ড. এম আবদুল আলীম
সময় প্রবাহিত হয়। সেই প্রবহমানতায় ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সংঘটিত হয় নানা ঘটন-অঘটন। সেগুলোর কোনোটি থেকে প্রবাহিত হয় আলোকের ঝরনাধারা, আবার কোনোটি ঢাকা থাকে নিকষ অন্ধকারে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে বাঙালির ইতিহাসে এমনই এক প্রহর নেমে এসেছিল, যা ইতিহাসে ‘কৃষ্ণপ্রহর’রূপে চিহ্নিত হয়ে জাতির ললাটে কলঙ্কতিলক এঁকে দিয়েছে। সেই কলঙ্কিত প্রহরে সপরিবারে হত্যা করা হয় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে অনেক বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারের সদস্য এবং অন্যদের হত্যাকাণ্ড সব বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার হত্যার ঘটনা নিঃসন্দেহে বর্বরোচিত, কিন্তু নবাব ব্যতীত তাঁর পরিবারের সদস্যদের, অর্থাৎ স্ত্রী-কন্যাকে হত্যা করা হয়নি। প্রাচীন ও মধ্য যুগে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বহু রাজা-বাদশা-অমাত্যবর্গ হত্যার শিকার হয়েছেন; কিন্তু তাঁরা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূ এবং স্বজন-সহযোগীদের মতো নির্মম হত্যার শিকার হননি। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হয়েছেন ইরানের প্রধানমন্ত্রী ড. মোসাদ্দেক, কঙ্গোর বিপ্লবী নেতা প্যাট্রিস লুলুম্বা, বলিভিয়ার বিপ্লবী নেতা চে গুয়ে ভারা, চিলির রাষ্ট্রনায়ক সালভাদর আলেন্দে প্রমুখ। এ ছাড়া আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন স্বাধীন ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি সোলমান বন্দরনায়েকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী। লক্ষণীয় এসব ইতিহাসখ্যাত ব্যক্তির পরিবারের সদস্য কিংবা তাঁদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কাউকে হত্যা করা হয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে তাঁর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল খুকু ও পারভীন জামাল রোজী, ভাই শেখ আবু নাসের, ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি, ভাগনের স্ত্রী বেগম আরজু মণি, ভাগনের শিশুপুত্র সুকান্ত আবদুল্লাহসহ অনেক শিশু ও নারী-পুরুষকে। কিন্তু এতেও খুনিদের রক্তপিপাসা মেটেনি। কিছুদিন পর জেলখানার ভেতর ঢুকে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ চার রাজনৈতিক সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে।
পঁচাত্তরের এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের পাশাপাশি এতে যুক্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মীর জাফরদের উত্তরসূরিরা, যার প্রধান কুশীলব ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বঙ্গবন্ধুর লাশ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে রেখে খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। যাঁদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদউল্লাহ (বঙ্গবন্ধুর মেয়াদকালের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি), আবু সাঈদ চৌধুরী (বঙ্গবন্ধুর সময়ের প্রথম রাষ্ট্রপতি), অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী, ফণীভূষণ মজুমদার, সোহরাব হোসেন, আব্দুল মান্নান, মনোরঞ্জন ধর, আবদুল মোমিন খান, আসাদুজ্জামান খান, এ আর মল্লিক, মোজাফফর আহমদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নূরুল ইসলাম মনজুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, মোমিন উদ্দিন আহমেদ, মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া, ক্ষিতীশচন্দ্র মণ্ডল, মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়া, সৈয়দ আলতাফ হোসেন এবং আবদুর রউফ। তাঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন; কেউ কেউ সামরিক স্বৈরশাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বদলে ফেলেন রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সব বৈশিষ্ট্য; এমনকি সংবিধান পর্যন্ত। খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে চালানো হয় নানা অপপ্রচার। পাঠ্যপুস্তক এবং ইতিহাসের পাতা থেকে তাঁর নাম-নিশানা মুছে ফেলতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়। এমনকি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না মর্মে দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। আত্মস্বীকৃত খুনিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত পর্যন্ত করা হয়। বাস্তবেই বাঙালির ইতিহাসে ওই সময়টা ছিল ঘোরতর কৃষ্ণপ্রহর। এমন দুর্দিন এই জাতির জীবনে আর আসেনি কখনো।