ড. তৈফুর রহমান
সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।…
সুচেতনা, জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে দারুচিনি দ্বীপের কথা, তার রহস্যময় শ্যামলিমার কথা, সেই সবুজের গহিনে দিকহারা নাবিকের আশ্রয়-আকাঙ্ক্ষার কথা। এই দারুচিনি দ্বীপ কি আসলে কোনো সমুদ্রঘেরা ভূখণ্ড, নাকি বনলতা সেন নিজেই—তা নিয়ে কবিরা বিতর্ক করুক। আমরা বরং এই দারুচিনি দ্বীপের তত্ত্ব তালাশ করি।
দারুচিনি দ্বীপের কথা শুনলেই আপনার মনে কোন দেশের কথা মনে হয়? নির্ঘাত শ্রীলঙ্কা। কিন্তু কেন? আমরা যে মিষ্টি কিন্তু ঝাঁজালো মসলা ব্যবহার করি প্রতিদিন, সেই দারুচিনি কি শ্রীলঙ্কা বা সিংহল থেকে আসে? যদি বলি ‘না’, তাহলে কি খানিক ধাক্কা লাগবে? লাগারই কথা।
দুনিয়ায় দারুচিনি দুই প্রকারের। একটা দেখতে গাছের বাকলের মতো, মুখে দিয়ে কামড় বসালে সুতীব্র ঘ্রাণ আর ঝাঁজালো মিষ্টি স্বাদে প্রাণ ভরিয়ে দেয়। এটি আমাদের মায়েরা প্রতিদিন ব্যবহার করছেন, হোটেলে-রেস্তোরাঁ-বিয়েবাড়িতে সুবাস ছোটাচ্ছে, এটি আমাদের অতিপরিচিত দারুচিনি—যার কেতাবি নাম কাসিয়া।
আরেক প্রকার অনেকটাই আলাদা, গাছের পাতলা বাকল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে হাভানা চুরুটের মতন পাকিয়ে লম্বা লাঠির মতো বানিয়ে ইঞ্চি কয়েক করে কেটে সুদৃশ্য কাচের বোতলে বন্দী হয়ে বিক্রি হয় ইউরোপের দোকানে। সেই বস্তুর নাম সিনামন। গন্ধে ও স্বাদে আমাদের দারুচিনির মতো হলেও তীব্রতায় অনেক কম, অনেক ম্রিয়মাণ। অথচ তার দাম ক্যাসিয়ার চেয়ে অনেক বেশি। তাই সিনামন একরকমের দারুচিনি হলেও আমাদের ‘সাথে তার হয় নাকো দেখা!’
বোঝার সুবিধার জন্য আমাদের দারুচিনিকে ‘দারুচিনি’ আর উঁচুতলার চৌধুরী সাহেবের নামীদামি মসলাকে আপাতত ‘সিনামন’ বলেই ডাকা যাক।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, আমাদের অতিপরিচিত দারুচিনি শ্রীলঙ্কায় জন্মায় না! এর আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব চীন দেশ। পরে কালের পরিক্রমায় মালয় সাগর বা ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপে বিস্তার লাভ করে। শ্রীলঙ্কায় জন্মে অতিমূল্যবান সিনামন, যা আমাদের দারুচিনি থেকে রূপে-গুণে-ঘ্রাণে আলাদা।
দক্ষিণ চীনদেশ থেকে আরব আর পারস্যের বণিকেরা জাহাজ বোঝাই করে যে বস্তু মালয় সাগর, বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরেরর উপকূলের নগর-বন্দরে-বাজারে বিক্রি করে অবশিষ্টাংশ ইউরোপে পাঠাত আকেলজান্দ্রিয়া হয়ে রোমে অথবা ভেনিসে, তাই-ই আমাদের পরিচিত দারুচিনি। আর সেই বণিকদের আরেক অংশ সিংহল দ্বীপ থেকে অথবা মালাবার বন্দর থেকে অনেক মূল্য দিয়ে আঁটি বেঁধে নিয়ে যেত সিনামন। শুনতে অনেকটা ধাঁধার মতো লাগে। যা লাউ তাই-ই কদু—এমন হলেও এখানে লাউ আর কদুর জাত আলাদা।
আসলে দারুচিনি নামের ভেতরেই এই ধাঁধার উত্তর আছে।
