অনলাইন ডেস্ক
মিয়ানমারের আরকান বা রাখাইন রাজ্যের সশস্ত্র গ্রুপ ‘আরাকান আর্মি’ (এএ) যাত্রা শুরু করে ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল। বিদ্রোহী গ্রুপটির কমান্ডার ইন চিফের নাম থোয়ান ম্রা নাইং। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে দেশটির অন্য বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর কমান্ডারদের মধ্যে নিজেকে অত্যন্ত সফল কমান্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন নাইং। সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির (কেআইএ) সহায়ক শক্তি হিসেবে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের কাচিন রাজ্যে ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে অংশ নেয় এএ। এর পর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শান রাজ্যের বিদ্রোহী গ্রুপ মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির (এমএনডিএএ) সঙ্গেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে নাইংয়ের গ্রুপ।
নিজেদের রাজ্যে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে আগে থেকেই অল্প-বিস্তর সংঘর্ষে জড়ালেও মূলত ২০১৮ সাল থেকে তা এক ধরনের গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। প্রায় তিন বছর যুদ্ধের পর ২০২০ সালের শেষদিকে অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিতে যায় গ্রুপটি। ফলে গত ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চল উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও এখন বেশ স্থিতিশীল রয়েছে রাখাইন রাজ্য। গোলযোগের এই সুযোগে রাজ্যটির বড় একটা অংশে, বিশেষত উত্তরাঞ্চলে নিজেদের প্রশাসন চালু করতে সক্ষম হয়েছে এএর রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ)।
তবে যেকোনো সময় অশান্ত হয়ে উঠতে পারে রাখাইন রাজ্য। এ জন্য ইন্ধনের অভাব নেই। সামান্য ইস্যুতে এএর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করতে পারে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাতমাদৌ। তবে তা করার আগে নানা কারণে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। আবার এএর বিরুদ্ধে রাখাইনের অন্য বিদ্রোহীদের উসকে দিতে পারে সেনাবাহিনী। বা ফাটল দেখা দিতে পারে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর জোট দ্য ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স, দ্য নর্দান অ্যালায়েন্স এবং দ্য ফেডারেল পলিটিক্যাল নেগোসিয়েশন অ্যান্ড কনসালটেটিভ কমিটির (এফপিএনসিসি) মধ্যে।
তবে জান্তা বিরোধীদের সঙ্গে মিলে অন্য বিদ্রোহীদের মতো এএও পুরোদমে সামরিক তৎপরতা শুরু করলে এরই মধ্যে সংকটাপন্ন তাতমাদৌ দিশেহারা হয়ে পড়ত বলে ধারণা করা হয়। হংকংভিত্তিক গণমাধ্যম এশিয়া টাইমসের প্রতিনিধি বার্টিল লিন্টনারের সঙ্গে সম্প্রতি নিজেদের ভবিষ্যৎ এবং মিয়ানমারের ক্রম বিস্তৃত গৃহযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছেন মেজর জেনারেল থোয়ান ম্রা নাইং। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য ইংরেজি থেকে সেই সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছেন তাসনিম আলম।
২০২০ সালের নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পরপরই আপনারা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিতে গেলেন। এর পর থেকেই আরাকানের পরিস্থিতি তুলনামূলক শান্ত। যেখানে সারা মিয়ানমারই জান্তাবিরোধী বিদ্রোহ-বিক্ষোভে উত্তাল, সেখানে রাখাইনে কত দিন শান্তি ধরে রাখা সম্ভব হবে?
থোয়ান ম্রা নাইং: অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি নিয়ে ভরসা করার মতো কিছু নেই। আমাদের মাথার ওপর তরবারি ঝুলে আছে। এ অবস্থায় যুদ্ধবিরতি কত দিন টিকবে, তা অনিশ্চিত। তবে বৃহত্তর স্বার্থে আমরা অর্থপূর্ণ যুদ্ধবিরতিতে যেতে চাই।
এ মুহূর্তে (জান্তার প্রশাসন) স্যাককে (স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল) দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। আপাতত পরিস্থিতি সামলানোর কৌশলের ভিত্তিতে তারা এসব যুদ্ধ পরিচালনা করছে। আমরা যেহেতু বিচার, রাজস্ব, জননিরাপত্তা এবং আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পরিচালনা করছি, তাই তারা আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত। তাদের ক্রোধের বিষয়টি আমাদের ভালোভাবে জানা আছে।
মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর তিনটি জোটে আপনারা রয়েছেন। কিন্তু কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ), কারেনি ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টি (কেএনপিপি) ও দলটির সশস্ত্র শাখা কারেনি আর্মি এবং রেস্টোরেশন কাউন্সিল অব শান স্টেট (আরসিএসএস) তো ওই জোটগুলোর সদস্য নয়। তাদের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কেমন?
