পাভেল পার্থ
রবীন্দ্রনাথের ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গানটি কী আমরা মনে রেখেছি? আমরা কী জানি আমাদের দেশের মাটির আজ কী হাল, কী দশা? আমরা কি মাটির জীবন বাঁচিয়ে রাখছি? অপরিকল্পিত উন্নয়ন, দশাসই নগরায়ণ কিংবা রাসায়নিক কৃষির দাপটে মাটি আজ রক্তাক্ত, দূষিত ও দখল হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
আমাদের জনপদে ‘মাটি’ কেবল মাটি নয়, মাটি এক জীবনবোধের রূপকল্প। সহজিয়া সাধনার জটিল বয়ান। আমরা যখন বলি, ‘মাটির কাছে ফেরা’ কিংবা ‘জন্মমাটি’ কিংবা ‘মাটির মতন মানুষ’ তখন আমরা ভিন্ন ভিন্ন জীবনের ব্যঞ্জনা বুঝি। আমাদের সামনে হাজির হয় বেশ কিছু দার্শনিক ও রাজনৈতিক দৃশ্যকল্প। এই জনপদ বিশ্বাস করে—মাটির প্রাণ আছে। মাটি মানুষসহ প্রাণসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার রসদ জোগায়। মাটি জোগায় মুখের আহার। কিন্তু আমরা কি মাটির আহার ঠিক রেখেছি? অধিক ফসল ফলানোর নামে আমরা মাটির বুকে ঢেলেছি নির্দয় বিষের জঞ্জাল। মাটির প্রাণ আজ যন্ত্রণায় ছটফট করে। এমনকি নিদারুণভাবে জীবন্ত মাটি প্রতিদিন আমরা তুলে দিচ্ছি ইটের ভাটায়। মাটিকে আর মাটি রাখিনি। মাটির সংসার তছনছ করে দিয়েছি।
এক দলা মাটি কেবলমাত্র একদলা মাটি নয়। মৃত্তিকা-বাস্তুসংস্থান এক জটিল সংসার। এখানে মাটির রাসায়নিক উপাদান আছে, অণুজীব আছে, ঘুমিয়ে থাকা বীজ দানা আছে, আছে কত সহস্র প্রাণপ্রজাতি। তথাকথিত সবুজ বিপ্লব মাটির এই সংসারকে বুঝতে চায়নি। এক দলা মৃত্তিকা-পরিবারের সকল সদস্যকে খুন করে কেবল মাটিকে বিবেচনা করেছে শস্য-উৎপাদনের একটি ক্ষেত্র হিসেবে। এভাবে দিনের পর দিন মাটি আজ সব হারিয়ে শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে। এমনকি আমরা মাটির আর্দ্রতা, মাটির জলকণা, মাটির হিউমাস কোনো কিছুই ঠিক রাখিনি। মাটির তলার পানি মেশিন দিয়ে টেনে টেনে তুলে আজ মাটির শরীর শুকিয়ে ফেলেছি। এভাবেই আমরা একতরফাভাবে কেবলমাত্র মানুষের জন্য খাদ্য হিসেবে কেবল ধান বা কিছু দানা জাতীয় ফসলের বাণিজ্যিক উৎপাদন করতে পেরেছি। মাটির ওপর এত অনাচার-অত্যাচার প্রশ্নহীনভাবে আমরা করে চলেছি। কারণ এক ঐতিহাসিক ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব এখনো আমরা ধারণ করে রেখেছি। আমরা এখনো মনে করি ‘মাটি সর্বংসহা’। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল। কারণ, মাটির হিউমাস কমেছে, মাটির পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র বদলে গেছে, মাটির উৎপাদনশীলতার মাত্রা ও হার বদলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
ডাকসাইটে এসব উন্নয়ন বাহাদুরির পাশাপাশি আমাদের মাটি-জগৎ আজ ‘জলবায়ু সংকটের’ কারণেও দাঁড়িয়ে আছে এক গভীর বিপদের মুখোমুখি। দেশজুড়ে জলবায়ু বিপর্যয়ের নানা অভিঘাত ও নিদারুণ প্রভাব পড়ছে মৃত্তিকা-বাস্তুতন্ত্রে। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি আজ তীব্র খরা ও নির্দয় শুষ্কতায় তড়পাচ্ছে। পাহাড়ের মাটি অরণ্যের বিস্তার হারিয়ে প্রতিদিন ক্ষয় হচ্ছে। দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলের মাটি আজ তীব্র লবণাক্ততায় আক্রান্ত। কৃষিজমি থেকে শুরু করে দক্ষিণাঞ্চলের বসতবাড়ির মাটিও হয়ে পড়ছে লবণাক্ত। জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে ক্রমশ লবণাক্ত হয়ে যাওয়া মাটির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ আজ বাধ্য হয়ে জন্মমাটি ছেড়ে নিজেদের আগাম বিক্রি করছে ইটের ভাটায়। মাটি হারিয়ে মানুষ আজ জীবন বাঁচাতে হন্যে হয়েছে। চারদিকে এক প্রবল হাহাকার।
