আজকের পত্রিকা: আপনার বয়স ৮০ পূর্ণ হচ্ছে, আপনাকে শুভেচ্ছা। সারা জীবন যে সমাজের কথা বলেছেন, যে সংগ্রাম করেছেন, সেই জায়গা থেকে বলুন, আগামীর রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে?
রাশেদ খান মেনন: আমরা যখন ছাত্ররাজনীতিতে এসেছি এবং রাজনীতির যে সময়টা পার করেছি, সেই সময়টা ছিল আমাদের জাতীয় চেতনা উন্মেষের কাল। পৃথিবীব্যাপী সাম্যবাদী ব্যবস্থা প্রবর্তনের আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল সে সময়। সেই সময়ের রাজনীতি ছিল অনেক বেশি আদর্শনিষ্ঠ। ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছিলাম।
আজকের দিনে রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। যে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের স্বপ্ন দেখে আমরা রাজনীতি শুরু করেছিলাম, সেই সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব আর নেই; বরং পৃথিবীব্যাপী নয়া উদারনৈতিক রাজনীতি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। নতুন প্রজন্ম অনেক বেশি ভোগবাদী হয়ে উঠেছে।
রাজনীতি বা রাজনৈতিক সংগ্রাম মানুষের মধ্যে এখন আর কাজ করে না। রাজনীতিকে তারা এখন দেখে নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠা, অর্থবিত্ত ও সম্পদ আহরণ এবং ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার জায়গা থেকে। ফলে আদর্শ ও ত্যাগ-তিতিক্ষার জায়গা থেকে আমরা যে রাজনীতিতে এগিয়েছি, আজকে এই অবনমনের জায়গাটা দেখে ক্ষুব্ধ হই, কিন্তু এটাই হলো বাস্তবতা।
আজকের পত্রিকা: এই পরিস্থিতি কেন এবং কী করে সৃষ্টি হলো?
রাশেদ খান মেনন: এককথায় পুঁজির দাপটে সামগ্রিকভাবে সবকিছুতে পচন ধরেছে। মার্ক্সবাদের প্রাসঙ্গিকতা তখনো ছিল, এখনো আছে। এখন আরও বেশি করে আছে। কারণ হলো, পশ্চিমা বিশ্ব কিন্তু এখন পুঁজিবাদের বিশ্লেষণ করার জন্য মার্ক্সবাদের অধ্যয়ন করছে। কারণ, তারা দেখছে, পুঁজিবাদ অল্প দিন পরপরেই সংকটের মধ্যে পতিত হচ্ছে। সেই সংকট থেকে উত্তরণ করতে গিয়ে তারা রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদ এখন করুণ দশায় উপনীত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছেছে। এই অবস্থায় পথ দেখানোর ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদ আজও প্রাসঙ্গিক। তাই এসব দেশ এখন মার্ক্সবাদ দিয়েই পথ খুঁজছে।
আজকের পত্রিকা: আমাদের দেশে বামপন্থী রাজনীতির দিন দিন ক্ষয় কেন ঘটছে?
রাশেদ খান মেনন: বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থীরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল প্রধান। কিন্তু ষাটের দশকের মধ্য ভাগ থেকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিতর্কের কারণে পার্টি বিভক্ত হয়ে গেল। সেই বিতর্ক থেমে থাকেনি। এটা ক্রমাগত আরও ধারা-উপধারায় বিভক্ত হয়ে গেল। এই বিভক্তির ফলে তাদের শক্তির ক্ষয় হলো। মস্কোপন্থী আর পিকিংপন্থী হোক, তারা দেশীয় পরিস্থিতির চেয়ে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দিকে চেয়ে থাকত। কেউ রাশিয়ার দিকে এবং কেউ চীনের দিকে চেয়ে থাকত।
রাশিয়া মনে করত, এখানে বুর্জোয়া নেতৃত্ব দিয়ে বিপ্লবের পথে এগোনো সম্ভব। আর এটা মেনে নিয়ে মস্কোপন্থীরা নিঃশর্তভাবে বুর্জোয়া দল আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে গেল। অন্যদিকে চীনপন্থী দলগুলো চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব এবং ভারতের নকশালবাড়ী আন্দোলনের প্রভাবে সশস্ত্র বিপ্লবের লাইন গ্রহণের ফলে ক্রমাগত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আবার মুক্তিযুদ্ধ যখন সংগঠিত হলো, সেই প্রশ্নে খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবে চীন ধারার যে দলগুলো ছিল, আমরাসহ কয়েকটি পার্টি বাদে প্রায় অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করল। এসব কারণে বামপন্থীরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এরপর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের যে বিপর্যয়, সেটাও আমাদের দেশের বামপন্থী রাজনীতির এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপর্যয়ের ফলে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মানুষের মনে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা, যারা সেই সব লড়াই-সংগ্রাম দেখেনি, তারা সেসবকে অলীক স্বপ্ন বলেই মনে করে।
তাদের সামনে রয়েছে নতুন পৃথিবী, যেখানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, ইন্টারনেট, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, চ্যাটজিপিটি—এসবই হলো তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। এখন আপনি যে আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন একটা স্মার্ট মোবাইল দিয়ে, সেসব কি আমরা কিছুদিন আগেও ভাবতে পারতাম? আমাদের এ সময়ের ছেলে-মেয়েদের এখন ফেসবুকে দিনের অধিকাংশ সময় কাটে। আমার মনে হয়, তাদের আসলে ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নেই। এমনকি প্রেম-বিরহের অনুভূতিও মোবাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।
আজকের পত্রিকা: সামনে জাতীয় নির্বাচনের আগে জোটকেন্দ্রিক সমীকরণে কোনো চমকের সম্ভাবনা আছে কি?