থোয়ান ম্রা নাইং: ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এবং নর্দান অ্যালায়েন্সের সঙ্গে বিভিন্ন অপারেশনে আমরা নিয়মিত অংশ নিচ্ছি। আমরা এখনো এফপিএনসিসির সদস্য। কেএনইউ এবং কেএনপিপি এবং অধিকাংশ জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গেও আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে।
গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখলের পর থেকে স্যাকের কার্যক্রম নিয়ে আপনার সার্বিক মূল্যায়ন কী? তাদের সঙ্গে আলোচনা কি সম্ভব, নাকি সশস্ত্র সংগ্রামই একমাত্র পথ?
থোয়ান ম্রা নাইং: স্যাকের হাতে পড়ে স্বাস্থ্য খাত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে, দেউলিয়া হতে বসেছে অর্থনীতি, আর অচল হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক রাজনৈতিক অঙ্গন। স্যাক উদভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবারের জান্তা সরকার বা স্যাক কূটনৈতিক মহলে অনেক বেশি নিঃসঙ্গ। একই সঙ্গে অনেক ফ্রন্টে যুদ্ধ শুরু করায় শক্তি ক্ষয় হচ্ছে সামরিক বাহিনীর। বলতে গেলে ঝড়ের কবলে পড়ে গেছে জান্তা সরকার। তাই তাদের আর বেশি ভুল করার সুযোগ নেই।
এ অবস্থায় তাদের চেইন অব কমান্ড এবং অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা একবার ভেঙে পড়লে, সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিলে, তাতমাদৌ একটি সুপারনোভার মতো বিস্ফোরিত হতে পারে। কিন্তু তাদের সামরিক শক্তি ও ঘুরে দাঁড়ানোর সামর্থ্যকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা যেকোনো কিছুই করতে পারে। সময়ে সময়ে তাদের নির্বিচার বর্বরতা আমাদের দেখতে হয়েছে। তাই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনো শান্তি আলোচনা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। বিরাজমান শত্রুতামূলক পরিবেশে শান্তি আলোচনার কথা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর ছাড়া কিছু নয়।
জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এবং রাখাইনের স্থানীয় রাজনীতিতে আরকান ন্যাশনাল পার্টির (এএনপি) ভূমিকাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
থোয়ান ম্রা নাইং: গত নির্বাচনে (২০২০ সালের নভেম্বর) এনএলডি বিস্ময়কর জয় লাভ করলেও দলটির সার্বিক অবস্থা ভালো বলা যাবে না। দলটির নেতৃত্ব বয়সের ভারে ন্যুব্জ, স্থবির। এদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। এনএলডির নতুন নেতৃত্ব দরকার। তবে মিয়ানমার জনগণের স্বার্থে আমি নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান কামনা করি, যারা চলমান রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করতে পারবে।
আর এএনপির বিষয়ে বলব, জান্তার ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৩ সালে নির্বাচন হবে কি হবে না, তারা সেদিকে তাকিয়ে আছে। এসব কিছু বিবেচনায় নিলে (মিয়ানমারের) রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ভয়ানক ও অনিশ্চিত বলতে হয়। তবে এএনপিকে নিয়ে আরেকটি সম্ভাব্য দৃশ্য কল্পনা করা যায়—আগামী কয়েক বছরে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো নির্বাচন না হলে রাখাইনের অন্যান্য পার্টি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মতো এএনপিও ইউএলএর সঙ্গে একীভূত হয়ে যেতে পারে।
আপনার চূড়ান্ত লক্ষ্য কী—আরাকান স্বাধীন করা, না, ফেডারেল ইউনিয়নের অধীনে স্বায়ত্তশাসন? ভবিষ্যতে মিয়ানমারের রাষ্ট্র কাঠামো আপনি কেমন দেখতে চান?
থোয়ান ম্রা নাইং: স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমত্বের অধিকারের দাবি আমাদের জাতীয় আন্দোলনের প্রাণ। তবে হ্যাঁ, ভবিষ্যতে মিয়ানমার যদি একটা ফেডারেল ইউনিয়ন হয়, সেই কনফেডারেশনের রাজনৈতিক স্বাধীনতা যদি আরাকানি জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়, তাহলে হয়তো আমরা ভিন্ন চিন্তা করব।
যা বলছিলাম, আমরা তো আমাদের (অন্য জাতিগোষ্ঠীর) ভাইবোনদের সঙ্গে থাকাকেই অগ্রাধিকার দিতে চাই। কিন্তু ফেডারেল ইউনিয়নে আমাদের প্রত্যাশিত রাজনৈতিক মর্যাদা স্বীকার করা না হলে আমরা নিজেদের মতো করে আন্তর্জাতিক মহলের সদস্য হতে চেষ্টা করব।
আপনাদের আর্মি কতটা শক্তিশালী? আরাকানের কতটুকু আপনাদের নিয়ন্ত্রণে আছে?
