মন্টি বৈষ্ণব
আপনার জন্ম ব্রিটিশ শাসনামলে, আর বড় হয়েছেন পাকিস্তান শাসনামলে। এই সময়ে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেছেন?
রনো: আমি আমার জীবনে তিনটি রাজত্ব, তিনটি পতাকা দেখেছি। ১৯৪২ সালে আমার জন্ম। তাই ব্রিটিশ ভারতকে আমি দেখেছি মাত্র পাঁচ বছর। সে সময় মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ বসু, বাঘা যতীন, সূর্য সেনসহ আরও অনেকেই লড়াই করে ব্রিটিশকে তাড়িয়েছেন। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের বিষয়টি অনেক দুঃখজনক। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো। একই সঙ্গে তৈরি হলো দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান। তারপর আমি প্রায় ২৪ বছর কাটিয়েছি পাকিস্তানে।
রাজনীতিতে যুক্ত হলেন কীভাবে?
রনো: দেশভাগের ঘটনাপ্রবাহে ১৯৫৪ সালের আগস্ট মাসে ঢাকায় আসি। ফলে বড় হয়েছি পাকিস্তান শাসনামলে। ১৯৫৪ সালে আমি সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। এই স্কুল থেকে আমি পরে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে মেধা তালিকায় ১২তম স্থান লাভও করেছিলাম। ১৯৬০ সালে ঢাকার নটর ডেম কলেজ হতে আইএসসি পাস করি। এর পর ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হই। তখন দেশে সামরিক শাসন চলছিল। প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল না। ওই বছরই গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হই। বলা যেতে পারে, সেই সময় থেকেই আমার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। ১৯৬১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ ছিল আমার জীবনের প্রথম রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ। এ ছাড়া ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় যে ছাত্রসভা হয়েছিল, সেখানে একজন বক্তা ছিলাম আমি।
প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নকে সংগঠিত করা যেমন, তেমনি এর ভাঙনেও আপনি জড়িত ছিলেন। এই বিষয়ে যদি কিছু বলতেন।
রনো: আমি দীর্ঘদিন ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ছাত্রদের মধ্যেই শুরু হয় আমার প্রথম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। পঞ্চাশের দশকে ছাত্র ইউনিয়ন অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৩ সালে ছাত্র ইউনিয়ন দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়। সে বছরের শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে আমাকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। একই বছর আমাদের দেশের কমিউনিস্ট দলগুলোর মধ্যে চীন-সোভিয়েত বিতর্ক জমে ওঠে। ফলে কমিউনিস্টরা যে যার মতো করে সোভিয়েত বা চীনের পার্টির লাইনের সমর্থন করতে থাকে। ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বের মধ্যেও এর প্রভাব পড়ে। একাংশের নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। অন্য অংশে ছিলেন কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, মহিউদ্দিন আহমদ, আবদুল হালিম ও আমি।
সে সময় রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক উভয় দিক দিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে বিভাজন ও সংকট বাড়তে থাকে। ১৯৬৫ সাল আমার জীবন তো বটেই, এ দেশে বাম আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক ঘটনার জন্য স্মরণীয় ছিল। কারণ, সেই বছরের এপ্রিল মাসে তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত হয়। ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্তির পরপরই কারাগার থেকে বের হয়ে আমি মেনন গ্রুপকে সমর্থন করি এবং মেনন গ্রুপের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করি।
তখনকার ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে এখনকার ছাত্র আন্দোলনের পার্থক্য করতে বললে কী বলবেন?
রনো: তখনকার ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। সেটা শুধু শিক্ষা আন্দোলন নয়, একী সঙ্গে আইয়ুব শাসন বিরোধী আন্দোলন, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার আন্দোলন, দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনও ছিল। পাশাপাশি সেই সময় আমরা কিছু ভালো শিক্ষকও পেয়েছিলাম। সেই সময়কার ছাত্ররা জেলে গেছে, মার খেয়েছে, পুলিশের সঙ্গে লড়াই করেছে। আর এসব আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেটা ১৯৫২ সালে, ১৯৬২ সালে ও পরবর্তীকালে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানেও দেখা গেছে। এখনকার ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে আগেকার সংগ্রামী মনোভাব খুঁজে পাওয়া যায় না। আগেকার ছাত্র আন্দোলনে যে রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল, সেটা এখন অনুপস্থিত বলে ছাত্ররা আজ নিজেদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করতে পারছে না।
আপনি তো বহুবার কারাবরণ করেছেন। শুনেছি কারাগারে থাকা অবস্থায় আপনি আইন বিষয়ে পরীক্ষাও দিয়েছেন।
রনো: আমি চার থেকে পাঁচবার কারাগারে গেছি। আমি ছিলাম বিজ্ঞানের ছাত্র। জেল থেকে বিজ্ঞানের কোনো বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়া চলত না। কারণ, বিজ্ঞান মানেই ল্যাবরেটরির কাজ, যা জেলে থেকে সম্ভব নয়। একমাত্র ল’ পরীক্ষা ছাড়া অন্য কোনো পরীক্ষা জেল থেকে দেওয়া সম্ভব ছিল না। ১৯৬৪ সালে আমি যখন জেলে যাই, তখন ঠিক করি, জেল থেকে আইন শাস্ত্রের পরীক্ষা দেব। পরে আমি কারাগার থেকেই আইন বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি পাই। আমার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বিজ্ঞানে হলেও আইনে ডিগ্রি পাস ও ওকালতির সনদ নিয়েছি। এসব ডিগ্রি ও সনদ ভবিষ্যতে কোনো কাজে লাগেনি। তবে পৃথিবীর পাঠশালা থেকে যে বিদ্যার্জন করছি, তা এই ৭৮ বছরেও সমাপ্ত হয়নি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই—এ নিয়ে কিছু বলবেন?
