জাহীদ রেজা নূর
জেলের ভেতর মুনীর চৌধুরী একটা চিরকুট পেলেন। রণেশ দাশগুপ্তের লেখা। সেটা ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাস। চিরকুটে মুনীর চৌধুরীকে অনুরোধ করা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি নাটক লেখার জন্য। একাঙ্কিকা। জেলের ভেতরেই যেন তার অভিনয় করা যায়, এ রকমভাবে লিখতে হবে।
মুনীর চৌধুরী এই অনুরোধটি রাখলেন এবং যা সৃষ্টি করলেন, তা হয়ে রইল আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অক্ষয় দলিল।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জেলখানাতেই নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল।
রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিলেন, সে কথায় কার কী এসে যায়?
দুই.
রণেশ দাশগুপ্ত ভাষা আন্দোলনের ওপর নাটক লেখার জন্য মুনীর চৌধুরীকে চিঠিটি লিখেছিলেন কি স্বাধীন পাকিস্তানের মুক্ত ভূমি থেকে, নাকি তিনিও ছিলেন জেলে? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, আমরা এই কমরেডের জীবনী পড়তে গেলে পাই যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর বিপজ্জনক বিবেচনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ছাড়া পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু চার মাস পর আবার বন্দী হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চলছিল, তখন তিনি জেলেই ছিলেন। জেল থেকেই লিখেছিলেন এই চিরকুট। বিনা বিচারে আটক রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্ত মুক্তি লাভ করেছিলেন ১৯৫৫ সালে।
১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠিত হলে অনেক কমিউনিস্টই সে দলে যোগ দেন। সে সময় রণেশ দাশগুপ্ত বামপন্থীদের পত্রিকা দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। যত দিন বাংলাদেশে ছিলেন, তত দিন দৈনিক সংবাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল।
তিন
ঢাকার সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়া ১৯৩৪ সাল থেকে। এর আগে ১৯৩১ সালে একবার ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সে সময় ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত সারা বাংলার কলেজছাত্রদের জন্য একটি প্রবন্ধ রচনার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘স্বামী বিবেকানন্দ’। সে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেই পুরস্কার আনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
জীবনী লিখছি না। শুধু জানিয়ে রাখি, তাঁর জন্ম হয়েছিল ভারতের আসামের ডিব্রুগড়ে, ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি। ডিব্রুগড় ছিল রণেশের মা ইন্দুপ্রভা (সেন) দাশগুপ্তের পিত্রালয়। ইন্দুপ্রভার বাবা কালীমোহন সেনের আদিনিবাস ছিল বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে।
রণেশের বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ছিলেন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। রাঁচিতেই তাঁর চাকরি হয়।
রণেশের ডাকনাম ছিল খোকা। রাঁচি জেলা স্কুল থেকে ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। বিজ্ঞানে পড়বেন বলে ভর্তি হন বাঁকুড়া খ্রিস্টিয়ান কলেজে। দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন আইএসসি। এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে, সেখানে ব্রজমোহন কলেজ বা বিএম কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি।
বরিশালে তিনি উঠেছিলেন তাঁর জেঠু সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন রণেশ দাশগুপ্তের জেঠতুতো দাদা। এখানে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের চোখ পড়ে তাঁর দিকে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে কলেজ হোস্টেলে ওঠেন। বিএ পাস না করেই ১৯৩৩ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বিক্রমপুরের বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। এর আগে বাবা আহত হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে বাবার মৃত্যু হলে তাঁরা চলে আসেন তাঁতীবাজারে।
৪
একবার যখন কলকাতায় এলেন, তখন যোগানন্দ জ্যাঠামশাই বললেন, তাঁর বউদিকে নিয়ে বরিশালে যেতে হবে। এই বউদি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী। শিয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেখানেই আসবেন বউদি। বউদিকে খুঁজতে খুঁজতে ট্রেনের একটা কামরার সামনে এলেন রণেশ। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন যোগানন্দ দাশ। বউদি চোখ ইশারায় যোগানন্দ দাশকে প্রণাম করতে বললেন। রণেশ খুব উদ্ধত ছিলেন। প্রণাম তিনি করলেন না। যোগানন্দ দাশ বললেন, ‘ও কি প্রণাম করবে? ও তো বলশেভিক!’
