তারেক আজিজ
আলবার্ট হলের আলো-আঁধারি সিঁড়ি পেরিয়ে বন্ধু অমৃত দত্তের সঙ্গে সোমেন উঠে এলেন তিন তলার স্টুডিওতে। সোমেন ঢাকার ছেলে, বয়স মাত্র ১৮ বছর। এই বয়সেই গল্প লিখে বেশ নাম করেছেন। এই তো গত বছর ‘সাপ্তাহিক দেশ’ পত্রিকায় একটা গল্প ছাপা হয়েছে—‘শিশু তপন’। সেবার বড়দিনের ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন কলকাতা। কলেজ স্ট্রিটের র্যালফ ফক্সের একটা বই খুঁজছিলেন। স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলার প্রস্তাব দিলেন অমৃত। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের মুখে অমৃত অনেক শুনেছেন এই স্টুডিওর কথা, এর ফটোগ্রাফারের কথা। প্রস্তাবে সাড়া দিলেন সোমেন। ফটোগ্রাফারের নির্দেশমতো পরনের রংজ্বলা ধূসর উলের চাদরটা সরিয়ে রাখলেন সোমেন; বেত বোনা চেয়ারটার পেছন ভাগে হাত রেখে বসলেন। ওদিকে কালো কাপড়ে মাথা ঢেকে তেপায়া ক্যামেরার পেছন–ভাগে দাঁড়ালেন ফটোগ্রাফার। লেন্সের খাপটা খুলে নিয়ে আওড়ালেন ‘ওয়ান, টু, থ্রি…’। ১৯৩৮ সালে ডিসেম্বরের এক বিকেলে তোলা হলো সোমেন চন্দের জীবনের একমাত্র ছবি। এর তিন বছর পরই ঢাকার বুকে আততায়ীর আক্রমণে অমিত সম্ভাবনাময় এই সাহিত্যিকের জীবন প্রদীপ নিভে যায়। আঠারো বছরের সোমেনের মুখটি যার ক্যামেরায় অমর হয়ে রইল, তাঁর নাম চারুচন্দ্র গুহ (১৮৮৪–১৯৫৭)। স্টুডিও ব্যবসার প্রাথমিক যুগে যে ক’জন বাঙালি ফটোগ্রাফার দিশারি হয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের অন্যতম নাম চারু গুহ। নামটি আজকের ঢাকাবাসীর কাছে নতুন ঠেকলেও বুড়িগঙ্গার ওপারে তেঘরিয়ায় জন্ম নেওয়া চারু গুহর কর্মজীবনের শুরুটা কিন্তু হয়েছিল এই ঢাকাতেই।
চারুর জন্ম ১৮৮৪ সালে। মাত্র দশ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। মা শরৎশশী পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে বিপদে পড়ে যান। চা বাগানের কিছু শেয়ার কেনা ছিল, সেগুলো বিক্রি করে সংসার চলতে থাকে। ১৬ বছর বয়সে চারু চলে যান কলকাতায় মামা সুরেন ঘোষের কাছে। সেখানে থেকেই পড়ালেখা চালাতে থাকেন, ভর্তি হন কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টে। ১৯০৫ সালে পাস করবার পরপর দার্জিলিঙে ছবি আঁকার একটা কাজ পেলেন চারু। এই দার্জিলিঙে গিয়ে তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে যায়। চারুর সখ্য গড়ে ওঠে সেখানকার এক ইউরোপীয় ফটোগ্রাফারের সঙ্গে।
ভদ্রলোকের নিজস্ব স্টুডিও ছিল। তবে কিছুদিন পর তিনি স্টুডিও ব্যবসা গুটিয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে দীর্ঘদিনের আলাপচারিতায় চারুও ঝুঁকে পড়লেন ছবি তোলায়। ফটোগ্রাফারের ফেলে যাওয়া ব্যবসার ক্যামেরা, আর আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনে নিতে চাইলেন তিনি। টাকা চেয়ে পূর্ব বাংলায় মাকে চিঠি লিখলেন। সংসারের শত অভাব-অভিযোগের মধ্যেও চারুর চাপাচাপিতে শরৎশশী টাকার জোগাড় করলেন। ছবি তোলার কলাকৌশল শিখে ক্যামেরা, আর অন্যান্য যন্ত্রপাতিসহ চারু ফিরে এলেন তেঘরিয়ায়, মায়ের কাছে। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে তো আর স্টুডিও ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়। ওদিকে ছোট ভাই পরেশও মেডিকেল স্কুল পাস করে ডাক্তার হয়েছেন। দুই ভাই মিলে বাসা ভাড়া করে মাকে নিয়ে সংসার পাতলেন ঢাকায়। আর সদরঘাটের কাছেই চারু খুললেন তাঁর স্বপ্নের নিজস্ব স্টুডিও।
চারু যে সময়ে ফটো স্টুডিওর ব্যবসা শুরু করেন, সে সময় ঢাকার মাত্র দুটি বাণিজ্যিক স্টুডিওর নাম জানা যায়—ক্যাপ ফ্রিৎজ স্টুডিও ও বেঙ্গল স্টুডিও। ওয়াইজঘাটের ক্যাপ ফ্রিৎজ স্টুডিওর ফটোগ্রাফার ছিলেন জার্মান নাগরিক ফ্রিৎজ ক্যাপ। ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহর আর্থিক সহযোগিতায় বিশ শতকের শুরুতে ক্যাপ এই স্টুডিও চালু করেন। অন্যদিকে বেঙ্গল স্টুডিওর ফটোগ্রাফার ছিলেন পি মুখার্জি। চারু গুহ স্টুডিও চালুর পরের বছর নবাবপুর রোডে চালু হয় ‘আর সি দাস এন্ড সন্স’ নামে এক স্টুডিও। সেখানে ছবি তোলার পাশাপাশি ক্যামেরা, ছবি ছাপানোর কাগজ, রাসায়নিক—এসবও বিক্রি হতো। ক্রমে গড়ে ওঠে খাজা আফজালের স্টুডিও, খাজা সোলায়মান কাদেরের স্টুডিও ও টেকনিক্যাল আর্ট স্টুডিও। অনেক পরে ত্রিশের দশকে নবাবপুর রোডে চালু হয় ডস অ্যান্ড কোম্পানি। ছবি তোলাও কারও পেশা হতে পারে! বিষয়টি স্থানীয় ঢাকাবাসীর কাছে ছিল রীতিমতো অভিনব। তাঁরা পেশাটির চমৎকার এক নাম দেয় ‘ফটোওয়ালা’।
১৯০১ সালে ঢাকাবাসী প্রথম বিদ্যুতের আলো দেখতে পেলেও প্রথম দু–তিন দশক তা সহজলভ্য ছিল না। অল্প কিছু আবাসিক ভবন, আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু থাকত রাতের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। বিদ্যুতের অপ্রতুলতার কারণে বেশির ভাগ ব্যবসার মতো স্টুডিও ব্যবসাও ছিল সূর্যের আলোনির্ভর। এ ধরনের স্টুডিওকে বলা হতো ডে–লাইট স্টুডিও। চারুর স্টুডিওটি ছিল সেরকমই। স্টুডিওর নিচতলা ছিল ডার্ক রুম আর কাউন্টার। কখনো দোকানের সামনে, কখনো ওপরতলায় টিনের চাল বা বাঁশের বেড়ার সাহায্যে আলো নিয়ন্ত্রণ করে সফট লাইটে ছবি তোলা হতো। পেছনে ঝোলানো থাকত প্রয়োজনমতো নিজের ছবি আঁকা কাপড়ে তৈরি ব্যাকড্রপ। সাধারণের ছবি তোলার জন্য এই স্টুডিও খোলা থাকত সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এত স্বপ্ন আর উদ্যোগ নিয়ে চালু করার পরও চারুর স্টুডিও ব্যবসা লাভের মুখ দেখল না। স্টুডিও নিয়ে চারুর নিজের অতৃপ্তি ছিল। দার্জিলিঙে বিদ্যুতের সুবিধা ছিল, কৃত্রিম আলোকে নিয়ন্ত্রণ করে ফটোতে নানান শৈল্পিক মাত্রা যোগ করা যেত। আলোছায়ার খেলাকে ধারণ করবার সেই সুযোগ ঢাকায় সীমিত। এ সীমাবদ্ধতার সঙ্গে আয়ের বিষয়টিও যোগ হলো।
