অনলাইন ডেস্ক
প্রায় ছয় দশকের জীবনের ৩৭ বছর কাটিয়েছেন সাংবাদিকতায়। প্রাণনাশের হুমকি উপেক্ষা করে শাসকদের অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতিকে উন্মোচন করেছেন অবিরত। একনায়ক রদ্রিগো দুতার্তের ফিলিপাইনের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই ছিল আপসহীন। সেই লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ‘হাউ টু ফাইট আ ডিক্টেটর’ নামে বই। তিনি আর কেউ নন, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসা।
ফিলিপাইন সরকারের ‘মাথাব্যথা’ হয়ে উঠেছিল র্যাপলার নামে যে সংবাদমাধ্যম, তা তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১২ সাল থেকে এর প্রধান নির্বাহী তিনি। ২০২১ সালে রুশ সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জেতেন মারিয়া।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, দুতার্তে ২০১৬ সালে মাদকের বিরুদ্ধে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তাতে তিন বছরে ফিলিপাইনে অন্তত ২৭ হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। এর মধ্যে বেশির ভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
সাবেক প্রেসিডেন্ট দুতার্তের অপশাসনের সমালোচনায় মুখর ছিলেন মারিয়া রেসা। দুতার্তে তাঁর বিরুদ্ধে পাল্টা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন। দীর্ঘ দুই দশক যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনের এশিয়াবিষয়ক প্রতিবেদক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।
চ্যাট জিপিটির বিপদ, সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, নির্বাচন ও মানসম্মত সাংবাদিকতা নিয়ে সম্প্রতি মারিয়া রেসার সঙ্গে কথা বলেছেন ওয়ার্ল্ড এডিটরস ফোরাম বোর্ডের সদস্য ফার্নান্দো বেলজুন্স। তাঁর সেই সাক্ষাৎকার স্প্যানিশ সংবাদপত্র এল কোরেও ও এবিসিতে প্রথম প্রকাশিত হয়।
ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত মারিয়া রেসা বিশ্বের সবচেয়ে প্রশংসিত সাংবাদিকদের একজন এবং একই সঙ্গে নির্যাতিত সাংবাদিকদেরও একজন। তাঁর বিরুদ্ধে ফিলিপাইন সরকার অসংখ্য মামলা করেছে। গত ১৮ জানুয়ারি কর ফাঁকির এক মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। তবে অন্যান্য মামলায় তাঁকে কারাগারে পাঠানো হতে পারে বলে আশঙ্কা আছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, মারিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসের ছেলে বংবং মার্কোস এখন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট। তিনিও রেসার বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধের পূর্বাভাস দিয়েছেন।
শান্তিতে নোবেল পদকও কী আপনাকে রাজনৈতিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারছে না?
মারিয়া: সবচেয়ে খারাপ কিছুর জন্য আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এই মামলাগুলো আদালত পর্যন্ত যাবে বলে আমি কখনো ভাবিনি। তার পরও কর ফাঁকির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেতে আমাকে চার বছর দুই মাস লড়াই করতে হলো। রায় থেকে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে মামলাটি খুবই হাস্যকর ছিল। এই মামলা চলার মধ্যেই আমি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। আমার বিরুদ্ধে আরও মামলা রয়েছে। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চিকে দেখুন, তিনিও নোবেল পেয়েছিলেন এবং তিনি এখন মিয়ানমারে আটক রয়েছেন। যা হোক, সাংবাদিকেরা এখন যেভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, আগে তেমনটা হয়নি।
স্বৈরশাসক মার্কোসকে যেদিন ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, সেদিন ফিলিপাইনে জাতীয় ছুটি ছিল। আপনি কি মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম না থাকলে আপনার ছেলে নির্বাচনে জিতত?
