সৌভিক রেজা
একজন দৃঢ়চেতা মানুষ ও প্রতিভাবান সাহিত্যিক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামকে স্মরণ করেছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের অন্যতম শরিক আবুল ফজল। তাঁর বক্তব্য থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই নজরুল বাংলা সাহিত্যের আসরে উপস্থিত হয়েছিলেন। যদিও সেই প্রস্তুতির ইতিহাস তেমন একটা বিশদ জানা যায় না। প্রস্তুতি পর্বের ইতিহাস কালানুক্রমিকভাবে জানা না গেলেও তাঁর সেই প্রতিভার বিশিষ্টতার কথা, সমকালে ও পরবর্তী সময়ে, মোটামুটিভাবে আমাদের সাহিত্যের বিশিষ্টজনেরা স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
২. এই যে আমরা ‘প্রতিভা’র কথা বলছি, সেই ব্যাপারটি আদতে কী জিনিস? এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমাদের কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রতিভার মধ্যে অলৌকিকের একটা আভাস পেয়েও বুদ্ধদেব বসু এর মধ্যে দেখেছিলেন ‘বুদ্ধির দীপ্তি’, যাকে কিনা তাঁর ‘মেধার নামান্তর’ বলেই মনে হয়েছিল। বুদ্ধদেব বসুর মতে, ‘প্রতিভাকে উন্নত বুদ্ধি ভাবলে কবি হয়ে ওঠেন এমন এক ব্যক্তি, যাঁর ধীশক্তি কোনো কোনো ব্যক্তিগত বা ঐতিহাসিক কারণে কাব্যরচনায় নিয়োজিত’ রয়েছে। অন্যদিকে, বিশিষ্ট ভারতীয় মনোবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী সুধীর কাকর একজন প্রতিভাধর মানুষের জীবনে ‘গুণগতভাবে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র’ এক ‘অনন্যসাধারণ সৃষ্টিশীলতা’ দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর এটিও মনে হয়েছিল যে, ‘সাধারণ মানের যে সৃষ্টিশীলতা তা আমাদের আনন্দ দিতে পারে, কখনো হয়তো অন্তর্দৃষ্টিও। কিন্তু কোনো প্রতিভার সৃষ্টিসম্ভার, সে শিল্পজগতেই হোক কি বিজ্ঞানজগতেই হোক, তা তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষেত্রসীমা অতিক্রম করে ভবিষ্যতে সেই পরিমণ্ডলের দিকনির্ণয়কেই গভীরভাবে প্রভাবিত করবে।’
৩. কাজী নজরুল ইসলামে ক্ষেত্রে কি এই ব্যাপারটিই আমরা সুনির্দিষ্টভাবে দেখতে পাই না? নতুবা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কেনই বা বলেছিলেন, ‘নজরুল কবি...প্রতিভাবান মৌলিক কবি।...আমি এই ভেবে বিপুল আনন্দ অনুভব করছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি বাংলার কবি, বাঙালির কবি!...কবিরা সাধারণত কোমল ও ভীরু, কিন্তু নজরুল তা নন। কারাগারের শৃঙ্খল পরে বুকের রক্ত দিয়ে তিনি যা লিখেছেন তা বাঙালির প্রাণে এক নতুন স্পন্দন জাগিয়ে তুলেছে।’ এর পাশাপাশি আমরা যদি জীবনানন্দ দাশের কথা খেয়াল করি, তাহলে দেখতে পাব যে, তিনি বলছেন, ‘প্রত্যেক মনীষারই একটি বিশেষ প্রতিভা থাকে; নিজের রাজ্যেই সে সিদ্ধ। কবির সিদ্ধিও তার নিজের জগতে; কাব্যসৃষ্টির ভেতরে।’ কবি ও তাঁর কাব্যের সঙ্গে প্রতিভার সংশ্লেষকে, তার সংযোজনকে চিহ্নিত করতে ভুল করেননি জীবনানন্দ দাশ। সেই কারণে তাঁর পক্ষে এইটিও বলা সম্ভব হয়েছিল যে, ‘তার প্রতিভার কাছে কবিকে বিশ্বস্ত থাকতে হবে; হয়তো কোনও একদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে তার কবিতাবৃত্ত প্রয়োজন হবে সমস্ত চরাচরের সমস্ত জীবের হৃদয়ে মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ ফসলের খেতে বুননের জন্যে।’ নজরুল তাঁর কাব্যিক মনের হাটে শুধুই আল্লা নামের বীজ বোনেননি [‘আল্লা নামের বীজ বুনেছি এবার মনের মাঠে’], কাব্যের বীজও বুনেছিলেন। আর সেই কাজটা করতে পেরেছিলেন সচেতনভাবে নিজের উপর আস্থা রেখে। এইটা শুধু নজরুলের বেলায়ই নয়, সব সার্থক কবির ক্ষেত্রেই সত্যি। যে-কারণে বুদ্ধদেব বসু বলেন, ‘তন্ময়ভাবে কিছু রচনা করতে হলে প্রথমেই চাই আস্থা; আস্থা নিজের উপর, অচেতনভাবে মানব-সংসারের উপরেও, মানুষের মনুষ্যত্ব ও সভ্যতার স্থায়িত্বের উপর; এক কথায়, আমরা যাকে অস্পষ্ট ‘জীবন’ বলি তার উপর।’ নজরুল ইসলাম এসবের বাইরে গিয়ে কিছু করেননি বা করবার চেষ্টা করেননি। এইটি তাঁর শিল্পিত মনের মাত্রাজ্ঞানেরই পরিচয়।
৪. নজরুলের এই শিল্পিত মনের মাত্রাজ্ঞানটাকে নিজের মতো করে বুঝে নিতে রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্র বসুরও খুব-একটা কষ্ট হয়নি। আর তাই তো তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীন দেশে জীবনের সহিত সাহিত্যের স্পষ্ট সম্বন্ধ আছে। আমাদের দেশে তা নাই। দেশ পরাধীন বলে এদেশের লোকেরা জীবনের সকল ঘটনা থেকে উপাদান সংগ্রহ করতে পারে না। নজরুলে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। নজরুল জীবনের নানাদিক থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন।...এতেই বুঝা যায় যে নজরুল একটা জীবন্ত মানুষ।’ নজরুলকে জীবন্ত মানুষ আখ্যা দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, সেইসঙ্গে এই কথাগুলোও বলেছিলেন, ‘কারাগারে আমরা অনেকে যাই; কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেই জেল-জীবনের প্রভাব কমই দেখতে পাই। তার কারণ অনুভূতি কম। কিন্তু নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর লেখার মধ্যে অনেক স্থানেই পাওয়া যায়। এতেও বুঝা যায় যে, তিনি একটা জ্যান্ত মানুষ।’ কাজী নজরুল ইসলামকে তিনিও ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে স্বীকার করে জানিয়েছিলেন, ‘নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়—এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্ট বুঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব—তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব।’ কথাগুলো অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি।
৫. রাজনীতিবিদ হয়েও সুভাষচন্দ্র বসু যে-কথা জোর দিয়ে বলতে পেরেছিলেন, একজন কবি হয়েও গোলাম মোস্তফা সেই সামর্থ্য অর্জন করতে পারেননি। আর তাই তো আমরা দেখি যে নজরুলকে পাকিস্তানের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেবার বিষয়ে তিনি তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। গোলাম মোস্তফা যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘নজরুলকে পাকিস্তানের জাতীয় কবি বলিয়া অনেকে মনে করেন। কিন্তু নজরুলের সবচেয়ে বড় অপবাদ যদি কিছু থাকে, তবে এই। নজরুল যা নন, তাঁর উপর তাই আরোপ করিলে তাঁকে হেয় করা হয়।’ নজরুলের অপরাধ হচ্ছে এই যে, ‘পাকিস্তানের কবি হওয়া তো দূরের কথা, নজরুল ছিলেন ঘোর পাকিস্তানবিরোধী। তিনি গাহিয়াছিলেন ‘অখণ্ড ভারতের’ গান।’ শুধু এইটুকুই নয়, গোলাম মোস্তফা এ-ও মনে করতেন যে, নজরুলের কাব্যে রয়েছে ‘ইসলামের সনাতন আদর্শের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ কথা’।
৬. শুধুই ইসলাম ধর্ম নয়, সেদিনের ‘পাকিস্তানের আদর্শ ও ধ্যান-ধারণার বিপরীত কথা’ও নজরুলের সাহিত্যে গোলাম মোস্তফা দেখতে পেয়েছিলেন। অন্যদিকে আবার গোলাম মোস্তফার সম্পূর্ণ বিপরীত কাব্যাদর্শে বিশ্বাসী হয়েও হুমায়ুন আজাদের মতো খ্যাতিমান অধ্যাপক-সমালোচক তাঁর নজরুল-সাহিত্যপাঠের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তরুণ বয়স থেকেই অস্বস্তি বোধ করি আমি নজরুলের লেখা পড়ার সময়; তিনি মাঝারি লেখক বলে নয়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিভ্রান্ত লেখক বলে। তিনি ভারী বোঝার মতো চেপে বসে আছেন বাঙালি মুসলমানের ওপর।’ তাঁর কাছে নজরুলকে মনে হয়েছে, ‘বাঙলা ভাষার বিভ্রান্ত কুসংস্কার-উদ্দীপ্ত লেখকদের মধ্যে প্রধান।’ আমরা বুঝতে পারি যে কাব্য বিষয়ে গোলাম মোস্তফার ধারণা যেমন ঠিক তেমনই হুমায়ুন আজাদের ধারণা মারাত্মভাবে একমুখীন। এঁদের দুজনের কেউই কাব্যের বৈচিত্র্য, এর উপসর্গগুলো ঠিকভাবে বুঝতেন কিনা, সেই সন্দেহ খানিকটা রয়েই যায়। একজন কবির চেতনায় কাব্যের নানান লক্ষণের উপস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে মণীন্দ্র গুপ্ত আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘একজন প্রকৃত কবির চেতনায় জীবন ও পৃথিবী সবসময়েই অফুরান। প্রেমের কবিতার পরে অপ্রেমের কবিতা, উদাসীনতার কবিতা, শান্তির কবিতা, একাকীত্বের কবিতা, ভয়ের কবিতা, মৃত্যুর কবিতা আসতে পারে। নিজেকে ছাড়িয়ে আরো কত বিচিত্র কবিতা আসতে পারে।’ কবির চেতনায় জারিত এই বৈচিত্র্যই হচ্ছে কবিতার আধুনিকতার প্রধানতম লক্ষণ।
৭. বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ‘একটি ভালো রচনা সমস্ত সমালোচনার সারাৎসার।’ নজরুল ইসলামের সাহিত্য আমাদেরকে জীবনের সেই সারাৎসারকেই নানাভাবে উপলব্ধি করায়। কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর সাহিত্যকর্মকে আমরা যে আজ নানাভাবে সমাদর করি, তার অন্যতম প্রধান কারণ ঠিক এখানেই নিহিত রয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
একজন দৃঢ়চেতা মানুষ ও প্রতিভাবান সাহিত্যিক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামকে স্মরণ করেছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের অন্যতম শরিক আবুল ফজল। তাঁর বক্তব্য থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই নজরুল বাংলা সাহিত্যের আসরে উপস্থিত হয়েছিলেন। যদিও সেই প্রস্তুতির ইতিহাস তেমন একটা বিশদ জানা যায় না। প্রস্তুতি পর্বের ইতিহাস কালানুক্রমিকভাবে জানা না গেলেও তাঁর সেই প্রতিভার বিশিষ্টতার কথা, সমকালে ও পরবর্তী সময়ে, মোটামুটিভাবে আমাদের সাহিত্যের বিশিষ্টজনেরা স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
