জাহীদ রেজা নূর
কনের মা–বাবা এই জুটির নাম দিয়েছিলেন ‘হাতি আর কবুতর’। দেবেন না কেন, বর তো ছিল কনের চেয়ে ২১ বছরের বড়। ১০০ কিলোগ্রামের চেয়েও বেশি ছিল তাঁর ওজন। উচ্চতাও ছিল দেখার মতো।
তবে এ কথা সবাই স্বীকার করতেন যে, দিয়েগো রিভেরার ছিল এক রসিক মন, জীবনের আনন্দের প্রতি ছিল অপরিসীম আনুগত্য, আর হৃদয়টা ছিল খুবই স্পর্শকাতর আর কোমল।
১৯২২ সালেই মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন তিনি। ১৯২৭–২৮ সালে গিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে, তার কিছুদিন আগে নিজ বাড়িতে আতিথ্য দান করেছিলেন সোভিয়েত কবি মায়াকোভ্স্কিকে। তিনি বিয়ে করেছিলেন ফ্রিদা কাহলোকে। ফ্রিদা তখনো খ্যাতি পাননি।
ফ্রিদার বাবা গুয়েরমো কাহলো ছিলেন হাঙ্গেরি থেকে আসা এক ইহুদি। ছবি তোলাই ছিল তাঁর পেশা। মা ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী মাতিলদা কালদেরন। দুই সন্তান ছিল তাঁদের সংসারে। বড়টিই ফ্রিদা। ফ্রিদার চেহারার সঙ্গে তাঁর মায়ের চেহারার ছিল অদ্ভুত মিল। বাবাও মেয়েটাকে ভালোবাসত হৃদয় দিয়ে। বুদ্ধিমতী ছিল মেয়েটি। স্কুলে মেয়েটা ছুটে বেড়াত, যেন এক রঙিন প্রজাপতি। যারা জানত, ছ’বছর বয়সে মেয়েটা পোলিও–আক্রান্ত হয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে বাধ্য হয়েছে, তারা ওর এই চঞ্চল চলাচলে অবাক হতো।
ফ্রিদার এই নান্দনিক ওড়াউড়ি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, যখন তাঁর বয়স সতেরো। যে বাসে করে ফ্রিদা যাচ্ছিল, তা অকস্মাৎ দুর্ঘটনায় পড়ে। একটি ট্রামের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। গুরুতর আহত হন ফ্রিদা। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। কয়েক বছর ধরে চলে চিকিৎসা। তাঁর জীবনের আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। তীব্র ব্যথায় মানসিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যেতে থাকেন ফ্রিদা। মোট ৩৩টি অস্ত্রোপচার হয় তাঁর শরীরে। বলা হয়ে থাকে, নিশ্বাস নেওয়া ছাড়া তাঁর শরীরের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এ সময়টি নিয়ে ফ্রিদা তাঁর মাকে বলেছিলেন পরে, ‘শুধু ছবি আঁকতাম বলেই সে সময় বেঁচে ছিলাম।’
ছবি আঁকার ঘটনাই ফ্রিদা আর দিয়েগো রিভেরার মধ্যে গড়ে দিয়েছিল সেতুবন্ধন। সেই যে স্কুলের দিনগুলোতে ফ্রিদা তন্ময় হয়ে দেখত শিক্ষক দিয়েগোকে, সে স্মৃতি মলিন হয়নি কখনো। কিন্ডারগার্টেন স্কুলের দেয়াল রাঙিয়ে দিতেন দিয়েগো তাঁর নান্দনিক হাতের আঁচড়ে। কয়েক বছর পর সেই শিক্ষকের কাছে নিজের আঁকা ছবি নিয়ে গেলেন ফ্রিদা। ভয় ছিল মনে, বড় শিল্পী হয়তো তাঁকে পাত্তা দেবেন না, তাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু ঘটল একেবারে উল্টো ব্যাপার। খুবই আগ্রহ নিয়ে ফ্রিদার ছবিগুলো দেখলেন দিয়েগো। তবে এ কথা এখন আর স্পষ্ট নয়, কোন বিষয়টি ভালো লেগেছিল দিয়েগোর—ফ্রিদার আঁকা ছবি নাকি স্বয়ং ফ্রিদা। সে রহস্যের জট না খুললেও আমরা অচিরেই দেখতে পাচ্ছি, ফ্রিদাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন দিয়েগো, ফ্রিদার বাবার কাছে। তাতে গুয়েরমো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। মেয়ের প্রায় দ্বিগুণ বয়সী মানুষকে বর হিসেবে মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু প্রগাঢ় ভালোবাসার কাছে পরাজিত হলেন বাবা। হার মানার আগে শুধু বললেন, ‘আমার মেয়ে সারা জীবন অসুস্থ থাকবে। এটা মেনে নিয়ে যদি বিয়ে করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারো, আমি রাজি আছি মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিতে।’
ফ্রিদা বিয়েতে দিলেন জমকালো সাজ। আগুন ছড়ানো কণ্ঠহার, বড় বড় কানের দুল, মেক্সিকোর ঐতিহ্যবাহী গাউনে তাঁকে লাগছিল অসাধারণ। ফ্রিদার অপার সৌন্দর্যে দিয়েগোর আগের বউ লুপে মারিনের মনে জ্বলে উঠল ঈর্ষার আগুন। ফ্রিদার খোঁড়া পা নিয়ে বিদ্রূপ করলেন তিনি, ‘দেখ, কি এক দেশলাই–সদৃশ পায়ের কাছে আমার লোভনীয় পা পরাজিত হয়েছে!’
সেখানেই শুরু হয়ে গেল তর্কযুদ্ধ। অন্যদের তর্কের মধ্যে তর্কে জড়িয়ে পড়লেন ফ্রিদা আর দিয়েগোও। শেষে ফ্রিদা সটান চলে এলেন বাবা–মায়ের কাছে। শুধু কয়েক দিন বাদে দিয়েগো ফ্রিদাকে নিজ ঘরে নিয়ে যেতে পারলেন।
বিয়ের কয়েক দিন পর লুপে মারিন নতুন বউ–বরের বাড়ি এলেন। তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করলেন বাড়ি। দেখলেন তা ঠিকভাবে সাজানো গোছানো হয়েছে কিনা। তারপর ফ্রিদাকে নিয়ে বাজারে গেলেন। তাঁকে নিয়েই কিনলেন রান্নার সরঞ্জাম, দিয়েগোর পছন্দের রান্না শিখিয়ে দিলেন ফ্রিদাকে। বললেন, ‘দিয়েগো কাজ করতে করতেই নাশতা করে। একটা ট্রেতে করে ঢাকা দিয়ে খাবার নিয়ে যেতে হয় সেখানে। যে কাপড়ে ঢাকা থাকবে খাবার, সে কাপড়ে লেখা থাকতে হবে, ‘আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি।’ লুপে এই ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন ম্যাক্সিকান চাষিদের কাছ থেকে।
নব্য দম্পতির জীবন এর পর থেকে সুখে–স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে গিয়েছিল, এমন কথা যারা ভাবছেন, তারা ভুল করছেন। খুব দ্রুতই তাঁদের মধ্যে শুরু হলো ঝগড়াঝাঁটি। দিয়েগো তাঁর বদভ্যাসগুলো থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারছিলেন না। পুরোনো বান্ধবীদের সঙ্গে ঘোরাফেরার উৎসাহ তাঁর বিন্দুমাত্র কমেনি। তিনি