মারিয়া: না, তা কখনোই মনে করি না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মার্কোসের নামকে পরিশুদ্ধ করার অভিযান শুরু হয়েছিল ২০১৪ সাল থেকে। আমরা র্যাপলারে দেখিয়েছি, তাঁদের লক্ষ্য ছিল মার্কোসের নাম থেকে দুর্নীতির সম্পর্ক মুছে ফেলা এবং তাঁকে ফিলিপাইনের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা নেতায় পরিণত করা। এটা ছিল গণতন্ত্রের মৃত্যু। ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে বদলে গেছে। লেখক মিলন কুন্ডেরা বলেছেন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। স্বৈরশাসক মার্কোস হঠাৎ নায়ক হয়ে ওঠে, এটি আমরা ভুলতে পারি না।
এখন তাঁর ছেলে ক্ষমতায়…
মারিয়া: মার্কোস জুনিয়র তাঁর বাবার রাজনৈতিক জোটগুলোকে পুনরায় একত্রিত করেছেন। তাঁর মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্য তাঁর বাবার শাসনামলের মন্ত্রীদের সন্তান বা নাতি-নাতনি। এটি একধরনের সামন্ত রাজবংশীয় রাজনীতি, যার প্রভাব ফিলিপাইন অঞ্চলে অনেক বেশি। তারা তাঁকে ভোট পেতে সাহায্য করেছে। এ ছাড়া তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের মেয়ে সারা দুতার্তেকেও নিজের জোটে ভিড়িয়েছেন। সারা যদি মার্কোস জুনিয়রের বিরুদ্ধে নির্বাচন করতেন, তবে ফলাফল হয়তো অন্যরকম হতো।
বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিরুদ্ধে ১৪০টিরও বেশি সংগঠন একজোট হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সেটি শুরু করতে আপনারা এত দেরি করলেন কেন?
মারিয়া: আমরা নির্বাচনের ১০০ দিন আগে এটি চালু করেছিলাম। সত্যি বলতে কি, দেরিই হয়ে গেছে। আরও আগে শুরু করা উচিত ছিল। যা হোক, আমরা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছি, অনেক মিথ্যা তথ্যের একমাত্র উৎস ছিল ফেসবুক।
ফিলিপাইনের সমাজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এত প্রভাব কেন?
মারিয়া: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের দিক থেকে টানা ছয় বছর ফিলিপাইন বিশ্ব রেকর্ড ধরে রেখেছে। এর একটি বড় কারণ, দেশটির জনসংখ্যার অন্তত ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ১ কোটি থেকে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বিদেশে থাকে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনেকটা বিনা মূল্যেই তারা এসব সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারে। অন্যদিকে দুর্নীতির কারণে যেকোনো সরকারি সেবা নিতে গেলে বাড়তি উৎকোচ দিতে হয়। অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা তো রয়েছেই। এসব কারণে বেশির ভাগ মানুষ কম্পিউটার এড়িয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহারে ঝুঁকে পড়েছে।
দুতার্তে সামাজিকমাধ্যমের তারকাদের ওপর নির্ভর করেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ভালো সাংবাদিকতা কি সামাজিকমাধ্যমের জনপ্রিয়তাকে জয় করতে পারবে?
মারিয়া: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা টিকতে পারবে না। আমরা সবকিছুকেই পণ্য বানিয়েছি। আমি আমার সাংবাদিকদের ‘জনপ্রিয়তার র্যাঙ্কিং’ দেখতে দিই না, কারণ জনপ্রিয়তা কোনো মাপকাঠি হতে পারে না। আমাদের কাজ হচ্ছে ক্ষমতাকাঠামোকে জবাবদিহির আওতায় আনা।
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার একজন নির্বাহী আপনার কাছে স্বীকার করেছেন যে তারা যুক্তরাষ্ট্রে যে ম্যানিপুলেশন প্রচারণা প্রয়োগ করেছিলেন, সেটির পরীক্ষা তারা ফিলিপাইনে করেছিলেন। তাহলে গণতন্ত্র নিজেকে রক্ষা করবে কীভাবে?
মারিয়া: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। এর জবাবদিহির দাবি জোরদার করতে হবে এবং দায়মুক্তি বন্ধ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো সত্যের চেয়ে মিথ্যা প্রচারকে বেশি প্রাধান্য দেয়। তারা প্রতারণামূলকভাবে আমাদের আবেগকে প্রভাবিত করে। ফলে আমরা সত্য ও মিথ্যাকে আলাদা করতে পারি না। এসব দিক বিবেচনা করলে বলা যায়, মার্ক জাকারবার্গ সবচেয়ে বড় একনায়ক। তিনি যেকোনো রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী নেতার চেয়ে অনেক বেশি স্বৈরাচারী।
আপনি ফেসবুকের ঝুঁকিগুলো কীভাবে আবিষ্কার করেছিলেন?
মারিয়া: ২০১৬ সালের ঘটনা। দুতার্তে তখন মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং প্রতি রাতে অসংখ্য মানুষকে মেরে ফেলতে শুরু করেন, তখন ফেসবুকে কেউ এ ব্যাপারে রিপোর্ট করা মাত্রই নির্যাতনের শিকার হতেন। আমরা ওই বছরের আগস্টে ‘হ্যাশট্যাগ নো প্লেস ফর হেট’ চালু করেছিলাম। এর মাধ্যমে আমরা আসলে ডিজিটাল যুদ্ধ শুরু করি। সে সময় আমি অসংখ্য ডেটা সংগ্রহ করেছিলাম এবং ইন্টারনেটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ওপর একটি সিরিজ শুরু করেছিলাম। তার আগে আমার কল্পনাতেও ছিল না যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো স্বৈরশাসকদের উত্থানের পক্ষে কাজ করবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কি তথ্য বিতরণের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে?
