উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দত্ত। এই লেখক সদ্য গত হয়েছেন। আর তাই সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ও বন্ধ সাপ্তাহিকটির তখনকার নির্বাহী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারের সম্মতিক্রমে আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।
তাপস কুমার দত্ত: ওপার বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে এপার বাংলার বাঙালিদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যে পার্থক্য, সেটা যত দিন যাচ্ছে ততই কি দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: দুটো ঘটনা ঘটেছে এখানে, সেটা হচ্ছে—১৯৪৭ সালের আগে যে বাংলা, একত্র দুই বাংলা, যেখানের হিন্দু আর বাঙালিরা ছিল সম্পূর্ণ কলকাতামুখী। মুসলমান বাঙালিদের মধ্যে দুটো শ্রেণি ছিল—একটা শ্রেণি অত্যন্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ, শিক্ষিত লোক এবং বেশির ভাগই ছিল অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মুসলমান। এ অল্প ও অশিক্ষিত মুসলমানদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিরা ডমিনেট করল। ফলে যখন দেশ ভাগ হলো, তখন অল্পশিক্ষিত অশিক্ষিত মুসলমানেরা উল্লসিত হলো, কারণ, শিক্ষিত বাঙালিরা ভয় পেল, দু-একটা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলো। আমি বাংলাদেশের অনেক জেলার কথা জানি, যেখানে আজ অবধি কোনো মানুষ খুন হয়নি দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে। যেমন ধরুন, রংপুর। সেখানে আজ অবধি কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত না ঘটা সত্ত্বেও রংপুর থেকে অনেক মানুষ চলে এসেছে ভারতবর্ষে। তখন এ রকম একটা প্রচারণা এসেছিল—পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানদের জায়গা। অতএব, হিন্দুরা সেখানে থাকলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তাই ছোটো ইন্ডিয়া। সেই ছোটার কাহিনিটা গত ৫৫ বছরের। সেই ছোটার কাহিনিতে অনেক মানুষ একেবারে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে তলিয়ে গেছে। আবার অনেক মানুষ সংগ্রাম করে করে ওপরে উঠেছে।...
তাপস কুমার দত্ত: এরপর থেকেও তো অনেক সংখ্যালঘু ওপারে চলে গেছে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এপার থেকেও গেছে, তবে তা আনুপাতিক হারে যথেষ্ট কম। যা বলছিলাম, এ ৫৫ বছরে যদি কেউ লাভবান হয়ে থাকে, আমি এপার বাংলার কথা বলছি—তা হলে হয়েছে পশ্চিম বাংলার মেয়েরা। এই যারা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল—সংগ্রাম করেছে, কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে, বস্তি বা কলোনিতে কোনোক্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে; তাদের দেখাদেখি পশ্চিম বাংলার কনজারভেটিভ পরিবার—যারা মেয়েদের অন্দরমহলে ফেলে রেখেছিল এবং অফিস-কাছারিতে যাওয়া তো স্বপ্নের বাইরে ছিল। যখন পূর্ববঙ্গের মেয়েরা জীবনসংগ্রামের বাধ্যবাধকতায় গ্র্যাজুয়েশন করে স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে ঢুকল; তখন এখানকার মেয়েরা উৎসাহিত হলো। আমরা যখন কলেজে পড়তাম; সন্ধ্যা ৬টার পর ট্রামে-বাসে কোনো মেয়েকে দেখা যেত না; যদি কোনো মেয়েকে দেখা যেত তা হলে সে নিশ্চয়ই বাঙাল (পূর্ববঙ্গীয়) হতো। কিন্তু এ পশ্চাৎপট একদম পাল্টে গেল ১৯৬৮ সালের পর থেকে। তখন বাস্তবিক নিষ্পেষণে পশ্চিম বাংলার মেয়েরাও বেরোতে শুরু করল, যেটা বলতে গিয়ে সরে এসেছি—সেটা হলো, এই দেশবিভাগ এবং এ দেশে উদ্বাস্তু স্রোত আসার অনেক খারাপ দিকের এই একটা ভালো দিক, আমাদের মেয়েরা অর্গল ভেঙে বেরোতে পেরেছিল। কিন্তু ওখানে (বাংলাদেশে) যারা রয়ে গেল (হিন্দু সম্প্রদায়) তাদেরও, আমরা দেখেছি, কেউ ১৯৬৭, কেউ ১৯৭০, কেউ ১৯৭৬-এ চলে আসতে লাগল।
তাপস কুমার দত্ত: এখনো কি অল্পবিস্তর চলে আসছে?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এখনো আসছে এবং এদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে এরা আওয়ামীপন্থী ছিল। অর্থাৎ এ দলটির কাছে ওরা নিরাপদ বোধ করত।
তাপস কুমার দত্ত: দেশভাগের পর ওপার বাংলার কী কী বিশেষ পরিবর্তন আপনার কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়েছে?
সমরেশ মজুমদার: ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এ ২৪ বছরে বাঙালির জীবনে পূর্ববঙ্গে একটা জিনিসেরই আমদানি ঘটেছে, সেটা হলো ইসলাম এবং ইসলামকেন্দ্রিক আরবি-ফারসি শব্দ। ওই সময় যাঁরা লেখালেখি করতেন, যেমন ধরুন—শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস—এঁরা যে বাংলা লিখতেন, তা ছিল পশ্চিম বাংলার বাংলা; অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারকৃত বাংলা। এঁরা বাংলার প্রাচীন সাহিত্য এবং রামায়ণ-মহাভারত ও আরও সব পৌরাণিক...প্রাচ্য ও পশ্চিমের সাহিত্যের ওপর ভালো দখল রাখতেন এবং সেটা তাঁদের ভেতরে লালন করতেন। ১৯৭১ সালের পর একটা আবেগ এল, আবেগের সঙ্গে ভয় এল। ভয়টা এই—আমরা এত দিন উনুনে পুড়ছিলাম, উনুন থেকে লাফিয়ে গরম তেলে পড়লাম না তো? অর্থাৎ আমরা পাকিস্তানের অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছিলাম, এখন ভারত বড়দাদার মতো দাদাগিরি করবে না তো? আমাদের দখল করবে না তো? তার কিছু কিছু ইন্ধন—আপনারা জানেন—ভারত যে সম্পূর্ণ বৈষ্ণব হয়ে ছিল তা নয়, ভারতের তরফ থেকে যারা দু-একটা বদমায়েশি কাজ করেছে, সেসব বাংলাদেশের কাছে প্রবল হয়ে ধরা দিল। ১৯৭১ সালের ওই আবেগ যখন কমতে শুরু করল, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর ওখানকার রাজনৈতিক দলগুলো জনসাধারণকে সস্তা পথে পাওয়ার জন্য অ্যান্টি-ভারত আবহাওয়া তৈরি করল এবং সেটা তাদের ভোট অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়কও হলো। এ সময় থেকে আমরা দেখতে শুরু করলাম, বাংলা সাহিত্যে যা লেখালেখি হচ্ছে, খবরের কাগজে রিপোর্টিংয়ে যে বাংলায় লেখালেখি হচ্ছে, সেখানে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর একটা উদাহরণ হলো জিম্মা। এ ‘জিম্মা’ শব্দটা আগে ওপার-এপার, কোনো বাংলায়ই ব্যবহৃত হতো না। যেমন খাবারটা খেয়ে দারুণ ‘মজা’ লাগল। এ ‘মজা’ শব্দটা হলো রসে-বসে আনন্দে আছি। তা খাবারটা খেয়ে ‘মজা’ লাগবে কেন আমার? খাবারটা খেয়ে আমার দারুণ ভালো লাগবে, অথবা আমি খুব আনন্দ পেলাম খেয়ে। কিন্তু ‘মজা’ লাগা বলতে কোথাও যেন একটু কৌতুক মেশানো থাকে। এ ধরনের কিছু শব্দ তৈরি হতে লাগল। এসব সচেতনভাবে তৈরি হতে লাগল, যাতে পশ্চিম বাংলার ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা আস্তে আস্তে একটু একটু করে আলাদা হতে থাকে। আবার, আমরা দেখতে পাই, ১৯৬০ বা ’৬৫ সাল অবধি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের আগ অবধি যেকোনো মুসলিম পরিবারে আরবি বা ফারসি নাম দেওয়া হতো। কিন্তু এর পর থেকে দেখা গেল তাদের নামের পাশে ব্র্যাকেট করে একটা ডাকনাম দেওয়া হলো। ১৯৪০-৫০ সালের দিকে কোনো মুসলমানের ডাকনামের তেমন প্রচলন ছিল না। ক্রমে এ ডাকনামই তার হাইলাইটস পেত বেশি, আসল নামটা আড়ালে থাকত। যেমন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। আমরা সবাই জানি ‘বন্যা’। এটা কিন্তু পাশাপাশি সচেতনভাবে বাঙালিত্ব ধরে রাখার প্রচেষ্টা। এর পরবর্তী প্রজন্ম, সত্তরের দশক থেকে যে প্রজন্ম শুরু হলো—তারা আরও অদ্ভুত হলো। তাদের আবার নাম হয়তো আবুল হায়াত, মেয়ের নাম বিপাশা হায়াত বা সুবর্ণা মুস্তাফা। হায়াত বা মুস্তাফা তার পারিবারিক পদবি কিন্তু নামটা বাংলা শব্দ। অর্থাৎ আগে যেটা ব্র্যাকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেটা এখন নামের সাইনবোর্ডে এসে প্রকাশ হলো। পাশাপাশি আরও একটা অদ্ভুত ছবি আছে; ছবিটা হলো—চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষ, ধরুন একজন মা; তার ছেলে হয়তো ঢাকায় চাকরি করে। তিনি যখন তার ছেলেকে চিঠি লিখছেন, তখন চট্টগ্রামের ভাষায় লিখছেন না। তিনি বইয়ের ভাষায় চিঠি লিখছেন এবং ছেলেও তা-ই করছে। কিন্তু ছেলে আর মায়ের যখন পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়, তখন কিন্তু তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন, যা ঢাকার লোক বুঝবে না। তা হলে চিঠিতে কেন বাংলা বর্ণমালায় চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করছে না? এ নিয়ে আমার নিজস্ব অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু এ বাঙালিত্ব বজায় রাখার জন্য একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি, একবার এক অনুষ্ঠানে একজন লোকের সঙ্গে—তাকে বাংলাদেশের মনে হওয়ায়—কথা বলতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাংলাদেশের? কোন জেলায় বাড়ি?’ তিন-চারবার প্রশ্ন করার পরও কোনো উত্তর পেলাম না। লোকজন অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার, তুমিও বাঙালি, সে-ও বাঙালি অথচ একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারছ না?’ আসলে সে সিলেটের বাঙালি। সে আমাদের ভাষা ভালোভাবে জানে না এবং নিজে যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষা আমাদের কাছে অজানা, তাই কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে। এই যে এত পার্থক্য—এসব পার্থক্যের সুযোগ নিয়েছে—আমার মনে হয়, কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী, যাতে বাংলা ভাষাকে ভাঙা যায়, নষ্ট করা যায়। একটা নতুন ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধরুন, যদি মসজিদে যান, মসজিদে যে প্রার্থনা হয় তা বাংলায়। যেখানে একদম পরিষ্কারভাবে, ‘হে পরম পিতা!’—এভাবে শুরু করে।...‘আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি; আমাদের প্রিয়জন তোমার কাছে গিয়েছে, বাসা থেকে কেউ যদি বিদেশে যায়, তবে তার চিঠিপত্তর, টেলিফোনে খবর পাওয়া যায়। তিনি আজ যেখানে গেছেন, সেখানে এসব কোনো পথ নেই; কিন্তু আমরা জানি, তিনি তোমার কাছে গেছেন। অতএব, তুমি তাকে ভালো রাখবে...। আমিন!’ এ কথাগুলো অতি পরিষ্কার সিম্পল বাংলা কথা, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না; অশিক্ষিত লোকও স্পষ্ট বুঝতে পারছে; কিন্তু ‘আমিন’ শব্দটা উচ্চারণ হওয়ামাত্র একটা অন্যরকম গন্ধ এল। আমিন কথাটা খ্রিষ্টানরা বলে। খ্রিষ্টানরা ‘পরম পিতা’ও বলে। কোরআনকে তো পৃথিবীর সব দেশের সব মুসলমান যথাযথ অনুসরণ করে না। আজকের পৃথিবীর সব মুসলমানের...বাংলাদেশের মুসলমানদের আইডিয়াল হচ্ছে ‘আরবি’ এবং আরবের লোকজন। অথচ আরবরা যে বুর্জোয়া জীবনযাপন করেন—মেয়েদের ক্ষেত্রে পার্টিকুলারলি—সেটা মানতে পারেন না ঢাকার মুসলমানরা; কিন্তু এরপরও ওরা আইডিয়াল। আজ যদি তুমি ঢাকা বা ফরিদপুরের রাস্তায় রোজার সময় যাও, তাহলে দেখবে, পর্দা টানিয়ে হোটেলে খাওয়াদাওয়া চলছে। অর্থাৎ পর্দা টানিয়ে দুপুরে খাওয়া যায়। আমার বন্ধুবান্ধব, যাঁরা আমার কাছে রোজার সময় আসছেন, তাঁরা প্রায়ই বলতেন, ভাই, আমি অসুস্থ, রোজা রাখতে পারছি না। কেউ বলতেন, আমি তো এখন পর্যটক! কারও হাঁটুতে ব্যথা, একটা অজুহাত, যেহেতু নামাজ পড়তে পারবে না...এসব অজুহাত বা ছুতো—এগুলো সবই কিন্তু বেরিয়ে আসার চেষ্টা। কিন্তু তারা ভয়ে থাকে, বেরিয়ে আসতে ভয় পায়। ফলে আমাদের সঙ্গে ওদের যে ডিফারেন্স, সেই ডিফারেন্সটা যথেষ্ট বড়। কারণ, আমরা যারা জন্মসূত্রে হিন্দু, তাদের ৮০ ভাগ হিন্দুধর্মের এ-বি-সি-ও পালন করি না। অথচ আমরা হিন্দু। বলতে হয়, তাই হিন্দু। আমাদের ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মাচরণ নেই। দুর্গাপূজা এলে আমরা প্ল্যান করি কোথায় বেড়াতে যাব। পুজোর আচার-আচরণের মধ্যে আমরা নেই। আমরা নানা খাবার দিয়ে, বিস্কুট, চাল-ডাল, চকলেট দিয়ে মূর্তি গড়ি, ছেলেখেলার মতো। কালীপূজার সময় আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি, পটকাবাজির ভয়ে। তাহলে আমরা হিন্দু হলাম কোথায়? আমরা ধর্ম থেকে সরে গেছি আস্তে আস্তে। তবে এ ধর্ম আমাদের কিছু দেয় না, আমাদের থেকে কিছু নেয়ও না। যখন রামকে নিয়ে সারা ভারতে এত হইচই কাণ্ড চলত, তখন আমরা পশ্চিম বাংলার মানুষজন রামকে একবারও দেবতা বলে মনে করি না। আমরা হনুমানকে দেখে ঠাট্টা করি, ‘কলা খাবি’ বলে। কিন্তু হনুমান ওদের কাছে ঈশ্বরের অবতার। ঘটনা যখন এ রকম ঘটে যায়, তখন বাংলাদেশের মুসলমান যারা; যারা সত্যিকার অর্থে কোরআন মানে, ধর্মান্ধ নয়, তারা কিন্তু আমাদের থেকে অনেক ডিসিপ্লিনড। ধর্ম ডিসিপ্লিন তৈরি করতে সাহায্য করে। ধর্ম একত্র করে মানুষকে। কিন্তু সেই একত্র করার মাঝখানে ধর্মান্ধ বা ধর্ম ব্যবসায়ীরা যত গণ্ডগোল পাকায়। ফলে আমাদের মধ্যে ক্রমেই পার্থক্য বাড়ছে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার কি মনে হয়, কয়েক দশক আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে রাজনীতিতে যে রকম মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, তাতে করে আগামী কয়েক দশক পর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রকম ধর্মরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
সমরেশ মজুমদার: আমার তো উল্টো মনে হয়। আমার মনে হয়, ধর্মান্ধ যারা—সে হিন্দু বা মুসলমান হোক, খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা কখনো শুনিনি। যদিও ক্রিশ্চিয়ানিটি পৃথিবীজুড়ে ছিল, কিন্তু আজ অবধি খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা শুনিনি, বৌদ্ধ ধর্মান্ধ শুনিনি।
তাপস কুমার দত্ত: ইউরোপে এককালে খ্রিষ্টানরাই ব্লাসফেমির মতো ঘৃণ্য আইন ধর্মের বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল—ওসব কি ধর্মান্ধতা নয়?
সমরেশ মজুমদার: খ্রিষ্টানরা এখন অনেক শ্রেণির হয়ে গেছে, সেখানে তারা একত্র নয়।
তাপস কুমার দত্ত: না, সেটা অন্য ব্যাপার, প্রশ্নটা হলো...
সমরেশ মজুমদার: আমাদের ভারতবর্ষেও তো হিন্দু ধর্ম একেক জায়গায় একেক রকম। আপনি সাউথ বা নর্থ ইন্ডিয়ায় বা অন্য প্রান্তে যে হিন্দু ধর্ম দেখবেন, তা পশ্চিম বাংলায় পাবেন না; এক জায়গার সঙ্গে অন্য জায়গায় ধর্মীয় অমিলই বেশি।
তাপস কুমার দত্ত: প্রশ্নটা তা নয়। একটা ধর্ম সম্প্রদায় নানা খণ্ডে বহু ধারায় বিভক্ত হতেই পারে। কিন্তু যেকোনো ধারারই একটা প্রচ্ছন্ন গোঁড়ামি আছে, মৌলবাদ আছে; আর সেটাই দিন দিন বিশ্বের ওপর বেশি পরিমাণে চেপে বসছে। আপনি কী মনে করেন?
সমরেশ মজুমদার: না, আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমার তো মনে হয়, ধর্ম পৃথিবী থেকে আস্তে আস্তে লোপ পেতে চলেছে। এখন যে চিৎকারটা আমরা শুনতে পাচ্ছি—কারণ, ধর্মবাদীরা আতঙ্কগ্রস্ত বলে চিৎকার করছে।
তাপস কুমার দত্ত: প্রথাগত ধর্মে আপনার বিশ্বাস কতটুকু?
সমরেশ মজুমদার: আমি ধর্মে একদম বিশ্বাসী নই।
তাপস কুমার দত্ত: আর বিবাহ প্রথায়?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, বিবাহ প্রথায় বিশ্বাসী। তবে বিয়ে কীভাবে হবে, সেটা নির্ভর করছে যারা বিয়ে করছে, তাদের ওপর।
তাপস কুমার দত্ত: তৃতীয় বিশ্বে বসবাস করার একটা মানসিক যন্ত্রণা আছে। বিশেষ করে, শিল্পী-সাহিত্যিক...যেকোনো সৃজনশীল মানুষের। আপনি তা কতটা অনুভব করেন?
সমরেশ মজুমদার: এটা ভারতবর্ষে, মানে পশ্চিম বাংলায় নেই, আমি কখনো অনুভব করিনি। এটা গুজরাটে থাকতে পারে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার লেখালেখিতে বা ভাবনায় কখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি বলছেন?
সমরেশ মজুমদার: সিপিএম যখন ক্ষমতায় এল, তখন আমি নকশাল আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস লিখলাম—কালবেলা। তো কালবেলার নায়ক অনিমেষ তখন কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বলেছে, সিপিএম ভ্রষ্টাচারী। আমাকে কিন্তু ও রকমভাবে কোনো সরকার বা শক্তি আপত্তি করেনি।
তাপস কুমার দত্ত: নিজের বিচারে আপনার প্রিয় লেখা কোনটি?
সমরেশ মজুমদার: তিনটি লেখা আমার খুব প্রিয়। সেটা হচ্ছে—‘উত্তরাধিকার’...
তাপস কুমার দত্ত: এ সিরিজটা? অর্থাৎ ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’?
সমরেশ মজুমদার: না, ‘কালবেলা’ আমার প্রিয় নয়। ‘এখনও সময় আছে’ বলে আমার একটা উপন্যাস আছে, আমার ভীষণ প্রিয়। আর গত বছর আমি ‘দেশ’-এ একটা উপন্যাস লিখেছি—‘উৎসারিত আলো’—এ তিনটি।
তাপস কুমার দত্ত: লেখালেখিতে কতটা অসন্তুষ্টি বা অতৃপ্তি রয়ে গেছে?
সমরেশ মজুমদার: প্রতিটি লেখায়ই আমার অসন্তুষ্টি রয়ে যায়। আমার মনে হয়, আবার লিখলে ভালো করতাম। কিন্তু একবার বই আকারে...।
তাপস কুমার দত্ত: সেটা ওই বইটার নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর। আমার জিজ্ঞাসা হলো, এমন কোনো প্রিয় লেখা কি আপনার ভেতরে লালিত আছে, যা এখনো আপনি লিখে উঠতে পারেননি?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এই যে আপনাকে এর আগে যে কথাগুলো বললাম। আমি হুমায়ূন (আহমেদ)-কে বারবার বলেছিলাম, দ্যাখো, তুমি এত জনপ্রিয় একজন লেখক, তোমার এত হাজার হাজার বই বিক্রি হয়, তোমার তো এখন হারানোর কোনো ভয় নেই। তা তুমি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ২০০৪ সালের এই সময়কাল পর্যন্ত কয়েকটা খণ্ডে লেখো না, উপন্যাস আকারে। সে বলল, আমার লিখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সাহস পাই না। আমি অ্যাকসিডেন্টলি আপনাদের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিচিত ছিলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আমার কাছে এরশাদ খুব কালারফুল চরিত্র। ঘৃণ্য, কিন্তু কালারফুল। কেউ ওর সঙ্গে দেখা করার সাহস পায়নি, যেতে চায়নি; আমি গিয়েছিলাম ওর আমন্ত্রণে। আমার বিপুল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এটা নিয়ে তিনটি পর্বে ভাগ করে লিখতে আমার খুব ইচ্ছা হয়। ১৯৪৭ থেকে ’৬৯, শেখ মুজিবুর যখন স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সেই অবধি। এরপর ১৯৬৯ থেকে ’৭১ এবং ’৭১ থেকে এখন অবধি। এ তিনটি পর্বে বাংলাদেশের পটভূমিতে যদি পারি, তো কখনো লিখব। আমি জানি, এ লেখা এই সরকার থাকলে ওখানে যাবে না।...এই যে দ্যাখো, ‘এত রক্ত কেন’ বইটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে; ঢাকার ফুটপাতে কিন্তু বইটা পাওয়া যায়। তো ব্যান্ড করে লাভটা কী হলো?