মাটির জন্য এখনো আমরা কোনো রাজনৈতিক ইশতেহার বা কার্যকর উদ্যোগ দেখিনি। কোনো সুনির্দিষ্ট আইন বা নীতি নেই মাটি সুরক্ষা প্রশ্নে। পরিবার, বিদ্যালয়, সংঘ, কি গণমাধ্যম—কোথাও মাটি ব্যবস্থাপনা ও মাটির প্রতি আমাদের আচরণ ও কর্তব্য কেমন হওয়া দরকার—সে বিষয়ে কোনো তৎপরতা নেই। ক্রমশ মাটি-বিচ্ছিন্ন এক নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা কীভাবে তাহলে মাটির প্রতি মমতা ও ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে পারি? মাটির প্রতি কৃতজ্ঞতা ও নতজানু হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারি? মাটি প্রশ্নে আজ আমাদের অবশ্যই রাষ্ট্রীয় তৎপরতা জরুরি। সামগ্রিক জাগরণ জরুরি। যদি ‘দেশের মাটির পরে’ আমরা আজ কৃতজ্ঞচিত্তে মাথা ঠেকাতে চাই, তবে সবার আগে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, মাটির প্রাণ আছে, মাটি এক জীবন্ত সত্তা, আর এর সুরক্ষায় আমাদের সবার দায় ও দায়িত্ব আছে।
ভূমি হচ্ছে মৌলিক প্রাকৃতিক সম্পদ, যা মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, শিল্পপণ্য, ভোগবিলাস, স্বাস্থ্য রক্ষার উপকরণ ইত্যাদি সবকিছুরই উৎস। মাটি বা ভূমি বা জমি সুরক্ষা প্রশ্নে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে প্রথম ‘কৃষিজমি সুরক্ষা আইন’ খসড়া করে। দুঃখজনকভাবে এখনো আইনটি কার্যকর হয়নি। কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনে ‘কৃষিজমিকে’ কেবলমাত্র খাদ্যশস্য উৎপাদনের স্থান হিসেবে দেখা হয়েছে। আইনের প্রেক্ষাপট বা ভূমিকা অংশে কৃষিজমি সুরক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, ‘পরিবেশ ও খাদ্যশস্য উৎপাদন অব্যাহত রাখার কথা।’ কৃষিজমি কোনোভাবেই কেবল খাদ্যশস্য উৎপাদনের জায়গা নয়। এটি এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যময় বাস্তুসংস্থান এবং এখানে নানা প্রাণী ও উদ্ভিদের যৌথ বসবাসের ভেতর দিয়ে এক জটিল প্রতিবেশ ব্যবস্থা চালু থাকে।
কৃষিজমি জীবন্ত; এর প্রাণ আছে। এটি নানা অণুজীব, পতঙ্গ, কেঁচো, কাঁকড়া, শামুক, সাপ, ছোট পাখি, গুল্ম ও বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদের আবাস ও বিচরণস্থল কৃষিজমি। কৃষিজমি একই সঙ্গে কোনো গ্রামীণ সমাজের বসতি স্থাপনের ইতিহাস এবং কৃষি সভ্যতার এক জীবন্ত দলিল। এটি সামাজিক সংহতি ও নানা বর্গ-শ্রেণির ঐক্যের প্রতীক। কৃষিজমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা প্রকাশ করে। একেক অঞ্চলের কৃষিজমি একেক ঋতু বা মৌসুমে একেক রং ও ব্যঞ্জনা নিয়ে মূর্ত হয়। কখনো-বা ধানের সবুজ প্রান্তর, কখনো হলুদ সরিষার খেত, কখনো জুমের মিশ্র ফসল, আবার কখনো রসুনের জমি।
কৃষিজমি জলবায়ু সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে এবং পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের কৃষিজমিই দুনিয়ার সামগ্রিক টেকসই বিকাশে ভূমিকা রাখে। ভৌগোলিকভাবে কৃষিজমি স্থানীয়; কিন্তু এর সামগ্রিক অবদান বৈশ্বিক। উল্লিখিত আইনে কৃষিজমিকে খুবই সংকীর্ণ অর্থে দেখা হয়েছে এবং এটিই আইনের প্রধান দর্শনগত ও মনস্তাত্ত্বিক ত্রুটি। মাটিসহ কৃষিজমির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। এটি কৃষিসভ্যতা বিকাশের ভিত্তিস্থল। কৃষিজমির সামগ্রিক অবদান ও সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়ে কৃষিজমি সুরক্ষা আইনে উল্লেখ করা জরুরি।
