মন্টি বৈষ্ণব
ঘুরতে যেতে কে না ভালোবাসে। বাঙালি হিসেবে আমরা বরাবরই ভ্রমণপিপাসু জাতি। প্রতিদিনের একঘেয়ে জীবনে মানুষ যখন হাঁপিয়ে ওঠে, তখনই মন পালাই পালাই করে। ঠিক সে সময় যদি ছুটি মিলে যায়, তবে সেই সুযোগ হাতছাড়া না করে অনেকেই ঘুরতে চলে যান পাহাড়ে কিংবা সমুদ্রে। আবার ভ্রমণে গেলে যান্ত্রিক জীবন থেকে পাওয়া যায় মুক্তি। পুতুলের মতো টানা কাজ করা থেকে পাওয়া যায় কিছু সময়ের বিরতি।
ঘড়ির সঙ্গে ঘুরতে থাকা জীবনে কিছুটা বদল তো চাই। স্বাদ হোক আর হাওয়া বদলই হোক, ভ্রমণের চেয়ে ভালো কিছু তো নেই। তাই ভ্রমণই সই। মন নেচে উঠল ভাবতেই। সঙ্গে ঢোলের বাড়ি হয়ে এল বোনের কাছ থেকে পাহাড়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে গেলাম; গন্তব্য খাগড়াছড়ি।
আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম ১৩ এপ্রিলের রাতে। আরামবাগ থেকে বাসে করে রওনা দিলাম। যাত্রা অবশ্য ব্যাঘাতহীন ছিল না। পোহাতে হয়েছে ভোগান্তি। না, তেমন বড় কিছু নয়। স্থানে স্থানে সড়কের দশা ও বাহনের শরীর-স্বাস্থ্য মিলিয়ে একটা অবস্থা আরকি। মাঝপথে শ্যামলী পরিবহনের গাড়ির (নন এসি) এঁকেবেঁকে চলতে দেখে মনে মনে গাইলাম ‘তোমার সাপের বেণি নাচে না, নাচে শ্যামলী পরিবহনের গাড়ি’।
বেহাল সড়ক পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছালাম খাগড়াছড়িতে। রাস্তার কারণে ঘুমাতে না পারার সুবিধাটা হলো ভোরের আলো ফুটতে দেখেছি। ভোরের আলোয় অদ্ভুত এক মায়াবী পরশ জড়িয়ে থাকে। গাড়ি থেকে মনে হয় কোনো এক রাজকন্যা আলতো ছোঁয়ায় ভোরকে রাঙিয়ে দিচ্ছে।
আমরা দলে ভারী ছিলাম। তাই পূজা-পার্বণে কারও বাড়িতে গিয়ে সমস্যায় ফেলতে চাইনি। উঠলাম হোটেল গাইরিংয়ে। গাইরিং মানে হচ্ছে টংঘর। হোটেলের প্রবেশপথেই দেখা হলো মধুমঞ্জুরি ফুলেদের সঙ্গে। তাদের অভ্যর্থনা বেশ ভালোই লাগল। এর কিছুক্ষণ পরই কোকিলের ডাক শুনে মুগ্ধ হলাম। ভালো লাগার বিষয় ছিল, এই কোকিলের ডাক শুনলাম টানা তিন দিন। যেখানে যেতাম, সেখানেই মনে হতো কোকিলেরা আমাদের সঙ্গেই রয়েছে।
দিনটি ছিল ১৪ এপ্রিল। মানে পয়লা বৈশাখ। হোটেল থেকে হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। চলে গেলাম ঠাকুরছড়া গ্রামের ভবতোষ রোয়াজা দাদার বাড়িতে। এ গ্রামের কথা বলার আগে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর পূজা-পার্বণের কথা বলতে চাই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা জনগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি। ত্রিপুরাদের বৈসু বা বৈসুক, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু নামের আদ্যক্ষর দিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি।
ত্রিপুরারা বৈসু উৎসব একটানা তিন দিন ধরে, মানে বাংলা বছরের শেষ দুই দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন উদ্যাপন করে। দিনের পরিক্রমায় এই তিন দিনের অনুষ্ঠানগুলোর নাম হলো প্রথম দিন হারি বৈসু, দ্বিতীয় দিন বৈসু বা বৈসুক মা, আর তৃতীয় দিন বিসিকাতাল।