তাপস কুমার দত্ত: এ বইটার জন্য বাংলাদেশের একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে ও-দেশে যাওয়ার ভিসা আপনাকে আটকে দেওয়া হয়। এখন যদি এ জাতীয় সমস্যা না থাকে, তা হলেও কি বাংলাদেশে যেতে কোনো আপত্তি থাকবে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি জানি, এ সরকার যদি এটা তুলেও দেয়, তবু সরকারের যারা অনুচর, তারা আমাকে আক্রমণ করবে।
তাপস কুমার দত্ত: অর্থাৎ আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?
সমরেশ মজুমদার: অফ কোর্স। আমি শেষবার যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন এত রক্ত কেন বেরিয়েছে, কিন্তু ব্যান হয়নি; সেদিন ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমেই বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। আমাকে নিয়ে অফিসাররা হঠাৎ তটস্থ হয়ে উঠলেন, কেন আমি এসেছি? কী উদ্দেশ্যে এসেছি? তো, আমাকে রিসিভ করতে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ। আমাকে নিয়ে সে সোজা চলে গেল নুহাশ পল্লীতে। ওখানে তিন রাত ছিলাম। এরপর রাতের অন্ধকারে ঢাকায় এলাম।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অন্য কোনো ভয় পাচ্ছিলেন?
সমরেশ মজুমদার: পুলিশ বোধ হয় ভাবছিল, আমাকে অ্যারেস্ট করা উচিত কি উচিত না। একদিন একটা অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে সেখান থেকে সোজা এয়ারপোর্টে। এরপর আমি যখন অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরবর্তী আমন্ত্রণ পেলাম, তখন তারা আমাকে ভিসা দিল না।
তাপস কুমার দত্ত: এখন আপনি কী ধরনের বই পড়ছেন?
সমরেশ মজুমদার: কয়েক দিন আগে ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ হুমায়ুন আজাদের বইটা সকাল থেকে পড়তে শুরু করেছিলাম। সেদিনই সকাল ৯টায়—বইটা পড়ছি, হাতে; খবর এল হুমায়ুন আজাদ মারা গেছেন। ওই বইটাতেই একটা জায়গায় লেখা ছিল, যেকোনো দিন তার মৃত্যু হতে পারে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। এ বইটা খুব বড় বা দামি লেখা নয়। খুব আবেগের লেখা, একই কথা বারবার লেখা; কিন্তু কথাগুলো লিখতে সাহস পায়নি তেমন কেউ।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি কি তাঁর আর কোনো উপন্যাস পড়েছেন?
সমরেশ মজুমদার: একটা পড়েছিলাম অনেক আগে, নামটা ভুলে গেছি। দাঁড়াও, নামটা মনে করি...
তাপস কুমার দত্ত: ‘শুভব্রত’, তার সম্পর্কিত সুসমাচার?
সমরেশ মজুমদার: না, আর কয়েকটা নাম বলো তো।
তাপস কুমার দত্ত: ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, সবকিছু ভেঙে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, বইগুলো বেশির ভাগ সময়ই কলকাতায় সহজে পাওয়া যায় না।
তাপস কুমার দত্ত: বয়স তো যথেষ্ট হলো। একদিন চলে যেতে হবে, তার দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে...কোনো আতঙ্ক বা আক্ষেপ?
সমরেশ মজুমদার: না, না। আজ রাতেও চলে যেতে পারি; আবার হয়তো দশ বা কুড়ি বছর পরও যেতে পারি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অবশ্যই দীর্ঘায়ু হবেন, আমি এর দার্শনিক দিকটা জানতে চাচ্ছি।
সমরেশ মজুমদার: আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ। আমি আজকে লেখালেখি করে যেটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি, সেটুকু আমার পাওয়ার কথা ছিল না। আমার লেখক হওয়ারই কথা ছিল না।
তাপস কুমার দত্ত: অনেক বছর আগে বাংলাদেশের একটা সাপ্তাহিক কাগজে আপনি বলেছিলেন, এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেবেন।
সমরেশ মজুমদার: ওসব কথা বাড়িয়ে লিখতে ভালোবাসে কিছু সাংবাদিক। যেমন অন্য একটা জায়গায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তসলিমার ‘ক’ পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে? আমি এর উত্তরে বলেছিলাম, আমি ‘ক’ পড়েছি এবং আমার মনে হয়েছে, একটা বারবনিতাকে যদি বলা হয়, তোমার আত্মজীবনী লেখ, সে তার অনেক কষ্টের কথা লিখবে; কিন্তু যেসব ক্লায়েন্ট তার কাছে আসে, তাদের বিস্তৃত পরিচয় দেবে না সে, এটুকু সৌজন্য দেখাবে। এ উত্তরটা তারা এভাবে লিখেছে যে, সমরেশ মজুমদার বলেছেন, তসলিমা নাসরিন বেশ্যা। এর উত্তরে তসলিমা লিখলেন আনন্দবাজারে, সমরেশ মজুমদারের গলায় গলা মিলিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, তসলিমা বেশ্যা। এর উত্তরে আমি আবার চিঠি লিখলাম আনন্দবাজারে—কোথায়, কখন বলেছি? কাকে বলেছি? যদি দয়া করে আমাকে জানানো হয়...। অতএব, যদি কোথাও কখনো লেখা হয়ে থাকে, আমি বলেছি এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেব—এগুলো বাজে কথা। হয়তো এভাবে বলেছি, লিখে টাকা পাওয়া যায়, জানতাম না। যখন লিখে টাকা পেতে শুরু করলাম, তখন আমাকে যদি বলা হয়, কেন লেখেন? আমি বলি, টাকার জন্য লিখি।
তাপস কুমার দত্ত: কথাটা এভাবে বলেছিলেন, একজন কৃষক যে কারণে চাষাবাদ করেন, একজন...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, একজন কৃষক যখন চাষাবাদ করেন, তিনি তো দেশ গড়ার জন্য চাষ করেন না; তিনি তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য চাষাবাদ করেন। একজন মাস্টার যখন পড়ান, তখন মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার চেয়ে তার সন্তানসন্ততিকে বড় করার জন্য পড়ান। তো, একজন লেখকের কী দায় আছে, তিনি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন? আমাদের দেশে কোনো লেখক যদি জনপ্রিয় হন, তখন ধরেই নেওয়া হয়, ওগুলো ভুসিমাল। যদি সে ধরনের লেখক জনপ্রিয়তা না পান বা বিক্রি না হয়, তখন তিনি একজন বিরাট লেখক। প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা যদি কেউ বেশি পান, কেন পান? কারণ, পাঠকদের ভালো লাগছে বলেই। কোনো একটা বই হয়তো বেশি পাঠকের ভালো লেগেছে। এমন নয় যে বছরের পর বছর তিনি জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। তা হলে যিনি পাঠককে সহজে স্পর্শ করতে পারছেন না, তার কোথাও খুঁত আছে নিশ্চয়ই। ভালো একটা ছবি তিন দিন সিনেমা হলে থেকে চলে গেল। আর একটা ছবি ‘বাবা কেন চাকর’ মাসের পর মাস চলল, জনপ্রিয় হলো। আবার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর যখন হাজারটা শো চলে, তখন বলতেই হয়, গুপী গাইন বাঘা বাইন খারাপ ছবি? চার্লি চ্যাপলিন তা হলে খারাপ ছবির নাম? ‘পথের পাঁচালী’ও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল—ওটাও তা হলে খারাপ ছবি?
তাপস কুমার দত্ত: ধরুন, হাইপোথেটিক্যালি আমরা ধরে নিলাম, কোনো ধনকুবের আপনার যাবতীয় চাহিদার স্পন্সরশিপের দায়িত্ব নিল। একজন কৃষক যে কারণে কৃষিকাজ করেন বা আর দশজন পেশাজীবী মানুষ যে কারণে পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, সেই প্রয়োজনটা আপনার আর রইল না। তখন কি লেখালেখি আপনি ছেড়ে দেবেন?
সমরেশ মজুমদার: চাহিদার কিন্তু শেষ নেই। আগে বাস-ট্রামে চড়তাম, আমার এখন বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। এখনো অবশ্য ইচ্ছা করে মাঝেমধ্যে বাস-ট্রামে উঠি। তো, আগে আমি জলপাইগুড়ি আমার বাড়ি যেতাম সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে, রিজারভেশন ছাড়া। এরপর রিজারভেশনে। এরপর এসি থ্রি-টিয়ার, এরপর এসি টু-টিয়ার। এর মানে এই নয়, আমি এখন এসি টু-টিয়ার ছাড়া যেতে পারব না। কিন্তু যদি কমফোর্ট পাই, তা আমি নেব না কেন?
তাপস কুমার দত্ত: আমি বলতে চাচ্ছি, শুধু ভরণপোষণ আর কমফোর্ট—এসব কারণেই লেখালেখি? ভোগবাদী ব্যাপার ছাড়া তা কি নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে না?
সমরেশ মজুমদার: শুনুন, আমাকে যদি এক কোটি টাকা দেওয়া হয় একটা উপন্যাস লেখার জন্য—সাত দিন চেষ্টা করেও লিখে উঠতে পারব না। আবার, আমাকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি, আমি লিখতে বসলাম, হয়তো দুদিনেই লেখাটা শেষ করে ফেলতে পারব।
তাপস কুমার দত্ত: তা হলে লেখালেখিটা শুধু হালচাষির হালচাষের মতো জীবিকা নির্বাহ নয়, আলাদা একটা ভেতরের তাগিদও...
সমরেশ মজুমদার: অবশ্যই।
তাপস কুমার দত্ত: বেশির ভাগ জনপ্রিয় লেখকের লেখায় দেখা যায়, কতগুলো পাগলামোর ঘটনা, কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা, কিছু সুখকর ঘটনা ও একটু বেদনাদায়ক ঘটনা। যেন ছাঁচে ঢেলে গরম তেলে ভেজে তোলা হট কেক...
সমরেশ মজুমদার: এটা আমার কাছে খুব অস্পষ্ট। ধরুন, আমার একটা বই, ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। সেই বইটা কলকাতায় ৫০-৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। ধরে নিতে পারি, বইটা জনপ্রিয়।
তাপস কুমার দত্ত: বইটার নাম কী?
সমরেশ মজুমদার: ‘গর্ভধারিণী’। তা ওটা কোন ফর্মুলায় লেখা, বলুন তো?
তাপস কুমার দত্ত: ওই বইটাতে আসলে এমন একটা সাসপেন্স বা থ্রিল এবং এর সঙ্গে আবেগ, বর্তমান সমাজব্যবস্থার কিছু মানুষের অমানবিক নোংরা দিকের প্রতি...।
সমরেশ মজুমদার: এসব তো অনেক বইতেই আছে।
তাপস কুমার দত্ত: হ্যাঁ, তা ঠিক, ‘মেঘ ছিল, ‘বৃষ্টিও’-তেও আছে। ‘আট কুঠুরী নয় দরজা’তেও।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে সেগুলো ওভাবে বিক্রি হয়নি কেন?