মারিয়া: হ্যাঁ, এটিই প্রধান সমস্যা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যে কাঠামো, তা অপসাংবাদিকতা ও মিথ্যাকেই পুরস্কৃত করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসলে ডেটা সঞ্চালনের নল বা টিউব হিসেবে কাজ করে।
মারিয়া: ১৯৯৬ সালের মার্কিন কমিউনিকেশন ডিসেন্সি আইনের ২৩০ ধারায় এই প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের আসলে পাইপলাইন হিসেবেই গণ্য করা হয়। অনেকটা টেলিফোনের মতো। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমগুলো তো প্রকৃতপক্ষে সেভাবে কাজ করে না। টেলিফোন হচ্ছে সমস্ত কল আসার মাধ্যম। কিন্তু সামাজিক নেটওয়ার্কের অ্যালগরিদম নিজেরাই ঠিক করে দেয়, তারা আপনাকে কী তথ্য দেবে! সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো নিজেরাই সম্পাদক হিসেবে কাজ করে। সুতরাং ২৩০ ধারা বাতিল করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোকে যখন মিথ্যা তথ্যের জন্য জবাবদিহি করতে হবে, তখন তারা এমনিতেই হারিয়ে যাবে।
সত্যের সর্বজনীন ধারণা হঠাৎ করেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা কি ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করছি?
মারিয়া: নিঃসন্দেহে আমরা গণতন্ত্রের মৃত্যু দেখছি। আর এটি দেখার একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে সাংবাদিকেরা। আমরা এখন নানা দিক থেকে সংকটের মুখে। বিজ্ঞাপনের বাজার, সাংবাদিকতার ব্যবসায়িক মডেল… সবকিছুকে গিলে ফেলেছে সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলো। কয়েক বছর আগেও ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের প্রশ্ন করা যেত। এখন তাদের কোনো প্রশ্ন করা যায় না। উল্টো তাদের আক্রমণের শিকার হতে হয়। আমাদের ওপর আক্রমণ, হুমকি, মানসিক চাপ—এ সবই হিমশৈলের চূড়ামাত্র।
চারজন নারী মিলে র্যাপলার প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এর সম্পাদকীয় পরিষদের মধ্যে নারী সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। আপনাকে যে ধরনের আক্রমণ করা হয়, তার মধ্যে যৌন আক্রমণও রয়েছে। আপনি কি মনে করেন, এটি নারী হওয়ার কারণেই?
মারিয়া: তথ্য আসলে সেটাই বলে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্ট নামের একটি সংগঠন আমাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হওয়া পাঁচ লাখের বেশি আক্রমণ বিশ্লেষণ করেছে। তারা বলেছে, ৬০ ভাগ আক্রমণ ছিল আমার বিশ্বাসযোগ্যতাকে নষ্ট করার লক্ষ্যে এবং ৪০ ভাগ আক্রমণ ছিল আমার মনোবল ভেঙে ফেলার উদ্দেশ্যে। তবে আমিই একমাত্র নারী নই, যিনি এ সমস্যায় ভুগছি। যৌন আক্রমণ হচ্ছে একটি লিঙ্গ বিভ্রান্তিকর শব্দ। পুরুষেরা এ ধরনের আক্রমণের শিকার হন না, তা তো নয়। তবে নারীদের যেভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়, পুরুষের ক্ষেত্রে ততটা হয় না। সহজাত লিঙ্গবাদ ও নারীবিদ্বেষ তো থাকবেই।
আপনার যৌন পরিচয়ের কারণে আপনার ওপর আক্রমণ বেশি হয় বলে কি মনে করেন?
মারিয়া: না, ফিলিপাইনে নয়। আমি ৩৭ বছর সাংবাদিকতা করেছি এবং আমি এমন এক দেশে কাজ করেছি, যেখানে সমকামী হওয়াও অবৈধ। কিন্তু ফিলিপাইনে এটি কোনো সমস্যা নয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশৃঙ্খলা আরও বাড়িয়ে তোলার ব্যাপারে আপনি কি উদ্বিগ্ন?