ফটোগ্রাফির প্রথম যুগে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলা ছিল বাঙালির কাছে বিলাসিতা। ঢাকার প্রভাবশালী লোকজন আর এখানে অবস্থানরত ইউরোপীয়রা আগে থেকেই ক্যাপের স্টুডিওতে ছবি তুলতেন। এর পাশাপাশি অন্য বিত্তবানদেরও নানা প্রয়োজনে কলকাতা যাওয়া–আসা ছিল, সেখানকার প্রসিদ্ধ স্টুডিওতে ছবি তুলতে তাঁরা গর্ববোধ করতেন। তাই কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া স্টুডিও ব্যবসা নিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ফটোওয়ালার সংসারও বড় হয়েছে। চারু বিয়ে করেছেন, জন্ম নিয়েছে সুধাংশু বালা ও চারুর প্রথম সন্তান। আট বছরের কিছু বেশি সময় চালানোর পর নানা প্রতিকূলতায় স্টুডিওটি বন্ধ হয়ে যায়। সেটা ১৯১৭ সালের কথা। এর পর পরিবার নিয়ে চারু চলে যান কলকাতা।
কলকাতায় পৌঁছে প্রথম শুরু করলেন ঘুরে ঘুরে ছবি তোলার কাজ। সারা দিন একটা ভারী ক্যামেরা নিয়ে ট্রামে চেপে আউটডোরে ছবি তুলতেন। বিকেলে ধর্মতলার এক স্টুডিওর ডার্ক রুমে বসে সেসব ডেভেলপ করতেন। নিজের সঞ্চয়ে একসময় হ্যারিসন রোডের (বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোড) যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেখানে নতুন করে স্টুডিও ব্যবসা চালু করেন। এবার প্রথমেই করলেন বিদ্যুতের ব্যবস্থা, হাজার ওয়াটের এক বাল্ব জুড়ে দিলেন স্টুডিওতে। স্টুডিওর নামও রাখলেন ‘ইলেক্ট্রো ফটো স্টুডিও’। হ্যারিসন রোডে ছবি তুলবার মানুষ পেতে চারুকে বেগ পেতে হলো না।
শিয়ালদহ আর হাওড়া রেলস্টেশনে যাতায়াত করা মানুষেরা চারুর খ্যাতি ছড়িয়ে দিল। ব্যবসার পসারের সঙ্গে চারু চলে এলেন কলেজ স্ট্রিটের আলবার্ট হলের (বর্তমানে যে ভবনে ইন্ডিয়ান কফি হাউস) তিন তলায়। এ কালের মতো তখনো আলবার্ট হল ছিল সামাজিক, রাজনৈতিক নানা কর্মসূচির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। স্টুডিও পোর্ট্রেটের পাশাপাশি সেসব সভা-সমাবেশ ক্যামেরাবন্দী করার কাজটিও পেয়ে গেলেন চারু গুহ। সন্ধ্যার পর তাঁর স্টুডিও হয়ে উঠল সেকালের রথী-মহারথীদের মিলনমেলা। চারুর ক্যামেরায় অমর হয়ে রইলেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর, গায়ক পঙ্কজ মল্লিকসহ বহু গুণীজন।
এক বিকেলে ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন এলেন, সঙ্গে কবি সুফিয়া এন হোসেন (পরবর্তীকালে বেগম সুফিয়া কামাল)। সেটা ১৯২৯ সালের কথা। নাসিরউদ্দীন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ‘সওগাত’–এর একটি নারী সংখ্যা প্রকাশ করবেন, যেখানে লেখিকাদের ছবিসহ লেখা থাকবে। সেকালে মুসলিম নারীদের ছবি তোলার উদাহরণ বিরল। কবি সুফিয়া কামাল কখনো ক্যামেরার সামনে দাঁড়াননি। চারুও কোনো মুসলিম নারীর ছবি তোলেননি। এর সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে নাসিরুদ্দীনকে সতর্কও করেন চারু। কিন্তু নাসিরুদ্দীন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। প্রথম এক মুসলিম নারী কবির ছবি তোলার কোনো পারিশ্রমিক নিলেন না চারু। ছবিগুলো সযত্নে পাঠিয়ে দিলেন ‘সওগাত’ অফিসে। চারুর তোলা সেই ছবিসহ প্রথম নারী সংখ্যা ‘সওগাত’ প্রকাশ পায় সে বছরের সেপ্টেম্বরে। এ সংখ্যা প্রকাশের পর অনেক মুসলিম লেখিকা তাঁদের ছবি পত্রিকায় ছাপাতে সম্মত হন।