থোয়ান ম্রা নাইং: (২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর) ১৩ বছরে আমরা ৩০ হাজারের বেশি সৈনিককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ এবং কৌশলগত দক্ষতা বিষয়ে আরও অনেক যোদ্ধার প্রশিক্ষণ চলমান। আমাদের ৭০ শতাংশ সৈনিকের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। বর্তমানে আমাদের ৫ থেকে ৬ হাজার সৈনিক জোটের শরিকদের অঞ্চলে নিয়োজিত আছেন। আর বাকিরা আরকানেই রয়েছেন।
উত্তর আরকানের প্রায় ৬০ শতাংশ অঞ্চল আমাদের নিয়ন্ত্রণে। তবে দক্ষিণ আরকানে আমাদের প্রভাব কম। কোনো কোনো জায়গায় আমাদের ও মিয়ানমার আর্মির প্রভাব সমান সমান। শহর অঞ্চলগুলো সাধারণত মিয়ানমার আর্মিই নিয়ন্ত্রণ করে। কৌশলগত কারণে এটা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে দরকার হলে সেসব এলাকায় আমরা কর্তৃত্ব খাটাতে পারি। হ্যাঁ, এমন অনেক এলাকা আছে, যার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে।
পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং চিন রাজ্যের আশপাশে যুদ্ধরত জান্তাবিরোধী সমন্বিত বাহিনীগুলোর সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কেমন?
থোয়ান ম্রা নাইং: এখন পর্যন্ত বলতে গেলে উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পর্ক নেই।
(বাংলাদেশের) প্রথম আলোয় ২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আপনি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও নাগরিকত্বের অধিকার স্বীকার করেছেন। এটা কি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই মুহূর্তে প্রত্যাবাসন এবং তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত?
থোয়ান ম্রা নাইং: আরাকানের সব বাসিন্দাদের মানবাধিকার ও নাগরিকত্বের অধিকার আমরা স্বীকার করি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে শরণার্থীদের ব্যাপক হারে প্রত্যাবাসন নতুন করে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। যেকোনো প্রত্যাবাসন স্বেচ্ছায় এবং আইন মেনে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানেই হতে হবে।
শরণার্থীরা যে নামে নিজেদের পরিচয় নির্ধারণ করতে চায়, তা নিয়ে অধিকাংশ আরাকানির বড় ধরনের আপত্তি রয়েছে। ‘রোহিঙ্গা’ পরিভাষাটা অধিকাংশ আরাকানি জনগণ মেনে নিতে চান না। এ পরিভাষাটিকে তাঁরা আপত্তিজনক মনে করেন। কারণ, তারা মনে করে এটা তাদের ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করে দেয়। (অথচ) তারাই এই মাটির আদি বাসিন্দা।
এখানে বিভিন্ন সময়ে মুসলমানেরা এসেছেন। আরাকান ব্রিটিশদের দখলে থাকার সময়েই (১৮২৬-১৯৪৮) তাঁরা ব্যাপক হারে এসেছেন। যারা এখানে বংশপরম্পরায় বসবাস করছেন, তাঁদের আরাকানের নাগরিক হতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এটা তো তাঁদের আত্মপরিচয়েরও প্রশ্ন। (রোহিঙ্গা পরিভাষা নিয়ে সমস্যাটা সেখানেই।)
আরাকানে মুসলমান, বৌদ্ধ, হিন্দু এবং খ্রিষ্টানদের শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু?
থোয়ান ম্রা নাইং: এটা সম্ভব। এ জন্য আমাদের বাইরের সব ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে। একটা গ্রুপকে আরেকটা গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে আরকানে যে পর্যায়ের সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং সাম্প্রদায়িক সংহতি বিরাজ করছে, তেমনটি ১৯৪১ / ৪২ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। এখন সামাজিক স্থিতিশীলতা অনেক ভালো। কমতে শুরু করেছে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। এ অবস্থায় নানা ধরনের ইতিবাচক সামাজিক কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব। এগুলো চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন। সমাজের ভেতর থেকে আরও আরও ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করতে হবে।
রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নিয়ে আপনার মতামত কী?
