আনোয়ারুল হক
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২৩ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তাদের নেতা-কর্মীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে অসংখ্য আন্দোলনকারীকে হত্যা এবং অনেকের জীবন বিপন্ন করেন।
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, টেন্ডারবাজি, যৌন নির্যাতন ইত্যাদি। গত ১০-১৫ বছরে গণরুমকেন্দ্রিক এবং ছাত্রলীগের সভা-সমাবেশ-মিছিলে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণের মতো নিপীড়নের শিকার হয়েছেন সারা দেশের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী।
এখন প্রশ্ন, এই সংগঠনের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচিতে কি এসব অপকাণ্ডের কথা লিপিবদ্ধ আছে? যদি না থাকে, তাহলে এসব ‘মহান’ কর্তব্য যাঁরা পালন করেছেন তাঁদের আইন ও শাস্তির আওতায় আনা যেতে পারে, সংগঠন কেন নিষিদ্ধ হবে? সংগঠনের ‘ঘোষণাপত্রে’ তো এ ধরনের কর্মসূচি নেই।
আমার তো মনে হয় এসব অপরাধের জন্য সবার আগে বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন বিগত সময়কালের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনকেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স’ দ্বারা পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যথেষ্ট ক্ষমতা ও স্বাধীনতা থাকলেও দলকানা ভিসি ও প্রশাসন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ছাত্রবিরোধী এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কখনোই কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং নীরব সমর্থন জানিয়ে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের চেয়েও বেশি অপরাধ করেছে।
দীর্ঘ ৭৫ বছরের অধিককাল যাবৎ ছাত্রলীগ সংগঠনটি পূর্ব বাংলা ও স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল। ভাষা সংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলন, আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং স্বাধীন দেশেও সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এসব সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের অসংখ্য কর্মী আত্মাহুতি দিয়েছেন, কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। ছাত্রলীগ সংগঠনটির অনেক গৌরবের ইতিহাস রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী সারজিস আলমসহ আন্দোলনের অনেকেই নাকি ছাত্রলীগ করতেন।
জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সিপাহসালার নিজেই জানিয়েছেন একসময় তিনি ছাত্রলীগ করতেন। এমনকি ছাত্রলীগের র্যাডিক্যাল অংশ জাসদ ছাত্রলীগও তিনি ছাত্রজীবনে করেছেন। ছাত্রলীগ পচা-গলা জিনিস হলে সারজিস আলম বা জামায়াতের সিপাহসালার কি ওই সংগঠন করতেন! তবে স্বাধীনতার পরে দেশ গঠনের কাজে ছাত্রলীগ যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল, খুনখারাবিসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিল। যখনই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছে (১৯৯৬-২০০১) বিশেষত বিগত ১০-১৫ বছর ছাত্রলীগ নেতৃত্বের আচরণ ও কর্মকাণ্ড ছিল বেপরোয়া, সংগঠনের ঘোষিত আদর্শের বিরোধী। বিনা ভোটে, রাতের ভোটে, ডামি ভোটে রাষ্ট্রক্ষমতা আগলে রাখা যায় এবং রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করে যেকোনো বিরোধী আন্দোলন দমিয়ে রাখা যায়—এটা দেখে তাঁরা হয়ে ওঠেন আরও দুর্বিনীত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনির ভূমিকা নেওয়ার আগে বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ড, পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড সমাজে ছাত্রলীগ সম্পর্কে যে ঘৃণার সৃষ্টি করেছিল তা ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অনুধাবন করতে পারেননি। ফলে এবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগও লাঠিসোঁটা, পিস্তল, বন্দুক নিয়ে নেমে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে হল ও ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলেই ক্যাম্পাসে জমিদারি প্রতিষ্ঠার উদাহরণ অতীতে ভিন্ন ছাত্রসংগঠনেরও আছে।
কিন্তু এবারের একনাগাড়ে ১৫ বছরের জমিদারি অন্য সময়ের তুলনায় আরও বীভৎস রূপ নিয়ে প্রকাশিত হয়। তার পরেও প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার যে কারণ,
সেই কারণ নির্মূল না করে নিষিদ্ধ ঘোষণায় কি এই সমস্যার সমাধান আসবে?