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জাতির ভাগ্যাকাশে যে ঘোর অমানিশা ও কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যায়, তা কেটে ঝলমলে সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটতে সময় লাগে দুই দশকের বেশি। বঙ্গবন্ধুর দলের নেতা-কর্মী এবং ভক্ত-অনুরাগীরা অনেকেই সেই দুর্বিষহ পরিবেশে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, যশোর, খুলনা, বরগুনা, পাবনা, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি স্থানে পুলিশ ও সেনাসদস্যদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা প্রতিবাদী মিছিল বের করে। অনেকে কারা নির্যাতন ভোগ করেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ওই সময় গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হন এবং তিন বছর কারাভোগ করেন। নির্মম নির্যাতনের শিকার হন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান বীর প্রতীক। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তাঁর কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ভারতে অবস্থান করে সীমান্ত এলাকায় সশস্ত্র প্রতিবাদ করেন। প্রবাসে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা পিতৃহত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন। ১৯৮১ সালের মে মাসে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পিতার আদর্শ শিরোধার্য করে দলীয় নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করে পথচলা শুরু করেন। দলে দলে মানুষ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকাতলে সমবেত হয়। খুনিচক্র এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক ও আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের আস্ফালন ক্রমেই কমে আসতে থাকে। রাজপথের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয় লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র চালনার ভার গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুর রক্তের সুযোগ্য উত্তরাধিকার জননেত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় সংসদে বাতিল করা হয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। শুরু হয় বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচারকাজও। নানা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত বিচার সম্পন্ন হয় এবং বিচারের রায় অনেকাংশে কার্যকর করা হয়।
ইতিহাসের রথচক্র থেমে থাকে না। সময়-সময় তার গতি মন্থর হলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মশাল নিয়ে তা ক্রমে এগিয়ে যেতে থাকে। সেই আলোর মশালে শামিল হয় বাংলার কোটি কোটি মানুষ। দিকে দিকে স্লোগান ওঠে, ‘এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে...’। জীবিত মুজিবের চেয়ে লোকান্তরের মুজিব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইতিহাসের সেই অমোঘ সত্য দীপ্র হয়ে ওঠে যে ব্যক্তিকে হত্যা করা গেলেও হত্যা করা যায় না তাঁর আদর্শ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবারও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। একে একে বাস্তবায়ন হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজ। দেশ হয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দূর হয় ক্ষুধা, হতে থাকে দারিদ্র্য বিমোচন। এ ছাড়া অবকাঠামো, শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, আর্থসামাজিক সব দিক থেকেই দেশ এগিয়ে যেতে থাকে। মার্কিনিদের আখ্যা দেওয়া সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশ ঘুরে দাঁড়ায়; বিশ্বমোড়লদের তাক লাগিয়ে দিয়ে নির্মিত হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু থেকে মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালিত হয় যথাযথ মর্যাদা এবং ভাবগাম্ভীর্যে। গৃহহীন পায় গৃহ, অন্নহীনে দেওয়া হয় অন্ন, মুমূর্ষু পায় চিকিৎসা, বিদ্যুৎ পৌঁছে ঘরে ঘরে, তথ্যপ্রযুক্তির সুফল পায় সব মানুষ, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে অভিযাত্রা শুরু হয় স্মার্ট বাংলাদেশের পথে।
এভাবেই পঁচাত্তরের আগস্টের সেই কৃষ্ণপ্রহর কেটে জাতির জীবনে আসে আলোকিত প্রহর। তবে আত্মতৃপ্ত হলে চলবে না। বঙ্গবন্ধুর মরণপণ সংগ্রামে অর্জিত বাংলাদেশকে যথাযথ অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ করে তোলার কাজ এখনো অনেক বাকি। কঠোরভাবে টেনে ধরতে হবে দুর্নীতি ও দ্রব্যমূল্যের লাগাম, অর্থ পাচারে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পঁচাত্তরের সেই ঘোর অমানিশার আবহ থেকে দেশকে পরিপূর্ণ মুক্ত করতে চাইলে সব নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ এবং আধুনিক দেশরূপে গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: গবেষক-প্রাবন্ধিক, সাবেক ডিন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সময় প্রবাহিত হয়। সেই প্রবহমানতায় ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সংঘটিত