তাপস কুমার দত্ত: না, আমি বলছি ‘গর্ভধারিণী’র মতো বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলেও ওই লেখাগুলোও বেশ জনপ্রিয়।
সমরেশ মজুমদার: যদি জানতাম, গর্ভধারিণীর মতো ওভাবে সাসপেন্স মেশালে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে, তা হলে তো সব বই ওভাবেই লেখা হতো। তা হলে ‘সাতকাহন’ কেন এত বিক্রি হলো? স্ট্রাগল করা মেয়েদের গল্প তো আমি আগেও লিখেছি, পরেও লিখেছি, সেগুলো কেন সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হলো না? আমি যদি আরেকটা দীপাবলীকে নিয়ে লিখি, সেটা কি সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হবেই?
তাপস কুমার দত্ত: সাতকাহনের দ্বিতীয় পর্ব কিন্তু প্রথম পর্বের মতো অত জনপ্রিয় নয়।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে? আসলে আমার কাছে মনে হয়, যেকোনো...আমি আপনাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখাটার কথা বললাম, ‘এখনো সময় আছে’ বইটা তিন থেকে চার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। লোকে না পড়লে আমার কষ্ট হয়, আমি তো লোকে লোকে গিয়ে বলতে পারি না, আপনি বইটা পড়ুন। কোত্থেকে ‘কালবেলা’ এক লাখ কপি বিক্রি হলো! ‘উত্তরাধিকার’ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার। অথচ উত্তরাধিকার ওটার চেয়ে অনেক বেটার উপন্যাস। তাই কোন লেখাটা জনপ্রিয় হবে, তা আগে থেকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। একটা লেখা জনপ্রিয় হতে পারে। একটা মেমসাহেব, একটা দৃষ্টিপাত, একটা মরুতীর্থ হিংলাজ জনপ্রিয় হতে পারে। কয়েকটা নয়।
তাপস কুমার দত্ত: ওপারের লেখকদের লেখা সম্পর্কে...
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, ওপারের এক নম্বরের সঙ্গে দুই নম্বরের ব্যবধান এত বিস্তর...জাফর ইকবাল সম্প্রতি সেই ব্যবধান একটু কমিয়ে এনেছেন। তো, গতবার যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তখন একজন লেখক আমাকে এসে বললেন, সমরেশ দা, আপনাকে একটা ভালো খবর দিই।
আমি বললাম, কী?
বলল, আমি এখন তিন নম্বরে।
আমি জানতে চাইলাম, কিসের তিন নম্বর? সে জানাল, জনপ্রিয়তার। তার পেছনে নাকি মিলন চলে গেছে, অমুক-তমুক অনেকে চলে গেছে। আমি হাসব না কাঁদব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তাপস কুমার দত্ত: কে?
সমরেশ মজুমদার: নামটা নাই-বা বললাম।
তাপস কুমার দত্ত: বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের রুচিবোধ আপনার কতটা উঁচুদরের বলে মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: আপনি যা ইচ্ছা তা-ই লিখে পাঠকদের ভোলাতে পারবেন না। পাঠকদের বিচারশক্তি দারুণ প্রখর। একটা লেখা দিয়ে ভোলাতে পারবেন, পরের দুটোয় হাফ ভোলাতে পারবেন; তৃতীয়টায় আর পারবেন না।
তাপস কুমার দত্ত: পাঠকেরা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমাকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না। তবে কিছু কিছু ঘটনায় মাঝেমধ্যে কষ্ট হয়। একবার বইমেলায় এক ভদ্রমহিলা তিনখানা (বড় ক্যানভাসের) বই বইতে পারছিলেন না, চেহারা দেখে বোঝা যায়, যথেষ্ট (আর্থিক) অসচ্ছল পরিবার। আমি বললাম, আপনি কী করেন?
তিনি বললেন, আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়াই।
আমার খুব খারাপ লাগল, আপনি এত দামি তিনটি বই কিনলেন?
তিনি বললেন, সারা বছর আমরা অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি।
এরপর দেখলাম, দূরে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ক্রাচ হাতে, একটা পা ডিফেক্টেড। ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, আমি আপনার অনিমেষ।
আমি বললাম, তার মানে?
তিনি জানালেন, তিনি নকশাল আন্দোলন করতেন এবং হাওড়া জেলে পুলিশের অত্যাচারে একটা পা নষ্ট হয়ে (অনিমেষের মতোই) গেছে। আমরা একসঙ্গে থাকি। (অনিমেষ-মাধবীলতার মতো), আমরা বিয়ে করিনি।
আরেকটা ঘটনা বলে শেষ করি—হ্যাঁ, একবার বিদেশে রাতে আমার খুব খিদে পেয়েছে, একটা বড় রেস্টুরেন্ট দেখে ভেতরে ঢুকে পড়ি। এরপর মেনু কার্ডের সবচেয়ে ছোট আইটেম যেটা, সেটার অর্ডার দিলাম। বেয়ারাগুলোকে দেখে মনে হলো এশিয়ান। তো, একটা বেয়ারা এসে বলল, স্যার! আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?
আমি বললাম, ইয়েস।
স্যার! আর ইউ ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল?
আমি আবার বললাম, ইয়েস।
বেয়ারা গিয়ে হোটেল মালিককে তথ্যগুলো জানাতেই হোটেল মালিক উঠে এসে বললেন, নমস্কার স্যার! আপনি বোধ হয় সমরেশ বাবু। আমি আপনার একটাই মাত্র বই পড়েছি। একবার একটা বাস টার্মিনালে দেখলাম একটা বই পড়ে আছে—বাংলা বই, নামটা ‘দৌড়’।
এরপর যতই বলছি, আমার খাওয়া হয়ে গেছে, তবু তিনি আমাকে জোর করে খাওয়াবেন। বিল দিতে গেলাম, বিল নিলেন না। এই অবধি ঠিক আছে। বেয়ারা এরপর বলল, সাহেব, একবার ভেতরে আসবেন? আপায় কইছিল, আপনি সমরেশ মজুমদার কি না জিজ্ঞেস করতে। তো, আমি ভেতরে ঢুকলাম। একজন ভদ্রমহিলা খাটের ওপর বসে নমস্কার জানিয়ে আমার দিকে একটা বই এগিয়ে দিলেন—‘গর্ভধারিণী’। আমার পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। দেখুন, কারোর জানার কথা নয়, আমি ওখানে যাব। কাকতালীয়ভাবে।
তাপস কুমার দত্ত: একবার কবি সম্মেলনে আপনাকে দেশের বাইরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল—কবি হিসেবে, ভুল করে। ঠিক এ রকমই একটা ঘটনার কথা...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আপনি সবই জানেন দেখছি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি বই বাজেয়াপ্ত করাটা কতটা সমর্থন করেন?
সমরেশ মজুমদার: যে কারণে তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেটাকে আমি সমর্থন করি না। তবে আমার হাতে আইন থাকলে তসলিমাকে অভিযুক্ত করতাম। আজ একটা ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ের ভালো সম্পর্ক; সম্পর্কটা দুজনকেই আনন্দিত করছে। যদি ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো তিক্ততা আসে, আজকের এ আনন্দটা কিন্তু মিথ্যা হয়ে যাবে না এবং সেই ছেলেটা ও মেয়েটার কোনো রাইট নেই ভবিষ্যতে এই আনন্দিত সম্পর্ককে নিয়ে খোলামেলা...ব্যঙ্গ করে লেখা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে লেখা। যে ক্ষেত্রে তারা একে অন্যকে ছোট ও অপমান করছে। মিলনের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়ে কী হয়েছে বা অমুকের সঙ্গে অমুকের আর কী হয়েছে—এর ডিটেইলস নিয়ে আমরা আদৌ আগ্রহী নই। আমরা তসলিমার ব্যাপারে এখানেই আগ্রহী যে সে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কী লড়াই করেছিল। তা না করে তার শারীরিক আনন্দের বিবরণ দিয়ে লিখছে—এটা এক ধরনের অসুখ। আমি জানি, আমার বাবা-মায়ের মিলনের ফলে আমি পৃথিবীতে এসেছি; এখন সেই মিলনটা কী রকম ছিল, তার বিবরণ দিয়ে যদি লিখতে যাই, তো আমার জন্মটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি কুৎসিত করছি। আমার জন্মের বিবরণের জন্য আমার বাবা-মায়ের শয্যা বিবরণ কি আমি দিতে পারি? নাকি তা আমি ভাবতে চাই? বা ভাবতে পারি?
তাপস কুমার দত্ত: আপনি আপনার খোলামেলা বা বিতর্কিত ভাবনা প্রকাশ করতে কতটা ভয় পান?
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, এ মুহূর্তে বোধ হয় আমিই সবচেয়ে সরাসরি লিখি। ‘পত্রপাঠ’ বলে একটা পত্রিকা আছে, মাসে বেরোয়—সেটায় আমি কলাম লিখি। সেখানে সরাসরি সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে লিখি। একজন কলেজ অধ্যাপককে পুলিশ অ্যারেস্ট করে—জনযুদ্ধগোষ্ঠীর ডায়েরি থেকে নাম পেয়ে তাকে অ্যারেস্ট করে। সারা দিন অত্যাচার করে সন্ধ্যায় তাকে ছেড়ে দেয়। এলাকার লোকজন মনে করে, সে জনযুদ্ধগোষ্ঠীর লোক। সে রেললাইনে আত্মহত্যা করে, তার স্ত্রী এ নিয়ে কেস করে। এ ঘটনা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। আমি এ-ও লিখেছিলাম, কয়েক দিন আগে ভোটের সময় একজন সাংবাদিক একটা গ্রামে গেছেন। সেখানে এক চায়ের দোকানে নানা আলোচনায় উঠে আসে, আমাদের দেশে যত মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অবিবাহিত। বিবাহিত ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়, জ্যোতিবাবু। সিদ্ধার্থবাবু, জ্যোতিবাবু কখনো বাজারে যাননি। বুদ্ধবাবু রিকশায় চাপেন, বাজারে যান। আর নামটা দেখুন, বুদ্ধদেব।...বিধানচন্দ্র, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ হচ্ছে সংসারী নাম।...এ রকম নাম যার, তাকে আমরা ভোট দেব না, তো অন্য লোককে ভোট দেব? সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কেমন আছেন? ওরা বলল, এই যে রাস্তাটা দেখছেন, এর নাম সুচেতনা (‘সুচেতনা’ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মেয়ের নাম)। আমাদের এখানে একটা ভাটিখানা আছে, খুব মারপিট চলত আগে, মদ খেতে খেতে। আমরা সেটার নাম দিয়েছি সুচেতনা...বাংলা বারের প্রতিশব্দ আর কি। ওখানে মদ খেয়ে এখন আর কেউ চেতনা হারাচ্ছে না। ফলে বুঝতেই পারছেন, আমরা সবই বুদ্ধবাবুর লোক। এ গল্পটা বের হওয়ার পর বুদ্ধবাবু আমায় বললেন, আমাকে নিয়ে লিখলেন, ঠিক আছে; আমার মেয়েকে জড়ালেন কেন? আমি বললাম, ‘হাওড়ার একটা লাইব্রেরি উদ্বোধন করতে তোমার মেয়ে আর তোমার স্ত্রী গিয়েছিলেন, লাইব্রেরিটার নাম রাখা হয়েছে সুচেতনা পাঠাগার। তোমার মেয়ে এখনই এমন কী যোগ্যতা অর্জন করেছে যে তার নামে একটা পাঠাগার রাখা হবে? যেহেতু সে তোমার মেয়ে, তাই রাখা হয়েছে।’ এখন, আপনি কী মনে করেন না, এর চেয়ে সরাসরি আক্রমণ করে লেখা—আর বড়াই করে বলি, আমাদের কোনো লেখকই লিখছেন না। লিখতে পারেন, কিন্তু লিখছেন না।
তাপস কুমার দত্ত: এত সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সমরেশ মজুমদার: থ্যাঙ্ক ইউ।
উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দত্ত। এই লেখক সদ্য গত হয়েছেন। আর তাই সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ও বন্ধ সাপ্তাহিকটির তখনকার নির্বাহী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারের সম্মতিক্রমে আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।
তাপস কুমার দত্ত: ওপার বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে এপার বাংলার বাঙালিদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যে পার্থক্য, সেটা যত দিন যাচ্ছে ততই কি দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: দুটো ঘটনা ঘটেছে এখানে, সেটা হচ্ছে—১৯৪৭ সালের আগে যে বাংলা, একত্র দুই বাংলা, যেখানের হিন্দু আর বাঙালিরা ছিল সম্পূর্ণ কলকাতামুখী। মুসলমান বাঙালিদের মধ্যে দুটো শ্রেণি ছিল—একটা শ্রেণি অত্যন্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ, শিক্ষিত লোক এবং বেশির ভাগই ছিল অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মুসলমান। এ অল্প ও অশিক্ষিত মুসলমানদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিরা ডমিনেট করল। ফলে যখন দেশ ভাগ হলো, তখন অল্পশিক্ষিত অশিক্ষিত মুসলমানেরা উল্লসিত হলো, কারণ, শিক্ষিত বাঙালিরা ভয় পেল, দু-একটা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলো। আমি বাংলাদেশের অনেক জেলার কথা জানি, যেখানে আজ অবধি কোনো মানুষ খুন হয়নি দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে। যেমন ধরুন, রংপুর। সেখানে আজ অবধি কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত না ঘটা সত্ত্বেও রংপুর থেকে অনেক মানুষ চলে এসেছে ভারতবর্ষে। তখন এ রকম একটা প্রচারণা এসেছিল—পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানদের জায়গা। অতএব, হিন্দুরা সেখানে থাকলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তাই ছোটো ইন্ডিয়া। সেই ছোটার কাহিনিটা গত ৫৫ বছরের। সেই ছোটার কাহিনিতে অনেক মানুষ একেবারে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে তলিয়ে গেছে। আবার অনেক মানুষ সংগ্রাম করে করে ওপরে উঠেছে।...
