কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর তিনি ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম, লন্ডনেও পড়াশোনা করেছেন। তিনি রাজনৈতিক পরিবারের মানুষ, তাঁর বাবা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে তিনি সোচ্চার ছিলেন। এবারও কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তাঁর। তবে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে নয়, পারিবারিক শিক্ষার কারণেই শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলে তিনি জানান। ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌসের এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আজকের পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক অর্চি হক।
অর্চি হক, ঢাকা
আজকের পত্রিকা: কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আপনি শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সে সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। আপনার এই অবস্থানের কারণ কী ছিল?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: আমি আমার নৈতিকতা বিসর্জন দিতে পারি নাই। আমি একজন শিক্ষক। শিক্ষকের অপর নাম আমরা বলি অভিভাবক। আমার একটা সন্তান রাস্তায় থাকলে আমার যে ভূমিকা হতো, আমার মনে হয়েছে শিক্ষকের ভূমিকা আরও জোরালো হওয়া উচিত। সেই ভাবনা থেকেই আমি দাঁড়িয়েছি। আমি যে বিশেষ কিছু করেছি তা নয়। এটাই কি স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল না? আমাদের শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো ন্যায্য ছিল। কিন্তু তাদের সাথে যে আচরণটা করা হয়েছে, সেটা অন্যায়। এই অন্যায় মেনে নেওয়া উচিত না, মেনে নেওয়া ঠিক না। সেই জায়গা থেকেই শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো।
আজকের পত্রিকা: আপনার বা আপনার পরিবারের রাজনৈতিক মতাদর্শ বা ভাবাদর্শ শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: আমি এটাকে ঠিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বলব না। আমি এটাকে বলব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সেটা আমার পারিবারিক শিক্ষা। আমাদের ঘরের ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে যেকোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পরিবারের বড়দের সাথে আমরা দ্বিমত পোষণ করতে পেরেছি। ছোট থেকে বড়, কারও কোনো কথা বা কাজ ভুল মনে হলে সেটাকে আমরা তার প্রতি সম্মান রেখে ‘না’ বলতে শিখেছি। অন্যায় মানে অবশ্যই ‘না’। বড় থেকে শুরু করে ছোট প্রত্যেকেরই ‘না’ বলবার অধিকার আছে। এটা আমার পারিবারিক শিক্ষা। এটা রাজনৈতিক মতাদর্শ না। আমরা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। অন্ধত্ব, দলকানা, ব্যক্তিকানা, স্বার্থপরতা—এই বিষয়গুলো আমাদের পরিবারে চলে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে না দাঁড়ানোটা যে অনেক বড় পাপ, সেটা আমাদের পরিবারে খুব শক্ত করেই মাথায় গেঁথে দেওয়া হয়েছে। আমরা এটা দেখেই বড় হয়েছি।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলায় কোনো ধরনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন? তৎকালীন সরকার বা প্রশাসন থেকে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: ১৫ বছরের স্বৈরশাসকের কাছ থেকে এটাই কি খুব স্বাভাবিক না? কী রকম বাধা আসতে পারে সেটা সবাই জানে, আগেও জানত। আমার মোবাইল ফোনে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের টেক্সট আসত। সরাসরি বা কারও মাধ্যমে হুমকি দেওয়া, এগুলো তো ওদের চিরাচরিত অভ্যাস। যুগে যুগে এটা স্বৈরাচারের একটা কৌশল। আপনি অন্যায় করবেন, আমি কিছু বলতে পারব না। আপনি চুরি করবেন, ভোট ডাকাতি করবেন, ব্যাংক লুটে নিয়ে চলে যাবেন, কিন্তু আমি কিছু বলতে পারব না। বিগত সরকার যেটা করেছে, লোভ আর ভয়ের এক কৌশল। সমাজে একদল লোককে পদ-পদবির লোভ দেখিয়ে তারা কুক্ষীগত করার চেষ্টা করেছে, আর বাকিদের ভেতর আয়নাঘর, গুম, খুন—এইসব নারকীয় কাজের মাধ্যমে ভয় সৃষ্টি করেছে। এভাবেই