ফারুক মেহেদী
গরিবের সুন্দরী বউ নাকি সবার ভাবি! ছোটবেলা থেকে এ কথাটি শুনে আসছি। প্রথমে এর মানে বুঝতাম না। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে থাকলাম আসলে গরিব মানুষের সুন্দরী বউ থাকলে তাঁর প্রতিবেশী অনেকে ভাব জমাতে চায়, একটু ঘনিষ্ঠ হতে চায়। গরিব বলে ওই ‘সুন্দরী ভাবি’ বিভিন্ন সময়ে অভাবের কারণে এটা-ওটা ধার চান। তখন সুযোগে কারও গোপন বাসনাও জেগে উঠতে পারে। নানান ছুতোয় ‘ভাবি’কে কাছে পাওয়ার নেশা ধরে অনেকের! পরের বউ হলে কী? সবাই তখন ওই বউয়ের রূপের নেশায় নানান বাহানা খোঁজে! মনে মনে মনকলা খায়! এ রকম কথাই শুনেছি। সাহিত্য, চলচ্চিত্রে গরিবের এমন সুন্দরী বউয়ের রূপে মাতাল হওয়ার অসংখ্য মনোমুগ্ধকর দৃশ্য হয়তো অনেকেই দেখেছেন। বাস্তবেও হরহামেশাই দেখা মেলে এমন ঘটনার! কেউ হয়তো আশপাশে, নিজের জানাশোনার মধ্যেও দু-চারটি ঘটনা জানেন, দেখেছেন। গ্রামে প্রচলিত প্রবাদ হলেও এটি এখন আর বুঝতে সমস্যা হয় না।
অভাব কি আর ভালোবাসা মানে? ছোটবেলায় পড়েছি ‘অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়’। এটা উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের একটি বাণী চিরন্তনী। বড় হয়ে এটারও সত্যতা আর নির্মমতা দেখেছি, বুঝেছি। এটাকে সমর্থন করা যায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি কবিতার লাইন দিয়ে। সেটিও ছোটবেলায় পড়া কবিতা। তিনি লিখেছিলেন ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। এর মানেও নিশ্চয় সবাই জানেন। ছেলেবেলায় আমার বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। এখন বুঝতে পারি ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে সৌন্দর্যের কোনো মূল্য নেই। যখন দুবেলা খাবার জোটে না, থাকার জন্য বাসস্থান থাকে না, তখন ক্ষুধার যন্ত্রণায় চোখে সরষে ফুল দেখে। নিসর্গের সব উপকরণকে সে তখন খাবার হিসেবে চিন্তা করে! সম্ভবত কবি এমনটিই বোঝাতে চেয়েছেন!
কবিতা, গল্প, সাহিত্য কিংবা চলচ্চিত্রের শিল্পরূপ, নান্দনিক মান নিয়ে কথা বলার জন্য এ লেখা নয়। অথবা অভাবের কারণে কারও সুন্দরী বউয়ের দিকে কার চোখ পড়েছে, এরপর তার কী দশা হলো, ঠিক এসবও আমার বলার বিষয় নয়। আসলে আজকে বলব আফগান উপাখ্যান নিয়ে! লেখাটির পর তখন দেশটিকে কেউ গরিবের সুন্দরী বউয়ের সঙ্গে মেলাতে পারেন, আবার না-ও মেলাতে পারেন!