কাজের উৎকর্ষের জন্য চারু সব সময় ছিলেন সচেষ্ট। ১৯৩১ সালে নিজ অর্থব্যয়ে জার্মানি গিয়ে শিখে আসেন ছবি তোলার আধুনিক সব কলাকৌশল। তাঁর সেসব কৌশল সেকালের বাঙালির জন্য ছিল অভিনব। কলেজ স্ট্রিটের আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের জন্যও ছবি তোলার গন্তব্য হয়ে ওঠে চারুর স্টুডিও। সেই কথা স্মরণ করেছেন ভাষাতত্ত্ববিদ সুকুমার সেন, ‘আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন আলবার্ট হলের ওপরতলায় তাঁর স্টুডিওটি গ্র্যাজুয়েট ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের তীর্থস্থানের মতো ছিল। সেনেট হাউসে কনভোকেশনের পর স্নাতক ও স্নাতকোত্তরেরা দলে দলে তাঁর স্টুডিওতে গিয়ে গাউন হুড পরে ছবি তোলাতো।’
চারু গুহর জীবনাবসান হয় ১৯৫৭ সালে। মৃত্যুর পর বড় ছেলে চিত্তরঞ্জন চার দশক ধরে চালিয়ে নেন ছবি তোলার ব্যবসা। স্টুডিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার বেশ অনেক কাল পর চারুর উত্তরসূরিরা সেখানে গড়ে তোলেন এক প্রদর্শনীশালা। সাধারণ পেশাজীবী মানুষকে ছবি তোলায় আকৃষ্ট করার জন্য এক কালে চারু আলবার্ট হলের দেয়ালে জুড়ে দিয়েছিলেন, ‘Your mother, wife and Children-keep them nearby photograph’, ‘If you want a record, have it photographed’, ‘If you have beauty I will take it, if you have none, come, I will make it. ’ ইত্যাদি কত কত বিজ্ঞাপন! রং চটে যাওয়া মলিন সেসব বিজ্ঞাপনের কিছু আজও টিকে আছে। আর স্টুডিওতে ঢুকবার মুখে চারুর তোলা কিছু ছবি পিন দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। বড় বড় স্বপ্নভরা চোখ নিয়ে সোমেন চন্দ সেখানে দিব্যি তাকিয়ে আছেন, ঠিক যেমনটি ছিলেন চারুর লেন্সের সামনে, আজ থেকে আশি বছর আগে।
সহায়ক সূত্র:
১. চারু গুহ: জীবন ও আলোকচিত্র, বই-চিত্র, ২০০৭
২. বেগম, ৫০ বর্ষ পূর্তি সংখ্যা, ২০০০
৩. পুরান ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ, অনুপম হায়াৎ, বাংলা একাডেমি, ২০০১
তারেক আজিজ: অধ্যাপক, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
আলবার্ট হলের আলো-আঁধারি সিঁড়ি পেরিয়ে বন্ধু অমৃত দত্তের সঙ্গে সোমেন উঠে এলেন তিন তলার স্টুডিওতে। সোমেন ঢাকার ছেলে, বয়স মাত্র ১৮ বছর। এই বয়সেই গল্প লিখে বেশ নাম করেছেন। এই তো গত বছর ‘সাপ্তাহিক দেশ’ পত্রিকায় একটা গল্প ছাপা হয়েছে—‘শিশু তপন’। সেবার বড়দিনের ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন কলকাতা। কলেজ স্ট্রিটের র্যালফ ফক্সের একটা বই খুঁজছিলেন। স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলার প্রস্তাব দিলেন অমৃত। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের মুখে অমৃত অনেক শুনেছেন এই স্টুডিওর কথা, এর ফটোগ্রাফারের কথা। প্রস্তাবে সাড়া দিলেন সোমেন। ফটোগ্রাফারের নির্দেশমতো পরনের রংজ্বলা ধূসর উলের চাদরটা সরিয়ে রাখলেন সোমেন; বেত বোনা চেয়ারটার পেছন ভাগে হাত রেখে বসলেন। ওদিকে কালো কাপড়ে মাথা ঢেকে তেপায়া ক্যামেরার পেছন–ভাগে দাঁড়ালেন ফটোগ্রাফার। লেন্সের খাপটা খুলে নিয়ে আওড়ালেন ‘ওয়ান, টু, থ্রি…’। ১৯৩৮ সালে ডিসেম্বরের এক বিকেলে তোলা হলো সোমেন চন্দের জীবনের একমাত্র ছবি। এর তিন বছর পরই ঢাকার বুকে আততায়ীর আক্রমণে অমিত সম্ভাবনাময় এই সাহিত্যিকের জীবন প্রদীপ নিভে যায়। আঠারো বছরের সোমেনের মুখটি যার ক্যামেরায় অমর হয়ে রইল, তাঁর নাম চারুচন্দ্র গুহ (১৮৮৪–১৯৫৭)। স্টুডিও ব্যবসার প্রাথমিক যুগে যে ক’জন বাঙালি ফটোগ্রাফার দিশারি হয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের অন্যতম নাম চারু গুহ। নামটি আজকের ঢাকাবাসীর কাছে নতুন ঠেকলেও বুড়িগঙ্গার ওপারে তেঘরিয়ায় জন্ম নেওয়া চারু গুহর কর্মজীবনের শুরুটা কিন্তু হয়েছিল এই ঢাকাতেই।
চারুর জন্ম ১৮৮৪ সালে। মাত্র দশ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। মা শরৎশশী পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে বিপদে পড়ে যান। চা বাগানের কিছু শেয়ার কেনা ছিল, সেগুলো বিক্রি করে সংসার চলতে থাকে। ১৬ বছর বয়সে চারু চলে যান কলকাতায় মামা সুরেন ঘোষের কাছে। সেখানে থেকেই পড়ালেখা চালাতে থাকেন, ভর্তি হন কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টে। ১৯০৫ সালে পাস করবার পরপর দার্জিলিঙে ছবি আঁকার একটা কাজ পেলেন চারু। এই দার্জিলিঙে গিয়ে তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে যায়। চারুর সখ্য গড়ে ওঠে সেখানকার এক ইউরোপীয় ফটোগ্রাফারের সঙ্গে।
ভদ্রলোকের নিজস্ব স্টুডিও ছিল। তবে কিছুদিন পর তিনি স্টুডিও ব্যবসা গুটিয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে দীর্ঘদিনের আলাপচারিতায় চারুও ঝুঁকে পড়লেন ছবি তোলায়। ফটোগ্রাফারের ফেলে যাওয়া ব্যবসার ক্যামেরা, আর আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনে নিতে চাইলেন তিনি। টাকা চেয়ে পূর্ব বাংলায় মাকে চিঠি লিখলেন। সংসারের শত অভাব-অভিযোগের মধ্যেও চারুর চাপাচাপিতে শরৎশশী টাকার জোগাড় করলেন। ছবি তোলার কলাকৌশল শিখে ক্যামেরা, আর অন্যান্য যন্ত্রপাতিসহ চারু ফিরে এলেন তেঘরিয়ায়, মায়ের কাছে। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে তো আর স্টুডিও ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়। ওদিকে ছোট ভাই পরেশও মেডিকেল স্কুল পাস করে ডাক্তার হয়েছেন। দুই ভাই মিলে বাসা ভাড়া করে মাকে নিয়ে সংসার পাতলেন ঢাকায়। আর সদরঘাটের কাছেই চারু খুললেন তাঁর স্বপ্নের নিজস্ব স্টুডিও।