স্বৈরাচারেরা সফল হয়। আয়নাঘর, গুম, খুন, ভোট ডাকাতি—এইসব তো প্রকাশ্য দিবালোকে ছিল, সবার কাছে। তা-ও কজন মানুষ ভয় মাড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পেরেছি? প্রতিবাদ করলেই পরিণতি ভয়াবহ, সেটাই তো কার্যত তা দেখিয়েছে! যারাই সরকারের মতের বিরুদ্ধে নেমেছে এযাবৎকালে তাদের জীবনের হুমকি, পরিবারের জন্য হুমকি ছিল। তবে কি জানেন, সবাইকে ভয় দেখানো যায় না, অন্যায়ের সীমালঙ্ঘন হলে সব মানুষকে দাবিয়ে রাখা যায় না, সব মানুষকে পদ-পদবির লোভে কিনে ফেলা যায় না। প্রতিবাদটা যখন ন্যায্য হয়, ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও দশের স্বার্থে হয়, তখন ওই ভয়টাও কাজ করে না।
আজকের পত্রিকা: কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের আন্দোলন—এই ৩৬ দিন কীভাবে কেটেছিল?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: ২৫ মার্চ বা একাত্তরের সময় আমরা যেমন শুনেছি, রাতগুলাও আতঙ্কের, বাসার দরজায় ঠক ঠক করে কড়া নাড়ানো হতো, ভেতরে কে আছে জানতে চাইত—এই আতঙ্কগুলো এবার আমরা যারাই প্রতিবাদ করেছি, তাদের মধ্যে বিরাজ করত; রাতগুলো ছিল বিভীষিকাময়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যখন অন্যায় হচ্ছিল, তখন ক্ষোভে রাগে-ঘুম হতো না। যেদিন থেকে শিক্ষার্থীদের সাথে মাঠে নামলাম, তখন থেকে শুরু হলো আরেক আতঙ্ক। কারণ, হুমকি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের টেক্সট (খুদে বার্তা) আসত। আমাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে, এটা বোঝাতে আমি কখন কোথায় যাচ্ছি, সেসবের ছবি পাঠাত। এসব কারণে একধরনের ভয় হতো। রাতে সে ভয়টা তীব্র হতো। কারণ, আয়নাঘরে ধরে নিয়ে যাওয়া, ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া—এসব তো রাতেই হতো। এমনও হয়েছে, মাঝে মাঝে কিছু রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়েছি, কিন্তু ঘুম হয়নি। তবে সকাল হলেই রাতের আতঙ্কটা কেটে যেত। তখন মনে হতো, জীবন আর মৃত্যু তো আল্লাহ্র নির্ধারণ করেন। আমি বেঁচে থেকেও যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে না পারি, প্রতিবাদ না করতে পারি, সেই বেঁচে থাকা আমার কাছে মূল্যহীন। প্রতিবাদে যখন যেতাম, সমমনা লোকজনেরা যখন পাশে থাকত, তখন সাহস পেতাম।
আন্দোলনের দিনগুলোতে পরের দিন কী হবে তা নিয়ে আমাদের কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। ছাত্রদের সাথে আমার ব্যক্তিগতভাবে কোনো যোগাযোগও ছিল না। প্রতিবাদের জায়গা থেকে বাসায় একাই আসা-যাওয়া করতাম। তখন ভয় হতো। কেমন যেন ঘোরের ভেতর ছিল সেই দিনগুলো। আমাদের জন্য একমাত্র বেঁচে থাকার মুহূর্ত ছিল প্রতিবাদ করার সময়টা।
আজকের পত্রিকা: সরকার পতনের পর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাস্কর্য এবং স্থাপনা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে; লুটপাট হয়েছে। অনেকে নিগৃহীত হয়েছেন। এই বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখেন?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: প্রথম কথা হচ্ছে, নিপীড়নের বিরুদ্ধেই তো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনটা ছিল। তাই যেকোনো ধরনের সহিংসতাই কাম্য নয়। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে, ফ্যাসিজমের শিকারে মানুষের ভেতরে তীব্র ক্ষোভ জন্মেছিল। একের পর এক অন্যায়, সমাজের প্রতিটা স্তরে যে পরিমাণ নৈরাজ্যের শিকার মানুষ হয়েছিল, আপামর জনতার বিগত সরকারের প্রতি একটা তীব্র আক্রোশ তৈরি হয়েছিল! ভাস্কর্যগুলোকে তারা সরকারের রূপক ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ওনার মতো (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) একজন রাজনীতিবিদকে প্রতিনিয়ত একটা পণ্যে পরিণত করেছিল। বঙ্গবন্ধু ভালোমন্দ যা-ই আছে, তা আমরা ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বের করে নিয়ে আসতে পারি। কোনো যুদ্ধ, কোনো আন্দোলন কারও একার কিংবা এক দলের হয় না। আপনি যতই ইতিহাস বিকৃত করেন, ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না। মানুষ বাংলাদেশের সত্যি ইতিহাস জানে। মুক্তিযুদ্ধে কার কী অবদান ছিল, সেটা তো সবাই স্বীকার করে। কিন্তু আপনি যখনই কোনো অবদানকে চর্বিত চর্বন করে ফেলবেন, মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়। ভাস্কর্যগুলো ভাঙার পেছনে মানুষ হিসেবে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আমি বলছি না যে এটা করা ঠিক। কিন্তু আমি বলব, এটা বিগত সরকার এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কর্মফল।