মারিয়া: হ্যাঁ, আমি অবশ্যই উদ্বিগ্ন। সবকিছুই খারাপ হতে যাচ্ছে, এটি আমরা সবাই জানি, তাই না? আমরা জিপিটি-৩-এর মাধ্যমে তৈরি করা স্বয়ংক্রিয় কিছু নিবন্ধ র্যাপলারে প্রকাশ করেছি। তার আগে আমরা নিবন্ধগুলো পর্যালোচনা করেছি এবং সতর্কতার সঙ্গে স্বাক্ষর করেছি। লেখাগুলো নিঃসন্দেহে ভালো, তবে তা কাল্পনিক তথ্য ও প্রকৃত তথ্যের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। প্রোগ্রামটিতে সব তথ্যই একসঙ্গে রাখা। ফলে প্রোগ্রামের ভেতরে আবর্জনা থাকলে আবর্জনাই বেরিয়ে আসে।
‘সত্যের অনুপস্থিতি’ নামের একটি তথ্যচিত্রে দেখা গেছে প্রেসিডেন্ট দুতার্তে র্যাপলারের এক তরুণ সাংবাদিককে হুমকি দিচ্ছেন এই বলে—‘আপনি সমালোচনা করতে পারেন, কিন্তু আপনি কারাগারে যাবেন।’ তখন অন্য সাংবাদিকেরা নীরব ছিলেন। আপনি কি মনে করেন, ফিলিপাইনের অন্য সাংবাদিকেরা আপনাকে সমর্থন করবেন?
মারিয়া: এটি একটি জটিল প্রশ্ন। কারণ নীরবতা একটা জটিল ব্যাপার। কিছু সংবাদ সংস্থা তখন সমর্থন দিয়েছিল বটে। তবে তারা ভয় থেকেই এমনটা করেছিল। আমি তাদের সাবধানতাটুকু বুঝি। বিশেষ করে করপোরেট সংস্থাগুলোর অবস্থা দেখুন। এবিএস-সিবিএন টেলিভিশন তাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি হারিয়েছে। ওই টেলিভিশনটি আগে আমি চালিয়েছি।
আপনার বইতে আপনি আপনার শৈশব নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। ফিলিপাইন ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার ঘটনা রয়েছে সেখানে। আপনার মধ্যে এক ধরনের শিকড়হীনতা ও শূন্যতাবোধ রয়েছে। আপনার জীবনের এই অভিজ্ঞতাগুলো আপনার সাংবাদিকতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধ লড়াইয়ের ব্যাপারে সাহায্য করেছে বলে মনে করেন কি?
মারিয়া: আসলে কী বলব…সাংবাদিকতা আমাকে জীবন দিয়েছে। এর মধ্যে সত্যিই জীবনদায়ী একটা ব্যাপার আছে। আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছি।
আপনি প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন এবং পুলিশ মাঝে মাঝেই বিমানবন্দরে আপনার জন্য অপেক্ষা করে। আপনি কি ফিলিপাইনে না ফেরার ব্যাপারে কখনো প্রলুব্ধ হয়েছেন?
মারিয়া: না। সেটি করলে বিরাট বড় বিশ্বাসঘাতকতা হবে। র্যাপলারের ওপর আমার বিশ্বাস রয়েছে। র্যাপলার টিম এই কঠিন সময়ে দুর্দান্ত কাজ করছে। আমি এই টিম নিয়ে গর্বিত। ফিলিপাইন খুবই কঠিন সময় পার করছে। দুর্ভাগ্যক্রমে দুতার্তে আমাদের বেছে নিয়েছিলেন। তাই আমাদেরও কোনো বিকল্প ছিল না। আমার নিজের সম্পর্কে ও সাংবাদিকতা সম্পর্কে যদি সব বিশ্বাস ছেড়ে দিই, তবে আমার উচিত র্যাপলারকে ছেড়ে দেওয়া। আপনি যখন নানা ধরনের পরীক্ষার মধ্যে পড়বেন, তখনই আপনি নিজেকে চিনতে পারবেন। আমাকে অবশ্যই আশাবাদী হতে হবে।
সূত্র: ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজ পাবলিশার্স
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মারুফ ইসলাম
প্রায় ছয় দশকের জীবনের ৩৭ বছর কাটিয়েছেন সাংবাদিকতায়। প্রাণনাশের হুমকি উপেক্ষা করে শাসকদের অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতিকে উন্মোচন করেছেন অবিরত। একনায়ক রদ্রিগো দুতার্তের ফিলিপাইনের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই ছিল আপসহীন। সেই লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ‘হাউ টু ফাইট আ ডিক্টেটর’ নামে বই। তিনি আর কেউ নন, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসা।
ফিলিপাইন সরকারের ‘মাথাব্যথা’ হয়ে উঠেছিল র্যাপলার নামে যে সংবাদমাধ্যম, তা তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১২ সাল থেকে এর প্রধান নির্বাহী তিনি। ২০২১ সালে রুশ সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জেতেন মারিয়া।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, দুতার্তে ২০১৬ সালে মাদকের বিরুদ্ধে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তাতে তিন বছরে ফিলিপাইনে অন্তত ২৭ হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। এর মধ্যে বেশির ভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