রণেশ তখনো বলশেভিক ব্যাপারটি ভালোমতো জানতেন না। সোভিয়েত ইউনিয়নে কিছু একটা হচ্ছে সে ব্যাপারটি বুঝতেন কিন্তু সেই দেশ থেকে খুব বেশি খবর আসত না।
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি রণেশ দাশগুপ্তকে খুব আকৃষ্ট করে।
৫
রবীন্দ্রনাথের কথা আসায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সে সময় তিনি বরিশালে ছিলেন। কলেজ হোস্টেলে। রবীন্দ্রনাথের ৭০তম বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান। কলেজ হোস্টেলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রণেশ দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত স্বরচিত কবিতা পড়লেন। তাতে বরিশালের নবীন কবি হিসেবে নাম হলো রণেশের। বিভিন্ন জায়গা থেকে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন।
একবার সরস্বতী সমাজের আমন্ত্রণে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে গিয়েছিলেন, সেটি ছিল গীতা জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। সে সভায় সভাপতি ছিলেন বরিশালের রাশভারী উকিল রায়বাহাদুর গণেশ দাশগুপ্ত। রণেশ তাঁর নিজের চিন্তাধারা অনুযায়ী কবিতা লিখেছিলেন। সে কবিতা পাঠ করার সময় পেছন থেকে শুনতে পেলেন ‘ও মশায়’ ‘ও মশায়’ বলে চিৎকার। প্রথমে রণেশ বুঝতে পারেননি কে কাকে ডাকছে। পরে আরও কয়েকবার ডাকার পর পেছন ফিরে দেখলেন সভাপতি মশাই ডাকছেন। তিনি বলছেন, ‘এটা রাজনীতির সভা নয়, আপনি পড়া বন্ধ করুন।’
রণেশ কবিতায় বলছিলেন বিপ্লবের কথা এবং তা গীতার ভাষ্য হিসেবে। সভাপতির কথায় তিনি মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। দর্শক-শ্রোতারা সে কবিতা শুনতে চাইছিল। রণেশ চলে যাওয়ায় হল হয়ে গেল খালি। প্রতিবাদ করে বেরিয়ে এলেন দর্শক-শ্রোতারা।
৬
বিভিন্ন সময়ে যেসব দাঙ্গা হয়েছে, রণেশ দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার এবং লেখায় তা নিয়ে অনেক কথা উঠে এসেছে। মনোযোগী পাঠক সে সময়ের একটা চিত্র খুঁজে পাবেন তাতে। সে আলোচনায় না গিয়ে সাহিত্যে দাঙ্গাবিষয়ক যে ভাবনার জন্ম হচ্ছিল এবং তা অনুপ্রাণিত করেছিল রণেশ দাশগুপ্তকে, সে কথা বলি।
সোমেন চন্দের বিখ্যাত ‘দাঙ্গা’ গল্পটির কথা তো বলতেই হয়। বলতে হয় সমরেশ বসুর ‘আদাব’ নামের গল্পটির কথা। অসীম রায়ের ‘বিক্ষোভ’ উপন্যাসের কথা। সাদাত হাসান মান্টো, কীষণ চন্দর দাঙ্গা এবং দেশভাগ নিয়ে প্রচুর মহাকাব্যিক লেখা লিখেছেন। দাঙ্গার বিষয়ে জীবনানন্দ দাশের বেশ কিছু কালজয়ী কবিতা রয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ওপর শওকত ওসমানের লেখা ‘আর্তনাদ’ উপন্যাসটার কথাও বলতে হয়।
সে সময় পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু পরিবারগুলো দলে দলে চলে গিয়েছিল পশ্চিম বাংলায়। তেমনি মুসলিম পরিবারগুলো পশ্চিম বাংলা থেকে চলে এসেছিল পূর্ব বাংলায়। কলকাতা থেকে আসা বাঙালি মুসলমানেরা মূলত খুলনা, যশোর ও সৈয়দপুরে এসেছিলেন বেশি। সে সময়ের কিছু কথা রণেশ দাশগুপ্তের লেখায় মূর্ত হয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশের নতুন ধরনের কবিতাগুলো মানুষকে পরিচিত গণ্ডির কবিতার আবেশ থেকে বের করে আনছিল। কিন্তু জীবনানন্দের গদ্য সম্ভারের সন্ধান তখনো পাওয়া যায়নি। জীবনানন্দ মার্ক্সিস্ট ছিলেন বলে কখনোই প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তাঁর অন্তত দুটি উপন্যাসে মার্ক্স, লেনিন ও কমিউনিস্টরা উঠে এসেছেন। উপন্যাস দুটির নাম ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ আর ‘জলপাইহাটি’। রণেশ দাশগুপ্তের ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ বইটিতে জীবনানন্দের এই দুটি উপন্যাস নিয়ে বৃহৎ আলোচনা আছে।
৭
‘দোটানা’ নামে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ বা ফিচার আছে রণেশ দাশগুপ্তের লেখা ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’ নামের বইটিতে। সরাসরি সাম্যবাদের কোনো কথা সেখানে নেই। কিন্তু বর্ণনার সহজতায় পাঠক বুঝে নিতে পারবেন রণেশ দাশগুপ্তের লেখার মর্মার্থ। প্রবন্ধের কয়েকটা লাইন এ রকম:
‘বদলাব বদলাব করে সাত দিন ধরে পরা সার্ট পায়জামা বদলানো হয়নি। সার্টটার হাতে দুটো ভয়ানকভাবে ময়লা হয়ে গেছে। পাজামাটা চটের থলে। হলঘরে অতগুলি লোকের দশা কি হতে পারে, সে কথা না ভেবেই নেহায়েত স্বার্থপরের মত মনে মনে বললাম, “ধরণী দ্বিধা হও”।
‘মুশকিলটা হয়েছে এই যে, আজ অফিসে কাজে আসার সময়ও দুদিন আগে পরা সার্ট পাজামা ভয়ানক ময়লা লাগল। না বদলে পারলাম না। অথচ আসতে আসতে যেসব মেহনতি মানুষ চোখে পড়েছে, তাদের অনেকেরই গায়ে কাজের জামা, আধ ময়লা জামা, নোংরা জামা, ছেঁড়া জামা। একজন আমার চেনা। সে একজন ফিটার। তার গায়ে দেখলাম, তেল কালিমাখা একটা হাফসার্ট। অথচ আমি জানি, উৎসবের দিনে এই লোকটি যে পোশাক পরিচ্ছদ পরে তা যেমন রুচিসম্মত, তেমনি প্রদীপ্ত। মানায়ও তাকে। মনে হয়, এ সম্পূর্ণ পৃথক একটি লোক, এর কিন্তু কাজের জামা পরতে মোটেই দ্বিধা জাগে বলে মনে হয় না। স্বচ্ছন্দে চলে গেল বুক ফুলিয়ে মহানগরীর ভিড় ঠেলে।’
‘বড় দোটানায় পড়ে গিয়েছি। ভাবছি, পকেট এ কলম, তার বদলে যদি হাতে একটা হাতুড়ি আর কিছু করার থাকতো তাহলে সম্ভবত এমন ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হতাম না। হয়েছি কলমজীবী, না ঘরকা না ঘাটকা।'