ছাত্রলীগের কয়েক লাখ কর্মী-সমর্থক রয়েছেন। এর মাঝে সারা দেশে কয়েক হাজার বা ১০-২০ হাজার নেতা-কর্মী এবারের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। তাঁদের বিচারের আওতায় এনে ছাত্রলীগসহ সব ছাত্র সংগঠনের জন্য ক্যাম্পাসে সংগঠন পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা কঠোরভাবে কার্যকর করলে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানোত্তর পরিস্থিতিতে ছাত্র আন্দোলনে হয়তোবা এক নতুন সুস্থ ধারার সৃষ্টি হতে পারত। যিনি বা যাঁরাই নিয়ম ভঙ্গ করবেন, বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাঁকে বা তাঁদের প্রশাসনিক নিয়মে বেঁধে ফেলবে, আইনের আওতায় নিয়ে আসবে—নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে এ ধরনের কঠোরতা প্রয়োগ করলে ছাত্রসংগঠনগুলোও বর্তমান সময়ের দাবির সঙ্গে মিলিয়ে নিজ নিজ সংগঠনে প্রয়োজনীয় সংস্কার করত।
তা না করে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের লাখ লাখ কর্মীর জন্য সুযোগ রেখে দিল আইনি-বেআইনি নানা পন্থায় প্রচলিত ধারাতেই অগ্রসর হওয়ার এবং নিষিদ্ধঘোষিত হওয়ায় তাদের মধ্যে একধরনের প্রতিরোধ ও প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করবে, যার নেতিবাচক প্রভাব ছাত্র আন্দোলনে পড়তে পারে।
অন্যদিকে অপরাধীদের বিচারের নামে যে পদ্ধতিতে মামলা হচ্ছে, মামলা হওয়ার পর বাদী সাংবাদিকদের বলছেন, আসামির নামও ইতিপূর্বে শোনেননি, শুধু একটি কাগজে সই দিয়েছেন—ফলে মানুষ আর সুষ্ঠু বিচারও আসা করতে পারছেন না।
ক্যাম্পাসে আজ ছাত্রলীগ নেই। কিন্তু কেন জানি অনেক কিছুই আগের স্টাইলে চলছে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্ররা ক্লাসরুমে ফিরে গেছেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের’ ছাত্রনেতারা আগের মতোই একাধিপত্য কায়েম করে নানা রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে একতরফা কর্মসূচি পালন করে চলেছেন। তাঁরা যুক্তি উপস্থাপন করছেন ছাত্র ঐক্য দৃশ্যমান রাখার স্বার্থে ক্যাম্পাসে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের আপাতত পৃথকভাবে সক্রিয় কর্মসূচি নেওয়া যাবে না। অথচ ওইসব ইস্যুতে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের রাজনৈতিক বক্তব্য (যাকে এখন সবাই বয়ান বলে) ভিন্ন। আর একতরফাভাবে উপস্থাপিত তাদের ‘বয়ান’-এ ভাষা প্রয়োগ, উপস্থাপন ভঙ্গি বা শারীরিক ভাষার সঙ্গে পতিত ছাত্রলীগ নেতাদের (যারা ফ্যাসিবাদী) অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
ছাত্রলীগ বিদায় হয়েছে, কিন্তু তার বিপজ্জনক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা কি উৎসর্গ করে গিয়েছে বিজয়ী ছাত্রনেতাদের জন্য!
এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন স্বৈরাচার, স্বেচ্ছাচার, দমন-পীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে নিঃশঙ্ক চিত্তে যে রাজপথে নেমে এল তার একটি প্রধান কারণ ছিল, তারা মনে করেছিল এই আন্দোলনে তথাকথিত রাজনীতি নেই, কোনো রাজনৈতিক দলের খবরদারি বা স্বার্থান্বেষী ইন্ধন নেই। কিন্তু আজ যদি তারা দেখে ছাত্ররাজনীতির মধ্যে ‘পলিটিকস’ (politics) ঢুকে গিয়েছে, নতুন ছাত্রনেতারা বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন, তাহলে অচিরেই তাঁরা ছাত্রসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।
দেশে কোন কোন দল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে, কোন কোন দল নিষিদ্ধ হবে, এ সিদ্ধান্ত যদি নতুন ছাত্রনেতারা নিতে চান, তা হবে তাঁদের জন্য আত্মঘাতী। তা হবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সারবত্তাকে ধ্বংস করে বৈষম্যের বাংলাদেশ গড়ে তোলার এক ফ্যাসিবাদী প্রয়াস। অথচ তাঁরা বলেছিলেন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তাঁরা ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে বৈষম্যমুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দায় ও দরদের সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। তা থেকে বিচ্যুতি নতুন করে বিভাজন ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিপদ সৃষ্টি করছে। মনে রাখতে হবে, আন্দোলন হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য, গণতন্ত্র হরণ করার জন্য নয়।
ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের অনুরোধ করব, স্বৈরাচার পতনের পরে দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের স্বার্থে একটু থেমে, কিছুটা পর্যালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণ করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করুন। নতুন করে দেশের বুকে আরও বড় ফ্যাসিবাদের বিপদ ডেকে আনবেন না। সবারই এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ কিন্তু জোয়ার-ভাটার দেশ! বিশ্বাসীদের আরও বেশি করে মনে রাখা প্রয়োজন, সীমা লঙ্ঘনকারীকে সৃষ্টিকর্তাও পছন্দ করেন না।
লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২৩ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তাদের নেতা-কর্মীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে অসংখ্য আন্দোলনকারীকে হত্যা এবং অনেকের জীবন বিপন্ন করেন।
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, টেন্ডারবাজি, যৌন নির্যাতন ইত্যাদি। গত ১০-১৫ বছরে গণরুমকেন্দ্রিক এবং ছাত্রলীগের সভা-সমাবেশ-মিছিলে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণের মতো নিপীড়নের শিকার হয়েছেন সারা দেশের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী।
এখন প্রশ্ন, এই সংগঠনের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচিতে কি এসব অপকাণ্ডের কথা লিপিবদ্ধ আছে? যদি না থাকে, তাহলে এসব ‘মহান’ কর্তব্য যাঁরা পালন করেছেন তাঁদের আইন ও শাস্তির আওতায় আনা যেতে পারে, সংগঠন কেন নিষিদ্ধ হবে? সংগঠনের ‘ঘোষণাপত্রে’ তো এ ধরনের কর্মসূচি নেই।
আমার তো মনে হয় এসব অপরাধের জন্য সবার আগে বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন বিগত সময়কালের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনকেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স’ দ্বারা পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যথেষ্ট ক্ষমতা ও স্বাধীনতা থাকলেও দলকানা ভিসি ও প্রশাসন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ছাত্রবিরোধী এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কখনোই কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং নীরব সমর্থন জানিয়ে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের চেয়েও বেশি অপরাধ করেছে।
দীর্ঘ ৭৫ বছরের অধিককাল যাবৎ ছাত্রলীগ সংগঠনটি পূর্ব বাংলা ও স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল। ভাষা সংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলন, আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং স্বাধীন দেশেও সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এসব সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের অসংখ্য কর্মী আত্মাহুতি দিয়েছেন, কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। ছাত্রলীগ সংগঠনটির অনেক গৌরবের ইতিহাস রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী সারজিস আলমসহ আন্দোলনের অনেকেই নাকি ছাত্রলীগ করতেন।
জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সিপাহসালার নিজেই জানিয়েছেন একসময় তিনি ছাত্রলীগ করতেন। এমনকি ছাত্রলীগের র্যাডিক্যাল অংশ জাসদ ছাত্রলীগও তিনি ছাত্রজীবনে করেছেন। ছাত্রলীগ পচা-গলা জিনিস হলে সারজিস আলম বা জামায়াতের সিপাহসালার কি ওই সংগঠন করতেন! তবে স্বাধীনতার পরে দেশ গঠনের কাজে ছাত্রলীগ যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল, খুনখারাবিসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিল। যখনই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছে (১৯৯৬-২০০১) বিশেষত বিগত ১০-১৫ বছর ছাত্রলীগ নেতৃত্বের আচরণ ও কর্মকাণ্ড ছিল বেপরোয়া, সংগঠনের ঘোষিত আদর্শের বিরোধী। বিনা ভোটে, রাতের ভোটে, ডামি ভোটে রাষ্ট্রক্ষমতা আগলে রাখা যায় এবং রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করে যেকোনো বিরোধী আন্দোলন দমিয়ে রাখা যায়—এটা দেখে তাঁরা হয়ে ওঠেন আরও দুর্বিনীত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনির ভূমিকা নেওয়ার আগে বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ড, পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড সমাজে ছাত্রলীগ সম্পর্কে যে ঘৃণার সৃষ্টি করেছিল তা ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অনুধাবন করতে পারেননি। ফলে এবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগও লাঠিসোঁটা, পিস্তল, বন্দুক নিয়ে নেমে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে হল ও ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলেই ক্যাম্পাসে জমিদারি প্রতিষ্ঠার উদাহরণ অতীতে ভিন্ন ছাত্রসংগঠনেরও আছে।
কিন্তু এবারের একনাগাড়ে ১৫ বছরের জমিদারি অন্য সময়ের তুলনায় আরও বীভৎস রূপ নিয়ে প্রকাশিত হয়। তার পরেও প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার যে কারণ,
সেই কারণ নির্মূল না করে নিষিদ্ধ ঘোষণায় কি এই সমস্যার সমাধান আসবে?