মাটির বৈচিত্র্যময় বিস্তার ও অবস্থান একেক অঞ্চল ও বাস্তুসংস্থানকে একেক পরিচয় দান করেছে। গড়ে তুলেছে একেক জীবনধারা ও উৎপাদন সম্পর্ক। জলবায়ু, পানিসম্পদ, ভূমিরূপ, মাটি, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, তৃণভূমি, কি অরণ্য—সবই ভূমির অংশ। বাংলাদেশে অঞ্চল ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতায় কৃষি জমির ধরনগুলো এক নয়। মহামতি খনার বচনে আছে, ‘রোদে ধান, ছায়ায় পান’। তার মানে কোনো কৃষি জমিনে রোদ পড়ে, আবার কোনোটি ছায়াময় জমিন। জমির ধরন বুঝে একেক জমিনে একেক ফসল ভালো হয়। হাওরাঞ্চলে বসতবাড়ি বাগানকে বলে ‘বিছরা’, মধুপুর গড়াঞ্চলে নিচু জমিকে বলে ‘বাইদ’ এবং উঁচু জমিকে ‘চালা’, বরেন্দ্র অঞ্চলের ঢেউখেলানো জমিকে স্থানীয়ভাবে বলে ‘গ্যালারি জমি’, মানিকগঞ্জে উঁচু জমিকে বলে ‘কান্দা জমি’, সিলেটের খাসি আদিবাসীরা কৃষিজ বাগানকে বলেন ‘জুম’। সিলেটের দুই টিলার মাঝের জমিকে আদিবাসী লালেং (পাত্র) ভাষায় বলে ‘গুল’।
এই জমিগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে খুব ভালো আঠালো বিন্নি ধানের আবাদ হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই পাহাড়ের খাদের জমিনও ভিন্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। বর্তমানে এমন জমিগুলোতে দুই পাশ আটকে বৃষ্টির পানি জমিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ের পাশাপাশি দেশের উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভূমির কৃষিজমির বৈশিষ্ট্য উঁচু হলেও তা স্তরবিশিষ্ট ভিন্নতা নিয়ে বিদ্যমান। কিন্তু বর্তমানে এই জমির বৈশিষ্ট্য যন্ত্র দিয়ে কেটে সমান করে এর স্তর বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট করা হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিজমির স্তরবিন্যাসকে অক্ষুণ্ন রাখা জরুরি। কক্সবাজারের টেকনাফসহ সমুদ্র উপকূলে জোয়ার প্লাবিত কৃষিজমি এবং নারিকেল জিঞ্জিরা বা সেন্টমার্টিনসহ সমুদ্র দ্বীপসমূহের মাটি ও কৃষিজমির বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিয়েই সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে। তো আমরা কি দেশের মৃত্তিকা-বিন্যাসের এমন প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ধরনকে বিবেচনা না করেই সকল অঞ্চলের মাটি ও জমির জন্য একই ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে থাকব বারবার? কেবল রাসায়নিক কৃষি নয়, কৃষিজমিতে কী ধরনের শস্য বা ফসলের আবাদ হবে, আর সেটি মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কতখানি ক্ষতিকর, তাও বিবেচনায় আনা জরুরি। বিশেষ করে হাইব্রিড, জিএমও ফসল, তামাক, হাইব্রিড ভুট্টা—এসব ফসল মাটির স্বাস্থ্য ভেঙে দেয়। এমনকি সামাজিক বনায়নের নামে একাশিয়া, ম্যাঞ্জিয়াম, সেগুন, ইউক্যালিপটাসের বৃহৎ বাগান কিংবা বাণিজ্যিক রাবার চাষও মাটির বাস্তুসংস্থান ও মাটির প্রাকৃতিক পানিধারণ ক্ষমতাকে বিনষ্ট করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০১৫) তথ্যমতে, দেশে মোট ভূমির পরিমাণ প্রায় ১৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন হেক্টর। দেশের মোট ভূমির ১৩ দশমিক ৩ শতাংশজুড়ে বনভূমি, ২০ দশমিক ১ শতাংশে জলাধার, ঘরবাড়ি, শিল্প-কারখানা এবং বাকি ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। এর ভেতর আবাদযোগ্য জমি ৮৫ লাখ ৫ হাজার ২৭৮ দশমিক ১৪ হেক্টর। কিন্তু নিদারুণভাবে দেশে প্রতিদিন কৃষিজমি কমছে। অর্থাৎ, মৃত্তিকা-বাস্তুসংস্থান বদলে যাচ্ছে।