সাবেক প্রেসিডেন্ট দুতার্তের অপশাসনের সমালোচনায় মুখর ছিলেন মারিয়া রেসা। দুতার্তে তাঁর বিরুদ্ধে পাল্টা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন। দীর্ঘ দুই দশক যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনের এশিয়াবিষয়ক প্রতিবেদক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।
চ্যাট জিপিটির বিপদ, সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, নির্বাচন ও মানসম্মত সাংবাদিকতা নিয়ে সম্প্রতি মারিয়া রেসার সঙ্গে কথা বলেছেন ওয়ার্ল্ড এডিটরস ফোরাম বোর্ডের সদস্য ফার্নান্দো বেলজুন্স। তাঁর সেই সাক্ষাৎকার স্প্যানিশ সংবাদপত্র এল কোরেও ও এবিসিতে প্রথম প্রকাশিত হয়।
ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত মারিয়া রেসা বিশ্বের সবচেয়ে প্রশংসিত সাংবাদিকদের একজন এবং একই সঙ্গে নির্যাতিত সাংবাদিকদেরও একজন। তাঁর বিরুদ্ধে ফিলিপাইন সরকার অসংখ্য মামলা করেছে। গত ১৮ জানুয়ারি কর ফাঁকির এক মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। তবে অন্যান্য মামলায় তাঁকে কারাগারে পাঠানো হতে পারে বলে আশঙ্কা আছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, মারিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসের ছেলে বংবং মার্কোস এখন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট। তিনিও রেসার বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধের পূর্বাভাস দিয়েছেন।
শান্তিতে নোবেল পদকও কী আপনাকে রাজনৈতিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারছে না?
মারিয়া: সবচেয়ে খারাপ কিছুর জন্য আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এই মামলাগুলো আদালত পর্যন্ত যাবে বলে আমি কখনো ভাবিনি। তার পরও কর ফাঁকির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেতে আমাকে চার বছর দুই মাস লড়াই করতে হলো। রায় থেকে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে মামলাটি খুবই হাস্যকর ছিল। এই মামলা চলার মধ্যেই আমি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। আমার বিরুদ্ধে আরও মামলা রয়েছে। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চিকে দেখুন, তিনিও নোবেল পেয়েছিলেন এবং তিনি এখন মিয়ানমারে আটক রয়েছেন। যা হোক, সাংবাদিকেরা এখন যেভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, আগে তেমনটা হয়নি।
স্বৈরশাসক মার্কোসকে যেদিন ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, সেদিন ফিলিপাইনে জাতীয় ছুটি ছিল। আপনি কি মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম না থাকলে আপনার ছেলে নির্বাচনে জিতত?
মারিয়া: না, তা কখনোই মনে করি না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মার্কোসের নামকে পরিশুদ্ধ করার অভিযান শুরু হয়েছিল ২০১৪ সাল থেকে। আমরা র্যাপলারে দেখিয়েছি, তাঁদের লক্ষ্য ছিল মার্কোসের নাম থেকে দুর্নীতির সম্পর্ক মুছে ফেলা এবং তাঁকে ফিলিপাইনের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা নেতায় পরিণত করা। এটা ছিল গণতন্ত্রের মৃত্যু। ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে বদলে গেছে। লেখক মিলন কুন্ডেরা বলেছেন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। স্বৈরশাসক মার্কোস হঠাৎ নায়ক হয়ে ওঠে, এটি আমরা ভুলতে পারি না।
এখন তাঁর ছেলে ক্ষমতায়…
মারিয়া: মার্কোস জুনিয়র তাঁর বাবার রাজনৈতিক জোটগুলোকে পুনরায় একত্রিত করেছেন। তাঁর মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্য তাঁর বাবার শাসনামলের মন্ত্রীদের সন্তান বা নাতি-নাতনি। এটি একধরনের সামন্ত রাজবংশীয় রাজনীতি, যার প্রভাব ফিলিপাইন অঞ্চলে অনেক বেশি। তারা তাঁকে ভোট পেতে সাহায্য করেছে। এ ছাড়া তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের মেয়ে সারা দুতার্তেকেও নিজের জোটে ভিড়িয়েছেন। সারা যদি মার্কোস জুনিয়রের বিরুদ্ধে নির্বাচন করতেন, তবে ফলাফল হয়তো অন্যরকম হতো।
বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিরুদ্ধে ১৪০টিরও বেশি সংগঠন একজোট হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সেটি শুরু করতে আপনারা এত দেরি করলেন কেন?