চারু যে সময়ে ফটো স্টুডিওর ব্যবসা শুরু করেন, সে সময় ঢাকার মাত্র দুটি বাণিজ্যিক স্টুডিওর নাম জানা যায়—ক্যাপ ফ্রিৎজ স্টুডিও ও বেঙ্গল স্টুডিও। ওয়াইজঘাটের ক্যাপ ফ্রিৎজ স্টুডিওর ফটোগ্রাফার ছিলেন জার্মান নাগরিক ফ্রিৎজ ক্যাপ। ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহর আর্থিক সহযোগিতায় বিশ শতকের শুরুতে ক্যাপ এই স্টুডিও চালু করেন। অন্যদিকে বেঙ্গল স্টুডিওর ফটোগ্রাফার ছিলেন পি মুখার্জি। চারু গুহ স্টুডিও চালুর পরের বছর নবাবপুর রোডে চালু হয় ‘আর সি দাস এন্ড সন্স’ নামে এক স্টুডিও। সেখানে ছবি তোলার পাশাপাশি ক্যামেরা, ছবি ছাপানোর কাগজ, রাসায়নিক—এসবও বিক্রি হতো। ক্রমে গড়ে ওঠে খাজা আফজালের স্টুডিও, খাজা সোলায়মান কাদেরের স্টুডিও ও টেকনিক্যাল আর্ট স্টুডিও। অনেক পরে ত্রিশের দশকে নবাবপুর রোডে চালু হয় ডস অ্যান্ড কোম্পানি। ছবি তোলাও কারও পেশা হতে পারে! বিষয়টি স্থানীয় ঢাকাবাসীর কাছে ছিল রীতিমতো অভিনব। তাঁরা পেশাটির চমৎকার এক নাম দেয় ‘ফটোওয়ালা’।
১৯০১ সালে ঢাকাবাসী প্রথম বিদ্যুতের আলো দেখতে পেলেও প্রথম দু–তিন দশক তা সহজলভ্য ছিল না। অল্প কিছু আবাসিক ভবন, আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু থাকত রাতের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। বিদ্যুতের অপ্রতুলতার কারণে বেশির ভাগ ব্যবসার মতো স্টুডিও ব্যবসাও ছিল সূর্যের আলোনির্ভর। এ ধরনের স্টুডিওকে বলা হতো ডে–লাইট স্টুডিও। চারুর স্টুডিওটি ছিল সেরকমই। স্টুডিওর নিচতলা ছিল ডার্ক রুম আর কাউন্টার। কখনো দোকানের সামনে, কখনো ওপরতলায় টিনের চাল বা বাঁশের বেড়ার সাহায্যে আলো নিয়ন্ত্রণ করে সফট লাইটে ছবি তোলা হতো। পেছনে ঝোলানো থাকত প্রয়োজনমতো নিজের ছবি আঁকা কাপড়ে তৈরি ব্যাকড্রপ। সাধারণের ছবি তোলার জন্য এই স্টুডিও খোলা থাকত সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এত স্বপ্ন আর উদ্যোগ নিয়ে চালু করার পরও চারুর স্টুডিও ব্যবসা লাভের মুখ দেখল না। স্টুডিও নিয়ে চারুর নিজের অতৃপ্তি ছিল। দার্জিলিঙে বিদ্যুতের সুবিধা ছিল, কৃত্রিম আলোকে নিয়ন্ত্রণ করে ফটোতে নানান শৈল্পিক মাত্রা যোগ করা যেত। আলোছায়ার খেলাকে ধারণ করবার সেই সুযোগ ঢাকায় সীমিত। এ সীমাবদ্ধতার সঙ্গে আয়ের বিষয়টিও যোগ হলো।
ফটোগ্রাফির প্রথম যুগে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলা ছিল বাঙালির কাছে বিলাসিতা। ঢাকার প্রভাবশালী লোকজন আর এখানে অবস্থানরত ইউরোপীয়রা আগে থেকেই ক্যাপের স্টুডিওতে ছবি তুলতেন। এর পাশাপাশি অন্য বিত্তবানদেরও নানা প্রয়োজনে কলকাতা যাওয়া–আসা ছিল, সেখানকার প্রসিদ্ধ স্টুডিওতে ছবি তুলতে তাঁরা গর্ববোধ করতেন। তাই কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া স্টুডিও ব্যবসা নিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ফটোওয়ালার সংসারও বড় হয়েছে। চারু বিয়ে করেছেন, জন্ম নিয়েছে সুধাংশু বালা ও চারুর প্রথম সন্তান। আট বছরের কিছু বেশি সময় চালানোর পর নানা প্রতিকূলতায় স্টুডিওটি বন্ধ হয়ে যায়। সেটা ১৯১৭ সালের কথা। এর পর পরিবার নিয়ে চারু চলে যান কলকাতা।