ইউএনডিপির (২০০৩) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতি বছর দেশে ১ শতাংশ করে কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় পর্যন্ত পাহাড়ি নদী ও চা বাগানের ছড়া থেকে বালু তোলা হলেও এখন দেশের অনেক নদ-নদী, ছড়া, নদী তীর ও চরাঞ্চল থেকে বালু উত্তোলন করা হয়। বালু উত্তোলন করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ভূমির বৈশিষ্ট্য বিনাশ করা হয়। নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে নদী তীরে ভাঙন তীব্র হয়ে অনেক কৃষি জমি বিলীন হয়ে যায়। জমিতে নানা মাত্রার রাসায়নিক প্রয়োগ, লাগাতার সেচ, নানা জাতের বাণিজ্যিক করপোরেট ফসল আবাদের পাশাপাশি শিল্প দূষণ, উজানে বাঁধ, বর্জ্য, পলিথিনসহ নানাবিধ কারণে কৃষি জমির মাটির স্বাস্থ্য ক্ষয় হচ্ছে।
বাংলাদেশের পরিবেশ বিষয়ক একটি প্রতিবেদন (২০০১) থেকে জানা যায়, ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূ-উপরিস্থ মাটি ব্যাপক ক্ষয় হয়েছে, যা মোট জমির প্রায় ১৭ শতাংশ। বনভূমি আচ্ছাদিত অঞ্চলে মাটি ক্ষয় অনেক কম এবং তা প্রতি বছর প্রতি হেক্টরে ২ দশমিক ৭ থেকে ৭ দশমিক ২ টন। মাটির জৈব উপাদান ভয়াবহভাবে কমছে এবং তা বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শুরু করে মধুপুর গড়, হিমালয় পাদদেশ, তিস্তা-করতোয়া-বাঙালী নদী অববাহিকা অঞ্চলে।
২০০২ সালে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট’-এর সম্মেলনে মাটি দিবসের প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়। থাইল্যান্ড এবং বিশ্ব মৃত্তিকা পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক মাটি দিবস উদ্যাপনের কাজ শুরু করে এবং বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা একে সহযোগিতা করে। ২০১৩ সালের জুনে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জাতিসংঘের ৬৮ তম সাধারণ অধিবেশনে মাটি দিবসের প্রসঙ্গটি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ বিশ্ব মাটি দিবসের বিষয়টি সমর্থন করে এবং ২০১৪ সালে প্রথম বিশ্ব মাটি দিবস পালিত হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মাটি দিবস পালিত হয়ে আসছে।
এ বছর মাটি দিবসের প্রতিপাদ্য হলো—‘মাটির লবণাক্ততা দূর কর, মাটির উৎপাদনশীলতা বাড়াও’। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মৃত্তিকা-বাস্তুসংস্থানের বড় সর্বনাশটি ঘটেছে আশির দশকের পর থেকে। উপকূলীয় লবণপানির জোয়ারভাটায় এককালে গড়ে ওঠা কৃষিজীবন থেকে বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘেরের কারণে উদ্বাস্তু হয়েছেন লাখো মানুষ। উপকূলীয় বাঁধ দিয়ে গ্রামের সঙ্গে নদীগুলোর জোয়ারভাটার প্রবাহ আটকে কৃষিজমিতে গড়ে ওঠে বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘের। দীর্ঘ সময়জুড়ে আবদ্ধ ঘেরে লবণপানি আটকে থাকায় জমিতে অভ্যন্তরীণ লবণের মাত্রা বাড়ে এবং মাটি লবণাক্ত হয়ে ক্রমান্বয়ে আবাদ অনুপযোগী হয়ে ওঠে। পাশাপাশি জলবায়ু বিপর্যয়জনিত সংকটের কারণে এই লবণাক্ততার মাত্রা আরও বাড়ছে এবং এই লবণাক্ততার বিস্তার ক্রমশ উপকূলের সকল মাটিকেই লবণাক্ত করে তুলছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (২০১০) দেখিয়েছে, ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার ১৬টি জেলাতেই কৃষিজমি কমেছে এবং সামগ্রিকভাবে উপকূলে ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ কৃষি জমি কমে গেছে। জলবায়ু বিপর্যয়সহ সকল সংকট থেকে দেশের মাটি সুরক্ষায় এখনই আমাদের জোরদার আওয়াজ তোলা দরকার, দরকার কার্যকর পদক্ষেপ। দরকার মৃত্তিকা-সংবেদনশীল রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
লেখক: পাভেল পার্থ, গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