থোয়ান ম্রা নাইং: এদের কোনোটার সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক নেই। তবে আরসার তুলনায় আরএসও রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি পরিপক্ব। কিন্তু আরসার নেটওয়ার্ক অনেক বিস্তৃত। সংগঠনটি অনেক বেশি সক্রিয়। আরাকানের গ্রামে এবং বাংলাদেশের শরণার্থীশিবিরে আপন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরসার নেতারা যা করছে, তা তো আপনারা নিজ চোখেই দেখছেন। শরণার্থীদের মধ্যে কিছু শিক্ষিত মুসলমান দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে আরসাকে ব্যবহার করছে। সংকটপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশকে তারা নিজেদের আখের গোছাতে কাজে লাগাচ্ছে।
আপনাদের একমাত্র প্রতিবেশী বাংলাদেশ। সীমানার ওপারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও জনগণের সঙ্গে, উদাহরণস্বরূপ মারমা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ককে আপনি কীভাবে দেখেন? আর (আপনাদের সীমান্ত থেকে) সামান্য দূরে অবস্থিত ভারতের বিষয়েই-বা আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
থোয়ান ম্রা নাইং: মারমা এবং মগের (ত্রিপুরার মগ) সঙ্গে আমাদের রক্তের কোনো তফাৎ নেই। তিন দেশের ওই অঞ্চলের সীমান্তবর্তী অন্য জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও একই কথা। আমাদের আন্দোলন নিয়ে তাদের গভীর বোঝাপড়া রয়েছে। তারা আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
আর বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ নয়। তবে এখনো এতটা ভালোও বলা যাবে না। বাংলাদেশ সরকার আমাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে কীভাবে সম্পর্ক রাখতে চায়, তা নিয়ে তাদের কোনো নীতি বা কৌশল এখনো আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
তবে ধীরে ধীরে এ পরিস্থিতির অবশ্যই উন্নতি হবে। নিজ উদ্যোগে তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। সুসম্পর্ক আমাদের উভয় পক্ষের জন্যই কল্যাণকর। শরণার্থী সমস্যা সমাধানে, তহবিল (রাখাইনের রোহিঙ্গাদের মধ্যে) সরবরাহে, মহামারি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে কার্যকর অগ্রগতির জন্য আমাদের মধ্যে সুসম্পর্কের বিকল্প নেই। উভয় সীমান্তের জনগণের ভালো থাকার জন্য স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্য ক্ষেত্রেও আমাদের সম্পর্ক বাড়াতে হবে।
সংঘাতময় আরাকান ও বাদবাকি মিয়ানমারে শান্তি ফেরাতে চীন এবং জাপানের মতো অন্য কোনো দেশ কোনো ভূমিকা রাখতে পারে কি? (এ অঞ্চলে) চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নেতৃত্বের প্রতিযোগিতাকে আপনারা কীভাবে দেখেন?
থোয়ান ম্রা নাইং: তত্ত্বগতভাবে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় (চীন ও জাপান) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু তা বেশ জটিল। পরিবর্তন আসতে হবে (সমাজের/দেশের) ভেতর থেকে। ওই ধরনের পরিবর্তনই আমাদের কাছে বেশি বাস্তবসম্মত, বেশি আবেদনময়। তবে কোনো সমীকরণই এখনো স্পষ্ট নয়। আর যুক্তরাষ্ট্র-চীনের প্রতিযোগিতা আমাদের স্পর্শ করবে না। তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই।
সবশেষে, একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? এবং তা কখন?
থোয়ান ম্রা নাইং: রাজনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটানো এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার সামর্থ্য মিয়ানমারের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিসরে অনুপস্থিত। বামন হয়ে আমি চাঁদে ছুঁতে চাই না ঠিক। কিন্তু জোরপূর্বক যারা আমাদের বঞ্চিত করেছে, সেই শত্রুদের থেকে আমাদের প্রত্যাশার কিছু নেই।
শত্রুরা যাই ভাবুক না কেন, নিজ হাতেই আমরা আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করব। নিজেদের ভিত্তিভূমিতেই নির্মাণ করব স্বপ্নের সৌধ, যা আমাদের একান্ত প্রাপ্য। আমাদের হারানো সার্বভৌমত্ব ফিরে পাওয়া এবং আরকানের ন্যায্য রাজনৈতিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারই আমার জীবনের ব্রত।
মিয়ানমারের আরকান বা রাখাইন রাজ্যের সশস্ত্র গ্রুপ ‘আরাকান আর্মি’ (এএ) যাত্রা শুরু করে ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল। বিদ্রোহী গ্রুপটির কমান্ডার ইন চিফের নাম থোয়ান ম্রা নাইং। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে দেশটির অন্য বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর কমান্ডারদের মধ্যে নিজেকে অত্যন্ত সফল কমান্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন নাইং। সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির (কেআইএ) সহায়ক শক্তি হিসেবে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের কাচিন রাজ্যে ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে অংশ নেয় এএ। এর পর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শান রাজ্যের বিদ্রোহী গ্রুপ মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির (এমএনডিএএ) সঙ্গেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে নাইংয়ের গ্রুপ।