আজকের পত্রিকা: শুধু যে বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের ভাস্কর্য ও স্থাপনা ভাঙা হয়েছে তা কিন্তু নয়, বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য, ময়মনসিংহের শশীলজ, এমনকি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাস্কর্যও ভাঙা হয়েছে। এ বিষয়টাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: অবশ্যই এগুলো কাম্য নয়। যেকোনো চরমপন্থা থেকেই নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। তবে একটা ব্যাপার কি জানেন? এটাও বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের একটা রাজনৈতিক কৌশলের ফল। তারা বাংলাদেশে মানুষের ভেতরে অনেক রকম বিভাজন সৃষ্টি করেছে। ভিন্ন ধর্ম, বর্ণের আর মতের প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণকে বাহবা দিয়েছে। আমি এই দেশে জন্মেছি, এই দেশে বড় হয়েছি, আমরা সবাইকে নিয়েই বড় হয়েছি। কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিষ্টান—এই জিনিসগুলো আমাদের মধ্যে আগে কাজ করত না। এই দেশ তো আমার একার না, সবার। ধর্ম যার যার, দেশটা সবার—এটাই কি আগে ছিল না? বিগত সরকার বিভিন্ন প্রক্রিয়া শুধু যে আমাদের ভেতর বিভাজন সৃষ্টি করেছে তা না, ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণেও উদ্বুদ্ধ করেছে। কিছুদিন পরে দেখবেন, এটাও হয়তো ইতিহাসেও লিপিবদ্ধ হবে, যুগে যুগে মানুষের মাথার মধ্যে কীভাবে বিভেদ, হিংসা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক অপশক্তির কৌশলে। ভিন্নমত হলে, ভিন্ন ধর্ম হলে তাকে নেগেটিভলি দেখতে হবে, তাকে আক্রমণ করতে হবে—এটা মানুষের মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেটারই বহিঃপ্রকাশ ছিল এগুলো। হয়তো ওই মানুষগুলো ১৫ বছর অত্যাচারিত হয়েছে। এখন সুযোগ পেয়ে সে আক্রমণ করেছে। এই ভাঙচুর আমি সমর্থন করি না। কিন্তু ভাঙচুরের পেছনে এটা কারণ বলে মনে করছি। তবে ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন মতের প্রতি মানুষের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ করে ফেলাটা যে স্বৈরশাসকের নোংরা রাজনৈতিক চাল—সেটা কিন্তু এখন মানুষ বুঝতে পেরেছে এবং সেখান থেকে তারা সরে এসেছে। ৫ আগস্টের ওই কয়েকটা অপ্রীতিকর ঘটনার পর দেখেছি কীভাবে মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিষ্টান, সবাই মিলে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে। ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে এক গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী নৈরাজ্য রুখে দিতে কি অপূর্বভাবে দলমত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই বন্যার সময়ও বাংলার মানুষ একসাথে কাজ করছে। এখনকার অবস্থাটা দেখেন, ৫ আগস্টের পর আপামর জনতার সাথে ছাত্র-ছাত্রীরা মিলে একটার পর একটা পরিস্থিতি সামলাচ্ছে। সুন্দর বাংলাদেশের শুরুটা এখানে, আমরা সবাই বাংলাদেশি।