রবীন্দ্রনাথের ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গানটি কী আমরা মনে রেখেছি? আমরা কী জানি আমাদের দেশের মাটির আজ কী হাল, কী দশা? আমরা কি মাটির জীবন বাঁচিয়ে রাখছি? অপরিকল্পিত উন্নয়ন, দশাসই নগরায়ণ কিংবা রাসায়নিক কৃষির দাপটে মাটি আজ রক্তাক্ত, দূষিত ও দখল হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
আমাদের জনপদে ‘মাটি’ কেবল মাটি নয়, মাটি এক জীবনবোধের রূপকল্প। সহজিয়া সাধনার জটিল বয়ান। আমরা যখন বলি, ‘মাটির কাছে ফেরা’ কিংবা ‘জন্মমাটি’ কিংবা ‘মাটির মতন মানুষ’ তখন আমরা ভিন্ন ভিন্ন জীবনের ব্যঞ্জনা বুঝি। আমাদের সামনে হাজির হয় বেশ কিছু দার্শনিক ও রাজনৈতিক দৃশ্যকল্প। এই জনপদ বিশ্বাস করে—মাটির প্রাণ আছে। মাটি মানুষসহ প্রাণসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার রসদ জোগায়। মাটি জোগায় মুখের আহার। কিন্তু আমরা কি মাটির আহার ঠিক রেখেছি? অধিক ফসল ফলানোর নামে আমরা মাটির বুকে ঢেলেছি নির্দয় বিষের জঞ্জাল। মাটির প্রাণ আজ যন্ত্রণায় ছটফট করে। এমনকি নিদারুণভাবে জীবন্ত মাটি প্রতিদিন আমরা তুলে দিচ্ছি ইটের ভাটায়। মাটিকে আর মাটি রাখিনি। মাটির সংসার তছনছ করে দিয়েছি।
এক দলা মাটি কেবলমাত্র একদলা মাটি নয়। মৃত্তিকা-বাস্তুসংস্থান এক জটিল সংসার। এখানে মাটির রাসায়নিক উপাদান আছে, অণুজীব আছে, ঘুমিয়ে থাকা বীজ দানা আছে, আছে কত সহস্র প্রাণপ্রজাতি। তথাকথিত সবুজ বিপ্লব মাটির এই সংসারকে বুঝতে চায়নি। এক দলা মৃত্তিকা-পরিবারের সকল সদস্যকে খুন করে কেবল মাটিকে বিবেচনা করেছে শস্য-উৎপাদনের একটি ক্ষেত্র হিসেবে। এভাবে দিনের পর দিন মাটি আজ সব হারিয়ে শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে। এমনকি আমরা মাটির আর্দ্রতা, মাটির জলকণা, মাটির হিউমাস কোনো কিছুই ঠিক রাখিনি। মাটির তলার পানি মেশিন দিয়ে টেনে টেনে তুলে আজ মাটির শরীর শুকিয়ে ফেলেছি। এভাবেই আমরা একতরফাভাবে কেবলমাত্র মানুষের জন্য খাদ্য হিসেবে কেবল ধান বা কিছু দানা জাতীয় ফসলের বাণিজ্যিক উৎপাদন করতে পেরেছি। মাটির ওপর এত অনাচার-অত্যাচার প্রশ্নহীনভাবে আমরা করে চলেছি। কারণ এক ঐতিহাসিক ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব এখনো আমরা ধারণ করে রেখেছি। আমরা এখনো মনে করি ‘মাটি সর্বংসহা’। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল। কারণ, মাটির হিউমাস কমেছে, মাটির পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র বদলে গেছে, মাটির উৎপাদনশীলতার মাত্রা ও হার বদলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
ডাকসাইটে এসব উন্নয়ন বাহাদুরির পাশাপাশি আমাদের মাটি-জগৎ আজ ‘জলবায়ু সংকটের’ কারণেও দাঁড়িয়ে আছে এক গভীর বিপদের মুখোমুখি। দেশজুড়ে জলবায়ু বিপর্যয়ের নানা অভিঘাত ও নিদারুণ প্রভাব পড়ছে মৃত্তিকা-বাস্তুতন্ত্রে। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি আজ তীব্র খরা ও নির্দয় শুষ্কতায় তড়পাচ্ছে। পাহাড়ের মাটি অরণ্যের বিস্তার হারিয়ে প্রতিদিন ক্ষয় হচ্ছে। দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলের মাটি আজ তীব্র লবণাক্ততায় আক্রান্ত। কৃষিজমি থেকে শুরু করে দক্ষিণাঞ্চলের বসতবাড়ির মাটিও হয়ে পড়ছে লবণাক্ত। জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে ক্রমশ লবণাক্ত হয়ে যাওয়া মাটির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ আজ বাধ্য হয়ে জন্মমাটি ছেড়ে নিজেদের আগাম বিক্রি করছে ইটের ভাটায়। মাটি হারিয়ে মানুষ আজ জীবন বাঁচাতে হন্যে হয়েছে। চারদিকে এক প্রবল হাহাকার।
