জাহীদ রেজা নূর
পরিকল্পনা করেছিল সনকা আর শৌনক। দিনের পর দিন অবরুদ্ধ জীবনের পর একটু বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চেয়েছিল ওরা। ভেবেছিল, সুযোগ পেলে ঘুরে আসবে সমুদ্র থেকে।
আটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেঁষে নিউইয়র্ক। তাই সমুদ্রের স্বাদ পাওয়া কঠিন কিছু নয়। চাইলেই চলে যাওয়া যায় সমুদ্রতটে। কিন্তু সবকিছুর ওপরে করোনা। করোনা জানিয়ে দিয়েছিল, ‘রোসো বৎস’। এত চঞ্চল হয়ো না। তোমাদের ঘরে বসিয়ে রাখার আরও অনেক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে আমার।
কিন্তু দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার পর সাহস বেড়েছে মানুষের। ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষের জায়গায় এখন দেখা যাচ্ছে সাহসী মানুষ। মুখে মাস্ক না দিয়েই কেউ কেউ হাঁটছে। তবে বলে রাখা ভালো, নিউইয়র্কের পথেঘাটে হাঁটতে গেলে কদাচিৎই পদযাত্রীর দেখা মেলে। তাই রাস্তায় বেরিয়ে সংক্রমণের ভয় নেই বললেই চলে।
আমরা দূরের কোনো সৈকতের কথা ভাবিনি। এফ ট্রেনে উঠে শেষ স্টপেজটাই হলো কোনি আইল্যান্ড। সবাই মিলে সেটায় চড়ে বসলেই সোজা সৈকতে চলে যাওয়া যায়। এখানে রয়েছে একটি নয়নাভিরাম অ্যাকোরিয়াম। বছর দু-এক আগে সেটা দেখেছি। সমুদ্রতটটাও ভালো। বহু দূর পর্যন্ত বালি। তারপর লোনা জল।
শুরুতে ভেবেছিলাম, আমরা পরিবারের চারজন কোনো একদিন বেরিয়ে পড়ব পথে। কিন্তু বৃহত্তর পরিবারের কাছে কথাচ্ছলে তা জানালে পরিবর্তিত হয়ে গেল পরিকল্পনা। বদ্ধ সময়কে জয় করার জন্য ভাবা হলো একটু দূরের কোনো সৈকতে গেলে কেমন হয়। এর আগে মোজেস সৈকতে গিয়েছিলাম আমরা। এবার মনে হলো জোনস পার্কের সৈকতে যাওয়া যেতে পারে। নিউইয়র্কের পাঁচটি বোরোর মধ্যে কুইন্স–লাগোয়া যে লং আইল্যান্ড, তারই মধ্যে জোনস বিচ।
একটা গাড়ি আর একটা স্মার্টফোন থাকলে এখন যেকোনো গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া ডাল–ভাত হয়ে গেছে। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে জিপিএস খুলে দিলেই এক যান্ত্রিক নারী–কণ্ঠ সময়মতো জানিয়ে দেবে—কোন পথ ধরে পৌঁছাতে হবে গন্তব্যে। কোনো রাস্তায় যানজট থাকলে সে আপনাআপনি অন্য সহজ পথে নিয়ে যাবে।
আমরা রওনা হয়েছিলাম দুই গাড়িতে দশজন। একটি গাড়িতে জিপিএস ছিল, অন্যটা চলছিল সামনের গাড়ির পেছন পেছন। কিন্তু কুইন্সের লোকাল পথ দিয়ে চলতে চলতেই একসময় সামনের গাড়িটি দৃষ্টিপথ থেকে হারিয়ে গেল। অর্থাৎ, দুচোখে অন্ধকার নিয়ে দ্বিতীয় গাড়িটি পড়ল অকুল পাথারে। তখনই চালু করা হলো জিপিএস এবং এক যন্ত্রমানবী জানিয়ে দিলেন—সামনেই ডানদিকে মোড় নিতে হবে। তারপর ছুটতে হবে ঘোড়ার মতো। সময়মতো তিনি জানিয়ে দেবেন ডান–বাম করতে হবে কিনা।
আমরা জানতাম, নিউইয়র্কের কুইন্স ভিলেজ থেকে ২৬ মাইল গেলে পাওয়া যাবে সমুদ্রের জল।
নিউইয়র্কের মধ্যেই পথচলার জন্য রয়েছে লোকাল ও হাইওয়ে বলে দুধরনের রাস্তা। লোকাল রাস্তায় ঘন ঘন লালবাতি। হাইওয়েতে কোনো লালবাতি নেই। ভোঁ করে চালিয়ে নির্দিষ্ট এক্সিট দিয়ে বেরিয়ে নিজের বাড়ি বা অফিস খুঁজে নেওয়া যায়। একবার পথ হারিয়ে ফেললে সে পথে ফিরে আসতে বেশ হ্যাপা পোহাতে হয়। ঘুরতে ঘুরতে যখন পথ খুঁজে পাওয়া যায়, ততক্ষণে সময় নষ্ট হয় অনেক।
