বিভুরঞ্জন সরকার
একাত্তরের মার্চ মাসের বিক্ষুব্ধ দিনগুলো, বিশেষ করে পয়লা মার্চের কথা আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে, আমৃত্যু থাকবে। তখন আমি দিনাজপুর সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। ২৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের কলেজছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন মনোনীত প্যানেল হেরে যায়। স্বভাবতই মন খারাপ। পরদিন সকালে বড় বন্দরের হিন্দু হোস্টেল থেকে বের হলাম কলেজে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সুইহারী মোড়ে এসে সিদ্ধান্ত বদলে কলেজে না গিয়ে ঢুকলাম চৌরঙ্গী সিনেমা হলে, মর্নিং শো দেখতে। কামাল ও নাসিমা খান অভিনীত 'রোড টু সোয়াত' নামের একটি উর্দু সিনেমা চলছিল। বেলা দেড়টা নাগাদ শো শেষে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি মিছিল।
কী ব্যাপার? হঠাৎ মিছিল কিসের, কেন?
প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো পরিচিত কাউকে না পেয়ে মিছিলে শামিল হলাম।
মিছিলে ধ্বনিত হচ্ছে নতুন স্লোগান।
‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘ইয়াহিয়ার মাথায় লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘ভুট্টোর মাথায় লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।
বুঝলাম, মারাত্মক কিছু ঘটেছে। তবে কী ঘটেছে, সেটা জানার জন্য আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। মিছিল সামনে অগ্রসর হচ্ছে আর তাতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। কাউকে ডাকতে হচ্ছে না। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিচ্ছে।
মিছিল গিয়ে জমায়েত হলো দিনাজপুর ইনস্টিটিউটের সামনের খোলা মাঠে। সেখানে গিয়ে জানলাম মিছিলের কারণ। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার প্রতিবাদে বাঙালি রাস্তায় নেমে এসেছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে যে ক্ষমতা ছাড়তে চায় না তা স্পষ্ট হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আনুষ্ঠানিকভাবে নির্দেশ দেওয়ার আগেই ইয়াহিয়ার ঘোষণা প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি রাস্তায় নেমে পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। অস্ত্র হাতে নেওয়ার স্লোগান উচ্চারিত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন করার কথা বলা হয়।
কী আশ্চর্য ঘটনা! কী করে মানুষ নেতার নির্দেশ ছাড়াই এভাবে পথে নামল! এ ঘটনা কেবল ঢাকায় ঘটেনি, ঘটেছিল সারা দেশে শহরে-বন্দরে-গ্রামে, একযোগে।
পাকিস্তানিদের মতলব ভালো না এটা বুঝতে সেদিন কারও অসুবিধা হয়নি। বাঙালি স্বাধীনতার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েই ছিল। মানুষকে প্রস্তুত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনসাধনার মাধ্যমে।
তাই ১ মার্চেই গর্জে উঠেছিল বিক্ষুব্ধ বাঙালি, কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত স্লোগান। সেদিনই এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে পাকিস্তানের কবরে অভ্যুদয় ঘটতে চলেছে এক স্বাধীন ভূখণ্ডের, নাম তার বাংলাদেশ।
মার্চ মাসের প্রথম দিন যা ছিল জনতার কণ্ঠে স্লোগানমাত্র, ডিসেম্বরের ষোলো তারিখ সেটিই বাস্তবে রূপ পেল। ভেতো বাঙালি ঠিকই অস্ত্র ধরল। লড়ল। মরল। মরার দেশে বরাভয় আনল এবং বাংলাদেশ স্বাধীন করল।