সমালোচনা একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। আর ফ্রিদা নিজের নান্দনিক ঔৎসুক্যে জাজ্বল্যমান হয়ে স্বামীর পাপগুলো ধরিয়ে দিতে লাগলেন। দিয়েগো তা সহ্য করতে পারতেন না, হাতের তুলি ছুড়ে ফেলে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে যেতেন। যাওয়ার সময় গালাগাল করতেন ফ্রিদাকে। কিন্তু বাড়ি তো ফিরতেই হতো। ফেরার সময় তাঁর হাত ভরে থাকত উপহারে—দামি দামি কানের দুল, গলার হারসহ কত কিছুই না উপহার দিতেন ফ্রিদাকে। ফ্রিদা খুব পছন্দ করতেন অলংকার। দামি পাথরের অলংকার হোক, হোক সস্তা কাচের—সবটাই ছিল ফ্রিদার পছন্দের। ফ্রিদা ম্যাক্সিকান পোশাক পরতে পছন্দ করতেন, নানা রঙের সুতোয় জড়িয়ে রাখতেন নিজের চুল।
খ্যাতনামা চিত্রকর দিয়েগোকে ফ্রিদা দেখতেন বড় এক খোকা হিসেবে। তিনি তাঁর ছবিতে দিয়েগোকে আঁকতেন তাঁর কোলে বসে আছেন, এমনভাবে। বড় দুর্ঘটনার পর ফ্রিদার সন্তান হবে না বলে শঙ্কা ছিল। তাই দিয়েগোর প্রতি তাঁর এক ধরনের অপত্যস্নেহ কাজ করত। বাথটাবে অনেক খেলনা ছড়িয়ে রেখে তিনি দিয়েগোকে স্নান করাতেন।
ফ্রিদা তিনবার সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন, তিনবারই অ্যাবরশন হয়ে গিয়েছিল। সন্তানের আশায় দিয়েগো এবার ফ্রিদাকে নিয়ে পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে।
ফ্রিদা যুক্তরাষ্ট্রকে ভালো বাসেননি। তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘অভিজাত সমাজ আমাকে স্বস্তি দেয় না। বড়লোকদের আমার ভালো লাগে না। কারণ, আমি দেখেছি হাজার হাজার মানুষ বাস করছে চরম দারিদ্রের মধ্যে, তাদের খাবার নেই, থাকার মতো বাড়ি নেই, এটা আমাকে দারুণ আহত করে। হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষকে অভুক্ত রেখে বড়লোকেরা ফুর্তি করে বেড়ায়, যা আমাকে বিরক্ত করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে শিল্পের বিকাশ আমাকে মুগ্ধ করে। আমি দেখতে পাচ্ছি, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ভুগছে রুচির বিকারে...তারা যেন বাস করে মুরগির খোঁয়াড়ে, যা ময়লা আর অস্বস্তিতে ভরপুর। বাড়িগুলো যেন ওভেন, বাড়িগুলো সম্পর্কে যা বলা হয়, তা আসলে মিথ। হতে পারে আমি ভুল করছি, কিন্তু আমি সে কথাই বলছি, যা আমি অনুভব করছি।’
যুক্তরাষ্ট্র–ভ্রমণ ফ্রিদার জন্য একেবারেই সুখকর হয়নি। ডেট্রয়েটে থাকাকালীন তিনি অসুখে পড়েছিলেন। সেখানে চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, তিনি আর মা হতে পারবেন না। এ সময় তিনি যে ছবিটি আঁকেন, তার নাম ছিল ‘হেনরি ফোর্ড হাসপাতাল, উড়ন্ত বিছানা’।
