মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৩ বছরে দেশকে যেই জায়গায় নিয়ে গেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। সেই কৃতিত্ব নেতা হিসেবে তাঁকে সবাই দিয়ে থাকেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের দায়িত্ব তিনি যাঁদের দিয়েছেন, তাঁরা বোধ হয় কাদের মির্জাদের কারণে খুব একটা সফলকাম হতে পারছেন না।
গত দুই বছরে করোনা সংক্রমণের সুযোগ নিয়ে সমাজের নানা স্তরের নানা ব্যক্তি, নানা গোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে হয়রানির নানা ফাঁদ পেতে বসেছে। ই-কমার্সের নামে কতগুলো বড় কোম্পানি হাজারো মানুষের পকেট থেকে হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হলো, দেশের সব কটি টিভি চ্যানেল এবং পত্রপত্রিকায় নানা চটকদারি বিজ্ঞাপন দিয়ে এরা মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। অনেক নামীদামি তারকাকে বিজ্ঞাপনে হাজির করে পণ্য ক্রয়ের লোভ দেখিয়েছে। ক্রিকেট খেলার স্পনসর করেছে। রথী-মহারথীদের কাউকে কাউকে এসব খেলা উপভোগ করতে বিদেশে নিয়ে গেছে। তাদের খরচও ওই সব ই-কমার্স জুগিয়েছে।
রথী-মহারথীদের টাকাপয়সা কম আছে—এমনটি কেউ ভাবে না। কিন্তু তাঁরা আতিথেয়তা ভোগ করলেন ওদের অর্থের বিনিময়ে। এখন সেই কোম্পানিগুলোর কয়েকটি প্রতারণার অভিযোগে বন্ধ রয়েছে।
রথী-মহারথীদের কী হবে? সারা দেশে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেখিয়ে মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের আবদুল কাদের মাঝি নামের এক স্বনামে পরিচিত ‘অতিরিক্ত সচিব’ নিজের বংশপরিচয় বদলিয়ে ‘চৌধুরী’ সেজেছেন। লেখাপড়ার দৌড়? স্কুলও পার হননি। তিনি গুলশানে বিরাট আলিশান অফিস সাজিয়েছেন। দামি গাড়ি কিনেছেন, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিবের গাড়ির স্টিকার লাগিয়েছেন, নানা ভিজিটিং কার্ড বিতরণ করছেন। অবাধে সচিবালয়ে যাতায়াত করছেন। বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে নিচ্ছেন।
জি কে শামীমের সঙ্গে তাঁর ব্যাংক লেনদেন ঘটেছে। সচিবালয়ে উনি তো শুধু মুখ দেখাতে যেতেন না নিশ্চয়ই। বড় বড় আমলার রুমে তাঁর যাতায়াত ছিল। কোন কোন রাজনীতিবিদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল, সেটি জানার কৌতূহল থাকা অস্বাভাবিক নয়। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এসব ‘কাদেরের’ উত্থান ঘটে না। গুলশানে তিনি বছরের পর বছর এমন শানশওকতের অফিস কীভাবে চালিয়ে গেলেন? সেখানে কারা কারা আসতেন? কার সঙ্গে কাদের যোগাযোগ করে কাজ বাগিয়ে দিতেন? কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে লাভ করতেন। অনেক সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তার নামও তিনি ব্যবহার করতেন বলে শোনা যায়।
আমাদের এত সব গোয়েন্দা সংস্থা এত তৎপর থাকার পরও কীভাবে সেই সুদূর নোয়াখালী থেকে আগত মাঝি আবদুল কাদেরের ‘চৌধুরী’ বনে যাওয়ার গল্পটা দীর্ঘদিন জানতে পারল না! অবশ্য শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দা সংস্থাই তাঁকে ধরতে সক্ষম হয়। জানি না, এই কাদেরের সংযোগ কাদের সঙ্গে ছিল, সেটি তারা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারবে কি না। বলা হয়েছে, মুসা বিন শমসেরের সঙ্গেও তাঁর ভীষণ ঘনিষ্ঠতা ছিল। জানা গেছে, উদীয়মান আবদুল কাদের চৌধুরী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও প্রভাবশালী ব্যক্তি মুসা বিন শমসেরের ব্যক্তিগত আইন উপদেষ্টা ছিলেন। গোয়েন্দা সংস্থা মুসা বিন শমসেরকে ডেকেছে। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না-পারা আবদুল কাদের মাঝি (চৌধুরী) মুসা বিন শমসেরের আইন উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতা লাভের পেছনে রহস্যটা কী? আইনের ডিগ্রিগুলো তাঁর কোথা থেকে পাওয়া? আবদুল কাদের মাঝির অফিসে শুধু ঢাকার নয়, ঢাকার বাইরেরও প্রচুর ধনাঢ্য প্রভাবশালী এবং সেলিব্রিটির আসা-যাওয়া ও সংযোগ ছিল। তাঁরা কি করতেন, সেটিই এখন জানার বিষয়।
