নজরুল জাহিদ
‘আদারিং’ বলে একটা প্রপঞ্চ আছে। যার অর্থ, মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পক্ষপাতের কারণে কাউকে দূরে সরিয়ে রাখা। যেমন বয়স, জেন্ডার, গায়ের রং, পেশা ইত্যাদি কারণে কাউকে অ্যাভয়েড করা।
এই আদারিং সবচেয়ে ক্ষতিকর হয় তখন, যখন ধর্মের বা বিশ্বাসের কারণে কাউকে ঘৃণা করা হয়। কারণ, তখন ‘আদারড’-কে কেবল দূরে সরিয়ে রাখাই নয়; নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে চার কোটি মানুষের মৃত্যু, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু এর উদাহরণ। মনে আছে টিক্কা খানের কথা ‘আদমি নেহি মিট্টি চাহিয়ে’—‘মানুষ নয় মাটি চাই?’। কারণ, তাঁদের বিবেচনায় আমরা যথেষ্ট মুসলমান ছিলাম না।
দেশে দেশের যুদ্ধের কথা থাক। জীবনযুদ্ধের কথা বলি।
২০১৫ সালে অভিজিৎ রায়, ২০১৬ সালে জুলহাস আর তনয়ের হত্যাকাণ্ড, একই বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনে আগুন দেওয়া—এসব আমাদের মনে আছে। সেখানকার জাদুঘরে খাঁ সাহেবের ব্যবহৃত ‘সরোদ, বেহালা, সন্তুর, এসরাজ, সৌদি আরবের বাদশাহর দেওয়া জায়নামাজ, ভারতের মাইহার রাজ্যের রাজার দেওয়া গালিচা, নিজ হাতে লেখা অগণিত চিঠি, ছবি ও বড় পোর্ট্রেট—সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। (বাংলা ট্রিবিউন, ১৪ জানুয়ারি ২০১৬)
তখন কি আমরা জোরালোভাবে এই প্রশ্ন করেছিলাম যে, কারা কোন বিশ্বাসে এভাবে অন্য বিশ্বাসকে ‘আদার’ বা ‘নিশ্চিহ্ন’ করতে চায়। তাঁদের সুশিক্ষা, আর ভিন্ন বিশ্বাসীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছিল? ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলো ধ্বংস হওয়া কি কেবলমাত্র 'কয়েকটি নিষ্প্রাণ সরঞ্জামের’ ধ্বংস, নাকি সুরহীন অসুরের সমাজ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত ছিল? আলুর গুদামে আগুন লাগলে কেউ কেউ পানি নয়, লবণ হাতে দৌড়ে যায়। অন্যেরা যখন আগুন নেভাতে ব্যস্ত, এরা তখন লবণ মাখিয়ে পোড়া আলু খায়। নইলে ‘মাদ্রাসা শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী-ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায়’ আলাউদ্দিন খাঁয়ের বিরল সংগ্রহ পুড়িয়ে দেওয়া হবে কেন? আলাউদ্দিন খাঁও কি তবে এই ঘটনায় একটি পক্ষ ছিলেন? মরণোত্তর পক্ষ?
