চঞ্চল মাহমুদ
দাদা, কেমন চলছে?
ইয়াংঙান ম্রো: ভালো, তবে দু-তিন দিন ধরে একটু ঠান্ডা-কাশি।
আচ্ছা! একটু সাবধানে থাকেন কয়েকটা দিন। গরম পানি খেতে থাকেন, ঠিক হয়ে যাবেন, আশা করি…
ইয়াংঙান ম্রো: ধন্যবাদ দাদা…
আলাপটা শুরু করি…
ইয়াংঙান ম্রো: হ্যাঁ। আমার জন্ম রোয়াংছড়িতে। আমার জন্মের তিন বছর পর আমার পরিবার বান্দরবান সদরের টংকাবতী ইউনিয়নের বাইট্যাপাড়া চলে আসে। আমরা অনেক গরিব ছিলাম। জুম চাষ করে কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করতাম। কখনো আমরা পেট ভরে খেতে পারতাম না। খুব অনটনে, খুব অভাবে আমাদের দিন পার হয়েছে।
আপনার বেড়ে ওঠার সময়টা কীভাবে কেটেছে?
ইয়াংঙান ম্রো: আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমরা প্রতি সন্ধ্যায় পাঠশালায় যেতাম। আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের ম্রো গান, গল্প, ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সব সময় উপদেশ দিতেন। সপ্তাহে আমাদের ক্লাস দুদিন বন্ধ থাকত। বৃহস্পতি, আর রোববার। এই দুদিন ছিল আমাদের ক্রামা ধর্মের প্রার্থনার দিন। বিশেষ করে রোববার ছিল আমাদের ক্রামা ধর্মের প্রধান দিন। যারা ক্রামাধর্মাবলম্বী, তারা রোববার কোথাও যেতে পারত না। কারণ, এই দিনে সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় ক্রামাবিহারে গিয়ে প্রার্থনা করতে হয়। অপর দিকে বৃহস্পতিবার ভোরেও বিহারে প্রার্থনা করতে হয়। আমাদের ক্রামা ধর্মের প্রবর্তক মেনলে ম্রো প্রথম ম্রো বর্ণমালা জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিলেন বলে বৃহস্পতিবার ক্রামা লোকদের কাছে অনেক পবিত্র দিন। আর রোববার ছিল মেনলে ম্রোর জন্মের দিন। তাই তাঁর জন্মের দিনকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণের জন্য পবিত্র দিন হিসেবে ধরা হয়।
যা হোক, আমরা যারা ছোট, তারা এই ছুটির দিনে কোথাও না গিয়ে আমাদের গ্রামে যাঁরা বয়স্ক ছিলেন, তাঁদের কাছে যেতাম ম্রো গল্প, ম্রোদের নিয়ম-নীতি আর ভাষা-সংস্কৃতিসহ ম্রো সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস, পূজা-পার্বণের গল্প শুনতে। প্রথম অবস্থায় তাঁরা খুবই আনন্দের সাথে আমাদের এসব বলতেন। কিন্তু একসময় তাঁরা আমাদের জন্য বিরক্ত হয়ে যেতেন। কারণ, সারা দিন জুমচাষের মতো কষ্টের কাজ করার পরও আমাদের জ্বালাতন সহ্য করতে হতো তাঁদের। কিন্তু তারপরও আমরা তাঁদের কাছে যেতাম। বিনিময়ে আমরা কোনো কোনো সময় তাঁদের পাকা চুল তুলতাম। আর কোনো কোনো সময় জঙ্গল থেকে পানপাতা নিয়ে তাঁদের দিতাম এবং গ্রামের সুপারিগাছ থেকে সুপারি নিয়ে তাঁদের দিতাম। এতে তাঁরা খুবই খুশি হতেন। আর তখন তাঁরা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আমাদের গল্প-কাহিনি শেনাতেন। তাঁরা আমাদের বলতেন, এই ম্রো সমাজটাকে তোমাদের রক্ষা করতে হবে। আমরা আর কদিন বাঁচব! তখন তোমরা নিজেদের দায়িত্ব মনে করে এগুলো ধরে রাখতে হবে। তাঁদের কথা আমার খুব ভালো লাগত। তাঁরা যখন এসব বলতেন, তখন তাঁদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকত। আমাদেরও খুব খারাপ লাগত। সব সময় তাঁদের কথা মনে পড়ে।
আপনার একাডেমিক পড়াশোনাটা কীভাবে শুরু হলো? হঠাৎ গ্রাম থেকে বান্দরবান এসে ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি, পোশাক—এ বিষয়গুলোর সঙ্গে নিজেকে কীভাবে মানিয়ে নিলেন?
ইয়াংঙান ম্রো: হ্যাঁ! ঠিকই বলেছেন। আমি ভিন্ন একটা জগতে এসে পড়লাম। কানের দুল, ডং, হাতের চুড়ি, চুল বাঁধার রশি, এগুলো খুলে আমাকে স্কুলড্রেস পরতে হলো। যে জিনিসগুলো খুব যত্ন করে আমার মা-বোনেরা বানিয়ে দিয়েছিল, এখানে তার কোনো মূল্যই নেই। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। নতুন করে প্যান্ট-শার্ট পরতে আমার খুব খারাপ লাগত, অস্বস্তি হতো। সারাক্ষণ সুরসুরি লাগত। মনে হতো নিজেকে অত্যাচার করছি। তাই কোনো কোনো সময় রাতে খালি গায়ে ঘুমাতাম। এদিকে বাংলা-ইংরেজির কিছুই জানি না। সব শিক্ষক অন্য ভাষার। শুধু একজন ম্রো জানতেন, যদিও উনি বাঙালি। উনিও কিছুদিন পর আসলেন না।
আপনি একবার স্কুল থেকে পালিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে গেলেন। এরপর আবার ফিরে আসা। এই আসা-যাওয়ার মাঝের সময়টুকু কীভাবে কাটল?
ইয়াংঙান ম্রো: ফিরে যাওয়াতে মা খুশিই হলেন। তখন আমার বয়স ১৩-১৪। মা আমার জন্য পাত্রী দেখলেন। বিয়ের জন্য দুটি শূকরও কেনা হলো। কিন্তু বাবা কিছুতেই মেনে নিলেন না। বললেন, তোমাকে পড়াশোনাটা করতেই হবে। তখন ভাবতাম, বাবা কত খারাপ (হাসি)। আমার খুব কষ্ট হতো তখন মানসিকভাবে। তবু ফিরতে হলো যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বেতারের একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে আপনি সাংঘাতিক মর্মপীড়ায় ভুগেছেন…
ইয়াংঙান ম্রো: বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে একদিন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে ম্রোদের গান ও গল্প রের্কড করার জন্য আমাকে বললেন। কিন্তু আমার ম্রোদের গল্প, আর গান কোনোটাই জানা ছিল না। ছোটকালে যা কিছু শুনেছিলাম, তার সবকিছুই ভুলে গেলাম। তখন আমার খুবই খারাপ লাগল। অপমানিত বোধ করলাম। আমাদের গ্রামের বয়স্করা আমাদের যে কথাগুলো বলেছিলেন, তখন আমার মনে পড়তে লাগল। তখন নিজেকে একজন অপরাধীর মতো লাগল। কারণ, বয়স্করা আমাদের বলতেন, আমাদের ম্রোদের গল্প, ভাষা, সংস্কৃতি ও জুমভূমি রক্ষা করতে হবে। তোমরা এসব রক্ষা না করলে আমাদের সমাজ থেকে সবকিছুই হারিয়ে যাবে। এসব রক্ষা করা তোমাদের পবিত্র দায়িত্ব, তোমাদের কর্তব্য।
তাঁদের কথা ভেবে আমার খুবই অস্থির লাগত। তাদের কথা ভেবে রাতে আমার ঘুম হতো না। ছটফট করতাম। ছটফট করতে করতে কখন ভোর হয়ে যেত, বুঝতে পারতাম না। আমার প্রতি এত বিশ্বাস, এত আশা করে, এত আদর করে মা-বাবা আর আমাদের গ্রামের বয়স্ক লোকজন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আর এখন আমি কিনা তাঁদের কথা সব ভুলে গেলাম! তা ছাড়া এখন তাঁরা আর কেউ বেঁচে নেই। এসব কথা ভেবে আমার কান্না আসত। আমি তো তাঁদের কথা রাখতে পারলাম না। আর তখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি পেলে বাড়িতে থাকতাম না। দুর্গম এলাকায় গিয়ে থাকতাম। সেখানে গিয়ে ম্রো সমাজের গল্প, ছড়া, ঘুমপাড়ানি গান, পূজা-পার্বণ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানার চেষ্টা করতে থাকলাম। সব সময় আমার কাছে দুটি ডায়েরি থাকত। একটি হলো মানুষের কথা লেখার জন্য, আরেকটি হলো আমি প্রতিদিন কী কী করছি, তা লিখে রাখার জন্য।
কোনো কোনো সময় আমাকে সারা দিন না খেয়ে হাঁটতে হতো। আর কোনো কোনো সময় গাছের নিচে ভাত খেতে হতো। বৃষ্টির দিনে এমন অনেকবার হয়েছিল যে, আমি গাছের নিচে ভাত খেতে গিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। আমাকে বৃষ্টির পানি দিয়ে ভাত খেতে হতো। আর কোনো কোনো সময় রোদের ভেতর হাঁটতে গিয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়তাম। তবুও আমি হাল ছাড়িনি। কারণ, এই কাজগুলো একটা জাতির মধ্যে কাউকে না কাউকে করতেই হয়। আমি যখনই কষ্ট পেতাম, তখনই বয়স্কদের কথা, আমার মা-বাবার কথা মনে পড়ত। কারণ, আমার মা-বাবা আমাকে সব সময় বলতেন, মানুষের উপকার করতে, জাতির জন্য কাজ করতে, দেশের জন্য কাজ করতে। মা-বাবার কথা রাখতে গিয়ে কলেজে পড়ার সময় টাকার অভাবে আমাকে তিন দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছিল। মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় দুর্গম এলাকা থেকে বাস না পেয়ে গভীর রাতে টানা পাঁচ ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছিল। তখন আমার খুবই কষ্ট হতো। কিন্তু মা-বাবার কথা মনে পড়লে মনের দুঃখ-কষ্টগুলো হালকা হয়ে যেত। মা-বাবার কথা রাখতে গিয়ে স্কুলে শীতকালে প্রায় এক মাস কম্বল ছাড়া রাতে ঘুমাতে হয়েছিল। তখন অনেক কষ্ট পেতাম। কিন্তু তখন ভাবতাম, আমাদের গ্রামে আমার বন্ধুদের কথা, যাদের অভাবের জন্য শীতের কাপড় কিনতে না পেরে কাপড় ছাড়া থাকতে হতো। তাদের অনেক কষ্ট হতো। তাদের কষ্টের কথা ভাবতে ভাবতে আমার দুঃখ-কষ্টগুলো হালকা হয়ে যেত।
যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড পিটারসেনের সঙ্গে রেংমিটচ্য ভাষা নিয়েও আপনার কিছু কাজ আছে বলে আমি জানি! এই ভাষাটা জানতে গিয়ে যখন দেখলেন, গোটা কয়েক মানুষ এই ভাষায় কথা বলছেন, তখন আপনার ভেতর কেমন অনুভূতি হয়েছিল। এ ছাড়া প্রায়বিলুপ্ত একটা ভাষাকে রক্ষার জন্য সেই ভাষাভাষী মানুষের প্রতি আপনার কী পরামর্শ?
