উপসম্পাদকীয়
মাসিদের যে দরদ থাকতে নেই তা নয়। দরদ তাঁদের থাকে, তাঁরা এমনকি কান্নাকাটিও করেন। তবে মায়ের মতো না; মায়ের কান্নাকাটিটাই খাঁটি বস্তু। মা কিন্তু অনেক সময় কাঁদতেও পারেন না; শোক অল্প হলে কাতর থাকেন, বেশি হলে পাথর বনে যান। ওই জ্ঞান থেকেই, মাসিরা কান্নাকাটি করলে মায়েদের মনে সন্দেহ দেখা দেয় যে মাসিরা হয়তো ভান করছেন।
মতলব আছে লোক-ঠকানোর। ব্যাপারটা সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি—সবখানেই ঘটে। রাষ্ট্রের যাঁরা কর্তা, যাঁদের আমরা সরকার বলে চিনি, সমালোচনা শুনলেই তাঁরা চটে লাল হন, ভাবেন তাঁরা রাষ্ট্রকে কত কষ্টে যত্ন-আত্তি করছেন, মায়া করছেন, রাষ্ট্রের ভালো-মন্দ তাঁদের মতো আর কে বোঝে? সেখানে অতিরিক্ত উৎপাত কেন? মাসিদের কেন আনাগোনা? মাসিদের ব্যাপারে মায়েদের এই ব্যবহার পুরোনো ব্যাপার। হালে দেখা যাচ্ছে, তৈরি পোশাক কারখানার মালিকেরাও এ রকমই করছেন।
পোশাকশ্রমিকেরা যে মজুরি পান তা যৎসামান্য এবং তাঁদের শ্রমের ওপরই যে ওই শিল্পের বিশ্ব বাজারটা টিকে রয়েছে, সেই সত্যটা সাধারণত প্রকাশ পায় না। শ্রমিকেরা দাবি করেছেন, তাঁদের ন্যূনতম মজুরি হওয়া চাই মাসে ২৫ হাজার টাকা। এটা কোনো মামাবাড়ির আবদার নয়। ভারতে শ্রমিকদের দাবি, মজুরি দিতে হবে মাসে ১৮ হাজার রুপি; বাংলাদেশের হিসাবে সেটা দাঁড়ায় ২৬ হাজার টাকা। বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অর্থনৈতিক গবেষকেরাও হিসাব করে দেখিয়েছেন যে শ্রমিকদের মানবোচিত জীবনধারণে কমপক্ষে ২৬ হাজারই দরকার, তার কমে চলে না।
বাংলাদেশের শ্রমিকেরা ২৬ হাজার চাননি, চেয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। তাঁদের দাবির সমর্থনে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংগঠনগুলো একটি কনভেনশন করেছে, তাতে সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নাগরিক সমাজেরও কেউ কেউ উপস্থিত ছিলেন। কনভেনশনের খবর তেমন একটা প্রচার পায়নি। প্রচার না পাওয়াটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ পোশাকশিল্পের মালিক, মিডিয়ার মালিক এবং রাষ্ট্রের মালিক সবাই এক ও অভিন্ন পক্ষ—তারা মালিকপক্ষ। পরস্পরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়; একে অপরের মাসতুতো ভাই-ই, যথার্থরূপে। মালিকদের দাবি যে শিল্পটিকে তাঁরা সন্তানের মতো লালনপালন করে থাকেন, সেখানে বাগড়া দেন শ্রমিকেরা, আবার তার সঙ্গে এসে জুটেছেন তথাকথিত নাগরিক সমাজের মাসিরা। এই মাসিদের নিশ্চয়ই মতলব আছে, হয়তো শিল্পের ধ্বংসই তাঁরা চান। বিদেশিদের এজেন্ট হওয়া বিচিত্র নয়।
‘মাসি’ কথাটা আমাদের বানানো নয়; ওই কনভেনশনের পরে মালিকেরা একটি পাল্টা সভা করেছেন এবং সেখানে তাঁরা বলেছেন যে তাঁদের অতিযত্নে প্রতিষ্ঠিত, আদরে লালিত-পালিত, প্রাণের চেয়েও প্রিয় শিল্প সম্পর্কে যাঁরা কোনো জ্ঞানই রাখেন না, সেই মাসিরা এখন দরদ দেখাচ্ছেন। হ্যাঁ, এটা তো ঠিকই যে সাধারণ নাগরিক এবং শ্রমিকেরাও ওই শিল্পের আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে অজ্ঞ; কিন্তু এটা তো সবাই জানে যে ওই শিল্প থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়, সেটাই দেশের উন্নতির প্রধান ভরসা এবং বাংলাদেশের জামাকাপড়ের যে বিদেশি বাজারে ভালো চাহিদা রয়েছে তার কারণ বাংলাদেশের প্রতি বিদেশিদের ভালোবাসা নয়, কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের সস্তা শ্রম। এত সস্তায় এমন শ্রম দুনিয়ার অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না।