আমরা যখন কাঁঠাল আঁকি, মনে আগে থেকে গেঁথে রাখা ‘আদর্শ’ কাঁঠালটিই আঁকি। কিন্তু কাঁঠাল গাছের তলায় যখন যাই, সব কাঁঠাল কি এক রকম দেখায়? কোনোটা ছোট, কোনোটা বড়, কোনোটা বাঁকা, কোনোটা লম্বা। তাহলে যে কাঁঠালটা দেখতে আমার মনের মধ্যে গেঁথে রাখা কাঁঠালটার মতো নয়, সেটা কি কাঁঠাল নয়? মানুষও তেমনি। সবাই হয়তো আমার মনের মতো নয়। কিন্তু সবার মধ্যেই আছে অমিত সম্ভাবনা। বস্তুত আমরা সবাই এক।
আমরা যেমন একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখা হলে ‘হাই, হ্যালো’ করি, ‘সালাম-আদাব’ দিই; মায়া সভ্যতায় এ রকম অবস্থায় একজন আরেকজনকে বলতো, ‘In Lak'ech Ala K'in’ (ইনলাকেশ আলাকিন)। অর্থাৎ, ‘আই এম অ্যানাদার ইয়োরসেলফ’। খাঁটি বাংলায়, ‘আমিই তুমি’ বা ‘আমরা এক’। এভাবে তাঁরা নিজেদের বারবার একতা ও ঐক্যের কথা মনে করিয়ে দিত। আমরা জানি, শব্দের শক্তি আছে। বুঝে বললে শব্দের বারংবার উচ্চারণ অটো সাজেশনের মতো কাজ করে।
এ তো গেল অতি অতীতের কথা। এমনকি বর্তমানেও আমেরিকান আদিবাসী লাখোটারা পরস্পরকে সম্বোধনের সময় বলে ‘মিঠাকুইয়ে ওএয়াসিন’; অর্থাৎ, ‘আমরা পরস্পর সম্পর্কিত’। এই সম্পর্ক বা ‘ওয়াননেস’ বা ‘ইন্টারকানেকটেডনেস’ বলতে তাঁরা কেবল মানুষের সঙ্গে মানুষের নয়, বরং পশু-পাখি-কীটপতঙ্গ-গাছ-নদী-পাহাড়-উপত্যকা—সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্ক বুঝিয়ে থাকে। ভেদ-বিভেদের এই সময়ে আবার যদি আমরা চার হাজার বছর আগের মায়া সভ্যতার সেই শুভ সম্বোধনটি চালু করতে পারতাম !
এই তো সেদিন। একজন নৃবিজ্ঞানী আফ্রিকান আদিবাসী শিশুদের নিয়ে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। শিশুদের এক লাইনে দাঁড় করানো হলো। তাদের দেখানো হলো এক পাত্র ভরা নানান মজাদার ফল। তারপর ভরা পাত্রটি দূরে এক গাছের নিচে রেখে আসা হলো। এর পর শিশুদের বলা হলো, বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে দৌড় যেতে। যে আগে যেতে পারবে, সেই পাবে ফলভর্তি গামলা। ধরে নিন আমাদের বিস্কুট দৌড়ের মতো একটা খেলা, যেখানে মাত্র একটা বিস্কুট ঝুলবে।
বাঁশি বাজল। এবং অবাক কাণ্ড হলো, বাচ্চারা একজন আরেকজনের হাত ধরাধরি করে দৌড় দিল এবং একসঙ্গে গাছের কাছে পৌঁছাল। একসঙ্গেই তারা গামলাভর্তি ফল নিয়ে ফিরে এল। বিস্মিত নৃবিজ্ঞানী জিজ্ঞেস করলেন, কেন তারা একসঙ্গে দৌড় দিল। একজন কেউ একা জোরে দৌড় দিলে তো সে একাই জয়ী হতে পারত? বাচ্চারা একসঙ্গে জবাব দিল ‘ubuntu’। ‘উবুন্তু’ মানে হচ্ছে, ‘I exist because we exist’; অর্থাৎ, ‘সবাই আছে, বলেই আমি আছি’। (সূত্র: James Clear, ‘How to Be Happy: A Surprising Lesson on Happiness From an African Tribe’)
রুশ ঔপন্যাসিক দস্তয়েভস্কির ‘দ্য ইডিয়ট’ উপন্যাসে আছে, ‘beauty will save the world’।