ইয়াংঙান ম্রো: আমি ২০১৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রফেসর ডেভিড এ কে পিটারসনের সাথে রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কাজ করছি। রেংমিটচ্য ভাষায় কাজ করতে গিয়ে আমি অনেক শিক্ষা পেলাম। তাদের ভাষার মতো আমাদের ভাষাও পরবর্তী সময়ে হারিয়ে যেতে পারে—এটা আমার মধ্যে সব সময় কাজ করতে থাকে। কারণ, আজ যারা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে, তারাও অনেকে ম্রো ভাষাটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। মানুষের সামনে ‘ম্রো ভাষা ভুলে গেছে’ বলতে পারাকে তারা গর্ব বলে ভাবতে থাকে। অথচ মাতৃভাষার মতো গুরুত্ব, আর কোনো কিছুতেই থাকতে পারে না। হয়তো এই কথা তারা জানে না।
এই রেংমিটচ্য ভাষায় এখন মাত্র ছয়জন কথা বলতে পারেন। ছয়জন লোক মারা গেলে রেংমিটচ্য ভাষা আর থাকবে না। আর একটা ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে তার জাতি (পরিচয়) হারিয়ে যাওয়া। আমরা যখন রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম, তখন আমরা তাঁদের সংখ্যা পেয়েছিলাম ২২ জনের মতো। তবে তাঁরা বলতেন, রেংমিটচ্য ভাষা বলতে পারা লোকের সংখ্যা প্রায় ৩২ জন। যারা রেংমিটচ্য ভাষা পুরোপুরি বলতে পারে। কিন্তু তাঁরা দুর্গম এলাকায় থাকে বলে আমরাও সবার সাথে দেখা করতে পারলাম না। ডেভিড আমাকে অনেকবার রেংমিটচ্য ভাষার লোকদের খুঁজতে পাঠিয়েছিলেন। পরে আমরা তাঁদের নিয়ে রেংমিটচ্য ভাষা কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করলাম। তাঁদের কাজ হবে, রেংমিটচ্য ভাষার যেসব লোক আছে, তাদের সাথে দেখা করে যারা রেংমিটচ্য ভাষা বলতে পারে না, তাদের শেখানো। মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক বলতাম। কিন্তু তারা রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কথা বলতে চাইত না।
কারণ, তাদের ভাষায় কতগুলো শব্দ আছে, যা অন্য ভাষার লোকদের কাছে শুনতে খারাপ লাগে। তখন অন্য ভাষার লোকজন তাদের কথায় হাসতে থাকে। তখন থেকে তাঁরা নিজেদের রেংমিটচ্য ভাষা বলতে লজ্জাবোধ করতেন। তাই শুধু বাইরে থেকে বললে হবে না, মাতৃভাষাটাকে টিকিয়ে রাখতে ওই ভাষার লোকদের পাশাপাশি রাষ্ট্রের এবং সরকারের অনেক দায়িত্ব আছে বলে আমি মনে করি। আবার শুধু সরকার বা রাষ্ট্রের মাধ্যমেও কাজ হবে না। ওই ভাষার লোকদেরও নিজেদের ভাষাকে টিকে রাখতে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।
একটি ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে যেমন ভাষাভাষীর গুরুত্ব রয়েছে, ঠিক তেমনি বর্ণমালাও অনেক জরুরি। আর সেই বর্ণমালা দিয়ে তাদের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হবে। তাদের নিজেদের ভাষা শেখার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের জন্য ডিকশনারি করতে হবে। কারণ, নিজেদের বর্ণমালা দিয়ে যা কিছু লিখতে পারব, তা হয়তো অন্য বর্ণমালা দিয়ে লেখা যাবে না। আমি একটি উদাহরণ দিয়ে বলি যে ম্রো বর্ণমালায় আমরা যা কিছু লিখতে পারি, তা বাংলা বা ইংরেজি দিয়ে লিখতে পারব না। আমি ম্রো ভাষা দিয়ে যে ভাব প্রকাশ করতে পারব, তা বাংলা বা ইংরেজি দিয়ে প্রকাশ করতে পারব না। ম্রো ভাষা দিয়ে আমি যা অতি সহজে বিশ্লেষণ করতে পারব, তা বাংলা বা ইংরেজি দিয়ে করতে পারব না। আমরা সব মাতৃভাষাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করি। তাই তো প্রায়বিলুপ্ত রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কাজ করেছি। তাই একেকটি জাতির জন্য তার মাতৃভাষা অত্যন্ত গুরুত্ব একটি উপাদান।
নিজের মাতৃভাষা যেখানে উপেক্ষিত, সেখানে দেশপ্রেম শব্দটা আপনাকে কীভাবে আলোড়িত করে?
ইয়াংঙান ম্রো: এটাও সত্য যে কে কীভাবে আমাদের মাতৃভাষাকে দেখছে, তা আমি বলতে পারব না। আমি জানি, শুধু আমার মাতৃভাষাকে আমি খুবই ভালোবাসি। আমার কাছে আমার মাতৃভাষা সেরা ভাষা। এই ভাষা আমার কাছে খুবই পবিত্র। কারণ, এই ভাষায় আমার মা-বাবা আর আমাদের পূর্বপুরুষেরা কথা বলতেন।
একটা মজার কথা বলি, আমি যখন স্কুলে ভর্তি হলাম, তখন প্রথম দিন থেকেই একটা গান গাইতে হতো। পরে বুঝলাম এটা জাতীয় সংগীত। প্রথম প্রথম আয়ত্ত করতে না পারলেও পরে এটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। গ্রামে গিয়ে এই গান গাইলে অন্য বন্ধুরা তিরস্কার করে বলত, ‘তোমরা তো বাঙালি হয়ে গেছ, তোমাদের সাথে কথা বলা যাবে না।’
আপনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ম্রো ভাষায় অনুবাদ করেছেন…
ইয়াংঙান ম্রো: আমার মা-বাবা আর আমাদের গ্রামের বয়স্ক যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কোনো কোনো সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপান আর ব্রিটিশদের মধ্যকার যুদ্ধের কাহিনি শোনাতেন। তাঁরা আমাদের আরও শোনাতেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর পরিবারের করুণ কাহিনি। তখন আমরা অধীর আগ্রহ নিয়ে তাঁদের কথা শুনতাম। মাঝে মাঝে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁদের কাছে আমরা এসব কাহিনি শুনতাম। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাংলা থেকে ম্রো ভাষায় অনুবাদ করেছি। ম্রো ভাষায় যারা বাংলা পড়তে পারে না, তারাও তা জানতে পারবে। যদিও এখনো তা প্রকাশ করতে পারিনি। তবে ভবিষ্যতে প্রকাশ করার প্রবল আগ্রহ আছে।
ম্রো ভাষার প্রথম প্রকাশিত লেখক আপনি। ম্রো বর্ণমালা, ম্রো ধর্মগ্রন্থকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন এবং ম্রো ভাষার প্রথম ব্যাকরণটাও আপনি প্রকাশ করলেন। একটা জাতিগোষ্ঠীর জন্য এই মহৎ কাজগুলো করতে পেরে আপনার অনুভূতি কেমন?
ইয়াংঙান ম্রো: এটাকে মোটেও মহান কাজ বলতে রাজি না আমি। ভালোবাসার তাড়না থেকে, মা-বাবার স্বপ্ন থেকে, আমাদের গ্রামের বয়স্ক যারা ছিলেন, তাদের কথা রাখতে গিয়ে আমি এখনো মাতৃভাষায় বই লিখে যাচ্ছি। ম্রো রূপকথার গল্প, ম্রো পূজা-পার্বণ ও ম্রো সমাজ নিয়ে লেখালেখি করছি। ইতিমধ্যে আমার লেখা ১৮টি বই ম্রো ভাষায় এবং ১০টি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় লেখা বইগুলোর বেশির ভাগই অমর একুশে বইমেলায় স্থান পেয়েছিল। আমার আরও অনেক বই অপ্রকাশিত রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে ম্রো সমাজ, সংস্কৃতি, ক্রামাদি লেখার অনুবাদ, জুমচাষ, ম্রো সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার-বিশ্বাস, রূপকথার গল্প, ম্রো কবিতা-উপন্যাসসহ আরও অনেক।
আপনার গবেষণা ও লেখালেখিকে ম্রো সমাজ কীভাবে গ্রহণ করেছে?
ইয়াংঙান ম্রো: ম্রো ভাষায় লেখা আমার অনেক বই আমাদের গ্রামের মানুষ পড়ছে। দুর্গম এলাকার মানুষের সাথে যখন দেখা হয়, তখন তারা আমাকে বলে, আমার বই তারা পড়ছে। তখন আমার মাঝে যে তৃপ্তি আসে, তা অন্য কোনো কিছু দিয়ে তুলনা করা যাবে না। তবে কিছু কটু কথা আমাকেও শুনতে হয়েছে, এটা আমাদের সমাজের আলাদা কিছু না। সব সমাজেই কাজ করতে গেলে বাধা পার হয়েই আসতে হয়।
ম্রো ভাষার অবিকাশমান অবস্থা নিয়ে আপনার ভেতর যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, সেটা আমি টের পাই। তবে একটা কথা জানতে ইচ্ছা করছে, নিজের মাতৃভাষাকে বিকাশের চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ম্রো সংস্কৃতির ভূমিকা কী হতে পারে?
