ফাতিমা জাহান
আপনি একা একা ভ্রমণ করছেন। একা ভ্রমণের শুরু কবে থেকে এবং কেন?
ফাতিমা: স্বাভাবিকভাবে সবাই একা ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন না। হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে, আর না হয় পরিবারের সঙ্গে ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। আমি আসলে পড়াশোনা করেছি বেঙ্গালুরুর বোর্ডিং স্কুলে। বোর্ডিং স্কুল থেকে বাড়িতে খুব কম সময় আসা হতো। ঢাকা থেকে বেঙ্গালুরুর দূরত্বের কারণে এমনও দেখা গেছে, দুই বছরে একবার বাড়িতে এসেছি। ছুটিতে বেশির ভাগ সময় আমাকে বোর্ডিং স্কুলে থাকতে হতো। কারণ, ছুটি থাকত কম; মাত্র ৩ থেকে ৪ দিন। আর বাবা–মা খুব কড়া ছিলেন। তাঁরা চাইতেন না এত কম সময়ের ছুটিতে আমি বাড়িতে আসি। সময় নষ্ট করাটা তাঁদের খুব বেশি পছন্দের ছিল না।
আমার বয়স যখন ১৮, তখন আমি দ্বাদশ শ্রেণি পাস করেছি। কোনো এক ছুটিতে বাড়ি যেতে পারছি না। মনটা খারাপের কোনো এক দিন ভাবলাম, বেঙ্গালুরুতে তো ঘুরে বেড়ানোর অনেক জায়গা আছে। কাছাকাছি কোথাও তো আমি নিজেই যেতে পারি। একদিন গোয়াতে গিয়ে তিন দিন থাকলাম। ফিরে এসে ভাবলাম, একা ঘুরতে যাওয়াটা তো অনেক আনন্দের। নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো যায়। অন্য কারও জন্য চিন্তা বা অপেক্ষা করতে হয় না।
ধরুন, আমি গেলাম সমুদ্র সৈকতে। নিজের মতো করে পানিতে হাঁটলাম, আবার দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের ওঠানামা দেখলাম। মোট কথা, নিজের মতো করে প্রকৃতিকে উপভোগ করলাম। কিন্তু এই আনন্দটা অন্য কারও সঙ্গে গেলে হয়তো তেমন করে উপভোগ করা হতো না। এর আগেও আমি দল বেঁধে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানে ধরাবাঁধা কিছু নিয়ম ছিল। এ ক্ষেত্রে নিজের কোনো স্বাধীনতা থাকে না।
ভ্রমণ করতে আমি খুব পছন্দ করি। এটা আমার শখ। যখন আমার বয়স বাড়তে থাকল, তখন ঐতিহাসিক জায়গাগুলোর প্রতি আমার ভালো লাগা শুরু হলো। অনেক পুরোনো কোনো স্থানের ইতিহাস আমি খুঁজে খুঁজে বের করতাম। তারপর সে স্থানগুলো দেখতে যেতাম। এক সময় খেয়াল করলাম, আমি শুধু ঐতিহাসিক কোনো স্থানে ঘুরতে যাচ্ছি না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থানও ঘুরে ঘুরে দেখছি।
এ ক্ষেত্রে দেখা যায় কী, একা ভ্রমণে নিজের মতো করে অনেক কিছু করা যায়। ধরুন, আমি কোনো এক প্রসিদ্ধ স্থানে ঘুরতে গেলাম। ঘুরতে ঘুরতে জানতে পারলাম, আমি যে স্থানে গেছি, তার কাছাকাছি ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে আরও একটি সুন্দর জায়গা আছে। চলে গেলাম সেখানে। একা ভ্রমণের সুবিধা হচ্ছে, নিজের ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারছি। বলা যায়, বন্ধনহীনভাবে। বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই।
একা ভ্রমণ করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, ভারত উপমহাদেশে বেশির ভাগ মানুষ আসলে দীর্ঘদিনের জন্য ঘুরতে যায় না। বেশি হলে এক সপ্তাহ কিংবা দুই সপ্তাহের জন্য ঘুরতে যায়। কিন্তু আমি যখন একা একা ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতে শুরু করলাম, তখন দেশের বাইরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে দেখলাম, অনেকে এক মাস থেকে শুরু করে বছরব্যাপী সময় নিয়ে ভ্রমণ করছেন। বিষয়টা আমার কাছে খুবই অন্যরকম লাগল। ভ্রমণে একবার আমার সঙ্গে ব্রাজিলের এক ছেলের পরিচয় হয়েছিল, তখন সে তিন বছর ধরে ভ্রমণ করছে।
একা ভ্রমণের আরেকটি বিষয় হলো—নিজেকে যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়, যেটা দল বেঁধে গেলে সমস্যায় পড়তে হয়। যেমন আমি একবার এক মাসের জন্য রাজস্থান গেলাম, এই এক মাস সময়ের জন্য কিন্তু কাউকে সঙ্গে পাওয়া যাবে না। আবার ভ্রমণে থাকা খাওয়াতে অনেক ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, এসব পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া আবার অনেকের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এ জন্য কাউকে সঙ্গেও পাওয়া যায় না। আর আমি যখন একা ভ্রমণ করি, তখন সেই স্থানের মানুষ ও সংস্কৃতিটাকে বোঝার চেষ্টা করি। এমনকি তাঁদের ঐতিহ্য বোঝার জন্য তাঁদের ঘরেও থেকেছি। এ বিষয়ে আবার সবাই অভ্যস্ত নাও হতে পারে। আসলে সময়, পরিস্থিতি, স্থান, কাল বিবেচনায় অন্য কেউ ভ্রমণের সঙ্গী হতো চায় না। সবকিছু মিলিয়ে আমি একা ভ্রমণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
বললেন, ১৮ বছর বয়স থেকে একা ভ্রমণ করতে শুরু করেছেন। কতগুলো দেশ আপনি এর মধ্যে ভ্রমণ করেছেন?
ফাতিমা: আমি ৩৪ থেকে ৩৫টা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি আসলে গুণে গুণে দেশ ভ্রমণ করি না। আনন্দ নিয়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করি।
ভ্রমণ কি শুধু এশিয়ায়...
ফাতিমা: আমি এশিয়ার বাইরে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ঘুরেছি।
বাংলাদেশের মানুষ আফ্রিকায় ভ্রমণ করতে কম যান। দূরত্ব এবং দুর্গম বলে অনেকেই হয়তো আফ্রিকায় ভ্রমণ করতে যান না। আপনি কেন গেলেন?
ফাতিমা: আসলে এই উপমহাদেশের লোকজন ভ্রমণ বলতে বোঝায় আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া। চাকরি বা কাজের সূত্রে কোথাও গেলাম আর সেখানটাই ঘুরে বেড়ালাম। অথবা প্যাকেজ কোনো ভ্রমণ। তারা ঘুরে ঘুরে যা দেখাবে, তাই দেখব। আমি এই বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে পছন্দ করি। আমি আমার নিজের মতো করে ঘুরতে পছন্দ করি। নিজে যা দেখতে চাইব, সেটাই দেখব। এ ক্ষেত্রে অন্য কেউ, সে হোক আমার বন্ধু বা ট্যুর গাইড যেভাবে বলবে, সেইভাবে দেখতে চাই না।
আর আফ্রিকার ছেলেমেয়েগুলো আমাদের মতো মুক্তমনা। হয়তো দেখতে ভিন্ন, কিন্তু তারা আমাদের মতো চিন্তাভাবনা করে। আমার মনে হয়, আফ্রিকার জঙ্গলের জন্য সে দেশে ভ্রমণ করতে অনেকে ভয় পায়। কিন্তু আফ্রিকার সব দেশ মোটামুটি সভ্য।
আপনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। অনেক দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। যে বিষয়টা জানতে চাই, একজন নারী হিসেবে একা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কেমন? আমরা বিশ্ব সম্পর্কে যা জানি, ভ্রমণ বিষয়ে যা জানি, সেগুলোর বেশির ভাগ হচ্ছে পুরুষের চোখ দিয়ে দেখার অভিজ্ঞতা। নারীরা বিশেষ কিছু কঠিন বাস্তবতার কারণে একা ঘুরতে যেতে চান না। এই যে আপনি গেছেন বিভিন্ন দেশে, ঘুরে বেড়িয়েছেন একা একা, একজন নারী হিসেবে আপনার ভ্রমণের সে অভিজ্ঞতা কেমন?