মারিয়া: আমরা নির্বাচনের ১০০ দিন আগে এটি চালু করেছিলাম। সত্যি বলতে কি, দেরিই হয়ে গেছে। আরও আগে শুরু করা উচিত ছিল। যা হোক, আমরা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছি, অনেক মিথ্যা তথ্যের একমাত্র উৎস ছিল ফেসবুক।
ফিলিপাইনের সমাজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এত প্রভাব কেন?
মারিয়া: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের দিক থেকে টানা ছয় বছর ফিলিপাইন বিশ্ব রেকর্ড ধরে রেখেছে। এর একটি বড় কারণ, দেশটির জনসংখ্যার অন্তত ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ১ কোটি থেকে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বিদেশে থাকে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনেকটা বিনা মূল্যেই তারা এসব সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারে। অন্যদিকে দুর্নীতির কারণে যেকোনো সরকারি সেবা নিতে গেলে বাড়তি উৎকোচ দিতে হয়। অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা তো রয়েছেই। এসব কারণে বেশির ভাগ মানুষ কম্পিউটার এড়িয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহারে ঝুঁকে পড়েছে।
দুতার্তে সামাজিকমাধ্যমের তারকাদের ওপর নির্ভর করেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ভালো সাংবাদিকতা কি সামাজিকমাধ্যমের জনপ্রিয়তাকে জয় করতে পারবে?
মারিয়া: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা টিকতে পারবে না। আমরা সবকিছুকেই পণ্য বানিয়েছি। আমি আমার সাংবাদিকদের ‘জনপ্রিয়তার র্যাঙ্কিং’ দেখতে দিই না, কারণ জনপ্রিয়তা কোনো মাপকাঠি হতে পারে না। আমাদের কাজ হচ্ছে ক্ষমতাকাঠামোকে জবাবদিহির আওতায় আনা।
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার একজন নির্বাহী আপনার কাছে স্বীকার করেছেন যে তারা যুক্তরাষ্ট্রে যে ম্যানিপুলেশন প্রচারণা প্রয়োগ করেছিলেন, সেটির পরীক্ষা তারা ফিলিপাইনে করেছিলেন। তাহলে গণতন্ত্র নিজেকে রক্ষা করবে কীভাবে?
মারিয়া: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। এর জবাবদিহির দাবি জোরদার করতে হবে এবং দায়মুক্তি বন্ধ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো সত্যের চেয়ে মিথ্যা প্রচারকে বেশি প্রাধান্য দেয়। তারা প্রতারণামূলকভাবে আমাদের আবেগকে প্রভাবিত করে। ফলে আমরা সত্য ও মিথ্যাকে আলাদা করতে পারি না। এসব দিক বিবেচনা করলে বলা যায়, মার্ক জাকারবার্গ সবচেয়ে বড় একনায়ক। তিনি যেকোনো রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী নেতার চেয়ে অনেক বেশি স্বৈরাচারী।
আপনি ফেসবুকের ঝুঁকিগুলো কীভাবে আবিষ্কার করেছিলেন?
মারিয়া: ২০১৬ সালের ঘটনা। দুতার্তে তখন মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং প্রতি রাতে অসংখ্য মানুষকে মেরে ফেলতে শুরু করেন, তখন ফেসবুকে কেউ এ ব্যাপারে রিপোর্ট করা মাত্রই নির্যাতনের শিকার হতেন। আমরা ওই বছরের আগস্টে ‘হ্যাশট্যাগ নো প্লেস ফর হেট’ চালু করেছিলাম। এর মাধ্যমে আমরা আসলে ডিজিটাল যুদ্ধ শুরু করি। সে সময় আমি অসংখ্য ডেটা সংগ্রহ করেছিলাম এবং ইন্টারনেটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ওপর একটি সিরিজ শুরু করেছিলাম। তার আগে আমার কল্পনাতেও ছিল না যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো স্বৈরশাসকদের উত্থানের পক্ষে কাজ করবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কি তথ্য বিতরণের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে?