আবদুল কাদের নামের লোকের অভাব নেই। তবে আবদুল কাদের মাঝি তো অনেক আবদুল কাদেরকে টপকে গেছেন। নোয়াখালীর আরেক আবদুল কাদের রাজনীতির অঙ্গনে বছরখানেক ধরে তোলপাড় করে যাচ্ছেন। তাঁর পুরো নাম আবদুল কাদের মির্জা। বসুরহাট পৌরসভার তিনি নির্বাচিত মেয়র। নির্বাচনের আগে তিনি লাইভে এসে নোয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে গেছেন। সবাই নাকি অপরাজনীতি করেন। তিনি বিশুদ্ধ রাজনীতির একজন প্রবক্তা সেজেছিলেন। অনেকে তাঁকে বাহ্বা দিয়েছিলেন। নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেন।
এরপর অনেকেই মনে করেছিল, আবদুল কাদের মির্জার মিশন হয়তো শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু নির্বাচনের পর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাসহ নোয়াখালীর ওই অঞ্চলে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে একের পর এক বিরোধে জড়িয়ে পড়লেন। সেখানে রক্তারক্তি হলো। একজন সাংবাদিক মারা গেলেন, ৪০-৫০ জন নেতা-কর্মী আহত হলেন। একপর্যায়ে আবদুল কাদের মির্জা লাইভে এসে তাঁর বড় ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তাঁর স্ত্রী এবং নোয়াখালী অঞ্চলের নেতাদের বিরুদ্ধেই নয়, অন্য অঞ্চলের নেতাদের সম্পর্কেও নানা ধরনের উক্তি করতে থাকেন। বিষয়টি আওয়ামীবিরোধী মহল বেশ উপভোগ করতে থাকে। ফলে শুধু নোয়াখালী অঞ্চলেই নয়, অনেক জায়গাতেই আবদুল কাদের মির্জার প্রভাব নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। আওয়ামী লীগ থেকে কেন কাদের মির্জাকে নিবৃত্ত করা যায়নি, সেটিও প্রশ্ন উঠতে থাকে।
কাদের মির্জাকে কেন এখন পর্যন্ত কিছু করা যায়নি, সেটি সবাই বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করছেন। গত শুক্রবার (৮ অক্টোবর) বিএনপির নেতা আবদুল হাইয়ের পারিবারিক মার্কেটের একাংশ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আবদুল কাদের মির্জা ভেঙে দেন। ৯ তারিখ কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি খিজির হায়াত খানের বাসায় একদল দুর্বৃত্ত হামলা করে। তিনি এর জন্য কাদের মির্জার অনুসারীদের দায়ী করেন। অবশ্য খিজির হায়াতকে আগেও আক্রমণ করা হয়েছিল। সেখানে এখন চলছে পাল্টাপাল্টি হামলা, প্রতিহামলা ইত্যাদির অভিযোগ; কিন্তু পুলিশ প্রশাসন বা স্থানীয় প্রশাসনের কেউ এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আবদুল কাদের মির্জা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে তাঁর নিজের মতো করে চলছেন। আওয়ামী লীগের যেন কিছুই করার নেই! এমনটি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছেও বেশ বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। দলের সাধারণ সম্পাদকই যেখানে ছোট ভাই কাদের মির্জাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, তখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দুর্বলতা কোথায়—সেটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। কাদের মির্জার কারণে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নোয়াখালী অঞ্চলে কতটা দুর্বল হচ্ছে, সেটি কাদের মির্জা হয়তো বুঝতে পারছেন না। কিন্তু সাধারণ মানুষ একসময় বাহ্বা দিলেও এখন তাঁর ব্যাপারে আগ্রহ হারালেও রাজনৈতিক মহল নানাভাবেই শঙ্কিত।