মাঠের নানা ফসল, বাগানের নানা ফুল, গাছের নানা ফল—সবারই আলাদা নাম, রূপ, গন্ধ, স্বাদ আছে। কিন্তু সবাই মিলে একটা শক্তিশালী বন্ধন। এই যে ছন্দময় প্রাকৃতিক বন্ধনে একটির ওপর আরেকটির নির্ভরতা, গাছের ফল পাখি খায়, পাখির বিষ্ঠায় গাছ জন্মায়, ফুলের মধু মৌমাছি খায়, মৌমাছির ফুলভ্রমণে পরাগায়ন ঘটে। একটি আরেকটির ওপর ভর করে টিকে থাকে। কেউ কম বা কেউ বেশি প্রয়োজনীয় না। সবাই সমানভাবে জরুরি। মানুষেও এমন বৈচিত্র্য আছে। পাহাড়ি, আদিবাসী, সমতলের অধিবাসী, নারী, পুরুষ, সমপ্রেমী, হিজড়া, দলিত—সবাই সুন্দর। সবার নিজ নিজ ধর্ম, ভাষা, পোশাক, খাবার, ঐতিহ্য, উৎসব মিলে মানুষের সামগ্রিক সৌন্দর্য। এই যে আমেরিকা পৃথিবীতে মোড়লি করে যাচ্ছে, এর প্রধান কারণ হলো তার বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ। বৈচিত্র্যের সংরক্ষণেই রয়েছে মানুষের সসম্মানে টিকে থাকা, আর বৈচিত্র্যের ক্ষয়েই রয়েছে মানুষের মিলিতভাবে ক্ষয়ে যাওয়ার সূত্র।
আমাদের দেশে এই ক্ষয়ে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। এমনকি পাঠ্যপুস্তক থেকে বৈচিত্র্যের উপাদান সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। ক্লাসরুম থেকে শুরু করে সবখানে ভিন্নধারার চিন্তার প্রতি মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য একাডেমিক ফ্রিডমটা খুব জরুরি। কেন? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক, দর্শন বা জেন্ডার বিষয়ক পাঠদান চলছে; ছাত্র-শিক্ষক উভয়ে যত ভয়হীন চিত্তে কথা বলতে পারবে, ততই উভয়ে লাভবান হবে। দর্শনের আলোচনায় নাস্তিকতা আসতে পারে, জেন্ডারের আলোচনায় সমকামিতা আসতে পারে। এখন এই ক্লাসরুমের আলোচনায় যদি নাস্তিক বা সমকামী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ‘আদারড’ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে ছাত্র-শিক্ষক কেউই লাভবান হবে না। ফলত অজানা-অধরা থেকে যাবে এসব বিষয়ে হালনাগাদ তথ্যাদি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছাত্র-শিক্ষক সবাই।
বাংলাদেশের সব পর্যায়ের শিক্ষায়তনের শিক্ষকদের মধ্যে এই ‘আদার’ বোধ এখন বাস্তব। এতবার আক্রান্ত হওয়ার পর শঙ্কিত না হয়ে কে পারবেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কণিকা’-তে আছে—
‘দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি
সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?’
ভয়ের ব্যাপার হলো, বিনাশী এই ‘আদারিং’ বা শূন্যকরণ একবার শুরু হলে আর থামে না। মেইনস্ট্রিম পপুলেশন, আর সবাইকে ‘আদার’ করার পর নিজেদের মধ্যকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশকে ‘আদার’ করতে থাকে। আপনি এখন সংখ্যাগুরুর অংশ। আপনার চিন্তার বা রুচির সাথে না মিললে অন্যকে ‘আদার’ করা সমর্থন করছেন। বিশ্বাস করুন, আপনিও সংখ্যালঘু হয়ে যাবেন, আপনাকেও ‘আদার’ করা হবে অচিরেই। অনেকের মতো আপনিও ‘যথেষ্ট মুসলমান’ বা ‘যথেষ্ট হিন্দু’ না হওয়ার ‘অপরাধে’ সাজা পাবেন।