এবার দিন কয়েক আগে ‘রোড টু সোয়াত’ সিনেমা প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল সাংবাদিক বন্ধু মাহবুব কামালের সঙ্গে। তিনি বললেন তাঁর স্মৃতির কথা। মাহবুব কামালের বয়ান এমন: তারিখটা মনে নেই, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে এক সকালে বাবা (তিনি খুব রসিক ছিলেন) আমাকে ঘুম থেকে তুলে ইত্তেফাক পত্রিকাটি সামনে ধরে বললেন, দ্যাখ্, তোর মিতা কী বলেছে। এখানে মিতা মানে আমার বন্ধু বা বন্ধুস্থানীয় কেউ নন। তিনি হলেন তৎকালীন পাকিস্তানের চিত্রনায়ক কামাল। নামের মিলেই তিনি মিতা। কামাল দেখতে ছিলেন অনেকটা ভারতীয় নায়ক রাজ কাপুরের মতো।
যাই হোক, ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় খবরটি পড়ে যা জানলাম তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে এ রকম: ‘সত্তর সালের নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলসহ বেশ কিছু এলাকায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর পশ্চিম পাকিস্তানের চিত্রতারকারা সেই জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই উদ্যোগে অনেক নায়ক-নায়িকা, যেমন—মোহাম্মদ আলী, জেবা, শামীম আরা, সাবিহা, সন্তোষ সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু চিত্রনায়ক কামালের কাছে যখন টাকা চাওয়া হয়েছিল, তিনি টাকা না দিয়ে বলেছিলেন, বাঙাল মুল্লুকমে জো হুয়া, উসমে হামারা তো কোয়ি কসুর নেহি থা। অর্থাৎ, বাঙালদের দেশে যা ঘটেছে, সেখানে আমাদের তো কোনো দোষ নেই!
রিপোর্টটি পড়ার পর মাথা গরম হয়ে গেল। ছুটে গেলাম বন্ধু সালামের বাসায়। সালাম মানে আব্দুস সালাম। সে তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ফকিরেরপুল শাখার সাধারণ সম্পাদক আর আমি ছিলাম একই কমিটির সাহিত্য সম্পাদক। সালাম বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। যা হোক, সালামকে রিপোর্টটি দেখানোর পর সে ছাত্রলীগের ফকিরেরপুল শাখার জরুরি মিটিং ডাকার কথা বলল। আমরা সবাই একজোট হলাম।
তখন ফকিরেরপুলের কাছেই অবস্থিত জোনাকী সিনেমা হলে কামাল ও নাসিমা খান অভিনীত ‘রোড টু সোয়াত’ সিনেমাটি প্রদর্শিত হচ্ছিল। আমরা ঠিক করলাম, কামালের কোনো সিনেমা চলতে দেওয়া যাবে না। সালামের নেতৃত্বে সবাই মিলে জোনাকী সিনেমা হলে গিয়ে প্রথমে সিনেমাটির বিলবোর্ড, ব্যানার ভেঙে ফেললাম। এরপর সরাসরি ম্যানেজারের রুমে গিয়ে তাঁকে বললাম, এই ছবি আপনার হলে আর চলতে পারবে না। বন্ধ হয়ে গেল ‘রোড টু সোয়াত’-এর প্রদর্শনী। পরদিন ইত্তেফাকে ছাপা হলো এই খবর। এরপর সারা পূর্ব পাকিস্তানের সব সিনেমা হল থেকে নেমে গেল ‘রোড টু সোয়াত’। আসলে অসংখ্য ছোট ঘটনাই শেষ পর্যন্ত বড় আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।
মাহবুব কামালের এই কথা শুনে মনে পড়ল, ঠিকই তো, দিনাজপুর চৌরঙ্গী সিনেমা হলেও ‘রোড টু সোয়াত’ আর চলেনি।
মার্চ মাস এলে আমার ‘রোড টু সোয়াত’ সিনেমার কথা যেমন মনে পড়ে, তেমনি মনে পড়ে ‘এমভি সোয়াত’ নামে একটি জাহাজের কথা। বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা থেকে এই জাহাজে করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরে। ২৫ মার্চের আগে আগে এই খবর প্রচার হলে বিক্ষুব্ধ চট্টগ্রামবাসী এমভি সোয়াত থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাসে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।