তাপস কুমার দত্ত: এরপর থেকেও তো অনেক সংখ্যালঘু ওপারে চলে গেছে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এপার থেকেও গেছে, তবে তা আনুপাতিক হারে যথেষ্ট কম। যা বলছিলাম, এ ৫৫ বছরে যদি কেউ লাভবান হয়ে থাকে, আমি এপার বাংলার কথা বলছি—তা হলে হয়েছে পশ্চিম বাংলার মেয়েরা। এই যারা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল—সংগ্রাম করেছে, কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে, বস্তি বা কলোনিতে কোনোক্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে; তাদের দেখাদেখি পশ্চিম বাংলার কনজারভেটিভ পরিবার—যারা মেয়েদের অন্দরমহলে ফেলে রেখেছিল এবং অফিস-কাছারিতে যাওয়া তো স্বপ্নের বাইরে ছিল। যখন পূর্ববঙ্গের মেয়েরা জীবনসংগ্রামের বাধ্যবাধকতায় গ্র্যাজুয়েশন করে স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে ঢুকল; তখন এখানকার মেয়েরা উৎসাহিত হলো। আমরা যখন কলেজে পড়তাম; সন্ধ্যা ৬টার পর ট্রামে-বাসে কোনো মেয়েকে দেখা যেত না; যদি কোনো মেয়েকে দেখা যেত তা হলে সে নিশ্চয়ই বাঙাল (পূর্ববঙ্গীয়) হতো। কিন্তু এ পশ্চাৎপট একদম পাল্টে গেল ১৯৬৮ সালের পর থেকে। তখন বাস্তবিক নিষ্পেষণে পশ্চিম বাংলার মেয়েরাও বেরোতে শুরু করল, যেটা বলতে গিয়ে সরে এসেছি—সেটা হলো, এই দেশবিভাগ এবং এ দেশে উদ্বাস্তু স্রোত আসার অনেক খারাপ দিকের এই একটা ভালো দিক, আমাদের মেয়েরা অর্গল ভেঙে বেরোতে পেরেছিল। কিন্তু ওখানে (বাংলাদেশে) যারা রয়ে গেল (হিন্দু সম্প্রদায়) তাদেরও, আমরা দেখেছি, কেউ ১৯৬৭, কেউ ১৯৭০, কেউ ১৯৭৬-এ চলে আসতে লাগল।
তাপস কুমার দত্ত: এখনো কি অল্পবিস্তর চলে আসছে?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এখনো আসছে এবং এদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে এরা আওয়ামীপন্থী ছিল। অর্থাৎ এ দলটির কাছে ওরা নিরাপদ বোধ করত।
তাপস কুমার দত্ত: দেশভাগের পর ওপার বাংলার কী কী বিশেষ পরিবর্তন আপনার কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়েছে?
সমরেশ মজুমদার: ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এ ২৪ বছরে বাঙালির জীবনে পূর্ববঙ্গে একটা জিনিসেরই আমদানি ঘটেছে, সেটা হলো ইসলাম এবং ইসলামকেন্দ্রিক আরবি-ফারসি শব্দ। ওই সময় যাঁরা লেখালেখি করতেন, যেমন ধরুন—শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস—এঁরা যে বাংলা লিখতেন, তা ছিল পশ্চিম বাংলার বাংলা; অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারকৃত বাংলা। এঁরা বাংলার প্রাচীন সাহিত্য এবং রামায়ণ-মহাভারত ও আরও সব পৌরাণিক...প্রাচ্য ও পশ্চিমের সাহিত্যের ওপর ভালো দখল রাখতেন এবং সেটা তাঁদের ভেতরে লালন করতেন। ১৯৭১ সালের পর একটা আবেগ এল, আবেগের সঙ্গে ভয় এল। ভয়টা এই—আমরা এত দিন উনুনে পুড়ছিলাম, উনুন থেকে লাফিয়ে গরম তেলে পড়লাম না তো? অর্থাৎ আমরা পাকিস্তানের অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছিলাম, এখন ভারত বড়দাদার মতো দাদাগিরি করবে না তো? আমাদের দখল করবে না তো? তার কিছু কিছু ইন্ধন—আপনারা জানেন—ভারত যে সম্পূর্ণ বৈষ্ণব হয়ে ছিল তা নয়, ভারতের তরফ থেকে যারা দু-একটা বদমায়েশি কাজ করেছে, সেসব বাংলাদেশের কাছে প্রবল হয়ে ধরা দিল। ১৯৭১ সালের ওই আবেগ যখন কমতে শুরু করল, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর ওখানকার রাজনৈতিক দলগুলো জনসাধারণকে সস্তা পথে পাওয়ার জন্য অ্যান্টি-ভারত আবহাওয়া তৈরি করল এবং সেটা তাদের ভোট অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়কও হলো। এ সময় থেকে আমরা দেখতে শুরু করলাম, বাংলা সাহিত্যে যা লেখালেখি হচ্ছে, খবরের কাগজে রিপোর্টিংয়ে যে বাংলায় লেখালেখি হচ্ছে, সেখানে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর একটা উদাহরণ হলো জিম্মা। এ ‘জিম্মা’ শব্দটা আগে ওপার-এপার, কোনো বাংলায়ই ব্যবহৃত হতো না। যেমন খাবারটা খেয়ে দারুণ ‘মজা’ লাগল। এ ‘মজা’ শব্দটা হলো রসে-বসে আনন্দে আছি। তা খাবারটা খেয়ে ‘মজা’ লাগবে কেন আমার? খাবারটা খেয়ে আমার দারুণ ভালো লাগবে, অথবা আমি খুব আনন্দ পেলাম খেয়ে। কিন্তু ‘মজা’ লাগা বলতে কোথাও যেন একটু কৌতুক মেশানো থাকে। এ ধরনের কিছু শব্দ তৈরি হতে লাগল। এসব সচেতনভাবে তৈরি হতে লাগল, যাতে পশ্চিম বাংলার ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা আস্তে আস্তে একটু একটু করে আলাদা হতে থাকে। আবার, আমরা দেখতে পাই, ১৯৬০ বা ’৬৫ সাল অবধি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের আগ অবধি যেকোনো মুসলিম পরিবারে আরবি বা ফারসি নাম দেওয়া হতো। কিন্তু এর পর থেকে দেখা গেল তাদের নামের পাশে ব্র্যাকেট করে একটা ডাকনাম দেওয়া হলো। ১৯৪০-৫০ সালের দিকে কোনো মুসলমানের ডাকনামের তেমন প্রচলন ছিল না। ক্রমে এ ডাকনামই তার হাইলাইটস পেত বেশি, আসল নামটা আড়ালে থাকত। যেমন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। আমরা সবাই জানি ‘বন্যা’। এটা কিন্তু পাশাপাশি সচেতনভাবে বাঙালিত্ব ধরে রাখার প্রচেষ্টা। এর পরবর্তী প্রজন্ম, সত্তরের দশক থেকে যে প্রজন্ম শুরু হলো—তারা আরও অদ্ভুত হলো। তাদের আবার নাম হয়তো আবুল হায়াত, মেয়ের নাম বিপাশা হায়াত বা সুবর্ণা মুস্তাফা। হায়াত বা মুস্তাফা তার পারিবারিক পদবি কিন্তু নামটা বাংলা শব্দ। অর্থাৎ আগে যেটা ব্র্যাকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেটা এখন নামের সাইনবোর্ডে এসে প্রকাশ হলো। পাশাপাশি আরও একটা অদ্ভুত ছবি আছে; ছবিটা হলো—চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষ, ধরুন একজন মা; তার ছেলে হয়তো ঢাকায় চাকরি করে। তিনি যখন তার ছেলেকে চিঠি লিখছেন, তখন চট্টগ্রামের ভাষায় লিখছেন না। তিনি বইয়ের ভাষায় চিঠি লিখছেন এবং ছেলেও তা-ই করছে। কিন্তু ছেলে আর মায়ের যখন পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়, তখন কিন্তু তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন, যা ঢাকার লোক বুঝবে না। তা হলে চিঠিতে কেন বাংলা বর্ণমালায় চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করছে না? এ নিয়ে আমার নিজস্ব অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু এ বাঙালিত্ব বজায় রাখার জন্য একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি, একবার এক অনুষ্ঠানে একজন লোকের সঙ্গে—তাকে বাংলাদেশের মনে হওয়ায়—কথা বলতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাংলাদেশের? কোন জেলায় বাড়ি?’ তিন-চারবার প্রশ্ন করার পরও কোনো উত্তর পেলাম না। লোকজন অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার, তুমিও বাঙালি, সে-ও বাঙালি অথচ একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারছ না?’ আসলে সে সিলেটের বাঙালি। সে আমাদের ভাষা ভালোভাবে জানে না এবং নিজে যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষা আমাদের কাছে অজানা, তাই কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে। এই যে এত পার্থক্য—এসব পার্থক্যের সুযোগ নিয়েছে—আমার মনে হয়, কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী, যাতে বাংলা ভাষাকে ভাঙা যায়, নষ্ট করা যায়। একটা নতুন ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধরুন, যদি মসজিদে যান, মসজিদে যে প্রার্থনা হয় তা বাংলায়। যেখানে একদম পরিষ্কারভাবে, ‘হে পরম পিতা!’—এভাবে শুরু করে।...‘আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি; আমাদের প্রিয়জন তোমার কাছে গিয়েছে, বাসা থেকে কেউ যদি বিদেশে যায়, তবে তার চিঠিপত্তর, টেলিফোনে খবর পাওয়া যায়। তিনি আজ যেখানে গেছেন, সেখানে এসব কোনো পথ নেই; কিন্তু আমরা জানি, তিনি তোমার কাছে গেছেন। অতএব, তুমি তাকে ভালো রাখবে...। আমিন!’ এ কথাগুলো অতি পরিষ্কার সিম্পল বাংলা কথা, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না; অশিক্ষিত লোকও স্পষ্ট বুঝতে পারছে; কিন্তু ‘আমিন’ শব্দটা উচ্চারণ হওয়ামাত্র একটা অন্যরকম গন্ধ এল। আমিন কথাটা খ্রিষ্টানরা বলে। খ্রিষ্টানরা ‘পরম পিতা’ও বলে। কোরআনকে তো পৃথিবীর সব দেশের সব মুসলমান যথাযথ অনুসরণ করে না। আজকের পৃথিবীর সব মুসলমানের...বাংলাদেশের মুসলমানদের আইডিয়াল হচ্ছে ‘আরবি’ এবং আরবের লোকজন। অথচ আরবরা যে বুর্জোয়া জীবনযাপন করেন—মেয়েদের ক্ষেত্রে পার্টিকুলারলি—সেটা মানতে পারেন না ঢাকার মুসলমানরা; কিন্তু এরপরও ওরা আইডিয়াল। আজ যদি তুমি ঢাকা বা ফরিদপুরের রাস্তায় রোজার সময় যাও, তাহলে দেখবে, পর্দা টানিয়ে হোটেলে খাওয়াদাওয়া চলছে। অর্থাৎ পর্দা টানিয়ে দুপুরে খাওয়া যায়। আমার বন্ধুবান্ধব, যাঁরা আমার কাছে রোজার সময় আসছেন, তাঁরা প্রায়ই বলতেন, ভাই, আমি অসুস্থ, রোজা রাখতে পারছি না। কেউ বলতেন, আমি তো এখন পর্যটক! কারও হাঁটুতে ব্যথা, একটা অজুহাত, যেহেতু নামাজ পড়তে পারবে না...এসব অজুহাত বা ছুতো—এগুলো সবই কিন্তু বেরিয়ে আসার চেষ্টা। কিন্তু তারা ভয়ে থাকে, বেরিয়ে আসতে ভয় পায়। ফলে আমাদের সঙ্গে ওদের যে ডিফারেন্স, সেই ডিফারেন্সটা যথেষ্ট বড়। কারণ, আমরা যারা জন্মসূত্রে হিন্দু, তাদের ৮০ ভাগ হিন্দুধর্মের এ-বি-সি-ও পালন করি না। অথচ আমরা হিন্দু। বলতে হয়, তাই হিন্দু। আমাদের ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মাচরণ নেই। দুর্গাপূজা এলে আমরা প্ল্যান করি কোথায় বেড়াতে যাব। পুজোর আচার-আচরণের মধ্যে আমরা নেই। আমরা নানা খাবার দিয়ে, বিস্কুট, চাল-ডাল, চকলেট দিয়ে মূর্তি গড়ি, ছেলেখেলার মতো। কালীপূজার সময় আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি, পটকাবাজির ভয়ে। তাহলে আমরা হিন্দু হলাম কোথায়? আমরা ধর্ম থেকে সরে গেছি আস্তে আস্তে। তবে এ ধর্ম আমাদের কিছু দেয় না, আমাদের থেকে কিছু নেয়ও না। যখন রামকে নিয়ে সারা ভারতে এত হইচই কাণ্ড চলত, তখন আমরা পশ্চিম বাংলার মানুষজন রামকে একবারও দেবতা বলে মনে করি না। আমরা হনুমানকে দেখে ঠাট্টা করি, ‘কলা খাবি’ বলে। কিন্তু হনুমান ওদের কাছে ঈশ্বরের অবতার। ঘটনা যখন এ রকম ঘটে যায়, তখন বাংলাদেশের মুসলমান যারা; যারা সত্যিকার অর্থে কোরআন মানে, ধর্মান্ধ নয়, তারা কিন্তু আমাদের থেকে অনেক ডিসিপ্লিনড। ধর্ম ডিসিপ্লিন তৈরি করতে সাহায্য করে। ধর্ম একত্র করে মানুষকে। কিন্তু সেই একত্র করার মাঝখানে ধর্মান্ধ বা ধর্ম ব্যবসায়ীরা যত গণ্ডগোল পাকায়। ফলে আমাদের মধ্যে ক্রমেই পার্থক্য বাড়ছে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার কি মনে হয়, কয়েক দশক আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে রাজনীতিতে যে রকম মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, তাতে করে আগামী কয়েক দশক পর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রকম ধর্মরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
সমরেশ মজুমদার: আমার তো উল্টো মনে হয়। আমার মনে হয়, ধর্মান্ধ যারা—সে হিন্দু বা মুসলমান হোক, খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা কখনো শুনিনি। যদিও ক্রিশ্চিয়ানিটি পৃথিবীজুড়ে ছিল, কিন্তু আজ অবধি খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা শুনিনি, বৌদ্ধ ধর্মান্ধ শুনিনি।
তাপস কুমার দত্ত: ইউরোপে এককালে খ্রিষ্টানরাই ব্লাসফেমির মতো ঘৃণ্য আইন ধর্মের বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল—ওসব কি ধর্মান্ধতা নয়?
সমরেশ মজুমদার: খ্রিষ্টানরা এখন অনেক শ্রেণির হয়ে গেছে, সেখানে তারা একত্র নয়।
তাপস কুমার দত্ত: না, সেটা অন্য ব্যাপার, প্রশ্নটা হলো...
সমরেশ মজুমদার: আমাদের ভারতবর্ষেও তো হিন্দু ধর্ম একেক জায়গায় একেক রকম। আপনি সাউথ বা নর্থ ইন্ডিয়ায় বা অন্য প্রান্তে যে হিন্দু ধর্ম দেখবেন, তা পশ্চিম বাংলায় পাবেন না; এক জায়গার সঙ্গে অন্য জায়গায় ধর্মীয় অমিলই বেশি।
তাপস কুমার দত্ত: প্রশ্নটা তা নয়। একটা ধর্ম সম্প্রদায় নানা খণ্ডে বহু ধারায় বিভক্ত হতেই পারে। কিন্তু যেকোনো ধারারই একটা প্রচ্ছন্ন গোঁড়ামি আছে, মৌলবাদ আছে; আর সেটাই দিন দিন বিশ্বের ওপর বেশি পরিমাণে চেপে বসছে। আপনি কী মনে করেন?
সমরেশ মজুমদার: না, আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমার তো মনে হয়, ধর্ম পৃথিবী থেকে আস্তে আস্তে লোপ পেতে চলেছে। এখন যে চিৎকারটা আমরা শুনতে পাচ্ছি—কারণ, ধর্মবাদীরা আতঙ্কগ্রস্ত বলে চিৎকার করছে।
তাপস কুমার দত্ত: প্রথাগত ধর্মে আপনার বিশ্বাস কতটুকু?
সমরেশ মজুমদার: আমি ধর্মে একদম বিশ্বাসী নই।
তাপস কুমার দত্ত: আর বিবাহ প্রথায়?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, বিবাহ প্রথায় বিশ্বাসী। তবে বিয়ে কীভাবে হবে, সেটা নির্ভর করছে যারা বিয়ে করছে, তাদের ওপর।
তাপস কুমার দত্ত: তৃতীয় বিশ্বে বসবাস করার একটা মানসিক যন্ত্রণা আছে। বিশেষ করে, শিল্পী-সাহিত্যিক...যেকোনো সৃজনশীল মানুষের। আপনি তা কতটা অনুভব করেন?
সমরেশ মজুমদার: এটা ভারতবর্ষে, মানে পশ্চিম বাংলায় নেই, আমি কখনো অনুভব করিনি। এটা গুজরাটে থাকতে পারে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার লেখালেখিতে বা ভাবনায় কখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি বলছেন?
সমরেশ মজুমদার: সিপিএম যখন ক্ষমতায় এল, তখন আমি নকশাল আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস লিখলাম—কালবেলা। তো কালবেলার নায়ক অনিমেষ তখন কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বলেছে, সিপিএম ভ্রষ্টাচারী। আমাকে কিন্তু ও রকমভাবে কোনো সরকার বা শক্তি আপত্তি করেনি।
তাপস কুমার দত্ত: নিজের বিচারে আপনার প্রিয় লেখা কোনটি?
সমরেশ মজুমদার: তিনটি লেখা আমার খুব প্রিয়। সেটা হচ্ছে—‘উত্তরাধিকার’...
তাপস কুমার দত্ত: এ সিরিজটা? অর্থাৎ ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’?
সমরেশ মজুমদার: না, ‘কালবেলা’ আমার প্রিয় নয়। ‘এখনও সময় আছে’ বলে আমার একটা উপন্যাস আছে, আমার ভীষণ প্রিয়। আর গত বছর আমি ‘দেশ’-এ একটা উপন্যাস লিখেছি—‘উৎসারিত আলো’—এ তিনটি।
তাপস কুমার দত্ত: লেখালেখিতে কতটা অসন্তুষ্টি বা অতৃপ্তি রয়ে গেছে?
সমরেশ মজুমদার: প্রতিটি লেখায়ই আমার অসন্তুষ্টি রয়ে যায়। আমার মনে হয়, আবার লিখলে ভালো করতাম। কিন্তু একবার বই আকারে...।
তাপস কুমার দত্ত: সেটা ওই বইটার নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর। আমার জিজ্ঞাসা হলো, এমন কোনো প্রিয় লেখা কি আপনার ভেতরে লালিত আছে, যা এখনো আপনি লিখে উঠতে পারেননি?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এই যে আপনাকে এর আগে যে কথাগুলো বললাম। আমি হুমায়ূন (আহমেদ)-কে বারবার বলেছিলাম, দ্যাখো, তুমি এত জনপ্রিয় একজন লেখক, তোমার এত হাজার হাজার বই বিক্রি হয়, তোমার তো এখন হারানোর কোনো ভয় নেই। তা তুমি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ২০০৪ সালের এই সময়কাল পর্যন্ত কয়েকটা খণ্ডে লেখো না, উপন্যাস আকারে। সে বলল, আমার লিখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সাহস পাই না। আমি অ্যাকসিডেন্টলি আপনাদের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিচিত ছিলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আমার কাছে এরশাদ খুব কালারফুল চরিত্র। ঘৃণ্য, কিন্তু কালারফুল। কেউ ওর সঙ্গে দেখা করার সাহস পায়নি, যেতে চায়নি; আমি গিয়েছিলাম ওর আমন্ত্রণে। আমার বিপুল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এটা নিয়ে তিনটি পর্বে ভাগ করে লিখতে আমার খুব ইচ্ছা হয়। ১৯৪৭ থেকে ’৬৯, শেখ মুজিবুর যখন স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সেই অবধি। এরপর ১৯৬৯ থেকে ’৭১ এবং ’৭১ থেকে এখন অবধি। এ তিনটি পর্বে বাংলাদেশের পটভূমিতে যদি পারি, তো কখনো লিখব। আমি জানি, এ লেখা এই সরকার থাকলে ওখানে যাবে না।...এই যে দ্যাখো, ‘এত রক্ত কেন’ বইটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে; ঢাকার ফুটপাতে কিন্তু বইটা পাওয়া যায়। তো ব্যান্ড করে লাভটা কী হলো?