সুতরাং এখনই সতর্ক হওয়া দরকার। তারাপদ রায়ের কবিতায় আছে, ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে, আমরা বুঝতে পারি নি।’ আমাদের জীবনে যেন সেই কবিতা সত্য হয়ে না দাঁড়ায়। বৈচিত্র্য মেনে নিলে, তার মতো শক্তিশালী বন্ধন সমাজে আর হয় না। বৈচিত্র্যের সৌন্দর্যের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে গেলে কী হবে, তা দস্তয়েভস্কি বলেই দিয়েছেন, ‘কেউ আমাদের রক্ষা করতে পারবে না।’
লেখক: বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির কার্যালয়ের মানবাধিকার বিষয়ক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা
‘আদারিং’ বলে একটা প্রপঞ্চ আছে। যার অর্থ, মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পক্ষপাতের কারণে কাউকে দূরে সরিয়ে রাখা। যেমন বয়স, জেন্ডার, গায়ের রং, পেশা ইত্যাদি কারণে কাউকে অ্যাভয়েড করা।
এই আদারিং সবচেয়ে ক্ষতিকর হয় তখন, যখন ধর্মের বা বিশ্বাসের কারণে কাউকে ঘৃণা করা হয়। কারণ, তখন ‘আদারড’-কে কেবল দূরে সরিয়ে রাখাই নয়; নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে চার কোটি মানুষের মৃত্যু, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু এর উদাহরণ। মনে আছে টিক্কা খানের কথা ‘আদমি নেহি মিট্টি চাহিয়ে’—‘মানুষ নয় মাটি চাই?’। কারণ, তাঁদের বিবেচনায় আমরা যথেষ্ট মুসলমান ছিলাম না।
দেশে দেশের যুদ্ধের কথা থাক। জীবনযুদ্ধের কথা বলি।
২০১৫ সালে অভিজিৎ রায়, ২০১৬ সালে জুলহাস আর তনয়ের হত্যাকাণ্ড, একই বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনে আগুন দেওয়া—এসব আমাদের মনে আছে। সেখানকার জাদুঘরে খাঁ সাহেবের ব্যবহৃত ‘সরোদ, বেহালা, সন্তুর, এসরাজ, সৌদি আরবের বাদশাহর দেওয়া জায়নামাজ, ভারতের মাইহার রাজ্যের রাজার দেওয়া গালিচা, নিজ হাতে লেখা অগণিত চিঠি, ছবি ও বড় পোর্ট্রেট—সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। (বাংলা ট্রিবিউন, ১৪ জানুয়ারি ২০১৬)
তখন কি আমরা জোরালোভাবে এই প্রশ্ন করেছিলাম যে, কারা কোন বিশ্বাসে এভাবে অন্য বিশ্বাসকে ‘আদার’ বা ‘নিশ্চিহ্ন’ করতে চায়। তাঁদের সুশিক্ষা, আর ভিন্ন বিশ্বাসীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছিল? ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলো ধ্বংস হওয়া কি কেবলমাত্র 'কয়েকটি নিষ্প্রাণ সরঞ্জামের’ ধ্বংস, নাকি সুরহীন অসুরের সমাজ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত ছিল? আলুর গুদামে আগুন লাগলে কেউ কেউ পানি নয়, লবণ হাতে দৌড়ে যায়। অন্যেরা যখন আগুন নেভাতে ব্যস্ত, এরা তখন লবণ মাখিয়ে পোড়া আলু খায়। নইলে ‘মাদ্রাসা শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী-ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায়’ আলাউদ্দিন খাঁয়ের বিরল সংগ্রহ পুড়িয়ে দেওয়া হবে কেন? আলাউদ্দিন খাঁও কি তবে এই ঘটনায় একটি পক্ষ ছিলেন? মরণোত্তর পক্ষ?