নিউইয়র্ক শহরে এখন ঘণ্টায় ২৫ মাইল বেগে চলতে হয়। হাইওয়েতে তা ৫৫ মাইল। কিছুদিন আগেও রাস্তায় গাড়িঘোড়ার সংখ্যা ছিল কম, এখন প্রতিদিনই বাড়ছে। খুব শিগগিরই আগের জনকোলাহলপূর্ণ শহরটি পুনরুজ্জীবিত হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
সোজা রাস্তাটা দিয়ে ১৩ মাইল যাওয়ার আগে আমরা যেখানে এক্সিট নিয়েছিলাম, সেখান থেকেই টের পাচ্ছিলাম বাতাসটা ভেজা ভেজা। গাড়ির জানালা খুলে দিতেই এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে বুঝিয়ে দিল সমুদ্র অদূরেই।
ভেজা বাতাস আমাদের স্নান করিয়ে দিচ্ছিল। সৈকতের কাছাকাছি এসে যন্ত্রমানবীর নির্দেশনায় গোলমাল দেখা দিল। আসলে দোষটা তার নয়। সে চেষ্টা করে যাচ্ছে সৈকতের পার্কিং লটে আমাদের জায়গা করে দেওয়ার জন্য, অথচ তা বন্ধ। অগত্যা একটু পরেই সে সন্ধান দিচ্ছে সামনের আরও কোনো ঢোকার রাস্তার। এভাবে কিছু দূর অতিক্রম করার পরই কেবল আমরা ঢুকতে পারলাম পার্কে। তখনো আমাদের সবার মুখে মাস্ক। বিশাল পার্কিং প্লেসে গাড়ি রেখে প্রথমেই আমরা স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে নিল কেউ, কেউ ভরে ফেলি ব্যাগে। এই বিশাল বালুকাবেলায় স্যান্ডেল পায়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
প্রচণ্ড বাতাস। সেই যে বহু দূর থেকে ভেজা বাতাস আমাদের শরীর করে তুলছিল শীতার্ত, সেই বাতাস এখন আসছে সমুদ্রের ভিতর থেকে। একটু আগেই সমুদ্রস্নানের স্বপ্ন দেখছিলাম যারা, তারা সে স্বপ্নকে পাঠিয়ে দিল কবরের নির্জনতায়।
এ কথা বোঝানো শক্ত, মাস্কে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মানুষের কাছে হঠাৎ মাস্ক থেকে মুক্তি কতটা আনন্দ দিতে পারে। সমুদ্রের ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে বালুকাবেলা, আছড়ে পড়া ঢেউয়ের সঙ্গে জলের গভীর থেকে কখনো তীরে আসছে ঝিনুক।
জোনস বিচ বালুর সৈকত। অনেকটা কক্সবাজারের মতো। এর আগে মোজেস বিচে গিয়েছিলাম। সেখানে পাথরের সংখ্যা ছিল বেশি। হঠাৎ করে অলক্ষ্যে পাথরে আঘাত লেগে কেটে যেতে পারে পা। কিন্তু এখানে সেই হাঙ্গামা নেই।
শহুরে মানুষ নিজেকে প্রায়ই একটা প্রশ্ন করে—কোথায় ভালো লাগে বেশি? সমুদ্রে নাকি পাহাড়ে? এর উত্তর ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। কিন্তু পছন্দের এই ছোট তালিকায় টিকচিহ্ন দিতে বেশির ভাগ মানুষই ইতস্তত করে। আসলে দুটোতেই মানুষ স্বচ্ছন্দ। দুটোর সৌন্দর্য দুরকম। এক জায়গায় তাদের মিল—বড়ত্বের জায়গায়। এরা মানুষের তুলনায় এত বেশি বড় যে, শুরুতেই পরাজয় মেনে নিয়ে ওদের সঙ্গে বাতচিৎ করতে হয়। ওদের বিশালত্বই মানুষকে বুঝিয়ে দেয়, মানুষ কত ক্ষুদ্র।
জোনস বিচে স্নান করা আর হলো না। কেউই সাহস করে সমুদ্রস্নানে নামেনি। অনেকেই এসেছেন স্বল্প পোশাকে। কিন্তু পা ভেজানোর বেশি শৌর্য দেখানোর চেষ্টা করছে না কেউ। সমুদ্রপাড়ে বসে কেউ কেউ রৌদ্রস্নান করছেন। তবে তাদের সংখ্যা বেশি নয়।