তাপস কুমার দত্ত: এ বইটার জন্য বাংলাদেশের একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে ও-দেশে যাওয়ার ভিসা আপনাকে আটকে দেওয়া হয়। এখন যদি এ জাতীয় সমস্যা না থাকে, তা হলেও কি বাংলাদেশে যেতে কোনো আপত্তি থাকবে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি জানি, এ সরকার যদি এটা তুলেও দেয়, তবু সরকারের যারা অনুচর, তারা আমাকে আক্রমণ করবে।
তাপস কুমার দত্ত: অর্থাৎ আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?
সমরেশ মজুমদার: অফ কোর্স। আমি শেষবার যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন এত রক্ত কেন বেরিয়েছে, কিন্তু ব্যান হয়নি; সেদিন ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমেই বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। আমাকে নিয়ে অফিসাররা হঠাৎ তটস্থ হয়ে উঠলেন, কেন আমি এসেছি? কী উদ্দেশ্যে এসেছি? তো, আমাকে রিসিভ করতে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ। আমাকে নিয়ে সে সোজা চলে গেল নুহাশ পল্লীতে। ওখানে তিন রাত ছিলাম। এরপর রাতের অন্ধকারে ঢাকায় এলাম।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অন্য কোনো ভয় পাচ্ছিলেন?
সমরেশ মজুমদার: পুলিশ বোধ হয় ভাবছিল, আমাকে অ্যারেস্ট করা উচিত কি উচিত না। একদিন একটা অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে সেখান থেকে সোজা এয়ারপোর্টে। এরপর আমি যখন অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরবর্তী আমন্ত্রণ পেলাম, তখন তারা আমাকে ভিসা দিল না।
তাপস কুমার দত্ত: এখন আপনি কী ধরনের বই পড়ছেন?
সমরেশ মজুমদার: কয়েক দিন আগে ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ হুমায়ুন আজাদের বইটা সকাল থেকে পড়তে শুরু করেছিলাম। সেদিনই সকাল ৯টায়—বইটা পড়ছি, হাতে; খবর এল হুমায়ুন আজাদ মারা গেছেন। ওই বইটাতেই একটা জায়গায় লেখা ছিল, যেকোনো দিন তার মৃত্যু হতে পারে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। এ বইটা খুব বড় বা দামি লেখা নয়। খুব আবেগের লেখা, একই কথা বারবার লেখা; কিন্তু কথাগুলো লিখতে সাহস পায়নি তেমন কেউ।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি কি তাঁর আর কোনো উপন্যাস পড়েছেন?
সমরেশ মজুমদার: একটা পড়েছিলাম অনেক আগে, নামটা ভুলে গেছি। দাঁড়াও, নামটা মনে করি...
তাপস কুমার দত্ত: ‘শুভব্রত’, তার সম্পর্কিত সুসমাচার?
সমরেশ মজুমদার: না, আর কয়েকটা নাম বলো তো।
তাপস কুমার দত্ত: ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, সবকিছু ভেঙে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, বইগুলো বেশির ভাগ সময়ই কলকাতায় সহজে পাওয়া যায় না।
তাপস কুমার দত্ত: বয়স তো যথেষ্ট হলো। একদিন চলে যেতে হবে, তার দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে...কোনো আতঙ্ক বা আক্ষেপ?
সমরেশ মজুমদার: না, না। আজ রাতেও চলে যেতে পারি; আবার হয়তো দশ বা কুড়ি বছর পরও যেতে পারি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অবশ্যই দীর্ঘায়ু হবেন, আমি এর দার্শনিক দিকটা জানতে চাচ্ছি।
সমরেশ মজুমদার: আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ। আমি আজকে লেখালেখি করে যেটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি, সেটুকু আমার পাওয়ার কথা ছিল না। আমার লেখক হওয়ারই কথা ছিল না।
তাপস কুমার দত্ত: অনেক বছর আগে বাংলাদেশের একটা সাপ্তাহিক কাগজে আপনি বলেছিলেন, এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেবেন।
সমরেশ মজুমদার: ওসব কথা বাড়িয়ে লিখতে ভালোবাসে কিছু সাংবাদিক। যেমন অন্য একটা জায়গায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তসলিমার ‘ক’ পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে? আমি এর উত্তরে বলেছিলাম, আমি ‘ক’ পড়েছি এবং আমার মনে হয়েছে, একটা বারবনিতাকে যদি বলা হয়, তোমার আত্মজীবনী লেখ, সে তার অনেক কষ্টের কথা লিখবে; কিন্তু যেসব ক্লায়েন্ট তার কাছে আসে, তাদের বিস্তৃত পরিচয় দেবে না সে, এটুকু সৌজন্য দেখাবে। এ উত্তরটা তারা এভাবে লিখেছে যে, সমরেশ মজুমদার বলেছেন, তসলিমা নাসরিন বেশ্যা। এর উত্তরে তসলিমা লিখলেন আনন্দবাজারে, সমরেশ মজুমদারের গলায় গলা মিলিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, তসলিমা বেশ্যা। এর উত্তরে আমি আবার চিঠি লিখলাম আনন্দবাজারে—কোথায়, কখন বলেছি? কাকে বলেছি? যদি দয়া করে আমাকে জানানো হয়...। অতএব, যদি কোথাও কখনো লেখা হয়ে থাকে, আমি বলেছি এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেব—এগুলো বাজে কথা। হয়তো এভাবে বলেছি, লিখে টাকা পাওয়া যায়, জানতাম না। যখন লিখে টাকা পেতে শুরু করলাম, তখন আমাকে যদি বলা হয়, কেন লেখেন? আমি বলি, টাকার জন্য লিখি।
তাপস কুমার দত্ত: কথাটা এভাবে বলেছিলেন, একজন কৃষক যে কারণে চাষাবাদ করেন, একজন...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, একজন কৃষক যখন চাষাবাদ করেন, তিনি তো দেশ গড়ার জন্য চাষ করেন না; তিনি তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য চাষাবাদ করেন। একজন মাস্টার যখন পড়ান, তখন মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার চেয়ে তার সন্তানসন্ততিকে বড় করার জন্য পড়ান। তো, একজন লেখকের কী দায় আছে, তিনি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন? আমাদের দেশে কোনো লেখক যদি জনপ্রিয় হন, তখন ধরেই নেওয়া হয়, ওগুলো ভুসিমাল। যদি সে ধরনের লেখক জনপ্রিয়তা না পান বা বিক্রি না হয়, তখন তিনি একজন বিরাট লেখক। প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা যদি কেউ বেশি পান, কেন পান? কারণ, পাঠকদের ভালো লাগছে বলেই। কোনো একটা বই হয়তো বেশি পাঠকের ভালো লেগেছে। এমন নয় যে বছরের পর বছর তিনি জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। তা হলে যিনি পাঠককে সহজে স্পর্শ করতে পারছেন না, তার কোথাও খুঁত আছে নিশ্চয়ই। ভালো একটা ছবি তিন দিন সিনেমা হলে থেকে চলে গেল। আর একটা ছবি ‘বাবা কেন চাকর’ মাসের পর মাস চলল, জনপ্রিয় হলো। আবার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর যখন হাজারটা শো চলে, তখন বলতেই হয়, গুপী গাইন বাঘা বাইন খারাপ ছবি? চার্লি চ্যাপলিন তা হলে খারাপ ছবির নাম? ‘পথের পাঁচালী’ও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল—ওটাও তা হলে খারাপ ছবি?
তাপস কুমার দত্ত: ধরুন, হাইপোথেটিক্যালি আমরা ধরে নিলাম, কোনো ধনকুবের আপনার যাবতীয় চাহিদার স্পন্সরশিপের দায়িত্ব নিল। একজন কৃষক যে কারণে কৃষিকাজ করেন বা আর দশজন পেশাজীবী মানুষ যে কারণে পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, সেই প্রয়োজনটা আপনার আর রইল না। তখন কি লেখালেখি আপনি ছেড়ে দেবেন?
সমরেশ মজুমদার: চাহিদার কিন্তু শেষ নেই। আগে বাস-ট্রামে চড়তাম, আমার এখন বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। এখনো অবশ্য ইচ্ছা করে মাঝেমধ্যে বাস-ট্রামে উঠি। তো, আগে আমি জলপাইগুড়ি আমার বাড়ি যেতাম সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে, রিজারভেশন ছাড়া। এরপর রিজারভেশনে। এরপর এসি থ্রি-টিয়ার, এরপর এসি টু-টিয়ার। এর মানে এই নয়, আমি এখন এসি টু-টিয়ার ছাড়া যেতে পারব না। কিন্তু যদি কমফোর্ট পাই, তা আমি নেব না কেন?
তাপস কুমার দত্ত: আমি বলতে চাচ্ছি, শুধু ভরণপোষণ আর কমফোর্ট—এসব কারণেই লেখালেখি? ভোগবাদী ব্যাপার ছাড়া তা কি নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে না?
সমরেশ মজুমদার: শুনুন, আমাকে যদি এক কোটি টাকা দেওয়া হয় একটা উপন্যাস লেখার জন্য—সাত দিন চেষ্টা করেও লিখে উঠতে পারব না। আবার, আমাকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি, আমি লিখতে বসলাম, হয়তো দুদিনেই লেখাটা শেষ করে ফেলতে পারব।
তাপস কুমার দত্ত: তা হলে লেখালেখিটা শুধু হালচাষির হালচাষের মতো জীবিকা নির্বাহ নয়, আলাদা একটা ভেতরের তাগিদও...
সমরেশ মজুমদার: অবশ্যই।
তাপস কুমার দত্ত: বেশির ভাগ জনপ্রিয় লেখকের লেখায় দেখা যায়, কতগুলো পাগলামোর ঘটনা, কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা, কিছু সুখকর ঘটনা ও একটু বেদনাদায়ক ঘটনা। যেন ছাঁচে ঢেলে গরম তেলে ভেজে তোলা হট কেক...
সমরেশ মজুমদার: এটা আমার কাছে খুব অস্পষ্ট। ধরুন, আমার একটা বই, ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। সেই বইটা কলকাতায় ৫০-৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। ধরে নিতে পারি, বইটা জনপ্রিয়।
তাপস কুমার দত্ত: বইটার নাম কী?
সমরেশ মজুমদার: ‘গর্ভধারিণী’। তা ওটা কোন ফর্মুলায় লেখা, বলুন তো?
তাপস কুমার দত্ত: ওই বইটাতে আসলে এমন একটা সাসপেন্স বা থ্রিল এবং এর সঙ্গে আবেগ, বর্তমান সমাজব্যবস্থার কিছু মানুষের অমানবিক নোংরা দিকের প্রতি...।
সমরেশ মজুমদার: এসব তো অনেক বইতেই আছে।
তাপস কুমার দত্ত: হ্যাঁ, তা ঠিক, ‘মেঘ ছিল, ‘বৃষ্টিও’-তেও আছে। ‘আট কুঠুরী নয় দরজা’তেও।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে সেগুলো ওভাবে বিক্রি হয়নি কেন?