‘দারুচিনি’ ফারসি শব্দ, যা ভাঙলে হয় দার-এ-চিনি বা অর্থাৎ ‘চীন দেশের বাকল!’ আশাকরি এখন ব্যাপারটি পরিষ্কার।
খুব সম্ভবত, কবি জীবনানন্দ দাশ নিজেও এই কাহিনি জানতেন। তাই দারুচিনি দ্বীপের অবস্থান তাঁর বনলতা সেন কবিতায় রহস্যাবৃত রেখেছেন এই বলে যে, তা সিংহল সাগরেও হতে পারে, হতে পারে মালয় সাগরে। হয়তো, এই দুই সাগরে সব দ্বীপই দারুচিনি দ্বীপ।
তা ক্যাসিয়াই হোক আর সিনামনই হোক, এই পুরু বা পাতলা বাকল আসলে একই গোত্রের গাছ থেকে আসে। তাদের মিষ্টি ঘ্রাণ আর স্বাদ মানবসভ্যতাকে বিমোহিত করে রেখেছে আজ হাজার হাজার বছর ধরে। মিসরের ফারাও বা ফেরাউনেরা তাদের যজ্ঞ, দেবতার তুষ্টি, উৎসব বা শোকে দারুচিনি পুড়িয়ে অর্ঘ্য দিতেন। এমনকি মমিতেও দেওয়া হতো দারুচিনির গুঁড়ো। প্রাচীন প্যাপিরাস পুঁথিতে সুদূর কোনো দেশ থেকে যাওয়া দারুচিনির কথা বলা আছে। বাদশা সোলায়মানের দরবারে শিবার রানি দেখা করতে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন বিরাট এক বস্তা দারুচিনি ধনকুবের বাদশা সোলায়মানের আক্কেল গুড়ুম করে দেওয়ার জন্য।
কেননা, সেই সময় দারুচিনি ছিল অতিমূল্যবান এক বিলাসদ্রব্য। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের কয়েক জায়গায় দারুচিনির উল্লেখ। অর্থাৎ এশিয়ার সুদূরতম প্রান্তের বিচ্ছিন্ন কিছু দ্বীপের কথা কিছুমাত্র না জানলেও সারা মধ্যপ্রাচ্য, মিসর এবং ইউরোপ দারুচিনির প্রেমে দিওয়ানা ছিল—যেকোনো মূল্যেই তার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে তারা পিছপা হতো না।
এই দারুচিনিসহ অন্যান্য লোভনীয় মসলা ইউরোপে পৌঁছাত মূলত আরব বণিকদের হাত ঘুরে। তারা একাধারে ছিল বণিক এবং মধ্যস্বত্বভোগী। এরা কোনোভাবেই জানতে দিতে চাইত না এই দারুচিনি দ্বীপের উৎস কোথায়। তাই নানা রকম গালগল্প এদের মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা পশ্চিমে। ইতিহাসের জনক বলে খ্যাত হেরোডোটাস তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য হিস্টোরি’ বইয়ে দারুচিনি কোথা থেকে কীভাবে আসে, তার বয়ান দিয়েছেন এভাবে,
‘গহিন এবং শ্বাপদসংকুল জঙ্গল থেকে দারুচিনির ডাল সংগ্রহ করে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে কাদামাটি মাখিয়ে বাসা বানায় অতিকায় এক রাক্ষস-পক্ষী। সেই পাহাড় দেখা গেলেও, তার ঢাল এতই খাড়া যে তা বেয়ে বেয়ে উঠে দারুচিনি নিয়ে আসা সম্ভব নয় কাঁধে করে। আর পাখির হাতে মরার আশঙ্কাও প্রচুর। তাহলে আনে কী করে? বণিকেরা বড়ই ধুরন্ধর, তারা একটা গরু না মহিষ কেটে বিরাট বিরাট মাংসের টুকরা পাহাড়ের নিচে ফেলে রেখে, তারপরে কাছের জঙ্গলে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। বোকা পাখি সেই মাংসের টুকরোগুলো তার বাসায় নিতে থাকে জমিয়ে মজা করে খাওয়ার জন্য। কিন্তু অতিলোভে তাঁতি নষ্ট এই বাণী তাদের জানা ছিল না। তাই একসময় সেই মাংসের ভারেই পাখির বাসা ভেঙে গুঁড়িয়ে পাহাড়ের নিচে চলে আসে। তখন সেই চালাক বণিকেরা সেগুলো টপাটপ কুড়িয়ে বস্তায় ভরে নিয়ে দেয় চম্পট।’