বহু দূরের দুটো দৃশ্য দেখে ভালো লাগল। রোদ গায়ে মেখে বই পড়ছেন একজন। অন্য একজন আঁকছেন ছবি। এ মুহূর্তে জগতের আর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা নিমগ্ন রয়েছেন নিজ নিজ কাজে। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে বত্রিশ বছর আগের কথা। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রাসনাদার শহরে ছিল আমার আবাস। একদিন বিকেলে বিষণ্ন মনে কুবান নদীর ধারে বসে ছিলাম। একা। ওপরে নীল আকাশ, নিচে নদী। আশপাশে কেউ নেই। সন্ধ্যা হয় হয়। এ সময় হঠাৎ একজন মানুষকে দেখতে পেলাম; হাতে বই। তিনি নদীর কিনারায় দাঁড়িয়ে বইটা পড়ছিলেন, আর মাঝে মাঝে অপস্রিয়মাণ সূর্যের দিকে তাকাচ্ছিলেন। সূর্য যখন অস্ত গেল, তখন তিনি বন্ধ করলেন তাঁর বই। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি সূর্যাস্তের সময় বই পড়ছিলেন কেন?’
ভদ্রলোক হেসে বলেছিলেন, ‘বইয়ের বর্ণনার সঙ্গে প্রকৃতিকে মিলিয়ে দেখছিলাম।’
‘মানে?’
‘মানে হলো, লেখক যেভাবে সূর্যাস্তর বর্ণনা দিয়েছেন, আদতেই সেভাবে সূর্যাস্ত হয় কিনা, দেখলাম! অদ্ভুত মিল!’
আমার মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। এ রকম একটা বিষয় কোনো মানুষের মনে দোলা দিতে পারে, সেটাই আনন্দের উৎস। এবারও জোনস বিচে পড়ুয়া মানুষটিকে দেখে সে রকমই ভালো লাগল।
আমরা অনেক দিন পর প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারছিলাম। বাইরে এসে মাস্ক ছাড়া প্রায় দুই ঘণ্টা থাকিনি অনেক দিন। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। দেশে ভারত থেকে আসা নতুন ধরনের করোনাভাইরাসে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত, আর নিউইয়র্কের মানুষ করোনাকে বিদায় জানানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে। এ জন্য বিশেষ কিছু করতে হয়নি, মাস্ক পরাকে করা হয়েছে বাধ্যতামূলক, হাত ধোয়া বা হাতে স্যানিটাইজার ব্যবহারকে করা হয়েছে বাধ্যতামূলক, আর একে অন্যের কাছ থেকে অন্তত ৬ ফুট দূরত্ব মানার অঙ্গীকার করতে হয়েছে। এর পর ফল মিলেছে। গত বছর ঠিক এ রকম সময় নিউইয়র্ক ছিল মৃত্যুপুরী। শুনেছি, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ ছিল শ্বাস–প্রশ্বাসের মতো। এক মিনিট সাইরেনের আওয়াজ না থাকলেই মনে হতো, কানে শুনতে পাচ্ছি তো, নাকি কান নষ্ট হয়ে গেছে? সেই নিউইয়র্ক এখন করোনাকে ভয় দেখাতে প্রস্তুত।
সমুদ্রের বাতাস পেটে খিদের জন্ম দেয়। সমুদ্র থেকে উঠে আসা একেকটি মানুষ পরিণত হয় খুদে রাক্ষসে। তিন বাড়ি থেকেই হালকা খাবার নিয়ে আসা হয়েছিল। সে খাওয়া উড়ে গেল এক ফুৎকারে। মাংসের চপ, চিপস, কেক, চা। চেরি খাওয়া হলো গপগপ করে। তারপর এল আলস্য।
এর আগে যা হয়েছিল, সে কথাও বলে রাখা দরকার। সমুদ্র থেকে তটে ফেরা হলে সেখানে দেখা যাবে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা রেস্টরুম। সবখানেই পর্যাপ্ত পরিমাণ টিস্যু পেপার আছে। পানি রয়েছে। আর রয়েছে তরল সাবান। এখানে এসে ফ্রেশ হয়ে তারপর তো খাওয়া–দাওয়া!