আর এই শ্রমিকদের অধিকাংশই হচ্ছেন নিরুপায় নারী, যাঁরা কারখানায় আসেন বেঁচে থাকার অন্য কোনো উপায় নেই বলেই। আর এই নারীরা যে কেবল দেশের কারখানাতেই যান তা নয়, সৌদি আরবে পর্যন্ত চলে যান, এমনই তাঁরা দুঃসাহসী ও কর্মঠ। সৌদি আরবে তাঁরা পবিত্র হজের জন্য যান না, জীবিকার খোঁজে যান। সেখানে গিয়ে কী ধরনের নির্যাতনের শিকার হন তার বিবরণ তাঁরা দিতে পারেন না; ভাষার অভাবে এবং স্বাভাবিক লজ্জায়। সৌদির মালিকেরা তো বটেই, বাংলাদেশের দূতাবাসের লোকেরাও এই নারীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে কার্পণ্য করেন না।
অসহায় শ্রমিকদের পক্ষে বললে মালিকেরা যে রেগে যাবেন, সেটা তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কই রাষ্ট্রও তো শ্রমিকদের পক্ষে বলে না। বিদেশি ক্রেতাদের সমিতি তবু মাঝেমধ্যে চক্ষুলজ্জায় পড়ে, তারা বলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা দাও, কাজের পরিবেশ কিছুটা উন্নত করো; জিজ্ঞেস করে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার আছে কি না। রাষ্ট্র নির্বিকার। অথচ বাংলাদেশ যে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে
তো সাধারণ মানুষের প্রাণদানের বিনিময়েই, যাঁদের ভেতর অধিকাংশই ছিলেন কৃষক ও শ্রমিক। তাঁরাই শহীদ হয়েছেন, তাঁদের ঘরের নারীরাই লাঞ্ছিত হয়েছেন সবার আগে। সেই মেহনতি মানুষ যখন তাঁদের বাঁচার অধিকারের কথা বলেন, তখন রাষ্ট্র ও মালিক সবাই তাঁদের ওপর খেপে যান, সবাই একত্র হয়ে তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। যেন চরম শত্রুর মোকাবিলা করছেন। মা বলে যাঁরা নিজেদের দাবি করেন, তাঁদের তখন মা তো নয়ই, মাসি বলেও মনে হয় না।
রাষ্ট্রীয় কর্তাদের শাসনে দেশের মানুষ যে ভালো নেই তা বলার অপেক্ষা আগেও রাখত না, বর্তমানে আরও বেশি পরিমাণে রাখে না। মেহনতি মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানার মালিকদের আয়ের যেকোনো রকমের তুলনাই জানিয়ে দেবে মেহনতিদের দশাটা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে; ধরিয়ে দেবে বিজ্ঞাপিত উন্নতির আসল রহস্যটা। অনুৎপাদক খাতের লোকদের আয়ের সঙ্গে উৎপাদক খাতের মেহনতিদের তুলনাটাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সামরিক ও অসামরিক আমলাতন্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে মেহনতি মানুষের আয়-ব্যয়ের তুলনা করুন, পরিষ্কার ধরা পড়বে রাষ্ট্রের পক্ষপাত কোন দিকে এবং কেন। ধরা পড়বে উন্নতি কোন দিকে ঘটছে এবং কীভাবে ঘটছে।
