তৌহীদ রেজা নুর
বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা (যথাযথ সম্মানের সাথে) এই মাসকে ভাষার মাস হিসেবে বিবেচনা করি এবং অবধারিতভাবেই মাতৃভাষার দশা-দুর্দশার খোঁজ খবর করতে আরম্ভ করি। ভাষার প্রশ্নে কোন দিকে যাচ্ছি আমরা, গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে নিজের ভাষার দিকে মনোযোগী হওয়া ভালো নাকি বাস্তবতার কথা মনে রেখে অন্য ভাষা (বিশেষত ইংরেজি) রপ্ত করা জরুরি ইত্যাদি নানা ভাবনায় আমরা নিরত হই। ফলে, ছেলেবেলা থেকে কোন ভাষায় আমাদের বর্তমান ও আগামী দিনের শিশুদের পারদর্শী করে তোলা জরুরি, তা নিয়েও আমাদের দুর্ভাবনার অন্ত নেই।
যতই আমরা এগোই একুশে ফেব্রুয়ারির দিকে, ততই এই ভাবনাগুলো আমাদের লেখায়, বলায় প্রাধান্য পেতে থাকে। আমাদের গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, শিক্ষালয়, প্রশাসন সর্বত্র মাতৃভাষার গতি-দুর্গতি নিয়ে আমাদের আবেগ-ভালোবাসা প্রকাশিত হতে থাকে। এবং ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হওয়ামাত্রই ভাষা নিয়ে আমাদের চিত্ত-চাঞ্চল্য দূরীভূত হতে থাকে। মার্চ পেরিয়ে এপ্রিল মাস আসার আগেই আমরা এসব ভাবনা-চিন্তা শীতকাল শেষ হতেই কাঁথা-কম্বল মাচায় তুলে রাখার মতো মাথা থেকে দূরে সরিয়ে রাখি। সময়ধারায় আবার ভাষার মরসুম এলে এসব নিয়ে হিসেব করতে বসি। ভাষা নিয়ে এহেন নিরেট রুটিন ভাবনায় আমরা যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তবে আশার কথা—এই বিশেষ দিনটি (২১ ফেব্রুয়ারি) এখন আর শুধু আমাদের নয়, বিশ্বের সকল দেশের জন্য একটি বিশেষ দিন—মাতৃভাষাকে ভালোবাসার, টিকিয়ে রাখার জন্য শপথ নেওয়ার একটি দিন হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিগণিত হচ্ছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকের আত্মদানে এই দিনটি অমরতা লাভ করেছে। তাই তো এই দিনটি নিছক একটি সংখ্যা বা তারিখ নয়। আমাদের হৃদয়ে তা চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে ‘অমর একুশে’ হিসেবে। বিবেচিত হয়ে আসছে আমাদের চেতনা আর অস্তিত্বের প্রতীক হিসেবে। বিস্মৃত হওয়া যাবে না যে, একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই অর্জিত হয়েছে আমাদের মহান স্বাধীনতা। সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিসহ আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাই একুশের রয়েছে ব্যাপক প্রভাব। একুশের এই চিরন্তনী আবেদন ও তাৎপর্যকে সম্মান জানাবার বিষয়টি তাই রুটিন কাজ হলে জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। শুধু ভাষার প্রশ্নে নয়, আমাদের আত্মোপলব্ধির প্রেরণা ও সংগ্রামের শপথ নিতে, ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের নানা প্রশ্নের উত্তর মেলাতে তাই আমাদের বারবার অমর একুশের কাছে ফিরে আসতে হয়, ফিরে আসতে হবে। কারণ, বাঙালির আত্ম-পরিচয় এবং জাতীয়তাবাদের কেন্দ্রভূমি হচ্ছে ভাষা, মাতৃভাষা বাংলা। বাঙালির বিমূর্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা এই ভাষাকে ঘিরেই মূর্ততা পেয়েছে। তাই বাংলাদেশের মানুষের জীবনবোধে সঞ্চারিত হয়েছে ভাষার জন্য আবেগ ও ভালোবাসা। তবে এই আবেগ ও ভালোবাসার প্রাবল্য যতখানি প্রকাশিত, এর তাৎপর্য জীবনের সাথে মেলাবার প্রচেষ্টা ততখানি প্রয়াসঋদ্ধ নয়।
কেন ভাষা? কেন বাংলা ভাষা?