ফ্রিদার আঁকাআঁকিতে এ সময় লেগেছে নতুন হাওয়া। দিয়েগো এই সময়টি সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ সময়ে ফ্রিদা যা এঁকেছে, তা এর আগে দেখেনি শিল্পের ইতিহাস—কঠোর সত্যের সামনে দাঁড়ানো নারীর ছবি।’
দিয়েগো রিভেরা অবশ্য হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি এ সময়। নেলসন রকফেলার তাঁকে রেডিও সিটিতে (এখন যা রকফেলার সেন্টার) ফ্রেসকো তৈরি করার কাজ দিয়েছেন। কিন্তু দিয়েগো কী আঁকলেন? তিনি প্রকাশ করলেন পুঁজিবাদকে সিফিলিসের শেষ অধ্যায় হিসেবে। আঁকলেন মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, ত্রোৎস্কিসহ বিপ্লবের নায়কদের ছবি। ছবিগুলো, বিশেষ করে, লেনিনের ছবি দেখে খুবই বিরক্ত হলেন রকফেলার। তিনি ছবিগুলো বদলে দিতে বললেন। ফ্রিদা তাঁর স্বামীকে নতি স্বীকার করতে মানা করলেন। তাতে রকফেলারের নির্দেশে ধ্বংস করে ফেলা হলো দিয়েগোর কীর্তি।
বিপ্লবের প্রতি ওঁরা দুজনেই ছিলেন বিশ্বস্ত। ১৯৩৬ সালে লিয়েভ ত্রোৎস্কির সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁদের। ত্রোৎস্কি তখন স্তালিনের রোষানলে পড়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। মেক্সিকোতে স্ত্রী নাতালিয়া সেদোভায়াসহ ত্রোৎস্কিকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন ফ্রিদা ও দিয়েগো। মেক্সিকোয় রুশ বিপ্লবের ‘খলনায়ক’কে অভ্যর্থনা জানানোর মতো কেউ ছিল না। এই দম্পতিই তাঁদের সঙ্গে সখ্য পাতিয়েছিল।
কনের মা–বাবা এই জুটির নাম দিয়েছিলেন ‘হাতি আর কবুতর’। দেবেন না কেন, বর তো ছিল কনের চেয়ে ২১ বছরের বড়। ১০০ কিলোগ্রামের চেয়েও বেশি ছিল তাঁর ওজন। উচ্চতাও ছিল দেখার মতো।
তবে এ কথা সবাই স্বীকার করতেন যে, দিয়েগো রিভেরার ছিল এক রসিক মন, জীবনের আনন্দের প্রতি ছিল অপরিসীম আনুগত্য, আর হৃদয়টা ছিল খুবই স্পর্শকাতর আর কোমল।
১৯২২ সালেই মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন তিনি। ১৯২৭–২৮ সালে গিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে, তার কিছুদিন আগে নিজ বাড়িতে আতিথ্য দান করেছিলেন সোভিয়েত কবি মায়াকোভ্স্কিকে। তিনি বিয়ে করেছিলেন ফ্রিদা কাহলোকে। ফ্রিদা তখনো খ্যাতি পাননি।
ফ্রিদার বাবা গুয়েরমো কাহলো ছিলেন হাঙ্গেরি থেকে আসা এক ইহুদি। ছবি তোলাই ছিল তাঁর পেশা। মা ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী মাতিলদা কালদেরন। দুই সন্তান ছিল তাঁদের সংসারে। বড়টিই ফ্রিদা। ফ্রিদার চেহারার সঙ্গে তাঁর মায়ের চেহারার ছিল অদ্ভুত মিল। বাবাও মেয়েটাকে ভালোবাসত হৃদয় দিয়ে। বুদ্ধিমতী ছিল মেয়েটি। স্কুলে মেয়েটা ছুটে বেড়াত, যেন এক রঙিন প্রজাপতি। যারা জানত, ছ’বছর বয়সে মেয়েটা পোলিও–আক্রান্ত হয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে বাধ্য হয়েছে, তারা ওর এই চঞ্চল চলাচলে অবাক হতো।