দীর্ঘ এই উদ্ধৃতি দেওয়া হলো। আমার মনে হয়, এ সময় রণেশ দাশগুপ্ত বেঁচে থাকলে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা আরও কিছুটা পাল্টাত। মানুষ দিনে দিনে আরও বেশি চতুর, দুর্নীতিবাজ, তেলবাজ হয়ে উঠেছে, সেটা দেখে তিনি হয়তো আরও বেশি কষ্ট পেতেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর যে বিশ্বাস ছিল, সে বিশ্বাসে আঘাত আসত কি না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যাঁরা পোড় খাওয়া মন ও শরীর নিয়ে পার্টি করে গেছেন, তাঁদের অনেকেই জীবিতাবস্থায় পার্টির নতুন নেতৃত্বের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তার ব্যতিক্রম নয়। নয়া নেতৃত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে যেভাবে দল চালিয়েছেন, তাতে আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে বড়সড় ভাবনা থাকলেও নিজ দেশ অনেক ক্ষেত্রেই ছিল আলোচনার বাইরে। অনেক বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রণেশ দাশগুপ্তদের মতো গুণী মানুষদের এড়িয়ে।
একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক জগতে ঝ্দানোভ চালিয়েছিলেন এক বীভৎস পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সৃজনশীলতার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন। লেখক, সাহিত্যিক, কবি পার্টির নির্দেশে লেখালেখি করতেন। সৃজনশীল মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় আঘাত আর কিছুই হতে পারে না। এই বীভৎসতার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনে। তার বিষে জর্জরিত হয়েছিল খোলা মনের মানুষ। এখন নানাভাবে সেই বীভৎসতার চিত্রগুলো তুলে আনা হচ্ছে। কিন্তু সে সময় এই নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির পক্ষেই গুণগান গাইছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতারা। ভারতবর্ষেও সেই চপেটাঘাত পড়েছিল। ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ নামে যে অশ্বডিম্বটি পাড়া হয়েছিল, সেটি যে মানবিক বিকাশের অন্তরায়, সে কথা বুঝতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। এ কারণেই বুঝি কমরেড ফরহাদ যখন ‘নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তখন তার সমালোচনা করতে হলো সনজীদা খাতুনকে।
সন্জীদা খাতুন তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি লেখার আগে রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের তো কোনো কথা জিজ্ঞেস করে না।’
কিন্তু পার্টির প্রতি অগাধ মমত্বের কারণে তিনি মলিনমুখে বলেছিলেন, ‘সেম সাইড হয়ে যায় না?’ অর্থাৎ কমরেড ফরহাদের লেখার বিরুদ্ধে সন্জীদা খাতুন লিখলে সেটা পার্টি লাইনের বাইরের কিছু হয় কি না, সে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি।
সে সময় যদি প্রতিবাদ করতেন তিনি বা তাঁর মতো বিচক্ষণ মানুষেরা, তাহলে পার্টি হয়তো তাঁদের দিকনির্দেশনায় ঋদ্ধ হতে পারত।
৮
রণেশ দাশগুপ্তের অসাধারণ একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ নামের বইয়ে। প্রবন্ধটির নাম, ‘বাংলাদেশ নয় এ মধুর খেলা রচয়িত্রীরা’।
মূলত বাংলাদেশের নারী লেখকদের নিয়ে প্রবন্ধটি। বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমামকে নিয়ে যখন তিনি এই প্রবন্ধ লিখছেন, তখন প্রথমজনের বয়স ৯২ এবং দ্বিতীয়জনের ৮২। এখন বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ বিভাজন মানা হয় না। সে সময় মানা হতো বলে লেখার শব্দগুলোকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে। তিনি লিখছেন, ‘বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমাম।... এই দুই প্রবীণা বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিভাবিকারূপে বিবেচিতা। বেগম সুফিয়া কামাল বিশ্বের দশক থেকেই বিশিষ্টা কবি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিষ্যা ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা সুফিয়া কামাল বরাবরই প্রগতিবাদিনী। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকা। যে মুক্তি ধারায় স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটল, তার সঙ্গে আপন চিন্তাভাবনা ও নারী সমাজের অন্তরঙ্গতা ও একাত্মতা প্রকাশের সহজ সরল বাণীরূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার জগত।... বেগম জাহানারা ইমাম ’৪৬-এ কলকাতা লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। রংপুরের মেয়ে জাহানারা ইমাম দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলায় চলে যান এবং বিবাহিত সাংসারিক জীবনযাপন করেন স্কুলশিক্ষকের কাজের পাশাপাশি। এই অবস্থান থেকেই বেগম জাহানারা ইমাম বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ও ব্যাপক গণহত্যা পতাকাবাহী নিরুপায় সামনে এসে গিয়েছেন।’
