ড. মিল্টন বিশ্বাস
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো...
যাক পুরাতন স্মৃতি
যাক ভুলে যাওয়া গীতি
যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক
যাক যাক
এসো এসো...
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা
রসের আবেশ রাশি
শুষ্ক করি দাও আসি
আনো আনো, আনো তব প্রলয়ের শাঁখ
মায়ার কুঁজঝটি জাল যাক, দূরে যাক যাক যাক
এসো এসো
অর্থাৎ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দে পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি, অশ্রুঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক; নববর্ষে পুরোনো বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত করেছি আমরা, মুজিববর্ষ শেষ হয়েছে গত মাসে। আর রাশিয়া যুদ্ধের দামামার ভেতরে বিশ্বব্যাপী অস্থির সময়ে আমাদের জীবনে পয়লা বৈশাখ এসেছে নতুন সাজে।
১৪ এপ্রিল আমাদের নববর্ষ। টি এস এলিয়টের ভাষায় ‘এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস’। দেখা যাচ্ছে কবির কথাই সত্য। যুদ্ধে মানুষ আজ বিচলিত, এই এপ্রিলেই তার প্রভাব ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। তবে এই এপ্রিল আমাদের বৈশাখী/বৈসাবি উৎসবের মাস—খররৌদ্র আর তীব্র ঝড়ের মাস। বৈশাখকে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছিলেন ‘মোহন ভীষণ বেশে’, দেখেছিলেন ‘অতলের বাণী খুঁজে পাওয়া মৌনী তাপসরূপে’। অন্য কবি লিখেছেন—‘রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল/ আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল/ ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল লয়ে অশনি।’ বৈশাখে এই ‘অশনি’র খেলা নিশ্চয় কারো কাছে প্রত্যাশিত নয়।
অবশ্য ২০২২ সালে আমাদের বৈশাখী আয়োজনের মধ্যে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সুন্দর মেলবন্ধন ঘটেছে। করোনাকাল তথা ২০২০ সালের আগে যেভাবে অতি সহজ-সরল, প্রশান্ত কিন্তু উদ্দীপনাময় আয়োজন ছিল, তা এখন আবার স্বাভাবিক হয়েছে। এখন আমরা স্বপ্নময়, আমাদের চিত্ত স্থির এবং আমাদের চেষ্টা অব্যর্থ। এবার হালখাতা খুলে দোকানে বসেছেন মালিক, বৈশাখী মেলায় নাগরদোলা, পুতুলনাচের উৎসবে শিশুদের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। প্রতিবছর যেসব থিম অনুসারে সারা দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হতো, তাও এবার হচ্ছে। রমনার বটমূলে প্রত্যুষের ছায়ায় আয়োজিত ছায়ানটের অনুষ্ঠান এবার হচ্ছে সশরীরে। আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নতুন বছরকে বরণ করার জন্য তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানও হচ্ছে সাড়ম্বরে, ‘পাচন’ আর ‘পুণ্যাহে’র মতো নানাবিধ ব্রত ও বিধি পালনের সব প্রথা মেনে।
একসময় ভারতবর্ষে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি ফলনের খাজনা আদায় করা হতো। ফলে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল কৃষিকাজে ফসল না থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা দিতে বাধ্য হতেন কৃষকেরা। খাজনা আদায়ের সময়টিকে কৃষকদের জন্য সহনীয় করতে প্রবর্তিত হয় ‘ফসলি’ সন। আসলে হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন সনের নিয়ম প্রচলন করা হয়েছিল। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনার শুরু। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। ক্রমান্বয়ে ফসলি সন বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে এটি পরিচিতি লাভ করে।