আজকের পত্রিকা: অন্তর্বর্তী সরকারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন প্রতিনিধি রয়েছে। কিন্তু শিক্ষক নেটওয়ার্কের কেউ এই সরকারে নেই। এই বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: আমার মতে, শিক্ষক নেটওয়ার্কের উদ্দেশ্য মূলত যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং সচেতনতা তৈরি করা। কোনো পদ-পদবি কখনোই তাদের লক্ষ্য না বলেই আমি মনে করি। সরকার গঠন হলে সেখানে যেতে হবে এ ধরনের কোনো উদ্দেশ্য আমরা যারাই প্রতিবাদ নেমেছি, তাঁদের ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের নিজ যোগ্যতায় সেখানে আছেন। নৈরাজ্যের সময় একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করাটা এত সহজ না। এখন আমরা হয়তো প্রায় দুই সপ্তাহ পর বসে এনালাইসিস করতে পারি, কেমন করলে ভালো হতো। কিন্তু যে সময়টায় এই সরকারটা গঠন করা হয়েছে, তখন পরিস্থিতি খুব স্থিতিশীল ছিল না। বাংলাদেশের জনগণের অনেকটা ম্যান্ডেট বা একধরনের সাপোর্ট নিয়েই তাঁরা এসেছেন। তাঁদের ব্যক্তি হিসেবে বা মানুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা আছে। এরা বাংলাদেশের ভালো চাইবে। সেখানে আরও ভালো হতে পারত, কে থাকতে পারত, কে পারত না, আমার মনে হয়, এ সময় আমরা এ আলোচনা না করে সামনে তাকাই। আমাদের সকলের উদ্দেশ্য হলো, দেশটা ভালো থাকুক। সেটা যদি কোনো মাধ্যমে, কোনোভাবে হয়, তবে তা-ই হোক।
আজকের পত্রিকা: অনেকেই শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন। এ বিষয়টিকে সমর্থন করেন?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: এটা আলোচনাসাপেক্ষ বিষয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে ছাত্ররাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে যেটার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে তা হচ্ছে, অপরাজনীতি, নোংরা রাজনীতি, লেজুরবৃত্তির রাজনীতি। ব্যক্তিগত স্বার্থে, দলের স্বার্থে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে।
আজকের পত্রিকা: নতুন বাংলাদেশকে কীভাবে দেখতে চান?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় একটা দেশ। তবে গত ১৫ বছরে অর্থনৈতিক এবং কাঠামোগত ধ্বংসের সাথে আরও যেটা ধ্বংস হয়েছে সেটা হলো, আমাদের নীতি-নৈতিকতা বোধ। যত ভালো পলিসিই গঠন করা হোক না কেন, একজন নীতি-নৈতিকতা বোধশূন্য মানুষের হাতে যদি দায়িত্ব পড়ে তাকে দিয়ে কোনো পলিসি ইমপ্লিমেন্টেশনও সম্ভব না। সুন্দর বাংলাদেশকে দেখতে চাই, প্রথমত এমন মানুষ দিয়ে যাদের নীতিবোধের জায়গাটা খুব শক্ত। এমন বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে কেউ জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকতে পারবে না।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এত বাধা, শিক্ষাব্যবস্থাটাকে একেবারে ভেঙে দিয়েছে, অনেককে আটকে দেওয়া হয়েছে, সামনে আসতে দেওয়া হয়নি। তারপরেও আমি আশার আলো দেখি। কারণ, এত বাধার পরেও তুখোড় ছেলেমেয়েদের আমরা পেয়েছি। নতুন প্রজন্মের প্রজ্ঞা, তাদের মনন আমাকে অভিভূত করে। এরা যদি একটা সঠিক কাঠামো পেত, এরা একেকজন রাষ্ট্র গঠনে আরও অবদান রাখতে পারত। এদের হাতে এবং এদের মাধ্যমেই আমি বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখি।
আমার মনে হতো, আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম কম। কিন্তু এই আন্দোলনে আমি দেখলাম, শুধু আমরা না, প্রবাসী যারা আছেন, তাঁরাও আন্দোলনে তীব্র ভূমিকা রেখেছেন। দেশের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা আমাকে অভিভূত করেছে। আমাদের অনেক বেশি দায়িত্ববান হতে হবে। প্রবাসীরা রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে যে রেমিট্যান্সটা পাঠায়, সেটার প্রতিদান দেওয়া উচিত। দেশপ্রেমের জায়গা থেকে আমরা সবাই যখন একসঙ্গে দাঁড়াই তখনই অভূতপূর্ব কিছু ঘটে, যেটা হয়েছে এবার। বাংলাদেশের নামটাকে আমরা আরও সমুজ্জ্বল করব—এটাই প্রত্যাশা।
আজকের পত্রিকা: কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আপনি শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সে সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। আপনার এই অবস্থানের কারণ কী ছিল?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: আমি আমার নৈতিকতা বিসর্জন দিতে পারি নাই। আমি একজন শিক্ষক। শিক্ষকের অপর নাম আমরা বলি অভিভাবক। আমার একটা সন্তান রাস্তায় থাকলে আমার যে ভূমিকা হতো, আমার মনে হয়েছে শিক্ষকের ভূমিকা আরও জোরালো হওয়া উচিত। সেই ভাবনা থেকেই আমি দাঁড়িয়েছি। আমি যে বিশেষ কিছু করেছি তা নয়। এটাই কি স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল না? আমাদের শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো ন্যায্য ছিল। কিন্তু তাদের সাথে যে আচরণটা করা হয়েছে, সেটা অন্যায়। এই অন্যায় মেনে নেওয়া উচিত না, মেনে নেওয়া ঠিক না। সেই জায়গা থেকেই শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো।