হারি বৈসু: হারি বৈসু দিয়ে উৎসবের প্রথম দিনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন এই উৎসব পালন করা হয়। এই দিনে খুব ভোরে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে ফুল সংগ্রহ করে এখানকার কিশোর-কিশোরীরা। এরপর সেই ফুল দিয়ে মালা তৈরি করে ঝোলানো হয় ঘরের দরজায়। ফুলের সঙ্গে দেওয়া হয় নিমপাতা, আমপাতাও। পাশাপাশি গৃহপালিত পশুর গলায়ও ফুলের মালা পরানো হয়। ফুল ঘরকে সুবাসিত করে আর নিমপাতা বাড়িকে রোগবালাই থেকে দূরে রাখে। এই দিনে অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে দেবতা পুকুরে তীর্থ দর্শনে যায়। এ ছাড়া এই দিনে ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী গরিয়া নৃত্যের দল বিভিন্ন পাড়া প্রদক্ষিণ করে বেড়ায়।
বৈসু/বৈসুক মা: চৈত্র মাসের শেষ দিন, অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তিতে এই উৎসব পালন করা হয়। এদিন সকালে বাড়ির ছেলেমেয়েরা কুচাই পানি (কুচাই পানিকে ত্রিপুরারা পবিত্র পানি বলে গণ্য করে) দিয়ে স্নান করে। এরপর গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির উঠানে গিয়ে গৃহপালিত পশুদের জন্য ধান ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এই দিন প্রাণী হত্যা করা হয় না। ঘরে ঘরে রান্না করা হয় হরেক রকমের সবজি দিয়ে নিরামিষ তরকারি। এই জনপ্রিয় তরকারি পাচন নামে পরিচিত। এ ছাড়া এই দিনে ঘরে ঘরে তৈরি করা হয় নানা রকমের পিঠা। আর বিকেল থেকে শুরু হয় এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় বেড়ানো।
বিসিকাতাল: বছরের প্রথম দিনে পালন করা হয় বিসিকাতাল বা নববর্ষ। বিসিকাতাল মূলত ত্রিপুরাদের নববর্ষ। এই দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হয়। সকালে বাড়ির ছেলেমেয়েরা বাবা-মাসহ বাড়ির গুরুজনদের স্নান করায়। এতে পারিবারিক বন্ধন হয় দৃঢ়। এ ছাড়া এই দিনে সবাই মন্দিরে গিয়ে প্রণাম করে আসে। সবার মঙ্গল কামনা করে গঙ্গাকে উদ্দেশ্য করে জলপূজা করা হয়। গঙ্গাপূজায় আগামী দিনের সুখ-শান্তির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়। এ ছাড়া নদীর পাড়ে কলাপাতায় ফুল, টাকা, মোমবাতি, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে করা হয় পূজা। গঙ্গাপূজার প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে পানি দিয়ে পুরোনো দিনের সব গ্লানি ধুয়ে দেওয়া। এই দিনও আবার অনেকে দেবতা পুকুর দর্শন করতে যায়। এ ছাড়া বিসিকাতাল দিনে আমিষসহ ভালোমন্দ খাবারের আয়োজন করা হয়। এই দিন ভালো খাবার খাওয়াতে পারলে সারা বছর ভালো যাবে বলে বিশ্বাস করা হয়।
এবার আসি ঠাকুরছড়া গ্রামের আলাপে। ভবতোষ দাদার বাড়িতে ঢুকতেই মাথার সঙ্গে টুক করে লাগল ফুল ও পাতা দিয়ে তৈরি মালা। দরজার ওপরে নানা রঙের ফুলের মালা দেখে মনটা ভরে উঠল। দুপুরে খেতে বসে দেখলাম নানা রকমের খাবারের আয়োজন। খাবারের মধ্যে ছিল বৈসুর বিশেষ খাবার পাচন, তেল ছাড়া বিভিন্ন তরকারি। তবে এসব খাবারে শুঁটকির প্রাধান্য ছিল অনেক বেশি। অবাক করার মতো স্বাদ ছিল শুধু সেদ্ধ করেই তৈরি করা মজাদার সব তরকারির। আমরা খুব তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। এরপর গেলাম কাটা ধানের আইল দিয়ে বাড়ির পাশে চেঙ্গি নদীর তীরে। আমাদের সঙ্গে ছিল বাড়ির কুকুর বিল্টু। এ নাম আমরা দিয়েছি। বিল্টু আমাদের সঙ্গে অনেক ছবি তুলল। আর যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা নদীর তীর থেকে বাড়িতে ফিরলাম, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পথ প্রদর্শক হিসেবেই থাকল। আমাদের চেঙ্গী নদীর তীরের সময়টাও কাটল দারুণ।