বাংলা নববর্ষ তথা পয়লা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি সূচনা হয় সূর্যোদয়ের প্রত্যুষে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় বাঙালির পয়লা বৈশাখের উৎসব। তবে ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ২০১৯ অবধি ছায়ানটের রমনার বটমূলে বর্ষবরণের আয়োজন হয়ে আসছে। ২০২০ ও ২০২১-এর আয়োজন ছিল অনলাইনে। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখ সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণের সূচনা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি ইউনেসকো কর্তৃক ২০১৬ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ২০১৭ সাল থেকে এই শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা, অর্থাৎ শিবের উপাসনা। একই সঙ্গে ওই দিন গ্রামবাংলায় আয়োজিত হয় চড়কমেলা।
নববর্ষের সব আনন্দ, উৎসব ও অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা স্মরণ করে বলতে হয়, সংকটে আক্রান্ত বিশ্বে আমাদের কাছে এখন বেঁচে থাকার গৌরব বেশি। নিকোত্মীয় হোক, দূরের বন্ধু হোক, দিনে হোক, দিনের অবসানে হোক—আমরা এখন সুস্থতার সংবাদ শুনতে চাই। গত দুই বছর করোনায় আক্রান্ত হলে কী করি, কী চিকিৎসা পাই, কোথায় মরতে হবে, কোথায় সেবা করে আত্মবিসর্জন করতে হবে—এটাই অশান্তচিত্তে আমরা খুঁজেছি। বিচিত্র কর্মের পেছনে মানুষের ছুটে চলার বিপরীতে রয়েছে নির্জন প্রকৃতির স্তব্ধতা। তার রূপ অক্লিষ্ট অক্লান্ত, তার সাজগোজ বিস্তীর্ণ নীলাকাশ থেকে অরণ্যের সবুজে প্রসারিত। প্রকৃতি নিজেকে চিরকাল প্রকাশমান রেখেছে, মানুষের মতো ঊর্ধ্বশ্বাস কর্মের বেগে নিজেকে অস্পষ্ট করে তোলেনি। মানুষের কর্মের চতুর্দিকে অবকাশ ও চাঞ্চল্যকে ধ্রুবশান্তির দ্বারা মথিত করে সে চিরনবীনের বার্তাবাহক।
এই একুশ শতকেও গ্রামীণ জীবনের প্রাধান্যের মধ্যে বাঙালি হিসেবে রাতদিনের কর্মযজ্ঞে ইউরোপ-আমেরিকার মতো আমাদের ব্যস্ত থাকার কথা নয়। এখনো প্রকৃতির উদার শান্তি, বিশাল স্তব্ধতার মধ্যে আমরা পরিভ্রমণ করতে পছন্দ করি। এজন্যই বৈশাখের তপ্ত আকাশ, তার শুষ্ক ধূসর প্রান্তরের নীরব মধ্যাহ্ন, নিঃশব্দ রাত্রি অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আলিঙ্গনে আমাদের জীবন মুখরিত হয়।
আজকের দিনের বহু আড়ম্বর, আস্ফালন, করতালি, মিথ্যাবাক্য, যা আমাদের স্বরচিত, যাকে বাংলাদেশের মধ্যে আমরা একমাত্র সত্য, একমাত্র বৃহৎ বলে মনে করছি, সেই করপোরেট কালচারের ঢেউ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কারণ নববর্ষ সবাইকে একই কাতারে নিয়ে আসে। সেখানে শ্রমজীবী আর বুদ্ধিজীবী একসঙ্গে চলেন, প্রত্যেকে নিজকে এবং জগৎকে ঠিকভাবে দেখতে পান, উৎসবের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মিলনলাভ সম্ভব হয়। উৎসবের আয়োজনে ব্যক্তিগত ভোগের নিবিড়তা নেই, বরং বৈশাখী আনন্দ আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীর মধ্যে ব্যাপ্ত করে দিয়েছে মহত্ত্ব। নববর্ষের আনন্দ আমাদের ঘরকে, মনকে, সমাজকে কলুষের ঘনবাষ্প থেকে অনেকটা পরিমাণে নির্মল করে রাখে, দূষিত বায়ুকে বদ্ধ করে রাখে না এবং মলিনতার আবর্জনাকে একেবারে গায়ের পাশে জমতে দেয় না। এতে করে বৈষম্যহীন সমাজ তৈরির পথ প্রসারিত হয়। উৎসব আমাদের শিখিয়েছে মানুষ বড়, পদ বড় নয়; দারিদ্র্য লজ্জাকর নয়, সকল কর্মে, সকল অবস্থাতেই সহজে মাথা তুলে রাখা যায়, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ধনি হওয়ার প্রচেষ্টা অন্যকে ছোটো করে দেখার দৃষ্টি তৈরি করে দেয় না। এজন্যই নববর্ষের উৎসব সর্বজনীন।