ঢাকা শহর এখন পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহরে পরিণত হয়েছে। ঢাকার নিচে আছে আর একটি মাত্র শহর, সেটি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। সিরিয়ায় যুদ্ধ চলেছে, তাই দামেস্কের ওই দশা। কিন্তু বাংলাদেশে তো কোনো যুদ্ধ নেই, তাহলে বাংলাদেশের রাজধানীর কেন এই দুর্দশা? হ্যাঁ, যুদ্ধ একটা অবশ্যই আছে, যুদ্ধ চলছে এই বাংলাদেশেও; সেটা দরিদ্রের সঙ্গে ধনীর যুদ্ধ। তার নাম শ্রেণিযুদ্ধ। আমরা ওই যুদ্ধের খবর রাখি না, খবর রাখতে চাইও না, রাখলে বুঝতাম ঢাকা কেন এতটা নিচে নেমে গেল। উন্নতি? হ্যাঁ, হচ্ছে, অবশ্যই উন্নতি হচ্ছে। উন্নতির দৃশ্য ও গল্প তো কোনো নতুন ব্যাপার নয়।
উন্নতি ব্রিটিশ শাসনে হয়েছে, পাকিস্তান আমলেও কম হয়নি। ব্রিটিশরা তো বলতেই পারে যে তারা আমাদের জন্য রেলের গাড়ি, টেলিগ্রাফের সংযোগ, স্টিমারে যাতায়াত, এসবের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, শিল্প-কারখানা তৈরি করেছে, ইংরেজি ভাষা শিখিয়েছে এবং চা কীভাবে খেতে হয়, সেটা পর্যন্ত হাতে ধরে দেখিয়ে দিয়েছে। আর আইয়ুব খান তো ১০ বছর ধরে মনের সুখে উন্নতির গান গাইতে গাইতে রাজত্ব করে গেছেন, উন্নয়নের দশক পালন শেষে সবচেয়ে সুন্দর গানটি গাইবার সময়েই তাঁর পতন ঘটল। কারণ ওই সব উন্নতি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম না। উন্নতির ওই দাতাদের আমরা মেরে-ধরে বিদায় করেছি। কারণ? কারণ হলো উন্নতিটা ছিল পুঁজিবাদী ধরনের, তাতে উন্নতির সঙ্গে সমানতালে বাড়ছিল বৈষম্য ও বঞ্চনা, দেশের সম্পদ চলে যাচ্ছিল বিদেশে।
এখনকার উন্নতিরও তো ওই একই দশা। উন্নতি অল্প কিছু মানুষের, যারা চেপে বসে আছে বাদবাকিদের ঘাড়ের ওপর, আর উন্নতির সব রসদ জোগাচ্ছে ওই বাদবাকিরাই। এই উন্নতরা উন্নতি করেছে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে। অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর খবরটা বেরিয়েছে যে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের ধনীরা যে গতিতে ও যে হারে উন্নতি করেছেন, তার তুলনা সারা বিশ্বের কোথাও নেই। উন্নতির উন্মাদনায় অধুনা চীন ছুটছে বুলেটের গতিতে। কিন্তু উন্নতির দৌড়ে বাংলাদেশের ধনীরা চীনের ধনীদের পেছনে এবং লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন। প্রতিযোগিতায় প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের ধনীরা হার মেনেছেন। রণে ভঙ্গ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ধনীরাও। এই উন্নতির অবিশ্বাস্য গতির উল্টো পিঠে লেখা রয়েছে মানুষের দুর্দশা, শঙ্কা ও কান্না। মায়ের আসল কান্না, মাসি বা মাসতুতো ভাইদের মায়াকান্না নয়।
উন্নতি কাদের শ্রমে ও ঘামে সম্ভব হচ্ছে তা-ও আমরা জানি। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ছোট্ট একটি কবিতা লিখেছিলেন ‘কুলি-মজুর’ নামে। ওই কবিতায় পুঁজিবাদী উন্নতির ভেতরকার খবরটা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি। ওটি লেখা হয়েছিল আজ থেকে ১১০ বছর আগে। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন রাজপথের মোটর, সাগরের জাহাজ, রেললাইনের রেলগাড়ি, জমিতে অট্টালিকা, এসব কাদের দান, এগুলো কার খুনে রাঙা? জবাবটা তাঁর ওই প্রশ্নের ভেতরেই বসে আছে। সব উন্নতিই শ্রমিকের শ্রম দিয়ে তৈরি, উন্নতি মাত্রেই শ্রমিকের খুনে রাঙা। বিনিময়ে শ্রমিক কী পেয়েছেন? বেতন? কত টাকা? নজরুলের ভাষায়, ‘বেতন দিয়াছ? চুপ্ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!/ কত পাই দিয়ে কুলিরে তুই কত ক্রোর পেলি বল্?’