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা, লোভ এবং সাগর পাড়ি দেওয়ার সক্ষমতা বাড়ে। তারা আর এই সব গালগল্প খুব একটা বিশ্বাস করতে চায় না। তাই প্রথমে পূর্ব এবং পরে পশ্চিম—দুই দিক থেকেই শুধু বাণিজ্য নয়; বরং দখলদারত্বের উদগ্র আকাঙ্ক্ষায় তারা ছুটে আসতে থাকে দারুচিনি দ্বীপের দিকে।
প্রথমে আসে চীনারা। ১৪০০ সালের দিকে চীনের মিং রাজারা পরিকল্পনা করে, বিরাট নৌবহর নিয়ে মালয় এবং ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করবে। শুরুতে তা নিতান্তই শুভেচ্ছা আর উপঢৌকন বিনিমিয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে প্রভাব বিস্তার আর নিজেদের পছন্দসই রাজাকে মসনদে বসানোর খেলায় তারা যুক্ত হয়, যা অধুনা ‘রেজিম চেঞ্জ’ নামে কুখ্যাতি পেয়েছে। এদের কয়েকটা দল আমাদের বঙ্গভূমিতেও কয়েকবার এসেছিল সেই সময়ে। আমাদের কূটনীতিকেরাও তখন চীন দেশে যেতেন—সেই গল্প আরও চিত্তাকর্ষক।
১৪১০ সালের ভেতরে মালয় সাগরের ছোট ছোট রাজা-সুলতানকে সরিয়ে, চীনের নজর পরে শ্রীলঙ্কার দিকে। শুভেচ্ছা ভ্রমণের নাম করে হাজার হাজার নৌসেনা নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণের এক বন্দরে। রাজা বদল শুধু নয়, তাদের বদনজর ছিল মধ্য-শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি নামক নগরে শত শত বছরের রক্ষিত গৌতম বুদ্ধের একটি দাঁতের ওপরে। কারণ তা মহামূল্যবান আর এই দাঁত যার হাতে থাকবে সিংহলের জনগণ তার কথা শুনতে বাধ্য হবে। সেই অভিযান সফল না হলেও তারা সেই দাঁত চুরি করে নিয়ে পালাল। পরে সেই দাঁত কীভাবে যেন উদ্ধার পায় এবং ক্যান্ডিতে ফেরত আসে।
আরও ২০০ বছর মোটামুটি শান্তিতে থাকার পরে, সেই দারুচিনির গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে হায়েনার মতো এগিয়ে আসে পর্তুগিজ হার্মাদেরা। তারা ১৫০০ সালের মধ্যে ভারতের মালাবার উপকূলে ঘাঁটি গেড়ে বসলেও এবং সেখানের বাজারে সিনামন কিনতে পারলেও এই মসলার ব্যবসা পুরোপুরি কবজায় আনতে পারছিল না। কারণ মালাবার উপকূলে গোলমরিচ উৎপন্ন হলেও, সিনামন আসে সিংহল বা শ্রীলঙ্কা থেকে। এদিকে পর্তুগিজরা শ্রীলঙ্কার অবস্থান কোনোভাবেই বের করতে পারছিল না। কারণ পর্তুগিজরা তাদের অনুসরণ করবে এই ভয়ে আরব জাহাজ আর আগের মতো মালাবার হয়ে শ্রীলঙ্কা যেত না। আরব আর পারস্যের জাহাজ তাদের নজর এড়িয়ে মালদ্বীপ হয়ে শ্রীলঙ্কায় যেত এবং জাহাজ ভরে সিনামন বা দারুচিনি নিয়ে সেই পথে সটকে পড়ত।