এরপর বিকেলে রীতি অনুযায়ী এ বাড়ি-ও বাড়ি বেড়াতে বের হলাম। এখানকার মানুষ যে কতটা আন্তরিক, তা পাড়া ঘুরতে বের না হলে বুঝতে পারতাম না। পাড়া ঘুরতে গিয়ে সবার বাড়িতে খেলাম পাচন, বিরিয়ানি (এই বিরিয়ানি মোটর ডাল আর শূকরের মাংস দিয়ে তৈরি), তরমুজ, কলাসহ বিভিন্ন খাবার। পাড়া ঘুরতে গিয়ে দেবাশীষ রোয়াজা দাদার বাড়িতে গিয়ে চোখ আটকে গেল। এই বাড়ির বিশাল জায়গাজুড়ে ছিল ফুলের বাগান। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় ছিল গন্ধরাজ ফুলের বাগান। সারা জীবনেও গাছভর্তি এত গন্ধরাজ ফুল দেখিনি। ফুলবাগানের মালিক দেবাশীষ দাদা বললেন, ‘ফুলের সঙ্গে থাকতে আমি খুব পছন্দ করি। যখন ফুলের গাছ মরে যায়, তখন বুকটা হাহাকার করে।’
পরদিন ছিল বিসিকাতাল, মানে ত্রিপুরাদের নববর্ষ। কোকিলের ডাকে ভাঙল ঘুম। ঘুম ভাঙার পর শুনলাম খোল-করতালসহকারে নগর কীর্তনের সুর। কীর্তনের সুর শুনতে শুনতে চলে গেলাম চেঙ্গী নদীর তীরে গঙ্গাপূজার স্থানে। সেখানে যাওয়ামাত্রই নামলাম পানিতে। দেখলাম হাঁটুপানিতে সবাই গঙ্গাপূজা করছেন। এদিন সবার মঙ্গল কামনা করে গঙ্গাপূজা করা হয়। পানিতে বাঁশ দিয়ে ভাসমান বেদি তৈরি করা হয়েছে। সেই বেদিতে রয়েছে হরেক রঙের ফুল। সেখানে জ্বলছে মোমবাতি। পানিতে ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম তীরে কলাপাতায় ফুল, টাকা আর মোমবাতি জ্বালছে। আর দেখলাম চেঙ্গী নদীর তীর ঘেঁষে অনেক দূর পর্যন্ত কলাপাতা আর ফুলের দীর্ঘ লাইন।
বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশের বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ পালন করা হলেও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী এখনো সৌর পঞ্জিকা অনুসারেই বৈসু উৎসব পালন করে। তাই চাকমাদের বিজু উৎসবের সঙ্গে ত্রিপুরাদের বৈসু উৎসবের এক দিনের পার্থক্য থাকে। এই বৈসু উৎসবের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ইতিহাস। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে মুছে যায় পুরোনো দিনের গ্লানি, দুঃখ, হিংসা, বিদ্বেষ।
ঘুরতে যেতে কে না ভালোবাসে। বাঙালি হিসেবে আমরা বরাবরই ভ্রমণপিপাসু জাতি। প্রতিদিনের একঘেয়ে জীবনে মানুষ যখন হাঁপিয়ে ওঠে, তখনই মন পালাই পালাই করে। ঠিক সে সময় যদি ছুটি মিলে যায়, তবে সেই সুযোগ হাতছাড়া না করে অনেকেই ঘুরতে চলে যান পাহাড়ে কিংবা সমুদ্রে। আবার ভ্রমণে গেলে যান্ত্রিক জীবন থেকে পাওয়া যায় মুক্তি। পুতুলের মতো টানা কাজ করা থেকে পাওয়া যায় কিছু সময়ের বিরতি।
ঘড়ির সঙ্গে ঘুরতে থাকা জীবনে কিছুটা বদল তো চাই। স্বাদ হোক আর হাওয়া বদলই হোক, ভ্রমণের চেয়ে ভালো কিছু তো নেই। তাই ভ্রমণই সই। মন নেচে উঠল ভাবতেই। সঙ্গে ঢোলের বাড়ি হয়ে এল বোনের কাছ থেকে পাহাড়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে গেলাম; গন্তব্য খাগড়াছড়ি।
আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম ১৩ এপ্রিলের রাতে। আরামবাগ থেকে বাসে করে রওনা দিলাম। যাত্রা অবশ্য ব্যাঘাতহীন ছিল না। পোহাতে হয়েছে ভোগান্তি। না, তেমন বড় কিছু নয়। স্থানে স্থানে সড়কের দশা ও বাহনের শরীর-স্বাস্থ্য মিলিয়ে একটা অবস্থা আরকি। মাঝপথে শ্যামলী পরিবহনের গাড়ির (নন এসি) এঁকেবেঁকে চলতে দেখে মনে মনে গাইলাম ‘তোমার সাপের বেণি নাচে না, নাচে শ্যামলী পরিবহনের গাড়ি’।
বেহাল সড়ক পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছালাম খাগড়াছড়িতে। রাস্তার কারণে ঘুমাতে না পারার সুবিধাটা হলো ভোরের আলো ফুটতে দেখেছি। ভোরের আলোয় অদ্ভুত এক মায়াবী পরশ জড়িয়ে থাকে। গাড়ি থেকে মনে হয় কোনো এক রাজকন্যা আলতো ছোঁয়ায় ভোরকে রাঙিয়ে দিচ্ছে।
আমরা দলে ভারী ছিলাম। তাই পূজা-পার্বণে কারও বাড়িতে গিয়ে সমস্যায় ফেলতে চাইনি। উঠলাম হোটেল গাইরিংয়ে। গাইরিং মানে হচ্ছে টংঘর। হোটেলের প্রবেশপথেই দেখা হলো মধুমঞ্জুরি ফুলেদের সঙ্গে। তাদের অভ্যর্থনা বেশ ভালোই লাগল। এর কিছুক্ষণ পরই কোকিলের ডাক শুনে মুগ্ধ হলাম। ভালো লাগার বিষয় ছিল, এই কোকিলের ডাক শুনলাম টানা তিন দিন। যেখানে যেতাম, সেখানেই মনে হতো কোকিলেরা আমাদের সঙ্গেই রয়েছে।
দিনটি ছিল ১৪ এপ্রিল। মানে পয়লা বৈশাখ। হোটেল থেকে হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। চলে গেলাম ঠাকুরছড়া গ্রামের ভবতোষ রোয়াজা দাদার বাড়িতে। এ গ্রামের কথা বলার আগে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর পূজা-পার্বণের কথা বলতে চাই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা জনগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি। ত্রিপুরাদের বৈসু বা বৈসুক, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু নামের আদ্যক্ষর দিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি।
ত্রিপুরারা বৈসু উৎসব একটানা তিন দিন ধরে, মানে বাংলা বছরের শেষ দুই দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন উদ্যাপন করে। দিনের পরিক্রমায় এই তিন দিনের অনুষ্ঠানগুলোর নাম হলো প্রথম দিন হারি বৈসু, দ্বিতীয় দিন বৈসু বা বৈসুক মা, আর তৃতীয় দিন বিসিকাতাল।
হারি বৈসু: হারি বৈসু দিয়ে উৎসবের প্রথম দিনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন এই উৎসব পালন করা হয়। এই দিনে খুব ভোরে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে ফুল সংগ্রহ করে এখানকার কিশোর-কিশোরীরা। এরপর সেই ফুল দিয়ে মালা তৈরি করে ঝোলানো হয় ঘরের দরজায়। ফুলের সঙ্গে দেওয়া হয় নিমপাতা, আমপাতাও। পাশাপাশি গৃহপালিত পশুর গলায়ও ফুলের মালা পরানো হয়। ফুল ঘরকে সুবাসিত করে আর নিমপাতা বাড়িকে রোগবালাই থেকে দূরে রাখে। এই দিনে অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে দেবতা পুকুরে তীর্থ দর্শনে যায়। এ ছাড়া এই দিনে ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী গরিয়া নৃত্যের দল বিভিন্ন পাড়া প্রদক্ষিণ করে বেড়ায়।