নিজেদের রাজ্যে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে আগে থেকেই অল্প-বিস্তর সংঘর্ষে জড়ালেও মূলত ২০১৮ সাল থেকে তা এক ধরনের গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। প্রায় তিন বছর যুদ্ধের পর ২০২০ সালের শেষদিকে অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিতে যায় গ্রুপটি। ফলে গত ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চল উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও এখন বেশ স্থিতিশীল রয়েছে রাখাইন রাজ্য। গোলযোগের এই সুযোগে রাজ্যটির বড় একটা অংশে, বিশেষত উত্তরাঞ্চলে নিজেদের প্রশাসন চালু করতে সক্ষম হয়েছে এএর রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ)।
তবে যেকোনো সময় অশান্ত হয়ে উঠতে পারে রাখাইন রাজ্য। এ জন্য ইন্ধনের অভাব নেই। সামান্য ইস্যুতে এএর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করতে পারে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাতমাদৌ। তবে তা করার আগে নানা কারণে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। আবার এএর বিরুদ্ধে রাখাইনের অন্য বিদ্রোহীদের উসকে দিতে পারে সেনাবাহিনী। বা ফাটল দেখা দিতে পারে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর জোট দ্য ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স, দ্য নর্দান অ্যালায়েন্স এবং দ্য ফেডারেল পলিটিক্যাল নেগোসিয়েশন অ্যান্ড কনসালটেটিভ কমিটির (এফপিএনসিসি) মধ্যে।
তবে জান্তা বিরোধীদের সঙ্গে মিলে অন্য বিদ্রোহীদের মতো এএও পুরোদমে সামরিক তৎপরতা শুরু করলে এরই মধ্যে সংকটাপন্ন তাতমাদৌ দিশেহারা হয়ে পড়ত বলে ধারণা করা হয়। হংকংভিত্তিক গণমাধ্যম এশিয়া টাইমসের প্রতিনিধি বার্টিল লিন্টনারের সঙ্গে সম্প্রতি নিজেদের ভবিষ্যৎ এবং মিয়ানমারের ক্রম বিস্তৃত গৃহযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছেন মেজর জেনারেল থোয়ান ম্রা নাইং। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য ইংরেজি থেকে সেই সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছেন তাসনিম আলম।
২০২০ সালের নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পরপরই আপনারা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতিতে গেলেন। এর পর থেকেই আরাকানের পরিস্থিতি তুলনামূলক শান্ত। যেখানে সারা মিয়ানমারই জান্তাবিরোধী বিদ্রোহ-বিক্ষোভে উত্তাল, সেখানে রাখাইনে কত দিন শান্তি ধরে রাখা সম্ভব হবে?
থোয়ান ম্রা নাইং: অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি নিয়ে ভরসা করার মতো কিছু নেই। আমাদের মাথার ওপর তরবারি ঝুলে আছে। এ অবস্থায় যুদ্ধবিরতি কত দিন টিকবে, তা অনিশ্চিত। তবে বৃহত্তর স্বার্থে আমরা অর্থপূর্ণ যুদ্ধবিরতিতে যেতে চাই।
এ মুহূর্তে (জান্তার প্রশাসন) স্যাককে (স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল) দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। আপাতত পরিস্থিতি সামলানোর কৌশলের ভিত্তিতে তারা এসব যুদ্ধ পরিচালনা করছে। আমরা যেহেতু বিচার, রাজস্ব, জননিরাপত্তা এবং আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পরিচালনা করছি, তাই তারা আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত। তাদের ক্রোধের বিষয়টি আমাদের ভালোভাবে জানা আছে।
মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর তিনটি জোটে আপনারা রয়েছেন। কিন্তু কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ), কারেনি ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টি (কেএনপিপি) ও দলটির সশস্ত্র শাখা কারেনি আর্মি এবং রেস্টোরেশন কাউন্সিল অব শান স্টেট (আরসিএসএস) তো ওই জোটগুলোর সদস্য নয়। তাদের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কেমন?
থোয়ান ম্রা নাইং: ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এবং নর্দান অ্যালায়েন্সের সঙ্গে বিভিন্ন অপারেশনে আমরা নিয়মিত অংশ নিচ্ছি। আমরা এখনো এফপিএনসিসির সদস্য। কেএনইউ এবং কেএনপিপি এবং অধিকাংশ জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গেও আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে।
গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখলের পর থেকে স্যাকের কার্যক্রম নিয়ে আপনার সার্বিক মূল্যায়ন কী? তাদের সঙ্গে আলোচনা কি সম্ভব, নাকি সশস্ত্র সংগ্রামই একমাত্র পথ?