এ সম্পর্কে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব ফারুক আজিজ খান তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘বসন্ত ১৯৭১ ’-এ লিখেছেন: ২৫ মার্চ রাতে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার আগে মেজর জিয়াউর রহমান তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে এই অস্ত্র খালাসের জন্য নিয়োজিত হয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকাসহ অন্যত্র সেনা অভিযানের খবর পেয়ে তিনি দ্রুত শহর ছেড়ে কক্সবাজারের দিকে অগ্রসর হন। যাত্রাপথে তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের কাছে সাময়িক শিবির গড়ে তোলেন।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী ও চট্টগ্রাম বেতারের কর্মীরা ভেবেছিলেন, কোনো সেনা কর্মকর্তা যদি রেডিওতে ঘোষণা দেন, তাহলে পাকিস্তানি আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা সহজ হবে। তাই তাঁরা মেজর জিয়াকে সেই ঘোষণা পাঠ করতে বলেন। ঘোষণাটি আগেই মুসাবিদা বা খসড়া করা হয়েছিল। জিয়া তাৎক্ষণিকভাবে তাতে রাজি হয়ে যান। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় এই লিখিত ঘোষণাপাঠ রেডিওতে সম্প্রচারিত হওয়ায় জিয়া রাতারাতি নায়ক হয়ে যান। কিন্তু এটা স্বৈরাচারি ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বড় ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। বিশ্বের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছিল যে এটা একটি সামরিক বিদ্রোহ। তাই ধারণ করা ঘোষণাটি কিছুটা সংশোধন করে পরদিন আবার সম্প্রচার করা হয়।
ফারুক আজিজ খান আরও লিখছেন: মেজর জিয়া ভারত সীমান্তের রামগড় শহরে এসে পৌঁছান ৩০ অথবা ৩১ মার্চ। রাঙামাটির পুলিশ সুপার বজলুর রহমানও আগরতলায় যাওয়ার জন্য রামগড়ে চলে যান ২৬ মার্চ। তিনি তাঁর বাহিনীকে পরিত্যাগ করে যান, যার মধ্যে ৫০০ জনের সশস্ত্র একটি দল ছিল। পাহাড় ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ রাঙামাটি, কাপ্তাই ও সংলগ্ন এলাকার জন্য এটা অত্যন্ত সহায়ক বাহিনী ছিল। আমরা যদি কয়েকটি পাহাড় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতাম, তাহলে গেরিলাযুদ্ধ চালানো অনেক সহজ হতো। সে ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ ভিন্ন একটি মাত্রা পেত।...দৃশ্যপট থেকে মেজর জিয়ার দ্রুত অন্তর্ধান লড়াইরত মানুষের নৈতিক মনোবল অনেকটাই দুর্বল করে দেয়। রেডিও ভাষণের মাধ্যমে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যে সাহস ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁর অন্তর্ধানে যেন অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স তৈরি হলো। অন্যদিকে বেতার ভাষণে জিয়ার নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা এবং নির্বিচারে অবাঙালি নিধনের ঘটনা আমাদের পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার তালিকায় একেবারে শীর্ষে নিয়ে গেল।
এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে যাওয়া, কালুরঘাট বেতার থেকে ঘোষণাপাঠ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেনাপ্রধান ওসমানীর সঙ্গে বিরোধ এবং পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতির প্রতি আনুকূল্য দেখিয়ে জিয়াউর রহমান বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। মার্চ মাস এলেই পুরোনো এসব কথা মনে পড়ে।
‘রোড টু সোয়াত’ সিনেমার নায়কের বাঙালিবিরোধী মনোভাবের কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে হলে সিনেমাটির প্রদর্শন বন্ধে নেতৃত্ব দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম এখন বিএনপির নেতা এবং এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে যাওয়া মেজর জিয়া সেই বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। ঘটনা দুটি কি কাকতালীয়?
জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
একাত্তরের মার্চ মাসের বিক্ষুব্ধ দিনগুলো, বিশেষ করে পয়লা মার্চের কথা আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে, আমৃত্যু থাকবে। তখন আমি দিনাজপুর সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। ২৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের কলেজছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন মনোনীত প্যানেল হেরে যায়। স্বভাবতই মন খারাপ। পরদিন সকালে বড় বন্দরের হিন্দু হোস্টেল থেকে বের হলাম কলেজে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সুইহারী মোড়ে এসে সিদ্ধান্ত বদলে কলেজে না গিয়ে ঢুকলাম চৌরঙ্গী সিনেমা হলে, মর্নিং শো দেখতে। কামাল ও নাসিমা খান অভিনীত 'রোড টু সোয়াত' নামের একটি উর্দু সিনেমা চলছিল। বেলা দেড়টা নাগাদ শো শেষে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি মিছিল।
কী ব্যাপার? হঠাৎ মিছিল কিসের, কেন?
প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো পরিচিত কাউকে না পেয়ে মিছিলে শামিল হলাম।
মিছিলে ধ্বনিত হচ্ছে নতুন স্লোগান।
‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘ইয়াহিয়ার মাথায় লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘ভুট্টোর মাথায় লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।
বুঝলাম, মারাত্মক কিছু ঘটেছে। তবে কী ঘটেছে, সেটা জানার জন্য আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। মিছিল সামনে অগ্রসর হচ্ছে আর তাতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। কাউকে ডাকতে হচ্ছে না। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিচ্ছে।
মিছিল গিয়ে জমায়েত হলো দিনাজপুর ইনস্টিটিউটের সামনের খোলা মাঠে। সেখানে গিয়ে জানলাম মিছিলের কারণ। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার প্রতিবাদে বাঙালি রাস্তায় নেমে এসেছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে যে ক্ষমতা ছাড়তে চায় না তা স্পষ্ট হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আনুষ্ঠানিকভাবে নির্দেশ দেওয়ার আগেই ইয়াহিয়ার ঘোষণা প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি রাস্তায় নেমে পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। অস্ত্র হাতে নেওয়ার স্লোগান উচ্চারিত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন করার কথা বলা হয়।
কী আশ্চর্য ঘটনা! কী করে মানুষ নেতার নির্দেশ ছাড়াই এভাবে পথে নামল! এ ঘটনা কেবল ঢাকায় ঘটেনি, ঘটেছিল সারা দেশে শহরে-বন্দরে-গ্রামে, একযোগে।
পাকিস্তানিদের মতলব ভালো না এটা বুঝতে সেদিন কারও অসুবিধা হয়নি। বাঙালি স্বাধীনতার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েই ছিল। মানুষকে প্রস্তুত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনসাধনার মাধ্যমে।
তাই ১ মার্চেই গর্জে উঠেছিল বিক্ষুব্ধ বাঙালি, কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত স্লোগান। সেদিনই এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে পাকিস্তানের কবরে অভ্যুদয় ঘটতে চলেছে এক স্বাধীন ভূখণ্ডের, নাম তার বাংলাদেশ।
মার্চ মাসের প্রথম দিন যা ছিল জনতার কণ্ঠে স্লোগানমাত্র, ডিসেম্বরের ষোলো তারিখ সেটিই বাস্তবে রূপ পেল। ভেতো বাঙালি ঠিকই অস্ত্র ধরল। লড়ল। মরল। মরার দেশে বরাভয় আনল এবং বাংলাদেশ স্বাধীন করল।