ছাত্রলীগের কয়েক লাখ কর্মী-সমর্থক রয়েছেন। এর মাঝে সারা দেশে কয়েক হাজার বা ১০-২০ হাজার নেতা-কর্মী এবারের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। তাঁদের বিচারের আওতায় এনে ছাত্রলীগসহ সব ছাত্র সংগঠনের জন্য ক্যাম্পাসে সংগঠন পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা কঠোরভাবে কার্যকর করলে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানোত্তর পরিস্থিতিতে ছাত্র আন্দোলনে হয়তোবা এক নতুন সুস্থ ধারার সৃষ্টি হতে পারত। যিনি বা যাঁরাই নিয়ম ভঙ্গ করবেন, বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাঁকে বা তাঁদের প্রশাসনিক নিয়মে বেঁধে ফেলবে, আইনের আওতায় নিয়ে আসবে—নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে এ ধরনের কঠোরতা প্রয়োগ করলে ছাত্রসংগঠনগুলোও বর্তমান সময়ের দাবির সঙ্গে মিলিয়ে নিজ নিজ সংগঠনে প্রয়োজনীয় সংস্কার করত।
তা না করে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের লাখ লাখ কর্মীর জন্য সুযোগ রেখে দিল আইনি-বেআইনি নানা পন্থায় প্রচলিত ধারাতেই অগ্রসর হওয়ার এবং নিষিদ্ধঘোষিত হওয়ায় তাদের মধ্যে একধরনের প্রতিরোধ ও প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করবে, যার নেতিবাচক প্রভাব ছাত্র আন্দোলনে পড়তে পারে।
অন্যদিকে অপরাধীদের বিচারের নামে যে পদ্ধতিতে মামলা হচ্ছে, মামলা হওয়ার পর বাদী সাংবাদিকদের বলছেন, আসামির নামও ইতিপূর্বে শোনেননি, শুধু একটি কাগজে সই দিয়েছেন—ফলে মানুষ আর সুষ্ঠু বিচারও আসা করতে পারছেন না।
ক্যাম্পাসে আজ ছাত্রলীগ নেই। কিন্তু কেন জানি অনেক কিছুই আগের স্টাইলে চলছে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্ররা ক্লাসরুমে ফিরে গেছেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের’ ছাত্রনেতারা আগের মতোই একাধিপত্য কায়েম করে নানা রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে একতরফা কর্মসূচি পালন করে চলেছেন। তাঁরা যুক্তি উপস্থাপন করছেন ছাত্র ঐক্য দৃশ্যমান রাখার স্বার্থে ক্যাম্পাসে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের আপাতত পৃথকভাবে সক্রিয় কর্মসূচি নেওয়া যাবে না। অথচ ওইসব ইস্যুতে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের রাজনৈতিক বক্তব্য (যাকে এখন সবাই বয়ান বলে) ভিন্ন। আর একতরফাভাবে উপস্থাপিত তাদের ‘বয়ান’-এ ভাষা প্রয়োগ, উপস্থাপন ভঙ্গি বা শারীরিক ভাষার সঙ্গে পতিত ছাত্রলীগ নেতাদের (যারা ফ্যাসিবাদী) অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
ছাত্রলীগ বিদায় হয়েছে, কিন্তু তার বিপজ্জনক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা কি উৎসর্গ করে গিয়েছে বিজয়ী ছাত্রনেতাদের জন্য!
এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন স্বৈরাচার, স্বেচ্ছাচার, দমন-পীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে নিঃশঙ্ক চিত্তে যে রাজপথে নেমে এল তার একটি প্রধান কারণ ছিল, তারা মনে করেছিল এই আন্দোলনে তথাকথিত রাজনীতি নেই, কোনো রাজনৈতিক দলের খবরদারি বা স্বার্থান্বেষী ইন্ধন নেই। কিন্তু আজ যদি তারা দেখে ছাত্ররাজনীতির মধ্যে ‘পলিটিকস’ (politics) ঢুকে গিয়েছে, নতুন ছাত্রনেতারা বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন, তাহলে অচিরেই তাঁরা ছাত্রসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।
দেশে কোন কোন দল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে, কোন কোন দল নিষিদ্ধ হবে, এ সিদ্ধান্ত যদি নতুন ছাত্রনেতারা নিতে চান, তা হবে তাঁদের জন্য আত্মঘাতী। তা হবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সারবত্তাকে ধ্বংস করে বৈষম্যের বাংলাদেশ গড়ে তোলার এক ফ্যাসিবাদী প্রয়াস। অথচ তাঁরা বলেছিলেন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তাঁরা ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে বৈষম্যমুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দায় ও দরদের সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। তা থেকে বিচ্যুতি নতুন করে বিভাজন ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিপদ সৃষ্টি করছে। মনে রাখতে হবে, আন্দোলন হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য, গণতন্ত্র হরণ করার জন্য নয়।
ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের অনুরোধ করব, স্বৈরাচার পতনের পরে দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের স্বার্থে একটু থেমে, কিছুটা পর্যালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণ করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করুন। নতুন করে দেশের বুকে আরও বড় ফ্যাসিবাদের বিপদ ডেকে আনবেন না। সবারই এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ কিন্তু জোয়ার-ভাটার দেশ! বিশ্বাসীদের আরও বেশি করে মনে রাখা প্রয়োজন, সীমা লঙ্ঘনকারীকে সৃষ্টিকর্তাও পছন্দ করেন না।
লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
৬ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
৬ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
৬ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
৬ ঘণ্টা আগে