শিমুল খালেদ
সকালবেলার চন্দ্রঘোনা। কুয়াশার আচ্ছাদন থেকে চারপাশ আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতে শুরু করেছে কেবল। রাঙ্গুনিয়া লিচুবাগান হয়ে আমরা যখন চন্দ্রঘোনা বাজারে পৌঁছাই, বেলা বাড়ার সঙ্গে মফস্বল শহরটিও ব্যস্ত হয়ে উঠছে। দূর পাহাড়ের জুমে ফলানো আনারস এক জায়গায় স্তূপ করে রাখা; গায়ের চাদর একপাশে রেখে মিঠে রোদ গায়ে মাখতে মাখতে মধ্যবয়সী বিক্রেতা বেতের মোড়া পেতে বসেছেন। ধাতব শব্দ তুলে দোকানের শাটার একটা-দুটো করে উঠতে শুরু করেছে।
দীর্ঘ ভ্রমণের পর আড়ষ্ট হয়ে থাকা শরীর এক-আধটু কসরতের জন্য মুখিয়ে ছিল। তবে সেই আশায় গুঁড়েবালি। সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকের তাড়া—তড়িঘড়ি ওঠে পড়তে হবে। তিন চাকায় চড়িয়ে নিয়ে যাবে আমাদের গন্তব্যস্থল কাপ্তাইয়ে, কর্ণফুলী নদীর তীরসংলগ্ন ক্যাম্পসাইটে। সারা রাত সিলেট-চট্টগ্রাম ট্রেন ভ্রমণের পর ভোরবেলায় বাস, অতঃপর অটোরিকশায় প্রায় ষোলো ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রা শেষ হচ্ছে। রাঙামাটিতে এটা আমার প্রথম ভ্রমণ এবং এই আসাটাও হুটহাট করেই।
সপ্তাহের মাঝামাঝি এক সকালবেলার কথা। সেদিন সকাল সকাল অচেনা নম্বর থেকে ফোনে একটা এসএমএস আসে। আমেরিকাপ্রবাসী বন্ধু রাফাত আনসারী সেটি পাঠিয়েছে। মেসেজের সারমর্ম, সে দুই দিন আগে দেশে ছুটিতে এসেছে এবং সপ্তাহের শেষ দিকে কয়েকজন মিলে রাঙামাটি বেড়াতে যাচ্ছে। আমাকেও সেই দলের সদস্য ধরে নিয়ে ইতিমধ্যে ট্রেনের টিকিটও কেটে ফেলেছে। আমি যেন অমত না করি!
পাহাড়ের গা পেঁচিয়ে ফিতার মতো চলে যাওয়া পিচঢালা পথ ধরে ছোট বাহনজোড়া চলতে থাকল। মাঝে মাঝে একটা-দুটো সিঁড়িপথ চোখে পড়ল, মূল পথ থেকে ওপরের দিকে উঠে গেছে, পাহাড়ের চূড়ায় বাংলো আকৃতির একটা-দুটো কুটির। যেতে যেতে পথের দুপাশ ঘন সবুজ হয়ে ওঠে। বনানীর চেহারাও পাল্টায়। পাহাড়জুড়ে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা বনের ঠাসবুনোট, বনতলে লতাগুল্ম কন্দজাতীয় উদ্ভিদের আচ্ছাদন। আন্দাজ করি, কাপ্তাইয়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমায় চলে এসেছি। পথের ধারে সাঁটানো সাইনবোর্ড দেখে নিশ্চিত হলাম কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান হয়েই যাচ্ছি।
অরণ্যের বুনো স্পর্শ মেখে চোখেমুখে আছড়ে পড়ছে পৌষের বাতাস। গন্তব্যস্থল কাপ্তাই প্রশান্তি পার্কের ফটকের সামনে ইতিমধ্যে এসে পড়েছি। ঘড়ির কাঁটা বলছে, সবে দুপুর হতে চলেছে। আমরা এসেছি ক্যাম্পিং ট্যুরে। তাই আপাতত বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে সবার ব্যাগ-ব্যাগেজ রাখার জন্য একটা রুম পাওয়া গেল। সেখানে ব্যাগপত্র রেখে ছাউনিতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চলে গেলাম নদীর একদম তীরে।
খরস্রোতা কর্ণফুলীর কলকল স্রোত বয়ে চলেছে জীবনের উচ্ছ্বাসে। নদীর একদম পাশ ঘেঁষে পার্ক কর্তৃপক্ষের বানানো একটা মাচাঘর। ওপরে শণ ও বেত, মেঝে মুলিবাঁশ দিয়ে তৈরি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সাত-পাঁচ না ভেবেই মাচার মেঝেতে শুয়ে পড়ি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দল ভারী করতে যোগ দেয় রাফাত ও রুবেল। শীত ঋতুর শান্ত সৌম্য কর্ণফুলী। উজ্জ্বল সূর্যালোকে ঝলমল করছে ছোট ছোট ঢেউ কিংবা অল্পস্বল্প নড়াচড়া।
নদী পেরিয়ে ওই পাশে শিলাপাথরের পাহাড়, তার গায়ে ঘন পাহাড়ি বন। দীর্ঘ ভ্রমণের পর গা এলানোর সুযোগ পেয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে, শীতে দুপুরের ফুরফুরে শীতল হাওয়া গায়ে মেখে কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম ঠিক জানি না। বছর ষোলোর ছিপছিপে গড়নের এক কিশোরের গলার আওয়াজে সংবিৎ ফিরল। ঘাটে কায়াক প্রস্তুত; আমাদের কায়াকিংয়ের সময় হয়ে গেছে। মরা ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো একটি গাছের নিচে অপেক্ষমাণ রংবেরঙের কয়েকটি কায়াক। চারটি নৌকার প্রতিটিতে দুজন করে ভাগ হয়ে আমরা আটজন চেপে কর্ণফুলীর টলমলে জলে নেমে পড়ি।
একদম প্রথম বোটের সামনের সিটে আমি, পেছনের সিটে সঙ্গী সুমন। বোটগুলোর প্রতিটির জন্য একটা করেই বইঠা বরাদ্দ। দুপাশে পাখা লাগানো বইঠা ঠেলতে ঠেলতে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল। এ এক আজব জলতরি, যেটার পেটের ভেতরে ঢুকলে অর্ধেক শরীর ঢুকে যায় আন্ডারওয়াটার বা পানির তলায়! বেশ রোমাঞ্চ লাগছিল। পানিতে বইঠার চাপে কায়াক ছুটতে থাকে। ভাটি ধরে যেতে যেতে আমরা দেখতে থাকি নদীতীরের দিনযাপন। পানিতে হাপুস-হুপুস করছিল ছেলেপুলেদের একটা দল। আরেকটু সামনে যেতেই দেখলাম ছোট জাল নদী থেকে তুলে তা থেকে মাছ ধরে খলুইতে রাখছেন এক জেলে দম্পতি।
বইঠা বাইতে বাইতে খেয়াল করলাম, নদীর ঠিক মাঝামাঝি চলে এসেছি। আর সেখান থেকে চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্যপট। নদীর মাঝ বরাবর পানির সমতলের দেড়-দুই ফুট ওপর থেকে সামনে তাকালে ভাটির পানে বয়ে যাওয়া জলস্রোত পেরিয়ে দুই পাড়জুড়ে ঘন অরণ্যঢাকা পাহাড়শ্রেণি। নদীর গা ঘেঁষা সেই পাহাড় পেরিয়ে পেছনে উঁকি দিচ্ছে আরও উঁচু পাহাড়। তারপর আরও উঁচু পাহাড় স্তর। অপূর্ব সেই দৃশ্য!