১৫০৬ সালের দিকে পর্তুগিজদের এক জাহাজ আরব জাহাজকে ধরে শ্রীলঙ্কা থেকে আহরিত সব সিনামন কেড়ে নেবে সেই আশায় মালদ্বীপের দিকে রওনা হলো। ভারত মহাসাগরের অচেনা এই অংশে এসে বিপরীত এক স্রোতে পথ হারিয়ে ভাসতে ভাসতে হাজির হলো খোদ শ্রীলঙ্কারই দক্ষিণের এক উপকূলে। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। তারা স্থানীয় রাজাকে অনেক মিষ্টি কথা বলে মন ভোলাল। তার পরে অন্তর্দ্বন্দ্বে বিভক্ত সিংহলি রাজ্যগুলোর দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পর্তুগিজরা সিনামনের ব্যবসায় একচ্ছত্র অধিকার নিয়ে নিল আরব, পারসি, গুজরাটি সব বণিককে সরিয়ে। চীনাদের মতো আধিপত্যের আশায় তারাও বদনজর দিয়েছিল বুদ্ধের দাঁতের দিকে। কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারেনি।
এর প্রায় দেড় শ বছর পরে ওলন্দাজরা পর্তুগিজদের হটিয়ে দিতে থাকে এশিয়া থেকে। তারা শ্রীলঙ্কার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসে ১৬৫৮ সালের ভেতর। অকথ্য অত্যাচার করে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে শুধু সিনামন চাষিদের। এরা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের আশায় হামলা চালায় ক্যান্ডিতে এবং ছিনিয়ে নেয় বুদ্ধের দাঁত। কিন্তু ক্যান্ডির জনতা আগেভাগেই আসল দাঁত সরিয়ে নকল দাঁত রেখে দিয়েছিল। তাই আসল দাঁতের বলে বলীয়ান হয়ে ওলন্দাজদের হটিয়ে দেয় ক্যান্ডি থেকে।
তবে শ্রীলঙ্কা থেকে এদের ঝেঁটিয়ে বের করার মতো হিম্মত শ্রীলঙ্কানদের ছিল না। শেষমেশ ১৭৯৬ সালে ফরাসি বিপ্লবের পরে ওলন্দাজরা যখন ফরাসিদের করায়ত্ত, গায়ের জোর কমে গেছে, সেই সুযোগে শ্রীলঙ্কানদের ইংরেজরা বোঝাল যে ইংরেজরা আদতে নিরীহ বণিক, খুব পরোপকারী। তারা যদি ওলন্দাজদের বের করে দেয় তাহলে কি তারা সামান্য বাণিজ্য অধিকারটুকু পাবে? শ্রীলঙ্কানরা তখনো হয়তো পলাশীর গল্প শোনেনি বা তাদের হয়তো উপায় ছিল না। মন্দের ভালো হিসেবে ইংরেজদের পথ করে দেয় তারা।
তার পরের ইতিহাস? দারুচিনি দ্বীপ অবশেষে ইংরেজমুক্ত হয় দেড় শ বছর পর, ১৯৪৮ সালে।
আসলেই কি শ্রীলঙ্কানরা মুক্ত হয়েছে? নাকি ১৪১০ সালের পুনরাবৃত্তিতে আবারও সেই মিংদের খপ্পরে পড়ে গিয়েছে পাক্কা ৬০০ বছর পরে এসে? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে আরও অনেক পরে।
লেখক: প্রযুক্তিবিদ, ইনফিনিয়াম ইউকে লিমিটেড, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য
সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।…
সুচেতনা, জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে দারুচিনি দ্বীপের কথা, তার রহস্যময় শ্যামলিমার কথা, সেই সবুজের গহিনে দিকহারা নাবিকের আশ্রয়-আকাঙ্ক্ষার কথা। এই দারুচিনি দ্বীপ কি আসলে কোনো সমুদ্রঘেরা ভূখণ্ড, নাকি বনলতা সেন নিজেই—তা নিয়ে কবিরা বিতর্ক করুক। আমরা বরং এই দারুচিনি দ্বীপের তত্ত্ব তালাশ করি।
দারুচিনি দ্বীপের কথা শুনলেই আপনার মনে কোন দেশের কথা মনে হয়? নির্ঘাত শ্রীলঙ্কা। কিন্তু কেন? আমরা যে মিষ্টি কিন্তু ঝাঁজালো মসলা ব্যবহার করি প্রতিদিন, সেই দারুচিনি কি শ্রীলঙ্কা বা সিংহল থেকে আসে? যদি বলি ‘না’, তাহলে কি খানিক ধাক্কা লাগবে? লাগারই কথা।