এরই মধ্যে আফগানিস্তানের কী অবস্থা হয়েছে, আমরা সবাই জানি! দেশটি তালেবানরা দখলে নিয়েছে। কাবুলে তাদের বিজয় উল্লাস দেখা যাচ্ছে। ভয়ে, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ, বিদেশি নাগরিকেরা যেভাবে পারছেন, পালানোর চেষ্টা করছেন। কাবুল বিমানবন্দর লোকাল বাস বা লঞ্চঘাটের মতো রূপ নিয়েছে। জীবন বাঁচাতে মানুষ কতটা বেপরোয়া হলে বিমানের ছাদে, ককপিটে বা ইঞ্জিনের ওপরে উঠেও দেশ ছাড়তে চায়, এটাও দেখেছে বিশ্ববাসী। ইসলামি কট্টরপন্থী তালেবানের নির্মমতা আর ভয়াবহতা দুই দশক আগেও মানুষ দেখেছে। সেই আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে আবারও।
কেমন হবে তালেবান সরকার? কী হবে তাদের শাসনব্যবস্থা, দেশ পরিচালনার নীতি-কৌশল? কারা থাকবে নেতৃত্বে? অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক সম্পর্ক কতটা অটুট থাকবে? রিজার্ভ, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, খাদ্য সরবরাহব্যবস্থার কী হবে? এ রকম হাজারো প্রশ্ন এখন আফগানিস্তান ঘিরে। কোনো কিছু বিশ্লেষণ না করেও বলা যায়, দেশটি এখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ক্রমেই দেশটি অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে!
রাজনৈতিক কারণে আফগানিস্তান সব সময়ই হটস্পট। দেশটি ভঙ্গুর ও গরিব হলেও কখনো রাশিয়া, কখনো আমেরিকা তাদের নিজেদের মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে দেশটিকে বগলদাবা করেছিল। প্রতিবেশী চীন, ভারতও কম যায়নি। তারাও তক্কে তক্কে আছে। তালেবানকে কাবুল দখলে আমেরিকাকে আপাত নির্বিকার মনে হলেও বাস্তবে ততটা নয়। দেশটি নিয়ে রাজনৈতিক কৌশল অবশ্যই আছে, তবে এরই মধ্যে তারা আফগানিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক চাপ দেওয়া শুরু করেছে।
রাশিয়া আবারও দেশটি নিয়ে পুরোনো কৌশল শাণিত করতে চাইছে। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দেশটি কীভাবে চলবে, তা তাদের ওপরই ছেড়ে দিতে বলেছেন। একই সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোকে এ বিষয়ে নাক না গলানোরও পরামর্শ দিয়েছেন। পুতিন ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দেশটির সরকার গঠন নিয়ে টেলিফোনে কথা বলেছেন। শর্ত সাপেক্ষে তালেবানের সঙ্গে কাজ করতে চায় যুক্তরাজ্য। কথা বলতে শুরু করেছে ফ্রান্সসহ আরও বেশ কিছু দেশ। বলা যায়, পরাশক্তির দেশগুলো আফগানিস্তান নিয়ে এখন নিজ নিজ স্বার্থে খেলবে! কেউ রাজনৈতিক, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে, কেউ অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্র বিচেনায় কৌশল নিচ্ছে। তবে সবাই খেলবে তাদের নিজ নিজ স্বার্থে–এতে কোনো সন্দেহ নেই।
রাজনৈতিকভাবে আফগানিস্তান এখন বলা যায়, পরাশক্তি কিংবা প্রতিবেশী সবারই নজরে। কে কীভাবে ভূমিকা রাখবে, কোন পথে হাঁটলে দেশটিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা যাবে, মূলত এটিই বিষয়। আফগানিস্তানের জনগণ, তাদের সুন্দর জীবন, নাগরিক অধিকার, মুক্তমত, স্বাধীন চলাফেরা, মানবাধিকার, দেশটির উন্নয়ন সবই ওই ‘কাজির গরু গোয়ালে নয়, কেতাবে আছে’র মতো। চিন্তা, মূল্যবোধে পিছিয়ে পড়া জাতি হিসেবে আফগানদের টিকিয়ে রাখা এবং একে ইস্যু করে পরাশক্তিদের উদ্দেশ্য বৈশ্বিক রাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়ন করা।
আফগানিস্তানের কিছু প্রাকৃতিক সম্পদেই মূলত নজর! দেশটিতে আছে বিপুল পরিমাণ কপার, কোবাল্ট, কয়লা, জ্বালানি তেল ও গ্যাস। আর লিথিয়াম নামে আছে আরেকটি মূল্যবান ধাতু; যা মোবাইল ডিভাইসের ব্যাটারিতে এবং ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারিতে ব্যবহৃত হয়। আগামী দিনে বিশ্বে জিরো-কার্বন নিঃসরণ করে–এমন ইলেকট্রিক গাড়ির চাহিদা বাড়বে। তখন লিথিয়ামের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। তাই এ সুযোগটি কে হাতছাড়া করবে?