এ দুজনের কথা বলার পর রণেশ দাশগুপ্ত বলেছেন তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে। তিনি লিখছেন, ‘ঢাকা থেকে প্রকাশিত নির্বাচিত কলাম বইটিতে লেনিনের অনুসারী কমিউনিস্টদের যে উল্লেখ রয়েছে, তাতে কমিউনিস্টদের পুরুষ হিসেবে দেখিয়ে নারীদের ভালো-মন্দের প্রতি উদাসীন বলে ধিক্কার দেয়া হয়েছে। ঊনিশ শতকের জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলকে নারীর ভোটাধিকার বিরোধী বলে উপস্থিত করা হয়েছে। কিন্তু কলকাতা থেকে প্রকাশিত “নির্বাচিত কলাম” বইটিতে “যাব না কেন? যাব”কে যুক্ত করে যে সার্বিক বা পরিপূরক বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছে, তাতে ’৯০-৯১–এর সমাজতন্ত্রের সংকট ও লেনিনের অবমাননার এক বিস্ময়কর আবেগময় প্রস্তাবনা বেরিয়ে এসেছে লেখিকার কলম থেকে। এ ধরনের বক্তব্যকে হঠাৎ আলোর ঝলকানি বলে মনে করে নিলে ভুল হবে। এই কলামটিতে তসলিমা নাসরিন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনে লেনিনের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় শোকাহত মস্তক অবনত করেছেন।’
এরপর তিনি লেখক মতিয়া চৌধুরীর কথা বলেছেন। স্বনামধন্য এই রাজনীতির মানুষটি ষাটের দশকের শেষে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দৈনিক সংবাদে তিনি ধারাবাহিকভাবে জেলের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্ত লিখছেন, ‘মতিয়া চৌধুরী প্রধানত বাংলাদেশের বিপ্লবের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণের রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রতিনিধিরূপে বাংলাদেশের মুক্তির ধারাভাষ্য উপস্থিত করেছেন মুখ্যত বিশাল বিশাল জনসমাবেশ প্রদত্ত ভাষণে। সেই কারণে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এর বাইরে তার কোনো ভাষ্যকে পাওয়া যাবে না, তবে তার লেখা কারা কাহিনীটি দলিত বঞ্চিত নারী জীবনের ছবি দেশবাসীকে বিবেকের কাছে তীব্র ও তীক্ষ্ণতাবোধ উপস্থিত করেছিল।’
এরপর তিনি বলেছেন মালেকা বেগমের কথা, সেলিনা হোসেনের কথা, পান্না কায়সারের কথা।
এই প্রবন্ধটি পাঠ করতে বলব শুধু এই কারণে যে একজন লেখক তাঁর পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে নির্মোহ ভঙ্গিতে কীভাবে কোনো বই বা মানুষের বিশ্লেষণ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
৯
অগাধ পড়াশোনা করেছেন তিনি। বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই ছিলেন পারদর্শী। রাজনীতির মাঠে তিনি একজন নান্দনিক শিল্পী। সংস্কৃতিই ছিল তাঁর শক্তিমত্তার বড় জায়গা। রাজনীতির কথা বলতে গেলে ১৯৫৮ সালের মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনের কথা বলতে হয়। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। ৩৫টি পদের মধ্যে ২৫টিতে জয়ী হয় মুসলিম লীগ, বাকি পদগুলো পায় আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল।
একটি মাত্র পদে নির্বাচিত হয় কমিউনিস্ট প্রার্থী। নির্বাচিত প্রার্থীর নাম রণেশ দাশগুপ্ত।
১০.
বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তির আরেকটি অসামান্য কাজের কথা বলে লেখাটি শেষ করব।
তাঁর ছদ্মনাম ছিল জমিল শরাফী। দৈনিক সংবাদে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি বিভিন্ন বই সম্পাদনা করতেন। ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংকলন’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল জমিল শরাফীর সম্পাদনায়।
তবে দাদা জীবনানন্দ দাশের ওপর বই সম্পাদনা করেছেন তিনি স্বনামেই। ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার’ নামের বইটিই ছিল বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চার প্রথম উদ্যোগ। এই বইটিতেই জীবনানন্দের পুরো কাব্যসম্ভার এক মলাটের মধ্যে পায় বাংলাদেশের অধিবাসীরা।
১১
১৯৭৫ সালে এ দেশের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তা দেখেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। সে বছর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি ফিরতি বিমান টিকিটসহ কলকাতায় গিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ড। কলকাতায় থাকা অবস্থাতেই নভেম্বরের জেলহত্যার কথা শুনতে পান। বন্ধুরা এ সময় তাঁকে বাংলাদেশে ফিরতে নিষেধ করেন। সেই থেকে শুরু হয় কলকাতার জীবন। কিন্তু নিজেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষ ভাবতেই পছন্দ করতেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। ভারতীয় সরকারের কোনো ভাতা নেননি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। অনেক ঠিকানা বদলের পর তাঁর থাকার জায়গা হয় লেনিন স্কুলে। কায়ক্লেশে সেখানেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকিটা সময়। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি মারা যান। বাংলাদেশ-ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। ঢাকায়ই হয় তাঁর শেষকৃত্য। তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হলে শহীদ মিনারে বিপুল জনসমাগম হয়।
জেলের ভেতর মুনীর চৌধুরী একটা চিরকুট পেলেন। রণেশ দাশগুপ্তের লেখা। সেটা ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাস। চিরকুটে মুনীর চৌধুরীকে অনুরোধ করা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি নাটক লেখার জন্য। একাঙ্কিকা। জেলের ভেতরেই যেন তার অভিনয় করা যায়, এ রকমভাবে লিখতে হবে।
মুনীর চৌধুরী এই অনুরোধটি রাখলেন এবং যা সৃষ্টি করলেন, তা হয়ে রইল আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অক্ষয় দলিল।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জেলখানাতেই নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল।
রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিলেন, সে কথায় কার কী এসে যায়?