দুনিয়ায় দারুচিনি দুই প্রকারের। একটা দেখতে গাছের বাকলের মতো, মুখে দিয়ে কামড় বসালে সুতীব্র ঘ্রাণ আর ঝাঁজালো মিষ্টি স্বাদে প্রাণ ভরিয়ে দেয়। এটি আমাদের মায়েরা প্রতিদিন ব্যবহার করছেন, হোটেলে-রেস্তোরাঁ-বিয়েবাড়িতে সুবাস ছোটাচ্ছে, এটি আমাদের অতিপরিচিত দারুচিনি—যার কেতাবি নাম কাসিয়া।
আরেক প্রকার অনেকটাই আলাদা, গাছের পাতলা বাকল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে হাভানা চুরুটের মতন পাকিয়ে লম্বা লাঠির মতো বানিয়ে ইঞ্চি কয়েক করে কেটে সুদৃশ্য কাচের বোতলে বন্দী হয়ে বিক্রি হয় ইউরোপের দোকানে। সেই বস্তুর নাম সিনামন। গন্ধে ও স্বাদে আমাদের দারুচিনির মতো হলেও তীব্রতায় অনেক কম, অনেক ম্রিয়মাণ। অথচ তার দাম ক্যাসিয়ার চেয়ে অনেক বেশি। তাই সিনামন একরকমের দারুচিনি হলেও আমাদের ‘সাথে তার হয় নাকো দেখা!’
বোঝার সুবিধার জন্য আমাদের দারুচিনিকে ‘দারুচিনি’ আর উঁচুতলার চৌধুরী সাহেবের নামীদামি মসলাকে আপাতত ‘সিনামন’ বলেই ডাকা যাক।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, আমাদের অতিপরিচিত দারুচিনি শ্রীলঙ্কায় জন্মায় না! এর আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব চীন দেশ। পরে কালের পরিক্রমায় মালয় সাগর বা ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপে বিস্তার লাভ করে। শ্রীলঙ্কায় জন্মে অতিমূল্যবান সিনামন, যা আমাদের দারুচিনি থেকে রূপে-গুণে-ঘ্রাণে আলাদা।
দক্ষিণ চীনদেশ থেকে আরব আর পারস্যের বণিকেরা জাহাজ বোঝাই করে যে বস্তু মালয় সাগর, বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরেরর উপকূলের নগর-বন্দরে-বাজারে বিক্রি করে অবশিষ্টাংশ ইউরোপে পাঠাত আকেলজান্দ্রিয়া হয়ে রোমে অথবা ভেনিসে, তাই-ই আমাদের পরিচিত দারুচিনি। আর সেই বণিকদের আরেক অংশ সিংহল দ্বীপ থেকে অথবা মালাবার বন্দর থেকে অনেক মূল্য দিয়ে আঁটি বেঁধে নিয়ে যেত সিনামন। শুনতে অনেকটা ধাঁধার মতো লাগে। যা লাউ তাই-ই কদু—এমন হলেও এখানে লাউ আর কদুর জাত আলাদা।
আসলে দারুচিনি নামের ভেতরেই এই ধাঁধার উত্তর আছে।
‘দারুচিনি’ ফারসি শব্দ, যা ভাঙলে হয় দার-এ-চিনি বা অর্থাৎ ‘চীন দেশের বাকল!’ আশাকরি এখন ব্যাপারটি পরিষ্কার।
খুব সম্ভবত, কবি জীবনানন্দ দাশ নিজেও এই কাহিনি জানতেন। তাই দারুচিনি দ্বীপের অবস্থান তাঁর বনলতা সেন কবিতায় রহস্যাবৃত রেখেছেন এই বলে যে, তা সিংহল সাগরেও হতে পারে, হতে পারে মালয় সাগরে। হয়তো, এই দুই সাগরে সব দ্বীপই দারুচিনি দ্বীপ।