রনো: ১৯৭১ সাল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আমার মনে হয়, আমি খুব ভাগ্যবান। ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় আমি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি বলে। যুদ্ধে গেছি, সেটা আমার জন্য গৌরবের বিষয়। তবে বলে রাখি, আমি সরাসরি বন্দুক নিয়ে সম্মুখ সমরে অংশ নিইনি। আমি সংগঠক ও রাজনীতিকের ভূমিকা পালন করেছি।
১৯৬৯ সালে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করি ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’। ১৯৭১ সালে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ এই নামে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। আমাদের ১৪টি ঘাঁটি ছিল। আমাদের সশস্ত্র সৈনিক ছিল ৩০ হাজারেরও বেশি। ১৯৭১ সালে পাক-হানাদার বাহিনীর যে নৃশংস গণহত্যা ও বর্বরতা দেখেছি, তার তুলনা বোধ হয় সমকালীন ইতিহাসে নাই। তবে এর বিপরীতে আরেকটি চিত্র আছে। তা হলো সাধারণ মানুষের দেশের জন্য যুদ্ধ। কী অপরিসীম সেই বীরত্ব, কী অসামান্য সেই আত্মত্যাগ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আপনার পরিবারের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায় নিয়ে—
রনো: বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছি। কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই যে খবর পেলাম, তাতে আনন্দ কষ্টে পরিণত হয়ে গেল। আমার খালাতো বোন ডোরা পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হন; তাও আবার ঠিক বিজয় দিবসেই, মানে ১৬ ডিসেম্বর। ঘটনাটি হলো—পাকিস্তানি বাহিনী মুজিব পরিবারকে গৃহবন্দী করে রেখেছিল ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের এক বাড়িতে। বাড়ির ছাদেও ছিল পাক সেনাদের বাংকার। সেদিন ডোরাসহ আমার পরিবারের সদস্যরা ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে দেখতে যান। সেখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি করে বসে। তাদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই আমার খালাতো বোন ডোরা মারা যান। একটা গুলি আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর মাথার চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। আরেকটি গুলি আমার মায়ের হাতের ভেতর দিয়ে কাঁধের ভেতরেও ঢোকে। পরে জেনেছি এ রকম মৃত্যুর ঘটনা সেদিন আরও অনেক হয়েছে।
লেখার অনুপ্রেরণার উৎস সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
রনো: আমি স্কুলজীবন থেকে লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। যেমন—ইলা মিত্রের ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমি স্কুলছাত্র। সেই ঘটনা শুনে আমি একটা লেখা লিখি। কোনো পত্রিকার সেই লেখা ছাপা হয়নি। তারপর আলজেরিয়ার যুদ্ধের এক নেত্রী জামিলা; তাঁকে নিয়েও একটা লেখা লিখেছিলাম। আমি যখন নবম কি দশম শ্রেণিতে পড়ি, তখন স্কুল ম্যাগাজিনে রবীন্দ্রনাথের ওপর লেখা লিখেছিলাম। পরে আমি বেশ অবাক হলাম, যখন দেখলাম স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুলের ৫০ বছর পূর্তির ম্যাগাজিনে আমার সেই পুরোনো লেখা পুনর্মুদ্রণ করেছে।
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ওই বয়সেই লিখেছেন?
রনো: হ্যাঁ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আমাদের গর্ব। বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রনাথ তো অনেক বড় কিছু। পৃথিবীর আর কোনো দেশের কবি, সমাজজীবনকে এত বেশি প্রভাবিত করতে পারেননি, যা রবীন্দ্রনাথ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ একজন বিশাল মাপের প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। কবি, ছোট গল্পকার, গীতিকার, সুরকার, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস কোনদিকে ওনার দখল নেই? কোনো দিকেই তিনি স্টার মার্কের কম নম্বর পাবেন না। পাকিস্তানিরা রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু বলে পরিত্যাগ করেছিল। তিনি ছোট গল্পে ইংরেজ, জমিদারদের অত্যাচার তুলে ধরেছিলেন। আবার তিনি তাঁর লেখাতে নারীকে যেভাবে সম্মান করেছেন, সেটা অনেক প্রশংসনীয়। সবদিক মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বলা হবে বিশ্বমানবতার কবি।
বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থানের বিষয় সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
রনো: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে তিনি ধর্ম নিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। এইবার আসি জিয়াউর রহমানের কথায়। তিনি সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তিনি দেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি করে গেছেন, সেটা অতুলনীয়। তিনি ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে দিলেন। পাশাপাশি যেসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল, সে দলগুলোকে তিনি পুনর্জীবিত করলেন। ফলে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ইত্যাদি দলগুলো প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ পেল। পরে এই দলগুলোকে বাতাস দিয়েছেন এরশাদ। বিএনপি এই দলগুলোর সঙ্গে মন্ত্রিত্বও ভাগাভাগি করল। ফলে মৌলবাদের যে আস্ফালন ঘটল, সেটা কিন্তু আমাদের ছাত্রদের প্রগতিশীল আন্দোলনের বিপক্ষে ছিল।
যে উদ্দেশ্য আর লক্ষ্য নিয়ে আমরা পাকিস্তানকে পরাজিত করেছিলাম। সে লক্ষ্য কিন্তু এখন বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও আমি বলব, বাংলাদেশের মাটিতে মৌলবাদ কোনো দিনও বিজয়ী হতে পারবে না। তবে আপাতত তাদের যে আস্ফালন, সেটা অনেক ভয়াবহ। সকল অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মৌলবাদকে প্রতিরোধ করতে হবে।
এই তো কয়েক বছর আগে গণজাগরণ মঞ্চ হলো। এটা কী প্রমাণ করে?