যদি ভেবে থাকেন, এর পর বাড়ি ফেরার পথে একমাত্র চালক ছাড়া সবাই ঘুমাতে শুরু করল, তাহলে ভুল করবেন। নিউইয়র্ক এমন এক জায়গা, যেখানে গোটা শহরটাই দিন–রাত ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকে। সে কথা মেনে নিয়েই আমরা পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করতে থাকি।
পরিকল্পনা করেছিল সনকা আর শৌনক। দিনের পর দিন অবরুদ্ধ জীবনের পর একটু বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চেয়েছিল ওরা। ভেবেছিল, সুযোগ পেলে ঘুরে আসবে সমুদ্র থেকে।
আটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেঁষে নিউইয়র্ক। তাই সমুদ্রের স্বাদ পাওয়া কঠিন কিছু নয়। চাইলেই চলে যাওয়া যায় সমুদ্রতটে। কিন্তু সবকিছুর ওপরে করোনা। করোনা জানিয়ে দিয়েছিল, ‘রোসো বৎস’। এত চঞ্চল হয়ো না। তোমাদের ঘরে বসিয়ে রাখার আরও অনেক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে আমার।
কিন্তু দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার পর সাহস বেড়েছে মানুষের। ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষের জায়গায় এখন দেখা যাচ্ছে সাহসী মানুষ। মুখে মাস্ক না দিয়েই কেউ কেউ হাঁটছে। তবে বলে রাখা ভালো, নিউইয়র্কের পথেঘাটে হাঁটতে গেলে কদাচিৎই পদযাত্রীর দেখা মেলে। তাই রাস্তায় বেরিয়ে সংক্রমণের ভয় নেই বললেই চলে।
আমরা দূরের কোনো সৈকতের কথা ভাবিনি। এফ ট্রেনে উঠে শেষ স্টপেজটাই হলো কোনি আইল্যান্ড। সবাই মিলে সেটায় চড়ে বসলেই সোজা সৈকতে চলে যাওয়া যায়। এখানে রয়েছে একটি নয়নাভিরাম অ্যাকোরিয়াম। বছর দু-এক আগে সেটা দেখেছি। সমুদ্রতটটাও ভালো। বহু দূর পর্যন্ত বালি। তারপর লোনা জল।
শুরুতে ভেবেছিলাম, আমরা পরিবারের চারজন কোনো একদিন বেরিয়ে পড়ব পথে। কিন্তু বৃহত্তর পরিবারের কাছে কথাচ্ছলে তা জানালে পরিবর্তিত হয়ে গেল পরিকল্পনা। বদ্ধ সময়কে জয় করার জন্য ভাবা হলো একটু দূরের কোনো সৈকতে গেলে কেমন হয়। এর আগে মোজেস সৈকতে গিয়েছিলাম আমরা। এবার মনে হলো জোনস পার্কের সৈকতে যাওয়া যেতে পারে। নিউইয়র্কের পাঁচটি বোরোর মধ্যে কুইন্স–লাগোয়া যে লং আইল্যান্ড, তারই মধ্যে জোনস বিচ।
একটা গাড়ি আর একটা স্মার্টফোন থাকলে এখন যেকোনো গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া ডাল–ভাত হয়ে গেছে। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে জিপিএস খুলে দিলেই এক যান্ত্রিক নারী–কণ্ঠ সময়মতো জানিয়ে দেবে—কোন পথ ধরে পৌঁছাতে হবে গন্তব্যে। কোনো রাস্তায় যানজট থাকলে সে আপনাআপনি অন্য সহজ পথে নিয়ে যাবে।