সীতা পাহাড় আর রাম পাহাড় নামের এই পাহাড়ের মধ্য দিয়েই খরস্রোতা কর্ণফুলী প্রবাহিত হয়েছে। কর্ণফুলীর উচ্ছল স্রোতোধারা আর চারপাশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট জন্ম দিয়েছে না জানি কত শত ছন্দ আর কবিতার! প্রেমের কবি নজরুল তাই তো কর্ণফুলীকে ভালোবেসে লিখেছিলেন, ‘তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি, তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে, সাম্পান নায়ে ফিরেছিল তার-দয়িতের সন্ধানে, আনমনে তার খুলে গেল খোঁপা, কানফুল গেল খুলি, সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হলে কি কর্ণফুলী?’
কর্ণফুলী নদীর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা কাহিনি শোনা যায়। তবে সবচেয়ে প্রচলিত গল্পটি হচ্ছে—আরাকানের এক রাজকন্যা চট্টগ্রামের এক রাজপুত্রের প্রেমে পড়ে। এক জ্যোৎস্না রাতে তারা দুজন এই নদীতে নৌভ্রমণ উপভোগ করছিল। নদীর পানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখার সময় রাজকন্যার কানে গোঁজা একটি ফুল পানিতে পড়ে যায়। ফুলটি হারিয়ে কাতর রাজকন্যা সেটি উদ্ধারের জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু প্রবল স্রোতে রাজকন্যা ভেসে যায়, তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
রাজপুত্র রাজকন্যাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দেয়, কিন্তু সফল হয়নি। প্রিয়তমার শোকে রাজপুত্র পানিতে ডুবে আত্মাহুতি দেয়। করুণ এই কাহিনি থেকেই নদীটির নাম হয় কর্ণফুলী। মারমা জনগোষ্ঠীর কাছে এর নাম কিনসা খিয়ং। উজানে সীমান্তের ওপারে মিজোরামে কর্ণফুলীকে ডাকা হয় খাওৎলাং তুইপুই নামে।
বইঠা থামিয়ে মাঝ নদীতে থেমে ভরদুপুরের মৌনতা কিছুক্ষণ উপভোগ করে তারপর কায়াকের মাথা নদীর অপর পাশ অভিমুখে ঘুরালাম। সেখানে কয়েকজন জেলে পাথুরে পাহাড়ের দেয়াল ঘেঁষে নৌকা নিয়ে একদম স্থির বসে ছিল। চোখে শ্যেনদৃষ্টি; নিবদ্ধ নদীর পানির দিকে। যেন স্রোতের ভেতরে কোনো বিশেষ নড়াচড়ার অপেক্ষায়। পাহাড়ের পাথুরে শিলা উপরিভাগে যতটা দৃশ্যমান হয়; তার চেয়েও নদীর তলদেশে লুকিয়ে থাকা অংশ খুব একটা কম নয়। জেলেদের সঙ্গে আলাপে জানলাম, নদীর এই অংশে গভীরতা ৩৫-৪০ ফুটের মতো।
খেয়াল করলাম, নদীর অপরাপর দিকে পানি বাতাসে মৃদু ঢেউ খেলানো থাকলেও এখানে একদম স্থির। উজান থেকে নেমে আসা স্রোতে পাথুরে দেয়ালে বাধা পেয়ে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছিল। লাইফ জ্যাকেট পরা থাকলেও সঙ্গী সুমন সাঁতার জানেন না। তাই সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে এপাশে ঘাটের দিকে চলে আসি। কায়াক পর্ব শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর লাঞ্চের ডাক পড়ে। পরের গন্তব্য কাপ্তাই হ্রদ।
পার্কের ফটক থেকে কাপ্তাই সদর অভিমুখে চলে যাওয়া পথের পুরোটাই ক্রমশ ওপরের দিকে উঠে গেছে। এক পাশে সংরক্ষিত পাহাড়ি বনভূমি, অপর পাশে বেশ নিচে কর্ণফুলী। কাপ্তাই সদরে বাহন থেকে মাটিতে পা ফেলার আগেই চোখে পড়ল কাপ্তাই হ্রদের অবারিত জলরাশি। নৌকাঘাট সামনেই। ডানের রাস্তাটি চলে গেছে জলবিদ্যুৎ বাঁধের দিকে। বাহন থেকে নেমে প্রথমেই কানে এল মধ্যবয়সী এক নারীকণ্ঠ—মামা, লেকে ঘুরবেন, সাম্পান দিয়া?