আজকের পত্রিকা: আপনার বা আপনার পরিবারের রাজনৈতিক মতাদর্শ বা ভাবাদর্শ শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: আমি এটাকে ঠিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বলব না। আমি এটাকে বলব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সেটা আমার পারিবারিক শিক্ষা। আমাদের ঘরের ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে যেকোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পরিবারের বড়দের সাথে আমরা দ্বিমত পোষণ করতে পেরেছি। ছোট থেকে বড়, কারও কোনো কথা বা কাজ ভুল মনে হলে সেটাকে আমরা তার প্রতি সম্মান রেখে ‘না’ বলতে শিখেছি। অন্যায় মানে অবশ্যই ‘না’। বড় থেকে শুরু করে ছোট প্রত্যেকেরই ‘না’ বলবার অধিকার আছে। এটা আমার পারিবারিক শিক্ষা। এটা রাজনৈতিক মতাদর্শ না। আমরা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। অন্ধত্ব, দলকানা, ব্যক্তিকানা, স্বার্থপরতা—এই বিষয়গুলো আমাদের পরিবারে চলে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে না দাঁড়ানোটা যে অনেক বড় পাপ, সেটা আমাদের পরিবারে খুব শক্ত করেই মাথায় গেঁথে দেওয়া হয়েছে। আমরা এটা দেখেই বড় হয়েছি।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলায় কোনো ধরনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন? তৎকালীন সরকার বা প্রশাসন থেকে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: ১৫ বছরের স্বৈরশাসকের কাছ থেকে এটাই কি খুব স্বাভাবিক না? কী রকম বাধা আসতে পারে সেটা সবাই জানে, আগেও জানত। আমার মোবাইল ফোনে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের টেক্সট আসত। সরাসরি বা কারও মাধ্যমে হুমকি দেওয়া, এগুলো তো ওদের চিরাচরিত অভ্যাস। যুগে যুগে এটা স্বৈরাচারের একটা কৌশল। আপনি অন্যায় করবেন, আমি কিছু বলতে পারব না। আপনি চুরি করবেন, ভোট ডাকাতি করবেন, ব্যাংক লুটে নিয়ে চলে যাবেন, কিন্তু আমি কিছু বলতে পারব না। বিগত সরকার যেটা করেছে, লোভ আর ভয়ের এক কৌশল। সমাজে একদল লোককে পদ-পদবির লোভ দেখিয়ে তারা কুক্ষীগত করার চেষ্টা করেছে, আর বাকিদের ভেতর আয়নাঘর, গুম, খুন—এইসব নারকীয় কাজের মাধ্যমে ভয় সৃষ্টি করেছে। এভাবেই স্বৈরাচারেরা সফল হয়। আয়নাঘর, গুম, খুন, ভোট ডাকাতি—এইসব তো প্রকাশ্য দিবালোকে ছিল, সবার কাছে। তা-ও কজন মানুষ ভয় মাড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পেরেছি? প্রতিবাদ করলেই পরিণতি ভয়াবহ, সেটাই তো কার্যত তা দেখিয়েছে! যারাই সরকারের মতের বিরুদ্ধে নেমেছে এযাবৎকালে তাদের জীবনের হুমকি, পরিবারের জন্য হুমকি ছিল। তবে কি জানেন, সবাইকে ভয় দেখানো যায় না, অন্যায়ের সীমালঙ্ঘন হলে সব মানুষকে দাবিয়ে রাখা যায় না, সব মানুষকে পদ-পদবির লোভে কিনে ফেলা যায় না। প্রতিবাদটা যখন ন্যায্য হয়, ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও দশের স্বার্থে হয়, তখন ওই ভয়টাও কাজ করে না।
আজকের পত্রিকা: কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের আন্দোলন—এই ৩৬ দিন কীভাবে কেটেছিল?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: ২৫ মার্চ বা একাত্তরের সময় আমরা যেমন শুনেছি, রাতগুলাও আতঙ্কের, বাসার দরজায় ঠক ঠক করে কড়া নাড়ানো হতো, ভেতরে কে আছে জানতে চাইত—এই আতঙ্কগুলো এবার আমরা যারাই প্রতিবাদ করেছি, তাদের মধ্যে বিরাজ করত; রাতগুলো ছিল বিভীষিকাময়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যখন অন্যায় হচ্ছিল, তখন ক্ষোভে রাগে-ঘুম হতো না। যেদিন থেকে শিক্ষার্থীদের সাথে মাঠে নামলাম, তখন থেকে শুরু হলো আরেক আতঙ্ক। কারণ, হুমকি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের টেক্সট (খুদে