দুই.
রণেশ দাশগুপ্ত ভাষা আন্দোলনের ওপর নাটক লেখার জন্য মুনীর চৌধুরীকে চিঠিটি লিখেছিলেন কি স্বাধীন পাকিস্তানের মুক্ত ভূমি থেকে, নাকি তিনিও ছিলেন জেলে? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, আমরা এই কমরেডের জীবনী পড়তে গেলে পাই যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর বিপজ্জনক বিবেচনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ছাড়া পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু চার মাস পর আবার বন্দী হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চলছিল, তখন তিনি জেলেই ছিলেন। জেল থেকেই লিখেছিলেন এই চিরকুট। বিনা বিচারে আটক রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্ত মুক্তি লাভ করেছিলেন ১৯৫৫ সালে।
১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠিত হলে অনেক কমিউনিস্টই সে দলে যোগ দেন। সে সময় রণেশ দাশগুপ্ত বামপন্থীদের পত্রিকা দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। যত দিন বাংলাদেশে ছিলেন, তত দিন দৈনিক সংবাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল।
তিন
ঢাকার সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়া ১৯৩৪ সাল থেকে। এর আগে ১৯৩১ সালে একবার ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সে সময় ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত সারা বাংলার কলেজছাত্রদের জন্য একটি প্রবন্ধ রচনার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘স্বামী বিবেকানন্দ’। সে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেই পুরস্কার আনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
জীবনী লিখছি না। শুধু জানিয়ে রাখি, তাঁর জন্ম হয়েছিল ভারতের আসামের ডিব্রুগড়ে, ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি। ডিব্রুগড় ছিল রণেশের মা ইন্দুপ্রভা (সেন) দাশগুপ্তের পিত্রালয়। ইন্দুপ্রভার বাবা কালীমোহন সেনের আদিনিবাস ছিল বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে।
রণেশের বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ছিলেন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। রাঁচিতেই তাঁর চাকরি হয়।
রণেশের ডাকনাম ছিল খোকা। রাঁচি জেলা স্কুল থেকে ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। বিজ্ঞানে পড়বেন বলে ভর্তি হন বাঁকুড়া খ্রিস্টিয়ান কলেজে। দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন আইএসসি। এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে, সেখানে ব্রজমোহন কলেজ বা বিএম কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি।
বরিশালে তিনি উঠেছিলেন তাঁর জেঠু সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন রণেশ দাশগুপ্তের জেঠতুতো দাদা। এখানে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের চোখ পড়ে তাঁর দিকে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে কলেজ হোস্টেলে ওঠেন। বিএ পাস না করেই ১৯৩৩ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বিক্রমপুরের বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। এর আগে বাবা আহত হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে বাবার মৃত্যু হলে তাঁরা চলে আসেন তাঁতীবাজারে।
৪
একবার যখন কলকাতায় এলেন, তখন যোগানন্দ জ্যাঠামশাই বললেন, তাঁর বউদিকে নিয়ে বরিশালে যেতে হবে। এই বউদি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী। শিয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেখানেই আসবেন বউদি। বউদিকে খুঁজতে খুঁজতে ট্রেনের একটা কামরার সামনে এলেন রণেশ। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন যোগানন্দ দাশ। বউদি চোখ ইশারায় যোগানন্দ দাশকে প্রণাম করতে বললেন। রণেশ খুব উদ্ধত ছিলেন। প্রণাম তিনি করলেন না। যোগানন্দ দাশ বললেন, ‘ও কি প্রণাম করবে? ও তো বলশেভিক!’