২. এই যে আমরা ‘প্রতিভা’র কথা বলছি, সেই ব্যাপারটি আদতে কী জিনিস? এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমাদের কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রতিভার মধ্যে অলৌকিকের একটা আভাস পেয়েও বুদ্ধদেব বসু এর মধ্যে দেখেছিলেন ‘বুদ্ধির দীপ্তি’, যাকে কিনা তাঁর ‘মেধার নামান্তর’ বলেই মনে হয়েছিল। বুদ্ধদেব বসুর মতে, ‘প্রতিভাকে উন্নত বুদ্ধি ভাবলে কবি হয়ে ওঠেন এমন এক ব্যক্তি, যাঁর ধীশক্তি কোনো কোনো ব্যক্তিগত বা ঐতিহাসিক কারণে কাব্যরচনায় নিয়োজিত’ রয়েছে। অন্যদিকে, বিশিষ্ট ভারতীয় মনোবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী সুধীর কাকর একজন প্রতিভাধর মানুষের জীবনে ‘গুণগতভাবে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র’ এক ‘অনন্যসাধারণ সৃষ্টিশীলতা’ দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর এটিও মনে হয়েছিল যে, ‘সাধারণ মানের যে সৃষ্টিশীলতা তা আমাদের আনন্দ দিতে পারে, কখনো হয়তো অন্তর্দৃষ্টিও। কিন্তু কোনো প্রতিভার সৃষ্টিসম্ভার, সে শিল্পজগতেই হোক কি বিজ্ঞানজগতেই হোক, তা তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষেত্রসীমা অতিক্রম করে ভবিষ্যতে সেই পরিমণ্ডলের দিকনির্ণয়কেই গভীরভাবে প্রভাবিত করবে।’
৩. কাজী নজরুল ইসলামে ক্ষেত্রে কি এই ব্যাপারটিই আমরা সুনির্দিষ্টভাবে দেখতে পাই না? নতুবা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কেনই বা বলেছিলেন, ‘নজরুল কবি...প্রতিভাবান মৌলিক কবি।...আমি এই ভেবে বিপুল আনন্দ অনুভব করছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি বাংলার কবি, বাঙালির কবি!...কবিরা সাধারণত কোমল ও ভীরু, কিন্তু নজরুল তা নন। কারাগারের শৃঙ্খল পরে বুকের রক্ত দিয়ে তিনি যা লিখেছেন তা বাঙালির প্রাণে এক নতুন স্পন্দন জাগিয়ে তুলেছে।’ এর পাশাপাশি আমরা যদি জীবনানন্দ দাশের কথা খেয়াল করি, তাহলে দেখতে পাব যে, তিনি বলছেন, ‘প্রত্যেক মনীষারই একটি বিশেষ প্রতিভা থাকে; নিজের রাজ্যেই সে সিদ্ধ। কবির সিদ্ধিও তার নিজের জগতে; কাব্যসৃষ্টির ভেতরে।’ কবি ও তাঁর কাব্যের সঙ্গে প্রতিভার সংশ্লেষকে, তার সংযোজনকে চিহ্নিত করতে ভুল করেননি জীবনানন্দ দাশ। সেই কারণে তাঁর পক্ষে এইটিও বলা সম্ভব হয়েছিল যে, ‘তার প্রতিভার কাছে কবিকে বিশ্বস্ত থাকতে হবে; হয়তো কোনও একদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে তার কবিতাবৃত্ত প্রয়োজন হবে সমস্ত চরাচরের সমস্ত জীবের হৃদয়ে মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ ফসলের খেতে বুননের জন্যে।’ নজরুল তাঁর কাব্যিক মনের হাটে শুধুই আল্লা নামের বীজ বোনেননি [‘আল্লা নামের বীজ বুনেছি এবার মনের মাঠে’], কাব্যের বীজও বুনেছিলেন। আর সেই কাজটা করতে পেরেছিলেন সচেতনভাবে নিজের উপর আস্থা রেখে। এইটা শুধু নজরুলের বেলায়ই নয়, সব সার্থক কবির ক্ষেত্রেই সত্যি। যে-কারণে বুদ্ধদেব বসু বলেন, ‘তন্ময়ভাবে কিছু রচনা করতে হলে প্রথমেই চাই আস্থা; আস্থা নিজের উপর, অচেতনভাবে মানব-সংসারের উপরেও, মানুষের মনুষ্যত্ব ও সভ্যতার স্থায়িত্বের উপর; এক কথায়, আমরা যাকে অস্পষ্ট ‘জীবন’ বলি তার উপর।’ নজরুল ইসলাম এসবের বাইরে গিয়ে কিছু করেননি বা করবার চেষ্টা করেননি। এইটি তাঁর শিল্পিত মনের মাত্রাজ্ঞানেরই পরিচয়।