ফাতিমা: আমি তো মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারে জন্মেছি। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি মেয়েদের জন্য থাকে পরিবারের বিভিন্ন বাধা নিষেধ। বাড়ির ছেলেদের খেলার জন্য মাঠে পাঠানো হতো। কিন্তু মেয়েদের ঘরে থাকতে বলত। বিষয়টি আমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিত। তখন থেকে ভাবতাম, ছেলেরা যা পারে, তা মেয়েরা কেন করতে পারবে না। এই ভাবনা থেকে ছেলেদের কাজগুলো করার চেষ্টা করেছি। আর সেই চেষ্টা থেকে একা ভ্রমণের আগ্রহ জন্মেছে।
দেশের বাইরে একা ভ্রমণের ক্ষেত্রে খুব বেশি বাধার সম্মুখীন হইনি। দেশের বাইরে নারীরা অনেক নিরাপদ। আমি তো একা নির্ভয়ে বিমানবন্দর থেকে রাতে হোটেলে গিয়েছি। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও একা একা ঘুরেছি। বলে রাখা ভালো, মধ্যপ্রাচ্যে মেয়েরা হয়তো ঘর থেকে বের হতে পারে না। সেখানকার মেয়েরা কিন্তু অনেক নিরাপদ। সেখানে যত রাতই হোক না কেন, একা ভ্রমণ করেছি। তাই দেশের বাইরে একা ভ্রমণে আমার অভিজ্ঞতা ভালো।
বাংলাদেশের নারীদের সঙ্গে বাইরের দেশের নারীদের তুলনা করতে বললে কী বলবেন?
ফাতিমা: আমাদের দেশের নারীদের নেই কোনো স্বাধীনতা। রাতে একা একা চলাফেরা করতে পারে না। এখানকার নারীদের কথা বলারও স্বাধীনতা নেই। নারী হিসেবে সংযত থাকতে হবে, তুমি তো মেয়ে মানুষ, তুমি চুপ থাকো, এ কাজ তোমার পক্ষে করা সম্ভব না। এই কথা আমাকেও শুনতে হয়েছে। আমাদের দেশের নারীদের যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, বাইরের দেশে সেভাবে দেখা হয় না। বাইরের দেশের নারীদের এই ধরনের সমস্যায় খুব বেশি পড়তে হয় না। তবে, অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে মেয়েরা ঘর থেকে বের হতে পারলেও কথা বলার স্বাধীনতা নেই।
আমি নিজেকে নারী নই, মানুষ হিসেবেই চিন্তা করি। আমি একজন মানুষ—এটাই ভাবতে ভালো লাগে। এমন নয় যে এ দেশের মেয়েরা শারীরিকভাবে অক্ষম। নারীকে কথা বলার স্বাধীনতা দেওয়া দরকার। তাহলে এ দেশের নারীরা অনেক দূর এগিয়ে যাবে। অন্য দেশের নারীরা পারলে এ দেশের নারীরাও পারবে। এমনকি কাজের ক্ষেত্রেও চিন্তা করা হয় যে, মেয়েরা এই কাজগুলো করতে পারবে না। এখানেই আমরা পিছিয়ে পড়ছি। যেমন পাহাড়ে ওঠা, গাড়ি চালানোর মতো কাজগুলো নারীরা করতে পারবে না। কিন্তু দেশের বাইরে নারীরা তো গাড়ি চালাচ্ছে। আমি মেয়ে এটা চিন্তা করা যাবে না। বিষয়টি মাথা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এই প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলে এ দেশের নারীরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।
আপনি তো দীর্ঘদিন ভারতে আছেন। ভারতের সঙ্গে আপনার আলাদা একটা সম্পর্ক। ভারতের নারীদের সঙ্গে বাংলাদেশের নারীদের তুলনা করতে বললে কী বলবেন?
ফাতিমা: ভারত আর বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। ভারতে তো অনেক বড় দেশ। সেখানে কোনো প্রদেশে হয়তো পাশের বাড়িতে কী হচ্ছে, সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। আবার কোনো কোনো প্রদেশের মানুষ মনে করছে, এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, একেক প্রদেশে একেক ধরনের সংস্কৃতি। আমি বড় হয়েছি বেঙ্গালুরুতে। বেঙ্গালুরুর মানুষজন যথেষ্ট প্রগতিশীল। আমি সেখানে যে স্বাধীনতা পেয়েছি, সেটা বাংলাদেশ উপভোগ করিনি।
আমি যেমন একা ভ্রমণ করি, বেঙ্গালুরুতে তেমনি একা বাসা নিয়ে থাকি। সেখানে আমি নিজের মতো করে থাকতে পারি। পাশের প্রতিবেশী এসে জানতে চায় না, আমি কেন একা থাকি। এখানে একা থাকার, একা একা চলাফেরা করার স্বাধীনতা আছে। আবার চাকরি ক্ষেত্রে এ দেশের মেয়েদের পিছিয়ে রাখা হয়। বলা হয়ে থাকে, মেয়েরা এই ধরনের কাজ পারবে না। আমি সিঙ্গাপুরে কাজ করেছি, সেখানে কাজের ক্ষেত্রে অন্যরকম সংস্কৃতি রয়েছে।
তবে দক্ষিণ ভারত একটু অন্যরকম। যেটা কাশ্মীর বা বিহারে দেখা যায় না। বিহারে বা উত্তর প্রদেশেও এটা অনুমোদন হবে না যে, নারীরা সবক্ষেত্রে কথা বলতে পারবে। যেমন আমি একটা ব্যাংকের কোনো শাখার ম্যানেজার। ব্যাংকের সবাই আমার কথা মেনে চলছে। তাদের মাথাতে এই বিষয়টা কাজ করে না যে, তারা একজন নারীর অধীনে কাজ করছে। এই সংস্কৃতি ভারতের অনেক প্রদেশে আছে। এসব প্রদেশে যোগ্যতা অনুসারে কাজ পাচ্ছে। আবার ভারতের অনেক প্রদেশের লোকজন আছে, যারা কাজের ক্ষেত্রে নারী নেতৃত্ব মেনে নিতে পারে না। এখানেই স্বাধীনতার বিষয়টা স্থানভেদে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া রাতের বেলাতে চলাফেরার যে স্বাধীনতা, সেটা তো আছেই।
দক্ষিণ ভারতের সমাজ কাঠামোর প্রগতিশীল হওয়ার পেছনে কারণ কী বলে মনে করেন?
ফাতিমা: দক্ষিণ ভারতের সমাজ কাঠামো প্রগতিশীল হওয়ার পেছনের কারণ শত শত বছর ধরে, তারা এই সংস্কৃতিকে ধারণ করে আসছেন। এ ছাড়া এখানকার মানুষেরা কাজে–কর্মে অনেক সৎ। অন্যের বিশ্বাসের ওপর এদের আস্থা আছে। এ ছাড়া এখানকার আইনকানুন ও পুলিশ অনেক কঠোর। আমরা পুলিশকে ভয় পাই। অর্থাৎ, আইনের প্রয়োগের বিষয়টি এখানে অনেক কঠোর। কেউ অন্যায় আচরণ করলে পুলিশ সেটা শক্ত হাতে সমাধান করছে। এ ক্ষেত্রে কোনো মন্ত্রী যদি অন্যায় করেন, তাঁকেও পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আইন প্রয়োগের নিয়মনীতি এখানে অনেক বেশি কঠোর।
আপনি বলেছেন বেঙ্গালুরু অন্যরকম। আবার সিঙ্গাপুরকে বলেছেন আরও আলাদা। এই পার্থক্য কেন মনে হলো আপনার?
ফাতিমা: এই আলাদা হওয়ার বিষয়টি সিঙ্গাপুর নেতৃত্বের গুণাবলি বলা যেতে পারে। সিঙ্গাপুরে দায়িত্বে ছিলেন লিক ওয়ান। তিনি আইনের বিষয়ে খুব কঠোর ছিলেন। তিনি দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা তৈরি করতে পেরেছেন। আর সে নীতিমালা অনুসারে দেশ পরিচালনা করতে পেরেছিলেন। ফলে সিঙ্গাপুর অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক দূর এগিয়েছে। অন্যদিকে ভারত ও বাংলাদেশের নেতৃত্ব হয়তো সে বিশ্বাস এখনো অর্জন করতে পারেনি। এখানকার মানুষজন দেশের উন্নতির কথা না ভেবে ব্যক্তিগত উন্নতির কথা বেশি ভাবছে। এই দেশগুলোর সরকার আইন প্রণয়নে কঠোর হতে পারেনি। এখানেই সিঙ্গাপুরের সঙ্গে বেঙ্গালুরুর পার্থক্য।
বেঙ্গালুরু বা সিঙ্গাপুরের মানুষের মন মানসিকতার পার্থক্যের কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?
ফাতিমা: ভারতের ইতিহাস তো অনেক পুরোনো। এখন এখানে কোনো নিয়ম কানুন প্রয়োগ করতে চাইলে, অন্যরা বলে ওঠে এটা-সেটা এখানকার সংস্কৃতি নয়। বিষয়টি আবার সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে হয় না। সিঙ্গাপুরের ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়। এখানে তিন জাতির মিশ্রণ আছে। এক চাইনিজ, দুই মালেশিয়ান আর তিন ইন্ডিয়ান। এরা চাকরি বা ব্যবসা করার জন্য সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন।
আমাদের যেমন হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য আছে, সিঙ্গাপুরের কিন্তু তেমনটি নেই। আমরা বাঙালিরা কিছু একটা হলেই বলি, এটা আমাদের সংস্কৃতি না। যেটা সিঙ্গাপুরের লোকজন বলতে পারে না। তাই সেখানকার নেতৃত্ব যে আইন প্রয়োগ করছে, সেটা মানতে বাধ্য থাকছে। বিষয়টি আবার আমাদের এখানে সম্ভব নয়। নতুন কোনো নিয়ম হলে সেটা তারা মেনে নিচ্ছে। আমরা এই জায়গায় পিছিয়ে যাচ্ছি।
আপনার কি সে রকমই মনে হচ্ছে? এখানে সংস্কৃতি মানে আমরা বুঝে নিচ্ছি একটা বৈশিষ্ট্য। সংস্কৃতি বলতে আসলে অনেক কিছুর সংমিশ্রণকে বোঝায়। আপনার কি মনে হয়, আমরা যে সংস্কৃতির মধ্যে আঁটকে আছি, সেখান থেকে বের হওয়া প্রয়োজন?