এটা প্রমাণ করে আমাদের ভেতরে এখনো পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী চেতনা আছে। সেদিন মৌলবাদের বিরুদ্ধে শাহবাগের মোড়ে লক্ষ মানুষের সমাবেশ হয়েছিল। সেই আন্দোলনের ফলেই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোও গেছে। এ জন্য অবশ্যই শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানানো উচিত বলে মনে করি। কারণ, শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের আর কোনো নেতার পক্ষে এই ফাঁসি দেওয়া সম্ভব হতো কিনা জানি না।
আবার এই সরকার অন্যদিকে নিজেদের সুবিধার জন্য হেফাজতে ইসলামকে হাতে রাখার জন্য কৌশলও অবলম্বন করল। আমাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হলো রবীন্দ্রনাথ, শরৎ চন্দ্রসহ অনেক নামকরা সাহিত্যিকের রচনাগুলো। এগুলো ছিল হেফাজত ইসলামের দাবি। সেই হেফাজত ইসলাম এখন দেশের বিভিন্ন স্থানের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলছে। এটা হলো আওয়ামী লীগের হেফাজত ইসলামের সঙ্গে কৌশল করার পরিণতি। তাই বলতে হয় কৌশলে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া আসলে এক প্রকারের দুর্বলতা।
আর্থসামাজিক অবস্থায় আমাদের দেশের নারীদের অবস্থান কেমন?
রনো: এখনকার নারীরা কেবল আন্দোলন করছে না। পাশাপাশি নারী মুক্তির ক্ষেত্রে পথে বিরাট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা দলবদ্ধভাবে কারখানায় যাচ্ছে, অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে পুলিশের সঙ্গে রাস্তায় মারামারি করেছ। দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের পরও অতিরিক্ত কাজ করেছ। আবার ঘরে সংসার সামলাচ্ছে। তারা কিন্তু গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। তাদের সমাজে টিকে থাকার যে লড়াই, সেটা আবার উচ্চবিত্তের নারীরা পারেনি। উচ্চবিত্তের নারীদের সন্তুষ্ট রাখা হয় গাড়ি, বাড়ি, আর গয়না দিয়ে। গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকদের কারণে, নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন আগে ছিল না, যেটা এখন আছে। এ ছাড়া সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা নির্বাচিত হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছ, উদ্যোক্তা হচ্ছে, শহর-গ্রামের অনেক নারী স্বাবলম্বীও হচ্ছে। এটা বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়নের পথকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তারপরও এ দেশে নারী নির্যাতন কমছে না কেন?
রনো: আজকের পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বা বিশ্বায়ন ভোগবাদকে প্রাধান্য দেয় বেশি। আমরা তাদের মিডিয়া দ্বারা প্রভাবিত হই। তাই বলতে হয়, একমাত্র সমাজতন্ত্র ছাড়া পিতৃতন্ত্রের অবসান হবে না। ইউরোপে পুঁজিবাদ নারীকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসছে। কারণ, কলকারখানায় নারীদের দরকার। কিন্তু সেখানে পিতৃতান্ত্রিকতা রয়ে গেছে। তাই বলতে হয়, একমাত্র সমাজতন্ত্র নারীর পরিপূর্ণ মুক্তি দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফরাসি বিপ্লব হয়ে গেছে। ইংল্যান্ডে পুঁজিবাদ গেড়ে বসছে। তাদের শিল্প-সাহিত্য কতই না উন্নত। কিন্তু সেখানে মেয়েদের ভোটাধিকার ছিল না। আমেরিকার প্রথম সংবিধানে সবার ভোটের অধিকার ছিল। শুধুমাত্র ভোটের অধিকার ছিল না নারী আর নিগ্রোদের। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম নারীরা ভোটের অধিকার পেয়েছে রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের পরে। তাই বলতে হয় সমাজতন্ত্র ছাড়া নারীদের পরিপূর্ণ মুক্তি সম্ভব না।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
রনো: আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা প্রথমত হওয়া উচিত সেক্যুলার। আমাদের সময় কিন্তু ধর্ম শিক্ষা বলতে কিছু ছিল না। পাকিস্তান আমলেও ধর্ম শিক্ষা বলে কিছু ছিল না। এখন বিভিন্ন শ্রেণিতে ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ কারণে মৌলবাদীরা বেশ মাথা চাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম শিক্ষা যে যার যার বাড়িতে শিখবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার কাঠামো বিজ্ঞানমনস্ক করতে হবে। আমি পাঠ্যপুস্তকে এমন শিক্ষা দিলাম, যার কারণে কুসংস্কারটা আমার মনের ভেতর গেড়ে বসে। তাহলে তো সেটা হবে না। তৃতীয়ত, ইতিহাসের বিকৃতি করা যাবে না। আমাদের এখানে কিন্তু ইতিহাস বিকৃত হয়। যে যখন ক্ষমতায় থাকে, সে তখন তার সুবিধামতো ইতিহাস তৈরি করে। ইংরেজরা যেমন এই কাজটা করেছে। তেমনি আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও সময়ে-সময়ে ইতিহাস বিকৃত করেছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের দেশের শিক্ষকেরাও পাঠদানের বিষয়ে খুব বেশি মনোযোগী না। আবার অনেক স্কুলশিক্ষকের বেতনও কম। এখনকার ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে বেশি পড়ালেখা করে কোচিং সেন্টারগুলোতে। আমার মতে কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করিয়ে দিয়ে শিক্ষকদের বেতন ভাতা বাড়ানো উচিত।
আরেকটা কারণ হলো বহু ধারাতে বিভক্ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ইংরেজি ধারার শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, সবাই বাংলা মিডিয়ামে পড়ালেখা করবে। শিক্ষাব্যবস্থা যদি বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত থাকে। যেমন—এক শ্রেণির ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করবে বাংলায়, আরেক শ্রেণির ছেলেমেয়েরা পড়বে ইংরেজি মিডিয়ামে। আরও আছে মাদ্রাসা শিক্ষা, সেখানেও আবার দুই ধারার শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় এত বিভাজন হওয়া চলবে না। শিক্ষাব্যবস্থা হবে একমুখী। এরশাদের শাসন আমলে ছাত্রদের যে আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে তাদের দাবির মধ্যে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। তখন তো শেখ হাসিনা, আর খালেদা জিয়া এটাকে সমর্থনও দিয়েছিলেন। সেই একমুখী শিক্ষা তো চালু করতে পারে। আবার এই ক্ষেত্রে যদি আপস করতে হয়। শরৎ চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের লেখা যদি হেফাজতের কথায় পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিতে হয়—এটা তো ঠিক না।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেন ভেঙে পড়ল?