রণেশ তখনো বলশেভিক ব্যাপারটি ভালোমতো জানতেন না। সোভিয়েত ইউনিয়নে কিছু একটা হচ্ছে সে ব্যাপারটি বুঝতেন কিন্তু সেই দেশ থেকে খুব বেশি খবর আসত না।
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি রণেশ দাশগুপ্তকে খুব আকৃষ্ট করে।
৫
রবীন্দ্রনাথের কথা আসায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সে সময় তিনি বরিশালে ছিলেন। কলেজ হোস্টেলে। রবীন্দ্রনাথের ৭০তম বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান। কলেজ হোস্টেলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রণেশ দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত স্বরচিত কবিতা পড়লেন। তাতে বরিশালের নবীন কবি হিসেবে নাম হলো রণেশের। বিভিন্ন জায়গা থেকে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন।
একবার সরস্বতী সমাজের আমন্ত্রণে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে গিয়েছিলেন, সেটি ছিল গীতা জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। সে সভায় সভাপতি ছিলেন বরিশালের রাশভারী উকিল রায়বাহাদুর গণেশ দাশগুপ্ত। রণেশ তাঁর নিজের চিন্তাধারা অনুযায়ী কবিতা লিখেছিলেন। সে কবিতা পাঠ করার সময় পেছন থেকে শুনতে পেলেন ‘ও মশায়’ ‘ও মশায়’ বলে চিৎকার। প্রথমে রণেশ বুঝতে পারেননি কে কাকে ডাকছে। পরে আরও কয়েকবার ডাকার পর পেছন ফিরে দেখলেন সভাপতি মশাই ডাকছেন। তিনি বলছেন, ‘এটা রাজনীতির সভা নয়, আপনি পড়া বন্ধ করুন।’
রণেশ কবিতায় বলছিলেন বিপ্লবের কথা এবং তা গীতার ভাষ্য হিসেবে। সভাপতির কথায় তিনি মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। দর্শক-শ্রোতারা সে কবিতা শুনতে চাইছিল। রণেশ চলে যাওয়ায় হল হয়ে গেল খালি। প্রতিবাদ করে বেরিয়ে এলেন দর্শক-শ্রোতারা।
৬
বিভিন্ন সময়ে যেসব দাঙ্গা হয়েছে, রণেশ দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার এবং লেখায় তা নিয়ে অনেক কথা উঠে এসেছে। মনোযোগী পাঠক সে সময়ের একটা চিত্র খুঁজে পাবেন তাতে। সে আলোচনায় না গিয়ে সাহিত্যে দাঙ্গাবিষয়ক যে ভাবনার জন্ম হচ্ছিল এবং তা অনুপ্রাণিত করেছিল রণেশ দাশগুপ্তকে, সে কথা বলি।
সোমেন চন্দের বিখ্যাত ‘দাঙ্গা’ গল্পটির কথা তো বলতেই হয়। বলতে হয় সমরেশ বসুর ‘আদাব’ নামের গল্পটির কথা। অসীম রায়ের ‘বিক্ষোভ’ উপন্যাসের কথা। সাদাত হাসান মান্টো, কীষণ চন্দর দাঙ্গা এবং দেশভাগ নিয়ে প্রচুর মহাকাব্যিক লেখা লিখেছেন। দাঙ্গার বিষয়ে জীবনানন্দ দাশের বেশ কিছু কালজয়ী কবিতা রয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ওপর শওকত ওসমানের লেখা ‘আর্তনাদ’ উপন্যাসটার কথাও বলতে হয়।
সে সময় পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু পরিবারগুলো দলে দলে চলে গিয়েছিল পশ্চিম বাংলায়। তেমনি মুসলিম পরিবারগুলো পশ্চিম বাংলা থেকে চলে এসেছিল পূর্ব বাংলায়। কলকাতা থেকে আসা বাঙালি মুসলমানেরা মূলত খুলনা, যশোর ও সৈয়দপুরে এসেছিলেন বেশি। সে সময়ের কিছু কথা রণেশ দাশগুপ্তের লেখায় মূর্ত হয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশের নতুন ধরনের কবিতাগুলো মানুষকে পরিচিত গণ্ডির কবিতার আবেশ থেকে বের করে আনছিল। কিন্তু জীবনানন্দের গদ্য সম্ভারের সন্ধান তখনো পাওয়া যায়নি। জীবনানন্দ মার্ক্সিস্ট ছিলেন বলে কখনোই প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তাঁর অন্তত দুটি উপন্যাসে মার্ক্স, লেনিন ও কমিউনিস্টরা উঠে এসেছেন। উপন্যাস দুটির নাম ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ আর ‘জলপাইহাটি’। রণেশ দাশগুপ্তের ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ বইটিতে জীবনানন্দের এই দুটি উপন্যাস নিয়ে বৃহৎ আলোচনা আছে।
৭
‘দোটানা’ নামে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ বা ফিচার আছে রণেশ দাশগুপ্তের লেখা ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’ নামের বইটিতে। সরাসরি সাম্যবাদের কোনো কথা সেখানে নেই। কিন্তু বর্ণনার সহজতায় পাঠক বুঝে নিতে পারবেন রণেশ দাশগুপ্তের লেখার মর্মার্থ। প্রবন্ধের কয়েকটা লাইন এ রকম:
‘বদলাব বদলাব করে সাত দিন ধরে পরা সার্ট পায়জামা বদলানো হয়নি। সার্টটার হাতে দুটো ভয়ানকভাবে ময়লা হয়ে গেছে। পাজামাটা চটের থলে। হলঘরে অতগুলি লোকের দশা কি হতে পারে, সে কথা না ভেবেই নেহায়েত স্বার্থপরের মত মনে মনে বললাম, “ধরণী দ্বিধা হও”।
‘মুশকিলটা হয়েছে এই যে, আজ অফিসে কাজে আসার সময়ও দুদিন আগে পরা সার্ট পাজামা ভয়ানক ময়লা লাগল। না বদলে পারলাম না। অথচ আসতে আসতে যেসব মেহনতি মানুষ চোখে পড়েছে, তাদের অনেকেরই গায়ে কাজের জামা, আধ ময়লা জামা, নোংরা জামা, ছেঁড়া জামা। একজন আমার চেনা। সে একজন ফিটার। তার গায়ে দেখলাম, তেল কালিমাখা একটা হাফসার্ট। অথচ আমি জানি, উৎসবের দিনে এই লোকটি যে পোশাক পরিচ্ছদ পরে তা যেমন রুচিসম্মত, তেমনি প্রদীপ্ত। মানায়ও তাকে। মনে হয়, এ সম্পূর্ণ পৃথক একটি লোক, এর কিন্তু কাজের জামা পরতে মোটেই দ্বিধা জাগে বলে মনে হয় না। স্বচ্ছন্দে চলে গেল বুক ফুলিয়ে মহানগরীর ভিড় ঠেলে।’