আবদুল কাদেরদের ব্যাপার-স্যাপারই মনে হয় আলাদা! তবে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো অঞ্চলে দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে যা চলছে, তাতে কাদের নামের না-হয়েও কাদেরদের মতোই কর্মকাণ্ড কেউ কেউ করে যাচ্ছেন। রাজবাড়ী-১ আসনে বড় ভাই কাজী কেরামত আলীকে চলতি ভাষায় ‘ঠেক’ দিয়ে ছোট ভাই কাজী ইরাদত আলী গত নির্বাচনে নিজেকে এমপি করে নিলেন। বড় ভাই কিছুই করতে পারলেন না। এখন তাঁকে ছোট ভাই রাজনীতিতে কোণঠাসা করে ফেলেছেন।
নাটোর-২ আসনে শফিকুল ইসলাম ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, লতাপাতাসহ সবাইকে দলের বিভিন্ন পদ-পদবিতে বসিয়ে দিলেন। সবাই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে গেলেন। নিজেও দেশে-বিদেশে প্রাসাদসম বাড়ি তৈরি করলেন। নাটোরের সব এমপি, আওয়ামী লীগ নেতাকে এলাকাছাড়া করলেন। এত ক্ষমতা তাঁর কোত্থেকে এল! দলে এমন প্রভাবশালী হওয়া যায় কি? বরগুনার আরেক সাংসদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে যে, ২২টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপি সাহেব দুই লাখ টাকা করে অনুদান দিয়েছেন। অথচ কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই টাকার চেক সম্পর্কে খবর জানে না। কেউ মিডিয়ার সামনে কথা বলতেও সাহস পাচ্ছে না। বরগুনাতে বেশ কিছু উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু যাঁরা পেলেন, তাঁরা অন্যের নামের টিপসই বা স্বাক্ষর দিয়ে টাকা তুলে নিলেন। মৃত ব্যক্তির নামেও টাকা তোলা হয়েছে। এসব কাজ যাঁরা করেন, তাঁরা আসলে কারা? আবদুল কাদের মাঝি আর আবদুল কাদের মির্জাদেরই অনুসারী নয় কি?
সম্প্রতি কিছু ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সামনেও বেশ কিছু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। মনোনয়ন নিয়ে এরই মধ্যে পত্রপত্রিকায় অনেক খবর ছাপা হয়েছে। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা বাদ পড়েছেন—এমন খবরও ছাপা হয়েছে। জামায়াত-শিবির ও বিএনপি থেকে আসা কেউ কেউ আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে এখন মনোনয়নও লাভ করেছেন। এসব নাম যেসব অঞ্চল থেকে প্রস্তাবাকারে পাঠানো হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, নাম যেখান থেকেই পাঠানো হোক না কেন, দলের হাইকমান্ড মনোনয়নের সময় প্রার্থীর আমলনামা ভালো করে যাচাই-বাছাই করছে না কেন? কোনো একটি উপজেলা থেকে নামের তালিকা পাঠালেই সেটি নির্ভুল হবে—এমনটি কি এখন ভাবা যায়? দলের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এখন অনেক কিছুই একাকার হয়ে গেছে। সেখানে দলের ত্যাগীরা কীভাবে মার খাচ্ছে, তা তো বসুরহাটেই দেখা গেল। এই পরিস্থিতি আর কত দিন চলতে দেওয়া হবে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৩ বছরে দেশকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। সেই কৃতিত্ব নেতা হিসেবে তাঁকে সবাই দিয়ে থাকেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের দায়িত্ব তিনি যাঁদের দিয়েছেন, তাঁরা বোধ হয় কাদের মির্জাদের কারণে খুব একটা সফলকাম হতে পারছেন না। এখন বোধ হয় আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনাকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেটি আওয়ামী লীগের স্বার্থেই শুধু নয়, দেশের স্বার্থেও।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৩ বছরে দেশকে যেই জায়গায় নিয়ে গেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। সেই কৃতিত্ব নেতা হিসেবে তাঁকে সবাই দিয়ে থাকেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের দায়িত্ব তিনি যাঁদের দিয়েছেন, তাঁরা বোধ হয় কাদের মির্জাদের কারণে খুব একটা সফলকাম হতে পারছেন না।