এবার দিন কয়েক আগে ‘রোড টু সোয়াত’ সিনেমা প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল সাংবাদিক বন্ধু মাহবুব কামালের সঙ্গে। তিনি বললেন তাঁর স্মৃতির কথা। মাহবুব কামালের বয়ান এমন: তারিখটা মনে নেই, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে এক সকালে বাবা (তিনি খুব রসিক ছিলেন) আমাকে ঘুম থেকে তুলে ইত্তেফাক পত্রিকাটি সামনে ধরে বললেন, দ্যাখ্, তোর মিতা কী বলেছে। এখানে মিতা মানে আমার বন্ধু বা বন্ধুস্থানীয় কেউ নন। তিনি হলেন তৎকালীন পাকিস্তানের চিত্রনায়ক কামাল। নামের মিলেই তিনি মিতা। কামাল দেখতে ছিলেন অনেকটা ভারতীয় নায়ক রাজ কাপুরের মতো।
যাই হোক, ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় খবরটি পড়ে যা জানলাম তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে এ রকম: ‘সত্তর সালের নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলসহ বেশ কিছু এলাকায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর পশ্চিম পাকিস্তানের চিত্রতারকারা সেই জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই উদ্যোগে অনেক নায়ক-নায়িকা, যেমন—মোহাম্মদ আলী, জেবা, শামীম আরা, সাবিহা, সন্তোষ সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু চিত্রনায়ক কামালের কাছে যখন টাকা চাওয়া হয়েছিল, তিনি টাকা না দিয়ে বলেছিলেন, বাঙাল মুল্লুকমে জো হুয়া, উসমে হামারা তো কোয়ি কসুর নেহি থা। অর্থাৎ, বাঙালদের দেশে যা ঘটেছে, সেখানে আমাদের তো কোনো দোষ নেই!
রিপোর্টটি পড়ার পর মাথা গরম হয়ে গেল। ছুটে গেলাম বন্ধু সালামের বাসায়। সালাম মানে আব্দুস সালাম। সে তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ফকিরেরপুল শাখার সাধারণ সম্পাদক আর আমি ছিলাম একই কমিটির সাহিত্য সম্পাদক। সালাম বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। যা হোক, সালামকে রিপোর্টটি দেখানোর পর সে ছাত্রলীগের ফকিরেরপুল শাখার জরুরি মিটিং ডাকার কথা বলল। আমরা সবাই একজোট হলাম।
তখন ফকিরেরপুলের কাছেই অবস্থিত জোনাকী সিনেমা হলে কামাল ও নাসিমা খান অভিনীত ‘রোড টু সোয়াত’ সিনেমাটি প্রদর্শিত হচ্ছিল। আমরা ঠিক করলাম, কামালের কোনো সিনেমা চলতে দেওয়া যাবে না। সালামের নেতৃত্বে সবাই মিলে জোনাকী সিনেমা হলে গিয়ে প্রথমে সিনেমাটির বিলবোর্ড, ব্যানার ভেঙে ফেললাম। এরপর সরাসরি ম্যানেজারের রুমে গিয়ে তাঁকে বললাম, এই ছবি আপনার হলে আর চলতে পারবে না। বন্ধ হয়ে গেল ‘রোড টু সোয়াত’-এর প্রদর্শনী। পরদিন ইত্তেফাকে ছাপা হলো এই খবর। এরপর সারা পূর্ব পাকিস্তানের সব সিনেমা হল থেকে নেমে গেল ‘রোড টু সোয়াত’। আসলে অসংখ্য ছোট ঘটনাই শেষ পর্যন্ত বড় আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।
মাহবুব কামালের এই কথা শুনে মনে পড়ল, ঠিকই তো, দিনাজপুর চৌরঙ্গী সিনেমা হলেও ‘রোড টু সোয়াত’ আর চলেনি।
মার্চ মাস এলে আমার ‘রোড টু সোয়াত’ সিনেমার কথা যেমন মনে পড়ে, তেমনি মনে পড়ে ‘এমভি সোয়াত’ নামে একটি জাহাজের কথা। বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা থেকে এই জাহাজে করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরে। ২৫ মার্চের আগে আগে এই খবর প্রচার হলে বিক্ষুব্ধ চট্টগ্রামবাসী এমভি সোয়াত থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাসে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।