আমরা রওনা হয়েছিলাম দুই গাড়িতে দশজন। একটি গাড়িতে জিপিএস ছিল, অন্যটা চলছিল সামনের গাড়ির পেছন পেছন। কিন্তু কুইন্সের লোকাল পথ দিয়ে চলতে চলতেই একসময় সামনের গাড়িটি দৃষ্টিপথ থেকে হারিয়ে গেল। অর্থাৎ, দুচোখে অন্ধকার নিয়ে দ্বিতীয় গাড়িটি পড়ল অকুল পাথারে। তখনই চালু করা হলো জিপিএস এবং এক যন্ত্রমানবী জানিয়ে দিলেন—সামনেই ডানদিকে মোড় নিতে হবে। তারপর ছুটতে হবে ঘোড়ার মতো। সময়মতো তিনি জানিয়ে দেবেন ডান–বাম করতে হবে কিনা।
আমরা জানতাম, নিউইয়র্কের কুইন্স ভিলেজ থেকে ২৬ মাইল গেলে পাওয়া যাবে সমুদ্রের জল।
নিউইয়র্কের মধ্যেই পথচলার জন্য রয়েছে লোকাল ও হাইওয়ে বলে দুধরনের রাস্তা। লোকাল রাস্তায় ঘন ঘন লালবাতি। হাইওয়েতে কোনো লালবাতি নেই। ভোঁ করে চালিয়ে নির্দিষ্ট এক্সিট দিয়ে বেরিয়ে নিজের বাড়ি বা অফিস খুঁজে নেওয়া যায়। একবার পথ হারিয়ে ফেললে সে পথে ফিরে আসতে বেশ হ্যাপা পোহাতে হয়। ঘুরতে ঘুরতে যখন পথ খুঁজে পাওয়া যায়, ততক্ষণে সময় নষ্ট হয় অনেক।
নিউইয়র্ক শহরে এখন ঘণ্টায় ২৫ মাইল বেগে চলতে হয়। হাইওয়েতে তা ৫৫ মাইল। কিছুদিন আগেও রাস্তায় গাড়িঘোড়ার সংখ্যা ছিল কম, এখন প্রতিদিনই বাড়ছে। খুব শিগগিরই আগের জনকোলাহলপূর্ণ শহরটি পুনরুজ্জীবিত হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
সোজা রাস্তাটা দিয়ে ১৩ মাইল যাওয়ার আগে আমরা যেখানে এক্সিট নিয়েছিলাম, সেখান থেকেই টের পাচ্ছিলাম বাতাসটা ভেজা ভেজা। গাড়ির জানালা খুলে দিতেই এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে বুঝিয়ে দিল সমুদ্র অদূরেই।
ভেজা বাতাস আমাদের স্নান করিয়ে দিচ্ছিল। সৈকতের কাছাকাছি এসে যন্ত্রমানবীর নির্দেশনায় গোলমাল দেখা দিল। আসলে দোষটা তার নয়। সে চেষ্টা করে যাচ্ছে সৈকতের পার্কিং লটে আমাদের জায়গা করে দেওয়ার জন্য, অথচ তা বন্ধ। অগত্যা একটু পরেই সে সন্ধান দিচ্ছে সামনের আরও কোনো ঢোকার রাস্তার। এভাবে কিছু দূর অতিক্রম করার পরই কেবল আমরা ঢুকতে পারলাম পার্কে। তখনো আমাদের সবার মুখে মাস্ক। বিশাল পার্কিং প্লেসে গাড়ি রেখে প্রথমেই আমরা স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে নিল কেউ, কেউ ভরে ফেলি ব্যাগে। এই বিশাল বালুকাবেলায় স্যান্ডেল পায়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
প্রচণ্ড বাতাস। সেই যে বহু দূর থেকে ভেজা বাতাস আমাদের শরীর করে তুলছিল শীতার্ত, সেই বাতাস এখন আসছে সমুদ্রের ভিতর থেকে। একটু আগেই সমুদ্রস্নানের স্বপ্ন দেখছিলাম যারা, তারা সে স্বপ্নকে পাঠিয়ে দিল কবরের নির্জনতায়।