গত দুই বছরে করোনা সংক্রমণের সুযোগ নিয়ে সমাজের নানা স্তরের নানা ব্যক্তি, নানা গোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে হয়রানির নানা ফাঁদ পেতে বসেছে। ই-কমার্সের নামে কতগুলো বড় কোম্পানি হাজারো মানুষের পকেট থেকে হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হলো, দেশের সব কটি টিভি চ্যানেল এবং পত্রপত্রিকায় নানা চটকদারি বিজ্ঞাপন দিয়ে এরা মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। অনেক নামীদামি তারকাকে বিজ্ঞাপনে হাজির করে পণ্য ক্রয়ের লোভ দেখিয়েছে। ক্রিকেট খেলার স্পনসর করেছে। রথী-মহারথীদের কাউকে কাউকে এসব খেলা উপভোগ করতে বিদেশে নিয়ে গেছে। তাদের খরচও ওই সব ই-কমার্স জুগিয়েছে।
রথী-মহারথীদের টাকাপয়সা কম আছে—এমনটি কেউ ভাবে না। কিন্তু তাঁরা আতিথেয়তা ভোগ করলেন ওদের অর্থের বিনিময়ে। এখন সেই কোম্পানিগুলোর কয়েকটি প্রতারণার অভিযোগে বন্ধ রয়েছে।
রথী-মহারথীদের কী হবে? সারা দেশে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেখিয়ে মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের আবদুল কাদের মাঝি নামের এক স্বনামে পরিচিত ‘অতিরিক্ত সচিব’ নিজের বংশপরিচয় বদলিয়ে ‘চৌধুরী’ সেজেছেন। লেখাপড়ার দৌড়? স্কুলও পার হননি। তিনি গুলশানে বিরাট আলিশান অফিস সাজিয়েছেন। দামি গাড়ি কিনেছেন, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিবের গাড়ির স্টিকার লাগিয়েছেন, নানা ভিজিটিং কার্ড বিতরণ করছেন। অবাধে সচিবালয়ে যাতায়াত করছেন। বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে নিচ্ছেন।
জি কে শামীমের সঙ্গে তাঁর ব্যাংক লেনদেন ঘটেছে। সচিবালয়ে উনি তো শুধু মুখ দেখাতে যেতেন না নিশ্চয়ই। বড় বড় আমলার রুমে তাঁর যাতায়াত ছিল। কোন কোন রাজনীতিবিদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল, সেটি জানার কৌতূহল থাকা অস্বাভাবিক নয়। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এসব ‘কাদেরের’ উত্থান ঘটে না। গুলশানে তিনি বছরের পর বছর এমন শানশওকতের অফিস কীভাবে চালিয়ে গেলেন? সেখানে কারা কারা আসতেন? কার সঙ্গে কাদের যোগাযোগ করে কাজ বাগিয়ে দিতেন? কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে লাভ করতেন। অনেক সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তার নামও তিনি ব্যবহার করতেন বলে শোনা যায়।
আমাদের এত সব গোয়েন্দা সংস্থা এত তৎপর থাকার পরও কীভাবে সেই সুদূর নোয়াখালী থেকে আগত মাঝি আবদুল কাদেরের ‘চৌধুরী’ বনে যাওয়ার গল্পটা দীর্ঘদিন জানতে পারল না! অবশ্য শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দা সংস্থাই তাঁকে ধরতে সক্ষম হয়। জানি না, এই কাদেরের সংযোগ কাদের সঙ্গে ছিল, সেটি তারা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারবে কি না। বলা হয়েছে, মুসা বিন শমসেরের সঙ্গেও তাঁর ভীষণ ঘনিষ্ঠতা ছিল। জানা গেছে, উদীয়মান আবদুল কাদের চৌধুরী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও প্রভাবশালী ব্যক্তি মুসা বিন শমসেরের ব্যক্তিগত আইন উপদেষ্টা ছিলেন। গোয়েন্দা সংস্থা মুসা বিন শমসেরকে ডেকেছে। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না-পারা আবদুল কাদের মাঝি (চৌধুরী) মুসা বিন শমসেরের আইন উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতা লাভের পেছনে রহস্যটা কী? আইনের ডিগ্রিগুলো তাঁর কোথা থেকে পাওয়া? আবদুল কাদের মাঝির অফিসে শুধু ঢাকার নয়, ঢাকার বাইরেরও প্রচুর ধনাঢ্য প্রভাবশালী এবং সেলিব্রিটির আসা-যাওয়া ও সংযোগ ছিল। তাঁরা কি করতেন, সেটিই এখন জানার বিষয়।