তা ক্যাসিয়াই হোক আর সিনামনই হোক, এই পুরু বা পাতলা বাকল আসলে একই গোত্রের গাছ থেকে আসে। তাদের মিষ্টি ঘ্রাণ আর স্বাদ মানবসভ্যতাকে বিমোহিত করে রেখেছে আজ হাজার হাজার বছর ধরে। মিসরের ফারাও বা ফেরাউনেরা তাদের যজ্ঞ, দেবতার তুষ্টি, উৎসব বা শোকে দারুচিনি পুড়িয়ে অর্ঘ্য দিতেন। এমনকি মমিতেও দেওয়া হতো দারুচিনির গুঁড়ো। প্রাচীন প্যাপিরাস পুঁথিতে সুদূর কোনো দেশ থেকে যাওয়া দারুচিনির কথা বলা আছে। বাদশা সোলায়মানের দরবারে শিবার রানি দেখা করতে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন বিরাট এক বস্তা দারুচিনি ধনকুবের বাদশা সোলায়মানের আক্কেল গুড়ুম করে দেওয়ার জন্য।
কেননা, সেই সময় দারুচিনি ছিল অতিমূল্যবান এক বিলাসদ্রব্য। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের কয়েক জায়গায় দারুচিনির উল্লেখ। অর্থাৎ এশিয়ার সুদূরতম প্রান্তের বিচ্ছিন্ন কিছু দ্বীপের কথা কিছুমাত্র না জানলেও সারা মধ্যপ্রাচ্য, মিসর এবং ইউরোপ দারুচিনির প্রেমে দিওয়ানা ছিল—যেকোনো মূল্যেই তার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে তারা পিছপা হতো না।
এই দারুচিনিসহ অন্যান্য লোভনীয় মসলা ইউরোপে পৌঁছাত মূলত আরব বণিকদের হাত ঘুরে। তারা একাধারে ছিল বণিক এবং মধ্যস্বত্বভোগী। এরা কোনোভাবেই জানতে দিতে চাইত না এই দারুচিনি দ্বীপের উৎস কোথায়। তাই নানা রকম গালগল্প এদের মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা পশ্চিমে। ইতিহাসের জনক বলে খ্যাত হেরোডোটাস তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য হিস্টোরি’ বইয়ে দারুচিনি কোথা থেকে কীভাবে আসে, তার বয়ান দিয়েছেন এভাবে,
‘গহিন এবং শ্বাপদসংকুল জঙ্গল থেকে দারুচিনির ডাল সংগ্রহ করে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে কাদামাটি মাখিয়ে বাসা বানায় অতিকায় এক রাক্ষস-পক্ষী। সেই পাহাড় দেখা গেলেও, তার ঢাল এতই খাড়া যে তা বেয়ে বেয়ে উঠে দারুচিনি নিয়ে আসা সম্ভব নয় কাঁধে করে। আর পাখির হাতে মরার আশঙ্কাও প্রচুর। তাহলে আনে কী করে? বণিকেরা বড়ই ধুরন্ধর, তারা একটা গরু না মহিষ কেটে বিরাট বিরাট মাংসের টুকরা পাহাড়ের নিচে ফেলে রেখে, তারপরে কাছের জঙ্গলে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। বোকা পাখি সেই মাংসের টুকরোগুলো তার বাসায় নিতে থাকে জমিয়ে মজা করে খাওয়ার জন্য। কিন্তু অতিলোভে তাঁতি নষ্ট এই বাণী তাদের জানা ছিল না। তাই একসময় সেই মাংসের ভারেই পাখির বাসা ভেঙে গুঁড়িয়ে পাহাড়ের নিচে চলে আসে। তখন সেই চালাক বণিকেরা সেগুলো টপাটপ কুড়িয়ে বস্তায় ভরে নিয়ে দেয় চম্পট।’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা, লোভ এবং সাগর পাড়ি দেওয়ার সক্ষমতা বাড়ে। তারা আর এই সব গালগল্প খুব একটা বিশ্বাস করতে চায় না। তাই প্রথমে পূর্ব এবং পরে পশ্চিম—দুই দিক থেকেই শুধু বাণিজ্য নয়; বরং দখলদারত্বের উদগ্র আকাঙ্ক্ষায় তারা ছুটে আসতে থাকে দারুচিনি দ্বীপের দিকে।