আমরা যখন কাঁঠাল আঁকি, মনে আগে থেকে গেঁথে রাখা ‘আদর্শ’ কাঁঠালটিই আঁকি। কিন্তু কাঁঠাল গাছের তলায় যখন যাই, সব কাঁঠাল কি এক রকম দেখায়? কোনোটা ছোট, কোনোটা বড়, কোনোটা বাঁকা, কোনোটা লম্বা। তাহলে যে কাঁঠালটা দেখতে আমার মনের মধ্যে গেঁথে রাখা কাঁঠালটার মতো নয়, সেটা কি কাঁঠাল নয়? মানুষও তেমনি। সবাই হয়তো আমার মনের মতো নয়। কিন্তু সবার মধ্যেই আছে অমিত সম্ভাবনা। বস্তুত আমরা সবাই এক।
আমরা যেমন একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখা হলে ‘হাই, হ্যালো’ করি, ‘সালাম-আদাব’ দিই; মায়া সভ্যতায় এ রকম অবস্থায় একজন আরেকজনকে বলতো, ‘In Lak'ech Ala K'in’ (ইনলাকেশ আলাকিন)। অর্থাৎ, ‘আই এম অ্যানাদার ইয়োরসেলফ’। খাঁটি বাংলায়, ‘আমিই তুমি’ বা ‘আমরা এক’। এভাবে তাঁরা নিজেদের বারবার একতা ও ঐক্যের কথা মনে করিয়ে দিত। আমরা জানি, শব্দের শক্তি আছে। বুঝে বললে শব্দের বারংবার উচ্চারণ অটো সাজেশনের মতো কাজ করে।
এ তো গেল অতি অতীতের কথা। এমনকি বর্তমানেও আমেরিকান আদিবাসী লাখোটারা পরস্পরকে সম্বোধনের সময় বলে ‘মিঠাকুইয়ে ওএয়াসিন’; অর্থাৎ, ‘আমরা পরস্পর সম্পর্কিত’। এই সম্পর্ক বা ‘ওয়াননেস’ বা ‘ইন্টারকানেকটেডনেস’ বলতে তাঁরা কেবল মানুষের সঙ্গে মানুষের নয়, বরং পশু-পাখি-কীটপতঙ্গ-গাছ-নদী-পাহাড়-উপত্যকা—সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্ক বুঝিয়ে থাকে। ভেদ-বিভেদের এই সময়ে আবার যদি আমরা চার হাজার বছর আগের মায়া সভ্যতার সেই শুভ সম্বোধনটি চালু করতে পারতাম !
এই তো সেদিন। একজন নৃবিজ্ঞানী আফ্রিকান আদিবাসী শিশুদের নিয়ে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। শিশুদের এক লাইনে দাঁড় করানো হলো। তাদের দেখানো হলো এক পাত্র ভরা নানান মজাদার ফল। তারপর ভরা পাত্রটি দূরে এক গাছের নিচে রেখে আসা হলো। এর পর শিশুদের বলা হলো, বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে দৌড় যেতে। যে আগে যেতে পারবে, সেই পাবে ফলভর্তি গামলা। ধরে নিন আমাদের বিস্কুট দৌড়ের মতো একটা খেলা, যেখানে মাত্র একটা বিস্কুট ঝুলবে।
বাঁশি বাজল। এবং অবাক কাণ্ড হলো, বাচ্চারা একজন আরেকজনের হাত ধরাধরি করে দৌড় দিল এবং একসঙ্গে গাছের কাছে পৌঁছাল। একসঙ্গেই তারা গামলাভর্তি ফল নিয়ে ফিরে এল। বিস্মিত নৃবিজ্ঞানী জিজ্ঞেস করলেন, কেন তারা একসঙ্গে দৌড় দিল। একজন কেউ একা জোরে দৌড় দিলে তো সে একাই জয়ী হতে পারত? বাচ্চারা একসঙ্গে জবাব দিল ‘ubuntu’। ‘উবুন্তু’ মানে হচ্ছে, ‘I exist because we exist’; অর্থাৎ, ‘সবাই আছে, বলেই আমি আছি’। (সূত্র: James Clear, ‘How to Be Happy: A Surprising Lesson on Happiness From an African Tribe’)
রুশ ঔপন্যাসিক দস্তয়েভস্কির ‘দ্য ইডিয়ট’ উপন্যাসে আছে, ‘beauty will save the world’।
মাঠের নানা ফসল, বাগানের নানা ফুল, গাছের নানা ফল—সবারই আলাদা নাম, রূপ, গন্ধ, স্বাদ আছে। কিন্তু সবাই মিলে একটা শক্তিশালী বন্ধন। এই যে ছন্দময় প্রাকৃতিক বন্ধনে একটির ওপর আরেকটির নির্ভরতা, গাছের ফল পাখি খায়, পাখির বিষ্ঠায় গাছ জন্মায়, ফুলের মধু মৌমাছি খায়, মৌমাছির ফুলভ্রমণে পরাগায়ন ঘটে। একটি আরেকটির ওপর ভর করে টিকে থাকে। কেউ কম বা কেউ বেশি প্রয়োজনীয় না। সবাই সমানভাবে জরুরি। মানুষেও এমন বৈচিত্র্য আছে। পাহাড়ি, আদিবাসী, সমতলের অধিবাসী, নারী, পুরুষ, সমপ্রেমী, হিজড়া, দলিত—সবাই সুন্দর। সবার নিজ নিজ ধর্ম, ভাষা, পোশাক, খাবার, ঐতিহ্য, উৎসব মিলে মানুষের সামগ্রিক সৌন্দর্য। এই যে আমেরিকা পৃথিবীতে মোড়লি করে যাচ্ছে, এর প্রধান কারণ হলো তার বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ। বৈচিত্র্যের সংরক্ষণেই রয়েছে মানুষের সসম্মানে টিকে থাকা, আর বৈচিত্র্যের ক্ষয়েই রয়েছে মানুষের মিলিতভাবে ক্ষয়ে যাওয়ার সূত্র।