ঘাটে গিয়ে দরদাম শেষে আটজনের দলের জন্য একটা জুতসই লঞ্চ নেওয়া হলো। লঞ্চের চালকই গাইড। কাপ্তাই হ্রদের জলরাশিতে আলোড়ন তুলে ছুটে চলল জলযান। দূরে এক-দুটো সাম্পান নৌকা ভাসতে দেখলাম। নৌকার দুপাশে একজোড়া বইঠা। বইঠা দুটো গলুইয়ের দুপাশ থেকে উঠে গিয়ে তার হাতল একসঙ্গে বাঁধা হয়েছে কোমরসমান উঁচুতে। মাঝিকে তাই দাঁড়িয়ে ঠেলতে হচ্ছিল বইঠাযুগল। ছোট নৌকা, তাই দুজন করেই যাত্রী দেখলাম। লঞ্চ আস্তে আস্তে হ্রদের গভীরের দিকে যাচ্ছে আর আমরা যেন ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছি নীলাভ কোনো রাজ্যপাটে!
হ্রদের নীল জল যেন সুনয়নার নীলচক্ষু! জলরাশির মাঝে সবুজ দ্বীপের মতো জেগে আছে একেকটা টিলা। টিলাগুলোর বেশির ভাগেই জনবসতি নেই। নীল আর সবুজ মিলেমিশে দৃষ্টিতে মুগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দিতে থাকল। ভাসতে ভাসতে অন্য নৌকায় যাত্রী হওয়া পাহাড়ের স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়। দূরে, বহু দূরে আবছা অবয়বে কয়েক স্তরের পাহাড়শ্রেণি। মাঝি বলল, পাহাড়ের ওই গহিনে মিজোরাম সীমান্ত। আরও কিছুক্ষণ হ্রদে ভাসার পর একটি টিলার পাশে লঞ্চ নোঙর করা হলো।
একটা বয়সী পাকুড়গাছ দাঁড়িয়ে আছে পাকা সিঁড়ি বাঁধানো ঘাটে। টিলার ওপর একটা বাজার। নেমে পা বাড়াই সেদিকে। বাজারটির ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই চাকমা। ছোট ছোট দোকান। বয়সী কয়েকজন প্রৌঢ় এক জায়গায় জটলা বেঁধে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। কথা চলছিল তাঁদের মাতৃভাষায়। টিলার ওপর বাজারের শেষ মাথায় অল্পনা চাকমা দিদির ছোট্ট খাবারের দোকান। কড়াইয়ের গরম তেলে পিঠা ভাজা হচ্ছিল। নারকেলের টুকরো আর গুড়ের সঙ্গে ময়দার মিশ্রণে বানানো লালচে রঙের সেই পিঠার স্বাদ মুখে লেগে আছে এখনো।
রাঙামাটির মগবান ইউনিয়নে পড়েছে এই বাজার। নাম নতুন বাজার। টিলার অন্য পাশে চাকমাদের পাড়াটার নাম দোখাইয়াপাড়া। দোকানগুলোর টিনের দেয়ালে সাঁটানো নির্বাচনী পোস্টার। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছিল তখন। হ্রদে নৌকায় করে মাইকে চলছিল প্রার্থীদের প্রচার। এ রকম এক মাইক থেকে কানে আসে, ‘পাহাড়ি বাঙালি ভাই ভাই, আনারস মার্কায় ভোট চাই’। নৌকায় ফিরে আরও কিছুক্ষণ নৌযাত্রার পর আমরা প্রবেশ করলাম জীবনতলী ইউনিয়নে। বিকেল গড়াচ্ছে, রোদও মিঠে মিঠে হচ্ছে। মাঝি এবার নোঙর করল এক বৌদ্ধবিহারের টিলার পাদদেশে।
টিলার চূড়ায় সোনালি রঙের বুদ্ধমূর্তি। বেশ দূর থেকেও স্পষ্ট চোখে পড়ে। টিলার সিঁড়ি বেয়ে আমরা ওপরে উঠে এলাম। বৌদ্ধমন্দিরে পুণ্যার্থীদের ভিড়। প্রার্থনাকক্ষের ভেতরে মৃদু আলোয় যেন অন্যরকম আবহ! ফুরফুরে বাতাস উঠে আসছে হ্রদ থেকে। ধনপাতা বনবিহার থেকে নৌকায় ফিরে এলাম আমরা; মাঝিও আবার নোঙর তুললেন।
কাপ্তাই হ্রদ এবার সেজেছে অন্যরকম চেহারায়। সূর্য পাটে যাচ্ছে। গোধূলির সোনা রঙে নৈসর্গিক মুগ্ধতায় সেজেছে পুরো হ্রদ। চারপাশজুড়ে অপূর্ব এক নীরবতা। অনুভব করতে জানলে মৌনতারও প্রগাঢ় কোনো ভাষা থাকে! ফুরোমন পাহাড়ের রাজ্যপাটে পৌষের শীতলতা ভর করতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার ছাই রং আস্তে আস্তে চারপাশের সোনালি জলরাশির ওপর আঁধারের চাদর ফেলে ঢেকে দিচ্ছে। কাপ্তাই নৌকাঘাটে ফেরার আগেই গ্রাস করল ঘুটঘুটে অন্ধকার।
ঘাটে নেমে সেখানের এক টংদোকানে চায়ের পর্ব সেরে ফিরে এলাম আস্তানায়। ক্যাম্পসাইটে তাঁবু বসানো হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। রাতের খাবারের ডাক পড়ল একটু আগেভাগেই। উদরপূর্তির পর তাঁবুতে ফিরে টের পেলাম হাড় কাঁপানো ঠান্ডা চেপে ধরছে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে নদীর পাড়ে বসে কিছুক্ষণ চলল আড্ডা-গল্প। কিছু ফানুস আমরা সঙ্গে করে নিয়েছিলাম। সেগুলো ওড়াতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হলো। নদী থেকে আসা বাতাসের দাপটে দেশলাইয়ের কাঠিতে আগুন জ্বালানো যাচ্ছিল না। কয়েকবারের প্রচেষ্টার পর ওড়ানো গেল। রঙিন কাপড়ের ভেতরে আলোর প্রদীপ জ্বলতে জ্বলতে ওপরে উঠে যেতে থাকে। ঘাড় পেছনে বাঁকিয়ে একটানা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় তারাদের ভিড়ে কোনটা ফানুস সেটা আর ঠাহর করতে পারলাম না।
রাত বাড়ছে; ক্যাম্পিংয়ে আসা প্রায় সবাই ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে যার যার তাঁবুতে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে গেছে নদীর অন্য পাশের ঘন বন। বন্যপ্রাণীবিষয়ক এক লেখকের বয়ানে জেনেছিলাম, কাপ্তাইয়ের ওই পাহাড়ি বনভূমিতে বসবাস করে বিড়াল গোত্রের সুন্দরতম এক সদস্য ক্লাউডেড লেপার্ড বা মেঘলা চিতা। স্থানীয়রা যাকে ডাকে লতা বাঘ বা গেছোবাঘ নামে। সারা দিন কোনো গাছের ডালে অলস শুয়ে থেকে নিশ্চয় তার সময় হয়েছে শিকারের সন্ধানে বের হওয়ার! নদীপাড়ের পাথরের চাতালে থাবার শক্ত নখে ভারসাম্য রক্ষা করে সামনে ঝুঁকে তৃষ্ণা মেটাতে মেটাতে দেখছে কি অন্য পাড়ের মনুষ্য ক্রিয়াকলাপ?