প্রথমে আসে চীনারা। ১৪০০ সালের দিকে চীনের মিং রাজারা পরিকল্পনা করে, বিরাট নৌবহর নিয়ে মালয় এবং ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করবে। শুরুতে তা নিতান্তই শুভেচ্ছা আর উপঢৌকন বিনিমিয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে প্রভাব বিস্তার আর নিজেদের পছন্দসই রাজাকে মসনদে বসানোর খেলায় তারা যুক্ত হয়, যা অধুনা ‘রেজিম চেঞ্জ’ নামে কুখ্যাতি পেয়েছে। এদের কয়েকটা দল আমাদের বঙ্গভূমিতেও কয়েকবার এসেছিল সেই সময়ে। আমাদের কূটনীতিকেরাও তখন চীন দেশে যেতেন—সেই গল্প আরও চিত্তাকর্ষক।
১৪১০ সালের ভেতরে মালয় সাগরের ছোট ছোট রাজা-সুলতানকে সরিয়ে, চীনের নজর পরে শ্রীলঙ্কার দিকে। শুভেচ্ছা ভ্রমণের নাম করে হাজার হাজার নৌসেনা নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণের এক বন্দরে। রাজা বদল শুধু নয়, তাদের বদনজর ছিল মধ্য-শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি নামক নগরে শত শত বছরের রক্ষিত গৌতম বুদ্ধের একটি দাঁতের ওপরে। কারণ তা মহামূল্যবান আর এই দাঁত যার হাতে থাকবে সিংহলের জনগণ তার কথা শুনতে বাধ্য হবে। সেই অভিযান সফল না হলেও তারা সেই দাঁত চুরি করে নিয়ে পালাল। পরে সেই দাঁত কীভাবে যেন উদ্ধার পায় এবং ক্যান্ডিতে ফেরত আসে।
আরও ২০০ বছর মোটামুটি শান্তিতে থাকার পরে, সেই দারুচিনির গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে হায়েনার মতো এগিয়ে আসে পর্তুগিজ হার্মাদেরা। তারা ১৫০০ সালের মধ্যে ভারতের মালাবার উপকূলে ঘাঁটি গেড়ে বসলেও এবং সেখানের বাজারে সিনামন কিনতে পারলেও এই মসলার ব্যবসা পুরোপুরি কবজায় আনতে পারছিল না। কারণ মালাবার উপকূলে গোলমরিচ উৎপন্ন হলেও, সিনামন আসে সিংহল বা শ্রীলঙ্কা থেকে। এদিকে পর্তুগিজরা শ্রীলঙ্কার অবস্থান কোনোভাবেই বের করতে পারছিল না। কারণ পর্তুগিজরা তাদের অনুসরণ করবে এই ভয়ে আরব জাহাজ আর আগের মতো মালাবার হয়ে শ্রীলঙ্কা যেত না। আরব আর পারস্যের জাহাজ তাদের নজর এড়িয়ে মালদ্বীপ হয়ে শ্রীলঙ্কায় যেত এবং জাহাজ ভরে সিনামন বা দারুচিনি নিয়ে সেই পথে সটকে পড়ত।
১৫০৬ সালের দিকে পর্তুগিজদের এক জাহাজ আরব জাহাজকে ধরে শ্রীলঙ্কা থেকে আহরিত সব সিনামন কেড়ে নেবে সেই আশায় মালদ্বীপের দিকে রওনা হলো। ভারত মহাসাগরের অচেনা এই অংশে এসে বিপরীত এক স্রোতে পথ হারিয়ে ভাসতে ভাসতে হাজির হলো খোদ শ্রীলঙ্কারই দক্ষিণের এক উপকূলে। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। তারা স্থানীয় রাজাকে অনেক মিষ্টি কথা বলে মন ভোলাল। তার পরে অন্তর্দ্বন্দ্বে বিভক্ত সিংহলি রাজ্যগুলোর দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পর্তুগিজরা সিনামনের ব্যবসায় একচ্ছত্র অধিকার নিয়ে নিল আরব, পারসি, গুজরাটি সব বণিককে সরিয়ে। চীনাদের মতো আধিপত্যের আশায় তারাও বদনজর দিয়েছিল বুদ্ধের দাঁতের দিকে। কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারেনি।