৪. নজরুলের এই শিল্পিত মনের মাত্রাজ্ঞানটাকে নিজের মতো করে বুঝে নিতে রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্র বসুরও খুব-একটা কষ্ট হয়নি। আর তাই তো তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীন দেশে জীবনের সহিত সাহিত্যের স্পষ্ট সম্বন্ধ আছে। আমাদের দেশে তা নাই। দেশ পরাধীন বলে এদেশের লোকেরা জীবনের সকল ঘটনা থেকে উপাদান সংগ্রহ করতে পারে না। নজরুলে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। নজরুল জীবনের নানাদিক থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন।...এতেই বুঝা যায় যে নজরুল একটা জীবন্ত মানুষ।’ নজরুলকে জীবন্ত মানুষ আখ্যা দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, সেইসঙ্গে এই কথাগুলোও বলেছিলেন, ‘কারাগারে আমরা অনেকে যাই; কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেই জেল-জীবনের প্রভাব কমই দেখতে পাই। তার কারণ অনুভূতি কম। কিন্তু নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর লেখার মধ্যে অনেক স্থানেই পাওয়া যায়। এতেও বুঝা যায় যে, তিনি একটা জ্যান্ত মানুষ।’ কাজী নজরুল ইসলামকে তিনিও ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে স্বীকার করে জানিয়েছিলেন, ‘নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়—এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্ট বুঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব—তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব।’ কথাগুলো অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি।
৫. রাজনীতিবিদ হয়েও সুভাষচন্দ্র বসু যে-কথা জোর দিয়ে বলতে পেরেছিলেন, একজন কবি হয়েও গোলাম মোস্তফা সেই সামর্থ্য অর্জন করতে পারেননি। আর তাই তো আমরা দেখি যে নজরুলকে পাকিস্তানের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেবার বিষয়ে তিনি তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। গোলাম মোস্তফা যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘নজরুলকে পাকিস্তানের জাতীয় কবি বলিয়া অনেকে মনে করেন। কিন্তু নজরুলের সবচেয়ে বড় অপবাদ যদি কিছু থাকে, তবে এই। নজরুল যা নন, তাঁর উপর তাই আরোপ করিলে তাঁকে হেয় করা হয়।’ নজরুলের অপরাধ হচ্ছে এই যে, ‘পাকিস্তানের কবি হওয়া তো দূরের কথা, নজরুল ছিলেন ঘোর পাকিস্তানবিরোধী। তিনি গাহিয়াছিলেন ‘অখণ্ড ভারতের’ গান।’ শুধু এইটুকুই নয়, গোলাম মোস্তফা এ-ও মনে করতেন যে, নজরুলের কাব্যে রয়েছে ‘ইসলামের সনাতন আদর্শের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ কথা’।