মারিয়া: হ্যাঁ, এটিই প্রধান সমস্যা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যে কাঠামো, তা অপসাংবাদিকতা ও মিথ্যাকেই পুরস্কৃত করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসলে ডেটা সঞ্চালনের নল বা টিউব হিসেবে কাজ করে।
মারিয়া: ১৯৯৬ সালের মার্কিন কমিউনিকেশন ডিসেন্সি আইনের ২৩০ ধারায় এই প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের আসলে পাইপলাইন হিসেবেই গণ্য করা হয়। অনেকটা টেলিফোনের মতো। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমগুলো তো প্রকৃতপক্ষে সেভাবে কাজ করে না। টেলিফোন হচ্ছে সমস্ত কল আসার মাধ্যম। কিন্তু সামাজিক নেটওয়ার্কের অ্যালগরিদম নিজেরাই ঠিক করে দেয়, তারা আপনাকে কী তথ্য দেবে! সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো নিজেরাই সম্পাদক হিসেবে কাজ করে। সুতরাং ২৩০ ধারা বাতিল করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোকে যখন মিথ্যা তথ্যের জন্য জবাবদিহি করতে হবে, তখন তারা এমনিতেই হারিয়ে যাবে।
সত্যের সর্বজনীন ধারণা হঠাৎ করেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা কি ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করছি?
মারিয়া: নিঃসন্দেহে আমরা গণতন্ত্রের মৃত্যু দেখছি। আর এটি দেখার একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে সাংবাদিকেরা। আমরা এখন নানা দিক থেকে সংকটের মুখে। বিজ্ঞাপনের বাজার, সাংবাদিকতার ব্যবসায়িক মডেল… সবকিছুকে গিলে ফেলেছে সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলো। কয়েক বছর আগেও ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের প্রশ্ন করা যেত। এখন তাদের কোনো প্রশ্ন করা যায় না। উল্টো তাদের আক্রমণের শিকার হতে হয়। আমাদের ওপর আক্রমণ, হুমকি, মানসিক চাপ—এ সবই হিমশৈলের চূড়ামাত্র।
চারজন নারী মিলে র্যাপলার প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এর সম্পাদকীয় পরিষদের মধ্যে নারী সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। আপনাকে যে ধরনের আক্রমণ করা হয়, তার মধ্যে যৌন আক্রমণও রয়েছে। আপনি কি মনে করেন, এটি নারী হওয়ার কারণেই?
মারিয়া: তথ্য আসলে সেটাই বলে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্ট নামের একটি সংগঠন আমাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হওয়া পাঁচ লাখের বেশি আক্রমণ বিশ্লেষণ করেছে। তারা বলেছে, ৬০ ভাগ আক্রমণ ছিল আমার বিশ্বাসযোগ্যতাকে নষ্ট করার লক্ষ্যে এবং ৪০ ভাগ আক্রমণ ছিল আমার মনোবল ভেঙে ফেলার উদ্দেশ্যে। তবে আমিই একমাত্র নারী নই, যিনি এ সমস্যায় ভুগছি। যৌন আক্রমণ হচ্ছে একটি লিঙ্গ বিভ্রান্তিকর শব্দ। পুরুষেরা এ ধরনের আক্রমণের শিকার হন না, তা তো নয়। তবে নারীদের যেভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়, পুরুষের ক্ষেত্রে ততটা হয় না। সহজাত লিঙ্গবাদ ও নারীবিদ্বেষ তো থাকবেই।
আপনার যৌন পরিচয়ের কারণে আপনার ওপর আক্রমণ বেশি হয় বলে কি মনে করেন?
মারিয়া: না, ফিলিপাইনে নয়। আমি ৩৭ বছর সাংবাদিকতা করেছি এবং আমি এমন এক দেশে কাজ করেছি, যেখানে সমকামী হওয়াও অবৈধ। কিন্তু ফিলিপাইনে এটি কোনো সমস্যা নয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশৃঙ্খলা আরও বাড়িয়ে তোলার ব্যাপারে আপনি কি উদ্বিগ্ন?
মারিয়া: হ্যাঁ, আমি অবশ্যই উদ্বিগ্ন। সবকিছুই খারাপ হতে যাচ্ছে, এটি আমরা সবাই জানি, তাই না? আমরা জিপিটি-৩-এর মাধ্যমে তৈরি করা স্বয়ংক্রিয় কিছু নিবন্ধ র্যাপলারে প্রকাশ করেছি। তার আগে আমরা নিবন্ধগুলো পর্যালোচনা করেছি এবং সতর্কতার সঙ্গে স্বাক্ষর করেছি। লেখাগুলো নিঃসন্দেহে ভালো, তবে তা কাল্পনিক তথ্য ও প্রকৃত তথ্যের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। প্রোগ্রামটিতে সব তথ্যই একসঙ্গে রাখা। ফলে প্রোগ্রামের ভেতরে আবর্জনা থাকলে আবর্জনাই বেরিয়ে আসে।
‘সত্যের অনুপস্থিতি’ নামের একটি তথ্যচিত্রে দেখা গেছে প্রেসিডেন্ট দুতার্তে র্যাপলারের এক তরুণ সাংবাদিককে হুমকি দিচ্ছেন এই বলে—‘আপনি সমালোচনা করতে পারেন, কিন্তু আপনি কারাগারে যাবেন।’ তখন অন্য সাংবাদিকেরা নীরব ছিলেন। আপনি কি মনে করেন, ফিলিপাইনের অন্য সাংবাদিকেরা আপনাকে সমর্থন করবেন?