মাসিদের যে দরদ থাকতে নেই তা নয়। দরদ তাঁদের থাকে, তাঁরা এমনকি কান্নাকাটিও করেন। তবে মায়ের মতো না; মায়ের কান্নাকাটিটাই খাঁটি বস্তু। মা কিন্তু অনেক সময় কাঁদতেও পারেন না; শোক অল্প হলে কাতর থাকেন, বেশি হলে পাথর বনে যান। ওই জ্ঞান থেকেই, মাসিরা কান্নাকাটি করলে মায়েদের মনে সন্দেহ দেখা দেয় যে মাসিরা হয়তো ভান করছেন।
মতলব আছে লোক-ঠকানোর। ব্যাপারটা সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি—সবখানেই ঘটে। রাষ্ট্রের যাঁরা কর্তা, যাঁদের আমরা সরকার বলে চিনি, সমালোচনা শুনলেই তাঁরা চটে লাল হন, ভাবেন তাঁরা রাষ্ট্রকে কত কষ্টে যত্ন-আত্তি করছেন, মায়া করছেন, রাষ্ট্রের ভালো-মন্দ তাঁদের মতো আর কে বোঝে? সেখানে অতিরিক্ত উৎপাত কেন? মাসিদের কেন আনাগোনা? মাসিদের ব্যাপারে মায়েদের এই ব্যবহার পুরোনো ব্যাপার। হালে দেখা যাচ্ছে, তৈরি পোশাক কারখানার মালিকেরাও এ রকমই করছেন।
পোশাকশ্রমিকেরা যে মজুরি পান তা যৎসামান্য এবং তাঁদের শ্রমের ওপরই যে ওই শিল্পের বিশ্ব বাজারটা টিকে রয়েছে, সেই সত্যটা সাধারণত প্রকাশ পায় না। শ্রমিকেরা দাবি করেছেন, তাঁদের ন্যূনতম মজুরি হওয়া চাই মাসে ২৫ হাজার টাকা। এটা কোনো মামাবাড়ির আবদার নয়। ভারতে শ্রমিকদের দাবি, মজুরি দিতে হবে মাসে ১৮ হাজার রুপি; বাংলাদেশের হিসাবে সেটা দাঁড়ায় ২৬ হাজার টাকা। বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অর্থনৈতিক গবেষকেরাও হিসাব করে দেখিয়েছেন যে শ্রমিকদের মানবোচিত জীবনধারণে কমপক্ষে ২৬ হাজারই দরকার, তার কমে চলে না।
বাংলাদেশের শ্রমিকেরা ২৬ হাজার চাননি, চেয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। তাঁদের দাবির সমর্থনে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংগঠনগুলো একটি কনভেনশন করেছে, তাতে সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নাগরিক সমাজেরও কেউ কেউ উপস্থিত ছিলেন। কনভেনশনের খবর তেমন একটা প্রচার পায়নি। প্রচার না পাওয়াটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ পোশাকশিল্পের মালিক, মিডিয়ার মালিক এবং রাষ্ট্রের মালিক সবাই এক ও অভিন্ন পক্ষ—তারা মালিকপক্ষ। পরস্পরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়; একে অপরের মাসতুতো ভাই-ই, যথার্থরূপে। মালিকদের দাবি যে শিল্পটিকে তাঁরা সন্তানের মতো লালনপালন করে থাকেন, সেখানে বাগড়া দেন শ্রমিকেরা, আবার তার সঙ্গে এসে জুটেছেন তথাকথিত নাগরিক সমাজের মাসিরা। এই মাসিদের নিশ্চয়ই মতলব আছে, হয়তো শিল্পের ধ্বংসই তাঁরা চান। বিদেশিদের এজেন্ট হওয়া বিচিত্র নয়।
‘মাসি’ কথাটা আমাদের বানানো নয়; ওই কনভেনশনের পরে মালিকেরা একটি পাল্টা সভা করেছেন এবং সেখানে তাঁরা বলেছেন যে তাঁদের অতিযত্নে প্রতিষ্ঠিত, আদরে লালিত-পালিত, প্রাণের চেয়েও প্রিয় শিল্প সম্পর্কে যাঁরা কোনো জ্ঞানই রাখেন না, সেই মাসিরা এখন দরদ দেখাচ্ছেন। হ্যাঁ, এটা তো ঠিকই যে সাধারণ নাগরিক এবং শ্রমিকেরাও ওই শিল্পের আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে অজ্ঞ; কিন্তু এটা তো সবাই জানে যে ওই শিল্প থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়, সেটাই দেশের উন্নতির প্রধান ভরসা এবং বাংলাদেশের জামাকাপড়ের যে বিদেশি বাজারে ভালো চাহিদা রয়েছে তার কারণ বাংলাদেশের প্রতি বিদেশিদের ভালোবাসা নয়, কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের সস্তা শ্রম। এত সস্তায় এমন শ্রম দুনিয়ার অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না।