তাঁবুতে ঢুকে পড়ার পর শীত যেন আরও জেঁকে বসল। নদী থেকে ধেয়ে আসা বাতাসের সঙ্গে হাড় কাঁপানো শীত; দাঁতে দাঁত বাড়ি লাগছিল যেন। বেড হিসেবে প্রতিটি তাঁবুর মেঝেতে দেওয়া হয়েছে দুই ফালি ককশিট। নিচ থেকে ওঠা ঠান্ডা আটকানোর জন্য তা যথেষ্ট না হওয়ায় রাফাত তাঁবু থেকে বের হয়ে কোত্থেকে জানি আরও দুই ফালি ককশিট নিয়ে এল। এবার বেডটা মোটামুটি আরামদায়ক হয়ে উঠল। ঝিম ধরে থাকা শীতের রাতে নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে কানে আসছিল ফোঁটা ফোঁটা কুয়াশা দলা বেঁধে তাঁবুর গায়ে আছড়ে পড়ার শব্দ। দূর থেকে থেমে থেমে কানে আসছিল একপাল শেয়ালের হুক্কাহুয়া।
ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে রাত কাটানোর পর ঘুম ভাঙল বেশ ভোরে। তাঁবুর চেইন খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখি ইতিমধ্যে দলের অনেকেই উঠে পড়েছে। ভোরের কর্ণফুলী সবে আড়মোড়া ভাঙছে। কুয়াশার দঙ্গল সারা রাত নদীর ওপর ঘাপটি মেরে বসে থাকার পর আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। নদীর শান্ত জলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কুয়াশার অস্থির ছুটে চলার সঙ্গে যোগ দেয় একট-দুটো পানকৌড়ি। নদীর ওপর পাশের বনের চেহারাও হয়ে গেছে কুয়াশাময়।
জেলেরা তাঁদের নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন সেই ভোরেই। কোনোটা ছইওয়ালা, আবার কোনোটা খোলা ছোট নৌকা। হাড় কাঁপানো এমন শীতও যেন তাঁদের থোড়াই কেয়ার! আগের দিন কায়াকিংয়ের সময় জেলেদের কাছে জেনেছিলাম, নদীর অপর পাশের পাথুরে পাহাড়ের খাড়ির অংশ বেশি গভীর। ক্যাটফিশ গোত্রীয় মাছের আবাসস্থল সেই পাথুরে তলদেশে। আর পুরো নদীতেই চলাফেরা করে কার্পজাতীয় মাছ। এসব নিয়ে যখন ভাবছিলাম, হঠাৎই একটা বড়সড় মাছের ঘাই নদীর মাঝ বরাবর আলোড়ন তুলল! শান্ত পানিতে তৈরি হওয়া ঢেউয়ের গোলাকার বলয় চারপাশে প্রসারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।
ক্যাম্পসাইট থেকে ফিরে নাশতার জন্য রেস্তোরাঁয় ডাক পড়ল। ডিম ভুনার সঙ্গে গরম-গরম খিচুড়িতে পেট পুরে নাশতা সেরে ঝটপট গোছগাছ সেরে বেরিয়ে পড়তে হলো। আমাদের পরের গন্তব্য রাঙামাটি শহর। কাপ্তাই হ্রদের পাশজুড়ে শৈল্পিক রেখা টেনে চলে গেছে যে পাহাড়শ্রেণি, তার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া চড়াই-উতরাই পথ ধরে আমরা যাব। বাহনে চেপে বসার আগে ঘাড় ফিরিয়ে আরেকবার কর্ণফুলীর দিকে চোখ রেখে অস্ফুটে বললাম, ভালো থেকো কাপ্তাই; আবার দেখা হবে নিশ্চয়!