ইয়াংঙান ম্রো: এখানেও একটি কথা বলতে চাই যে আমরা শুধু বই লিখে বা বই প্রকাশ করে আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে পারব না। এই ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের সাথে সাথে সরকার ও রাষ্ট্রের অনেক ভূমিকা থাকে। সেটা হতে পারে মাতৃভাষায় বইপুস্তকের ব্যবস্থা, মাতৃভাষার শিক্ষক নিয়োগ, গ্রামে গ্রামে তাদের মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে প্রচার করা। এই প্রচার হতে পারে ব্যানার/সাইনবোর্ডের মাধ্যমে, হতে পারে তাদের শিক্ষিত লোকজনের মাধ্যমে, হতে পারে কর্মশালার মাধ্যমে। এগুলোর মাধ্যমে আমার মনে হয়, কিছুটা হলেও বিপন্ন ভাষাগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
ম্রো ভাষায় কোনো বর্ণমালা ছিল না। মহান মেনলে ম্রো একটি ভাষার মানুষের জন্য বর্ণমালা, ধর্মগ্রন্থ থেকে শুরু করে গান-কবিতাসহ অনেক কিছুই দিয়ে গেলেন। একটি জাতির জন্য সবকিছু দিয়ে ‘আবার আসব’ বলে তিনি হারিয়ে গেলেন। ম্রোরা এখনো মনে করেন, শুভ্রসাজে একটি সাদা ঘোড়ায় চেপে মেনলে ম্রো ফিরে আসবেন। মেনলে ম্রোর প্রত্যাবর্তন নিয়ে আপনার চিন্তার জায়গাটা কেমন?
ইয়াংঙান ম্রো: ম্রো বর্ণমালা বলতে গেলে ক্রামা ধর্মের কাহিনিও চলে আসে। কারণ, এই ক্রামা ধর্মের সাথে ম্রো বর্ণমালার কাহিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রথমে এই ম্রো বর্ণমালাকে বলা হতো ক্রামা বর্ণমালা। কিন্তু তখন একটা সমস্যা দেখা দিত। যারা ক্রামা ধর্মের লোক না, তারা এই বর্ণমালা পড়তে চাইত না। তাই পরে এই ক্রামা বর্ণমালাকে ম্রো বর্ণমালা নামে ডাকা হয়। আর তখন থেকে ক্রামা ধর্মের বাইরে লোকেরাও পড়তে থাকে। এখন এই বর্ণমালা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তবে অনেকে এই ক্রামা বর্ণমালা বা ম্রো বর্ণমালা কী করে আসছে, তা জানত না। তাই সংক্ষেপে এই বর্ণমালা আবিষ্কারের কাহিনি তুলে ধরছি—
১৯৮০ সালে বান্দরবান জেলার সুয়ালক ইউনিয়নে প্রথম ম্রো আবাসিক উচ্চবিদ্যালয় চালু হয়। প্রথমে সেখানে ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হয়। সেখানে শুধু ম্রো ও খুমী জনগোষ্ঠী লেখাপড়া করত। তখন সেখানে ছাত্র-ছাত্রী না পাওয়ায় গ্রামে গ্রামে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহ করতে হতো। ম্রো সমাজ তখনকার দিনে যে বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিল, তা হলো ছেলেধরার ভয়। অনেকে প্রচার করতেন যে স্কুলে ভর্তি করার নামে তাদের ছেলেমেয়েকে ছেলেধরার হাতে বিক্রি করে দেবে। তাই তখন কোনো ম্রো অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে রাজি হতেন না।
একদিন পোড়াপাড়া, অর্থাৎ বর্তমান ক্রামাদিপাড়ার মেনসিং ম্রোর বড় ছেলে মেনলে ম্রোকেও ম্রো আবাসিক উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। প্রথমে তাঁর মা-বাবা রাজি হলেন না আদরের ছেলে মেনলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে। তাঁদের মনে শঙ্কা, না জানি স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে ছেলেধরার হাতে বিক্রি করে দেয় কি না। তবু তাঁরা মেনলেকে স্কুলে ভর্তি করেন। মেনলে স্কুলে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করতেন। একদিন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, স্কুলের পাশে থাকা অশ্বথগাছে গিয়ে ধ্যান করবেন। যেই ভাবা, সেই কাজ। শুরু করলেন ধ্যান। দু-এক দিন নয়, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধ্যান করতে লাগলেন।
একদিন এক সাদা পোশাক পরা লোকের সাথে তাঁর দেখা হলো। লোকটি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী জন্য ধ্যান করছেন। মেনলে তখন বললেন, ম্রোদের নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই, নেই কোনো ধর্ম। তাই আমি ম্রোদের জন্য নিজস্ব বর্ণমালা ও ধর্ম চাই। তখন লোকটি মেনলেকে একটি বই দিলেন। বললেন, এই বর্ণমলা তোমরা পড়ে নেবে। মেনলে বই খুলে দেখলেন। কিন্তু সেটা অনেক কঠিন। তাই তিনি বইটি নিতে পারলেন না। এর চেয়ে সহজ বর্ণমালা চাইলেন। সাদা পোশাক পরা লোকটি পরে দেবেন বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মেনলেও ভোর হয়ে যাওয়ায় স্কুলে চলে গেলেন। পরদিন তিনি আবারও ধ্যানের জন্য অশ্বথগাছের নিচে গেলেন। সে রাতেও সাদা পোশাক পরা লোকটি উপস্থিত হয়ে তাঁকে একটি বই দিলেন। মেনলে দেখলেন এসব বর্ণমালাও অনেক কঠিন। তাই তিনি আবারও অপারগতা প্রকাশ করলেন। লোকটি পরের রাতে নিয়ে আসবেন বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মেনলেও ভোর হওয়ায় স্কুলে গেলেন। পরেরবার মেনলে আবারও ধ্যান করতে গেলে সাদা পোশাকের লোকটি আবারও চলে আসলেন। এবার তিনি বললেন এর চেয়ে সহজ বর্ণমালার বই আর কোথাও নেই। তাই এই বই মেনলেকে নিতে হবে। মেনলে দেখলেন, এই বর্ণমালার বইটি আগের দুটির চেয়ে অনেক সহজ। তাই তিনি সেটি নিলেন। তাই ম্রো বর্ণমালা এখনো তিনটি। নাম ইয়ুকলুং, থানা ও চাইয়াং।
সাধারণত চাইয়াং দিয়ে বইপুস্তক লেখা হয়। কারণ, বাকি দুটি অনেক কঠিন। পরে সাদা পোশাক পরা লোকটি মেনলেকে বললেন, ক্রামা নামে একটি ধর্ম পৃথিবীতে প্রচার করতে। তখন থেকে মেনলে একা একা লুকিয়ে লুকিয়ে ক্রামা বর্ণমালা পড়তে থাকেন। একসময় তিনি মানুষের মাঝে ক্রামা ধর্ম ও বর্ণমালা প্রচার করার জন্য স্কুল থেকে চলে গেলেন। তিনি মন দিলেন ক্রামা ধর্ম ও বর্ণমালা প্রচারে। নতুন কমিটি গঠন করলেন। পরে তাঁর প্রধান শিষ্য তৈরি করে নিলেন। পারাও ম্রোকে তাঁর প্রধান শিষ্য এবং লেংয়াং ম্রো ও সিংলক ম্রোকে তাঁর অন্যতম শিষ্য বানালেন। ম্রো ভাষা ও বর্ণমালার প্রধান করলেন রেংসং ম্রোকে।
এ ছাড়া গ্রামে গ্রামে ছয়জন করে সদস্য বানালেন। তাঁদের ডাকা হয় অরিত্বরাউপ নামে। ক্রামা ধর্মের উপদেশ, গান এবং ধর্মীয় রীতিনীতি মানুষকে বোঝানো, অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা করা এবং বিচার-সালিসের কাজ করতে হবে অরিত্বরাউপদের। তখন থেকে মেনলে উপাধি পেয়ে পেলেন ক্রামাদি নামে। ক্রামা ধর্মের প্রবর্তক বলে তিনি ক্রামাদি উপাধি পেলেন। ক্রামাদি বৃস্পতিবার প্রথম ম্রো বর্ণমালা মানুষের সামনে প্রকাশ করেছিলেন বলে ক্রামা ধর্মাবলম্বীদের কাছে বৃস্পতিবার খুবই পবিত্র দিন। পরে ক্রামাদি প্রচার করে বেড়াতেন, ম্রো বিয়ের সময় যে ১১০টি রুপার টাকা দিতে হয়, তা কমিয়ে ৫০টি করার জন্য। আর বিয়ের সময় যে বল্লম দেওয়ার বিধান, সেটি বন্ধ করে দিতে। কারণ, এগুলো এখন পেলেও ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে না।
ক্রামা ধর্মের আগে ম্রো সমাজে একটি রীতি প্রচলিত ছিল। মৃত ব্যক্তিকে তিন-চার দিন, এমনকি সপ্তাহখানেক রাখার রেওয়াজ ছিল। এতে মানুষ দুর্গন্ধে অনেক কষ্ট পেত। পরে ক্রামাদি বলেন, এসব বন্ধ করতে হবে। কারণ, মৃত ব্যক্তি আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। বরং বেশি দিন রাখলে মানুষ কষ্ট পায়। তখন তাঁর আত্মা মানুষকে দুর্গন্ধে কষ্ট দেওয়ার পাপে স্বর্গে যেতে পারে না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তা সৎকার করতে হবে। তিনি বলতেন, গো-হত্যা বন্ধ করতে হবে। কারণ, সারা রাত গরুকে কষ্ট দিয়ে ভোরে মেরে ফেলা হয়, তা তিনি মেনে নিতে পারতেন না। আর গো-হত্যা বাদ দেওয়ার সাথে সমাজে মদ পানও অনেক কমে যেতে থাকে। কারণ, ক্রামা ধর্মে পুরোপুরিভাবেই মদ পান নিষেধ ছিল। যারা মদ পান করবে, তারা ক্রামা মন্দিরে ঢুকতে পারবে না।