মাটির জন্য এখনো আমরা কোনো রাজনৈতিক ইশতেহার বা কার্যকর উদ্যোগ দেখিনি। কোনো সুনির্দিষ্ট আইন বা নীতি নেই মাটি সুরক্ষা প্রশ্নে। পরিবার, বিদ্যালয়, সংঘ, কি গণমাধ্যম—কোথাও মাটি ব্যবস্থাপনা ও মাটির প্রতি আমাদের আচরণ ও কর্তব্য কেমন হওয়া দরকার—সে বিষয়ে কোনো তৎপরতা নেই। ক্রমশ মাটি-বিচ্ছিন্ন এক নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা কীভাবে তাহলে মাটির প্রতি মমতা ও ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে পারি? মাটির প্রতি কৃতজ্ঞতা ও নতজানু হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারি? মাটি প্রশ্নে আজ আমাদের অবশ্যই রাষ্ট্রীয় তৎপরতা জরুরি। সামগ্রিক জাগরণ জরুরি। যদি ‘দেশের মাটির পরে’ আমরা আজ কৃতজ্ঞচিত্তে মাথা ঠেকাতে চাই, তবে সবার আগে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, মাটির প্রাণ আছে, মাটি এক জীবন্ত সত্তা, আর এর সুরক্ষায় আমাদের সবার দায় ও দায়িত্ব আছে।
ভূমি হচ্ছে মৌলিক প্রাকৃতিক সম্পদ, যা মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, শিল্পপণ্য, ভোগবিলাস, স্বাস্থ্য রক্ষার উপকরণ ইত্যাদি সবকিছুরই উৎস। মাটি বা ভূমি বা জমি সুরক্ষা প্রশ্নে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে প্রথম ‘কৃষিজমি সুরক্ষা আইন’ খসড়া করে। দুঃখজনকভাবে এখনো আইনটি কার্যকর হয়নি। কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনে ‘কৃষিজমিকে’ কেবলমাত্র খাদ্যশস্য উৎপাদনের স্থান হিসেবে দেখা হয়েছে। আইনের প্রেক্ষাপট বা ভূমিকা অংশে কৃষিজমি সুরক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, ‘পরিবেশ ও খাদ্যশস্য উৎপাদন অব্যাহত রাখার কথা।’ কৃষিজমি কোনোভাবেই কেবল খাদ্যশস্য উৎপাদনের জায়গা নয়। এটি এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যময় বাস্তুসংস্থান এবং এখানে নানা প্রাণী ও উদ্ভিদের যৌথ বসবাসের ভেতর দিয়ে এক জটিল প্রতিবেশ ব্যবস্থা চালু থাকে।
কৃষিজমি জীবন্ত; এর প্রাণ আছে। এটি নানা অণুজীব, পতঙ্গ, কেঁচো, কাঁকড়া, শামুক, সাপ, ছোট পাখি, গুল্ম ও বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদের আবাস ও বিচরণস্থল কৃষিজমি। কৃষিজমি একই সঙ্গে কোনো গ্রামীণ সমাজের বসতি স্থাপনের ইতিহাস এবং কৃষি সভ্যতার এক জীবন্ত দলিল। এটি সামাজিক সংহতি ও নানা বর্গ-শ্রেণির ঐক্যের প্রতীক। কৃষিজমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা প্রকাশ করে। একেক অঞ্চলের কৃষিজমি একেক ঋতু বা মৌসুমে একেক রং ও ব্যঞ্জনা নিয়ে মূর্ত হয়। কখনো-বা ধানের সবুজ প্রান্তর, কখনো হলুদ সরিষার খেত, কখনো জুমের মিশ্র ফসল, আবার কখনো রসুনের জমি।
কৃষিজমি জলবায়ু সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে এবং পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের কৃষিজমিই দুনিয়ার সামগ্রিক টেকসই বিকাশে ভূমিকা রাখে। ভৌগোলিকভাবে কৃষিজমি স্থানীয়; কিন্তু এর সামগ্রিক অবদান বৈশ্বিক। উল্লিখিত আইনে কৃষিজমিকে খুবই সংকীর্ণ অর্থে দেখা হয়েছে এবং এটিই আইনের প্রধান দর্শনগত ও মনস্তাত্ত্বিক ত্রুটি। মাটিসহ কৃষিজমির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। এটি কৃষিসভ্যতা বিকাশের ভিত্তিস্থল। কৃষিজমির সামগ্রিক অবদান ও সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়ে কৃষিজমি সুরক্ষা আইনে উল্লেখ করা জরুরি।