আমরা সকল ভাবনা ভাবি নিজের ভাষায়। এই নিজের ভাষাটা আবার কী? বাড়ন্ত শিশু মায়ের সান্নিধ্যে বড় হয়ে ওঠার কালে তার মুখে ফোটে মায়ের বোল। তাই শৈশবে মাতৃভাষাই শিশুর মনের ভাব প্রকাশ করার, যোগাযোগ করার একমাত্র মাধ্যম। ফলে, মায়ের সান্নিধ্যে থেকে চারপাশের সবকিছু শিখতে থাকার এই পর্যায়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বড় হয়ে ওঠার কালে মায়ের সান্নিধ্য থেকে ক্রমশই সামনে বিস্তারিত জগতের সাথে পরিচয় হতে থাকে তার, যেখানে অন্য ব্যক্তি বা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সে নিজেকে প্রকাশ করতে শেখে। সে সময়ে মায়ের ভাষার বাইরে অন্য ভাষার সাথেও তার পরিচয় হয়। ফলে ওই শিশুর ব্যক্তিসত্তা বাইরের নানা অভিঘাতে ধীরে ধীরে নানাভাবে স্পষ্টতর হতে থাকে। কিন্তু শিশু একদম ছেলেবেলায় যে ভাষায় তার ভাব প্রকাশ করতে শেখে, সে ভাষাতেই মূলত আজীবন নিজের যাবতীয় ভাবনা ভাবে। এমনকি যখন সে অন্য ভাষায় কোনো কিছু বলে বা লিখে, তখনো তার মস্তিষ্ক প্রথমে চকিতে তার মাতৃভাষায় সেই সব ভাব-এর (যা সে বলতে বা লিখতে চায়) বোধগম্য ছবি তৈরি করে, এবং প্রকাশক (কোন শিশু বা ব্যক্তি) সেই ছবির সাথে তার ভাবনা ঐকতানিক কি না মিলিয়ে নিয়েই ভাব প্রকাশ করে থাকেন। সেই ভাব প্রকাশের জন্য মানুষ শব্দের (Words) আশ্রয় নেয়।
শৈশবের অমূল্য অভিজ্ঞতা পার করার কালে ব্যক্তিসত্তা এমন একপর্যায়ে উপনীত হয়, যখন মানুষ শব্দ ছাড়া চিন্তা করতে পারে না—ফ্রিদরিখ ম্যাক্সম্যুলার তেমনটাই মনে করেন। তাই শব্দের পরে শব্দ মিলিয়ে মানুষ অর্থবোধক ভাব প্রকাশ করে, যা আদতে তার চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। তাই ভাষা সত্যি সত্যি বিস্ময়ের বস্তু। আর মাতৃভাষার রয়েছে বিস্ময়করতম গুরুত্ব, যা শুধু ব্যক্তি মানুষ নয়, পুরো সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য। যা ওই লোকসমাজের সার্বিক পরিচয়, উপলব্ধি, জ্ঞান, সংস্কৃতি, লৌকিকতা সবই প্রকাশ করতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে। এখানেই মাতৃভাষার তাৎপর্য নিহিত।
আমাদের আজকের সমাজে জোর দাবি আছে ইংরেজি ভাষা পোক্ত করে শেখার জন্য। বাংলা তো নিজের ভাষা, তা না শিখলেও চলবে, না ব্যবহার করলেও চলবে। কেননা গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিক আমাদের তো নেটিভ ভাষার চেয়ে গ্লোবাল ভাষা আয়ত্তে রাখা বেশি জরুরি। দাবিটি একেবারে অমূলক নয় সত্য; কিন্তু এহেন মানসিকতার মানুষের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক আগেই বলে গেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তার পরে ইংরেজি শেখার পত্তন’। কারণ, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন অবোধের মতো ‘পরধন লোভে মত্ত’ হয়ে বঙ্গ ভান্ডারের ‘বিবিধ রতন’ অবহেলা করার মাধ্যমে নিজেকেই ভিক্ষুকের জাতে পরিণত করা হয়। গ্লোবালাইজেশনের ধোঁয়াতে ইংরেজির গুরুত্ব বাড়তে পারে। কিন্তু তা নিজের ভাষাকে অগ্রাহ্য, উপেক্ষা করে নয়।
কবি সৈয়দ সুলতান (১৫৫০–১৬৪৮) বাংলা ভাষায় কাব্য রচনা করার পর তাঁকে ‘মোনাফেক’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তিনি সকাতরে তাই লিখলেন, ‘যারে যেই ভাষে করিল সৃজন, সেই ভাষ তাহার অমূল্য রতন’। এটিই মাতৃভাষার মূল স্পিরিট।
ভাষা: শিক্ষায়, পেশায়, বিজ্ঞান চর্চায়