কলকাতায় পৌঁছে প্রথম শুরু করলেন ঘুরে ঘুরে ছবি তোলার কাজ। সারা দিন একটা ভারী ক্যামেরা নিয়ে ট্রামে চেপে আউটডোরে ছবি তুলতেন। বিকেলে ধর্মতলার এক স্টুডিওর ডার্ক রুমে বসে সেসব ডেভেলপ করতেন। নিজের সঞ্চয়ে একসময় হ্যারিসন রোডের (বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোড) যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেখানে নতুন করে স্টুডিও ব্যবসা চালু করেন। এবার প্রথমেই করলেন বিদ্যুতের ব্যবস্থা, হাজার ওয়াটের এক বাল্ব জুড়ে দিলেন স্টুডিওতে। স্টুডিওর নামও রাখলেন ‘ইলেক্ট্রো ফটো স্টুডিও’। হ্যারিসন রোডে ছবি তুলবার মানুষ পেতে চারুকে বেগ পেতে হলো না।
শিয়ালদহ আর হাওড়া রেলস্টেশনে যাতায়াত করা মানুষেরা চারুর খ্যাতি ছড়িয়ে দিল। ব্যবসার পসারের সঙ্গে চারু চলে এলেন কলেজ স্ট্রিটের আলবার্ট হলের (বর্তমানে যে ভবনে ইন্ডিয়ান কফি হাউস) তিন তলায়। এ কালের মতো তখনো আলবার্ট হল ছিল সামাজিক, রাজনৈতিক নানা কর্মসূচির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। স্টুডিও পোর্ট্রেটের পাশাপাশি সেসব সভা-সমাবেশ ক্যামেরাবন্দী করার কাজটিও পেয়ে গেলেন চারু গুহ। সন্ধ্যার পর তাঁর স্টুডিও হয়ে উঠল সেকালের রথী-মহারথীদের মিলনমেলা। চারুর ক্যামেরায় অমর হয়ে রইলেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর, গায়ক পঙ্কজ মল্লিকসহ বহু গুণীজন।
এক বিকেলে ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন এলেন, সঙ্গে কবি সুফিয়া এন হোসেন (পরবর্তীকালে বেগম সুফিয়া কামাল)। সেটা ১৯২৯ সালের কথা। নাসিরউদ্দীন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ‘সওগাত’–এর একটি নারী সংখ্যা প্রকাশ করবেন, যেখানে লেখিকাদের ছবিসহ লেখা থাকবে। সেকালে মুসলিম নারীদের ছবি তোলার উদাহরণ বিরল। কবি সুফিয়া কামাল কখনো ক্যামেরার সামনে দাঁড়াননি। চারুও কোনো মুসলিম নারীর ছবি তোলেননি। এর সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে নাসিরুদ্দীনকে সতর্কও করেন চারু। কিন্তু নাসিরুদ্দীন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। প্রথম এক মুসলিম নারী কবির ছবি তোলার কোনো পারিশ্রমিক নিলেন না চারু। ছবিগুলো সযত্নে পাঠিয়ে দিলেন ‘সওগাত’ অফিসে। চারুর তোলা সেই ছবিসহ প্রথম নারী সংখ্যা ‘সওগাত’ প্রকাশ পায় সে বছরের সেপ্টেম্বরে। এ সংখ্যা প্রকাশের পর অনেক মুসলিম লেখিকা তাঁদের ছবি পত্রিকায় ছাপাতে সম্মত হন।
কাজের উৎকর্ষের জন্য চারু সব সময় ছিলেন সচেষ্ট। ১৯৩১ সালে নিজ অর্থব্যয়ে জার্মানি গিয়ে শিখে আসেন ছবি তোলার আধুনিক সব কলাকৌশল। তাঁর সেসব কৌশল সেকালের বাঙালির জন্য ছিল অভিনব। কলেজ স্ট্রিটের আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের জন্যও ছবি তোলার গন্তব্য হয়ে ওঠে চারুর স্টুডিও। সেই কথা স্মরণ করেছেন ভাষাতত্ত্ববিদ সুকুমার সেন, ‘আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন আলবার্ট হলের ওপরতলায় তাঁর স্টুডিওটি গ্র্যাজুয়েট ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের তীর্থস্থানের মতো ছিল। সেনেট হাউসে কনভোকেশনের পর স্নাতক ও স্নাতকোত্তরেরা দলে দলে তাঁর স্টুডিওতে গিয়ে গাউন হুড পরে ছবি তোলাতো।’