রনো: সময়টা ১৯৫৬ সাল। ক্রুশ্চেভ নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত পার্টির বিশতম কংগ্রেসে শুধু স্তালিনের বিরুদ্ধেই কুৎসা করা হয়নি, সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু সংশোধনবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটানো হয়। পরে বিশেষ করে সোভিয়েত পার্টির ২২ তম কংগ্রেসে সংশোধনবাদী ধারণাসমূহ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পৃথিবীর কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টিগুলোর মধ্যে পার্থক্য দূর করে একটি সাধারণ লাইন ঠিক করার জন্য ১৯৬০ সালে ৮৬টি পার্টির এক সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হয় মস্কোতে। বস্তুত কয়েকটি পার্টি তাদের নাম গোপন রাখে বলে এটা ৮১ পার্টির সম্মেলন বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু এই আপসরফার দলিল পরবর্তীকালে টেকেনি। সে সম্মেলনে তখনকার অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন গোপাল নাগ। তিনি চীনের পার্টি সমর্থন করেন। কিন্তু মণি সিংহসহ অনেকে সমর্থন করেছেন সোভিয়েত লাইন। পরে চীন ও সোভিয়েত পার্টির মধ্যে লেটার অব এক্সচেঞ্জ হয় সাতবার। ১৯৬৩ সালের ১৪ জুলাই চীনের পার্টি যে চিঠি লিখেছিল, তার মর্মবস্তুর আলোকে আমরা আমিসহ আরও অনেকে সঠিক বলে মনে করে চীনা লাইন সমর্থন করি। আজকের বাস্তবতা হলো, চীন সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। আর সোভিয়েত তো নেই-ই।
আমাদের দেশে বামপন্থীদের মধ্যে এত বিভক্তি কেন?
রনো: বামদের মধ্যে যে ভাঙন, সেটা একটা তো হয়েছিল সারা পৃথিবীব্যাপী। সেটা হয়তো এড়িয়ে যাওয়া যেত না। কারণ, এই ভাঙনের রেশ সারা পৃথিবীতে হয়েছিল। চীনপন্থী, আর রুশপন্থী। এখন তো আর সোভিয়েতও নেই, আর চীনও সেই জায়গা নেই। এটা একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। ‘পন্থী’ বিষয়টা চলে গেল। তা না হলে আমাদের দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলো পরের দিকে তাকিয়ে থাকত। ওরা যা বলত, সেটা মেনে নিত।
অন্যদিকে আমরা শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারিনি। আমাদের মধ্যে পেটি বুর্জোয়া ক্যারিয়ার, উচ্চাভিলাষ, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আকাঙ্ক্ষা—এগুলোই কাজ করছে। এ কারণে কাজী জাফর, এক সময়কার তুখোড় ছাত্রনেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি এরশাদের মন্ত্রী হয়ে গেলেন। আমার বন্ধু রাশেদ খান মেনন। তাঁর সম্পর্কে বলতে খারাপ লাগে, তিনিও যেভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে গিয়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করলেন। সেটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
শেষে বিশেষ কিছু বলবেন?
রনো: ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ে আমি জন্মেছিলাম বলে, অনেক বিপ্লবী মুহূর্ত কেটেছে আমার জীবনে। তবে সারা জীবন কী করতে পেরেছি জানি না। সব সময় এক অস্থিরতা আমার মধ্যে কাজ করেছে এই ভেবে যে, আমাদের এই দেশ অনেক রাজনৈতিক-সামাজিক ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে যে জায়গাটায় এসে পৌঁছেছে, তা খুব একটা ভালো না। আজ দেশের সাধারণ মানুষেরা ভালো নেই। পাশাপাশি দেশের কমিউনিস্ট ও প্রগতির শক্তি অনেক দুর্বল। তবে, একদিন না একদিন শ্রমিক শ্রেণির জয় হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রনো: আপনাদেরও।
***হায়দার আকবর খান রনোর এ পর্যন্ত ২৫ টির মতো বই প্রকাশিত প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘শতাব্দী পেরিয়ে’, ‘মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা’, ‘উত্তাল ষাটের দশক’, ‘ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব’, ‘রবীন্দ্রনাথ-শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে’, ‘মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ’, ‘মার্কসবাদের প্রথম পাঠ’, ‘মার্ক্সীয় অর্থনীতি’, ‘মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম’, ‘বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), ‘সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর’, ‘পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা’, ‘কোয়ান্টাম জগৎ: কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন’, ‘পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ (প্রথম খণ্ড) ও ‘গ্রাম শহরের গরিব মানুষ জোট বাঁধো’।
২০০৯ সালে রাশেদ খান মেনন; অর্থাৎ, ওয়ার্কার্স পার্টি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে গেলে রনো ওয়ার্কার্স পার্টির একাংশ নিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। দুচোখের দৃষ্টিশক্তি না থাকলেও আপাদমস্তক এই কমিউনিস্টের কাজ থেমে নেই। তিনি গত দুই থেকে তিন বছরে শ্রুতিলেখকের মাধ্যমে তিনটি বইয়ের কাজ সম্পাদন করছেন। বইগুলো হলো ‘সুবিধাবাদ ও সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লেনিন’, ‘স্তালিন’ এবং ‘নারী ও নারীমুক্তি’।
আপনার জন্ম ব্রিটিশ শাসনামলে, আর বড় হয়েছেন পাকিস্তান শাসনামলে। এই সময়ে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেছেন?
রনো: আমি আমার জীবনে তিনটি রাজত্ব, তিনটি পতাকা দেখেছি। ১৯৪২ সালে আমার জন্ম। তাই ব্রিটিশ ভারতকে আমি দেখেছি মাত্র পাঁচ বছর। সে সময় মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ বসু, বাঘা যতীন, সূর্য সেনসহ আরও অনেকেই লড়াই করে ব্রিটিশকে তাড়িয়েছেন। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের বিষয়টি অনেক দুঃখজনক। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো। একই সঙ্গে তৈরি হলো দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান। তারপর আমি প্রায় ২৪ বছর কাটিয়েছি পাকিস্তানে।
রাজনীতিতে যুক্ত হলেন কীভাবে?