রাশেদ খান মেনন: ১৪ দলীয় জোট থেকে আমরা নির্বাচন করব, সেটা তো প্রধানমন্ত্রী অনেক আগেই বলেছেন। আশা করি, জোটগতভাবে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। তবে বেশ কিছু ইসলামিক দলসহ আরও কিছু দল, যারা এখনো নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধিত নয়, তারা ১৪ দল অথবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদেরকে নতুন করে জোট গঠন করতে বলা হয়েছে। পরে ১৪ দলকে সম্প্রসারণ করে মহাজোট গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যাবে।
আজকের পত্রিকা: আপনি কি মনে করেন, আগামী নির্বাচনে বহিঃশক্তির কোনো প্রভাব পড়বে?
রাশেদ খান মেনন: এ দেশে বহিঃশক্তির কোনো ধরনের অবস্থান আছে বলে আমি মনে করি না। আমেরিকার ভূমিকা এ দেশের মানুষ একাত্তর ও পঁচাত্তর সালে দেখেছে। তাদের ভূমিকা দেখেছে এরশাদ আমলে। এরশাদ আমলেই তাদের সম্পর্কে এ দেশের মানুষের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। আমেরিকাকে এ দেশের জনগণ খুব একটা পছন্দ করে না। তা ছাড়া মুসলিম বিশ্বে আমেরিকার যে ভূমিকা, সে কারণেও এ দেশের মানুষ তাদের গ্রহণ করে না। ফলে আমেরিকা, মার্কিন যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের যেসব দেশ আছে, বাংলাদেশের রাজনীতি বা নির্বাচনে তারা খুব বড় কোনো প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি না।
আজকের পত্রিকা: সরকার এত ঋণ নিচ্ছে। সম্প্রতি আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ঋণ নিয়েছে। এ দেশের মানুষের জন্য সেটা কি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না?
রাশেদ খান মেনন: আইএমএফের ঋণ সব সময় শর্তমাফিক হয়। যদিও আইএমএফ বলছে, এসব শর্ত পূরণ না করলে পরবর্তী কিস্তি দেওয়া হবে না। আর এ দেশের অর্থনীতি এগোবে না। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি এমনিতেই এগিয়ে আছে। তবে আমি আইএমএফের ঋণ নেওয়াটাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখছি না। কারণ, আইএমএফের শর্তের কারণে জনগণের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসবে বলে আমার ধারণা।
দক্ষিণ কোরিয়া ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ অতীতে এবং এখনো দেখছি, এসব আমাদের জন্য খুব বেশি উপকার করেনি। ঋণ নিলে শোধ করার ক্ষমতা আমরা এখনো রাখি। সে সক্ষমতা আছে বলে আমি মনে করি।
আজকের পত্রিকা: আমাদের দেশে অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। একই সঙ্গে ধর্মান্ধতা ও বৈষম্য বেড়েছে। এর কারণ কী?
রাশেদ খান মেনন: আমাদের দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সাধারণ জনগণ এ উন্নয়নের ফল পাচ্ছে না। একটা চরম বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। এই বৈষম্যের সূচক চলে গেছে ৪ দশমিক ৯৯; যেটা বিপজ্জনক। এই বৈষম্যের কারণে স্বাভাবিকভাবে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম অস্থিতিশীল অবস্থায় জনগণ রাষ্ট্রের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে, তখন ধর্মকে আঁকড়ে ধরে। আবার বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দলের পক্ষ থেকে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করার পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে ছিল এবং এখনো আছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরও একটা ভূমিকা এখানে আছে। এখানে তারা জামায়াতের মাধ্যমে ধর্মীয় মৌলবাদের প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করেছে। সবকিছু মিলিয়ে মানুষের মধ্যে রক্ষণশীল মনোভাব তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে আমাদের সরকার বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে আপস করে চলার নীতি গ্রহণ করেছে।
আজকের পত্রিকা: জীবনের দীর্ঘ সময় পার করেছেন। বিষয়টি সামগ্রিকভাবে যদি মূল্যায়ন করেন।
রাশেদ খান মেনন: জীবন তো আসলে সরলরেখায় চলে না, আঁকাবাঁকা পথে চলে। তবে আমার জীবনটা কোনো মসৃণ পথে চলেনি। খুব কঠিনভাবে জীবনটা পার করেছি। সেই পথে যেমন অর্জন আছে, তেমনি ব্যর্থতাও আছে। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, এসব আমাদের অর্জন। পরে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং বিএনপি-জামায়াতবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছি এবং বিজয় অর্জন করেছি। এসব আমাদের অর্জন।
কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম, স্বাধীনতার সূর্যোদয়ে আমার চোখে যে স্বপ্ন ছিল, সেটা পূরণ হয়নি। সমাজে আগের চেয়ে বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, অসহিষ্ণুতা, ভেদাভেদ বেড়েছে। এসব নেতিবাচক দিক আমাকে পীড়া দেয়। জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে আসার পর এসব দেখতে হবে, তা কখনো আশা করিনি।
আজকের পত্রিকা: আপনাকে ধন্যবাদ।
রাশেদ খান মেনন: আজকের পত্রিকাকে ধন্যবাদ।