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা
সকালবেলার চন্দ্রঘোনা। কুয়াশার আচ্ছাদন থেকে চারপাশ আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতে শুরু করেছে কেবল। রাঙ্গুনিয়া লিচুবাগান হয়ে আমরা যখন চন্দ্রঘোনা বাজারে পৌঁছাই, বেলা বাড়ার সঙ্গে মফস্বল শহরটিও ব্যস্ত হয়ে উঠছে। দূর পাহাড়ের জুমে ফলানো আনারস এক জায়গায় স্তূপ করে রাখা; গায়ের চাদর একপাশে রেখে মিঠে রোদ গায়ে মাখতে মাখতে মধ্যবয়সী বিক্রেতা বেতের মোড়া পেতে বসেছেন। ধাতব শব্দ তুলে দোকানের শাটার একটা-দুটো করে উঠতে শুরু করেছে।
দীর্ঘ ভ্রমণের পর আড়ষ্ট হয়ে থাকা শরীর এক-আধটু কসরতের জন্য মুখিয়ে ছিল। তবে সেই আশায় গুঁড়েবালি। সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকের তাড়া—তড়িঘড়ি ওঠে পড়তে হবে। তিন চাকায় চড়িয়ে নিয়ে যাবে আমাদের গন্তব্যস্থল কাপ্তাইয়ে, কর্ণফুলী নদীর তীরসংলগ্ন ক্যাম্পসাইটে। সারা রাত সিলেট-চট্টগ্রাম ট্রেন ভ্রমণের পর ভোরবেলায় বাস, অতঃপর অটোরিকশায় প্রায় ষোলো ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রা শেষ হচ্ছে। রাঙামাটিতে এটা আমার প্রথম ভ্রমণ এবং এই আসাটাও হুটহাট করেই।
সপ্তাহের মাঝামাঝি এক সকালবেলার কথা। সেদিন সকাল সকাল অচেনা নম্বর থেকে ফোনে একটা এসএমএস আসে। আমেরিকাপ্রবাসী বন্ধু রাফাত আনসারী সেটি পাঠিয়েছে। মেসেজের সারমর্ম, সে দুই দিন আগে দেশে ছুটিতে এসেছে এবং সপ্তাহের শেষ দিকে কয়েকজন মিলে রাঙামাটি বেড়াতে যাচ্ছে। আমাকেও সেই দলের সদস্য ধরে নিয়ে ইতিমধ্যে ট্রেনের টিকিটও কেটে ফেলেছে। আমি যেন অমত না করি!
পাহাড়ের গা পেঁচিয়ে ফিতার মতো চলে যাওয়া পিচঢালা পথ ধরে ছোট বাহনজোড়া চলতে থাকল। মাঝে মাঝে একটা-দুটো সিঁড়িপথ চোখে পড়ল, মূল পথ থেকে ওপরের দিকে উঠে গেছে, পাহাড়ের চূড়ায় বাংলো আকৃতির একটা-দুটো কুটির। যেতে যেতে পথের দুপাশ ঘন সবুজ হয়ে ওঠে। বনানীর চেহারাও পাল্টায়। পাহাড়জুড়ে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা বনের ঠাসবুনোট, বনতলে লতাগুল্ম কন্দজাতীয় উদ্ভিদের আচ্ছাদন। আন্দাজ করি, কাপ্তাইয়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমায় চলে এসেছি। পথের ধারে সাঁটানো সাইনবোর্ড দেখে নিশ্চিত হলাম কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান হয়েই যাচ্ছি।
অরণ্যের বুনো স্পর্শ মেখে চোখেমুখে আছড়ে পড়ছে পৌষের বাতাস। গন্তব্যস্থল কাপ্তাই প্রশান্তি পার্কের ফটকের সামনে ইতিমধ্যে এসে পড়েছি। ঘড়ির কাঁটা বলছে, সবে দুপুর হতে চলেছে। আমরা এসেছি ক্যাম্পিং ট্যুরে। তাই আপাতত বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে সবার ব্যাগ-ব্যাগেজ রাখার জন্য একটা রুম পাওয়া গেল। সেখানে ব্যাগপত্র রেখে ছাউনিতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চলে গেলাম নদীর একদম তীরে।
খরস্রোতা কর্ণফুলীর কলকল স্রোত বয়ে চলেছে জীবনের উচ্ছ্বাসে। নদীর একদম পাশ ঘেঁষে পার্ক কর্তৃপক্ষের বানানো একটা মাচাঘর। ওপরে শণ ও বেত, মেঝে মুলিবাঁশ দিয়ে তৈরি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সাত-পাঁচ না ভেবেই মাচার মেঝেতে শুয়ে পড়ি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দল ভারী করতে যোগ দেয় রাফাত ও রুবেল। শীত ঋতুর শান্ত সৌম্য কর্ণফুলী। উজ্জ্বল সূর্যালোকে ঝলমল করছে ছোট ছোট ঢেউ কিংবা অল্পস্বল্প নড়াচড়া।
নদী পেরিয়ে ওই পাশে শিলাপাথরের পাহাড়, তার গায়ে ঘন পাহাড়ি বন। দীর্ঘ ভ্রমণের পর গা এলানোর সুযোগ পেয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে, শীতে দুপুরের ফুরফুরে শীতল হাওয়া গায়ে মেখে কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম ঠিক জানি না। বছর ষোলোর ছিপছিপে গড়নের এক কিশোরের গলার আওয়াজে সংবিৎ ফিরল। ঘাটে কায়াক প্রস্তুত; আমাদের কায়াকিংয়ের সময় হয়ে গেছে। মরা ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো একটি গাছের নিচে অপেক্ষমাণ রংবেরঙের কয়েকটি কায়াক। চারটি নৌকার প্রতিটিতে দুজন করে ভাগ হয়ে আমরা আটজন চেপে কর্ণফুলীর টলমলে জলে নেমে পড়ি।
একদম প্রথম বোটের সামনের সিটে আমি, পেছনের সিটে সঙ্গী সুমন। বোটগুলোর প্রতিটির জন্য একটা করেই বইঠা বরাদ্দ। দুপাশে পাখা লাগানো বইঠা ঠেলতে ঠেলতে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল। এ এক আজব জলতরি, যেটার পেটের ভেতরে ঢুকলে অর্ধেক শরীর ঢুকে যায় আন্ডারওয়াটার বা পানির তলায়! বেশ রোমাঞ্চ লাগছিল। পানিতে বইঠার চাপে কায়াক ছুটতে থাকে। ভাটি ধরে যেতে যেতে আমরা দেখতে থাকি নদীতীরের দিনযাপন। পানিতে হাপুস-হুপুস করছিল ছেলেপুলেদের একটা দল। আরেকটু সামনে যেতেই দেখলাম ছোট জাল নদী থেকে তুলে তা থেকে মাছ ধরে খলুইতে রাখছেন এক জেলে দম্পতি।
বইঠা বাইতে বাইতে খেয়াল করলাম, নদীর ঠিক মাঝামাঝি চলে এসেছি। আর সেখান থেকে চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্যপট। নদীর মাঝ বরাবর পানির সমতলের দেড়-দুই ফুট ওপর থেকে সামনে তাকালে ভাটির পানে বয়ে যাওয়া জলস্রোত পেরিয়ে দুই পাড়জুড়ে ঘন অরণ্যঢাকা পাহাড়শ্রেণি। নদীর গা ঘেঁষা সেই পাহাড় পেরিয়ে পেছনে উঁকি দিচ্ছে আরও উঁচু পাহাড়। তারপর আরও উঁচু পাহাড় স্তর। অপূর্ব সেই দৃশ্য!