ফ্রিদার এই নান্দনিক ওড়াউড়ি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, যখন তাঁর বয়স সতেরো। যে বাসে করে ফ্রিদা যাচ্ছিল, তা অকস্মাৎ দুর্ঘটনায় পড়ে। একটি ট্রামের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। গুরুতর আহত হন ফ্রিদা। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। কয়েক বছর ধরে চলে চিকিৎসা। তাঁর জীবনের আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। তীব্র ব্যথায় মানসিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যেতে থাকেন ফ্রিদা। মোট ৩৩টি অস্ত্রোপচার হয় তাঁর শরীরে। বলা হয়ে থাকে, নিশ্বাস নেওয়া ছাড়া তাঁর শরীরের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এ সময়টি নিয়ে ফ্রিদা তাঁর মাকে বলেছিলেন পরে, ‘শুধু ছবি আঁকতাম বলেই সে সময় বেঁচে ছিলাম।’
ছবি আঁকার ঘটনাই ফ্রিদা আর দিয়েগো রিভেরার মধ্যে গড়ে দিয়েছিল সেতুবন্ধন। সেই যে স্কুলের দিনগুলোতে ফ্রিদা তন্ময় হয়ে দেখত শিক্ষক দিয়েগোকে, সে স্মৃতি মলিন হয়নি কখনো। কিন্ডারগার্টেন স্কুলের দেয়াল রাঙিয়ে দিতেন দিয়েগো তাঁর নান্দনিক হাতের আঁচড়ে। কয়েক বছর পর সেই শিক্ষকের কাছে নিজের আঁকা ছবি নিয়ে গেলেন ফ্রিদা। ভয় ছিল মনে, বড় শিল্পী হয়তো তাঁকে পাত্তা দেবেন না, তাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু ঘটল একেবারে উল্টো ব্যাপার। খুবই আগ্রহ নিয়ে ফ্রিদার ছবিগুলো দেখলেন দিয়েগো। তবে এ কথা এখন আর স্পষ্ট নয়, কোন বিষয়টি ভালো লেগেছিল দিয়েগোর—ফ্রিদার আঁকা ছবি নাকি স্বয়ং ফ্রিদা। সে রহস্যের জট না খুললেও আমরা অচিরেই দেখতে পাচ্ছি, ফ্রিদাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন দিয়েগো, ফ্রিদার বাবার কাছে। তাতে গুয়েরমো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। মেয়ের প্রায় দ্বিগুণ বয়সী মানুষকে বর হিসেবে মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু প্রগাঢ় ভালোবাসার কাছে পরাজিত হলেন বাবা। হার মানার আগে শুধু বললেন, ‘আমার মেয়ে সারা জীবন অসুস্থ থাকবে। এটা মেনে নিয়ে যদি বিয়ে করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারো, আমি রাজি আছি মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিতে।’
ফ্রিদা বিয়েতে দিলেন জমকালো সাজ। আগুন ছড়ানো কণ্ঠহার, বড় বড় কানের দুল, মেক্সিকোর ঐতিহ্যবাহী গাউনে তাঁকে লাগছিল অসাধারণ। ফ্রিদার অপার সৌন্দর্যে দিয়েগোর আগের বউ লুপে মারিনের মনে জ্বলে উঠল ঈর্ষার আগুন। ফ্রিদার খোঁড়া পা নিয়ে বিদ্রূপ করলেন তিনি, ‘দেখ, কি এক দেশলাই–সদৃশ পায়ের কাছে আমার লোভনীয় পা পরাজিত হয়েছে!’