এ সম্পর্কে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব ফারুক আজিজ খান তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘বসন্ত ১৯৭১ ’-এ লিখেছেন: ২৫ মার্চ রাতে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার আগে মেজর জিয়াউর রহমান তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে এই অস্ত্র খালাসের জন্য নিয়োজিত হয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকাসহ অন্যত্র সেনা অভিযানের খবর পেয়ে তিনি দ্রুত শহর ছেড়ে কক্সবাজারের দিকে অগ্রসর হন। যাত্রাপথে তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের কাছে সাময়িক শিবির গড়ে তোলেন।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী ও চট্টগ্রাম বেতারের কর্মীরা ভেবেছিলেন, কোনো সেনা কর্মকর্তা যদি রেডিওতে ঘোষণা দেন, তাহলে পাকিস্তানি আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা সহজ হবে। তাই তাঁরা মেজর জিয়াকে সেই ঘোষণা পাঠ করতে বলেন। ঘোষণাটি আগেই মুসাবিদা বা খসড়া করা হয়েছিল। জিয়া তাৎক্ষণিকভাবে তাতে রাজি হয়ে যান। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় এই লিখিত ঘোষণাপাঠ রেডিওতে সম্প্রচারিত হওয়ায় জিয়া রাতারাতি নায়ক হয়ে যান। কিন্তু এটা স্বৈরাচারি ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বড় ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। বিশ্বের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছিল যে এটা একটি সামরিক বিদ্রোহ। তাই ধারণ করা ঘোষণাটি কিছুটা সংশোধন করে পরদিন আবার সম্প্রচার করা হয়।
ফারুক আজিজ খান আরও লিখছেন: মেজর জিয়া ভারত সীমান্তের রামগড় শহরে এসে পৌঁছান ৩০ অথবা ৩১ মার্চ। রাঙামাটির পুলিশ সুপার বজলুর রহমানও আগরতলায় যাওয়ার জন্য রামগড়ে চলে যান ২৬ মার্চ। তিনি তাঁর বাহিনীকে পরিত্যাগ করে যান, যার মধ্যে ৫০০ জনের সশস্ত্র একটি দল ছিল। পাহাড় ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ রাঙামাটি, কাপ্তাই ও সংলগ্ন এলাকার জন্য এটা অত্যন্ত সহায়ক বাহিনী ছিল। আমরা যদি কয়েকটি পাহাড় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতাম, তাহলে গেরিলাযুদ্ধ চালানো অনেক সহজ হতো। সে ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ ভিন্ন একটি মাত্রা পেত।...দৃশ্যপট থেকে মেজর জিয়ার দ্রুত অন্তর্ধান লড়াইরত মানুষের নৈতিক মনোবল অনেকটাই দুর্বল করে দেয়। রেডিও ভাষণের মাধ্যমে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যে সাহস ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁর অন্তর্ধানে যেন অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স তৈরি হলো। অন্যদিকে বেতার ভাষণে জিয়ার নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা এবং নির্বিচারে অবাঙালি নিধনের ঘটনা আমাদের পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার তালিকায় একেবারে শীর্ষে নিয়ে গেল।
এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে যাওয়া, কালুরঘাট বেতার থেকে ঘোষণাপাঠ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেনাপ্রধান ওসমানীর সঙ্গে বিরোধ এবং পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতির প্রতি আনুকূল্য দেখিয়ে জিয়াউর রহমান বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। মার্চ মাস এলেই পুরোনো এসব কথা মনে পড়ে।
‘রোড টু সোয়াত’ সিনেমার নায়কের বাঙালিবিরোধী মনোভাবের কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে হলে সিনেমাটির প্রদর্শন বন্ধে নেতৃত্ব দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম এখন বিএনপির নেতা এবং এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে যাওয়া মেজর জিয়া সেই বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। ঘটনা দুটি কি কাকতালীয়?
জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
৯ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
৯ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
৯ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
৯ ঘণ্টা আগে