ফাতিমা: আমার মনে হয় এই জায়গাটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। কিন্তু আমাদের অবচেতন মনে যে সংস্কৃতি ঢুকে গেছে, সে সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। যেমন আমি নিজেও বাংলাদেশ বা ভারতের যে সংস্কৃতি, সেটা থেকে মাঝেমধ্যে বের হয়ে আসতে পারি না। এক ধরনের মানুষ হয়তো বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু আরেক ধরনের মানুষ আছেন, যারা এই বিষয় থেকে কোনোভাবেই বের হয়ে আসতে পারেন না। তবে তাঁদের মঙ্গলের জন্য এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
তার মানে কি সময় অনুসারে সংস্কৃতিতে সংস্কার করা উচিত? কারণ, সংস্কৃতি শব্দটির মধ্যে সংস্কার শব্দটি আছে।
ফাতিমা: আমি মনে করি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুর সংস্কার বা পরিবর্তন হওয়া উচিত। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক কিছু বদলাচ্ছে। যেমন—আগে মানুষ পায়ে হেঁটে বা গরুর গাড়িতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আসা–যাওয়া করত। সেখানে আজকে মানুষ ব্যবহার করছে ইঞ্জিনের কোনো গাড়ি। যেহেতু আমরা যুগের সঙ্গে নিজেদের পরিবর্তন করছি সেহেতু সংস্কৃতিরও পরিবর্তন হওয়া উচিত।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থা কেমন মনে করছেন?
ফাতিমা: প্রথমত, এ দেশে নারীদের কথা বলার স্বাধীনতা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাঁদের কথা শোনার মতো মন মানসিকতা আমাদের থাকতে হবে। আমরা শুধু বলেই যাব, কিন্তু কেউ তা শুনবে না। এভাবে চলতে থাকলে কোনো পরিবর্তনই হবে না।
এমন নয় যে বাংলাদেশের নারীরা কোনো কিছুতে প্রতিবাদ করছে না। কিন্তু তাঁদের দমিয়ে রাখা হচ্ছে। এ দেশের নারীরা যতই যৌক্তিক কথা বলুক না কেন, তাদের কেউ গুরুত্বই দিচ্ছে না। যেহেতু তিনি নারী, সেহেতু তার কথা শোনাই হবে না। আমাদের আসলে শোনার মতো মন মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
আমাদের সমাজের পুরুষদেরও নারীদের কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে। পুরুষদের চিন্তা ভাবনা পরিবর্তন করতে হবে। যেকোনো বিষয়ে নারী ও পুরুষের বক্তব্য নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পুরুষদের যেমন নারীদের কথা বলার জায়গা তৈরি করে দিতে হবে, তেমনি আমাদের নারীদেরও সাহসিকতার সঙ্গে কথা বলা শিখতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে কোনো কাজে যেন নিজেরা আপস না করে। এ দেশের নারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আপস করে চুপ হয়ে যায়। এমনকি আমার নিজের কর্মক্ষেত্রেও বলা হয়েছিল আপস করতে। কিন্তু আমি সেটা করিনি।
এই উপমহাদেশে নারীদের অপবাদ বা নিন্দিত হতে হয় বেশি। সমাজ কোনো নারীকে নিন্দিত বা অপবাদ দিল, সে নারীকে ভাবতে হবে তিনি ভালো আছেন। এ ক্ষেত্রে কোনোভাবেই ভেঙে পড়া যাবে না, হতাশ হওয়া যাবে না। যেটা করতে হবে, সেটা হলো সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।
এই যে আজকে আমি একা ভ্রমণ করছি। এটা করতে পেরেছি। তার কারণ অতিরঞ্জিত সামাজিকতাকে আমি খুব বেশি গুরুত্ব দিইনি। নিজের মতো করে চলার চেষ্টা করেছি। আমাকে এই চলার পথে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। যে কথাগুলো এখনো শুনছি। এ কথাগুলোকে আমি খুব বেশি গুরুত্ব দিইনি। আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, তাই আবর্জনাকে আমি বিদায় দিয়েছি।
আমাদের এ অঞ্চলের ইতিহাসে নারীদের গৌরবময় জায়গা রয়েছে। যেমন আমাদের বেগম রোকেয়া বা নাটোরের রানি ভবানী ছিলেন। নাটোরের রানি ভবানী এই ভারতবর্ষের বাইরের ইতিহাসেও বেশ প্রশংসিত ছিলেন। তিনি সরাসরি আলিবর্দী খানের সঙ্গেও কথা বলতেন বলে আমরা জানি। এ ক্ষেত্রে আপনার কি মনে হয়, কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর আমরা আমাদের সমাজ থেকে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছি অথবা পিছিয়ে পড়ে গেছি। এ সময়ে এসে নারীদের তাঁদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। নারীদের এই অধিকার আদায়ের আন্দোলনের বিষয়টি কিন্তু খুব বেশি দিন আগের কথা নয়।
নারীদের সব সময় এক ধরনের হতাশা তো ছিলই। সেটা হয়তো হাজার হাজার বছর ধরেই ছিল। আমরা যেটা জানি, এই পথপরিক্রমায় অনেক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যেটা ইউরোপের মতো পরিবর্তন নয়। ইউরোপের পরিবর্তনটা হয়েছে একটু অন্যভাবে। ইউরোপের বর্তমান নারী-পুরুষের যে ন্যায়ের শাসন, তার জন্য অনেক পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের খাপ খাওয়াতে হয়েছে। আমাদের এখানে কিন্তু সেটা করতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে মহিমান্বিত করার জন্য তাদের একজন নাইটিঙ্গেল তৈরি ও গ্রহণ করতে হয়েছে।
কিন্তু আমাদের এখানে রানি রাশমণি বা রানি ভবানী কিংবা বেগম রোকেয়াকে ওই জায়গা থেকে গ্রহণ করতে হয়নি। তাঁরা বরং উদ্ভূত পরিস্থিতিকে নিজেদের মতো করে সমাধান করে গেছেন। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, বেগম রোকেয়ার সময়ে তৎকালীন মুসলিম ও হিন্দু সমাজ একই রকম রক্ষণশীল ছিল।
ফাতিমা: এ কথা ঠিক যে, সে সময়ে হিন্দুদের সমাজব্যবস্থা অনেক রক্ষণশীল ও পর্দাশীল ছিল। ওই সময়ে নারীরা অন্তঃপুরবাসিনী ছিলেন এবং কঠিনভাবে পর্দাপ্রথা পালন করতেন। তারা গঙ্গায় স্নান করতে গেলে পালকিতে কাপড় পেঁচিয়ে সেই পালকিকে তিন থেকে চারবার পানিতে ডুব দিতেন। তাঁরা পালকি থেকে বের হতেন না। আর সেভাবেই তাঁদের স্নানের কাজ সমাপ্ত হতো। এগুলো ছিল।
আপনার কি মনে হয়, একুশ শতকে এসে নারীরা অনেক বেশি সমস্যায় পড়ে যাচ্ছেন?
ফাতিমা: এখনকার নারীরা বাইরে বের হচ্ছেন, খেলাধুলাতে অংশগ্রহণ করছেন, চাকরি করছেন, রাজনীতিও করছেন। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও একজন নারী। আমার যেটা মনে হয়, আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত যে ব্যাপারগুলো আছে, যেমন রাজার পুত্র রাজা হবে, এ ক্ষেত্রে রাজার মেয়ে থাকলে সে মেয়েও কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন। এ বিষয়ে আমাদের চিন্তা ভাবনা পরিবর্তন করতে হবে। এ ধরনের পরিবর্তন বা সংস্কার অনেক বেশি প্রয়োজন।
অন্যদিকে সম্পত্তিতে ছেলেমেয়ের সমান অধিকার হওয়া উচিত। আইন করে সব ধর্মের ক্ষেত্রে সমতা আনতে হবে। এ ধরনের আইনি প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমাদের মন মানসিকতারও পরিবর্তন আনতে হবে। বেগম রোকেয়া, রানি রাশমণি কিংবা রানি ভবানী কিন্তু তাঁদের স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছিলেন। আর এই কারণেই মনে হয় তাঁরা সাহসী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
বেগম রোকেয়া, রানি ভবানীদের কিন্তু সমাজে লড়াই করতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সমাজ কিন্তু খুব সহজেই তাঁদের মেনে নেয়নি। তারপরও তাঁরা তাঁদের কাজ করে গেছেন। ১৮ শতকের নারীরা যদি সে সময়কার সমাজ বাস্তবতায় এই কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন, একুশ শতকে তো এই লড়াই আরও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। একুশ শতকে এসে আইন করা হচ্ছে সমতার জন্য। এই বিষয়ে যদি কিছু বলতেন।
ফাতিমা: রানি রাশমণির সময়েও কিন্তু দেখা গেছে, অনেক রাজা খুব অল্প বয়সে মারা গেছেন। তার পরিবর্তে কিন্তু তাঁদের রানিরা দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। এ ক্ষেত্রে নারীদের সাহসী হতে হবে। ভাবতে হবে এটা আমার রাজ্য, আমি আমার মতো করে রাজ্য পরিচালনা করব। রানি রাশমণি, রানি ভবানীর কিন্তু এই সাহস ছিল। বর্তমানে আমাদের দেশের নারীদেরও উদ্যোগী হতে হবে। সাহসিকতার সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। পুরুষেরা যে কাজ পারবে, আমরাও সে কাজ করতে পারব। আমাদের নারীরা এই কথাটাই চিন্তা ভাবনাতে আনতে পারেন না।
এই না পারার কারণ কী?