রনো: দেশভাগের ঘটনাপ্রবাহে ১৯৫৪ সালের আগস্ট মাসে ঢাকায় আসি। ফলে বড় হয়েছি পাকিস্তান শাসনামলে। ১৯৫৪ সালে আমি সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। এই স্কুল থেকে আমি পরে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে মেধা তালিকায় ১২তম স্থান লাভও করেছিলাম। ১৯৬০ সালে ঢাকার নটর ডেম কলেজ হতে আইএসসি পাস করি। এর পর ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হই। তখন দেশে সামরিক শাসন চলছিল। প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল না। ওই বছরই গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হই। বলা যেতে পারে, সেই সময় থেকেই আমার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। ১৯৬১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ ছিল আমার জীবনের প্রথম রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ। এ ছাড়া ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় যে ছাত্রসভা হয়েছিল, সেখানে একজন বক্তা ছিলাম আমি।
প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নকে সংগঠিত করা যেমন, তেমনি এর ভাঙনেও আপনি জড়িত ছিলেন। এই বিষয়ে যদি কিছু বলতেন।
রনো: আমি দীর্ঘদিন ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ছাত্রদের মধ্যেই শুরু হয় আমার প্রথম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। পঞ্চাশের দশকে ছাত্র ইউনিয়ন অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৩ সালে ছাত্র ইউনিয়ন দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়। সে বছরের শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে আমাকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। একই বছর আমাদের দেশের কমিউনিস্ট দলগুলোর মধ্যে চীন-সোভিয়েত বিতর্ক জমে ওঠে। ফলে কমিউনিস্টরা যে যার মতো করে সোভিয়েত বা চীনের পার্টির লাইনের সমর্থন করতে থাকে। ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বের মধ্যেও এর প্রভাব পড়ে। একাংশের নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। অন্য অংশে ছিলেন কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, মহিউদ্দিন আহমদ, আবদুল হালিম ও আমি।
সে সময় রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক উভয় দিক দিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে বিভাজন ও সংকট বাড়তে থাকে। ১৯৬৫ সাল আমার জীবন তো বটেই, এ দেশে বাম আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক ঘটনার জন্য স্মরণীয় ছিল। কারণ, সেই বছরের এপ্রিল মাসে তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত হয়। ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্তির পরপরই কারাগার থেকে বের হয়ে আমি মেনন গ্রুপকে সমর্থন করি এবং মেনন গ্রুপের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করি।
তখনকার ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে এখনকার ছাত্র আন্দোলনের পার্থক্য করতে বললে কী বলবেন?
রনো: তখনকার ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। সেটা শুধু শিক্ষা আন্দোলন নয়, একী সঙ্গে আইয়ুব শাসন বিরোধী আন্দোলন, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার আন্দোলন, দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনও ছিল। পাশাপাশি সেই সময় আমরা কিছু ভালো শিক্ষকও পেয়েছিলাম। সেই সময়কার ছাত্ররা জেলে গেছে, মার খেয়েছে, পুলিশের সঙ্গে লড়াই করেছে। আর এসব আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেটা ১৯৫২ সালে, ১৯৬২ সালে ও পরবর্তীকালে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানেও দেখা গেছে। এখনকার ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে আগেকার সংগ্রামী মনোভাব খুঁজে পাওয়া যায় না। আগেকার ছাত্র আন্দোলনে যে রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল, সেটা এখন অনুপস্থিত বলে ছাত্ররা আজ নিজেদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করতে পারছে না।
আপনি তো বহুবার কারাবরণ করেছেন। শুনেছি কারাগারে থাকা অবস্থায় আপনি আইন বিষয়ে পরীক্ষাও দিয়েছেন।
রনো: আমি চার থেকে পাঁচবার কারাগারে গেছি। আমি ছিলাম বিজ্ঞানের ছাত্র। জেল থেকে বিজ্ঞানের কোনো বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়া চলত না। কারণ, বিজ্ঞান মানেই ল্যাবরেটরির কাজ, যা জেলে থেকে সম্ভব নয়। একমাত্র ল’ পরীক্ষা ছাড়া অন্য কোনো পরীক্ষা জেল থেকে দেওয়া সম্ভব ছিল না। ১৯৬৪ সালে আমি যখন জেলে যাই, তখন ঠিক করি, জেল থেকে আইন শাস্ত্রের পরীক্ষা দেব। পরে আমি কারাগার থেকেই আইন বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি পাই। আমার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বিজ্ঞানে হলেও আইনে ডিগ্রি পাস ও ওকালতির সনদ নিয়েছি। এসব ডিগ্রি ও সনদ ভবিষ্যতে কোনো কাজে লাগেনি। তবে পৃথিবীর পাঠশালা থেকে যে বিদ্যার্জন করছি, তা এই ৭৮ বছরেও সমাপ্ত হয়নি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই—এ নিয়ে কিছু বলবেন?