হয় নানা ঘটন-অঘটন। সেগুলোর কোনোটি থেকে প্রবাহিত হয় আলোকের ঝরনাধারা, আবার কোনোটি ঢাকা থাকে নিকষ অন্ধকারে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে বাঙালির ইতিহাসে এমনই এক প্রহর নেমে এসেছিল, যা ইতিহাসে ‘কৃষ্ণপ্রহর’রূপে চিহ্নিত হয়ে জাতির ললাটে কলঙ্কতিলক এঁকে দিয়েছে। সেই কলঙ্কিত প্রহরে সপরিবারে হত্যা করা হয় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে অনেক বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারের সদস্য এবং অন্যদের হত্যাকাণ্ড সব বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার হত্যার ঘটনা নিঃসন্দেহে বর্বরোচিত, কিন্তু নবাব ব্যতীত তাঁর পরিবারের সদস্যদের, অর্থাৎ স্ত্রী-কন্যাকে হত্যা করা হয়নি। প্রাচীন ও মধ্য যুগে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বহু রাজা-বাদশা-অমাত্যবর্গ হত্যার শিকার হয়েছেন; কিন্তু তাঁরা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূ এবং স্বজন-সহযোগীদের মতো নির্মম হত্যার শিকার হননি। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হয়েছেন ইরানের প্রধানমন্ত্রী ড. মোসাদ্দেক, কঙ্গোর বিপ্লবী নেতা প্যাট্রিস লুলুম্বা, বলিভিয়ার বিপ্লবী নেতা চে গুয়ে ভারা, চিলির রাষ্ট্রনায়ক সালভাদর আলেন্দে প্রমুখ। এ ছাড়া আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন স্বাধীন ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি সোলমান বন্দরনায়েকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী। লক্ষণীয় এসব ইতিহাসখ্যাত ব্যক্তির পরিবারের সদস্য কিংবা তাঁদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কাউকে হত্যা করা হয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে তাঁর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল খুকু ও পারভীন জামাল রোজী, ভাই শেখ আবু নাসের, ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি, ভাগনের স্ত্রী বেগম আরজু মণি, ভাগনের শিশুপুত্র সুকান্ত আবদুল্লাহসহ অনেক শিশু ও নারী-পুরুষকে। কিন্তু এতেও খুনিদের রক্তপিপাসা মেটেনি। কিছুদিন পর জেলখানার ভেতর ঢুকে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ চার রাজনৈতিক সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে।
পঁচাত্তরের এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের পাশাপাশি এতে যুক্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মীর জাফরদের উত্তরসূরিরা, যার প্রধান কুশীলব ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বঙ্গবন্ধুর লাশ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে রেখে খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। যাঁদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদউল্লাহ (বঙ্গবন্ধুর মেয়াদকালের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি), আবু সাঈদ চৌধুরী (বঙ্গবন্ধুর সময়ের প্রথম রাষ্ট্রপতি), অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী, ফণীভূষণ মজুমদার, সোহরাব হোসেন, আব্দুল মান্নান, মনোরঞ্জন ধর, আবদুল মোমিন খান, আসাদুজ্জামান খান, এ আর মল্লিক, মোজাফফর আহমদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নূরুল ইসলাম মনজুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, মোমিন উদ্দিন আহমেদ, মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া, ক্ষিতীশচন্দ্র মণ্ডল, মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়া, সৈয়দ আলতাফ হোসেন এবং আবদুর রউফ। তাঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন; কেউ কেউ সামরিক স্বৈরশাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বদলে ফেলেন রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সব বৈশিষ্ট্য; এমনকি সংবিধান পর্যন্ত। খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে চালানো হয় নানা অপপ্রচার। পাঠ্যপুস্তক এবং ইতিহাসের পাতা থেকে তাঁর নাম-নিশানা মুছে ফেলতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়। এমনকি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না মর্মে দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। আত্মস্বীকৃত খুনিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত পর্যন্ত করা হয়। বাস্তবেই বাঙালির ইতিহাসে ওই সময়টা ছিল ঘোরতর কৃষ্ণপ্রহর। এমন দুর্দিন এই জাতির জীবনে আর আসেনি কখনো।