শুধু দখলবাজি, বন্দুকের নল দিয়ে তো আর দেশ চলবে না! মানুষের রুটি-রুজি থাকতে হবে। দুমুঠো খাবার লাগবে। থাকার জায়গা, বস্ত্র, চিকিৎসা—এসবও লাগবে। এ জন্য লাগবে টাকা। কাবুল দখলের পর থেকেই অর্থনৈতিকভাবে নাজুক দেশটি চরম ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। এরই মধ্যে আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভে থাকা ৯ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আটকে দিয়েছে দেশটি। এখন চাইলেই এ টাকা তুলতে দেবে না আমেরিকা। এত দিনের মিত্র দেশ জার্মানিও দেশটির সব আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমা অন্য দাতা দেশ এত দিন আফগানিস্তানের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পেছনে মোট খরচের ৭৫ শতাংশ বহন করত। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। আইএমএফও দেশটিতে তাদের বরাদ্দ স্থগিত করেছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তো আছেই। এখন প্রভাব পড়বে সেগুলোর।
বিশ্বব্যাংক বলছে, দেশটির জিডিপির প্রায় ২২ শতাংশই জোগান দেয় বিদেশি সহায়তা। এখন এটি বন্ধ হওয়া মানে তালেবানের পকেট খালি! এমনিতে নিরাপত্তার কারণে দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগ নেই। নতুন করে তালেবান শাসনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের ফলে সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে–এ আশাও করা যায় না। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, দেশটি থেকে প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ছোট হওয়া সত্ত্বেও ২০১৪ সালের পর দেশটিতে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ গেছে মাত্র ৪টি। আর একই সময়ে নেপালে তার ১০ গুণ এবং শ্রীলঙ্কায় ৫০ গুণ বেশি বিনিয়োগ গেছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, দেশটির বেসরকারি খাত খুবই দুর্বল। ৬০ শতাংশ জনসংখ্যাই কৃষিতে নির্ভর করে। তালেবানের অর্থের বড় উৎসই চোরাকারবারি, বিশেষ করে আফিম বিক্রি। তালেবান নিয়ন্ত্রণের পর দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। দেশটির আতঙ্কিত জনগণ তাদের ব্যাংকে জমানো টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে গণমাধ্যমে খবর হয়েছে। কাবুল দখলের পর ভারতের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় ভারতের সঙ্গে। চলতি অর্থবছরে ভারত ৮৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে আফগানিস্তানে। আর দেশটি ভারতে রপ্তানি করে ৫১ কোটি ডলারের পণ্য। আর ভারত দেশটির প্রায় ৪০০ প্রকল্পে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে এখন প্রায় বিপাকে রয়েছে।