‘বড় দোটানায় পড়ে গিয়েছি। ভাবছি, পকেট এ কলম, তার বদলে যদি হাতে একটা হাতুড়ি আর কিছু করার থাকতো তাহলে সম্ভবত এমন ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হতাম না। হয়েছি কলমজীবী, না ঘরকা না ঘাটকা।'
দীর্ঘ এই উদ্ধৃতি দেওয়া হলো। আমার মনে হয়, এ সময় রণেশ দাশগুপ্ত বেঁচে থাকলে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা আরও কিছুটা পাল্টাত। মানুষ দিনে দিনে আরও বেশি চতুর, দুর্নীতিবাজ, তেলবাজ হয়ে উঠেছে, সেটা দেখে তিনি হয়তো আরও বেশি কষ্ট পেতেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর যে বিশ্বাস ছিল, সে বিশ্বাসে আঘাত আসত কি না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যাঁরা পোড় খাওয়া মন ও শরীর নিয়ে পার্টি করে গেছেন, তাঁদের অনেকেই জীবিতাবস্থায় পার্টির নতুন নেতৃত্বের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তার ব্যতিক্রম নয়। নয়া নেতৃত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে যেভাবে দল চালিয়েছেন, তাতে আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে বড়সড় ভাবনা থাকলেও নিজ দেশ অনেক ক্ষেত্রেই ছিল আলোচনার বাইরে। অনেক বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রণেশ দাশগুপ্তদের মতো গুণী মানুষদের এড়িয়ে।
একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক জগতে ঝ্দানোভ চালিয়েছিলেন এক বীভৎস পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সৃজনশীলতার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন। লেখক, সাহিত্যিক, কবি পার্টির নির্দেশে লেখালেখি করতেন। সৃজনশীল মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় আঘাত আর কিছুই হতে পারে না। এই বীভৎসতার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনে। তার বিষে জর্জরিত হয়েছিল খোলা মনের মানুষ। এখন নানাভাবে সেই বীভৎসতার চিত্রগুলো তুলে আনা হচ্ছে। কিন্তু সে সময় এই নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির পক্ষেই গুণগান গাইছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতারা। ভারতবর্ষেও সেই চপেটাঘাত পড়েছিল। ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ নামে যে অশ্বডিম্বটি পাড়া হয়েছিল, সেটি যে মানবিক বিকাশের অন্তরায়, সে কথা বুঝতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। এ কারণেই বুঝি কমরেড ফরহাদ যখন ‘নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তখন তার সমালোচনা করতে হলো সনজীদা খাতুনকে।
সন্জীদা খাতুন তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি লেখার আগে রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের তো কোনো কথা জিজ্ঞেস করে না।’
কিন্তু পার্টির প্রতি অগাধ মমত্বের কারণে তিনি মলিনমুখে বলেছিলেন, ‘সেম সাইড হয়ে যায় না?’ অর্থাৎ কমরেড ফরহাদের লেখার বিরুদ্ধে সন্জীদা খাতুন লিখলে সেটা পার্টি লাইনের বাইরের কিছু হয় কি না, সে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি।
সে সময় যদি প্রতিবাদ করতেন তিনি বা তাঁর মতো বিচক্ষণ মানুষেরা, তাহলে পার্টি হয়তো তাঁদের দিকনির্দেশনায় ঋদ্ধ হতে পারত।
৮
রণেশ দাশগুপ্তের অসাধারণ একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ নামের বইয়ে। প্রবন্ধটির নাম, ‘বাংলাদেশ নয় এ মধুর খেলা রচয়িত্রীরা’।
মূলত বাংলাদেশের নারী লেখকদের নিয়ে প্রবন্ধটি। বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমামকে নিয়ে যখন তিনি এই প্রবন্ধ লিখছেন, তখন প্রথমজনের বয়স ৯২ এবং দ্বিতীয়জনের ৮২। এখন বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ বিভাজন মানা হয় না। সে সময় মানা হতো বলে লেখার শব্দগুলোকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে। তিনি লিখছেন, ‘বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমাম।... এই দুই প্রবীণা বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিভাবিকারূপে বিবেচিতা। বেগম সুফিয়া কামাল বিশ্বের দশক থেকেই বিশিষ্টা কবি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিষ্যা ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা সুফিয়া কামাল বরাবরই প্রগতিবাদিনী। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকা। যে মুক্তি ধারায় স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটল, তার সঙ্গে আপন চিন্তাভাবনা ও নারী সমাজের অন্তরঙ্গতা ও একাত্মতা প্রকাশের সহজ সরল বাণীরূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার জগত।... বেগম জাহানারা ইমাম ’৪৬-এ কলকাতা লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। রংপুরের মেয়ে জাহানারা ইমাম দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলায় চলে যান এবং বিবাহিত সাংসারিক জীবনযাপন করেন স্কুলশিক্ষকের কাজের পাশাপাশি। এই অবস্থান থেকেই বেগম জাহানারা ইমাম বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ও ব্যাপক গণহত্যা পতাকাবাহী নিরুপায় সামনে এসে গিয়েছেন।’