৬. শুধুই ইসলাম ধর্ম নয়, সেদিনের ‘পাকিস্তানের আদর্শ ও ধ্যান-ধারণার বিপরীত কথা’ও নজরুলের সাহিত্যে গোলাম মোস্তফা দেখতে পেয়েছিলেন। অন্যদিকে আবার গোলাম মোস্তফার সম্পূর্ণ বিপরীত কাব্যাদর্শে বিশ্বাসী হয়েও হুমায়ুন আজাদের মতো খ্যাতিমান অধ্যাপক-সমালোচক তাঁর নজরুল-সাহিত্যপাঠের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তরুণ বয়স থেকেই অস্বস্তি বোধ করি আমি নজরুলের লেখা পড়ার সময়; তিনি মাঝারি লেখক বলে নয়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিভ্রান্ত লেখক বলে। তিনি ভারী বোঝার মতো চেপে বসে আছেন বাঙালি মুসলমানের ওপর।’ তাঁর কাছে নজরুলকে মনে হয়েছে, ‘বাঙলা ভাষার বিভ্রান্ত কুসংস্কার-উদ্দীপ্ত লেখকদের মধ্যে প্রধান।’ আমরা বুঝতে পারি যে কাব্য বিষয়ে গোলাম মোস্তফার ধারণা যেমন ঠিক তেমনই হুমায়ুন আজাদের ধারণা মারাত্মভাবে একমুখীন। এঁদের দুজনের কেউই কাব্যের বৈচিত্র্য, এর উপসর্গগুলো ঠিকভাবে বুঝতেন কিনা, সেই সন্দেহ খানিকটা রয়েই যায়। একজন কবির চেতনায় কাব্যের নানান লক্ষণের উপস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে মণীন্দ্র গুপ্ত আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘একজন প্রকৃত কবির চেতনায় জীবন ও পৃথিবী সবসময়েই অফুরান। প্রেমের কবিতার পরে অপ্রেমের কবিতা, উদাসীনতার কবিতা, শান্তির কবিতা, একাকীত্বের কবিতা, ভয়ের কবিতা, মৃত্যুর কবিতা আসতে পারে। নিজেকে ছাড়িয়ে আরো কত বিচিত্র কবিতা আসতে পারে।’ কবির চেতনায় জারিত এই বৈচিত্র্যই হচ্ছে কবিতার আধুনিকতার প্রধানতম লক্ষণ।
৭. বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ‘একটি ভালো রচনা সমস্ত সমালোচনার সারাৎসার।’ নজরুল ইসলামের সাহিত্য আমাদেরকে জীবনের সেই সারাৎসারকেই নানাভাবে উপলব্ধি করায়। কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর সাহিত্যকর্মকে আমরা যে আজ নানাভাবে সমাদর করি, তার অন্যতম প্রধান কারণ ঠিক এখানেই নিহিত রয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্ব’র তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে।
৮ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয়, করোনাকালই বোধহয় ভালো ছিল। শাটডাউনে সব বন্ধ, রাস্তায় যানবাহন নেই, মানুষের চলাচল সীমিত, যারাও বাইরে যাচ্ছে তাদের মুখে মাস্ক পরা। রাস্তার ধারের গাছগুলোতে ধুলার পর্দা পড়ছে না, কলকারখানার চোঙা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে না, বায়ুদূষণও কমে এসেছে। এক অদেখা জীবাণুর আতঙ্কে আমাদের কী দুঃসময়ই না কেট
৮ ঘণ্টা আগেতিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন মেজ। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি।
৯ ঘণ্টা আগেমঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেটে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ যেভাবে হকাররা দখল করে রাখেন, তাতে চলাচলে অসুবিধা হয় রাজধানীবাসীর। তাই ব্যস্ত সড়ক হকারমুক্ত করতে পারলে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী সাধুবাদ পাবে।
৯ ঘণ্টা আগে