যদিও অনেকে পরবর্তী সময়ে প্রচার করেন যে ক্রামা ধর্মের জন্য ম্রো সমাজে প্লং বা বাঁশি হারিয়ে যায়। তবে এই কথা মোটেই সত্য নয়। তিনি শুধুমাত্র গো-হত্যা নিষেধ করেছিলেন। তিনি নিষেধ করেছেন মদ পান করা। মদ পানের ফলে সমাজে ঝগড়া হতো, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো। একজন সমাজ সংস্কারক কোনো দিনও ম্রোদের পরিচয় বহনকারী চিহ্ন প্লুং বা বাঁশি ব্যবহার নিষেধ করতে পারবেন না। তিনি বলতেন, আগেকার ম্রোরা গরুর মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া বর্ণমালা এখন আবার ফিরে পেয়েছে। এত দিন বর্ণমালা খেয়েছে বলে গরুকে গো-হত্যার মাধ্যমে কষ্ট দিয়ে শেষে মেরে ফেলেছে। এখন ম্রোরা আবারও বর্ণমালা পেয়েছে। তাই গো-হত্যা উৎসবের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার দরকার হবে না।
ক্রামাদি ম্রো সমাজ, সংস্কৃতি আর ভাষা নিয়ে অনেক চিন্তিত ছিলেন। আর তা তাঁর কথাবার্তা আর উপদেশ থেকে জানা যায়। তাঁর নিরুদ্দেশের আগে তিনি বলে গেলেন, নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষা রক্ষা করতে হবে। তিনি বলতেন, সব সময় চুল লম্বা রাখতে, নিজেদের পুঁতির মালা পরে রাখতে। এতে ম্রোরা যে আলাদা জাতি, তা সহজে মানুষ চিনতে পারবে। নিরুদ্দেশ থেকে কঠোর ধ্যান করার পর তিনি যখন ফিরে আসবেন সাদা ঘোড়ার পিঠে করে, তখন তিনি লম্বা চুল থাকা এবং নিজেদের পোশাক পরা লোক ও নিজেদের ভাষায় কথা বলা লোকদের সাথে আগে সাক্ষাৎ করবেন। তাঁর কথা রাখতে গিয়ে আজও ম্রো সামজে অনেক লোক চুল লম্বা রাখেন, নিজেদের পোশাক পরে থাকেন, নিজেদের ভাষা রক্ষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য প্রাণপণ কাজ করে চলেছেন।
তিনি যদি তখন বলতেন যে তিনি আর ফিরে আসবেন না, তবে আজকের ম্রো সমাজে চুল লম্বা রাখা পুরুষ, নিজেদের পোশাক পরা লোক আর নিজেদের বর্ণমালা পড়া লোক থাকত কি না, সন্দেহ রয়েছে। তিনি আরেকটি কথা বলতেন, তিনি ফিরে এসে ম্রো বর্ণমালাকে আরও উন্নত করবেন। তিনি যদি ফিরে আসার কথা না বলতেন, তাহলে যারা ক্রামা ধর্মের অনুসারী, তাঁরা আজ ক্রামাবিহারে গিয়ে প্রার্থনা করতেন কি না, জানি না। কারণ, অনেকে কিন্তু তাঁর ফিরে আসার সময় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য এখনো মনে মনে অপেক্ষা করেন। আর তাই সম্ভব বিহারে গিয়ে নিজের মনটাকে পবিত্র করা। কারণ, অপবিত্র মন দিয়ে ক্রামাদির সাথে সাক্ষাৎ করা যাবে না। তাই আজও নিজেদের মনকে পবিত্র করার জন্য লোকেরা বিহারে যান।
ক্রামাদি ফিরে আসার সময় যাতে তাঁর সাথে দেখা করতে পারে, সে জন্য এখনো চুল লম্বা রাখে পুরুষেরা; নিজেদের বর্ণমালা শিখতে থাকে। তবে আমার যা মনে হয়, তিনি আর কোনো দিনও ফিরে আসবেন না। তিনি সেদিন ফিরে আসার কথা এ জন্য বলেছিলেন, যাতে তাঁর কথা রাখতে গিয়ে নিজেদের সমাজ-সংস্কৃতি আর ভাষাকে সবাই ধরে রাখে। তিনি যদি সেবার ফিরে না আসার কথা বলতেন, তাহলে কিসের আশায় এখনো ক্রামা ধর্ম, আর বর্ণমালা টিকে থাকবে, কিসের আশায় ম্রো বর্ণমালায় তারা লেখাপড়া করবে। কিসের আশায় তারা ম্রো সমাজ-সংস্কৃতি ধরে রাখবে। তিনি আরও বলেছেন, ‘বই দেখলে আমাকে দেখতে পাবে, গাছ দেখলে আমাকে দেখতে পাবে।’ তার মানে, তাঁর লেখাগুলো দেখলে তাঁকে দেখা হচ্ছে। কারণ, তিনি সব সময় আমাদের সাথে আছেন। অর্থাৎ তাঁর লেখা, তাঁর উপদেশ সব সময় আমাদের মাঝে রয়েছে। তাই ক্রামাদি শুধু একজন ধর্ম প্রবর্তক বা একজন বর্ণমালা প্রবর্তক ছিলেন না, তিনি একজন সমাজ সংস্কারকও ছিলেন। একজন ভালো বক্তাও ছিলেন তিনি। এখনো আমাদের কাছে তাঁর উপদেশবাণী আছে। আমার ইচ্ছা—উপদেশবাণীগুলো পরে বাংলায় অনুবাদ করে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। তিনি ম্রো সমাজ, ম্রো বর্ণমালা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করতেন। এগুলো নিয়ে তিনি অনেক আশঙ্কা-উৎকণ্ঠায় ছিলেন।
ইয়াংঙান ম্রোর প্রকাশিত বইগুলো:
ম্রো ভাষায় প্রকাশিত বই:
১। মাইতং (আগুনের মর্শাল)
২। প্রেনপক সাংচিয়া (পৃথিবী উৎপত্তির কাহিনি)
৩। আরোং আনৈই (আলোকিত)
৪। রিইয়ুং খতি (ক্রামাদির লেখা সংকলন)
৫। বাংলা সাং (বাংলা ভাষা শিক্ষা)
৬। ম্রোচ্য সাংচিয়া (ম্রো গল্প)
৭। ঙেওয়া সাং মোয়া (শিশুদের শিক্ষার জন্য)
৮। ইংরিজি সাং (ইংরেজি ভাষা শিক্ষা)
৯। ঙিয়াচ্য সাং (বাল্য শিক্ষা)
১০। ঙিয়াচ্য সাং-২ (বাল্য শিক্ষা-২)
১১। রিইয়ুংখতি-২ (ক্রামা ধর্মগ্রন্থ-২)
১২। হয়লাই (ক্রামাদির উপদেশবাণী)
১৩। সাংচার খতি (ম্রো লেখা)
১৪। খতি অরি (ক্রামাদির লেখা সংকলন)
১৫। সাংলুং সাং (ম্রো লেখা)
১৬। রাঅং সাংচিয়া (রাঅং কাহিনি)
১৭। রোয়া সাং (গণিত শিক্ষা)
১৮। ম্রোচ্য ততোং (ম্রো ব্যাকরণ)
বাংলা ভাষায় লেখা বই:
১। ক্রামাদি-প্রকাশকাল, ২০১৫, অনঘ প্রকাশনী, অমর একুশে বইমেলা।
২। ম্রো রূপকথা, প্রকাশকাল-২০১৯, বিদ্যানন্দ প্রকাশনী-অমর একুশে বইমেলা।
৩। ম্রো রূপকথা-২, প্রকাশকাল-২০২০, বিদ্যানন্দ প্রকাশনী, অমর একুশে বইমেলা।
৪। জুম পাহাড়ের মানুষ (উপন্যাস), প্রকাশকাল-২০২০, আগামী প্রকাশনী, অমর একুশে বইমেলা।
৫। ক্রামা ধর্মের উৎপত্তি ও ম্রো সমাজ, প্রকাশ-২০২০, পূর্বস্বর প্রকাশনী, চট্টগ্রাম বইমেলা।
৬। ম্রো ডিকশনারি, প্রকাশকাল-২০১৯, বান্দরবান।
৭। ম্রো ১০১ জীবনী, প্রকাশকাল-২০২০, বান্দরবান।
৮। ম্রো গল্পসমূহ, প্রকাশকাল-২০১৯, বান্দরবান।
৯। ম্রো লোকগল্প, প্রকাশকাল-২০২১, আপন আলো প্রকাশনী, চট্টগ্রাম।
১০। জুম পাহাড়ের জীবন, প্রকাশকাল-২০২২, তিউরি প্রকাশনী, অমর একুশে বইমেলা।
অপ্রকাশিত বই:
১। শ্মশান লোকদের কান্না (উপন্যাস)
২। নীড়হারা পাখি (উপন্যাস)
৩। রক্তপিপাসু (উপন্যাস)
৪। আদরের সন্তান (উপন্যাস)
৫। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ (ম্রো ভাষায়)
৬। ম্রো রূপকথা-৫
৭। বেদনার মহাকাব্য (আত্মজীবনী)
৮। মা-বাবার স্বপ্ন (আত্মজীবনী)
৯। সিনপ্রেন সাংচিয়া (ম্রো লেখা)
১০। থুরাই চপা লাইমাক (ম্রো লেখা)
১১। ক্রামা ধর্মের আসার আগে ও পরে ম্রো সমাজের অবস্থা
১২। ম্রোচ্য মেং-২ (ম্রো লেখা)
১৩। কিইয়ক তাইন সো (ম্রো ভাষার গান)
১৪। ফুংপ্রেম সাংচিয়া (ম্রো লেখা)
১৫। ছবিসহ শিশুদের ম্রো শিক্ষা (ম্রো ভাষা)
১৬। গুপ্তধন (ছোট গল্প)
১৭। হারানোর গ্রাম (ছোট গল্প)
১৮। ম্রো সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার বিশ্বাস ও পূজা-পার্বণ
১৯। সিং চ্যক লং ওয়ান (কৃষিবিষয়ক, ম্রো ভাষা)
২০। রোয়া লং ওয়ান, (সাপ সম্পর্কে, ম্রো ভাষা)
২১। তানত্য লাইমাক (ম্রো লেখা) ইত্যাদি ছাড়া আরও অনেক আছে।
দাদা, কেমন চলছে?
ইয়াংঙান ম্রো: ভালো, তবে দু-তিন দিন ধরে একটু ঠান্ডা-কাশি।
আচ্ছা! একটু সাবধানে থাকেন কয়েকটা দিন। গরম পানি খেতে থাকেন, ঠিক হয়ে যাবেন, আশা করি…
ইয়াংঙান ম্রো: ধন্যবাদ দাদা…
আলাপটা শুরু করি…
ইয়াংঙান ম্রো: হ্যাঁ। আমার জন্ম রোয়াংছড়িতে। আমার জন্মের তিন বছর পর আমার পরিবার বান্দরবান সদরের টংকাবতী ইউনিয়নের বাইট্যাপাড়া চলে আসে। আমরা অনেক গরিব ছিলাম। জুম চাষ করে কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করতাম। কখনো আমরা পেট ভরে খেতে পারতাম না। খুব অনটনে, খুব অভাবে আমাদের দিন পার হয়েছে।
আপনার বেড়ে ওঠার সময়টা কীভাবে কেটেছে?