এ কথা বোঝানো শক্ত, মাস্কে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মানুষের কাছে হঠাৎ মাস্ক থেকে মুক্তি কতটা আনন্দ দিতে পারে। সমুদ্রের ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে বালুকাবেলা, আছড়ে পড়া ঢেউয়ের সঙ্গে জলের গভীর থেকে কখনো তীরে আসছে ঝিনুক।
জোনস বিচ বালুর সৈকত। অনেকটা কক্সবাজারের মতো। এর আগে মোজেস বিচে গিয়েছিলাম। সেখানে পাথরের সংখ্যা ছিল বেশি। হঠাৎ করে অলক্ষ্যে পাথরে আঘাত লেগে কেটে যেতে পারে পা। কিন্তু এখানে সেই হাঙ্গামা নেই।
শহুরে মানুষ নিজেকে প্রায়ই একটা প্রশ্ন করে—কোথায় ভালো লাগে বেশি? সমুদ্রে নাকি পাহাড়ে? এর উত্তর ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। কিন্তু পছন্দের এই ছোট তালিকায় টিকচিহ্ন দিতে বেশির ভাগ মানুষই ইতস্তত করে। আসলে দুটোতেই মানুষ স্বচ্ছন্দ। দুটোর সৌন্দর্য দুরকম। এক জায়গায় তাদের মিল—বড়ত্বের জায়গায়। এরা মানুষের তুলনায় এত বেশি বড় যে, শুরুতেই পরাজয় মেনে নিয়ে ওদের সঙ্গে বাতচিৎ করতে হয়। ওদের বিশালত্বই মানুষকে বুঝিয়ে দেয়, মানুষ কত ক্ষুদ্র।
জোনস বিচে স্নান করা আর হলো না। কেউই সাহস করে সমুদ্রস্নানে নামেনি। অনেকেই এসেছেন স্বল্প পোশাকে। কিন্তু পা ভেজানোর বেশি শৌর্য দেখানোর চেষ্টা করছে না কেউ। সমুদ্রপাড়ে বসে কেউ কেউ রৌদ্রস্নান করছেন। তবে তাদের সংখ্যা বেশি নয়।
বহু দূরের দুটো দৃশ্য দেখে ভালো লাগল। রোদ গায়ে মেখে বই পড়ছেন একজন। অন্য একজন আঁকছেন ছবি। এ মুহূর্তে জগতের আর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা নিমগ্ন রয়েছেন নিজ নিজ কাজে। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে বত্রিশ বছর আগের কথা। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রাসনাদার শহরে ছিল আমার আবাস। একদিন বিকেলে বিষণ্ন মনে কুবান নদীর ধারে বসে ছিলাম। একা। ওপরে নীল আকাশ, নিচে নদী। আশপাশে কেউ নেই। সন্ধ্যা হয় হয়। এ সময় হঠাৎ একজন মানুষকে দেখতে পেলাম; হাতে বই। তিনি নদীর কিনারায় দাঁড়িয়ে বইটা পড়ছিলেন, আর মাঝে মাঝে অপস্রিয়মাণ সূর্যের দিকে তাকাচ্ছিলেন। সূর্য যখন অস্ত গেল, তখন তিনি বন্ধ করলেন তাঁর বই। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি সূর্যাস্তের সময় বই পড়ছিলেন কেন?’
ভদ্রলোক হেসে বলেছিলেন, ‘বইয়ের বর্ণনার সঙ্গে প্রকৃতিকে মিলিয়ে দেখছিলাম।’
‘মানে?’
‘মানে হলো, লেখক যেভাবে সূর্যাস্তর বর্ণনা দিয়েছেন, আদতেই সেভাবে সূর্যাস্ত হয় কিনা, দেখলাম! অদ্ভুত মিল!’