সীতা পাহাড় আর রাম পাহাড় নামের এই পাহাড়ের মধ্য দিয়েই খরস্রোতা কর্ণফুলী প্রবাহিত হয়েছে। কর্ণফুলীর উচ্ছল স্রোতোধারা আর চারপাশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট জন্ম দিয়েছে না জানি কত শত ছন্দ আর কবিতার! প্রেমের কবি নজরুল তাই তো কর্ণফুলীকে ভালোবেসে লিখেছিলেন, ‘তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি, তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে, সাম্পান নায়ে ফিরেছিল তার-দয়িতের সন্ধানে, আনমনে তার খুলে গেল খোঁপা, কানফুল গেল খুলি, সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হলে কি কর্ণফুলী?’
কর্ণফুলী নদীর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা কাহিনি শোনা যায়। তবে সবচেয়ে প্রচলিত গল্পটি হচ্ছে—আরাকানের এক রাজকন্যা চট্টগ্রামের এক রাজপুত্রের প্রেমে পড়ে। এক জ্যোৎস্না রাতে তারা দুজন এই নদীতে নৌভ্রমণ উপভোগ করছিল। নদীর পানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখার সময় রাজকন্যার কানে গোঁজা একটি ফুল পানিতে পড়ে যায়। ফুলটি হারিয়ে কাতর রাজকন্যা সেটি উদ্ধারের জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু প্রবল স্রোতে রাজকন্যা ভেসে যায়, তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
রাজপুত্র রাজকন্যাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দেয়, কিন্তু সফল হয়নি। প্রিয়তমার শোকে রাজপুত্র পানিতে ডুবে আত্মাহুতি দেয়। করুণ এই কাহিনি থেকেই নদীটির নাম হয় কর্ণফুলী। মারমা জনগোষ্ঠীর কাছে এর নাম কিনসা খিয়ং। উজানে সীমান্তের ওপারে মিজোরামে কর্ণফুলীকে ডাকা হয় খাওৎলাং তুইপুই নামে।
বইঠা থামিয়ে মাঝ নদীতে থেমে ভরদুপুরের মৌনতা কিছুক্ষণ উপভোগ করে তারপর কায়াকের মাথা নদীর অপর পাশ অভিমুখে ঘুরালাম। সেখানে কয়েকজন জেলে পাথুরে পাহাড়ের দেয়াল ঘেঁষে নৌকা নিয়ে একদম স্থির বসে ছিল। চোখে শ্যেনদৃষ্টি; নিবদ্ধ নদীর পানির দিকে। যেন স্রোতের ভেতরে কোনো বিশেষ নড়াচড়ার অপেক্ষায়। পাহাড়ের পাথুরে শিলা উপরিভাগে যতটা দৃশ্যমান হয়; তার চেয়েও নদীর তলদেশে লুকিয়ে থাকা অংশ খুব একটা কম নয়। জেলেদের সঙ্গে আলাপে জানলাম, নদীর এই অংশে গভীরতা ৩৫-৪০ ফুটের মতো।
খেয়াল করলাম, নদীর অপরাপর দিকে পানি বাতাসে মৃদু ঢেউ খেলানো থাকলেও এখানে একদম স্থির। উজান থেকে নেমে আসা স্রোতে পাথুরে দেয়ালে বাধা পেয়ে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছিল। লাইফ জ্যাকেট পরা থাকলেও সঙ্গী সুমন সাঁতার জানেন না। তাই সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে এপাশে ঘাটের দিকে চলে আসি। কায়াক পর্ব শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর লাঞ্চের ডাক পড়ে। পরের গন্তব্য কাপ্তাই হ্রদ।
পার্কের ফটক থেকে কাপ্তাই সদর অভিমুখে চলে যাওয়া পথের পুরোটাই ক্রমশ ওপরের দিকে উঠে গেছে। এক পাশে সংরক্ষিত পাহাড়ি বনভূমি, অপর পাশে বেশ নিচে কর্ণফুলী। কাপ্তাই সদরে বাহন থেকে মাটিতে পা ফেলার আগেই চোখে পড়ল কাপ্তাই হ্রদের অবারিত জলরাশি। নৌকাঘাট সামনেই। ডানের রাস্তাটি চলে গেছে জলবিদ্যুৎ বাঁধের দিকে। বাহন থেকে নেমে প্রথমেই কানে এল মধ্যবয়সী এক নারীকণ্ঠ—মামা, লেকে ঘুরবেন, সাম্পান দিয়া?
ঘাটে গিয়ে দরদাম শেষে আটজনের দলের জন্য একটা জুতসই লঞ্চ নেওয়া হলো। লঞ্চের চালকই গাইড। কাপ্তাই হ্রদের জলরাশিতে আলোড়ন তুলে ছুটে চলল জলযান। দূরে এক-দুটো সাম্পান নৌকা ভাসতে দেখলাম। নৌকার দুপাশে একজোড়া বইঠা। বইঠা দুটো গলুইয়ের দুপাশ থেকে উঠে গিয়ে তার হাতল একসঙ্গে বাঁধা হয়েছে কোমরসমান উঁচুতে। মাঝিকে তাই দাঁড়িয়ে ঠেলতে হচ্ছিল বইঠাযুগল। ছোট নৌকা, তাই দুজন করেই যাত্রী দেখলাম। লঞ্চ আস্তে আস্তে হ্রদের গভীরের দিকে যাচ্ছে আর আমরা যেন ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছি নীলাভ কোনো রাজ্যপাটে!