এমন এক বৈরী সময়ে কোনো বিদেশি বিনিয়োগ না এলে, স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হলে, রিজার্ভের অর্থ তুলতে না পারলে, উন্নয়ন-সহযোগীদের সহায়তা বন্ধ থাকলে, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিক না হলে দেশটি চলবে কীভাবে? মানুষ যখন খেতে পারবে না, কাজ পাবে না, জিনিসপত্র কিনতে পারবে না, কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হবে না, কারও আয় বাড়বে না, তখন কী পরিস্থিতি হবে, সেটা সহজেই ধারণা করা যায়। তখন আবারও সেই গৃহযুদ্ধ, সংঘাত, খুনোখুনি, রক্তপাতের বৃত্তেই দেশটি ঘুরপাক খাবে বলে নানান গবেষণা, বিশ্লেষণ ও পূর্বাভাসে উঠে আসছে। অর্থনৈতিক সংকট তখন রাজনৈতিক সংকটকে আরও বেশি জটিল করে তুলতে পারে বলেই আশঙ্কা সর্বত্র।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
গরিবের সুন্দরী বউ নাকি সবার ভাবি! ছোটবেলা থেকে এ কথাটি শুনে আসছি। প্রথমে এর মানে বুঝতাম না। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে থাকলাম আসলে গরিব মানুষের সুন্দরী বউ থাকলে তাঁর প্রতিবেশী অনেকে ভাব জমাতে চায়, একটু ঘনিষ্ঠ হতে চায়। গরিব বলে ওই ‘সুন্দরী ভাবি’ বিভিন্ন সময়ে অভাবের কারণে এটা-ওটা ধার চান। তখন সুযোগে কারও গোপন বাসনাও জেগে উঠতে পারে। নানান ছুতোয় ‘ভাবি’কে কাছে পাওয়ার নেশা ধরে অনেকের! পরের বউ হলে কী? সবাই তখন ওই বউয়ের রূপের নেশায় নানান বাহানা খোঁজে! মনে মনে মনকলা খায়! এ রকম কথাই শুনেছি। সাহিত্য, চলচ্চিত্রে গরিবের এমন সুন্দরী বউয়ের রূপে মাতাল হওয়ার অসংখ্য মনোমুগ্ধকর দৃশ্য হয়তো অনেকেই দেখেছেন। বাস্তবেও হরহামেশাই দেখা মেলে এমন ঘটনার! কেউ হয়তো আশপাশে, নিজের জানাশোনার মধ্যেও দু-চারটি ঘটনা জানেন, দেখেছেন। গ্রামে প্রচলিত প্রবাদ হলেও এটি এখন আর বুঝতে সমস্যা হয় না।
অভাব কি আর ভালোবাসা মানে? ছোটবেলায় পড়েছি ‘অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়’। এটা উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের একটি বাণী চিরন্তনী। বড় হয়ে এটারও সত্যতা আর নির্মমতা দেখেছি, বুঝেছি। এটাকে সমর্থন করা যায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি কবিতার লাইন দিয়ে। সেটিও ছোটবেলায় পড়া কবিতা। তিনি লিখেছিলেন ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। এর মানেও নিশ্চয় সবাই জানেন। ছেলেবেলায় আমার বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। এখন বুঝতে পারি ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে সৌন্দর্যের কোনো মূল্য নেই। যখন দুবেলা খাবার জোটে না, থাকার জন্য বাসস্থান থাকে না, তখন ক্ষুধার যন্ত্রণায় চোখে সরষে ফুল দেখে। নিসর্গের সব উপকরণকে সে তখন খাবার হিসেবে চিন্তা করে! সম্ভবত কবি এমনটিই বোঝাতে চেয়েছেন!
কবিতা, গল্প, সাহিত্য কিংবা চলচ্চিত্রের শিল্পরূপ, নান্দনিক মান নিয়ে কথা বলার জন্য এ লেখা নয়। অথবা অভাবের কারণে কারও সুন্দরী বউয়ের দিকে কার চোখ পড়েছে, এরপর তার কী দশা হলো, ঠিক এসবও আমার বলার বিষয় নয়। আসলে আজকে বলব আফগান উপাখ্যান নিয়ে! লেখাটির পর তখন দেশটিকে কেউ গরিবের সুন্দরী বউয়ের সঙ্গে মেলাতে পারেন, আবার না-ও মেলাতে পারেন!