ফাতিমা: আমরা সব সময় দেখে আসছি, বাইরের কাজগুলো পুরুষেরা করছেন। বিষয়টি ছোটবেলা থেকে আমাদের মাথায় গেঁথে দেওয়া হয়। নারীরা মনে করে—এটা আমার কাজ না। আমি এটা পারব না। যে নারী মনে করেন, এ কাজ আমার, আমি এ কাজ করতে পারব, মূলত তারাই সমাজের এই বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। এটা সে আমলেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
তার মানে বলতে চাচ্ছেন, চরিত্রের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি?
ফাতিমা: আমরা হয়তো শিক্ষা–দীক্ষা গ্রহণ করছি, বাইরে যেতে পারছি। আমরা পোশাক–আশাকে আধুনিক হয়েছি। কিন্তু চিন্তা ভাবনাতে আমরা আধুনিক হয়ে উঠতে পারিনি।
ভ্রমণে ফিরি। একা ভ্রমণ। এই আগ্রহের মূল কারণ কী? মানুষ চাকরি করে অনেক টাকা উপার্জন করছে। আপনি চাকরি করে নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারতেন। আপনি কেন ভ্রমণের দিকে ঝুঁকে গেলেন?
ফাতিমা: মানুষকে জানা, বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিকে জানার আগ্রহ আমার অনেক বেশি। জানার আগ্রহ থেকে মূলত একা ভ্রমণে কৌতূহলী হয়েছি।
আমি একসময় করপোরেট অফিসে চাকরি করেছি। মাস শেষে অনেক টাকাও উপার্জন করেছি। কিন্তু দিন শেষে মনে হয়েছে, আমি যা চাইছি, তা চাকরি করে পূরণ করা সম্ভব নয়। আমার জানার প্রচণ্ড আগ্রহ। মানুষ সম্পর্কে জানার কৌতূহল আমার অনেক বেশি। করপোরেট অফিসে চাকরি করে, মোটা অঙ্কের টাকা বাড়িতে নিয়ে এসে আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারতাম না। তাই আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভ্রমণে ঝুঁকে গেছি। ভবিষ্যতেও মনে হয় এমন কিছু করব, যেটা করলে আমি এক জায়গায় আটকে থাকব না। মানুষ সম্পর্কে জানতে পারব।
আপনি তো অল্প কিছুদিন হলো বাংলাতে লিখতে শিখেছেন। এত কম সময়ে সুন্দর করে বাংলা আয়ত্ত করলেন কীভাবে? এটা কীভাবে আপনি অর্জন করলেন?
ফাতিমা: আমি আসলে যেভাবে কথা বলি, সেভাবেই লেখার চেষ্টা করি। বাংলা ভাষাকে আয়ত্তে আনার জন্য আমি রাতদিন বাংলা বই পড়ছি। শব্দের ভান্ডার বাড়ানোর চেষ্টা করছি। যখনই সময় পেয়েছি, তখনই বই নিয়ে বসে পড়েছি।
কোন ভাষায় আপনার চর্চা বা কাজ করতে হয়েছে বেশি? আপনার দীর্ঘদিনের চর্চার মাধ্যম কী?
ফাতিমা: আমার ইংরেজিতে চর্চা বেশি হয়েছে। আর কথাও বলেছি ইংরেজিতে বেশি। এর পর বাংলা, জার্মান, উর্দু, তামিল, হিন্দি ও আরবি।
আপনার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
ফাতিমা: ঢাকা আমার জন্মস্থান। ঢাকার খিলগাঁওতে আমাদের পৈতৃক বাড়ি রয়েছে। আমার মা মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। বাবা মারা গেছেন দেড় বছর আগে। আমার এক বোন ঢাকায় থাকেন, পেশায় ডাক্তার। বাবার নাম এস এম ফজলে আলী। উনি যুগ্ম সচিব হিসেবে কেবিনেট বিভাগ থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি মূলত ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
যে কথা বলতে চাই, আমরা আসলে অনেকাংশে নির্লিপ্ত হয়ে গেছি। যেটা আগে ছিল না। আমরা এ সময়ে এসে নিজেদের সমাজে নিরাপদ মনে করছি না। ছোটবেলায় মা দারোয়ানের সঙ্গে আমাকে স্কুলে পাঠিয়েছেন। মাকে কখনো দেখিনি আমি বা আমার বোনের সঙ্গে স্কুলে যাচ্ছেন। যেটা এখনকার দিনে সম্ভব নয়। সমাজে আইন–শৃঙ্খলার অবক্ষয় হয়েছে। নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এটা একটি সমাজের জন্য অনেক ভয়াবহ বিষয়। আমরা এই সময়ে অনেক বেশি স্বার্থপরও হয়ে গেছি। আমি যে সময়টাতে বাংলাদেশে ছিলাম সে সময়ের তুলনায় এখন অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আজ থেকে ২০ বছর আগের বাংলাদেশের সঙ্গে এখনকার বাংলাদেশের তেমন কোনো মিল খুঁজে পাই না। আমি এ কারণে খুবই হতাশ। সমাজে ধর্মের অপব্যবহার বেড়ে গেছে এখন বেশি।
আমরা প্রতিযোগিতামূলক মন মানসিকতার মধ্যে বড় হচ্ছি। সামাজিকভাবে আমরা যে অবস্থানে আছি, সেটা থেকে আরও অনেক ওপরের অবস্থানে যেতে হবে—এই চিন্তায় আমরা ক্রমশ বেড়ে উঠছি। এখনকার বেশির ভাগ বাবা–মা চান তাঁদের সন্তান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে। টাকা পয়সা দিয়ে গাড়ি বাড়ি তৈরি করবে। সে টাকা হোক সৎ না অসৎ কোনো উপায়ে আসছে, সেটা কোনো বিষয় নয়। এই যে প্রতিযোগিতামূলক একটা অবস্থানে আমরা নেমে গেছি এর জন্য আমরা যা হতে চাই বা যেটাতে আমার আগ্রহ বেশি, সে জায়গা থেকে আমরা অনেক দূরে পিছিয়ে পড়ছি। এতে আমাদের আগ্রহের জায়গাতে ভাটা পড়ছে।
তবে এ ক্ষেত্রে সমাজ ব্যবস্থা অনেক বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। যেমন আজকে আমি যদি করপোরেট অফিসের চাকরি ছেড়ে দিই, তাহলে আমাকে শুনতে হবে অনেক কথা। সবাই হায় হায় করবে। অনেক ধরনের কথা শুনতে হবে। এই কটু কথা অনেকে সহ্য করতে পারেন না। এ জন্য তাঁরা মনের কাছে হেরে গিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমে যায়।
আমি বলতে চাই, চাকরি ছেড়ে দিয়ে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছি। এই কাজটা অনেকেই করতে পারেন না। এ ধরনের সাহসী পদক্ষেপ আসলে নারী-পুরুষ সবারই নেওয়া উচিত। আমি আমার আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়েছি। এতে আমি খুব আনন্দিত।
এই আনন্দে, খুশি থাকাই জীবনের মূল বিষয়। লালন বলেছেন, ‘সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো।’ ফাতিমা আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
ফাতিমা: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আপনি একা একা ভ্রমণ করছেন। একা ভ্রমণের শুরু কবে থেকে এবং কেন?
