্য সবচেয়ে বড় দুটি ‘কীর্তি’ ছিল তাঁর, একটি হচ্ছে জেলহত্যা, অন্যটি ১৫ আগস্টের খুনিদের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বিচার বন্ধ করে দেওয়া।
মওলানা ভাসানী যে কখনোই শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থানকে সুনজরে দেখেননি, তার প্রমাণ তিনি দিয়েছিলেন মোশতাক সরকারকে আশীর্বাদ করে। তারও আগে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ‘বাংলাদেশ বেতার’কে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ বানানো আর ‘জয় বাংলা’র জায়গায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ দিয়েই কলুষিত পথে হাঁটার শুরু।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতিকে জটিল করে তুলতে চেয়েছেন। তিনি কাদের নিয়েছিলেন তাঁর মন্ত্রিসভায়? তিনি ভালো করেই জানতেন আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি বা মোজাফফর ন্যাপের নেতারা তাঁর তৈরি দলে যোগ দেবেন না। তাই তিনি ডান-বাম দুদিকেই হাত বাড়ান। কাকে পান? পান মুসলিম লীগারদের, জামায়াতিদের আর ভাসানী ন্যাপের লোকদের।
যে কট্টর বামপন্থীরা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল, তাদেরও প্রশ্রয় দিলেন জিয়াউর রহমান।এবং বললেন, ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’। এর ফল কী হলো, তা নিয়েই আগামী সংখ্যায় লিখব এবং ‘আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ শব্দ তিনটি যে মূলত গর্বের বিষয়, সেটা নিয়েও কথা বলব।
সিসা একটি নরম ধাতু। এটি ঈষৎ নীলাভ ধূসর বর্ণের। এর পারমাণবিক সংখ্যা ৮২। ধাতুটি এতটাই নরম যে একটি ছুরির সাহায্যে একে কাটা যায়। সিসা কিন্তু মারাত্মক ক্ষতিকর বিষ। এই বিষের ভেতরেই বাস করছে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ। বাংলাদেশের বাতাসে যেমন সিসার উপস্থিতি দেখা গেছে, তেমনি মাটিতে-পানিতেও পাওয়া গেছে...
১৪ মিনিট আগেঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী পরিচয়ে দ্রুত অস্ত্রোপচারে সহায়তা করার কথা বলে পাপিয়া আক্তার রোগীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। তিনি যে ‘ভুয়া’ ছাত্রী, সেটি বুঝতে পেরে চিকিৎসকেরা তাঁকে আটক করেন। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। হয়তো তাঁর শাস্তিও হবে। পাপিয়া শুধু অচেনা রোগী ও তাদের স্বজনদের নয়, তাঁর স্বামীকেও ধোঁকা...
২৪ মিনিট আগেএখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১ দিন আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১ দিন আগে