তাহলে শিক্ষায়, বিভিন্ন পেশায়, বিজ্ঞানচর্চায় আমরা কোন ভাষাকে গুরুত্ব দেব? আমাদের বর্তমান সমাজের জন্য এটি আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর যথাযথ উত্তর খুঁজে পেতেও সহায় হই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এ ক্ষেত্রে তিনি যা বলেছেন, তা অনেকটা এ রকম—শিক্ষার প্রণালিটি যদি একবার মাতৃভাষার সাহায্যে অপেক্ষাকৃত সহজে আয়ত্তে আনা যায়, মন যদি শিক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে, তবে ধারণাশক্তিও পরিপক্ব হয়ে ওঠে, এবং এতে অনাবশ্যক পীড়ন, কঠিন চেষ্টা ও শরীর মনের অবসাদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। ফলে, অনেক অল্প সময়েও স্থায়ীভাবে নতুন শিক্ষা গ্রহণ করা যায়।
মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২ বছরর পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিলেন এবং যখন তিনি ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, এর অনতিকাল পরই স্কুল মাস্টারের শাসন এড়াতে তিনি স্কুল ছেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করেন। নিজের ভাষায় চিন্তাকে ফুটিয়ে তোলা, সাজিয়ে তোলার আনন্দ গোড়া থেকেই পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তিনি উপলব্ধি করেছেন মাতৃভাষায় রচনার অভ্যাস সহজ হয়ে গেলে যথাসময়ে অন্য ভাষা আয়ত্ত করে সেটাকে সাহসপূর্বক ব্যবহার করতে কলমে বাধে না। এর মানে কী দাঁড়াল? নিজের ভাষাকে আগে আয়ত্তে আনা জরুরি। তবেই অন্য ভাষা রপ্ত করা সহজতর। যদিও মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদাহরণ টানা হলো এই লেখায়, কিন্তু যেকোনো মানুষের জন্যই তা প্রযোজ্য। কারণ, নিজের ভাষায় চিন্তাকে ফুটিয়ে তোলা, সাজিয়ে তোলার আনন্দ লাভ করলেই একজন এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় সফলতার সাথে অবগাহন করতে পারবেন।
মনে রাখতে হবে, আমরা যখন কোনো ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া শ্রেয় ভাবি, তখন তা শুধু শহরে বসবাসরত মানুষের জন্য নয়, দেশের বিস্তারিত গ্রামীণ সমাজের সকল মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে ভাবতে হবে। রবীন্দ্রনাথ আরও ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘...সাধারণের কাছে ইংরেজি ভাষা বেদের মন্ত্র অপেক্ষা সরল নহে। এবং অধিকাংশ জ্ঞান-বিজ্ঞান ইংরেজি ভাষার কড়া পাহারার মধ্যে আবদ্ধ। তাহার ফল এই, বিদ্যালয়ে আমরা যাহা লাভ করি সমাজে তাহার কোন চর্চা নাই। সুতরাং আমাদের প্রাণের সহিত রক্তের সহিত মিশ্রিত হয় না। বিদ্যার প্রধান গৌরব দাঁড়াইয়াছে অর্থোপার্জনের উপায়রূপে।’ তাই কি নয়? আমাদের বিভিন্ন শিক্ষায়তন থেকে যারা আজ শিক্ষা লাভ করে বের হয়ে আসছে, তাদের মনে যতটা না লব্ধ জ্ঞান প্রয়োগের আগ্রহ, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহ শিক্ষার ডিগ্রি দেখিয়ে কত ভালো উপার্জনের সুযোগ নিশ্চিত করা যায়, সেদিকে।
তাই জরুরি উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো মাতৃভাষায় চারদিকে পরিব্যাপ্ত করে দেওয়া। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলেই গণমানস বিজ্ঞানমনস্ক হবে। তা না হলে, ‘বাংলাদেশের মাটির মধ্যে বিজ্ঞানের শিকড় প্রবেশ করিতে পারিবে না।’ ইংরেজি জানা সমাজের কিয়দংশের উন্নতি দেখে আমরা উল্লসিত হতে পারি, কিন্তু তা সামগ্রিক সমাজের জন্য সুখকর বার্তা বয়ে আনবে না কখনোই। নিজ ভাষায় উচ্চশিক্ষা লাভ করে শুধু নিজের দেশের নয়, বিশ্বের উন্নতি সাধনে অবদান রাখার নজির রয়েছে অনেক। তাই ‘অমর একুশে’-এর দেশে তা যত দ্রুত সবাই অনুধাবন করবে ততই মঙ্গল।