আবদুল কাদের নামের লোকের অভাব নেই। তবে আবদুল কাদের মাঝি তো অনেক আবদুল কাদেরকে টপকে গেছেন। নোয়াখালীর আরেক আবদুল কাদের রাজনীতির অঙ্গনে বছরখানেক ধরে তোলপাড় করে যাচ্ছেন। তাঁর পুরো নাম আবদুল কাদের মির্জা। বসুরহাট পৌরসভার তিনি নির্বাচিত মেয়র। নির্বাচনের আগে তিনি লাইভে এসে নোয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে গেছেন। সবাই নাকি অপরাজনীতি করেন। তিনি বিশুদ্ধ রাজনীতির একজন প্রবক্তা সেজেছিলেন। অনেকে তাঁকে বাহ্বা দিয়েছিলেন। নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেন।
এরপর অনেকেই মনে করেছিল, আবদুল কাদের মির্জার মিশন হয়তো শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু নির্বাচনের পর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাসহ নোয়াখালীর ওই অঞ্চলে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে একের পর এক বিরোধে জড়িয়ে পড়লেন। সেখানে রক্তারক্তি হলো। একজন সাংবাদিক মারা গেলেন, ৪০-৫০ জন নেতা-কর্মী আহত হলেন। একপর্যায়ে আবদুল কাদের মির্জা লাইভে এসে তাঁর বড় ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তাঁর স্ত্রী এবং নোয়াখালী অঞ্চলের নেতাদের বিরুদ্ধেই নয়, অন্য অঞ্চলের নেতাদের সম্পর্কেও নানা ধরনের উক্তি করতে থাকেন। বিষয়টি আওয়ামীবিরোধী মহল বেশ উপভোগ করতে থাকে। ফলে শুধু নোয়াখালী অঞ্চলেই নয়, অনেক জায়গাতেই আবদুল কাদের মির্জার প্রভাব নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। আওয়ামী লীগ থেকে কেন কাদের মির্জাকে নিবৃত্ত করা যায়নি, সেটিও প্রশ্ন উঠতে থাকে।
কাদের মির্জাকে কেন এখন পর্যন্ত কিছু করা যায়নি, সেটি সবাই বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করছেন। গত শুক্রবার (৮ অক্টোবর) বিএনপির নেতা আবদুল হাইয়ের পারিবারিক মার্কেটের একাংশ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আবদুল কাদের মির্জা ভেঙে দেন। ৯ তারিখ কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি খিজির হায়াত খানের বাসায় একদল দুর্বৃত্ত হামলা করে। তিনি এর জন্য কাদের মির্জার অনুসারীদের দায়ী করেন। অবশ্য খিজির হায়াতকে আগেও আক্রমণ করা হয়েছিল। সেখানে এখন চলছে পাল্টাপাল্টি হামলা, প্রতিহামলা ইত্যাদির অভিযোগ; কিন্তু পুলিশ প্রশাসন বা স্থানীয় প্রশাসনের কেউ এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আবদুল কাদের মির্জা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে তাঁর নিজের মতো করে চলছেন। আওয়ামী লীগের যেন কিছুই করার নেই! এমনটি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছেও বেশ বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। দলের সাধারণ সম্পাদকই যেখানে ছোট ভাই কাদের মির্জাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, তখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দুর্বলতা কোথায়—সেটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। কাদের মির্জার কারণে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নোয়াখালী অঞ্চলে কতটা দুর্বল হচ্ছে, সেটি কাদের মির্জা হয়তো বুঝতে পারছেন না। কিন্তু সাধারণ মানুষ একসময় বাহ্বা দিলেও এখন তাঁর ব্যাপারে আগ্রহ হারালেও রাজনৈতিক মহল নানাভাবেই শঙ্কিত।