ইয়াংঙান ম্রো: আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমরা প্রতি সন্ধ্যায় পাঠশালায় যেতাম। আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের ম্রো গান, গল্প, ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সব সময় উপদেশ দিতেন। সপ্তাহে আমাদের ক্লাস দুদিন বন্ধ থাকত। বৃহস্পতি, আর রোববার। এই দুদিন ছিল আমাদের ক্রামা ধর্মের প্রার্থনার দিন। বিশেষ করে রোববার ছিল আমাদের ক্রামা ধর্মের প্রধান দিন। যারা ক্রামাধর্মাবলম্বী, তারা রোববার কোথাও যেতে পারত না। কারণ, এই দিনে সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় ক্রামাবিহারে গিয়ে প্রার্থনা করতে হয়। অপর দিকে বৃহস্পতিবার ভোরেও বিহারে প্রার্থনা করতে হয়। আমাদের ক্রামা ধর্মের প্রবর্তক মেনলে ম্রো প্রথম ম্রো বর্ণমালা জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিলেন বলে বৃহস্পতিবার ক্রামা লোকদের কাছে অনেক পবিত্র দিন। আর রোববার ছিল মেনলে ম্রোর জন্মের দিন। তাই তাঁর জন্মের দিনকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণের জন্য পবিত্র দিন হিসেবে ধরা হয়।
যা হোক, আমরা যারা ছোট, তারা এই ছুটির দিনে কোথাও না গিয়ে আমাদের গ্রামে যাঁরা বয়স্ক ছিলেন, তাঁদের কাছে যেতাম ম্রো গল্প, ম্রোদের নিয়ম-নীতি আর ভাষা-সংস্কৃতিসহ ম্রো সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস, পূজা-পার্বণের গল্প শুনতে। প্রথম অবস্থায় তাঁরা খুবই আনন্দের সাথে আমাদের এসব বলতেন। কিন্তু একসময় তাঁরা আমাদের জন্য বিরক্ত হয়ে যেতেন। কারণ, সারা দিন জুমচাষের মতো কষ্টের কাজ করার পরও আমাদের জ্বালাতন সহ্য করতে হতো তাঁদের। কিন্তু তারপরও আমরা তাঁদের কাছে যেতাম। বিনিময়ে আমরা কোনো কোনো সময় তাঁদের পাকা চুল তুলতাম। আর কোনো কোনো সময় জঙ্গল থেকে পানপাতা নিয়ে তাঁদের দিতাম এবং গ্রামের সুপারিগাছ থেকে সুপারি নিয়ে তাঁদের দিতাম। এতে তাঁরা খুবই খুশি হতেন। আর তখন তাঁরা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আমাদের গল্প-কাহিনি শেনাতেন। তাঁরা আমাদের বলতেন, এই ম্রো সমাজটাকে তোমাদের রক্ষা করতে হবে। আমরা আর কদিন বাঁচব! তখন তোমরা নিজেদের দায়িত্ব মনে করে এগুলো ধরে রাখতে হবে। তাঁদের কথা আমার খুব ভালো লাগত। তাঁরা যখন এসব বলতেন, তখন তাঁদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকত। আমাদেরও খুব খারাপ লাগত। সব সময় তাঁদের কথা মনে পড়ে।
আপনার একাডেমিক পড়াশোনাটা কীভাবে শুরু হলো? হঠাৎ গ্রাম থেকে বান্দরবান এসে ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি, পোশাক—এ বিষয়গুলোর সঙ্গে নিজেকে কীভাবে মানিয়ে নিলেন?
ইয়াংঙান ম্রো: হ্যাঁ! ঠিকই বলেছেন। আমি ভিন্ন একটা জগতে এসে পড়লাম। কানের দুল, ডং, হাতের চুড়ি, চুল বাঁধার রশি, এগুলো খুলে আমাকে স্কুলড্রেস পরতে হলো। যে জিনিসগুলো খুব যত্ন করে আমার মা-বোনেরা বানিয়ে দিয়েছিল, এখানে তার কোনো মূল্যই নেই। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। নতুন করে প্যান্ট-শার্ট পরতে আমার খুব খারাপ লাগত, অস্বস্তি হতো। সারাক্ষণ সুরসুরি লাগত। মনে হতো নিজেকে অত্যাচার করছি। তাই কোনো কোনো সময় রাতে খালি গায়ে ঘুমাতাম। এদিকে বাংলা-ইংরেজির কিছুই জানি না। সব শিক্ষক অন্য ভাষার। শুধু একজন ম্রো জানতেন, যদিও উনি বাঙালি। উনিও কিছুদিন পর আসলেন না।
আপনি একবার স্কুল থেকে পালিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে গেলেন। এরপর আবার ফিরে আসা। এই আসা-যাওয়ার মাঝের সময়টুকু কীভাবে কাটল?
ইয়াংঙান ম্রো: ফিরে যাওয়াতে মা খুশিই হলেন। তখন আমার বয়স ১৩-১৪। মা আমার জন্য পাত্রী দেখলেন। বিয়ের জন্য দুটি শূকরও কেনা হলো। কিন্তু বাবা কিছুতেই মেনে নিলেন না। বললেন, তোমাকে পড়াশোনাটা করতেই হবে। তখন ভাবতাম, বাবা কত খারাপ (হাসি)। আমার খুব কষ্ট হতো তখন মানসিকভাবে। তবু ফিরতে হলো যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বেতারের একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে আপনি সাংঘাতিক মর্মপীড়ায় ভুগেছেন…
ইয়াংঙান ম্রো: বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে একদিন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে ম্রোদের গান ও গল্প রের্কড করার জন্য আমাকে বললেন। কিন্তু আমার ম্রোদের গল্প, আর গান কোনোটাই জানা ছিল না। ছোটকালে যা কিছু শুনেছিলাম, তার সবকিছুই ভুলে গেলাম। তখন আমার খুবই খারাপ লাগল। অপমানিত বোধ করলাম। আমাদের গ্রামের বয়স্করা আমাদের যে কথাগুলো বলেছিলেন, তখন আমার মনে পড়তে লাগল। তখন নিজেকে একজন অপরাধীর মতো লাগল। কারণ, বয়স্করা আমাদের বলতেন, আমাদের ম্রোদের গল্প, ভাষা, সংস্কৃতি ও জুমভূমি রক্ষা করতে হবে। তোমরা এসব রক্ষা না করলে আমাদের সমাজ থেকে সবকিছুই হারিয়ে যাবে। এসব রক্ষা করা তোমাদের পবিত্র দায়িত্ব, তোমাদের কর্তব্য।
তাঁদের কথা ভেবে আমার খুবই অস্থির লাগত। তাদের কথা ভেবে রাতে আমার ঘুম হতো না। ছটফট করতাম। ছটফট করতে করতে কখন ভোর হয়ে যেত, বুঝতে পারতাম না। আমার প্রতি এত বিশ্বাস, এত আশা করে, এত আদর করে মা-বাবা আর আমাদের গ্রামের বয়স্ক লোকজন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আর এখন আমি কিনা তাঁদের কথা সব ভুলে গেলাম! তা ছাড়া এখন তাঁরা আর কেউ বেঁচে নেই। এসব কথা ভেবে আমার কান্না আসত। আমি তো তাঁদের কথা রাখতে পারলাম না। আর তখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি পেলে বাড়িতে থাকতাম না। দুর্গম এলাকায় গিয়ে থাকতাম। সেখানে গিয়ে ম্রো সমাজের গল্প, ছড়া, ঘুমপাড়ানি গান, পূজা-পার্বণ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানার চেষ্টা করতে থাকলাম। সব সময় আমার কাছে দুটি ডায়েরি থাকত। একটি হলো মানুষের কথা লেখার জন্য, আরেকটি হলো আমি প্রতিদিন কী কী করছি, তা লিখে রাখার জন্য।
কোনো কোনো সময় আমাকে সারা দিন না খেয়ে হাঁটতে হতো। আর কোনো কোনো সময় গাছের নিচে ভাত খেতে হতো। বৃষ্টির দিনে এমন অনেকবার হয়েছিল যে, আমি গাছের নিচে ভাত খেতে গিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। আমাকে বৃষ্টির পানি দিয়ে ভাত খেতে হতো। আর কোনো কোনো সময় রোদের ভেতর হাঁটতে গিয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়তাম। তবুও আমি হাল ছাড়িনি। কারণ, এই কাজগুলো একটা জাতির মধ্যে কাউকে না কাউকে করতেই হয়। আমি যখনই কষ্ট পেতাম, তখনই বয়স্কদের কথা, আমার মা-বাবার কথা মনে পড়ত। কারণ, আমার মা-বাবা আমাকে সব সময় বলতেন, মানুষের উপকার করতে, জাতির জন্য কাজ করতে, দেশের জন্য কাজ করতে। মা-বাবার কথা রাখতে গিয়ে কলেজে পড়ার সময় টাকার অভাবে আমাকে তিন দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছিল। মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় দুর্গম এলাকা থেকে বাস না পেয়ে গভীর রাতে টানা পাঁচ ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছিল। তখন আমার খুবই কষ্ট হতো। কিন্তু মা-বাবার কথা মনে পড়লে মনের দুঃখ-কষ্টগুলো হালকা হয়ে যেত। মা-বাবার কথা রাখতে গিয়ে স্কুলে শীতকালে প্রায় এক মাস কম্বল ছাড়া রাতে ঘুমাতে হয়েছিল। তখন অনেক কষ্ট পেতাম। কিন্তু তখন ভাবতাম, আমাদের গ্রামে আমার বন্ধুদের কথা, যাদের অভাবের জন্য শীতের কাপড় কিনতে না পেরে কাপড় ছাড়া থাকতে হতো। তাদের অনেক কষ্ট হতো। তাদের কষ্টের কথা ভাবতে ভাবতে আমার দুঃখ-কষ্টগুলো হালকা হয়ে যেত।
যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড পিটারসেনের সঙ্গে রেংমিটচ্য ভাষা নিয়েও আপনার কিছু কাজ আছে বলে আমি জানি! এই ভাষাটা জানতে গিয়ে যখন দেখলেন, গোটা কয়েক মানুষ এই ভাষায় কথা বলছেন, তখন আপনার ভেতর কেমন অনুভূতি হয়েছিল। এ ছাড়া প্রায়বিলুপ্ত একটা ভাষাকে রক্ষার জন্য সেই ভাষাভাষী মানুষের প্রতি আপনার কী পরামর্শ?