কীর্তিমান মানুষ নিজ ভাষা ছাড়াও অন্য ভাষায় অবদান রাখতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনভর দেশি-বিদেশি নানা ভাষার চর্চা করে গেছেন। তিনি বিলেতে ল্যাটিন ও ইংরেজি পড়েন। মূল ভাষায় গ্যেটের স্বাদ পাওয়ার জন্য তিনি জার্মান ভাষা শেখার চেষ্টা করেন। তাঁর ভাষা সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রবন্ধের পাতা উল্টালেই দেখা যাবে বাংলাদেশের চারপাশের ভাষা ও উপভাষার সাথেও তাঁর পরিচয় ছিল নিবিড়। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষার বুনিয়াদের ওপর গড়ে উঠেছিল বলেই ভাষা থেকে ভাষান্তরে সঞ্চরণ করা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সহজ ও আনন্দময় হয়েছিল। আমাদের দেশে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাইরেও নানা ভাষা-সংস্কৃতির মানুষ বাস করেন। তাঁদের মাতৃভাষাও বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান রয়েছে ‘অমর একুশে’-এর মূল স্পিরিটে।
এই সত্য অনুধাবন না করলে কবি আব্দুল হাকিম (১৬২০–১৬৯০)-এর মতো বলতে হবে ‘দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়, নিজ দেশ ছাড়ি কেন বিদেশে ন যায়’।
বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা (যথাযথ সম্মানের সাথে) এই মাসকে ভাষার মাস হিসেবে বিবেচনা করি এবং অবধারিতভাবেই মাতৃভাষার দশা-দুর্দশার খোঁজ খবর করতে আরম্ভ করি। ভাষার প্রশ্নে কোন দিকে যাচ্ছি আমরা, গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে নিজের ভাষার দিকে মনোযোগী হওয়া ভালো নাকি বাস্তবতার কথা মনে রেখে অন্য ভাষা (বিশেষত ইংরেজি) রপ্ত করা জরুরি ইত্যাদি নানা ভাবনায় আমরা নিরত হই। ফলে, ছেলেবেলা থেকে কোন ভাষায় আমাদের বর্তমান ও আগামী দিনের শিশুদের পারদর্শী করে তোলা জরুরি, তা নিয়েও আমাদের দুর্ভাবনার অন্ত নেই।
যতই আমরা এগোই একুশে ফেব্রুয়ারির দিকে, ততই এই ভাবনাগুলো আমাদের লেখায়, বলায় প্রাধান্য পেতে থাকে। আমাদের গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, শিক্ষালয়, প্রশাসন সর্বত্র মাতৃভাষার গতি-দুর্গতি নিয়ে আমাদের আবেগ-ভালোবাসা প্রকাশিত হতে থাকে। এবং ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হওয়ামাত্রই ভাষা নিয়ে আমাদের চিত্ত-চাঞ্চল্য দূরীভূত হতে থাকে। মার্চ পেরিয়ে এপ্রিল মাস আসার আগেই আমরা এসব ভাবনা-চিন্তা শীতকাল শেষ হতেই কাঁথা-কম্বল মাচায় তুলে রাখার মতো মাথা থেকে দূরে সরিয়ে রাখি। সময়ধারায় আবার ভাষার মরসুম এলে এসব নিয়ে হিসেব করতে বসি। ভাষা নিয়ে এহেন নিরেট রুটিন ভাবনায় আমরা যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তবে আশার কথা—এই বিশেষ দিনটি (২১ ফেব্রুয়ারি) এখন আর শুধু আমাদের নয়, বিশ্বের সকল দেশের জন্য একটি বিশেষ দিন—মাতৃভাষাকে ভালোবাসার, টিকিয়ে রাখার জন্য শপথ নেওয়ার একটি দিন হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিগণিত হচ্ছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকের আত্মদানে এই দিনটি অমরতা লাভ করেছে। তাই তো এই দিনটি নিছক একটি সংখ্যা বা তারিখ নয়। আমাদের হৃদয়ে তা চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে ‘অমর একুশে’ হিসেবে। বিবেচিত হয়ে আসছে আমাদের চেতনা আর অস্তিত্বের প্রতীক হিসেবে। বিস্মৃত হওয়া যাবে না যে, একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই অর্জিত হয়েছে আমাদের মহান স্বাধীনতা। সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিসহ আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাই একুশের রয়েছে ব্যাপক প্রভাব। একুশের এই চিরন্তনী আবেদন ও তাৎপর্যকে সম্মান জানাবার বিষয়টি তাই রুটিন কাজ হলে জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। শুধু ভাষার প্রশ্নে নয়, আমাদের আত্মোপলব্ধির প্রেরণা ও সংগ্রামের শপথ নিতে, ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের নানা প্রশ্নের উত্তর মেলাতে তাই আমাদের বারবার অমর একুশের কাছে ফিরে আসতে হয়, ফিরে আসতে হবে। কারণ, বাঙালির আত্ম-পরিচয় এবং জাতীয়তাবাদের কেন্দ্রভূমি হচ্ছে ভাষা, মাতৃভাষা বাংলা। বাঙালির বিমূর্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা এই ভাষাকে ঘিরেই মূর্ততা পেয়েছে। তাই বাংলাদেশের মানুষের জীবনবোধে সঞ্চারিত হয়েছে ভাষার জন্য আবেগ ও ভালোবাসা। তবে এই আবেগ ও ভালোবাসার প্রাবল্য যতখানি প্রকাশিত, এর তাৎপর্য জীবনের সাথে মেলাবার প্রচেষ্টা ততখানি প্রয়াসঋদ্ধ নয়।
কেন ভাষা? কেন বাংলা ভাষা?
আমরা সকল ভাবনা ভাবি নিজের ভাষায়। এই নিজের ভাষাটা আবার কী? বাড়ন্ত শিশু মায়ের সান্নিধ্যে বড় হয়ে ওঠার কালে তার মুখে ফোটে মায়ের বোল। তাই শৈশবে মাতৃভাষাই শিশুর মনের ভাব প্রকাশ করার, যোগাযোগ করার একমাত্র মাধ্যম। ফলে, মায়ের সান্নিধ্যে থেকে চারপাশের সবকিছু শিখতে থাকার এই পর্যায়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বড় হয়ে ওঠার কালে মায়ের সান্নিধ্য থেকে ক্রমশই সামনে বিস্তারিত জগতের সাথে পরিচয় হতে থাকে তার, যেখানে অন্য ব্যক্তি বা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সে নিজেকে প্রকাশ করতে শেখে। সে সময়ে মায়ের ভাষার বাইরে অন্য ভাষার সাথেও তার পরিচয় হয়। ফলে ওই শিশুর ব্যক্তিসত্তা বাইরের নানা অভিঘাতে ধীরে ধীরে নানাভাবে স্পষ্টতর হতে থাকে। কিন্তু শিশু একদম ছেলেবেলায় যে ভাষায় তার ভাব প্রকাশ করতে শেখে, সে ভাষাতেই মূলত আজীবন নিজের যাবতীয় ভাবনা ভাবে। এমনকি যখন সে অন্য ভাষায় কোনো কিছু বলে বা লিখে, তখনো তার মস্তিষ্ক প্রথমে চকিতে তার মাতৃভাষায় সেই সব ভাব-এর (যা সে বলতে বা লিখতে চায়) বোধগম্য ছবি তৈরি করে, এবং প্রকাশক (কোন শিশু বা ব্যক্তি) সেই ছবির সাথে তার ভাবনা ঐকতানিক কি না মিলিয়ে নিয়েই ভাব প্রকাশ করে থাকেন। সেই ভাব প্রকাশের জন্য মানুষ শব্দের (Words) আশ্রয় নেয়।
শৈশবের অমূল্য অভিজ্ঞতা পার করার কালে ব্যক্তিসত্তা এমন একপর্যায়ে উপনীত হয়, যখন মানুষ শব্দ ছাড়া চিন্তা করতে পারে না—ফ্রিদরিখ ম্যাক্সম্যুলার তেমনটাই মনে করেন। তাই শব্দের পরে শব্দ মিলিয়ে মানুষ অর্থবোধক ভাব প্রকাশ করে, যা আদতে তার চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। তাই ভাষা সত্যি সত্যি বিস্ময়ের বস্তু। আর মাতৃভাষার রয়েছে বিস্ময়করতম গুরুত্ব, যা শুধু ব্যক্তি মানুষ নয়, পুরো সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য। যা ওই লোকসমাজের সার্বিক পরিচয়, উপলব্ধি, জ্ঞান, সংস্কৃতি, লৌকিকতা সবই প্রকাশ করতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে। এখানেই মাতৃভাষার তাৎপর্য নিহিত।