আমাদের দেশে এই ক্ষয়ে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। এমনকি পাঠ্যপুস্তক থেকে বৈচিত্র্যের উপাদান সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। ক্লাসরুম থেকে শুরু করে সবখানে ভিন্নধারার চিন্তার প্রতি মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য একাডেমিক ফ্রিডমটা খুব জরুরি। কেন? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক, দর্শন বা জেন্ডার বিষয়ক পাঠদান চলছে; ছাত্র-শিক্ষক উভয়ে যত ভয়হীন চিত্তে কথা বলতে পারবে, ততই উভয়ে লাভবান হবে। দর্শনের আলোচনায় নাস্তিকতা আসতে পারে, জেন্ডারের আলোচনায় সমকামিতা আসতে পারে। এখন এই ক্লাসরুমের আলোচনায় যদি নাস্তিক বা সমকামী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ‘আদারড’ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে ছাত্র-শিক্ষক কেউই লাভবান হবে না। ফলত অজানা-অধরা থেকে যাবে এসব বিষয়ে হালনাগাদ তথ্যাদি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছাত্র-শিক্ষক সবাই।
বাংলাদেশের সব পর্যায়ের শিক্ষায়তনের শিক্ষকদের মধ্যে এই ‘আদার’ বোধ এখন বাস্তব। এতবার আক্রান্ত হওয়ার পর শঙ্কিত না হয়ে কে পারবেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কণিকা’-তে আছে—
‘দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি
সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?’
ভয়ের ব্যাপার হলো, বিনাশী এই ‘আদারিং’ বা শূন্যকরণ একবার শুরু হলে আর থামে না। মেইনস্ট্রিম পপুলেশন, আর সবাইকে ‘আদার’ করার পর নিজেদের মধ্যকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশকে ‘আদার’ করতে থাকে। আপনি এখন সংখ্যাগুরুর অংশ। আপনার চিন্তার বা রুচির সাথে না মিললে অন্যকে ‘আদার’ করা সমর্থন করছেন। বিশ্বাস করুন, আপনিও সংখ্যালঘু হয়ে যাবেন, আপনাকেও ‘আদার’ করা হবে অচিরেই। অনেকের মতো আপনিও ‘যথেষ্ট মুসলমান’ বা ‘যথেষ্ট হিন্দু’ না হওয়ার ‘অপরাধে’ সাজা পাবেন।
সুতরাং এখনই সতর্ক হওয়া দরকার। তারাপদ রায়ের কবিতায় আছে, ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে, আমরা বুঝতে পারি নি।’ আমাদের জীবনে যেন সেই কবিতা সত্য হয়ে না দাঁড়ায়। বৈচিত্র্য মেনে নিলে, তার মতো শক্তিশালী বন্ধন সমাজে আর হয় না। বৈচিত্র্যের সৌন্দর্যের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে গেলে কী হবে, তা দস্তয়েভস্কি বলেই দিয়েছেন, ‘কেউ আমাদের রক্ষা করতে পারবে না।’
লেখক: বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির কার্যালয়ের মানবাধিকার বিষয়ক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
১২ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
১২ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
১২ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
১২ ঘণ্টা আগে