ফাতিমা: স্বাভাবিকভাবে সবাই একা ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন না। হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে, আর না হয় পরিবারের সঙ্গে ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। আমি আসলে পড়াশোনা করেছি বেঙ্গালুরুর বোর্ডিং স্কুলে। বোর্ডিং স্কুল থেকে বাড়িতে খুব কম সময় আসা হতো। ঢাকা থেকে বেঙ্গালুরুর দূরত্বের কারণে এমনও দেখা গেছে, দুই বছরে একবার বাড়িতে এসেছি। ছুটিতে বেশির ভাগ সময় আমাকে বোর্ডিং স্কুলে থাকতে হতো। কারণ, ছুটি থাকত কম; মাত্র ৩ থেকে ৪ দিন। আর বাবা–মা খুব কড়া ছিলেন। তাঁরা চাইতেন না এত কম সময়ের ছুটিতে আমি বাড়িতে আসি। সময় নষ্ট করাটা তাঁদের খুব বেশি পছন্দের ছিল না।
আমার বয়স যখন ১৮, তখন আমি দ্বাদশ শ্রেণি পাস করেছি। কোনো এক ছুটিতে বাড়ি যেতে পারছি না। মনটা খারাপের কোনো এক দিন ভাবলাম, বেঙ্গালুরুতে তো ঘুরে বেড়ানোর অনেক জায়গা আছে। কাছাকাছি কোথাও তো আমি নিজেই যেতে পারি। একদিন গোয়াতে গিয়ে তিন দিন থাকলাম। ফিরে এসে ভাবলাম, একা ঘুরতে যাওয়াটা তো অনেক আনন্দের। নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো যায়। অন্য কারও জন্য চিন্তা বা অপেক্ষা করতে হয় না।
ধরুন, আমি গেলাম সমুদ্র সৈকতে। নিজের মতো করে পানিতে হাঁটলাম, আবার দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের ওঠানামা দেখলাম। মোট কথা, নিজের মতো করে প্রকৃতিকে উপভোগ করলাম। কিন্তু এই আনন্দটা অন্য কারও সঙ্গে গেলে হয়তো তেমন করে উপভোগ করা হতো না। এর আগেও আমি দল বেঁধে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানে ধরাবাঁধা কিছু নিয়ম ছিল। এ ক্ষেত্রে নিজের কোনো স্বাধীনতা থাকে না।
ভ্রমণ করতে আমি খুব পছন্দ করি। এটা আমার শখ। যখন আমার বয়স বাড়তে থাকল, তখন ঐতিহাসিক জায়গাগুলোর প্রতি আমার ভালো লাগা শুরু হলো। অনেক পুরোনো কোনো স্থানের ইতিহাস আমি খুঁজে খুঁজে বের করতাম। তারপর সে স্থানগুলো দেখতে যেতাম। এক সময় খেয়াল করলাম, আমি শুধু ঐতিহাসিক কোনো স্থানে ঘুরতে যাচ্ছি না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থানও ঘুরে ঘুরে দেখছি।
এ ক্ষেত্রে দেখা যায় কী, একা ভ্রমণে নিজের মতো করে অনেক কিছু করা যায়। ধরুন, আমি কোনো এক প্রসিদ্ধ স্থানে ঘুরতে গেলাম। ঘুরতে ঘুরতে জানতে পারলাম, আমি যে স্থানে গেছি, তার কাছাকাছি ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে আরও একটি সুন্দর জায়গা আছে। চলে গেলাম সেখানে। একা ভ্রমণের সুবিধা হচ্ছে, নিজের ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারছি। বলা যায়, বন্ধনহীনভাবে। বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই।
একা ভ্রমণ করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, ভারত উপমহাদেশে বেশির ভাগ মানুষ আসলে দীর্ঘদিনের জন্য ঘুরতে যায় না। বেশি হলে এক সপ্তাহ কিংবা দুই সপ্তাহের জন্য ঘুরতে যায়। কিন্তু আমি যখন একা একা ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতে শুরু করলাম, তখন দেশের বাইরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে দেখলাম, অনেকে এক মাস থেকে শুরু করে বছরব্যাপী সময় নিয়ে ভ্রমণ করছেন। বিষয়টা আমার কাছে খুবই অন্যরকম লাগল। ভ্রমণে একবার আমার সঙ্গে ব্রাজিলের এক ছেলের পরিচয় হয়েছিল, তখন সে তিন বছর ধরে ভ্রমণ করছে।
একা ভ্রমণের আরেকটি বিষয় হলো—নিজেকে যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়, যেটা দল বেঁধে গেলে সমস্যায় পড়তে হয়। যেমন আমি একবার এক মাসের জন্য রাজস্থান গেলাম, এই এক মাস সময়ের জন্য কিন্তু কাউকে সঙ্গে পাওয়া যাবে না। আবার ভ্রমণে থাকা খাওয়াতে অনেক ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, এসব পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া আবার অনেকের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এ জন্য কাউকে সঙ্গেও পাওয়া যায় না। আর আমি যখন একা ভ্রমণ করি, তখন সেই স্থানের মানুষ ও সংস্কৃতিটাকে বোঝার চেষ্টা করি। এমনকি তাঁদের ঐতিহ্য বোঝার জন্য তাঁদের ঘরেও থেকেছি। এ বিষয়ে আবার সবাই অভ্যস্ত নাও হতে পারে। আসলে সময়, পরিস্থিতি, স্থান, কাল বিবেচনায় অন্য কেউ ভ্রমণের সঙ্গী হতো চায় না। সবকিছু মিলিয়ে আমি একা ভ্রমণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
বললেন, ১৮ বছর বয়স থেকে একা ভ্রমণ করতে শুরু করেছেন। কতগুলো দেশ আপনি এর মধ্যে ভ্রমণ করেছেন?
ফাতিমা: আমি ৩৪ থেকে ৩৫টা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি আসলে গুণে গুণে দেশ ভ্রমণ করি না। আনন্দ নিয়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করি।
ভ্রমণ কি শুধু এশিয়ায়...
ফাতিমা: আমি এশিয়ার বাইরে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ঘুরেছি।
বাংলাদেশের মানুষ আফ্রিকায় ভ্রমণ করতে কম যান। দূরত্ব এবং দুর্গম বলে অনেকেই হয়তো আফ্রিকায় ভ্রমণ করতে যান না। আপনি কেন গেলেন?
ফাতিমা: আসলে এই উপমহাদেশের লোকজন ভ্রমণ বলতে বোঝায় আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া। চাকরি বা কাজের সূত্রে কোথাও গেলাম আর সেখানটাই ঘুরে বেড়ালাম। অথবা প্যাকেজ কোনো ভ্রমণ। তারা ঘুরে ঘুরে যা দেখাবে, তাই দেখব। আমি এই বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে পছন্দ করি। আমি আমার নিজের মতো করে ঘুরতে পছন্দ করি। নিজে যা দেখতে চাইব, সেটাই দেখব। এ ক্ষেত্রে অন্য কেউ, সে হোক আমার বন্ধু বা ট্যুর গাইড যেভাবে বলবে, সেইভাবে দেখতে চাই না।
আর আফ্রিকার ছেলেমেয়েগুলো আমাদের মতো মুক্তমনা। হয়তো দেখতে ভিন্ন, কিন্তু তারা আমাদের মতো চিন্তাভাবনা করে। আমার মনে হয়, আফ্রিকার জঙ্গলের জন্য সে দেশে ভ্রমণ করতে অনেকে ভয় পায়। কিন্তু আফ্রিকার সব দেশ মোটামুটি সভ্য।
আপনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। অনেক দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। যে বিষয়টা জানতে চাই, একজন নারী হিসেবে একা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কেমন? আমরা বিশ্ব সম্পর্কে যা জানি, ভ্রমণ বিষয়ে যা জানি, সেগুলোর বেশির ভাগ হচ্ছে পুরুষের চোখ দিয়ে দেখার অভিজ্ঞতা। নারীরা বিশেষ কিছু কঠিন বাস্তবতার কারণে একা ঘুরতে যেতে চান না। এই যে আপনি গেছেন বিভিন্ন দেশে, ঘুরে বেড়িয়েছেন একা একা, একজন নারী হিসেবে আপনার ভ্রমণের সে অভিজ্ঞতা কেমন?
ফাতিমা: আমি তো মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারে জন্মেছি। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি মেয়েদের জন্য থাকে পরিবারের বিভিন্ন বাধা নিষেধ। বাড়ির ছেলেদের খেলার জন্য মাঠে পাঠানো হতো। কিন্তু মেয়েদের ঘরে থাকতে বলত। বিষয়টি আমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিত। তখন থেকে ভাবতাম, ছেলেরা যা পারে, তা মেয়েরা কেন করতে পারবে না। এই ভাবনা থেকে ছেলেদের কাজগুলো করার চেষ্টা করেছি। আর সেই চেষ্টা থেকে একা ভ্রমণের আগ্রহ জন্মেছে।
দেশের বাইরে একা ভ্রমণের ক্ষেত্রে খুব বেশি বাধার সম্মুখীন হইনি। দেশের বাইরে নারীরা অনেক নিরাপদ। আমি তো একা নির্ভয়ে বিমানবন্দর থেকে রাতে হোটেলে গিয়েছি। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও একা একা ঘুরেছি। বলে রাখা ভালো, মধ্যপ্রাচ্যে মেয়েরা হয়তো ঘর থেকে বের হতে পারে না। সেখানকার মেয়েরা কিন্তু অনেক নিরাপদ। সেখানে যত রাতই হোক না কেন, একা ভ্রমণ করেছি। তাই দেশের বাইরে একা ভ্রমণে আমার অভিজ্ঞতা ভালো।
বাংলাদেশের নারীদের সঙ্গে বাইরের দেশের নারীদের তুলনা করতে বললে কী বলবেন?