বার্তা) আসত। আমাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে, এটা বোঝাতে আমি কখন কোথায় যাচ্ছি, সেসবের ছবি পাঠাত। এসব কারণে একধরনের ভয় হতো। রাতে সে ভয়টা তীব্র হতো। কারণ, আয়নাঘরে ধরে নিয়ে যাওয়া, ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া—এসব তো রাতেই হতো। এমনও হয়েছে, মাঝে মাঝে কিছু রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়েছি, কিন্তু ঘুম হয়নি। তবে সকাল হলেই রাতের আতঙ্কটা কেটে যেত। তখন মনে হতো, জীবন আর মৃত্যু তো আল্লাহ্র নির্ধারণ করেন। আমি বেঁচে থেকেও যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে না পারি, প্রতিবাদ না করতে পারি, সেই বেঁচে থাকা আমার কাছে মূল্যহীন। প্রতিবাদে যখন যেতাম, সমমনা লোকজনেরা যখন পাশে থাকত, তখন সাহস পেতাম।
আন্দোলনের দিনগুলোতে পরের দিন কী হবে তা নিয়ে আমাদের কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। ছাত্রদের সাথে আমার ব্যক্তিগতভাবে কোনো যোগাযোগও ছিল না। প্রতিবাদের জায়গা থেকে বাসায় একাই আসা-যাওয়া করতাম। তখন ভয় হতো। কেমন যেন ঘোরের ভেতর ছিল সেই দিনগুলো। আমাদের জন্য একমাত্র বেঁচে থাকার মুহূর্ত ছিল প্রতিবাদ করার সময়টা।
আজকের পত্রিকা: সরকার পতনের পর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাস্কর্য এবং স্থাপনা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে; লুটপাট হয়েছে। অনেকে নিগৃহীত হয়েছেন। এই বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখেন?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: প্রথম কথা হচ্ছে, নিপীড়নের বিরুদ্ধেই তো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনটা ছিল। তাই যেকোনো ধরনের সহিংসতাই কাম্য নয়। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে, ফ্যাসিজমের শিকারে মানুষের ভেতরে তীব্র ক্ষোভ জন্মেছিল। একের পর এক অন্যায়, সমাজের প্রতিটা স্তরে যে পরিমাণ নৈরাজ্যের শিকার মানুষ হয়েছিল, আপামর জনতার বিগত সরকারের প্রতি একটা তীব্র আক্রোশ তৈরি হয়েছিল! ভাস্কর্যগুলোকে তারা সরকারের রূপক ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ওনার মতো (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) একজন রাজনীতিবিদকে প্রতিনিয়ত একটা পণ্যে পরিণত করেছিল। বঙ্গবন্ধু ভালোমন্দ যা-ই আছে, তা আমরা ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বের করে নিয়ে আসতে পারি। কোনো যুদ্ধ, কোনো আন্দোলন কারও একার কিংবা এক দলের হয় না। আপনি যতই ইতিহাস বিকৃত করেন, ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না। মানুষ বাংলাদেশের সত্যি ইতিহাস জানে। মুক্তিযুদ্ধে কার কী অবদান ছিল, সেটা তো সবাই স্বীকার করে। কিন্তু আপনি যখনই কোনো অবদানকে চর্বিত চর্বন করে ফেলবেন, মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়। ভাস্কর্যগুলো ভাঙার পেছনে মানুষ হিসেবে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আমি বলছি না যে এটা করা ঠিক। কিন্তু আমি বলব, এটা বিগত সরকার এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কর্মফল।
আজকের পত্রিকা: শুধু যে বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের ভাস্কর্য ও স্থাপনা ভাঙা হয়েছে তা কিন্তু নয়, বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য, ময়মনসিংহের শশীলজ, এমনকি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাস্কর্যও ভাঙা হয়েছে। এ বিষয়টাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: অবশ্যই এগুলো কাম্য নয়। যেকোনো চরমপন্থা থেকেই নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। তবে একটা ব্যাপার কি জানেন? এটাও বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের একটা রাজনৈতিক কৌশলের ফল। তারা বাংলাদেশে মানুষের ভেতরে অনেক রকম বিভাজন সৃষ্টি করেছে। ভিন্ন ধর্ম, বর্ণের আর মতের প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণকে বাহবা দিয়েছে। আমি এই দেশে জন্মেছি, এই দেশে বড় হয়েছি, আমরা সবাইকে নিয়েই