হ্রদের নীল জল যেন সুনয়নার নীলচক্ষু! জলরাশির মাঝে সবুজ দ্বীপের মতো জেগে আছে একেকটা টিলা। টিলাগুলোর বেশির ভাগেই জনবসতি নেই। নীল আর সবুজ মিলেমিশে দৃষ্টিতে মুগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দিতে থাকল। ভাসতে ভাসতে অন্য নৌকায় যাত্রী হওয়া পাহাড়ের স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়। দূরে, বহু দূরে আবছা অবয়বে কয়েক স্তরের পাহাড়শ্রেণি। মাঝি বলল, পাহাড়ের ওই গহিনে মিজোরাম সীমান্ত। আরও কিছুক্ষণ হ্রদে ভাসার পর একটি টিলার পাশে লঞ্চ নোঙর করা হলো।
একটা বয়সী পাকুড়গাছ দাঁড়িয়ে আছে পাকা সিঁড়ি বাঁধানো ঘাটে। টিলার ওপর একটা বাজার। নেমে পা বাড়াই সেদিকে। বাজারটির ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই চাকমা। ছোট ছোট দোকান। বয়সী কয়েকজন প্রৌঢ় এক জায়গায় জটলা বেঁধে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। কথা চলছিল তাঁদের মাতৃভাষায়। টিলার ওপর বাজারের শেষ মাথায় অল্পনা চাকমা দিদির ছোট্ট খাবারের দোকান। কড়াইয়ের গরম তেলে পিঠা ভাজা হচ্ছিল। নারকেলের টুকরো আর গুড়ের সঙ্গে ময়দার মিশ্রণে বানানো লালচে রঙের সেই পিঠার স্বাদ মুখে লেগে আছে এখনো।
রাঙামাটির মগবান ইউনিয়নে পড়েছে এই বাজার। নাম নতুন বাজার। টিলার অন্য পাশে চাকমাদের পাড়াটার নাম দোখাইয়াপাড়া। দোকানগুলোর টিনের দেয়ালে সাঁটানো নির্বাচনী পোস্টার। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছিল তখন। হ্রদে নৌকায় করে মাইকে চলছিল প্রার্থীদের প্রচার। এ রকম এক মাইক থেকে কানে আসে, ‘পাহাড়ি বাঙালি ভাই ভাই, আনারস মার্কায় ভোট চাই’। নৌকায় ফিরে আরও কিছুক্ষণ নৌযাত্রার পর আমরা প্রবেশ করলাম জীবনতলী ইউনিয়নে। বিকেল গড়াচ্ছে, রোদও মিঠে মিঠে হচ্ছে। মাঝি এবার নোঙর করল এক বৌদ্ধবিহারের টিলার পাদদেশে।
টিলার চূড়ায় সোনালি রঙের বুদ্ধমূর্তি। বেশ দূর থেকেও স্পষ্ট চোখে পড়ে। টিলার সিঁড়ি বেয়ে আমরা ওপরে উঠে এলাম। বৌদ্ধমন্দিরে পুণ্যার্থীদের ভিড়। প্রার্থনাকক্ষের ভেতরে মৃদু আলোয় যেন অন্যরকম আবহ! ফুরফুরে বাতাস উঠে আসছে হ্রদ থেকে। ধনপাতা বনবিহার থেকে নৌকায় ফিরে এলাম আমরা; মাঝিও আবার নোঙর তুললেন।
কাপ্তাই হ্রদ এবার সেজেছে অন্যরকম চেহারায়। সূর্য পাটে যাচ্ছে। গোধূলির সোনা রঙে নৈসর্গিক মুগ্ধতায় সেজেছে পুরো হ্রদ। চারপাশজুড়ে অপূর্ব এক নীরবতা। অনুভব করতে জানলে মৌনতারও প্রগাঢ় কোনো ভাষা থাকে! ফুরোমন পাহাড়ের রাজ্যপাটে পৌষের শীতলতা ভর করতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার ছাই রং আস্তে আস্তে চারপাশের সোনালি জলরাশির ওপর আঁধারের চাদর ফেলে ঢেকে দিচ্ছে। কাপ্তাই নৌকাঘাটে ফেরার আগেই গ্রাস করল ঘুটঘুটে অন্ধকার।
ঘাটে নেমে সেখানের এক টংদোকানে চায়ের পর্ব সেরে ফিরে এলাম আস্তানায়। ক্যাম্পসাইটে তাঁবু বসানো হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। রাতের খাবারের ডাক পড়ল একটু আগেভাগেই। উদরপূর্তির পর তাঁবুতে ফিরে টের পেলাম হাড় কাঁপানো ঠান্ডা চেপে ধরছে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে নদীর পাড়ে বসে কিছুক্ষণ চলল আড্ডা-গল্প। কিছু ফানুস আমরা সঙ্গে করে নিয়েছিলাম। সেগুলো ওড়াতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হলো। নদী থেকে আসা বাতাসের দাপটে দেশলাইয়ের কাঠিতে আগুন জ্বালানো যাচ্ছিল না। কয়েকবারের প্রচেষ্টার পর ওড়ানো গেল। রঙিন কাপড়ের ভেতরে আলোর প্রদীপ জ্বলতে জ্বলতে ওপরে উঠে যেতে থাকে। ঘাড় পেছনে বাঁকিয়ে একটানা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় তারাদের ভিড়ে কোনটা ফানুস সেটা আর ঠাহর করতে পারলাম না।
রাত বাড়ছে; ক্যাম্পিংয়ে আসা প্রায় সবাই ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে যার যার তাঁবুতে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে গেছে নদীর অন্য পাশের ঘন বন। বন্যপ্রাণীবিষয়ক এক লেখকের বয়ানে জেনেছিলাম, কাপ্তাইয়ের ওই পাহাড়ি বনভূমিতে বসবাস করে বিড়াল গোত্রের সুন্দরতম এক সদস্য ক্লাউডেড লেপার্ড বা মেঘলা চিতা। স্থানীয়রা যাকে ডাকে লতা বাঘ বা গেছোবাঘ নামে। সারা দিন কোনো গাছের ডালে অলস শুয়ে থেকে নিশ্চয় তার সময় হয়েছে শিকারের সন্ধানে বের হওয়ার! নদীপাড়ের পাথরের চাতালে থাবার শক্ত নখে ভারসাম্য রক্ষা করে সামনে ঝুঁকে তৃষ্ণা মেটাতে মেটাতে দেখছে কি অন্য পাড়ের মনুষ্য ক্রিয়াকলাপ?