মাটির বৈচিত্র্যময় বিস্তার ও অবস্থান একেক অঞ্চল ও বাস্তুসংস্থানকে একেক পরিচয় দান করেছে। গড়ে তুলেছে একেক জীবনধারা ও উৎপাদন সম্পর্ক। জলবায়ু, পানিসম্পদ, ভূমিরূপ, মাটি, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, তৃণভূমি, কি অরণ্য—সবই ভূমির অংশ। বাংলাদেশে অঞ্চল ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতায় কৃষি জমির ধরনগুলো এক নয়। মহামতি খনার বচনে আছে, ‘রোদে ধান, ছায়ায় পান’। তার মানে কোনো কৃষি জমিনে রোদ পড়ে, আবার কোনোটি ছায়াময় জমিন। জমির ধরন বুঝে একেক জমিনে একেক ফসল ভালো হয়। হাওরাঞ্চলে বসতবাড়ি বাগানকে বলে ‘বিছরা’, মধুপুর গড়াঞ্চলে নিচু জমিকে বলে ‘বাইদ’ এবং উঁচু জমিকে ‘চালা’, বরেন্দ্র অঞ্চলের ঢেউখেলানো জমিকে স্থানীয়ভাবে বলে ‘গ্যালারি জমি’, মানিকগঞ্জে উঁচু জমিকে বলে ‘কান্দা জমি’, সিলেটের খাসি আদিবাসীরা কৃষিজ বাগানকে বলেন ‘জুম’। সিলেটের দুই টিলার মাঝের জমিকে আদিবাসী লালেং (পাত্র) ভাষায় বলে ‘গুল’।
এই জমিগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে খুব ভালো আঠালো বিন্নি ধানের আবাদ হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই পাহাড়ের খাদের জমিনও ভিন্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। বর্তমানে এমন জমিগুলোতে দুই পাশ আটকে বৃষ্টির পানি জমিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ের পাশাপাশি দেশের উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভূমির কৃষিজমির বৈশিষ্ট্য উঁচু হলেও তা স্তরবিশিষ্ট ভিন্নতা নিয়ে বিদ্যমান। কিন্তু বর্তমানে এই জমির বৈশিষ্ট্য যন্ত্র দিয়ে কেটে সমান করে এর স্তর বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট করা হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিজমির স্তরবিন্যাসকে অক্ষুণ্ন রাখা জরুরি। কক্সবাজারের টেকনাফসহ সমুদ্র উপকূলে জোয়ার প্লাবিত কৃষিজমি এবং নারিকেল জিঞ্জিরা বা সেন্টমার্টিনসহ সমুদ্র দ্বীপসমূহের মাটি ও কৃষিজমির বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিয়েই সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে। তো আমরা কি দেশের মৃত্তিকা-বিন্যাসের এমন প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ধরনকে বিবেচনা না করেই সকল অঞ্চলের মাটি ও জমির জন্য একই ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে থাকব বারবার? কেবল রাসায়নিক কৃষি নয়, কৃষিজমিতে কী ধরনের শস্য বা ফসলের আবাদ হবে, আর সেটি মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কতখানি ক্ষতিকর, তাও বিবেচনায় আনা জরুরি। বিশেষ করে হাইব্রিড, জিএমও ফসল, তামাক, হাইব্রিড ভুট্টা—এসব ফসল মাটির স্বাস্থ্য ভেঙে দেয়। এমনকি সামাজিক বনায়নের নামে একাশিয়া, ম্যাঞ্জিয়াম, সেগুন, ইউক্যালিপটাসের বৃহৎ বাগান কিংবা বাণিজ্যিক রাবার চাষও মাটির বাস্তুসংস্থান ও মাটির প্রাকৃতিক পানিধারণ ক্ষমতাকে বিনষ্ট করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০১৫) তথ্যমতে, দেশে মোট ভূমির পরিমাণ প্রায় ১৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন হেক্টর। দেশের মোট ভূমির ১৩ দশমিক ৩ শতাংশজুড়ে বনভূমি, ২০ দশমিক ১ শতাংশে জলাধার, ঘরবাড়ি, শিল্প-কারখানা এবং বাকি ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। এর ভেতর আবাদযোগ্য জমি ৮৫ লাখ ৫ হাজার ২৭৮ দশমিক ১৪ হেক্টর। কিন্তু নিদারুণভাবে দেশে প্রতিদিন কৃষিজমি কমছে। অর্থাৎ, মৃত্তিকা-বাস্তুসংস্থান বদলে যাচ্ছে।