আর এই শ্রমিকদের অধিকাংশই হচ্ছেন নিরুপায় নারী, যাঁরা কারখানায় আসেন বেঁচে থাকার অন্য কোনো উপায় নেই বলেই। আর এই নারীরা যে কেবল দেশের কারখানাতেই যান তা নয়, সৌদি আরবে পর্যন্ত চলে যান, এমনই তাঁরা দুঃসাহসী ও কর্মঠ। সৌদি আরবে তাঁরা পবিত্র হজের জন্য যান না, জীবিকার খোঁজে যান। সেখানে গিয়ে কী ধরনের নির্যাতনের শিকার হন তার বিবরণ তাঁরা দিতে পারেন না; ভাষার অভাবে এবং স্বাভাবিক লজ্জায়। সৌদির মালিকেরা তো বটেই, বাংলাদেশের দূতাবাসের লোকেরাও এই নারীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে কার্পণ্য করেন না।
অসহায় শ্রমিকদের পক্ষে বললে মালিকেরা যে রেগে যাবেন, সেটা তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কই রাষ্ট্রও তো শ্রমিকদের পক্ষে বলে না। বিদেশি ক্রেতাদের সমিতি তবু মাঝেমধ্যে চক্ষুলজ্জায় পড়ে, তারা বলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা দাও, কাজের পরিবেশ কিছুটা উন্নত করো; জিজ্ঞেস করে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার আছে কি না। রাষ্ট্র নির্বিকার। অথচ বাংলাদেশ যে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে
তো সাধারণ মানুষের প্রাণদানের বিনিময়েই, যাঁদের ভেতর অধিকাংশই ছিলেন কৃষক ও শ্রমিক। তাঁরাই শহীদ হয়েছেন, তাঁদের ঘরের নারীরাই লাঞ্ছিত হয়েছেন সবার আগে। সেই মেহনতি মানুষ যখন তাঁদের বাঁচার অধিকারের কথা বলেন, তখন রাষ্ট্র ও মালিক সবাই তাঁদের ওপর খেপে যান, সবাই একত্র হয়ে তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। যেন চরম শত্রুর মোকাবিলা করছেন। মা বলে যাঁরা নিজেদের দাবি করেন, তাঁদের তখন মা তো নয়ই, মাসি বলেও মনে হয় না।
রাষ্ট্রীয় কর্তাদের শাসনে দেশের মানুষ যে ভালো নেই তা বলার অপেক্ষা আগেও রাখত না, বর্তমানে আরও বেশি পরিমাণে রাখে না। মেহনতি মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানার মালিকদের আয়ের যেকোনো রকমের তুলনাই জানিয়ে দেবে মেহনতিদের দশাটা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে; ধরিয়ে দেবে বিজ্ঞাপিত উন্নতির আসল রহস্যটা। অনুৎপাদক খাতের লোকদের আয়ের সঙ্গে উৎপাদক খাতের মেহনতিদের তুলনাটাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সামরিক ও অসামরিক আমলাতন্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে মেহনতি মানুষের আয়-ব্যয়ের তুলনা করুন, পরিষ্কার ধরা পড়বে রাষ্ট্রের পক্ষপাত কোন দিকে এবং কেন। ধরা পড়বে উন্নতি কোন দিকে ঘটছে এবং কীভাবে ঘটছে।
ঢাকা শহর এখন পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহরে পরিণত হয়েছে। ঢাকার নিচে আছে আর একটি মাত্র শহর, সেটি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। সিরিয়ায় যুদ্ধ চলেছে, তাই দামেস্কের ওই দশা। কিন্তু বাংলাদেশে তো কোনো যুদ্ধ নেই, তাহলে বাংলাদেশের রাজধানীর কেন এই দুর্দশা? হ্যাঁ, যুদ্ধ একটা অবশ্যই আছে, যুদ্ধ চলছে এই বাংলাদেশেও; সেটা দরিদ্রের সঙ্গে ধনীর যুদ্ধ। তার নাম শ্রেণিযুদ্ধ। আমরা ওই যুদ্ধের খবর রাখি না, খবর রাখতে চাইও না, রাখলে বুঝতাম ঢাকা কেন এতটা নিচে নেমে গেল। উন্নতি? হ্যাঁ, হচ্ছে, অবশ্যই উন্নতি হচ্ছে। উন্নতির দৃশ্য ও গল্প তো কোনো নতুন ব্যাপার নয়।