বৈসু/বৈসুক মা: চৈত্র মাসের শেষ দিন, অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তিতে এই উৎসব পালন করা হয়। এদিন সকালে বাড়ির ছেলেমেয়েরা কুচাই পানি (কুচাই পানিকে ত্রিপুরারা পবিত্র পানি বলে গণ্য করে) দিয়ে স্নান করে। এরপর গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির উঠানে গিয়ে গৃহপালিত পশুদের জন্য ধান ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এই দিন প্রাণী হত্যা করা হয় না। ঘরে ঘরে রান্না করা হয় হরেক রকমের সবজি দিয়ে নিরামিষ তরকারি। এই জনপ্রিয় তরকারি পাচন নামে পরিচিত। এ ছাড়া এই দিনে ঘরে ঘরে তৈরি করা হয় নানা রকমের পিঠা। আর বিকেল থেকে শুরু হয় এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় বেড়ানো।
বিসিকাতাল: বছরের প্রথম দিনে পালন করা হয় বিসিকাতাল বা নববর্ষ। বিসিকাতাল মূলত ত্রিপুরাদের নববর্ষ। এই দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হয়। সকালে বাড়ির ছেলেমেয়েরা বাবা-মাসহ বাড়ির গুরুজনদের স্নান করায়। এতে পারিবারিক বন্ধন হয় দৃঢ়। এ ছাড়া এই দিনে সবাই মন্দিরে গিয়ে প্রণাম করে আসে। সবার মঙ্গল কামনা করে গঙ্গাকে উদ্দেশ্য করে জলপূজা করা হয়। গঙ্গাপূজায় আগামী দিনের সুখ-শান্তির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়। এ ছাড়া নদীর পাড়ে কলাপাতায় ফুল, টাকা, মোমবাতি, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে করা হয় পূজা। গঙ্গাপূজার প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে পানি দিয়ে পুরোনো দিনের সব গ্লানি ধুয়ে দেওয়া। এই দিনও আবার অনেকে দেবতা পুকুর দর্শন করতে যায়। এ ছাড়া বিসিকাতাল দিনে আমিষসহ ভালোমন্দ খাবারের আয়োজন করা হয়। এই দিন ভালো খাবার খাওয়াতে পারলে সারা বছর ভালো যাবে বলে বিশ্বাস করা হয়।
এবার আসি ঠাকুরছড়া গ্রামের আলাপে। ভবতোষ দাদার বাড়িতে ঢুকতেই মাথার সঙ্গে টুক করে লাগল ফুল ও পাতা দিয়ে তৈরি মালা। দরজার ওপরে নানা রঙের ফুলের মালা দেখে মনটা ভরে উঠল। দুপুরে খেতে বসে দেখলাম নানা রকমের খাবারের আয়োজন। খাবারের মধ্যে ছিল বৈসুর বিশেষ খাবার পাচন, তেল ছাড়া বিভিন্ন তরকারি। তবে এসব খাবারে শুঁটকির প্রাধান্য ছিল অনেক বেশি। অবাক করার মতো স্বাদ ছিল শুধু সেদ্ধ করেই তৈরি করা মজাদার সব তরকারির। আমরা খুব তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। এরপর গেলাম কাটা ধানের আইল দিয়ে বাড়ির পাশে চেঙ্গি নদীর তীরে। আমাদের সঙ্গে ছিল বাড়ির কুকুর বিল্টু। এ নাম আমরা দিয়েছি। বিল্টু আমাদের সঙ্গে অনেক ছবি তুলল। আর যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা নদীর তীর থেকে বাড়িতে ফিরলাম, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পথ প্রদর্শক হিসেবেই থাকল। আমাদের চেঙ্গী নদীর তীরের সময়টাও কাটল দারুণ।