ফাতিমা: আমাদের দেশের নারীদের নেই কোনো স্বাধীনতা। রাতে একা একা চলাফেরা করতে পারে না। এখানকার নারীদের কথা বলারও স্বাধীনতা নেই। নারী হিসেবে সংযত থাকতে হবে, তুমি তো মেয়ে মানুষ, তুমি চুপ থাকো, এ কাজ তোমার পক্ষে করা সম্ভব না। এই কথা আমাকেও শুনতে হয়েছে। আমাদের দেশের নারীদের যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, বাইরের দেশে সেভাবে দেখা হয় না। বাইরের দেশের নারীদের এই ধরনের সমস্যায় খুব বেশি পড়তে হয় না। তবে, অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে মেয়েরা ঘর থেকে বের হতে পারলেও কথা বলার স্বাধীনতা নেই।
আমি নিজেকে নারী নই, মানুষ হিসেবেই চিন্তা করি। আমি একজন মানুষ—এটাই ভাবতে ভালো লাগে। এমন নয় যে এ দেশের মেয়েরা শারীরিকভাবে অক্ষম। নারীকে কথা বলার স্বাধীনতা দেওয়া দরকার। তাহলে এ দেশের নারীরা অনেক দূর এগিয়ে যাবে। অন্য দেশের নারীরা পারলে এ দেশের নারীরাও পারবে। এমনকি কাজের ক্ষেত্রেও চিন্তা করা হয় যে, মেয়েরা এই কাজগুলো করতে পারবে না। এখানেই আমরা পিছিয়ে পড়ছি। যেমন পাহাড়ে ওঠা, গাড়ি চালানোর মতো কাজগুলো নারীরা করতে পারবে না। কিন্তু দেশের বাইরে নারীরা তো গাড়ি চালাচ্ছে। আমি মেয়ে এটা চিন্তা করা যাবে না। বিষয়টি মাথা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এই প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলে এ দেশের নারীরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।
আপনি তো দীর্ঘদিন ভারতে আছেন। ভারতের সঙ্গে আপনার আলাদা একটা সম্পর্ক। ভারতের নারীদের সঙ্গে বাংলাদেশের নারীদের তুলনা করতে বললে কী বলবেন?
ফাতিমা: ভারত আর বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। ভারতে তো অনেক বড় দেশ। সেখানে কোনো প্রদেশে হয়তো পাশের বাড়িতে কী হচ্ছে, সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। আবার কোনো কোনো প্রদেশের মানুষ মনে করছে, এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, একেক প্রদেশে একেক ধরনের সংস্কৃতি। আমি বড় হয়েছি বেঙ্গালুরুতে। বেঙ্গালুরুর মানুষজন যথেষ্ট প্রগতিশীল। আমি সেখানে যে স্বাধীনতা পেয়েছি, সেটা বাংলাদেশ উপভোগ করিনি।
আমি যেমন একা ভ্রমণ করি, বেঙ্গালুরুতে তেমনি একা বাসা নিয়ে থাকি। সেখানে আমি নিজের মতো করে থাকতে পারি। পাশের প্রতিবেশী এসে জানতে চায় না, আমি কেন একা থাকি। এখানে একা থাকার, একা একা চলাফেরা করার স্বাধীনতা আছে। আবার চাকরি ক্ষেত্রে এ দেশের মেয়েদের পিছিয়ে রাখা হয়। বলা হয়ে থাকে, মেয়েরা এই ধরনের কাজ পারবে না। আমি সিঙ্গাপুরে কাজ করেছি, সেখানে কাজের ক্ষেত্রে অন্যরকম সংস্কৃতি রয়েছে।
তবে দক্ষিণ ভারত একটু অন্যরকম। যেটা কাশ্মীর বা বিহারে দেখা যায় না। বিহারে বা উত্তর প্রদেশেও এটা অনুমোদন হবে না যে, নারীরা সবক্ষেত্রে কথা বলতে পারবে। যেমন আমি একটা ব্যাংকের কোনো শাখার ম্যানেজার। ব্যাংকের সবাই আমার কথা মেনে চলছে। তাদের মাথাতে এই বিষয়টা কাজ করে না যে, তারা একজন নারীর অধীনে কাজ করছে। এই সংস্কৃতি ভারতের অনেক প্রদেশে আছে। এসব প্রদেশে যোগ্যতা অনুসারে কাজ পাচ্ছে। আবার ভারতের অনেক প্রদেশের লোকজন আছে, যারা কাজের ক্ষেত্রে নারী নেতৃত্ব মেনে নিতে পারে না। এখানেই স্বাধীনতার বিষয়টা স্থানভেদে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া রাতের বেলাতে চলাফেরার যে স্বাধীনতা, সেটা তো আছেই।
দক্ষিণ ভারতের সমাজ কাঠামোর প্রগতিশীল হওয়ার পেছনে কারণ কী বলে মনে করেন?
ফাতিমা: দক্ষিণ ভারতের সমাজ কাঠামো প্রগতিশীল হওয়ার পেছনের কারণ শত শত বছর ধরে, তারা এই সংস্কৃতিকে ধারণ করে আসছেন। এ ছাড়া এখানকার মানুষেরা কাজে–কর্মে অনেক সৎ। অন্যের বিশ্বাসের ওপর এদের আস্থা আছে। এ ছাড়া এখানকার আইনকানুন ও পুলিশ অনেক কঠোর। আমরা পুলিশকে ভয় পাই। অর্থাৎ, আইনের প্রয়োগের বিষয়টি এখানে অনেক কঠোর। কেউ অন্যায় আচরণ করলে পুলিশ সেটা শক্ত হাতে সমাধান করছে। এ ক্ষেত্রে কোনো মন্ত্রী যদি অন্যায় করেন, তাঁকেও পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আইন প্রয়োগের নিয়মনীতি এখানে অনেক বেশি কঠোর।
আপনি বলেছেন বেঙ্গালুরু অন্যরকম। আবার সিঙ্গাপুরকে বলেছেন আরও আলাদা। এই পার্থক্য কেন মনে হলো আপনার?
ফাতিমা: এই আলাদা হওয়ার বিষয়টি সিঙ্গাপুর নেতৃত্বের গুণাবলি বলা যেতে পারে। সিঙ্গাপুরে দায়িত্বে ছিলেন লিক ওয়ান। তিনি আইনের বিষয়ে খুব কঠোর ছিলেন। তিনি দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা তৈরি করতে পেরেছেন। আর সে নীতিমালা অনুসারে দেশ পরিচালনা করতে পেরেছিলেন। ফলে সিঙ্গাপুর অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক দূর এগিয়েছে। অন্যদিকে ভারত ও বাংলাদেশের নেতৃত্ব হয়তো সে বিশ্বাস এখনো অর্জন করতে পারেনি। এখানকার মানুষজন দেশের উন্নতির কথা না ভেবে ব্যক্তিগত উন্নতির কথা বেশি ভাবছে। এই দেশগুলোর সরকার আইন প্রণয়নে কঠোর হতে পারেনি। এখানেই সিঙ্গাপুরের সঙ্গে বেঙ্গালুরুর পার্থক্য।
বেঙ্গালুরু বা সিঙ্গাপুরের মানুষের মন মানসিকতার পার্থক্যের কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?
ফাতিমা: ভারতের ইতিহাস তো অনেক পুরোনো। এখন এখানে কোনো নিয়ম কানুন প্রয়োগ করতে চাইলে, অন্যরা বলে ওঠে এটা-সেটা এখানকার সংস্কৃতি নয়। বিষয়টি আবার সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে হয় না। সিঙ্গাপুরের ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়। এখানে তিন জাতির মিশ্রণ আছে। এক চাইনিজ, দুই মালেশিয়ান আর তিন ইন্ডিয়ান। এরা চাকরি বা ব্যবসা করার জন্য সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন।
আমাদের যেমন হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য আছে, সিঙ্গাপুরের কিন্তু তেমনটি নেই। আমরা বাঙালিরা কিছু একটা হলেই বলি, এটা আমাদের সংস্কৃতি না। যেটা সিঙ্গাপুরের লোকজন বলতে পারে না। তাই সেখানকার নেতৃত্ব যে আইন প্রয়োগ করছে, সেটা মানতে বাধ্য থাকছে। বিষয়টি আবার আমাদের এখানে সম্ভব নয়। নতুন কোনো নিয়ম হলে সেটা তারা মেনে নিচ্ছে। আমরা এই জায়গায় পিছিয়ে যাচ্ছি।
আপনার কি সে রকমই মনে হচ্ছে? এখানে সংস্কৃতি মানে আমরা বুঝে নিচ্ছি একটা বৈশিষ্ট্য। সংস্কৃতি বলতে আসলে অনেক কিছুর সংমিশ্রণকে বোঝায়। আপনার কি মনে হয়, আমরা যে সংস্কৃতির মধ্যে আঁটকে আছি, সেখান থেকে বের হওয়া প্রয়োজন?