সেখানেই শুরু হয়ে গেল তর্কযুদ্ধ। অন্যদের তর্কের মধ্যে তর্কে জড়িয়ে পড়লেন ফ্রিদা আর দিয়েগোও। শেষে ফ্রিদা সটান চলে এলেন বাবা–মায়ের কাছে। শুধু কয়েক দিন বাদে দিয়েগো ফ্রিদাকে নিজ ঘরে নিয়ে যেতে পারলেন।
বিয়ের কয়েক দিন পর লুপে মারিন নতুন বউ–বরের বাড়ি এলেন। তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করলেন বাড়ি। দেখলেন তা ঠিকভাবে সাজানো গোছানো হয়েছে কিনা। তারপর ফ্রিদাকে নিয়ে বাজারে গেলেন। তাঁকে নিয়েই কিনলেন রান্নার সরঞ্জাম, দিয়েগোর পছন্দের রান্না শিখিয়ে দিলেন ফ্রিদাকে। বললেন, ‘দিয়েগো কাজ করতে করতেই নাশতা করে। একটা ট্রেতে করে ঢাকা দিয়ে খাবার নিয়ে যেতে হয় সেখানে। যে কাপড়ে ঢাকা থাকবে খাবার, সে কাপড়ে লেখা থাকতে হবে, ‘আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি।’ লুপে এই ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন ম্যাক্সিকান চাষিদের কাছ থেকে।
নব্য দম্পতির জীবন এর পর থেকে সুখে–স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে গিয়েছিল, এমন কথা যারা ভাবছেন, তারা ভুল করছেন। খুব দ্রুতই তাঁদের মধ্যে শুরু হলো ঝগড়াঝাঁটি। দিয়েগো তাঁর বদভ্যাসগুলো থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারছিলেন না। পুরোনো বান্ধবীদের সঙ্গে ঘোরাফেরার উৎসাহ তাঁর বিন্দুমাত্র কমেনি। তিনি সমালোচনা একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। আর ফ্রিদা নিজের নান্দনিক ঔৎসুক্যে জাজ্বল্যমান হয়ে স্বামীর পাপগুলো ধরিয়ে দিতে লাগলেন। দিয়েগো তা সহ্য করতে পারতেন না, হাতের তুলি ছুড়ে ফেলে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে যেতেন। যাওয়ার সময় গালাগাল করতেন ফ্রিদাকে। কিন্তু বাড়ি তো ফিরতেই হতো। ফেরার সময় তাঁর হাত ভরে থাকত উপহারে—দামি দামি কানের দুল, গলার হারসহ কত কিছুই না উপহার দিতেন ফ্রিদাকে। ফ্রিদা খুব পছন্দ করতেন অলংকার। দামি পাথরের অলংকার হোক, হোক সস্তা কাচের—সবটাই ছিল ফ্রিদার পছন্দের। ফ্রিদা ম্যাক্সিকান পোশাক পরতে পছন্দ করতেন, নানা রঙের সুতোয় জড়িয়ে রাখতেন নিজের চুল।
খ্যাতনামা চিত্রকর দিয়েগোকে ফ্রিদা দেখতেন বড় এক খোকা হিসেবে। তিনি তাঁর ছবিতে দিয়েগোকে আঁকতেন তাঁর কোলে বসে আছেন, এমনভাবে। বড় দুর্ঘটনার পর ফ্রিদার সন্তান হবে না বলে শঙ্কা ছিল। তাই দিয়েগোর প্রতি তাঁর এক ধরনের অপত্যস্নেহ কাজ করত। বাথটাবে অনেক খেলনা ছড়িয়ে রেখে তিনি দিয়েগোকে স্নান করাতেন।
ফ্রিদা তিনবার সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন, তিনবারই অ্যাবরশন হয়ে গিয়েছিল। সন্তানের আশায় দিয়েগো এবার ফ্রিদাকে নিয়ে পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে।
ফ্রিদা যুক্তরাষ্ট্রকে ভালো বাসেননি। তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘অভিজাত সমাজ আমাকে স্বস্তি দেয় না। বড়লোকদের আমার ভালো লাগে না। কারণ, আমি দেখেছি হাজার হাজার মানুষ বাস করছে চরম দারিদ্রের মধ্যে, তাদের খাবার নেই, থাকার মতো বাড়ি নেই, এটা আমাকে দারুণ আহত করে। হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষকে অভুক্ত রেখে বড়লোকেরা ফুর্তি করে বেড়ায়, যা আমাকে বিরক্ত করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে শিল্পের বিকাশ আমাকে মুগ্ধ করে। আমি দেখতে পাচ্ছি, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ভুগছে রুচির বিকারে...তারা যেন বাস করে মুরগির খোঁয়াড়ে, যা ময়লা আর অস্বস্তিতে ভরপুর। বাড়িগুলো যেন ওভেন, বাড়িগুলো সম্পর্কে যা বলা হয়, তা আসলে মিথ। হতে পারে আমি ভুল করছি, কিন্তু আমি সে কথাই বলছি, যা আমি অনুভব করছি।’