উন্নতি ব্রিটিশ শাসনে হয়েছে, পাকিস্তান আমলেও কম হয়নি। ব্রিটিশরা তো বলতেই পারে যে তারা আমাদের জন্য রেলের গাড়ি, টেলিগ্রাফের সংযোগ, স্টিমারে যাতায়াত, এসবের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, শিল্প-কারখানা তৈরি করেছে, ইংরেজি ভাষা শিখিয়েছে এবং চা কীভাবে খেতে হয়, সেটা পর্যন্ত হাতে ধরে দেখিয়ে দিয়েছে। আর আইয়ুব খান তো ১০ বছর ধরে মনের সুখে উন্নতির গান গাইতে গাইতে রাজত্ব করে গেছেন, উন্নয়নের দশক পালন শেষে সবচেয়ে সুন্দর গানটি গাইবার সময়েই তাঁর পতন ঘটল। কারণ ওই সব উন্নতি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম না। উন্নতির ওই দাতাদের আমরা মেরে-ধরে বিদায় করেছি। কারণ? কারণ হলো উন্নতিটা ছিল পুঁজিবাদী ধরনের, তাতে উন্নতির সঙ্গে সমানতালে বাড়ছিল বৈষম্য ও বঞ্চনা, দেশের সম্পদ চলে যাচ্ছিল বিদেশে।
এখনকার উন্নতিরও তো ওই একই দশা। উন্নতি অল্প কিছু মানুষের, যারা চেপে বসে আছে বাদবাকিদের ঘাড়ের ওপর, আর উন্নতির সব রসদ জোগাচ্ছে ওই বাদবাকিরাই। এই উন্নতরা উন্নতি করেছে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে। অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর খবরটা বেরিয়েছে যে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের ধনীরা যে গতিতে ও যে হারে উন্নতি করেছেন, তার তুলনা সারা বিশ্বের কোথাও নেই। উন্নতির উন্মাদনায় অধুনা চীন ছুটছে বুলেটের গতিতে। কিন্তু উন্নতির দৌড়ে বাংলাদেশের ধনীরা চীনের ধনীদের পেছনে এবং লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন। প্রতিযোগিতায় প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের ধনীরা হার মেনেছেন। রণে ভঙ্গ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ধনীরাও। এই উন্নতির অবিশ্বাস্য গতির উল্টো পিঠে লেখা রয়েছে মানুষের দুর্দশা, শঙ্কা ও কান্না। মায়ের আসল কান্না, মাসি বা মাসতুতো ভাইদের মায়াকান্না নয়।
উন্নতি কাদের শ্রমে ও ঘামে সম্ভব হচ্ছে তা-ও আমরা জানি। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ছোট্ট একটি কবিতা লিখেছিলেন ‘কুলি-মজুর’ নামে। ওই কবিতায় পুঁজিবাদী উন্নতির ভেতরকার খবরটা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি। ওটি লেখা হয়েছিল আজ থেকে ১১০ বছর আগে। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন রাজপথের মোটর, সাগরের জাহাজ, রেললাইনের রেলগাড়ি, জমিতে অট্টালিকা, এসব কাদের দান, এগুলো কার খুনে রাঙা? জবাবটা তাঁর ওই প্রশ্নের ভেতরেই বসে আছে। সব উন্নতিই শ্রমিকের শ্রম দিয়ে তৈরি, উন্নতি মাত্রেই শ্রমিকের খুনে রাঙা। বিনিময়ে শ্রমিক কী পেয়েছেন? বেতন? কত টাকা? নজরুলের ভাষায়, ‘বেতন দিয়াছ? চুপ্ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!/ কত পাই দিয়ে কুলিরে তুই কত ক্রোর পেলি বল্?’
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
৫ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
৫ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
৫ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
৫ ঘণ্টা আগে