ফাতিমা: আমার মনে হয় এই জায়গাটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। কিন্তু আমাদের অবচেতন মনে যে সংস্কৃতি ঢুকে গেছে, সে সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। যেমন আমি নিজেও বাংলাদেশ বা ভারতের যে সংস্কৃতি, সেটা থেকে মাঝেমধ্যে বের হয়ে আসতে পারি না। এক ধরনের মানুষ হয়তো বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু আরেক ধরনের মানুষ আছেন, যারা এই বিষয় থেকে কোনোভাবেই বের হয়ে আসতে পারেন না। তবে তাঁদের মঙ্গলের জন্য এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
তার মানে কি সময় অনুসারে সংস্কৃতিতে সংস্কার করা উচিত? কারণ, সংস্কৃতি শব্দটির মধ্যে সংস্কার শব্দটি আছে।
ফাতিমা: আমি মনে করি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুর সংস্কার বা পরিবর্তন হওয়া উচিত। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক কিছু বদলাচ্ছে। যেমন—আগে মানুষ পায়ে হেঁটে বা গরুর গাড়িতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আসা–যাওয়া করত। সেখানে আজকে মানুষ ব্যবহার করছে ইঞ্জিনের কোনো গাড়ি। যেহেতু আমরা যুগের সঙ্গে নিজেদের পরিবর্তন করছি সেহেতু সংস্কৃতিরও পরিবর্তন হওয়া উচিত।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থা কেমন মনে করছেন?
ফাতিমা: প্রথমত, এ দেশে নারীদের কথা বলার স্বাধীনতা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাঁদের কথা শোনার মতো মন মানসিকতা আমাদের থাকতে হবে। আমরা শুধু বলেই যাব, কিন্তু কেউ তা শুনবে না। এভাবে চলতে থাকলে কোনো পরিবর্তনই হবে না।
এমন নয় যে বাংলাদেশের নারীরা কোনো কিছুতে প্রতিবাদ করছে না। কিন্তু তাঁদের দমিয়ে রাখা হচ্ছে। এ দেশের নারীরা যতই যৌক্তিক কথা বলুক না কেন, তাদের কেউ গুরুত্বই দিচ্ছে না। যেহেতু তিনি নারী, সেহেতু তার কথা শোনাই হবে না। আমাদের আসলে শোনার মতো মন মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
আমাদের সমাজের পুরুষদেরও নারীদের কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে। পুরুষদের চিন্তা ভাবনা পরিবর্তন করতে হবে। যেকোনো বিষয়ে নারী ও পুরুষের বক্তব্য নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পুরুষদের যেমন নারীদের কথা বলার জায়গা তৈরি করে দিতে হবে, তেমনি আমাদের নারীদেরও সাহসিকতার সঙ্গে কথা বলা শিখতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে কোনো কাজে যেন নিজেরা আপস না করে। এ দেশের নারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আপস করে চুপ হয়ে যায়। এমনকি আমার নিজের কর্মক্ষেত্রেও বলা হয়েছিল আপস করতে। কিন্তু আমি সেটা করিনি।
এই উপমহাদেশে নারীদের অপবাদ বা নিন্দিত হতে হয় বেশি। সমাজ কোনো নারীকে নিন্দিত বা অপবাদ দিল, সে নারীকে ভাবতে হবে তিনি ভালো আছেন। এ ক্ষেত্রে কোনোভাবেই ভেঙে পড়া যাবে না, হতাশ হওয়া যাবে না। যেটা করতে হবে, সেটা হলো সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।
এই যে আজকে আমি একা ভ্রমণ করছি। এটা করতে পেরেছি। তার কারণ অতিরঞ্জিত সামাজিকতাকে আমি খুব বেশি গুরুত্ব দিইনি। নিজের মতো করে চলার চেষ্টা করেছি। আমাকে এই চলার পথে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। যে কথাগুলো এখনো শুনছি। এ কথাগুলোকে আমি খুব বেশি গুরুত্ব দিইনি। আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, তাই আবর্জনাকে আমি বিদায় দিয়েছি।
আমাদের এ অঞ্চলের ইতিহাসে নারীদের গৌরবময় জায়গা রয়েছে। যেমন আমাদের বেগম রোকেয়া বা নাটোরের রানি ভবানী ছিলেন। নাটোরের রানি ভবানী এই ভারতবর্ষের বাইরের ইতিহাসেও বেশ প্রশংসিত ছিলেন। তিনি সরাসরি আলিবর্দী খানের সঙ্গেও কথা বলতেন বলে আমরা জানি। এ ক্ষেত্রে আপনার কি মনে হয়, কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর আমরা আমাদের সমাজ থেকে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছি অথবা পিছিয়ে পড়ে গেছি। এ সময়ে এসে নারীদের তাঁদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। নারীদের এই অধিকার আদায়ের আন্দোলনের বিষয়টি কিন্তু খুব বেশি দিন আগের কথা নয়।
নারীদের সব সময় এক ধরনের হতাশা তো ছিলই। সেটা হয়তো হাজার হাজার বছর ধরেই ছিল। আমরা যেটা জানি, এই পথপরিক্রমায় অনেক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যেটা ইউরোপের মতো পরিবর্তন নয়। ইউরোপের পরিবর্তনটা হয়েছে একটু অন্যভাবে। ইউরোপের বর্তমান নারী-পুরুষের যে ন্যায়ের শাসন, তার জন্য অনেক পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের খাপ খাওয়াতে হয়েছে। আমাদের এখানে কিন্তু সেটা করতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে মহিমান্বিত করার জন্য তাদের একজন নাইটিঙ্গেল তৈরি ও গ্রহণ করতে হয়েছে।
কিন্তু আমাদের এখানে রানি রাশমণি বা রানি ভবানী কিংবা বেগম রোকেয়াকে ওই জায়গা থেকে গ্রহণ করতে হয়নি। তাঁরা বরং উদ্ভূত পরিস্থিতিকে নিজেদের মতো করে সমাধান করে গেছেন। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, বেগম রোকেয়ার সময়ে তৎকালীন মুসলিম ও হিন্দু সমাজ একই রকম রক্ষণশীল ছিল।
ফাতিমা: এ কথা ঠিক যে, সে সময়ে হিন্দুদের সমাজব্যবস্থা অনেক রক্ষণশীল ও পর্দাশীল ছিল। ওই সময়ে নারীরা অন্তঃপুরবাসিনী ছিলেন এবং কঠিনভাবে পর্দাপ্রথা পালন করতেন। তারা গঙ্গায় স্নান করতে গেলে পালকিতে কাপড় পেঁচিয়ে সেই পালকিকে তিন থেকে চারবার পানিতে ডুব দিতেন। তাঁরা পালকি থেকে বের হতেন না। আর সেভাবেই তাঁদের স্নানের কাজ সমাপ্ত হতো। এগুলো ছিল।
আপনার কি মনে হয়, একুশ শতকে এসে নারীরা অনেক বেশি সমস্যায় পড়ে যাচ্ছেন?
ফাতিমা: এখনকার নারীরা বাইরে বের হচ্ছেন, খেলাধুলাতে অংশগ্রহণ করছেন, চাকরি করছেন, রাজনীতিও করছেন। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও একজন নারী। আমার যেটা মনে হয়, আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত যে ব্যাপারগুলো আছে, যেমন রাজার পুত্র রাজা হবে, এ ক্ষেত্রে রাজার মেয়ে থাকলে সে মেয়েও কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন। এ বিষয়ে আমাদের চিন্তা ভাবনা পরিবর্তন করতে হবে। এ ধরনের পরিবর্তন বা সংস্কার অনেক বেশি প্রয়োজন।
অন্যদিকে সম্পত্তিতে ছেলেমেয়ের সমান অধিকার হওয়া উচিত। আইন করে সব ধর্মের ক্ষেত্রে সমতা আনতে হবে। এ ধরনের আইনি প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমাদের মন মানসিকতারও পরিবর্তন আনতে হবে। বেগম রোকেয়া, রানি রাশমণি কিংবা রানি ভবানী কিন্তু তাঁদের স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছিলেন। আর এই কারণেই মনে হয় তাঁরা সাহসী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
বেগম রোকেয়া, রানি ভবানীদের কিন্তু সমাজে লড়াই করতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সমাজ কিন্তু খুব সহজেই তাঁদের মেনে নেয়নি। তারপরও তাঁরা তাঁদের কাজ করে গেছেন। ১৮ শতকের নারীরা যদি সে সময়কার সমাজ বাস্তবতায় এই কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন, একুশ শতকে তো এই লড়াই আরও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। একুশ শতকে এসে আইন করা হচ্ছে সমতার জন্য। এই বিষয়ে যদি কিছু বলতেন।
ফাতিমা: রানি রাশমণির সময়েও কিন্তু দেখা গেছে, অনেক রাজা খুব অল্প বয়সে মারা গেছেন। তার পরিবর্তে কিন্তু তাঁদের রানিরা দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। এ ক্ষেত্রে নারীদের সাহসী হতে হবে। ভাবতে হবে এটা আমার রাজ্য, আমি আমার মতো করে রাজ্য পরিচালনা করব। রানি রাশমণি, রানি ভবানীর কিন্তু এই সাহস ছিল। বর্তমানে আমাদের দেশের নারীদেরও উদ্যোগী হতে হবে। সাহসিকতার সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। পুরুষেরা যে কাজ পারবে, আমরাও সে কাজ করতে পারব। আমাদের নারীরা এই কথাটাই চিন্তা ভাবনাতে আনতে পারেন না।
এই না পারার কারণ কী?