থোয়ান ম্রা নাইং: স্যাকের হাতে পড়ে স্বাস্থ্য খাত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে, দেউলিয়া হতে বসেছে অর্থনীতি, আর অচল হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক রাজনৈতিক অঙ্গন। স্যাক উদভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবারের জান্তা সরকার বা স্যাক কূটনৈতিক মহলে অনেক বেশি নিঃসঙ্গ। একই সঙ্গে অনেক ফ্রন্টে যুদ্ধ শুরু করায় শক্তি ক্ষয় হচ্ছে সামরিক বাহিনীর। বলতে গেলে ঝড়ের কবলে পড়ে গেছে জান্তা সরকার। তাই তাদের আর বেশি ভুল করার সুযোগ নেই।
এ অবস্থায় তাদের চেইন অব কমান্ড এবং অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা একবার ভেঙে পড়লে, সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিলে, তাতমাদৌ একটি সুপারনোভার মতো বিস্ফোরিত হতে পারে। কিন্তু তাদের সামরিক শক্তি ও ঘুরে দাঁড়ানোর সামর্থ্যকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা যেকোনো কিছুই করতে পারে। সময়ে সময়ে তাদের নির্বিচার বর্বরতা আমাদের দেখতে হয়েছে। তাই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনো শান্তি আলোচনা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। বিরাজমান শত্রুতামূলক পরিবেশে শান্তি আলোচনার কথা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর ছাড়া কিছু নয়।
জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এবং রাখাইনের স্থানীয় রাজনীতিতে আরকান ন্যাশনাল পার্টির (এএনপি) ভূমিকাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
থোয়ান ম্রা নাইং: গত নির্বাচনে (২০২০ সালের নভেম্বর) এনএলডি বিস্ময়কর জয় লাভ করলেও দলটির সার্বিক অবস্থা ভালো বলা যাবে না। দলটির নেতৃত্ব বয়সের ভারে ন্যুব্জ, স্থবির। এদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। এনএলডির নতুন নেতৃত্ব দরকার। তবে মিয়ানমার জনগণের স্বার্থে আমি নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান কামনা করি, যারা চলমান রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করতে পারবে।
আর এএনপির বিষয়ে বলব, জান্তার ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৩ সালে নির্বাচন হবে কি হবে না, তারা সেদিকে তাকিয়ে আছে। এসব কিছু বিবেচনায় নিলে (মিয়ানমারের) রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ভয়ানক ও অনিশ্চিত বলতে হয়। তবে এএনপিকে নিয়ে আরেকটি সম্ভাব্য দৃশ্য কল্পনা করা যায়—আগামী কয়েক বছরে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো নির্বাচন না হলে রাখাইনের অন্যান্য পার্টি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মতো এএনপিও ইউএলএর সঙ্গে একীভূত হয়ে যেতে পারে।
আপনার চূড়ান্ত লক্ষ্য কী—আরাকান স্বাধীন করা, না, ফেডারেল ইউনিয়নের অধীনে স্বায়ত্তশাসন? ভবিষ্যতে মিয়ানমারের রাষ্ট্র কাঠামো আপনি কেমন দেখতে চান?
থোয়ান ম্রা নাইং: স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমত্বের অধিকারের দাবি আমাদের জাতীয় আন্দোলনের প্রাণ। তবে হ্যাঁ, ভবিষ্যতে মিয়ানমার যদি একটা ফেডারেল ইউনিয়ন হয়, সেই কনফেডারেশনের রাজনৈতিক স্বাধীনতা যদি আরাকানি জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়, তাহলে হয়তো আমরা ভিন্ন চিন্তা করব।
যা বলছিলাম, আমরা তো আমাদের (অন্য জাতিগোষ্ঠীর) ভাইবোনদের সঙ্গে থাকাকেই অগ্রাধিকার দিতে চাই। কিন্তু ফেডারেল ইউনিয়নে আমাদের প্রত্যাশিত রাজনৈতিক মর্যাদা স্বীকার করা না হলে আমরা নিজেদের মতো করে আন্তর্জাতিক মহলের সদস্য হতে চেষ্টা করব।
আপনাদের আর্মি কতটা শক্তিশালী? আরাকানের কতটুকু আপনাদের নিয়ন্ত্রণে আছে?