এরই মধ্যে আফগানিস্তানের কী অবস্থা হয়েছে, আমরা সবাই জানি! দেশটি তালেবানরা দখলে নিয়েছে। কাবুলে তাদের বিজয় উল্লাস দেখা যাচ্ছে। ভয়ে, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ, বিদেশি নাগরিকেরা যেভাবে পারছেন, পালানোর চেষ্টা করছেন। কাবুল বিমানবন্দর লোকাল বাস বা লঞ্চঘাটের মতো রূপ নিয়েছে। জীবন বাঁচাতে মানুষ কতটা বেপরোয়া হলে বিমানের ছাদে, ককপিটে বা ইঞ্জিনের ওপরে উঠেও দেশ ছাড়তে চায়, এটাও দেখেছে বিশ্ববাসী। ইসলামি কট্টরপন্থী তালেবানের নির্মমতা আর ভয়াবহতা দুই দশক আগেও মানুষ দেখেছে। সেই আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে আবারও।
কেমন হবে তালেবান সরকার? কী হবে তাদের শাসনব্যবস্থা, দেশ পরিচালনার নীতি-কৌশল? কারা থাকবে নেতৃত্বে? অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক সম্পর্ক কতটা অটুট থাকবে? রিজার্ভ, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, খাদ্য সরবরাহব্যবস্থার কী হবে? এ রকম হাজারো প্রশ্ন এখন আফগানিস্তান ঘিরে। কোনো কিছু বিশ্লেষণ না করেও বলা যায়, দেশটি এখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ক্রমেই দেশটি অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে!
রাজনৈতিক কারণে আফগানিস্তান সব সময়ই হটস্পট। দেশটি ভঙ্গুর ও গরিব হলেও কখনো রাশিয়া, কখনো আমেরিকা তাদের নিজেদের মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে দেশটিকে বগলদাবা করেছিল। প্রতিবেশী চীন, ভারতও কম যায়নি। তারাও তক্কে তক্কে আছে। তালেবানকে কাবুল দখলে আমেরিকাকে আপাত নির্বিকার মনে হলেও বাস্তবে ততটা নয়। দেশটি নিয়ে রাজনৈতিক কৌশল অবশ্যই আছে, তবে এরই মধ্যে তারা আফগানিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক চাপ দেওয়া শুরু করেছে।
রাশিয়া আবারও দেশটি নিয়ে পুরোনো কৌশল শাণিত করতে চাইছে। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দেশটি কীভাবে চলবে, তা তাদের ওপরই ছেড়ে দিতে বলেছেন। একই সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোকে এ বিষয়ে নাক না গলানোরও পরামর্শ দিয়েছেন। পুতিন ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দেশটির সরকার গঠন নিয়ে টেলিফোনে কথা বলেছেন। শর্ত সাপেক্ষে তালেবানের সঙ্গে কাজ করতে চায় যুক্তরাজ্য। কথা বলতে শুরু করেছে ফ্রান্সসহ আরও বেশ কিছু দেশ। বলা যায়, পরাশক্তির দেশগুলো আফগানিস্তান নিয়ে এখন নিজ নিজ স্বার্থে খেলবে! কেউ রাজনৈতিক, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে, কেউ অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্র বিচেনায় কৌশল নিচ্ছে। তবে সবাই খেলবে তাদের নিজ নিজ স্বার্থে–এতে কোনো সন্দেহ নেই।
রাজনৈতিকভাবে আফগানিস্তান এখন বলা যায়, পরাশক্তি কিংবা প্রতিবেশী সবারই নজরে। কে কীভাবে ভূমিকা রাখবে, কোন পথে হাঁটলে দেশটিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা যাবে, মূলত এটিই বিষয়। আফগানিস্তানের জনগণ, তাদের সুন্দর জীবন, নাগরিক অধিকার, মুক্তমত, স্বাধীন চলাফেরা, মানবাধিকার, দেশটির উন্নয়ন সবই ওই ‘কাজির গরু গোয়ালে নয়, কেতাবে আছে’র মতো। চিন্তা, মূল্যবোধে পিছিয়ে পড়া জাতি হিসেবে আফগানদের টিকিয়ে রাখা এবং একে ইস্যু করে পরাশক্তিদের উদ্দেশ্য বৈশ্বিক রাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়ন করা।
আফগানিস্তানের কিছু প্রাকৃতিক সম্পদেই মূলত নজর! দেশটিতে আছে বিপুল পরিমাণ কপার, কোবাল্ট, কয়লা, জ্বালানি তেল ও গ্যাস। আর লিথিয়াম নামে আছে আরেকটি মূল্যবান ধাতু; যা মোবাইল ডিভাইসের ব্যাটারিতে এবং ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারিতে ব্যবহৃত হয়। আগামী দিনে বিশ্বে জিরো-কার্বন নিঃসরণ করে–এমন ইলেকট্রিক গাড়ির চাহিদা বাড়বে। তখন লিথিয়ামের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। তাই এ সুযোগটি কে হাতছাড়া করবে?