এ দুজনের কথা বলার পর রণেশ দাশগুপ্ত বলেছেন তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে। তিনি লিখছেন, ‘ঢাকা থেকে প্রকাশিত নির্বাচিত কলাম বইটিতে লেনিনের অনুসারী কমিউনিস্টদের যে উল্লেখ রয়েছে, তাতে কমিউনিস্টদের পুরুষ হিসেবে দেখিয়ে নারীদের ভালো-মন্দের প্রতি উদাসীন বলে ধিক্কার দেয়া হয়েছে। ঊনিশ শতকের জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলকে নারীর ভোটাধিকার বিরোধী বলে উপস্থিত করা হয়েছে। কিন্তু কলকাতা থেকে প্রকাশিত “নির্বাচিত কলাম” বইটিতে “যাব না কেন? যাব”কে যুক্ত করে যে সার্বিক বা পরিপূরক বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছে, তাতে ’৯০-৯১–এর সমাজতন্ত্রের সংকট ও লেনিনের অবমাননার এক বিস্ময়কর আবেগময় প্রস্তাবনা বেরিয়ে এসেছে লেখিকার কলম থেকে। এ ধরনের বক্তব্যকে হঠাৎ আলোর ঝলকানি বলে মনে করে নিলে ভুল হবে। এই কলামটিতে তসলিমা নাসরিন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনে লেনিনের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় শোকাহত মস্তক অবনত করেছেন।’
এরপর তিনি লেখক মতিয়া চৌধুরীর কথা বলেছেন। স্বনামধন্য এই রাজনীতির মানুষটি ষাটের দশকের শেষে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দৈনিক সংবাদে তিনি ধারাবাহিকভাবে জেলের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্ত লিখছেন, ‘মতিয়া চৌধুরী প্রধানত বাংলাদেশের বিপ্লবের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণের রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রতিনিধিরূপে বাংলাদেশের মুক্তির ধারাভাষ্য উপস্থিত করেছেন মুখ্যত বিশাল বিশাল জনসমাবেশ প্রদত্ত ভাষণে। সেই কারণে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এর বাইরে তার কোনো ভাষ্যকে পাওয়া যাবে না, তবে তার লেখা কারা কাহিনীটি দলিত বঞ্চিত নারী জীবনের ছবি দেশবাসীকে বিবেকের কাছে তীব্র ও তীক্ষ্ণতাবোধ উপস্থিত করেছিল।’
এরপর তিনি বলেছেন মালেকা বেগমের কথা, সেলিনা হোসেনের কথা, পান্না কায়সারের কথা।
এই প্রবন্ধটি পাঠ করতে বলব শুধু এই কারণে যে একজন লেখক তাঁর পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে নির্মোহ ভঙ্গিতে কীভাবে কোনো বই বা মানুষের বিশ্লেষণ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
৯
অগাধ পড়াশোনা করেছেন তিনি। বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই ছিলেন পারদর্শী। রাজনীতির মাঠে তিনি একজন নান্দনিক শিল্পী। সংস্কৃতিই ছিল তাঁর শক্তিমত্তার বড় জায়গা। রাজনীতির কথা বলতে গেলে ১৯৫৮ সালের মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনের কথা বলতে হয়। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। ৩৫টি পদের মধ্যে ২৫টিতে জয়ী হয় মুসলিম লীগ, বাকি পদগুলো পায় আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল।
একটি মাত্র পদে নির্বাচিত হয় কমিউনিস্ট প্রার্থী। নির্বাচিত প্রার্থীর নাম রণেশ দাশগুপ্ত।
১০.
বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তির আরেকটি অসামান্য কাজের কথা বলে লেখাটি শেষ করব।
তাঁর ছদ্মনাম ছিল জমিল শরাফী। দৈনিক সংবাদে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি বিভিন্ন বই সম্পাদনা করতেন। ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংকলন’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল জমিল শরাফীর সম্পাদনায়।
তবে দাদা জীবনানন্দ দাশের ওপর বই সম্পাদনা করেছেন তিনি স্বনামেই। ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার’ নামের বইটিই ছিল বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চার প্রথম উদ্যোগ। এই বইটিতেই জীবনানন্দের পুরো কাব্যসম্ভার এক মলাটের মধ্যে পায় বাংলাদেশের অধিবাসীরা।
১১
১৯৭৫ সালে এ দেশের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তা দেখেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। সে বছর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি ফিরতি বিমান টিকিটসহ কলকাতায় গিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ড। কলকাতায় থাকা অবস্থাতেই নভেম্বরের জেলহত্যার কথা শুনতে পান। বন্ধুরা এ সময় তাঁকে বাংলাদেশে ফিরতে নিষেধ করেন। সেই থেকে শুরু হয় কলকাতার জীবন। কিন্তু নিজেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষ ভাবতেই পছন্দ করতেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। ভারতীয় সরকারের কোনো ভাতা নেননি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। অনেক ঠিকানা বদলের পর তাঁর থাকার জায়গা হয় লেনিন স্কুলে। কায়ক্লেশে সেখানেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকিটা সময়। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি মারা যান। বাংলাদেশ-ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। ঢাকায়ই হয় তাঁর শেষকৃত্য। তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হলে শহীদ মিনারে বিপুল জনসমাগম হয়।
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
৮ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
৮ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
৮ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
৮ ঘণ্টা আগে