থোয়ান ম্রা নাইং: (২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর) ১৩ বছরে আমরা ৩০ হাজারের বেশি সৈনিককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ এবং কৌশলগত দক্ষতা বিষয়ে আরও অনেক যোদ্ধার প্রশিক্ষণ চলমান। আমাদের ৭০ শতাংশ সৈনিকের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। বর্তমানে আমাদের ৫ থেকে ৬ হাজার সৈনিক জোটের শরিকদের অঞ্চলে নিয়োজিত আছেন। আর বাকিরা আরকানেই রয়েছেন।
উত্তর আরকানের প্রায় ৬০ শতাংশ অঞ্চল আমাদের নিয়ন্ত্রণে। তবে দক্ষিণ আরকানে আমাদের প্রভাব কম। কোনো কোনো জায়গায় আমাদের ও মিয়ানমার আর্মির প্রভাব সমান সমান। শহর অঞ্চলগুলো সাধারণত মিয়ানমার আর্মিই নিয়ন্ত্রণ করে। কৌশলগত কারণে এটা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে দরকার হলে সেসব এলাকায় আমরা কর্তৃত্ব খাটাতে পারি। হ্যাঁ, এমন অনেক এলাকা আছে, যার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে।
পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং চিন রাজ্যের আশপাশে যুদ্ধরত জান্তাবিরোধী সমন্বিত বাহিনীগুলোর সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কেমন?
থোয়ান ম্রা নাইং: এখন পর্যন্ত বলতে গেলে উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পর্ক নেই।
(বাংলাদেশের) প্রথম আলোয় ২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আপনি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও নাগরিকত্বের অধিকার স্বীকার করেছেন। এটা কি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই মুহূর্তে প্রত্যাবাসন এবং তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত?
থোয়ান ম্রা নাইং: আরাকানের সব বাসিন্দাদের মানবাধিকার ও নাগরিকত্বের অধিকার আমরা স্বীকার করি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে শরণার্থীদের ব্যাপক হারে প্রত্যাবাসন নতুন করে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। যেকোনো প্রত্যাবাসন স্বেচ্ছায় এবং আইন মেনে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানেই হতে হবে।
শরণার্থীরা যে নামে নিজেদের পরিচয় নির্ধারণ করতে চায়, তা নিয়ে অধিকাংশ আরাকানির বড় ধরনের আপত্তি রয়েছে। ‘রোহিঙ্গা’ পরিভাষাটা অধিকাংশ আরাকানি জনগণ মেনে নিতে চান না। এ পরিভাষাটিকে তাঁরা আপত্তিজনক মনে করেন। কারণ, তারা মনে করে এটা তাদের ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করে দেয়। (অথচ) তারাই এই মাটির আদি বাসিন্দা।
এখানে বিভিন্ন সময়ে মুসলমানেরা এসেছেন। আরাকান ব্রিটিশদের দখলে থাকার সময়েই (১৮২৬-১৯৪৮) তাঁরা ব্যাপক হারে এসেছেন। যারা এখানে বংশপরম্পরায় বসবাস করছেন, তাঁদের আরাকানের নাগরিক হতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এটা তো তাঁদের আত্মপরিচয়েরও প্রশ্ন। (রোহিঙ্গা পরিভাষা নিয়ে সমস্যাটা সেখানেই।)
আরাকানে মুসলমান, বৌদ্ধ, হিন্দু এবং খ্রিষ্টানদের শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু?
থোয়ান ম্রা নাইং: এটা সম্ভব। এ জন্য আমাদের বাইরের সব ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে। একটা গ্রুপকে আরেকটা গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে আরকানে যে পর্যায়ের সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং সাম্প্রদায়িক সংহতি বিরাজ করছে, তেমনটি ১৯৪১ / ৪২ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। এখন সামাজিক স্থিতিশীলতা অনেক ভালো। কমতে শুরু করেছে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। এ অবস্থায় নানা ধরনের ইতিবাচক সামাজিক কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব। এগুলো চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন। সমাজের ভেতর থেকে আরও আরও ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করতে হবে।
রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নিয়ে আপনার মতামত কী?