এসেছে পয়লা বৈশাখ, ৩০ চৈত্রে ১৪২৮ বঙ্গাব্দ বিদায় নিয়েছে। এজন্য ‘উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা/ বিপুল নিঃশ্বাসে।’ রবীন্দ্রনাথ ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘পুরাতনই চিরনবীনতার অক্ষয় ভান্ডার।...নূতনত্বের মধ্যে চিরপুরাতনকে অনুভব করিলে তবেই অমেয় যৌবনসমুদ্রে আমাদের জীর্ণ জীবন স্নান করিতে পায়।’ এই ‘চিরপুরাতন’ হলো আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। আজকের এই নববর্ষের মধ্যে বাঙালির বহুসহস্র পুরাতন বর্ষকে উপলব্ধি করতে হবে। কারণ সেখানে রয়েছে সম্রাট আকবর কর্তৃক বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিহাস, সেখানে আছে গ্রামীণ বাংলার হালখাতা আর বৈশাখী মেলার আয়োজন, আছে বাঙালি জমিদারদের পুণ্যাহের উৎসব। ফসলের ঘ্রাণে গড়ে ওঠা আমার নববর্ষ শাশ্বত ও গৌরবের। নববর্ষে বৈশাখের খররৌদ্রে অগ্নিস্নানে শুদ্ধ হয়ে উঠুক আমাদের সমস্যাকবলিত জন্মভূমি।
‘হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি/ পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে-/ ব্যাপ্ত করি, লুপ্ত করি, স্তরে স্তরে স্তবকে স্তবকে/ ঘনঘোরস্তূপে।’ ‘ঘনঘোরস্তূপে’ নতুনের এই আহ্বান প্রকৃতপক্ষে সংকটকবলিত বাঙালির জীবনে প্রত্যাশার অভিব্যক্তি। এই মুহূর্তে আমরা পৃথিবীতে যতটুকু কাজ করি, তা যেন সত্যসত্যই দায়িত্ব পালনের জন্য করি, ভান না করি। কারণ অক্ষমরা বৃহৎ কাজ করতে পারে না বরং বৃহৎ ভানকে শ্রেয়স্কর জ্ঞান করে। জানে না যে মনুষ্যত্ব লাভের পক্ষে বড় মিথ্যার চেয়ে ছোট সত্য ঢের বেশি মূল্যবান। এই সত্য পথে হেঁটে আমরা নববর্ষের চেতনায় সামাজিক সংকট জয় করব। আর এই বৈশাখেই মানবজীবনকে সুন্দর ও কল্যাণকর করার জন্য শপথ নিতে হবে। কারণ বৈশাখে ‘মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে’। জীর্ণতার হোক ক্ষয়, জীবনের হোক জয়।
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো...
যাক পুরাতন স্মৃতি
যাক ভুলে যাওয়া গীতি
যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক
যাক যাক
এসো এসো...
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা
রসের আবেশ রাশি
শুষ্ক করি দাও আসি
আনো আনো, আনো তব প্রলয়ের শাঁখ
মায়ার কুঁজঝটি জাল যাক, দূরে যাক যাক যাক
এসো এসো
অর্থাৎ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দে পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি, অশ্রুঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক; নববর্ষে পুরোনো বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত করেছি আমরা, মুজিববর্ষ শেষ হয়েছে গত মাসে। আর রাশিয়া যুদ্ধের দামামার ভেতরে বিশ্বব্যাপী অস্থির সময়ে আমাদের জীবনে পয়লা বৈশাখ এসেছে নতুন সাজে।
১৪ এপ্রিল আমাদের নববর্ষ। টি এস এলিয়টের ভাষায় ‘এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস’। দেখা যাচ্ছে কবির কথাই সত্য। যুদ্ধে মানুষ আজ বিচলিত, এই এপ্রিলেই তার প্রভাব ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। তবে এই এপ্রিল আমাদের বৈশাখী/বৈসাবি উৎসবের মাস—খররৌদ্র আর তীব্র ঝড়ের মাস। বৈশাখকে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছিলেন ‘মোহন ভীষণ বেশে’, দেখেছিলেন ‘অতলের বাণী খুঁজে পাওয়া মৌনী তাপসরূপে’। অন্য কবি লিখেছেন—‘রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল/ আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল/ ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল লয়ে অশনি।’ বৈশাখে এই ‘অশনি’র খেলা নিশ্চয় কারো কাছে প্রত্যাশিত নয়।