ইয়াংঙান ম্রো: আমি ২০১৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রফেসর ডেভিড এ কে পিটারসনের সাথে রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কাজ করছি। রেংমিটচ্য ভাষায় কাজ করতে গিয়ে আমি অনেক শিক্ষা পেলাম। তাদের ভাষার মতো আমাদের ভাষাও পরবর্তী সময়ে হারিয়ে যেতে পারে—এটা আমার মধ্যে সব সময় কাজ করতে থাকে। কারণ, আজ যারা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে, তারাও অনেকে ম্রো ভাষাটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। মানুষের সামনে ‘ম্রো ভাষা ভুলে গেছে’ বলতে পারাকে তারা গর্ব বলে ভাবতে থাকে। অথচ মাতৃভাষার মতো গুরুত্ব, আর কোনো কিছুতেই থাকতে পারে না। হয়তো এই কথা তারা জানে না।
এই রেংমিটচ্য ভাষায় এখন মাত্র ছয়জন কথা বলতে পারেন। ছয়জন লোক মারা গেলে রেংমিটচ্য ভাষা আর থাকবে না। আর একটা ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে তার জাতি (পরিচয়) হারিয়ে যাওয়া। আমরা যখন রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম, তখন আমরা তাঁদের সংখ্যা পেয়েছিলাম ২২ জনের মতো। তবে তাঁরা বলতেন, রেংমিটচ্য ভাষা বলতে পারা লোকের সংখ্যা প্রায় ৩২ জন। যারা রেংমিটচ্য ভাষা পুরোপুরি বলতে পারে। কিন্তু তাঁরা দুর্গম এলাকায় থাকে বলে আমরাও সবার সাথে দেখা করতে পারলাম না। ডেভিড আমাকে অনেকবার রেংমিটচ্য ভাষার লোকদের খুঁজতে পাঠিয়েছিলেন। পরে আমরা তাঁদের নিয়ে রেংমিটচ্য ভাষা কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করলাম। তাঁদের কাজ হবে, রেংমিটচ্য ভাষার যেসব লোক আছে, তাদের সাথে দেখা করে যারা রেংমিটচ্য ভাষা বলতে পারে না, তাদের শেখানো। মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক বলতাম। কিন্তু তারা রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কথা বলতে চাইত না।
কারণ, তাদের ভাষায় কতগুলো শব্দ আছে, যা অন্য ভাষার লোকদের কাছে শুনতে খারাপ লাগে। তখন অন্য ভাষার লোকজন তাদের কথায় হাসতে থাকে। তখন থেকে তাঁরা নিজেদের রেংমিটচ্য ভাষা বলতে লজ্জাবোধ করতেন। তাই শুধু বাইরে থেকে বললে হবে না, মাতৃভাষাটাকে টিকিয়ে রাখতে ওই ভাষার লোকদের পাশাপাশি রাষ্ট্রের এবং সরকারের অনেক দায়িত্ব আছে বলে আমি মনে করি। আবার শুধু সরকার বা রাষ্ট্রের মাধ্যমেও কাজ হবে না। ওই ভাষার লোকদেরও নিজেদের ভাষাকে টিকে রাখতে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।
একটি ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে যেমন ভাষাভাষীর গুরুত্ব রয়েছে, ঠিক তেমনি বর্ণমালাও অনেক জরুরি। আর সেই বর্ণমালা দিয়ে তাদের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হবে। তাদের নিজেদের ভাষা শেখার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের জন্য ডিকশনারি করতে হবে। কারণ, নিজেদের বর্ণমালা দিয়ে যা কিছু লিখতে পারব, তা হয়তো অন্য বর্ণমালা দিয়ে লেখা যাবে না। আমি একটি উদাহরণ দিয়ে বলি যে ম্রো বর্ণমালায় আমরা যা কিছু লিখতে পারি, তা বাংলা বা ইংরেজি দিয়ে লিখতে পারব না। আমি ম্রো ভাষা দিয়ে যে ভাব প্রকাশ করতে পারব, তা বাংলা বা ইংরেজি দিয়ে প্রকাশ করতে পারব না। ম্রো ভাষা দিয়ে আমি যা অতি সহজে বিশ্লেষণ করতে পারব, তা বাংলা বা ইংরেজি দিয়ে করতে পারব না। আমরা সব মাতৃভাষাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করি। তাই তো প্রায়বিলুপ্ত রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কাজ করেছি। তাই একেকটি জাতির জন্য তার মাতৃভাষা অত্যন্ত গুরুত্ব একটি উপাদান।
নিজের মাতৃভাষা যেখানে উপেক্ষিত, সেখানে দেশপ্রেম শব্দটা আপনাকে কীভাবে আলোড়িত করে?
ইয়াংঙান ম্রো: এটাও সত্য যে কে কীভাবে আমাদের মাতৃভাষাকে দেখছে, তা আমি বলতে পারব না। আমি জানি, শুধু আমার মাতৃভাষাকে আমি খুবই ভালোবাসি। আমার কাছে আমার মাতৃভাষা সেরা ভাষা। এই ভাষা আমার কাছে খুবই পবিত্র। কারণ, এই ভাষায় আমার মা-বাবা আর আমাদের পূর্বপুরুষেরা কথা বলতেন।
একটা মজার কথা বলি, আমি যখন স্কুলে ভর্তি হলাম, তখন প্রথম দিন থেকেই একটা গান গাইতে হতো। পরে বুঝলাম এটা জাতীয় সংগীত। প্রথম প্রথম আয়ত্ত করতে না পারলেও পরে এটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। গ্রামে গিয়ে এই গান গাইলে অন্য বন্ধুরা তিরস্কার করে বলত, ‘তোমরা তো বাঙালি হয়ে গেছ, তোমাদের সাথে কথা বলা যাবে না।’
আপনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ম্রো ভাষায় অনুবাদ করেছেন…
ইয়াংঙান ম্রো: আমার মা-বাবা আর আমাদের গ্রামের বয়স্ক যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কোনো কোনো সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপান আর ব্রিটিশদের মধ্যকার যুদ্ধের কাহিনি শোনাতেন। তাঁরা আমাদের আরও শোনাতেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর পরিবারের করুণ কাহিনি। তখন আমরা অধীর আগ্রহ নিয়ে তাঁদের কথা শুনতাম। মাঝে মাঝে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁদের কাছে আমরা এসব কাহিনি শুনতাম। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাংলা থেকে ম্রো ভাষায় অনুবাদ করেছি। ম্রো ভাষায় যারা বাংলা পড়তে পারে না, তারাও তা জানতে পারবে। যদিও এখনো তা প্রকাশ করতে পারিনি। তবে ভবিষ্যতে প্রকাশ করার প্রবল আগ্রহ আছে।
ম্রো ভাষার প্রথম প্রকাশিত লেখক আপনি। ম্রো বর্ণমালা, ম্রো ধর্মগ্রন্থকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন এবং ম্রো ভাষার প্রথম ব্যাকরণটাও আপনি প্রকাশ করলেন। একটা জাতিগোষ্ঠীর জন্য এই মহৎ কাজগুলো করতে পেরে আপনার অনুভূতি কেমন?
ইয়াংঙান ম্রো: এটাকে মোটেও মহান কাজ বলতে রাজি না আমি। ভালোবাসার তাড়না থেকে, মা-বাবার স্বপ্ন থেকে, আমাদের গ্রামের বয়স্ক যারা ছিলেন, তাদের কথা রাখতে গিয়ে আমি এখনো মাতৃভাষায় বই লিখে যাচ্ছি। ম্রো রূপকথার গল্প, ম্রো পূজা-পার্বণ ও ম্রো সমাজ নিয়ে লেখালেখি করছি। ইতিমধ্যে আমার লেখা ১৮টি বই ম্রো ভাষায় এবং ১০টি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় লেখা বইগুলোর বেশির ভাগই অমর একুশে বইমেলায় স্থান পেয়েছিল। আমার আরও অনেক বই অপ্রকাশিত রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে ম্রো সমাজ, সংস্কৃতি, ক্রামাদি লেখার অনুবাদ, জুমচাষ, ম্রো সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার-বিশ্বাস, রূপকথার গল্প, ম্রো কবিতা-উপন্যাসসহ আরও অনেক।
আপনার গবেষণা ও লেখালেখিকে ম্রো সমাজ কীভাবে গ্রহণ করেছে?
ইয়াংঙান ম্রো: ম্রো ভাষায় লেখা আমার অনেক বই আমাদের গ্রামের মানুষ পড়ছে। দুর্গম এলাকার মানুষের সাথে যখন দেখা হয়, তখন তারা আমাকে বলে, আমার বই তারা পড়ছে। তখন আমার মাঝে যে তৃপ্তি আসে, তা অন্য কোনো কিছু দিয়ে তুলনা করা যাবে না। তবে কিছু কটু কথা আমাকেও শুনতে হয়েছে, এটা আমাদের সমাজের আলাদা কিছু না। সব সমাজেই কাজ করতে গেলে বাধা পার হয়েই আসতে হয়।
ম্রো ভাষার অবিকাশমান অবস্থা নিয়ে আপনার ভেতর যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, সেটা আমি টের পাই। তবে একটা কথা জানতে ইচ্ছা করছে, নিজের মাতৃভাষাকে বিকাশের চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ম্রো সংস্কৃতির ভূমিকা কী হতে পারে?
ইয়াংঙান ম্রো: এখানেও একটি কথা বলতে চাই যে আমরা শুধু বই লিখে বা বই প্রকাশ করে আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে পারব না। এই ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের সাথে সাথে সরকার ও রাষ্ট্রের অনেক ভূমিকা থাকে। সেটা হতে পারে মাতৃভাষায় বইপুস্তকের ব্যবস্থা, মাতৃভাষার শিক্ষক নিয়োগ, গ্রামে গ্রামে তাদের মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে প্রচার করা। এই প্রচার হতে পারে ব্যানার/সাইনবোর্ডের মাধ্যমে, হতে পারে তাদের শিক্ষিত লোকজনের মাধ্যমে, হতে পারে কর্মশালার মাধ্যমে। এগুলোর মাধ্যমে আমার মনে হয়, কিছুটা হলেও বিপন্ন ভাষাগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
ম্রো ভাষায় কোনো বর্ণমালা ছিল না। মহান মেনলে ম্রো একটি ভাষার মানুষের জন্য বর্ণমালা, ধর্মগ্রন্থ থেকে শুরু করে গান-কবিতাসহ অনেক কিছুই দিয়ে গেলেন। একটি জাতির জন্য সবকিছু দিয়ে ‘আবার আসব’ বলে তিনি হারিয়ে গেলেন। ম্রোরা এখনো মনে করেন, শুভ্রসাজে একটি সাদা ঘোড়ায় চেপে মেনলে ম্রো ফিরে আসবেন। মেনলে ম্রোর প্রত্যাবর্তন নিয়ে আপনার চিন্তার জায়গাটা কেমন?