যুক্তরাষ্ট্র–ভ্রমণ ফ্রিদার জন্য একেবারেই সুখকর হয়নি। ডেট্রয়েটে থাকাকালীন তিনি অসুখে পড়েছিলেন। সেখানে চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, তিনি আর মা হতে পারবেন না। এ সময় তিনি যে ছবিটি আঁকেন, তার নাম ছিল ‘হেনরি ফোর্ড হাসপাতাল, উড়ন্ত বিছানা’।
ফ্রিদার আঁকাআঁকিতে এ সময় লেগেছে নতুন হাওয়া। দিয়েগো এই সময়টি সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ সময়ে ফ্রিদা যা এঁকেছে, তা এর আগে দেখেনি শিল্পের ইতিহাস—কঠোর সত্যের সামনে দাঁড়ানো নারীর ছবি।’
দিয়েগো রিভেরা অবশ্য হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি এ সময়। নেলসন রকফেলার তাঁকে রেডিও সিটিতে (এখন যা রকফেলার সেন্টার) ফ্রেসকো তৈরি করার কাজ দিয়েছেন। কিন্তু দিয়েগো কী আঁকলেন? তিনি প্রকাশ করলেন পুঁজিবাদকে সিফিলিসের শেষ অধ্যায় হিসেবে। আঁকলেন মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, ত্রোৎস্কিসহ বিপ্লবের নায়কদের ছবি। ছবিগুলো, বিশেষ করে, লেনিনের ছবি দেখে খুবই বিরক্ত হলেন রকফেলার। তিনি ছবিগুলো বদলে দিতে বললেন। ফ্রিদা তাঁর স্বামীকে নতি স্বীকার করতে মানা করলেন। তাতে রকফেলারের নির্দেশে ধ্বংস করে ফেলা হলো দিয়েগোর কীর্তি।
বিপ্লবের প্রতি ওঁরা দুজনেই ছিলেন বিশ্বস্ত। ১৯৩৬ সালে লিয়েভ ত্রোৎস্কির সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁদের। ত্রোৎস্কি তখন স্তালিনের রোষানলে পড়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। মেক্সিকোতে স্ত্রী নাতালিয়া সেদোভায়াসহ ত্রোৎস্কিকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন ফ্রিদা ও দিয়েগো। মেক্সিকোয় রুশ বিপ্লবের ‘খলনায়ক’কে অভ্যর্থনা জানানোর মতো কেউ ছিল না। এই দম্পতিই তাঁদের সঙ্গে সখ্য পাতিয়েছিল।
দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মাথার ওপর নীল আকাশে উঁকি দেবে সাদা মেঘ। শরৎকাল বলে ভুল হতে পারে। ভুল ভাঙলে দেখতে পাবেন, মেঘের ভেলা সূর্যের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে হয়ে উঠছে গোলাপি কিংবা লাল। বুঝবেন, আপনি শরতের সাদা মেঘ নয়, দেখছেন তুষারে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
১ দিন আগেকোনো কিছু ওপর থেকে নিচে পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে আমরা সবাই এ বিষয়ে পড়েছি। কিন্তু এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র কাজ করে না। অর্থাৎ সেসব জায়গায় কোনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। যেতে চান সেই সব জায়গায়?
১ দিন আগেশীত, বসন্ত আর বর্ষায় বাংলার নীল নদ সারির রূপ বদলে ফেলে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে দক্ষ মাঝিরাও ভয়ে ভয়ে বইঠা চালান। আর শীতে সারি নদীর নীল পানি দেয় অপার্থিব জগতের খোঁজ। নদীটি ধরে কিছুদূর উজান বাইলেই পাওয়া যাবে লালাখাল জিরো পয়েন্ট।
১ দিন আগেভ্রমণকালে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী না হলে ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেতে পারে। ভ্রমণের সময় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন কিছু উপায়।
১ দিন আগে