রনো: ১৯৭১ সাল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আমার মনে হয়, আমি খুব ভাগ্যবান। ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় আমি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি বলে। যুদ্ধে গেছি, সেটা আমার জন্য গৌরবের বিষয়। তবে বলে রাখি, আমি সরাসরি বন্দুক নিয়ে সম্মুখ সমরে অংশ নিইনি। আমি সংগঠক ও রাজনীতিকের ভূমিকা পালন করেছি।
১৯৬৯ সালে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করি ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’। ১৯৭১ সালে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ এই নামে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। আমাদের ১৪টি ঘাঁটি ছিল। আমাদের সশস্ত্র সৈনিক ছিল ৩০ হাজারেরও বেশি। ১৯৭১ সালে পাক-হানাদার বাহিনীর যে নৃশংস গণহত্যা ও বর্বরতা দেখেছি, তার তুলনা বোধ হয় সমকালীন ইতিহাসে নাই। তবে এর বিপরীতে আরেকটি চিত্র আছে। তা হলো সাধারণ মানুষের দেশের জন্য যুদ্ধ। কী অপরিসীম সেই বীরত্ব, কী অসামান্য সেই আত্মত্যাগ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আপনার পরিবারের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায় নিয়ে—
রনো: বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছি। কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই যে খবর পেলাম, তাতে আনন্দ কষ্টে পরিণত হয়ে গেল। আমার খালাতো বোন ডোরা পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হন; তাও আবার ঠিক বিজয় দিবসেই, মানে ১৬ ডিসেম্বর। ঘটনাটি হলো—পাকিস্তানি বাহিনী মুজিব পরিবারকে গৃহবন্দী করে রেখেছিল ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের এক বাড়িতে। বাড়ির ছাদেও ছিল পাক সেনাদের বাংকার। সেদিন ডোরাসহ আমার পরিবারের সদস্যরা ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে দেখতে যান। সেখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি করে বসে। তাদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই আমার খালাতো বোন ডোরা মারা যান। একটা গুলি আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর মাথার চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। আরেকটি গুলি আমার মায়ের হাতের ভেতর দিয়ে কাঁধের ভেতরেও ঢোকে। পরে জেনেছি এ রকম মৃত্যুর ঘটনা সেদিন আরও অনেক হয়েছে।
লেখার অনুপ্রেরণার উৎস সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
রনো: আমি স্কুলজীবন থেকে লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। যেমন—ইলা মিত্রের ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমি স্কুলছাত্র। সেই ঘটনা শুনে আমি একটা লেখা লিখি। কোনো পত্রিকার সেই লেখা ছাপা হয়নি। তারপর আলজেরিয়ার যুদ্ধের এক নেত্রী জামিলা; তাঁকে নিয়েও একটা লেখা লিখেছিলাম। আমি যখন নবম কি দশম শ্রেণিতে পড়ি, তখন স্কুল ম্যাগাজিনে রবীন্দ্রনাথের ওপর লেখা লিখেছিলাম। পরে আমি বেশ অবাক হলাম, যখন দেখলাম স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুলের ৫০ বছর পূর্তির ম্যাগাজিনে আমার সেই পুরোনো লেখা পুনর্মুদ্রণ করেছে।
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ওই বয়সেই লিখেছেন?
রনো: হ্যাঁ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আমাদের গর্ব। বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রনাথ তো অনেক বড় কিছু। পৃথিবীর আর কোনো দেশের কবি, সমাজজীবনকে এত বেশি প্রভাবিত করতে পারেননি, যা রবীন্দ্রনাথ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ একজন বিশাল মাপের প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। কবি, ছোট গল্পকার, গীতিকার, সুরকার, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস কোনদিকে ওনার দখল নেই? কোনো দিকেই তিনি স্টার মার্কের কম নম্বর পাবেন না। পাকিস্তানিরা রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু বলে পরিত্যাগ করেছিল। তিনি ছোট গল্পে ইংরেজ, জমিদারদের অত্যাচার তুলে ধরেছিলেন। আবার তিনি তাঁর লেখাতে নারীকে যেভাবে সম্মান করেছেন, সেটা অনেক প্রশংসনীয়। সবদিক মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বলা হবে বিশ্বমানবতার কবি।
বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থানের বিষয় সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
রনো: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে তিনি ধর্ম নিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। এইবার আসি জিয়াউর রহমানের কথায়। তিনি সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তিনি দেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি করে গেছেন, সেটা অতুলনীয়। তিনি ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে দিলেন। পাশাপাশি যেসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল, সে দলগুলোকে তিনি পুনর্জীবিত করলেন। ফলে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ইত্যাদি দলগুলো প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ পেল। পরে এই দলগুলোকে বাতাস দিয়েছেন এরশাদ। বিএনপি এই দলগুলোর সঙ্গে মন্ত্রিত্বও ভাগাভাগি করল। ফলে মৌলবাদের যে আস্ফালন ঘটল, সেটা কিন্তু আমাদের ছাত্রদের প্রগতিশীল আন্দোলনের বিপক্ষে ছিল।
যে উদ্দেশ্য আর লক্ষ্য নিয়ে আমরা পাকিস্তানকে পরাজিত করেছিলাম। সে লক্ষ্য কিন্তু এখন বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও আমি বলব, বাংলাদেশের মাটিতে মৌলবাদ কোনো দিনও বিজয়ী হতে পারবে না। তবে আপাতত তাদের যে আস্ফালন, সেটা অনেক ভয়াবহ। সকল অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মৌলবাদকে প্রতিরোধ করতে হবে।
এই তো কয়েক বছর আগে গণজাগরণ মঞ্চ হলো। এটা কী প্রমাণ করে?
এটা প্রমাণ করে আমাদের ভেতরে এখনো পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী চেতনা আছে। সেদিন মৌলবাদের বিরুদ্ধে শাহবাগের মোড়ে লক্ষ মানুষের সমাবেশ হয়েছিল। সেই আন্দোলনের ফলেই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোও গেছে। এ জন্য অবশ্যই শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানানো উচিত বলে মনে করি। কারণ, শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের আর কোনো নেতার পক্ষে এই ফাঁসি দেওয়া সম্ভব হতো কিনা জানি না।
আবার এই সরকার অন্যদিকে নিজেদের সুবিধার জন্য হেফাজতে ইসলামকে হাতে রাখার জন্য কৌশলও অবলম্বন করল। আমাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হলো রবীন্দ্রনাথ, শরৎ চন্দ্রসহ অনেক নামকরা সাহিত্যিকের রচনাগুলো। এগুলো ছিল হেফাজত ইসলামের দাবি। সেই হেফাজত ইসলাম এখন দেশের বিভিন্ন স্থানের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলছে। এটা হলো আওয়ামী লীগের হেফাজত ইসলামের সঙ্গে কৌশল করার পরিণতি। তাই বলতে হয় কৌশলে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া আসলে এক প্রকারের দুর্বলতা।
আর্থসামাজিক অবস্থায় আমাদের দেশের নারীদের অবস্থান কেমন?