ফাতিমা: আমরা সব সময় দেখে আসছি, বাইরের কাজগুলো পুরুষেরা করছেন। বিষয়টি ছোটবেলা থেকে আমাদের মাথায় গেঁথে দেওয়া হয়। নারীরা মনে করে—এটা আমার কাজ না। আমি এটা পারব না। যে নারী মনে করেন, এ কাজ আমার, আমি এ কাজ করতে পারব, মূলত তারাই সমাজের এই বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। এটা সে আমলেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
তার মানে বলতে চাচ্ছেন, চরিত্রের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি?
ফাতিমা: আমরা হয়তো শিক্ষা–দীক্ষা গ্রহণ করছি, বাইরে যেতে পারছি। আমরা পোশাক–আশাকে আধুনিক হয়েছি। কিন্তু চিন্তা ভাবনাতে আমরা আধুনিক হয়ে উঠতে পারিনি।
ভ্রমণে ফিরি। একা ভ্রমণ। এই আগ্রহের মূল কারণ কী? মানুষ চাকরি করে অনেক টাকা উপার্জন করছে। আপনি চাকরি করে নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারতেন। আপনি কেন ভ্রমণের দিকে ঝুঁকে গেলেন?
ফাতিমা: মানুষকে জানা, বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিকে জানার আগ্রহ আমার অনেক বেশি। জানার আগ্রহ থেকে মূলত একা ভ্রমণে কৌতূহলী হয়েছি।
আমি একসময় করপোরেট অফিসে চাকরি করেছি। মাস শেষে অনেক টাকাও উপার্জন করেছি। কিন্তু দিন শেষে মনে হয়েছে, আমি যা চাইছি, তা চাকরি করে পূরণ করা সম্ভব নয়। আমার জানার প্রচণ্ড আগ্রহ। মানুষ সম্পর্কে জানার কৌতূহল আমার অনেক বেশি। করপোরেট অফিসে চাকরি করে, মোটা অঙ্কের টাকা বাড়িতে নিয়ে এসে আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারতাম না। তাই আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভ্রমণে ঝুঁকে গেছি। ভবিষ্যতেও মনে হয় এমন কিছু করব, যেটা করলে আমি এক জায়গায় আটকে থাকব না। মানুষ সম্পর্কে জানতে পারব।
আপনি তো অল্প কিছুদিন হলো বাংলাতে লিখতে শিখেছেন। এত কম সময়ে সুন্দর করে বাংলা আয়ত্ত করলেন কীভাবে? এটা কীভাবে আপনি অর্জন করলেন?
ফাতিমা: আমি আসলে যেভাবে কথা বলি, সেভাবেই লেখার চেষ্টা করি। বাংলা ভাষাকে আয়ত্তে আনার জন্য আমি রাতদিন বাংলা বই পড়ছি। শব্দের ভান্ডার বাড়ানোর চেষ্টা করছি। যখনই সময় পেয়েছি, তখনই বই নিয়ে বসে পড়েছি।
কোন ভাষায় আপনার চর্চা বা কাজ করতে হয়েছে বেশি? আপনার দীর্ঘদিনের চর্চার মাধ্যম কী?
ফাতিমা: আমার ইংরেজিতে চর্চা বেশি হয়েছে। আর কথাও বলেছি ইংরেজিতে বেশি। এর পর বাংলা, জার্মান, উর্দু, তামিল, হিন্দি ও আরবি।
আপনার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
ফাতিমা: ঢাকা আমার জন্মস্থান। ঢাকার খিলগাঁওতে আমাদের পৈতৃক বাড়ি রয়েছে। আমার মা মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। বাবা মারা গেছেন দেড় বছর আগে। আমার এক বোন ঢাকায় থাকেন, পেশায় ডাক্তার। বাবার নাম এস এম ফজলে আলী। উনি যুগ্ম সচিব হিসেবে কেবিনেট বিভাগ থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি মূলত ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
যে কথা বলতে চাই, আমরা আসলে অনেকাংশে নির্লিপ্ত হয়ে গেছি। যেটা আগে ছিল না। আমরা এ সময়ে এসে নিজেদের সমাজে নিরাপদ মনে করছি না। ছোটবেলায় মা দারোয়ানের সঙ্গে আমাকে স্কুলে পাঠিয়েছেন। মাকে কখনো দেখিনি আমি বা আমার বোনের সঙ্গে স্কুলে যাচ্ছেন। যেটা এখনকার দিনে সম্ভব নয়। সমাজে আইন–শৃঙ্খলার অবক্ষয় হয়েছে। নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এটা একটি সমাজের জন্য অনেক ভয়াবহ বিষয়। আমরা এই সময়ে অনেক বেশি স্বার্থপরও হয়ে গেছি। আমি যে সময়টাতে বাংলাদেশে ছিলাম সে সময়ের তুলনায় এখন অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আজ থেকে ২০ বছর আগের বাংলাদেশের সঙ্গে এখনকার বাংলাদেশের তেমন কোনো মিল খুঁজে পাই না। আমি এ কারণে খুবই হতাশ। সমাজে ধর্মের অপব্যবহার বেড়ে গেছে এখন বেশি।
আমরা প্রতিযোগিতামূলক মন মানসিকতার মধ্যে বড় হচ্ছি। সামাজিকভাবে আমরা যে অবস্থানে আছি, সেটা থেকে আরও অনেক ওপরের অবস্থানে যেতে হবে—এই চিন্তায় আমরা ক্রমশ বেড়ে উঠছি। এখনকার বেশির ভাগ বাবা–মা চান তাঁদের সন্তান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে। টাকা পয়সা দিয়ে গাড়ি বাড়ি তৈরি করবে। সে টাকা হোক সৎ না অসৎ কোনো উপায়ে আসছে, সেটা কোনো বিষয় নয়। এই যে প্রতিযোগিতামূলক একটা অবস্থানে আমরা নেমে গেছি এর জন্য আমরা যা হতে চাই বা যেটাতে আমার আগ্রহ বেশি, সে জায়গা থেকে আমরা অনেক দূরে পিছিয়ে পড়ছি। এতে আমাদের আগ্রহের জায়গাতে ভাটা পড়ছে।
তবে এ ক্ষেত্রে সমাজ ব্যবস্থা অনেক বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। যেমন আজকে আমি যদি করপোরেট অফিসের চাকরি ছেড়ে দিই, তাহলে আমাকে শুনতে হবে অনেক কথা। সবাই হায় হায় করবে। অনেক ধরনের কথা শুনতে হবে। এই কটু কথা অনেকে সহ্য করতে পারেন না। এ জন্য তাঁরা মনের কাছে হেরে গিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমে যায়।
আমি বলতে চাই, চাকরি ছেড়ে দিয়ে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছি। এই কাজটা অনেকেই করতে পারেন না। এ ধরনের সাহসী পদক্ষেপ আসলে নারী-পুরুষ সবারই নেওয়া উচিত। আমি আমার আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়েছি। এতে আমি খুব আনন্দিত।
এই আনন্দে, খুশি থাকাই জীবনের মূল বিষয়। লালন বলেছেন, ‘সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো।’ ফাতিমা আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
ফাতিমা: আপনাকেও ধন্যবাদ।
ইউনিক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত হোসেন। পর্যটনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি মনজুরুল ইসলাম।
০৩ অক্টোবর ২০২৪বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, সুফি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোনো বিভাজনমূলক এজেন্ডায় রাজনীতির দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত না হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা দৃঢ়ভাবে কোনো সাম্প্রদায়িক ফাঁদে আটকা পড়তে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করি। কোনোভাবেই তা হতে দেওয়া যাবে না।
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪‘আমি এটাকে ঠিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বলব না। আমি এটাকে বলব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সেটা আমার পারিবারিক শিক্ষা। আমাদের ঘরের ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে যেকোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পরিবারের বড়দের সাথে আমরা দ্বিমত পোষণ করতে পেরেছি। ছোট থেকে বড়, কারও কোনো কথা বা কাজ ভুল মনে হলে সেটাকে আমরা তার প্রতি স
৩১ আগস্ট ২০২৪একেক মানুষ বেছে নেন একেক পেশা। তাঁদের মধ্যে কারও কারও পেশা একটু ভিন্ন ধরনের। যেমন—মো. মুনসুর আলী ওরফে মন্টু খলিফা। বাপ-দাদার পেশাকে ভালোবেসে শিশুদের খতনা করানো বা হাজামের কাজ বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। জীবনে পার করেছেন প্রায় ৮৫ বছর। জানিয়েছেন গত ৬০ বছরে ২ লাখের বেশি শিশুর মুসলমানি বা সুন্নতে খতনা দিয়
৩০ মার্চ ২০২৪