ইউএনডিপির (২০০৩) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতি বছর দেশে ১ শতাংশ করে কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় পর্যন্ত পাহাড়ি নদী ও চা বাগানের ছড়া থেকে বালু তোলা হলেও এখন দেশের অনেক নদ-নদী, ছড়া, নদী তীর ও চরাঞ্চল থেকে বালু উত্তোলন করা হয়। বালু উত্তোলন করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ভূমির বৈশিষ্ট্য বিনাশ করা হয়। নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে নদী তীরে ভাঙন তীব্র হয়ে অনেক কৃষি জমি বিলীন হয়ে যায়। জমিতে নানা মাত্রার রাসায়নিক প্রয়োগ, লাগাতার সেচ, নানা জাতের বাণিজ্যিক করপোরেট ফসল আবাদের পাশাপাশি শিল্প দূষণ, উজানে বাঁধ, বর্জ্য, পলিথিনসহ নানাবিধ কারণে কৃষি জমির মাটির স্বাস্থ্য ক্ষয় হচ্ছে।
বাংলাদেশের পরিবেশ বিষয়ক একটি প্রতিবেদন (২০০১) থেকে জানা যায়, ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূ-উপরিস্থ মাটি ব্যাপক ক্ষয় হয়েছে, যা মোট জমির প্রায় ১৭ শতাংশ। বনভূমি আচ্ছাদিত অঞ্চলে মাটি ক্ষয় অনেক কম এবং তা প্রতি বছর প্রতি হেক্টরে ২ দশমিক ৭ থেকে ৭ দশমিক ২ টন। মাটির জৈব উপাদান ভয়াবহভাবে কমছে এবং তা বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শুরু করে মধুপুর গড়, হিমালয় পাদদেশ, তিস্তা-করতোয়া-বাঙালী নদী অববাহিকা অঞ্চলে।
২০০২ সালে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট’-এর সম্মেলনে মাটি দিবসের প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়। থাইল্যান্ড এবং বিশ্ব মৃত্তিকা পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক মাটি দিবস উদ্যাপনের কাজ শুরু করে এবং বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা একে সহযোগিতা করে। ২০১৩ সালের জুনে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জাতিসংঘের ৬৮ তম সাধারণ অধিবেশনে মাটি দিবসের প্রসঙ্গটি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ বিশ্ব মাটি দিবসের বিষয়টি সমর্থন করে এবং ২০১৪ সালে প্রথম বিশ্ব মাটি দিবস পালিত হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মাটি দিবস পালিত হয়ে আসছে।
এ বছর মাটি দিবসের প্রতিপাদ্য হলো—‘মাটির লবণাক্ততা দূর কর, মাটির উৎপাদনশীলতা বাড়াও’। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মৃত্তিকা-বাস্তুসংস্থানের বড় সর্বনাশটি ঘটেছে আশির দশকের পর থেকে। উপকূলীয় লবণপানির জোয়ারভাটায় এককালে গড়ে ওঠা কৃষিজীবন থেকে বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘেরের কারণে উদ্বাস্তু হয়েছেন লাখো মানুষ। উপকূলীয় বাঁধ দিয়ে গ্রামের সঙ্গে নদীগুলোর জোয়ারভাটার প্রবাহ আটকে কৃষিজমিতে গড়ে ওঠে বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘের। দীর্ঘ সময়জুড়ে আবদ্ধ ঘেরে লবণপানি আটকে থাকায় জমিতে অভ্যন্তরীণ লবণের মাত্রা বাড়ে এবং মাটি লবণাক্ত হয়ে ক্রমান্বয়ে আবাদ অনুপযোগী হয়ে ওঠে। পাশাপাশি জলবায়ু বিপর্যয়জনিত সংকটের কারণে এই লবণাক্ততার মাত্রা আরও বাড়ছে এবং এই লবণাক্ততার বিস্তার ক্রমশ উপকূলের সকল মাটিকেই লবণাক্ত করে তুলছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (২০১০) দেখিয়েছে, ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার ১৬টি জেলাতেই কৃষিজমি কমেছে এবং সামগ্রিকভাবে উপকূলে ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ কৃষি জমি কমে গেছে। জলবায়ু বিপর্যয়সহ সকল সংকট থেকে দেশের মাটি সুরক্ষায় এখনই আমাদের জোরদার আওয়াজ তোলা দরকার, দরকার কার্যকর পদক্ষেপ। দরকার মৃত্তিকা-সংবেদনশীল রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
লেখক: পাভেল পার্থ, গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
১৫ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
১৫ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
১৬ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
১৬ ঘণ্টা আগে