এরপর বিকেলে রীতি অনুযায়ী এ বাড়ি-ও বাড়ি বেড়াতে বের হলাম। এখানকার মানুষ যে কতটা আন্তরিক, তা পাড়া ঘুরতে বের না হলে বুঝতে পারতাম না। পাড়া ঘুরতে গিয়ে সবার বাড়িতে খেলাম পাচন, বিরিয়ানি (এই বিরিয়ানি মোটর ডাল আর শূকরের মাংস দিয়ে তৈরি), তরমুজ, কলাসহ বিভিন্ন খাবার। পাড়া ঘুরতে গিয়ে দেবাশীষ রোয়াজা দাদার বাড়িতে গিয়ে চোখ আটকে গেল। এই বাড়ির বিশাল জায়গাজুড়ে ছিল ফুলের বাগান। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় ছিল গন্ধরাজ ফুলের বাগান। সারা জীবনেও গাছভর্তি এত গন্ধরাজ ফুল দেখিনি। ফুলবাগানের মালিক দেবাশীষ দাদা বললেন, ‘ফুলের সঙ্গে থাকতে আমি খুব পছন্দ করি। যখন ফুলের গাছ মরে যায়, তখন বুকটা হাহাকার করে।’
পরদিন ছিল বিসিকাতাল, মানে ত্রিপুরাদের নববর্ষ। কোকিলের ডাকে ভাঙল ঘুম। ঘুম ভাঙার পর শুনলাম খোল-করতালসহকারে নগর কীর্তনের সুর। কীর্তনের সুর শুনতে শুনতে চলে গেলাম চেঙ্গী নদীর তীরে গঙ্গাপূজার স্থানে। সেখানে যাওয়ামাত্রই নামলাম পানিতে। দেখলাম হাঁটুপানিতে সবাই গঙ্গাপূজা করছেন। এদিন সবার মঙ্গল কামনা করে গঙ্গাপূজা করা হয়। পানিতে বাঁশ দিয়ে ভাসমান বেদি তৈরি করা হয়েছে। সেই বেদিতে রয়েছে হরেক রঙের ফুল। সেখানে জ্বলছে মোমবাতি। পানিতে ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম তীরে কলাপাতায় ফুল, টাকা আর মোমবাতি জ্বালছে। আর দেখলাম চেঙ্গী নদীর তীর ঘেঁষে অনেক দূর পর্যন্ত কলাপাতা আর ফুলের দীর্ঘ লাইন।
বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশের বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ পালন করা হলেও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী এখনো সৌর পঞ্জিকা অনুসারেই বৈসু উৎসব পালন করে। তাই চাকমাদের বিজু উৎসবের সঙ্গে ত্রিপুরাদের বৈসু উৎসবের এক দিনের পার্থক্য থাকে। এই বৈসু উৎসবের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ইতিহাস। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে মুছে যায় পুরোনো দিনের গ্লানি, দুঃখ, হিংসা, বিদ্বেষ।
দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মাথার ওপর নীল আকাশে উঁকি দেবে সাদা মেঘ। শরৎকাল বলে ভুল হতে পারে। ভুল ভাঙলে দেখতে পাবেন, মেঘের ভেলা সূর্যের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে হয়ে উঠছে গোলাপি কিংবা লাল। বুঝবেন, আপনি শরতের সাদা মেঘ নয়, দেখছেন তুষারে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
২ দিন আগেকোনো কিছু ওপর থেকে নিচে পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে আমরা সবাই এ বিষয়ে পড়েছি। কিন্তু এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র কাজ করে না। অর্থাৎ সেসব জায়গায় কোনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। যেতে চান সেই সব জায়গায়?
২ দিন আগেশীত, বসন্ত আর বর্ষায় বাংলার নীল নদ সারির রূপ বদলে ফেলে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে দক্ষ মাঝিরাও ভয়ে ভয়ে বইঠা চালান। আর শীতে সারি নদীর নীল পানি দেয় অপার্থিব জগতের খোঁজ। নদীটি ধরে কিছুদূর উজান বাইলেই পাওয়া যাবে লালাখাল জিরো পয়েন্ট।
২ দিন আগেভ্রমণকালে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী না হলে ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেতে পারে। ভ্রমণের সময় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন কিছু উপায়।
২ দিন আগে