তাঁবুতে ঢুকে পড়ার পর শীত যেন আরও জেঁকে বসল। নদী থেকে ধেয়ে আসা বাতাসের সঙ্গে হাড় কাঁপানো শীত; দাঁতে দাঁত বাড়ি লাগছিল যেন। বেড হিসেবে প্রতিটি তাঁবুর মেঝেতে দেওয়া হয়েছে দুই ফালি ককশিট। নিচ থেকে ওঠা ঠান্ডা আটকানোর জন্য তা যথেষ্ট না হওয়ায় রাফাত তাঁবু থেকে বের হয়ে কোত্থেকে জানি আরও দুই ফালি ককশিট নিয়ে এল। এবার বেডটা মোটামুটি আরামদায়ক হয়ে উঠল। ঝিম ধরে থাকা শীতের রাতে নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে কানে আসছিল ফোঁটা ফোঁটা কুয়াশা দলা বেঁধে তাঁবুর গায়ে আছড়ে পড়ার শব্দ। দূর থেকে থেমে থেমে কানে আসছিল একপাল শেয়ালের হুক্কাহুয়া।
ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে রাত কাটানোর পর ঘুম ভাঙল বেশ ভোরে। তাঁবুর চেইন খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখি ইতিমধ্যে দলের অনেকেই উঠে পড়েছে। ভোরের কর্ণফুলী সবে আড়মোড়া ভাঙছে। কুয়াশার দঙ্গল সারা রাত নদীর ওপর ঘাপটি মেরে বসে থাকার পর আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। নদীর শান্ত জলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কুয়াশার অস্থির ছুটে চলার সঙ্গে যোগ দেয় একট-দুটো পানকৌড়ি। নদীর ওপর পাশের বনের চেহারাও হয়ে গেছে কুয়াশাময়।
জেলেরা তাঁদের নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন সেই ভোরেই। কোনোটা ছইওয়ালা, আবার কোনোটা খোলা ছোট নৌকা। হাড় কাঁপানো এমন শীতও যেন তাঁদের থোড়াই কেয়ার! আগের দিন কায়াকিংয়ের সময় জেলেদের কাছে জেনেছিলাম, নদীর অপর পাশের পাথুরে পাহাড়ের খাড়ির অংশ বেশি গভীর। ক্যাটফিশ গোত্রীয় মাছের আবাসস্থল সেই পাথুরে তলদেশে। আর পুরো নদীতেই চলাফেরা করে কার্পজাতীয় মাছ। এসব নিয়ে যখন ভাবছিলাম, হঠাৎই একটা বড়সড় মাছের ঘাই নদীর মাঝ বরাবর আলোড়ন তুলল! শান্ত পানিতে তৈরি হওয়া ঢেউয়ের গোলাকার বলয় চারপাশে প্রসারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।
ক্যাম্পসাইট থেকে ফিরে নাশতার জন্য রেস্তোরাঁয় ডাক পড়ল। ডিম ভুনার সঙ্গে গরম-গরম খিচুড়িতে পেট পুরে নাশতা সেরে ঝটপট গোছগাছ সেরে বেরিয়ে পড়তে হলো। আমাদের পরের গন্তব্য রাঙামাটি শহর। কাপ্তাই হ্রদের পাশজুড়ে শৈল্পিক রেখা টেনে চলে গেছে যে পাহাড়শ্রেণি, তার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া চড়াই-উতরাই পথ ধরে আমরা যাব। বাহনে চেপে বসার আগে ঘাড় ফিরিয়ে আরেকবার কর্ণফুলীর দিকে চোখ রেখে অস্ফুটে বললাম, ভালো থেকো কাপ্তাই; আবার দেখা হবে নিশ্চয়!
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা
দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মাথার ওপর নীল আকাশে উঁকি দেবে সাদা মেঘ। শরৎকাল বলে ভুল হতে পারে। ভুল ভাঙলে দেখতে পাবেন, মেঘের ভেলা সূর্যের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে হয়ে উঠছে গোলাপি কিংবা লাল। বুঝবেন, আপনি শরতের সাদা মেঘ নয়, দেখছেন তুষারে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
১ দিন আগেকোনো কিছু ওপর থেকে নিচে পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে আমরা সবাই এ বিষয়ে পড়েছি। কিন্তু এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র কাজ করে না। অর্থাৎ সেসব জায়গায় কোনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। যেতে চান সেই সব জায়গায়?
১ দিন আগেশীত, বসন্ত আর বর্ষায় বাংলার নীল নদ সারির রূপ বদলে ফেলে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে দক্ষ মাঝিরাও ভয়ে ভয়ে বইঠা চালান। আর শীতে সারি নদীর নীল পানি দেয় অপার্থিব জগতের খোঁজ। নদীটি ধরে কিছুদূর উজান বাইলেই পাওয়া যাবে লালাখাল জিরো পয়েন্ট।
১ দিন আগেভ্রমণকালে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী না হলে ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেতে পারে। ভ্রমণের সময় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন কিছু উপায়।
১ দিন আগে