অবশ্য ২০২২ সালে আমাদের বৈশাখী আয়োজনের মধ্যে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সুন্দর মেলবন্ধন ঘটেছে। করোনাকাল তথা ২০২০ সালের আগে যেভাবে অতি সহজ-সরল, প্রশান্ত কিন্তু উদ্দীপনাময় আয়োজন ছিল, তা এখন আবার স্বাভাবিক হয়েছে। এখন আমরা স্বপ্নময়, আমাদের চিত্ত স্থির এবং আমাদের চেষ্টা অব্যর্থ। এবার হালখাতা খুলে দোকানে বসেছেন মালিক, বৈশাখী মেলায় নাগরদোলা, পুতুলনাচের উৎসবে শিশুদের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। প্রতিবছর যেসব থিম অনুসারে সারা দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হতো, তাও এবার হচ্ছে। রমনার বটমূলে প্রত্যুষের ছায়ায় আয়োজিত ছায়ানটের অনুষ্ঠান এবার হচ্ছে সশরীরে। আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নতুন বছরকে বরণ করার জন্য তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানও হচ্ছে সাড়ম্বরে, ‘পাচন’ আর ‘পুণ্যাহে’র মতো নানাবিধ ব্রত ও বিধি পালনের সব প্রথা মেনে।
একসময় ভারতবর্ষে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি ফলনের খাজনা আদায় করা হতো। ফলে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল কৃষিকাজে ফসল না থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা দিতে বাধ্য হতেন কৃষকেরা। খাজনা আদায়ের সময়টিকে কৃষকদের জন্য সহনীয় করতে প্রবর্তিত হয় ‘ফসলি’ সন। আসলে হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন সনের নিয়ম প্রচলন করা হয়েছিল। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনার শুরু। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। ক্রমান্বয়ে ফসলি সন বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে এটি পরিচিতি লাভ করে।
বাংলা নববর্ষ তথা পয়লা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি সূচনা হয় সূর্যোদয়ের প্রত্যুষে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় বাঙালির পয়লা বৈশাখের উৎসব। তবে ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ২০১৯ অবধি ছায়ানটের রমনার বটমূলে বর্ষবরণের আয়োজন হয়ে আসছে। ২০২০ ও ২০২১-এর আয়োজন ছিল অনলাইনে। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখ সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণের সূচনা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি ইউনেসকো কর্তৃক ২০১৬ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ২০১৭ সাল থেকে এই শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা, অর্থাৎ শিবের উপাসনা। একই সঙ্গে ওই দিন গ্রামবাংলায় আয়োজিত হয় চড়কমেলা।
নববর্ষের সব আনন্দ, উৎসব ও অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা স্মরণ করে বলতে হয়, সংকটে আক্রান্ত বিশ্বে আমাদের কাছে এখন বেঁচে থাকার গৌরব বেশি। নিকোত্মীয় হোক, দূরের বন্ধু হোক, দিনে হোক, দিনের অবসানে হোক—আমরা এখন সুস্থতার সংবাদ শুনতে চাই। গত দুই বছর করোনায় আক্রান্ত হলে কী করি, কী চিকিৎসা পাই, কোথায় মরতে হবে, কোথায় সেবা করে আত্মবিসর্জন করতে হবে—এটাই অশান্তচিত্তে আমরা খুঁজেছি। বিচিত্র কর্মের পেছনে মানুষের ছুটে চলার বিপরীতে রয়েছে নির্জন প্রকৃতির স্তব্ধতা। তার রূপ অক্লিষ্ট অক্লান্ত, তার সাজগোজ বিস্তীর্ণ নীলাকাশ থেকে অরণ্যের সবুজে প্রসারিত। প্রকৃতি নিজেকে চিরকাল প্রকাশমান রেখেছে, মানুষের মতো ঊর্ধ্বশ্বাস কর্মের বেগে নিজেকে অস্পষ্ট করে তোলেনি। মানুষের কর্মের চতুর্দিকে অবকাশ ও চাঞ্চল্যকে ধ্রুবশান্তির দ্বারা মথিত করে সে চিরনবীনের বার্তাবাহক।
এই একুশ শতকেও গ্রামীণ জীবনের প্রাধান্যের মধ্যে বাঙালি হিসেবে রাতদিনের কর্মযজ্ঞে ইউরোপ-আমেরিকার মতো আমাদের ব্যস্ত থাকার কথা নয়। এখনো প্রকৃতির উদার শান্তি, বিশাল স্তব্ধতার মধ্যে আমরা পরিভ্রমণ করতে পছন্দ করি। এজন্যই বৈশাখের তপ্ত আকাশ, তার শুষ্ক ধূসর প্রান্তরের নীরব মধ্যাহ্ন, নিঃশব্দ রাত্রি অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আলিঙ্গনে আমাদের জীবন মুখরিত হয়।