শুধু দখলবাজি, বন্দুকের নল দিয়ে তো আর দেশ চলবে না! মানুষের রুটি-রুজি থাকতে হবে। দুমুঠো খাবার লাগবে। থাকার জায়গা, বস্ত্র, চিকিৎসা—এসবও লাগবে। এ জন্য লাগবে টাকা। কাবুল দখলের পর থেকেই অর্থনৈতিকভাবে নাজুক দেশটি চরম ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। এরই মধ্যে আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভে থাকা ৯ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আটকে দিয়েছে দেশটি। এখন চাইলেই এ টাকা তুলতে দেবে না আমেরিকা। এত দিনের মিত্র দেশ জার্মানিও দেশটির সব আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমা অন্য দাতা দেশ এত দিন আফগানিস্তানের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পেছনে মোট খরচের ৭৫ শতাংশ বহন করত। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। আইএমএফও দেশটিতে তাদের বরাদ্দ স্থগিত করেছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তো আছেই। এখন প্রভাব পড়বে সেগুলোর।
বিশ্বব্যাংক বলছে, দেশটির জিডিপির প্রায় ২২ শতাংশই জোগান দেয় বিদেশি সহায়তা। এখন এটি বন্ধ হওয়া মানে তালেবানের পকেট খালি! এমনিতে নিরাপত্তার কারণে দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগ নেই। নতুন করে তালেবান শাসনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের ফলে সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে–এ আশাও করা যায় না। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, দেশটি থেকে প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ছোট হওয়া সত্ত্বেও ২০১৪ সালের পর দেশটিতে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ গেছে মাত্র ৪টি। আর একই সময়ে নেপালে তার ১০ গুণ এবং শ্রীলঙ্কায় ৫০ গুণ বেশি বিনিয়োগ গেছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, দেশটির বেসরকারি খাত খুবই দুর্বল। ৬০ শতাংশ জনসংখ্যাই কৃষিতে নির্ভর করে। তালেবানের অর্থের বড় উৎসই চোরাকারবারি, বিশেষ করে আফিম বিক্রি। তালেবান নিয়ন্ত্রণের পর দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। দেশটির আতঙ্কিত জনগণ তাদের ব্যাংকে জমানো টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে গণমাধ্যমে খবর হয়েছে। কাবুল দখলের পর ভারতের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় ভারতের সঙ্গে। চলতি অর্থবছরে ভারত ৮৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে আফগানিস্তানে। আর দেশটি ভারতে রপ্তানি করে ৫১ কোটি ডলারের পণ্য। আর ভারত দেশটির প্রায় ৪০০ প্রকল্পে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে এখন প্রায় বিপাকে রয়েছে।
এমন এক বৈরী সময়ে কোনো বিদেশি বিনিয়োগ না এলে, স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হলে, রিজার্ভের অর্থ তুলতে না পারলে, উন্নয়ন-সহযোগীদের সহায়তা বন্ধ থাকলে, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিক না হলে দেশটি চলবে কীভাবে? মানুষ যখন খেতে পারবে না, কাজ পাবে না, জিনিসপত্র কিনতে পারবে না, কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হবে না, কারও আয় বাড়বে না, তখন কী পরিস্থিতি হবে, সেটা সহজেই ধারণা করা যায়। তখন আবারও সেই গৃহযুদ্ধ, সংঘাত, খুনোখুনি, রক্তপাতের বৃত্তেই দেশটি ঘুরপাক খাবে বলে নানান গবেষণা, বিশ্লেষণ ও পূর্বাভাসে উঠে আসছে। অর্থনৈতিক সংকট তখন রাজনৈতিক সংকটকে আরও বেশি জটিল করে তুলতে পারে বলেই আশঙ্কা সর্বত্র।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
১ দিন আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
১ দিন আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
১ দিন আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
১ দিন আগে