আমার মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। এ রকম একটা বিষয় কোনো মানুষের মনে দোলা দিতে পারে, সেটাই আনন্দের উৎস। এবারও জোনস বিচে পড়ুয়া মানুষটিকে দেখে সে রকমই ভালো লাগল।
আমরা অনেক দিন পর প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারছিলাম। বাইরে এসে মাস্ক ছাড়া প্রায় দুই ঘণ্টা থাকিনি অনেক দিন। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। দেশে ভারত থেকে আসা নতুন ধরনের করোনাভাইরাসে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত, আর নিউইয়র্কের মানুষ করোনাকে বিদায় জানানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে। এ জন্য বিশেষ কিছু করতে হয়নি, মাস্ক পরাকে করা হয়েছে বাধ্যতামূলক, হাত ধোয়া বা হাতে স্যানিটাইজার ব্যবহারকে করা হয়েছে বাধ্যতামূলক, আর একে অন্যের কাছ থেকে অন্তত ৬ ফুট দূরত্ব মানার অঙ্গীকার করতে হয়েছে। এর পর ফল মিলেছে। গত বছর ঠিক এ রকম সময় নিউইয়র্ক ছিল মৃত্যুপুরী। শুনেছি, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ ছিল শ্বাস–প্রশ্বাসের মতো। এক মিনিট সাইরেনের আওয়াজ না থাকলেই মনে হতো, কানে শুনতে পাচ্ছি তো, নাকি কান নষ্ট হয়ে গেছে? সেই নিউইয়র্ক এখন করোনাকে ভয় দেখাতে প্রস্তুত।
সমুদ্রের বাতাস পেটে খিদের জন্ম দেয়। সমুদ্র থেকে উঠে আসা একেকটি মানুষ পরিণত হয় খুদে রাক্ষসে। তিন বাড়ি থেকেই হালকা খাবার নিয়ে আসা হয়েছিল। সে খাওয়া উড়ে গেল এক ফুৎকারে। মাংসের চপ, চিপস, কেক, চা। চেরি খাওয়া হলো গপগপ করে। তারপর এল আলস্য।
এর আগে যা হয়েছিল, সে কথাও বলে রাখা দরকার। সমুদ্র থেকে তটে ফেরা হলে সেখানে দেখা যাবে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা রেস্টরুম। সবখানেই পর্যাপ্ত পরিমাণ টিস্যু পেপার আছে। পানি রয়েছে। আর রয়েছে তরল সাবান। এখানে এসে ফ্রেশ হয়ে তারপর তো খাওয়া–দাওয়া!
যদি ভেবে থাকেন, এর পর বাড়ি ফেরার পথে একমাত্র চালক ছাড়া সবাই ঘুমাতে শুরু করল, তাহলে ভুল করবেন। নিউইয়র্ক এমন এক জায়গা, যেখানে গোটা শহরটাই দিন–রাত ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকে। সে কথা মেনে নিয়েই আমরা পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করতে থাকি।
দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মাথার ওপর নীল আকাশে উঁকি দেবে সাদা মেঘ। শরৎকাল বলে ভুল হতে পারে। ভুল ভাঙলে দেখতে পাবেন, মেঘের ভেলা সূর্যের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে হয়ে উঠছে গোলাপি কিংবা লাল। বুঝবেন, আপনি শরতের সাদা মেঘ নয়, দেখছেন তুষারে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
২ দিন আগেকোনো কিছু ওপর থেকে নিচে পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে আমরা সবাই এ বিষয়ে পড়েছি। কিন্তু এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র কাজ করে না। অর্থাৎ সেসব জায়গায় কোনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। যেতে চান সেই সব জায়গায়?
২ দিন আগেশীত, বসন্ত আর বর্ষায় বাংলার নীল নদ সারির রূপ বদলে ফেলে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে দক্ষ মাঝিরাও ভয়ে ভয়ে বইঠা চালান। আর শীতে সারি নদীর নীল পানি দেয় অপার্থিব জগতের খোঁজ। নদীটি ধরে কিছুদূর উজান বাইলেই পাওয়া যাবে লালাখাল জিরো পয়েন্ট।
২ দিন আগেভ্রমণকালে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী না হলে ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেতে পারে। ভ্রমণের সময় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন কিছু উপায়।
২ দিন আগে