ইয়াংঙান ম্রো: ম্রো বর্ণমালা বলতে গেলে ক্রামা ধর্মের কাহিনিও চলে আসে। কারণ, এই ক্রামা ধর্মের সাথে ম্রো বর্ণমালার কাহিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রথমে এই ম্রো বর্ণমালাকে বলা হতো ক্রামা বর্ণমালা। কিন্তু তখন একটা সমস্যা দেখা দিত। যারা ক্রামা ধর্মের লোক না, তারা এই বর্ণমালা পড়তে চাইত না। তাই পরে এই ক্রামা বর্ণমালাকে ম্রো বর্ণমালা নামে ডাকা হয়। আর তখন থেকে ক্রামা ধর্মের বাইরে লোকেরাও পড়তে থাকে। এখন এই বর্ণমালা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তবে অনেকে এই ক্রামা বর্ণমালা বা ম্রো বর্ণমালা কী করে আসছে, তা জানত না। তাই সংক্ষেপে এই বর্ণমালা আবিষ্কারের কাহিনি তুলে ধরছি—
১৯৮০ সালে বান্দরবান জেলার সুয়ালক ইউনিয়নে প্রথম ম্রো আবাসিক উচ্চবিদ্যালয় চালু হয়। প্রথমে সেখানে ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হয়। সেখানে শুধু ম্রো ও খুমী জনগোষ্ঠী লেখাপড়া করত। তখন সেখানে ছাত্র-ছাত্রী না পাওয়ায় গ্রামে গ্রামে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহ করতে হতো। ম্রো সমাজ তখনকার দিনে যে বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিল, তা হলো ছেলেধরার ভয়। অনেকে প্রচার করতেন যে স্কুলে ভর্তি করার নামে তাদের ছেলেমেয়েকে ছেলেধরার হাতে বিক্রি করে দেবে। তাই তখন কোনো ম্রো অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে রাজি হতেন না।
একদিন পোড়াপাড়া, অর্থাৎ বর্তমান ক্রামাদিপাড়ার মেনসিং ম্রোর বড় ছেলে মেনলে ম্রোকেও ম্রো আবাসিক উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। প্রথমে তাঁর মা-বাবা রাজি হলেন না আদরের ছেলে মেনলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে। তাঁদের মনে শঙ্কা, না জানি স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে ছেলেধরার হাতে বিক্রি করে দেয় কি না। তবু তাঁরা মেনলেকে স্কুলে ভর্তি করেন। মেনলে স্কুলে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করতেন। একদিন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, স্কুলের পাশে থাকা অশ্বথগাছে গিয়ে ধ্যান করবেন। যেই ভাবা, সেই কাজ। শুরু করলেন ধ্যান। দু-এক দিন নয়, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধ্যান করতে লাগলেন।
একদিন এক সাদা পোশাক পরা লোকের সাথে তাঁর দেখা হলো। লোকটি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী জন্য ধ্যান করছেন। মেনলে তখন বললেন, ম্রোদের নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই, নেই কোনো ধর্ম। তাই আমি ম্রোদের জন্য নিজস্ব বর্ণমালা ও ধর্ম চাই। তখন লোকটি মেনলেকে একটি বই দিলেন। বললেন, এই বর্ণমলা তোমরা পড়ে নেবে। মেনলে বই খুলে দেখলেন। কিন্তু সেটা অনেক কঠিন। তাই তিনি বইটি নিতে পারলেন না। এর চেয়ে সহজ বর্ণমালা চাইলেন। সাদা পোশাক পরা লোকটি পরে দেবেন বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মেনলেও ভোর হয়ে যাওয়ায় স্কুলে চলে গেলেন। পরদিন তিনি আবারও ধ্যানের জন্য অশ্বথগাছের নিচে গেলেন। সে রাতেও সাদা পোশাক পরা লোকটি উপস্থিত হয়ে তাঁকে একটি বই দিলেন। মেনলে দেখলেন এসব বর্ণমালাও অনেক কঠিন। তাই তিনি আবারও অপারগতা প্রকাশ করলেন। লোকটি পরের রাতে নিয়ে আসবেন বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মেনলেও ভোর হওয়ায় স্কুলে গেলেন। পরেরবার মেনলে আবারও ধ্যান করতে গেলে সাদা পোশাকের লোকটি আবারও চলে আসলেন। এবার তিনি বললেন এর চেয়ে সহজ বর্ণমালার বই আর কোথাও নেই। তাই এই বই মেনলেকে নিতে হবে। মেনলে দেখলেন, এই বর্ণমালার বইটি আগের দুটির চেয়ে অনেক সহজ। তাই তিনি সেটি নিলেন। তাই ম্রো বর্ণমালা এখনো তিনটি। নাম ইয়ুকলুং, থানা ও চাইয়াং।
সাধারণত চাইয়াং দিয়ে বইপুস্তক লেখা হয়। কারণ, বাকি দুটি অনেক কঠিন। পরে সাদা পোশাক পরা লোকটি মেনলেকে বললেন, ক্রামা নামে একটি ধর্ম পৃথিবীতে প্রচার করতে। তখন থেকে মেনলে একা একা লুকিয়ে লুকিয়ে ক্রামা বর্ণমালা পড়তে থাকেন। একসময় তিনি মানুষের মাঝে ক্রামা ধর্ম ও বর্ণমালা প্রচার করার জন্য স্কুল থেকে চলে গেলেন। তিনি মন দিলেন ক্রামা ধর্ম ও বর্ণমালা প্রচারে। নতুন কমিটি গঠন করলেন। পরে তাঁর প্রধান শিষ্য তৈরি করে নিলেন। পারাও ম্রোকে তাঁর প্রধান শিষ্য এবং লেংয়াং ম্রো ও সিংলক ম্রোকে তাঁর অন্যতম শিষ্য বানালেন। ম্রো ভাষা ও বর্ণমালার প্রধান করলেন রেংসং ম্রোকে।
এ ছাড়া গ্রামে গ্রামে ছয়জন করে সদস্য বানালেন। তাঁদের ডাকা হয় অরিত্বরাউপ নামে। ক্রামা ধর্মের উপদেশ, গান এবং ধর্মীয় রীতিনীতি মানুষকে বোঝানো, অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা করা এবং বিচার-সালিসের কাজ করতে হবে অরিত্বরাউপদের। তখন থেকে মেনলে উপাধি পেয়ে পেলেন ক্রামাদি নামে। ক্রামা ধর্মের প্রবর্তক বলে তিনি ক্রামাদি উপাধি পেলেন। ক্রামাদি বৃস্পতিবার প্রথম ম্রো বর্ণমালা মানুষের সামনে প্রকাশ করেছিলেন বলে ক্রামা ধর্মাবলম্বীদের কাছে বৃস্পতিবার খুবই পবিত্র দিন। পরে ক্রামাদি প্রচার করে বেড়াতেন, ম্রো বিয়ের সময় যে ১১০টি রুপার টাকা দিতে হয়, তা কমিয়ে ৫০টি করার জন্য। আর বিয়ের সময় যে বল্লম দেওয়ার বিধান, সেটি বন্ধ করে দিতে। কারণ, এগুলো এখন পেলেও ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে না।
ক্রামা ধর্মের আগে ম্রো সমাজে একটি রীতি প্রচলিত ছিল। মৃত ব্যক্তিকে তিন-চার দিন, এমনকি সপ্তাহখানেক রাখার রেওয়াজ ছিল। এতে মানুষ দুর্গন্ধে অনেক কষ্ট পেত। পরে ক্রামাদি বলেন, এসব বন্ধ করতে হবে। কারণ, মৃত ব্যক্তি আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। বরং বেশি দিন রাখলে মানুষ কষ্ট পায়। তখন তাঁর আত্মা মানুষকে দুর্গন্ধে কষ্ট দেওয়ার পাপে স্বর্গে যেতে পারে না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তা সৎকার করতে হবে। তিনি বলতেন, গো-হত্যা বন্ধ করতে হবে। কারণ, সারা রাত গরুকে কষ্ট দিয়ে ভোরে মেরে ফেলা হয়, তা তিনি মেনে নিতে পারতেন না। আর গো-হত্যা বাদ দেওয়ার সাথে সমাজে মদ পানও অনেক কমে যেতে থাকে। কারণ, ক্রামা ধর্মে পুরোপুরিভাবেই মদ পান নিষেধ ছিল। যারা মদ পান করবে, তারা ক্রামা মন্দিরে ঢুকতে পারবে না।
যদিও অনেকে পরবর্তী সময়ে প্রচার করেন যে ক্রামা ধর্মের জন্য ম্রো সমাজে প্লং বা বাঁশি হারিয়ে যায়। তবে এই কথা মোটেই সত্য নয়। তিনি শুধুমাত্র গো-হত্যা নিষেধ করেছিলেন। তিনি নিষেধ করেছেন মদ পান করা। মদ পানের ফলে সমাজে ঝগড়া হতো, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো। একজন সমাজ সংস্কারক কোনো দিনও ম্রোদের পরিচয় বহনকারী চিহ্ন প্লুং বা বাঁশি ব্যবহার নিষেধ করতে পারবেন না। তিনি বলতেন, আগেকার ম্রোরা গরুর মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া বর্ণমালা এখন আবার ফিরে পেয়েছে। এত দিন বর্ণমালা খেয়েছে বলে গরুকে গো-হত্যার মাধ্যমে কষ্ট দিয়ে শেষে মেরে ফেলেছে। এখন ম্রোরা আবারও বর্ণমালা পেয়েছে। তাই গো-হত্যা উৎসবের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার দরকার হবে না।