আমাদের আজকের সমাজে জোর দাবি আছে ইংরেজি ভাষা পোক্ত করে শেখার জন্য। বাংলা তো নিজের ভাষা, তা না শিখলেও চলবে, না ব্যবহার করলেও চলবে। কেননা গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিক আমাদের তো নেটিভ ভাষার চেয়ে গ্লোবাল ভাষা আয়ত্তে রাখা বেশি জরুরি। দাবিটি একেবারে অমূলক নয় সত্য; কিন্তু এহেন মানসিকতার মানুষের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক আগেই বলে গেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তার পরে ইংরেজি শেখার পত্তন’। কারণ, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন অবোধের মতো ‘পরধন লোভে মত্ত’ হয়ে বঙ্গ ভান্ডারের ‘বিবিধ রতন’ অবহেলা করার মাধ্যমে নিজেকেই ভিক্ষুকের জাতে পরিণত করা হয়। গ্লোবালাইজেশনের ধোঁয়াতে ইংরেজির গুরুত্ব বাড়তে পারে। কিন্তু তা নিজের ভাষাকে অগ্রাহ্য, উপেক্ষা করে নয়।
কবি সৈয়দ সুলতান (১৫৫০–১৬৪৮) বাংলা ভাষায় কাব্য রচনা করার পর তাঁকে ‘মোনাফেক’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তিনি সকাতরে তাই লিখলেন, ‘যারে যেই ভাষে করিল সৃজন, সেই ভাষ তাহার অমূল্য রতন’। এটিই মাতৃভাষার মূল স্পিরিট।
ভাষা: শিক্ষায়, পেশায়, বিজ্ঞান চর্চায়
তাহলে শিক্ষায়, বিভিন্ন পেশায়, বিজ্ঞানচর্চায় আমরা কোন ভাষাকে গুরুত্ব দেব? আমাদের বর্তমান সমাজের জন্য এটি আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর যথাযথ উত্তর খুঁজে পেতেও সহায় হই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এ ক্ষেত্রে তিনি যা বলেছেন, তা অনেকটা এ রকম—শিক্ষার প্রণালিটি যদি একবার মাতৃভাষার সাহায্যে অপেক্ষাকৃত সহজে আয়ত্তে আনা যায়, মন যদি শিক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে, তবে ধারণাশক্তিও পরিপক্ব হয়ে ওঠে, এবং এতে অনাবশ্যক পীড়ন, কঠিন চেষ্টা ও শরীর মনের অবসাদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। ফলে, অনেক অল্প সময়েও স্থায়ীভাবে নতুন শিক্ষা গ্রহণ করা যায়।
মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২ বছরর পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিলেন এবং যখন তিনি ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, এর অনতিকাল পরই স্কুল মাস্টারের শাসন এড়াতে তিনি স্কুল ছেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করেন। নিজের ভাষায় চিন্তাকে ফুটিয়ে তোলা, সাজিয়ে তোলার আনন্দ গোড়া থেকেই পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তিনি উপলব্ধি করেছেন মাতৃভাষায় রচনার অভ্যাস সহজ হয়ে গেলে যথাসময়ে অন্য ভাষা আয়ত্ত করে সেটাকে সাহসপূর্বক ব্যবহার করতে কলমে বাধে না। এর মানে কী দাঁড়াল? নিজের ভাষাকে আগে আয়ত্তে আনা জরুরি। তবেই অন্য ভাষা রপ্ত করা সহজতর। যদিও মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদাহরণ টানা হলো এই লেখায়, কিন্তু যেকোনো মানুষের জন্যই তা প্রযোজ্য। কারণ, নিজের ভাষায় চিন্তাকে ফুটিয়ে তোলা, সাজিয়ে তোলার আনন্দ লাভ করলেই একজন এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় সফলতার সাথে অবগাহন করতে পারবেন।