মারিয়া: এটি একটি জটিল প্রশ্ন। কারণ নীরবতা একটা জটিল ব্যাপার। কিছু সংবাদ সংস্থা তখন সমর্থন দিয়েছিল বটে। তবে তারা ভয় থেকেই এমনটা করেছিল। আমি তাদের সাবধানতাটুকু বুঝি। বিশেষ করে করপোরেট সংস্থাগুলোর অবস্থা দেখুন। এবিএস-সিবিএন টেলিভিশন তাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি হারিয়েছে। ওই টেলিভিশনটি আগে আমি চালিয়েছি।
আপনার বইতে আপনি আপনার শৈশব নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। ফিলিপাইন ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার ঘটনা রয়েছে সেখানে। আপনার মধ্যে এক ধরনের শিকড়হীনতা ও শূন্যতাবোধ রয়েছে। আপনার জীবনের এই অভিজ্ঞতাগুলো আপনার সাংবাদিকতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধ লড়াইয়ের ব্যাপারে সাহায্য করেছে বলে মনে করেন কি?
মারিয়া: আসলে কী বলব…সাংবাদিকতা আমাকে জীবন দিয়েছে। এর মধ্যে সত্যিই জীবনদায়ী একটা ব্যাপার আছে। আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছি।
আপনি প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন এবং পুলিশ মাঝে মাঝেই বিমানবন্দরে আপনার জন্য অপেক্ষা করে। আপনি কি ফিলিপাইনে না ফেরার ব্যাপারে কখনো প্রলুব্ধ হয়েছেন?
মারিয়া: না। সেটি করলে বিরাট বড় বিশ্বাসঘাতকতা হবে। র্যাপলারের ওপর আমার বিশ্বাস রয়েছে। র্যাপলার টিম এই কঠিন সময়ে দুর্দান্ত কাজ করছে। আমি এই টিম নিয়ে গর্বিত। ফিলিপাইন খুবই কঠিন সময় পার করছে। দুর্ভাগ্যক্রমে দুতার্তে আমাদের বেছে নিয়েছিলেন। তাই আমাদেরও কোনো বিকল্প ছিল না। আমার নিজের সম্পর্কে ও সাংবাদিকতা সম্পর্কে যদি সব বিশ্বাস ছেড়ে দিই, তবে আমার উচিত র্যাপলারকে ছেড়ে দেওয়া। আপনি যখন নানা ধরনের পরীক্ষার মধ্যে পড়বেন, তখনই আপনি নিজেকে চিনতে পারবেন। আমাকে অবশ্যই আশাবাদী হতে হবে।
সূত্র: ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজ পাবলিশার্স
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মারুফ ইসলাম
ইউনিক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত হোসেন। পর্যটনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি মনজুরুল ইসলাম।
০৩ অক্টোবর ২০২৪বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, সুফি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোনো বিভাজনমূলক এজেন্ডায় রাজনীতির দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত না হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা দৃঢ়ভাবে কোনো সাম্প্রদায়িক ফাঁদে আটকা পড়তে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করি। কোনোভাবেই তা হতে দেওয়া যাবে না।
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪‘আমি এটাকে ঠিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বলব না। আমি এটাকে বলব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সেটা আমার পারিবারিক শিক্ষা। আমাদের ঘরের ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে যেকোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পরিবারের বড়দের সাথে আমরা দ্বিমত পোষণ করতে পেরেছি। ছোট থেকে বড়, কারও কোনো কথা বা কাজ ভুল মনে হলে সেটাকে আমরা তার প্রতি স
৩১ আগস্ট ২০২৪একেক মানুষ বেছে নেন একেক পেশা। তাঁদের মধ্যে কারও কারও পেশা একটু ভিন্ন ধরনের। যেমন—মো. মুনসুর আলী ওরফে মন্টু খলিফা। বাপ-দাদার পেশাকে ভালোবেসে শিশুদের খতনা করানো বা হাজামের কাজ বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। জীবনে পার করেছেন প্রায় ৮৫ বছর। জানিয়েছেন গত ৬০ বছরে ২ লাখের বেশি শিশুর মুসলমানি বা সুন্নতে খতনা দিয়
৩০ মার্চ ২০২৪