আবদুল কাদেরদের ব্যাপার-স্যাপারই মনে হয় আলাদা! তবে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো অঞ্চলে দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে যা চলছে, তাতে কাদের নামের না-হয়েও কাদেরদের মতোই কর্মকাণ্ড কেউ কেউ করে যাচ্ছেন। রাজবাড়ী-১ আসনে বড় ভাই কাজী কেরামত আলীকে চলতি ভাষায় ‘ঠেক’ দিয়ে ছোট ভাই কাজী ইরাদত আলী গত নির্বাচনে নিজেকে এমপি করে নিলেন। বড় ভাই কিছুই করতে পারলেন না। এখন তাঁকে ছোট ভাই রাজনীতিতে কোণঠাসা করে ফেলেছেন।
নাটোর-২ আসনে শফিকুল ইসলাম ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, লতাপাতাসহ সবাইকে দলের বিভিন্ন পদ-পদবিতে বসিয়ে দিলেন। সবাই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে গেলেন। নিজেও দেশে-বিদেশে প্রাসাদসম বাড়ি তৈরি করলেন। নাটোরের সব এমপি, আওয়ামী লীগ নেতাকে এলাকাছাড়া করলেন। এত ক্ষমতা তাঁর কোত্থেকে এল! দলে এমন প্রভাবশালী হওয়া যায় কি? বরগুনার আরেক সাংসদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে যে, ২২টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপি সাহেব দুই লাখ টাকা করে অনুদান দিয়েছেন। অথচ কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই টাকার চেক সম্পর্কে খবর জানে না। কেউ মিডিয়ার সামনে কথা বলতেও সাহস পাচ্ছে না। বরগুনাতে বেশ কিছু উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু যাঁরা পেলেন, তাঁরা অন্যের নামের টিপসই বা স্বাক্ষর দিয়ে টাকা তুলে নিলেন। মৃত ব্যক্তির নামেও টাকা তোলা হয়েছে। এসব কাজ যাঁরা করেন, তাঁরা আসলে কারা? আবদুল কাদের মাঝি আর আবদুল কাদের মির্জাদেরই অনুসারী নয় কি?
সম্প্রতি কিছু ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সামনেও বেশ কিছু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। মনোনয়ন নিয়ে এরই মধ্যে পত্রপত্রিকায় অনেক খবর ছাপা হয়েছে। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা বাদ পড়েছেন—এমন খবরও ছাপা হয়েছে। জামায়াত-শিবির ও বিএনপি থেকে আসা কেউ কেউ আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে এখন মনোনয়নও লাভ করেছেন। এসব নাম যেসব অঞ্চল থেকে প্রস্তাবাকারে পাঠানো হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, নাম যেখান থেকেই পাঠানো হোক না কেন, দলের হাইকমান্ড মনোনয়নের সময় প্রার্থীর আমলনামা ভালো করে যাচাই-বাছাই করছে না কেন? কোনো একটি উপজেলা থেকে নামের তালিকা পাঠালেই সেটি নির্ভুল হবে—এমনটি কি এখন ভাবা যায়? দলের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এখন অনেক কিছুই একাকার হয়ে গেছে। সেখানে দলের ত্যাগীরা কীভাবে মার খাচ্ছে, তা তো বসুরহাটেই দেখা গেল। এই পরিস্থিতি আর কত দিন চলতে দেওয়া হবে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৩ বছরে দেশকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। সেই কৃতিত্ব নেতা হিসেবে তাঁকে সবাই দিয়ে থাকেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের দায়িত্ব তিনি যাঁদের দিয়েছেন, তাঁরা বোধ হয় কাদের মির্জাদের কারণে খুব একটা সফলকাম হতে পারছেন না। এখন বোধ হয় আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনাকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেটি আওয়ামী লীগের স্বার্থেই শুধু নয়, দেশের স্বার্থেও।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
১১ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
১১ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
১১ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
১১ ঘণ্টা আগে