ক্রামাদি ম্রো সমাজ, সংস্কৃতি আর ভাষা নিয়ে অনেক চিন্তিত ছিলেন। আর তা তাঁর কথাবার্তা আর উপদেশ থেকে জানা যায়। তাঁর নিরুদ্দেশের আগে তিনি বলে গেলেন, নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষা রক্ষা করতে হবে। তিনি বলতেন, সব সময় চুল লম্বা রাখতে, নিজেদের পুঁতির মালা পরে রাখতে। এতে ম্রোরা যে আলাদা জাতি, তা সহজে মানুষ চিনতে পারবে। নিরুদ্দেশ থেকে কঠোর ধ্যান করার পর তিনি যখন ফিরে আসবেন সাদা ঘোড়ার পিঠে করে, তখন তিনি লম্বা চুল থাকা এবং নিজেদের পোশাক পরা লোক ও নিজেদের ভাষায় কথা বলা লোকদের সাথে আগে সাক্ষাৎ করবেন। তাঁর কথা রাখতে গিয়ে আজও ম্রো সামজে অনেক লোক চুল লম্বা রাখেন, নিজেদের পোশাক পরে থাকেন, নিজেদের ভাষা রক্ষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য প্রাণপণ কাজ করে চলেছেন।
তিনি যদি তখন বলতেন যে তিনি আর ফিরে আসবেন না, তবে আজকের ম্রো সমাজে চুল লম্বা রাখা পুরুষ, নিজেদের পোশাক পরা লোক আর নিজেদের বর্ণমালা পড়া লোক থাকত কি না, সন্দেহ রয়েছে। তিনি আরেকটি কথা বলতেন, তিনি ফিরে এসে ম্রো বর্ণমালাকে আরও উন্নত করবেন। তিনি যদি ফিরে আসার কথা না বলতেন, তাহলে যারা ক্রামা ধর্মের অনুসারী, তাঁরা আজ ক্রামাবিহারে গিয়ে প্রার্থনা করতেন কি না, জানি না। কারণ, অনেকে কিন্তু তাঁর ফিরে আসার সময় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য এখনো মনে মনে অপেক্ষা করেন। আর তাই সম্ভব বিহারে গিয়ে নিজের মনটাকে পবিত্র করা। কারণ, অপবিত্র মন দিয়ে ক্রামাদির সাথে সাক্ষাৎ করা যাবে না। তাই আজও নিজেদের মনকে পবিত্র করার জন্য লোকেরা বিহারে যান।
ক্রামাদি ফিরে আসার সময় যাতে তাঁর সাথে দেখা করতে পারে, সে জন্য এখনো চুল লম্বা রাখে পুরুষেরা; নিজেদের বর্ণমালা শিখতে থাকে। তবে আমার যা মনে হয়, তিনি আর কোনো দিনও ফিরে আসবেন না। তিনি সেদিন ফিরে আসার কথা এ জন্য বলেছিলেন, যাতে তাঁর কথা রাখতে গিয়ে নিজেদের সমাজ-সংস্কৃতি আর ভাষাকে সবাই ধরে রাখে। তিনি যদি সেবার ফিরে না আসার কথা বলতেন, তাহলে কিসের আশায় এখনো ক্রামা ধর্ম, আর বর্ণমালা টিকে থাকবে, কিসের আশায় ম্রো বর্ণমালায় তারা লেখাপড়া করবে। কিসের আশায় তারা ম্রো সমাজ-সংস্কৃতি ধরে রাখবে। তিনি আরও বলেছেন, ‘বই দেখলে আমাকে দেখতে পাবে, গাছ দেখলে আমাকে দেখতে পাবে।’ তার মানে, তাঁর লেখাগুলো দেখলে তাঁকে দেখা হচ্ছে। কারণ, তিনি সব সময় আমাদের সাথে আছেন। অর্থাৎ তাঁর লেখা, তাঁর উপদেশ সব সময় আমাদের মাঝে রয়েছে। তাই ক্রামাদি শুধু একজন ধর্ম প্রবর্তক বা একজন বর্ণমালা প্রবর্তক ছিলেন না, তিনি একজন সমাজ সংস্কারকও ছিলেন। একজন ভালো বক্তাও ছিলেন তিনি। এখনো আমাদের কাছে তাঁর উপদেশবাণী আছে। আমার ইচ্ছা—উপদেশবাণীগুলো পরে বাংলায় অনুবাদ করে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। তিনি ম্রো সমাজ, ম্রো বর্ণমালা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করতেন। এগুলো নিয়ে তিনি অনেক আশঙ্কা-উৎকণ্ঠায় ছিলেন।
ইয়াংঙান ম্রোর প্রকাশিত বইগুলো:
ম্রো ভাষায় প্রকাশিত বই:
১। মাইতং (আগুনের মর্শাল)
২। প্রেনপক সাংচিয়া (পৃথিবী উৎপত্তির কাহিনি)
৩। আরোং আনৈই (আলোকিত)
৪। রিইয়ুং খতি (ক্রামাদির লেখা সংকলন)
৫। বাংলা সাং (বাংলা ভাষা শিক্ষা)
৬। ম্রোচ্য সাংচিয়া (ম্রো গল্প)
৭। ঙেওয়া সাং মোয়া (শিশুদের শিক্ষার জন্য)
৮। ইংরিজি সাং (ইংরেজি ভাষা শিক্ষা)
৯। ঙিয়াচ্য সাং (বাল্য শিক্ষা)
১০। ঙিয়াচ্য সাং-২ (বাল্য শিক্ষা-২)
১১। রিইয়ুংখতি-২ (ক্রামা ধর্মগ্রন্থ-২)
১২। হয়লাই (ক্রামাদির উপদেশবাণী)
১৩। সাংচার খতি (ম্রো লেখা)
১৪। খতি অরি (ক্রামাদির লেখা সংকলন)
১৫। সাংলুং সাং (ম্রো লেখা)
১৬। রাঅং সাংচিয়া (রাঅং কাহিনি)
১৭। রোয়া সাং (গণিত শিক্ষা)
১৮। ম্রোচ্য ততোং (ম্রো ব্যাকরণ)
বাংলা ভাষায় লেখা বই:
১। ক্রামাদি-প্রকাশকাল, ২০১৫, অনঘ প্রকাশনী, অমর একুশে বইমেলা।
২। ম্রো রূপকথা, প্রকাশকাল-২০১৯, বিদ্যানন্দ প্রকাশনী-অমর একুশে বইমেলা।
৩। ম্রো রূপকথা-২, প্রকাশকাল-২০২০, বিদ্যানন্দ প্রকাশনী, অমর একুশে বইমেলা।
৪। জুম পাহাড়ের মানুষ (উপন্যাস), প্রকাশকাল-২০২০, আগামী প্রকাশনী, অমর একুশে বইমেলা।
৫। ক্রামা ধর্মের উৎপত্তি ও ম্রো সমাজ, প্রকাশ-২০২০, পূর্বস্বর প্রকাশনী, চট্টগ্রাম বইমেলা।
৬। ম্রো ডিকশনারি, প্রকাশকাল-২০১৯, বান্দরবান।
৭। ম্রো ১০১ জীবনী, প্রকাশকাল-২০২০, বান্দরবান।
৮। ম্রো গল্পসমূহ, প্রকাশকাল-২০১৯, বান্দরবান।
৯। ম্রো লোকগল্প, প্রকাশকাল-২০২১, আপন আলো প্রকাশনী, চট্টগ্রাম।
১০। জুম পাহাড়ের জীবন, প্রকাশকাল-২০২২, তিউরি প্রকাশনী, অমর একুশে বইমেলা।
অপ্রকাশিত বই:
১। শ্মশান লোকদের কান্না (উপন্যাস)
২। নীড়হারা পাখি (উপন্যাস)
৩। রক্তপিপাসু (উপন্যাস)
৪। আদরের সন্তান (উপন্যাস)
৫। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ (ম্রো ভাষায়)
৬। ম্রো রূপকথা-৫
৭। বেদনার মহাকাব্য (আত্মজীবনী)
৮। মা-বাবার স্বপ্ন (আত্মজীবনী)
৯। সিনপ্রেন সাংচিয়া (ম্রো লেখা)
১০। থুরাই চপা লাইমাক (ম্রো লেখা)
১১। ক্রামা ধর্মের আসার আগে ও পরে ম্রো সমাজের অবস্থা
১২। ম্রোচ্য মেং-২ (ম্রো লেখা)
১৩। কিইয়ক তাইন সো (ম্রো ভাষার গান)
১৪। ফুংপ্রেম সাংচিয়া (ম্রো লেখা)
১৫। ছবিসহ শিশুদের ম্রো শিক্ষা (ম্রো ভাষা)
১৬। গুপ্তধন (ছোট গল্প)
১৭। হারানোর গ্রাম (ছোট গল্প)
১৮। ম্রো সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার বিশ্বাস ও পূজা-পার্বণ
১৯। সিং চ্যক লং ওয়ান (কৃষিবিষয়ক, ম্রো ভাষা)
২০। রোয়া লং ওয়ান, (সাপ সম্পর্কে, ম্রো ভাষা)
২১। তানত্য লাইমাক (ম্রো লেখা) ইত্যাদি ছাড়া আরও অনেক আছে।
ইউনিক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত হোসেন। পর্যটনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি মনজুরুল ইসলাম।
০৩ অক্টোবর ২০২৪বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, সুফি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোনো বিভাজনমূলক এজেন্ডায় রাজনীতির দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত না হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা দৃঢ়ভাবে কোনো সাম্প্রদায়িক ফাঁদে আটকা পড়তে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করি। কোনোভাবেই তা হতে দেওয়া যাবে না।
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪‘আমি এটাকে ঠিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বলব না। আমি এটাকে বলব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সেটা আমার পারিবারিক শিক্ষা। আমাদের ঘরের ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে যেকোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পরিবারের বড়দের সাথে আমরা দ্বিমত পোষণ করতে পেরেছি। ছোট থেকে বড়, কারও কোনো কথা বা কাজ ভুল মনে হলে সেটাকে আমরা তার প্রতি স
৩১ আগস্ট ২০২৪একেক মানুষ বেছে নেন একেক পেশা। তাঁদের মধ্যে কারও কারও পেশা একটু ভিন্ন ধরনের। যেমন—মো. মুনসুর আলী ওরফে মন্টু খলিফা। বাপ-দাদার পেশাকে ভালোবেসে শিশুদের খতনা করানো বা হাজামের কাজ বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। জীবনে পার করেছেন প্রায় ৮৫ বছর। জানিয়েছেন গত ৬০ বছরে ২ লাখের বেশি শিশুর মুসলমানি বা সুন্নতে খতনা দিয়
৩০ মার্চ ২০২৪