চারু গুহর জীবনাবসান হয় ১৯৫৭ সালে। মৃত্যুর পর বড় ছেলে চিত্তরঞ্জন চার দশক ধরে চালিয়ে নেন ছবি তোলার ব্যবসা। স্টুডিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার বেশ অনেক কাল পর চারুর উত্তরসূরিরা সেখানে গড়ে তোলেন এক প্রদর্শনীশালা। সাধারণ পেশাজীবী মানুষকে ছবি তোলায় আকৃষ্ট করার জন্য এক কালে চারু আলবার্ট হলের দেয়ালে জুড়ে দিয়েছিলেন, ‘Your mother, wife and Children-keep them nearby photograph’, ‘If you want a record, have it photographed’, ‘If you have beauty I will take it, if you have none, come, I will make it. ’ ইত্যাদি কত কত বিজ্ঞাপন! রং চটে যাওয়া মলিন সেসব বিজ্ঞাপনের কিছু আজও টিকে আছে। আর স্টুডিওতে ঢুকবার মুখে চারুর তোলা কিছু ছবি পিন দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। বড় বড় স্বপ্নভরা চোখ নিয়ে সোমেন চন্দ সেখানে দিব্যি তাকিয়ে আছেন, ঠিক যেমনটি ছিলেন চারুর লেন্সের সামনে, আজ থেকে আশি বছর আগে।
সহায়ক সূত্র:
১. চারু গুহ: জীবন ও আলোকচিত্র, বই-চিত্র, ২০০৭
২. বেগম, ৫০ বর্ষ পূর্তি সংখ্যা, ২০০০
৩. পুরান ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ, অনুপম হায়াৎ, বাংলা একাডেমি, ২০০১
তারেক আজিজ: অধ্যাপক, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মাথার ওপর নীল আকাশে উঁকি দেবে সাদা মেঘ। শরৎকাল বলে ভুল হতে পারে। ভুল ভাঙলে দেখতে পাবেন, মেঘের ভেলা সূর্যের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে হয়ে উঠছে গোলাপি কিংবা লাল। বুঝবেন, আপনি শরতের সাদা মেঘ নয়, দেখছেন তুষারে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
১ দিন আগেকোনো কিছু ওপর থেকে নিচে পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে আমরা সবাই এ বিষয়ে পড়েছি। কিন্তু এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র কাজ করে না। অর্থাৎ সেসব জায়গায় কোনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। যেতে চান সেই সব জায়গায়?
১ দিন আগেশীত, বসন্ত আর বর্ষায় বাংলার নীল নদ সারির রূপ বদলে ফেলে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে দক্ষ মাঝিরাও ভয়ে ভয়ে বইঠা চালান। আর শীতে সারি নদীর নীল পানি দেয় অপার্থিব জগতের খোঁজ। নদীটি ধরে কিছুদূর উজান বাইলেই পাওয়া যাবে লালাখাল জিরো পয়েন্ট।
১ দিন আগেভ্রমণকালে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী না হলে ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেতে পারে। ভ্রমণের সময় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন কিছু উপায়।
১ দিন আগে