রনো: এখনকার নারীরা কেবল আন্দোলন করছে না। পাশাপাশি নারী মুক্তির ক্ষেত্রে পথে বিরাট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা দলবদ্ধভাবে কারখানায় যাচ্ছে, অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে পুলিশের সঙ্গে রাস্তায় মারামারি করেছ। দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের পরও অতিরিক্ত কাজ করেছ। আবার ঘরে সংসার সামলাচ্ছে। তারা কিন্তু গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। তাদের সমাজে টিকে থাকার যে লড়াই, সেটা আবার উচ্চবিত্তের নারীরা পারেনি। উচ্চবিত্তের নারীদের সন্তুষ্ট রাখা হয় গাড়ি, বাড়ি, আর গয়না দিয়ে। গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকদের কারণে, নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন আগে ছিল না, যেটা এখন আছে। এ ছাড়া সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা নির্বাচিত হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছ, উদ্যোক্তা হচ্ছে, শহর-গ্রামের অনেক নারী স্বাবলম্বীও হচ্ছে। এটা বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়নের পথকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তারপরও এ দেশে নারী নির্যাতন কমছে না কেন?
রনো: আজকের পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বা বিশ্বায়ন ভোগবাদকে প্রাধান্য দেয় বেশি। আমরা তাদের মিডিয়া দ্বারা প্রভাবিত হই। তাই বলতে হয়, একমাত্র সমাজতন্ত্র ছাড়া পিতৃতন্ত্রের অবসান হবে না। ইউরোপে পুঁজিবাদ নারীকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসছে। কারণ, কলকারখানায় নারীদের দরকার। কিন্তু সেখানে পিতৃতান্ত্রিকতা রয়ে গেছে। তাই বলতে হয়, একমাত্র সমাজতন্ত্র নারীর পরিপূর্ণ মুক্তি দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফরাসি বিপ্লব হয়ে গেছে। ইংল্যান্ডে পুঁজিবাদ গেড়ে বসছে। তাদের শিল্প-সাহিত্য কতই না উন্নত। কিন্তু সেখানে মেয়েদের ভোটাধিকার ছিল না। আমেরিকার প্রথম সংবিধানে সবার ভোটের অধিকার ছিল। শুধুমাত্র ভোটের অধিকার ছিল না নারী আর নিগ্রোদের। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম নারীরা ভোটের অধিকার পেয়েছে রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের পরে। তাই বলতে হয় সমাজতন্ত্র ছাড়া নারীদের পরিপূর্ণ মুক্তি সম্ভব না।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
রনো: আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা প্রথমত হওয়া উচিত সেক্যুলার। আমাদের সময় কিন্তু ধর্ম শিক্ষা বলতে কিছু ছিল না। পাকিস্তান আমলেও ধর্ম শিক্ষা বলে কিছু ছিল না। এখন বিভিন্ন শ্রেণিতে ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ কারণে মৌলবাদীরা বেশ মাথা চাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম শিক্ষা যে যার যার বাড়িতে শিখবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার কাঠামো বিজ্ঞানমনস্ক করতে হবে। আমি পাঠ্যপুস্তকে এমন শিক্ষা দিলাম, যার কারণে কুসংস্কারটা আমার মনের ভেতর গেড়ে বসে। তাহলে তো সেটা হবে না। তৃতীয়ত, ইতিহাসের বিকৃতি করা যাবে না। আমাদের এখানে কিন্তু ইতিহাস বিকৃত হয়। যে যখন ক্ষমতায় থাকে, সে তখন তার সুবিধামতো ইতিহাস তৈরি করে। ইংরেজরা যেমন এই কাজটা করেছে। তেমনি আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও সময়ে-সময়ে ইতিহাস বিকৃত করেছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের দেশের শিক্ষকেরাও পাঠদানের বিষয়ে খুব বেশি মনোযোগী না। আবার অনেক স্কুলশিক্ষকের বেতনও কম। এখনকার ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে বেশি পড়ালেখা করে কোচিং সেন্টারগুলোতে। আমার মতে কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করিয়ে দিয়ে শিক্ষকদের বেতন ভাতা বাড়ানো উচিত।
আরেকটা কারণ হলো বহু ধারাতে বিভক্ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ইংরেজি ধারার শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, সবাই বাংলা মিডিয়ামে পড়ালেখা করবে। শিক্ষাব্যবস্থা যদি বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত থাকে। যেমন—এক শ্রেণির ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করবে বাংলায়, আরেক শ্রেণির ছেলেমেয়েরা পড়বে ইংরেজি মিডিয়ামে। আরও আছে মাদ্রাসা শিক্ষা, সেখানেও আবার দুই ধারার শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় এত বিভাজন হওয়া চলবে না। শিক্ষাব্যবস্থা হবে একমুখী। এরশাদের শাসন আমলে ছাত্রদের যে আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে তাদের দাবির মধ্যে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। তখন তো শেখ হাসিনা, আর খালেদা জিয়া এটাকে সমর্থনও দিয়েছিলেন। সেই একমুখী শিক্ষা তো চালু করতে পারে। আবার এই ক্ষেত্রে যদি আপস করতে হয়। শরৎ চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের লেখা যদি হেফাজতের কথায় পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিতে হয়—এটা তো ঠিক না।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেন ভেঙে পড়ল?