বড় হয়েছি। কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিষ্টান—এই জিনিসগুলো আমাদের মধ্যে আগে কাজ করত না। এই দেশ তো আমার একার না, সবার। ধর্ম যার যার, দেশটা সবার—এটাই কি আগে ছিল না? বিগত সরকার বিভিন্ন প্রক্রিয়া শুধু যে আমাদের ভেতর বিভাজন সৃষ্টি করেছে তা না, ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণেও উদ্বুদ্ধ করেছে। কিছুদিন পরে দেখবেন, এটাও হয়তো ইতিহাসেও লিপিবদ্ধ হবে, যুগে যুগে মানুষের মাথার মধ্যে কীভাবে বিভেদ, হিংসা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক অপশক্তির কৌশলে। ভিন্নমত হলে, ভিন্ন ধর্ম হলে তাকে নেগেটিভলি দেখতে হবে, তাকে আক্রমণ করতে হবে—এটা মানুষের মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেটারই বহিঃপ্রকাশ ছিল এগুলো। হয়তো ওই মানুষগুলো ১৫ বছর অত্যাচারিত হয়েছে। এখন সুযোগ পেয়ে সে আক্রমণ করেছে। এই ভাঙচুর আমি সমর্থন করি না। কিন্তু ভাঙচুরের পেছনে এটা কারণ বলে মনে করছি। তবে ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন মতের প্রতি মানুষের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ করে ফেলাটা যে স্বৈরশাসকের নোংরা রাজনৈতিক চাল—সেটা কিন্তু এখন মানুষ বুঝতে পেরেছে এবং সেখান থেকে তারা সরে এসেছে। ৫ আগস্টের ওই কয়েকটা অপ্রীতিকর ঘটনার পর দেখেছি কীভাবে মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিষ্টান, সবাই মিলে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে। ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে এক গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী নৈরাজ্য রুখে দিতে কি অপূর্বভাবে দলমত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই বন্যার সময়ও বাংলার মানুষ একসাথে কাজ করছে। এখনকার অবস্থাটা দেখেন, ৫ আগস্টের পর আপামর জনতার সাথে ছাত্র-ছাত্রীরা মিলে একটার পর একটা পরিস্থিতি সামলাচ্ছে। সুন্দর বাংলাদেশের শুরুটা এখানে, আমরা সবাই বাংলাদেশি।
আজকের পত্রিকা: অন্তর্বর্তী সরকারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন প্রতিনিধি রয়েছে। কিন্তু শিক্ষক নেটওয়ার্কের কেউ এই সরকারে নেই। এই বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: আমার মতে, শিক্ষক নেটওয়ার্কের উদ্দেশ্য মূলত যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং সচেতনতা তৈরি করা। কোনো পদ-পদবি কখনোই তাদের লক্ষ্য না বলেই আমি মনে করি। সরকার গঠন হলে সেখানে যেতে হবে এ ধরনের কোনো উদ্দেশ্য আমরা যারাই প্রতিবাদ নেমেছি, তাঁদের ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের নিজ যোগ্যতায় সেখানে আছেন। নৈরাজ্যের সময় একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করাটা এত সহজ না। এখন আমরা হয়তো প্রায় দুই সপ্তাহ পর বসে এনালাইসিস করতে পারি, কেমন করলে ভালো হতো। কিন্তু যে সময়টায় এই সরকারটা গঠন করা হয়েছে, তখন পরিস্থিতি খুব স্থিতিশীল ছিল না। বাংলাদেশের জনগণের অনেকটা ম্যান্ডেট বা একধরনের সাপোর্ট নিয়েই তাঁরা এসেছেন। তাঁদের ব্যক্তি হিসেবে বা মানুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা আছে। এরা বাংলাদেশের ভালো চাইবে। সেখানে আরও ভালো হতে পারত, কে থাকতে পারত, কে পারত না, আমার মনে হয়, এ সময় আমরা এ আলোচনা না করে সামনে তাকাই। আমাদের সকলের উদ্দেশ্য হলো, দেশটা ভালো থাকুক। সেটা যদি কোনো মাধ্যমে, কোনোভাবে হয়, তবে তা-ই হোক।
আজকের পত্রিকা: অনেকেই শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন। এ বিষয়টিকে সমর্থন করেন?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: এটা আলোচনাসাপেক্ষ বিষয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে ছাত্ররাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে যেটার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে তা হচ্ছে, অপরাজনীতি, নোংরা রাজনীতি, লেজুরবৃত্তির রাজনীতি। ব্যক্তিগত স্বার্থে, দলের স্বার্থে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে।
আজকের পত্রিকা: নতুন বাংলাদেশকে কীভাবে দেখতে চান?
অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস: বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় একটা দেশ। তবে গত ১৫ বছরে অর্থনৈতিক এবং কাঠামোগত ধ্বংসের সাথে আরও যেটা ধ্বংস হয়েছে সেটা হলো, আমাদের নীতি-নৈতিকতা বোধ। যত ভালো পলিসিই গঠন করা হোক না কেন, একজন নীতি-নৈতিকতা বোধশূন্য মানুষের হাতে যদি দায়িত্ব পড়ে তাকে দিয়ে কোনো পলিসি ইমপ্লিমেন্টেশনও সম্ভব না। সুন্দর বাংলাদেশকে দেখতে চাই, প্রথমত এমন মানুষ দিয়ে যাদের নীতিবোধের জায়গাটা খুব শক্ত। এমন বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে কেউ জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকতে পারবে না।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এত বাধা, শিক্ষাব্যবস্থাটাকে একেবারে ভেঙে দিয়েছে, অনেককে আটকে দেওয়া হয়েছে, সামনে আসতে দেওয়া হয়নি। তারপরেও আমি আশার আলো দেখি। কারণ, এত বাধার পরেও তুখোড় ছেলেমেয়েদের আমরা পেয়েছি। নতুন প্রজন্মের প্রজ্ঞা, তাদের মনন আমাকে অভিভূত করে। এরা যদি একটা সঠিক কাঠামো পেত, এরা একেকজন রাষ্ট্র গঠনে আরও অবদান রাখতে পারত। এদের হাতে এবং এদের মাধ্যমেই আমি বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখি।
আমার মনে হতো, আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম কম। কিন্তু এই আন্দোলনে আমি দেখলাম, শুধু আমরা না, প্রবাসী যারা আছেন, তাঁরাও আন্দোলনে তীব্র ভূমিকা রেখেছেন। দেশের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা আমাকে অভিভূত করেছে। আমাদের অনেক বেশি দায়িত্ববান হতে হবে। প্রবাসীরা রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে যে রেমিট্যান্সটা পাঠায়, সেটার প্রতিদান দেওয়া উচিত। দেশপ্রেমের জায়গা থেকে আমরা সবাই যখন একসঙ্গে দাঁড়াই তখনই অভূতপূর্ব কিছু ঘটে, যেটা হয়েছে এবার। বাংলাদেশের নামটাকে আমরা আরও সমুজ্জ্বল করব—এটাই প্রত্যাশা।
আলহামদুলিল্লাহ, এখন অনেকটা ভালো। চিকিৎসক ও ফিজিওর পরামর্শে নিয়মিত জিম করছি। থেরাপি নিচ্ছি। মাঠে ফিরতে আর কিছুদিন সময় লাগবে, কিন্তু এ সময়ে ফিটনেস ও শক্তি ধরে রাখতে হালকা অনুশীলন ও জিম করছি।
২ ঘণ্টা আগেইউনিক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত হোসেন। পর্যটনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি মনজুরুল ইসলাম।
০৩ অক্টোবর ২০২৪বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, সুফি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোনো বিভাজনমূলক এজেন্ডায় রাজনীতির দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত না হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা দৃঢ়ভাবে কোনো সাম্প্রদায়িক ফাঁদে আটকা পড়তে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করি। কোনোভাবেই তা হতে দেওয়া যাবে না।
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪একেক মানুষ বেছে নেন একেক পেশা। তাঁদের মধ্যে কারও কারও পেশা একটু ভিন্ন ধরনের। যেমন—মো. মুনসুর আলী ওরফে মন্টু খলিফা। বাপ-দাদার পেশাকে ভালোবেসে শিশুদের খতনা করানো বা হাজামের কাজ বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। জীবনে পার করেছেন প্রায় ৮৫ বছর। জানিয়েছেন গত ৬০ বছরে ২ লাখের বেশি শিশুর মুসলমানি বা সুন্নতে খতনা দিয়
৩০ মার্চ ২০২৪