মনে রাখতে হবে, আমরা যখন কোনো ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া শ্রেয় ভাবি, তখন তা শুধু শহরে বসবাসরত মানুষের জন্য নয়, দেশের বিস্তারিত গ্রামীণ সমাজের সকল মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে ভাবতে হবে। রবীন্দ্রনাথ আরও ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘...সাধারণের কাছে ইংরেজি ভাষা বেদের মন্ত্র অপেক্ষা সরল নহে। এবং অধিকাংশ জ্ঞান-বিজ্ঞান ইংরেজি ভাষার কড়া পাহারার মধ্যে আবদ্ধ। তাহার ফল এই, বিদ্যালয়ে আমরা যাহা লাভ করি সমাজে তাহার কোন চর্চা নাই। সুতরাং আমাদের প্রাণের সহিত রক্তের সহিত মিশ্রিত হয় না। বিদ্যার প্রধান গৌরব দাঁড়াইয়াছে অর্থোপার্জনের উপায়রূপে।’ তাই কি নয়? আমাদের বিভিন্ন শিক্ষায়তন থেকে যারা আজ শিক্ষা লাভ করে বের হয়ে আসছে, তাদের মনে যতটা না লব্ধ জ্ঞান প্রয়োগের আগ্রহ, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহ শিক্ষার ডিগ্রি দেখিয়ে কত ভালো উপার্জনের সুযোগ নিশ্চিত করা যায়, সেদিকে।
তাই জরুরি উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো মাতৃভাষায় চারদিকে পরিব্যাপ্ত করে দেওয়া। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলেই গণমানস বিজ্ঞানমনস্ক হবে। তা না হলে, ‘বাংলাদেশের মাটির মধ্যে বিজ্ঞানের শিকড় প্রবেশ করিতে পারিবে না।’ ইংরেজি জানা সমাজের কিয়দংশের উন্নতি দেখে আমরা উল্লসিত হতে পারি, কিন্তু তা সামগ্রিক সমাজের জন্য সুখকর বার্তা বয়ে আনবে না কখনোই। নিজ ভাষায় উচ্চশিক্ষা লাভ করে শুধু নিজের দেশের নয়, বিশ্বের উন্নতি সাধনে অবদান রাখার নজির রয়েছে অনেক। তাই ‘অমর একুশে’-এর দেশে তা যত দ্রুত সবাই অনুধাবন করবে ততই মঙ্গল।
কীর্তিমান মানুষ নিজ ভাষা ছাড়াও অন্য ভাষায় অবদান রাখতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনভর দেশি-বিদেশি নানা ভাষার চর্চা করে গেছেন। তিনি বিলেতে ল্যাটিন ও ইংরেজি পড়েন। মূল ভাষায় গ্যেটের স্বাদ পাওয়ার জন্য তিনি জার্মান ভাষা শেখার চেষ্টা করেন। তাঁর ভাষা সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রবন্ধের পাতা উল্টালেই দেখা যাবে বাংলাদেশের চারপাশের ভাষা ও উপভাষার সাথেও তাঁর পরিচয় ছিল নিবিড়। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষার বুনিয়াদের ওপর গড়ে উঠেছিল বলেই ভাষা থেকে ভাষান্তরে সঞ্চরণ করা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সহজ ও আনন্দময় হয়েছিল। আমাদের দেশে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাইরেও নানা ভাষা-সংস্কৃতির মানুষ বাস করেন। তাঁদের মাতৃভাষাও বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান রয়েছে ‘অমর একুশে’-এর মূল স্পিরিটে।
এই সত্য অনুধাবন না করলে কবি আব্দুল হাকিম (১৬২০–১৬৯০)-এর মতো বলতে হবে ‘দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়, নিজ দেশ ছাড়ি কেন বিদেশে ন যায়’।
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
৭ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
৭ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
৭ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
৭ ঘণ্টা আগে