রনো: সময়টা ১৯৫৬ সাল। ক্রুশ্চেভ নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত পার্টির বিশতম কংগ্রেসে শুধু স্তালিনের বিরুদ্ধেই কুৎসা করা হয়নি, সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু সংশোধনবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটানো হয়। পরে বিশেষ করে সোভিয়েত পার্টির ২২ তম কংগ্রেসে সংশোধনবাদী ধারণাসমূহ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পৃথিবীর কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টিগুলোর মধ্যে পার্থক্য দূর করে একটি সাধারণ লাইন ঠিক করার জন্য ১৯৬০ সালে ৮৬টি পার্টির এক সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হয় মস্কোতে। বস্তুত কয়েকটি পার্টি তাদের নাম গোপন রাখে বলে এটা ৮১ পার্টির সম্মেলন বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু এই আপসরফার দলিল পরবর্তীকালে টেকেনি। সে সম্মেলনে তখনকার অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন গোপাল নাগ। তিনি চীনের পার্টি সমর্থন করেন। কিন্তু মণি সিংহসহ অনেকে সমর্থন করেছেন সোভিয়েত লাইন। পরে চীন ও সোভিয়েত পার্টির মধ্যে লেটার অব এক্সচেঞ্জ হয় সাতবার। ১৯৬৩ সালের ১৪ জুলাই চীনের পার্টি যে চিঠি লিখেছিল, তার মর্মবস্তুর আলোকে আমরা আমিসহ আরও অনেকে সঠিক বলে মনে করে চীনা লাইন সমর্থন করি। আজকের বাস্তবতা হলো, চীন সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। আর সোভিয়েত তো নেই-ই।
আমাদের দেশে বামপন্থীদের মধ্যে এত বিভক্তি কেন?
রনো: বামদের মধ্যে যে ভাঙন, সেটা একটা তো হয়েছিল সারা পৃথিবীব্যাপী। সেটা হয়তো এড়িয়ে যাওয়া যেত না। কারণ, এই ভাঙনের রেশ সারা পৃথিবীতে হয়েছিল। চীনপন্থী, আর রুশপন্থী। এখন তো আর সোভিয়েতও নেই, আর চীনও সেই জায়গা নেই। এটা একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। ‘পন্থী’ বিষয়টা চলে গেল। তা না হলে আমাদের দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলো পরের দিকে তাকিয়ে থাকত। ওরা যা বলত, সেটা মেনে নিত।
অন্যদিকে আমরা শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারিনি। আমাদের মধ্যে পেটি বুর্জোয়া ক্যারিয়ার, উচ্চাভিলাষ, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আকাঙ্ক্ষা—এগুলোই কাজ করছে। এ কারণে কাজী জাফর, এক সময়কার তুখোড় ছাত্রনেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি এরশাদের মন্ত্রী হয়ে গেলেন। আমার বন্ধু রাশেদ খান মেনন। তাঁর সম্পর্কে বলতে খারাপ লাগে, তিনিও যেভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে গিয়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করলেন। সেটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
শেষে বিশেষ কিছু বলবেন?
রনো: ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ে আমি জন্মেছিলাম বলে, অনেক বিপ্লবী মুহূর্ত কেটেছে আমার জীবনে। তবে সারা জীবন কী করতে পেরেছি জানি না। সব সময় এক অস্থিরতা আমার মধ্যে কাজ করেছে এই ভেবে যে, আমাদের এই দেশ অনেক রাজনৈতিক-সামাজিক ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে যে জায়গাটায় এসে পৌঁছেছে, তা খুব একটা ভালো না। আজ দেশের সাধারণ মানুষেরা ভালো নেই। পাশাপাশি দেশের কমিউনিস্ট ও প্রগতির শক্তি অনেক দুর্বল। তবে, একদিন না একদিন শ্রমিক শ্রেণির জয় হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রনো: আপনাদেরও।
***হায়দার আকবর খান রনোর এ পর্যন্ত ২৫ টির মতো বই প্রকাশিত প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘শতাব্দী পেরিয়ে’, ‘মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা’, ‘উত্তাল ষাটের দশক’, ‘ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব’, ‘রবীন্দ্রনাথ-শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে’, ‘মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ’, ‘মার্কসবাদের প্রথম পাঠ’, ‘মার্ক্সীয় অর্থনীতি’, ‘মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম’, ‘বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), ‘সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর’, ‘পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা’, ‘কোয়ান্টাম জগৎ: কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন’, ‘পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ (প্রথম খণ্ড) ও ‘গ্রাম শহরের গরিব মানুষ জোট বাঁধো’।
২০০৯ সালে রাশেদ খান মেনন; অর্থাৎ, ওয়ার্কার্স পার্টি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে গেলে রনো ওয়ার্কার্স পার্টির একাংশ নিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। দুচোখের দৃষ্টিশক্তি না থাকলেও আপাদমস্তক এই কমিউনিস্টের কাজ থেমে নেই। তিনি গত দুই থেকে তিন বছরে শ্রুতিলেখকের মাধ্যমে তিনটি বইয়ের কাজ সম্পাদন করছেন। বইগুলো হলো ‘সুবিধাবাদ ও সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লেনিন’, ‘স্তালিন’ এবং ‘নারী ও নারীমুক্তি’।
ইউনিক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত হোসেন। পর্যটনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি মনজুরুল ইসলাম।
০৩ অক্টোবর ২০২৪বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, সুফি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোনো বিভাজনমূলক এজেন্ডায় রাজনীতির দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত না হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা দৃঢ়ভাবে কোনো সাম্প্রদায়িক ফাঁদে আটকা পড়তে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করি। কোনোভাবেই তা হতে দেওয়া যাবে না।
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪‘আমি এটাকে ঠিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বলব না। আমি এটাকে বলব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সেটা আমার পারিবারিক শিক্ষা। আমাদের ঘরের ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে যেকোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পরিবারের বড়দের সাথে আমরা দ্বিমত পোষণ করতে পেরেছি। ছোট থেকে বড়, কারও কোনো কথা বা কাজ ভুল মনে হলে সেটাকে আমরা তার প্রতি স
৩১ আগস্ট ২০২৪একেক মানুষ বেছে নেন একেক পেশা। তাঁদের মধ্যে কারও কারও পেশা একটু ভিন্ন ধরনের। যেমন—মো. মুনসুর আলী ওরফে মন্টু খলিফা। বাপ-দাদার পেশাকে ভালোবেসে শিশুদের খতনা করানো বা হাজামের কাজ বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। জীবনে পার করেছেন প্রায় ৮৫ বছর। জানিয়েছেন গত ৬০ বছরে ২ লাখের বেশি শিশুর মুসলমানি বা সুন্নতে খতনা দিয়
৩০ মার্চ ২০২৪