এর প্রায় দেড় শ বছর পরে ওলন্দাজরা পর্তুগিজদের হটিয়ে দিতে থাকে এশিয়া থেকে। তারা শ্রীলঙ্কার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসে ১৬৫৮ সালের ভেতর। অকথ্য অত্যাচার করে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে শুধু সিনামন চাষিদের। এরা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের আশায় হামলা চালায় ক্যান্ডিতে এবং ছিনিয়ে নেয় বুদ্ধের দাঁত। কিন্তু ক্যান্ডির জনতা আগেভাগেই আসল দাঁত সরিয়ে নকল দাঁত রেখে দিয়েছিল। তাই আসল দাঁতের বলে বলীয়ান হয়ে ওলন্দাজদের হটিয়ে দেয় ক্যান্ডি থেকে।
তবে শ্রীলঙ্কা থেকে এদের ঝেঁটিয়ে বের করার মতো হিম্মত শ্রীলঙ্কানদের ছিল না। শেষমেশ ১৭৯৬ সালে ফরাসি বিপ্লবের পরে ওলন্দাজরা যখন ফরাসিদের করায়ত্ত, গায়ের জোর কমে গেছে, সেই সুযোগে শ্রীলঙ্কানদের ইংরেজরা বোঝাল যে ইংরেজরা আদতে নিরীহ বণিক, খুব পরোপকারী। তারা যদি ওলন্দাজদের বের করে দেয় তাহলে কি তারা সামান্য বাণিজ্য অধিকারটুকু পাবে? শ্রীলঙ্কানরা তখনো হয়তো পলাশীর গল্প শোনেনি বা তাদের হয়তো উপায় ছিল না। মন্দের ভালো হিসেবে ইংরেজদের পথ করে দেয় তারা।
তার পরের ইতিহাস? দারুচিনি দ্বীপ অবশেষে ইংরেজমুক্ত হয় দেড় শ বছর পর, ১৯৪৮ সালে।
আসলেই কি শ্রীলঙ্কানরা মুক্ত হয়েছে? নাকি ১৪১০ সালের পুনরাবৃত্তিতে আবারও সেই মিংদের খপ্পরে পড়ে গিয়েছে পাক্কা ৬০০ বছর পরে এসে? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে আরও অনেক পরে।
লেখক: প্রযুক্তিবিদ, ইনফিনিয়াম ইউকে লিমিটেড, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য
দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মাথার ওপর নীল আকাশে উঁকি দেবে সাদা মেঘ। শরৎকাল বলে ভুল হতে পারে। ভুল ভাঙলে দেখতে পাবেন, মেঘের ভেলা সূর্যের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে হয়ে উঠছে গোলাপি কিংবা লাল। বুঝবেন, আপনি শরতের সাদা মেঘ নয়, দেখছেন তুষারে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
২ দিন আগেকোনো কিছু ওপর থেকে নিচে পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে আমরা সবাই এ বিষয়ে পড়েছি। কিন্তু এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র কাজ করে না। অর্থাৎ সেসব জায়গায় কোনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। যেতে চান সেই সব জায়গায়?
২ দিন আগেশীত, বসন্ত আর বর্ষায় বাংলার নীল নদ সারির রূপ বদলে ফেলে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে দক্ষ মাঝিরাও ভয়ে ভয়ে বইঠা চালান। আর শীতে সারি নদীর নীল পানি দেয় অপার্থিব জগতের খোঁজ। নদীটি ধরে কিছুদূর উজান বাইলেই পাওয়া যাবে লালাখাল জিরো পয়েন্ট।
২ দিন আগেভ্রমণকালে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী না হলে ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেতে পারে। ভ্রমণের সময় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন কিছু উপায়।
২ দিন আগে