আজকের দিনের বহু আড়ম্বর, আস্ফালন, করতালি, মিথ্যাবাক্য, যা আমাদের স্বরচিত, যাকে বাংলাদেশের মধ্যে আমরা একমাত্র সত্য, একমাত্র বৃহৎ বলে মনে করছি, সেই করপোরেট কালচারের ঢেউ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কারণ নববর্ষ সবাইকে একই কাতারে নিয়ে আসে। সেখানে শ্রমজীবী আর বুদ্ধিজীবী একসঙ্গে চলেন, প্রত্যেকে নিজকে এবং জগৎকে ঠিকভাবে দেখতে পান, উৎসবের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মিলনলাভ সম্ভব হয়। উৎসবের আয়োজনে ব্যক্তিগত ভোগের নিবিড়তা নেই, বরং বৈশাখী আনন্দ আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীর মধ্যে ব্যাপ্ত করে দিয়েছে মহত্ত্ব। নববর্ষের আনন্দ আমাদের ঘরকে, মনকে, সমাজকে কলুষের ঘনবাষ্প থেকে অনেকটা পরিমাণে নির্মল করে রাখে, দূষিত বায়ুকে বদ্ধ করে রাখে না এবং মলিনতার আবর্জনাকে একেবারে গায়ের পাশে জমতে দেয় না। এতে করে বৈষম্যহীন সমাজ তৈরির পথ প্রসারিত হয়। উৎসব আমাদের শিখিয়েছে মানুষ বড়, পদ বড় নয়; দারিদ্র্য লজ্জাকর নয়, সকল কর্মে, সকল অবস্থাতেই সহজে মাথা তুলে রাখা যায়, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ধনি হওয়ার প্রচেষ্টা অন্যকে ছোটো করে দেখার দৃষ্টি তৈরি করে দেয় না। এজন্যই নববর্ষের উৎসব সর্বজনীন।
এসেছে পয়লা বৈশাখ, ৩০ চৈত্রে ১৪২৮ বঙ্গাব্দ বিদায় নিয়েছে। এজন্য ‘উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা/ বিপুল নিঃশ্বাসে।’ রবীন্দ্রনাথ ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘পুরাতনই চিরনবীনতার অক্ষয় ভান্ডার।...নূতনত্বের মধ্যে চিরপুরাতনকে অনুভব করিলে তবেই অমেয় যৌবনসমুদ্রে আমাদের জীর্ণ জীবন স্নান করিতে পায়।’ এই ‘চিরপুরাতন’ হলো আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। আজকের এই নববর্ষের মধ্যে বাঙালির বহুসহস্র পুরাতন বর্ষকে উপলব্ধি করতে হবে। কারণ সেখানে রয়েছে সম্রাট আকবর কর্তৃক বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিহাস, সেখানে আছে গ্রামীণ বাংলার হালখাতা আর বৈশাখী মেলার আয়োজন, আছে বাঙালি জমিদারদের পুণ্যাহের উৎসব। ফসলের ঘ্রাণে গড়ে ওঠা আমার নববর্ষ শাশ্বত ও গৌরবের। নববর্ষে বৈশাখের খররৌদ্রে অগ্নিস্নানে শুদ্ধ হয়ে উঠুক আমাদের সমস্যাকবলিত জন্মভূমি।
‘হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি/ পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে-/ ব্যাপ্ত করি, লুপ্ত করি, স্তরে স্তরে স্তবকে স্তবকে/ ঘনঘোরস্তূপে।’ ‘ঘনঘোরস্তূপে’ নতুনের এই আহ্বান প্রকৃতপক্ষে সংকটকবলিত বাঙালির জীবনে প্রত্যাশার অভিব্যক্তি। এই মুহূর্তে আমরা পৃথিবীতে যতটুকু কাজ করি, তা যেন সত্যসত্যই দায়িত্ব পালনের জন্য করি, ভান না করি। কারণ অক্ষমরা বৃহৎ কাজ করতে পারে না বরং বৃহৎ ভানকে শ্রেয়স্কর জ্ঞান করে। জানে না যে মনুষ্যত্ব লাভের পক্ষে বড় মিথ্যার চেয়ে ছোট সত্য ঢের বেশি মূল্যবান। এই সত্য পথে হেঁটে আমরা নববর্ষের চেতনায় সামাজিক সংকট জয় করব। আর এই বৈশাখেই মানবজীবনকে সুন্দর ও কল্যাণকর করার জন্য শপথ নিতে হবে। কারণ বৈশাখে ‘মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে’। জীর্ণতার হোক ক্ষয়, জীবনের হোক জয়।
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
১৪ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
১৪ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
১৫ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
১৫ ঘণ্টা আগে