থোয়ান ম্রা নাইং: এদের কোনোটার সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক নেই। তবে আরসার তুলনায় আরএসও রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি পরিপক্ব। কিন্তু আরসার নেটওয়ার্ক অনেক বিস্তৃত। সংগঠনটি অনেক বেশি সক্রিয়। আরাকানের গ্রামে এবং বাংলাদেশের শরণার্থীশিবিরে আপন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরসার নেতারা যা করছে, তা তো আপনারা নিজ চোখেই দেখছেন। শরণার্থীদের মধ্যে কিছু শিক্ষিত মুসলমান দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে আরসাকে ব্যবহার করছে। সংকটপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশকে তারা নিজেদের আখের গোছাতে কাজে লাগাচ্ছে।
আপনাদের একমাত্র প্রতিবেশী বাংলাদেশ। সীমানার ওপারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও জনগণের সঙ্গে, উদাহরণস্বরূপ মারমা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ককে আপনি কীভাবে দেখেন? আর (আপনাদের সীমান্ত থেকে) সামান্য দূরে অবস্থিত ভারতের বিষয়েই-বা আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
থোয়ান ম্রা নাইং: মারমা এবং মগের (ত্রিপুরার মগ) সঙ্গে আমাদের রক্তের কোনো তফাৎ নেই। তিন দেশের ওই অঞ্চলের সীমান্তবর্তী অন্য জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও একই কথা। আমাদের আন্দোলন নিয়ে তাদের গভীর বোঝাপড়া রয়েছে। তারা আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
আর বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ নয়। তবে এখনো এতটা ভালোও বলা যাবে না। বাংলাদেশ সরকার আমাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে কীভাবে সম্পর্ক রাখতে চায়, তা নিয়ে তাদের কোনো নীতি বা কৌশল এখনো আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
তবে ধীরে ধীরে এ পরিস্থিতির অবশ্যই উন্নতি হবে। নিজ উদ্যোগে তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। সুসম্পর্ক আমাদের উভয় পক্ষের জন্যই কল্যাণকর। শরণার্থী সমস্যা সমাধানে, তহবিল (রাখাইনের রোহিঙ্গাদের মধ্যে) সরবরাহে, মহামারি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে কার্যকর অগ্রগতির জন্য আমাদের মধ্যে সুসম্পর্কের বিকল্প নেই। উভয় সীমান্তের জনগণের ভালো থাকার জন্য স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্য ক্ষেত্রেও আমাদের সম্পর্ক বাড়াতে হবে।
সংঘাতময় আরাকান ও বাদবাকি মিয়ানমারে শান্তি ফেরাতে চীন এবং জাপানের মতো অন্য কোনো দেশ কোনো ভূমিকা রাখতে পারে কি? (এ অঞ্চলে) চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নেতৃত্বের প্রতিযোগিতাকে আপনারা কীভাবে দেখেন?
থোয়ান ম্রা নাইং: তত্ত্বগতভাবে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় (চীন ও জাপান) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু তা বেশ জটিল। পরিবর্তন আসতে হবে (সমাজের/দেশের) ভেতর থেকে। ওই ধরনের পরিবর্তনই আমাদের কাছে বেশি বাস্তবসম্মত, বেশি আবেদনময়। তবে কোনো সমীকরণই এখনো স্পষ্ট নয়। আর যুক্তরাষ্ট্র-চীনের প্রতিযোগিতা আমাদের স্পর্শ করবে না। তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই।
সবশেষে, একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? এবং তা কখন?
থোয়ান ম্রা নাইং: রাজনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটানো এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার সামর্থ্য মিয়ানমারের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিসরে অনুপস্থিত। বামন হয়ে আমি চাঁদে ছুঁতে চাই না ঠিক। কিন্তু জোরপূর্বক যারা আমাদের বঞ্চিত করেছে, সেই শত্রুদের থেকে আমাদের প্রত্যাশার কিছু নেই।
শত্রুরা যাই ভাবুক না কেন, নিজ হাতেই আমরা আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করব। নিজেদের ভিত্তিভূমিতেই নির্মাণ করব স্বপ্নের সৌধ, যা আমাদের একান্ত প্রাপ্য। আমাদের হারানো সার্বভৌমত্ব ফিরে পাওয়া এবং আরকানের ন্যায্য রাজনৈতিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারই আমার জীবনের ব্রত।
ইউনিক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত হোসেন। পর্যটনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি মনজুরুল ইসলাম।
০৩ অক্টোবর ২০২৪বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, সুফি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোনো বিভাজনমূলক এজেন্ডায় রাজনীতির দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত না হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা দৃঢ়ভাবে কোনো সাম্প্রদায়িক ফাঁদে আটকা পড়তে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করি। কোনোভাবেই তা হতে দেওয়া যাবে না।
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪‘আমি এটাকে ঠিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বলব না। আমি এটাকে বলব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সেটা আমার পারিবারিক শিক্ষা। আমাদের ঘরের ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে যেকোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পরিবারের বড়দের সাথে আমরা দ্বিমত পোষণ করতে পেরেছি। ছোট থেকে বড়, কারও কোনো কথা বা কাজ ভুল মনে হলে সেটাকে আমরা তার প্রতি স
৩১ আগস্ট ২০২৪একেক মানুষ বেছে নেন একেক পেশা। তাঁদের মধ্যে কারও কারও পেশা একটু ভিন্ন ধরনের। যেমন—মো. মুনসুর আলী ওরফে মন্টু খলিফা। বাপ-দাদার পেশাকে ভালোবেসে শিশুদের খতনা করানো বা হাজামের কাজ বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। জীবনে পার করেছেন প্রায় ৮৫ বছর। জানিয়েছেন গত ৬০ বছরে ২ লাখের বেশি শিশুর মুসলমানি বা সুন্নতে খতনা দিয়
৩০ মার্চ ২০২৪