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জাতির ভাগ্যাকাশে যে ঘোর অমানিশা ও কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যায়, তা কেটে ঝলমলে সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটতে সময় লাগে দুই দশকের বেশি। বঙ্গবন্ধুর দলের নেতা-কর্মী এবং ভক্ত-অনুরাগীরা অনেকেই সেই দুর্বিষহ পরিবেশে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, যশোর, খুলনা, বরগুনা, পাবনা, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি স্থানে পুলিশ ও সেনাসদস্যদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা প্রতিবাদী মিছিল বের করে। অনেকে কারা নির্যাতন ভোগ করেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ওই সময় গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হন এবং তিন বছর কারাভোগ করেন। নির্মম নির্যাতনের শিকার হন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান বীর প্রতীক। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তাঁর কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ভারতে অবস্থান করে সীমান্ত এলাকায় সশস্ত্র প্রতিবাদ করেন। প্রবাসে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা পিতৃহত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন। ১৯৮১ সালের মে মাসে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পিতার আদর্শ শিরোধার্য করে দলীয় নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করে পথচলা শুরু করেন। দলে দলে মানুষ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকাতলে সমবেত হয়। খুনিচক্র এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক ও আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের আস্ফালন ক্রমেই কমে আসতে থাকে। রাজপথের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয় লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র চালনার ভার গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুর রক্তের সুযোগ্য উত্তরাধিকার জননেত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় সংসদে বাতিল করা হয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। শুরু হয় বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচারকাজও। নানা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত বিচার সম্পন্ন হয় এবং বিচারের রায় অনেকাংশে কার্যকর করা হয়।
ইতিহাসের রথচক্র থেমে থাকে না। সময়-সময় তার গতি মন্থর হলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মশাল নিয়ে তা ক্রমে এগিয়ে যেতে থাকে। সেই আলোর মশালে শামিল হয় বাংলার কোটি কোটি মানুষ। দিকে দিকে স্লোগান ওঠে, ‘এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে...’। জীবিত মুজিবের চেয়ে লোকান্তরের মুজিব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইতিহাসের সেই অমোঘ সত্য দীপ্র হয়ে ওঠে যে ব্যক্তিকে হত্যা করা গেলেও হত্যা করা যায় না তাঁর আদর্শ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবারও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। একে একে বাস্তবায়ন হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজ। দেশ হয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দূর হয় ক্ষুধা, হতে থাকে দারিদ্র্য বিমোচন। এ ছাড়া অবকাঠামো, শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, আর্থসামাজিক সব দিক থেকেই দেশ এগিয়ে যেতে থাকে। মার্কিনিদের আখ্যা দেওয়া সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশ ঘুরে দাঁড়ায়; বিশ্বমোড়লদের তাক লাগিয়ে দিয়ে নির্মিত হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু থেকে মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালিত হয় যথাযথ মর্যাদা এবং ভাবগাম্ভীর্যে। গৃহহীন পায় গৃহ, অন্নহীনে দেওয়া হয় অন্ন, মুমূর্ষু পায় চিকিৎসা, বিদ্যুৎ পৌঁছে ঘরে ঘরে, তথ্যপ্রযুক্তির সুফল পায় সব মানুষ, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে অভিযাত্রা শুরু হয় স্মার্ট বাংলাদেশের পথে।
এভাবেই পঁচাত্তরের আগস্টের সেই কৃষ্ণপ্রহর কেটে জাতির জীবনে আসে আলোকিত প্রহর। তবে আত্মতৃপ্ত হলে চলবে না। বঙ্গবন্ধুর মরণপণ সংগ্রামে অর্জিত বাংলাদেশকে যথাযথ অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ করে তোলার কাজ এখনো অনেক বাকি। কঠোরভাবে টেনে ধরতে হবে দুর্নীতি ও দ্রব্যমূল্যের লাগাম, অর্থ পাচারে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পঁচাত্তরের সেই ঘোর অমানিশার আবহ থেকে দেশকে পরিপূর্ণ মুক্ত করতে চাইলে সব নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ এবং আধুনিক দেশরূপে গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: গবেষক-প্রাবন্ধিক, সাবেক ডিন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
৬ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
৬ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
৬ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
৬ ঘণ্টা আগে