তাপস কুমার দত্ত: না, আমি বলছি ‘গর্ভধারিণী’র মতো বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলেও ওই লেখাগুলোও বেশ জনপ্রিয়।
সমরেশ মজুমদার: যদি জানতাম, গর্ভধারিণীর মতো ওভাবে সাসপেন্স মেশালে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে, তা হলে তো সব বই ওভাবেই লেখা হতো। তা হলে ‘সাতকাহন’ কেন এত বিক্রি হলো? স্ট্রাগল করা মেয়েদের গল্প তো আমি আগেও লিখেছি, পরেও লিখেছি, সেগুলো কেন সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হলো না? আমি যদি আরেকটা দীপাবলীকে নিয়ে লিখি, সেটা কি সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হবেই?
তাপস কুমার দত্ত: সাতকাহনের দ্বিতীয় পর্ব কিন্তু প্রথম পর্বের মতো অত জনপ্রিয় নয়।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে? আসলে আমার কাছে মনে হয়, যেকোনো...আমি আপনাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখাটার কথা বললাম, ‘এখনো সময় আছে’ বইটা তিন থেকে চার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। লোকে না পড়লে আমার কষ্ট হয়, আমি তো লোকে লোকে গিয়ে বলতে পারি না, আপনি বইটা পড়ুন। কোত্থেকে ‘কালবেলা’ এক লাখ কপি বিক্রি হলো! ‘উত্তরাধিকার’ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার। অথচ উত্তরাধিকার ওটার চেয়ে অনেক বেটার উপন্যাস। তাই কোন লেখাটা জনপ্রিয় হবে, তা আগে থেকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। একটা লেখা জনপ্রিয় হতে পারে। একটা মেমসাহেব, একটা দৃষ্টিপাত, একটা মরুতীর্থ হিংলাজ জনপ্রিয় হতে পারে। কয়েকটা নয়।
তাপস কুমার দত্ত: ওপারের লেখকদের লেখা সম্পর্কে...
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, ওপারের এক নম্বরের সঙ্গে দুই নম্বরের ব্যবধান এত বিস্তর...জাফর ইকবাল সম্প্রতি সেই ব্যবধান একটু কমিয়ে এনেছেন। তো, গতবার যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তখন একজন লেখক আমাকে এসে বললেন, সমরেশ দা, আপনাকে একটা ভালো খবর দিই।
আমি বললাম, কী?
বলল, আমি এখন তিন নম্বরে।
আমি জানতে চাইলাম, কিসের তিন নম্বর? সে জানাল, জনপ্রিয়তার। তার পেছনে নাকি মিলন চলে গেছে, অমুক-তমুক অনেকে চলে গেছে। আমি হাসব না কাঁদব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তাপস কুমার দত্ত: কে?
সমরেশ মজুমদার: নামটা নাই-বা বললাম।
তাপস কুমার দত্ত: বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের রুচিবোধ আপনার কতটা উঁচুদরের বলে মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: আপনি যা ইচ্ছা তা-ই লিখে পাঠকদের ভোলাতে পারবেন না। পাঠকদের বিচারশক্তি দারুণ প্রখর। একটা লেখা দিয়ে ভোলাতে পারবেন, পরের দুটোয় হাফ ভোলাতে পারবেন; তৃতীয়টায় আর পারবেন না।
তাপস কুমার দত্ত: পাঠকেরা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমাকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না। তবে কিছু কিছু ঘটনায় মাঝেমধ্যে কষ্ট হয়। একবার বইমেলায় এক ভদ্রমহিলা তিনখানা (বড় ক্যানভাসের) বই বইতে পারছিলেন না, চেহারা দেখে বোঝা যায়, যথেষ্ট (আর্থিক) অসচ্ছল পরিবার। আমি বললাম, আপনি কী করেন?
তিনি বললেন, আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়াই।
আমার খুব খারাপ লাগল, আপনি এত দামি তিনটি বই কিনলেন?
তিনি বললেন, সারা বছর আমরা অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি।
এরপর দেখলাম, দূরে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ক্রাচ হাতে, একটা পা ডিফেক্টেড। ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, আমি আপনার অনিমেষ।
আমি বললাম, তার মানে?
তিনি জানালেন, তিনি নকশাল আন্দোলন করতেন এবং হাওড়া জেলে পুলিশের অত্যাচারে একটা পা নষ্ট হয়ে (অনিমেষের মতোই) গেছে। আমরা একসঙ্গে থাকি। (অনিমেষ-মাধবীলতার মতো), আমরা বিয়ে করিনি।
আরেকটা ঘটনা বলে শেষ করি—হ্যাঁ, একবার বিদেশে রাতে আমার খুব খিদে পেয়েছে, একটা বড় রেস্টুরেন্ট দেখে ভেতরে ঢুকে পড়ি। এরপর মেনু কার্ডের সবচেয়ে ছোট আইটেম যেটা, সেটার অর্ডার দিলাম। বেয়ারাগুলোকে দেখে মনে হলো এশিয়ান। তো, একটা বেয়ারা এসে বলল, স্যার! আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?
আমি বললাম, ইয়েস।
স্যার! আর ইউ ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল?
আমি আবার বললাম, ইয়েস।
বেয়ারা গিয়ে হোটেল মালিককে তথ্যগুলো জানাতেই হোটেল মালিক উঠে এসে বললেন, নমস্কার স্যার! আপনি বোধ হয় সমরেশ বাবু। আমি আপনার একটাই মাত্র বই পড়েছি। একবার একটা বাস টার্মিনালে দেখলাম একটা বই পড়ে আছে—বাংলা বই, নামটা ‘দৌড়’।
এরপর যতই বলছি, আমার খাওয়া হয়ে গেছে, তবু তিনি আমাকে জোর করে খাওয়াবেন। বিল দিতে গেলাম, বিল নিলেন না। এই অবধি ঠিক আছে। বেয়ারা এরপর বলল, সাহেব, একবার ভেতরে আসবেন? আপায় কইছিল, আপনি সমরেশ মজুমদার কি না জিজ্ঞেস করতে। তো, আমি ভেতরে ঢুকলাম। একজন ভদ্রমহিলা খাটের ওপর বসে নমস্কার জানিয়ে আমার দিকে একটা বই এগিয়ে দিলেন—‘গর্ভধারিণী’। আমার পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। দেখুন, কারোর জানার কথা নয়, আমি ওখানে যাব। কাকতালীয়ভাবে।
তাপস কুমার দত্ত: একবার কবি সম্মেলনে আপনাকে দেশের বাইরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল—কবি হিসেবে, ভুল করে। ঠিক এ রকমই একটা ঘটনার কথা...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আপনি সবই জানেন দেখছি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি বই বাজেয়াপ্ত করাটা কতটা সমর্থন করেন?
সমরেশ মজুমদার: যে কারণে তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেটাকে আমি সমর্থন করি না। তবে আমার হাতে আইন থাকলে তসলিমাকে অভিযুক্ত করতাম। আজ একটা ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ের ভালো সম্পর্ক; সম্পর্কটা দুজনকেই আনন্দিত করছে। যদি ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো তিক্ততা আসে, আজকের এ আনন্দটা কিন্তু মিথ্যা হয়ে যাবে না এবং সেই ছেলেটা ও মেয়েটার কোনো রাইট নেই ভবিষ্যতে এই আনন্দিত সম্পর্ককে নিয়ে খোলামেলা...ব্যঙ্গ করে লেখা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে লেখা। যে ক্ষেত্রে তারা একে অন্যকে ছোট ও অপমান করছে। মিলনের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়ে কী হয়েছে বা অমুকের সঙ্গে অমুকের আর কী হয়েছে—এর ডিটেইলস নিয়ে আমরা আদৌ আগ্রহী নই। আমরা তসলিমার ব্যাপারে এখানেই আগ্রহী যে সে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কী লড়াই করেছিল। তা না করে তার শারীরিক আনন্দের বিবরণ দিয়ে লিখছে—এটা এক ধরনের অসুখ। আমি জানি, আমার বাবা-মায়ের মিলনের ফলে আমি পৃথিবীতে এসেছি; এখন সেই মিলনটা কী রকম ছিল, তার বিবরণ দিয়ে যদি লিখতে যাই, তো আমার জন্মটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি কুৎসিত করছি। আমার জন্মের বিবরণের জন্য আমার বাবা-মায়ের শয্যা বিবরণ কি আমি দিতে পারি? নাকি তা আমি ভাবতে চাই? বা ভাবতে পারি?
তাপস কুমার দত্ত: আপনি আপনার খোলামেলা বা বিতর্কিত ভাবনা প্রকাশ করতে কতটা ভয় পান?
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, এ মুহূর্তে বোধ হয় আমিই সবচেয়ে সরাসরি লিখি। ‘পত্রপাঠ’ বলে একটা পত্রিকা আছে, মাসে বেরোয়—সেটায় আমি কলাম লিখি। সেখানে সরাসরি সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে লিখি। একজন কলেজ অধ্যাপককে পুলিশ অ্যারেস্ট করে—জনযুদ্ধগোষ্ঠীর ডায়েরি থেকে নাম পেয়ে তাকে অ্যারেস্ট করে। সারা দিন অত্যাচার করে সন্ধ্যায় তাকে ছেড়ে দেয়। এলাকার লোকজন মনে করে, সে জনযুদ্ধগোষ্ঠীর লোক। সে রেললাইনে আত্মহত্যা করে, তার স্ত্রী এ নিয়ে কেস করে। এ ঘটনা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। আমি এ-ও লিখেছিলাম, কয়েক দিন আগে ভোটের সময় একজন সাংবাদিক একটা গ্রামে গেছেন। সেখানে এক চায়ের দোকানে নানা আলোচনায় উঠে আসে, আমাদের দেশে যত মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অবিবাহিত। বিবাহিত ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়, জ্যোতিবাবু। সিদ্ধার্থবাবু, জ্যোতিবাবু কখনো বাজারে যাননি। বুদ্ধবাবু রিকশায় চাপেন, বাজারে যান। আর নামটা দেখুন, বুদ্ধদেব।...বিধানচন্দ্র, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ হচ্ছে সংসারী নাম।...এ রকম নাম যার, তাকে আমরা ভোট দেব না, তো অন্য লোককে ভোট দেব? সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কেমন আছেন? ওরা বলল, এই যে রাস্তাটা দেখছেন, এর নাম সুচেতনা (‘সুচেতনা’ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মেয়ের নাম)। আমাদের এখানে একটা ভাটিখানা আছে, খুব মারপিট চলত আগে, মদ খেতে খেতে। আমরা সেটার নাম দিয়েছি সুচেতনা...বাংলা বারের প্রতিশব্দ আর কি। ওখানে মদ খেয়ে এখন আর কেউ চেতনা হারাচ্ছে না। ফলে বুঝতেই পারছেন, আমরা সবই বুদ্ধবাবুর লোক। এ গল্পটা বের হওয়ার পর বুদ্ধবাবু আমায় বললেন, আমাকে নিয়ে লিখলেন, ঠিক আছে; আমার মেয়েকে জড়ালেন কেন? আমি বললাম, ‘হাওড়ার একটা লাইব্রেরি উদ্বোধন করতে তোমার মেয়ে আর তোমার স্ত্রী গিয়েছিলেন, লাইব্রেরিটার নাম রাখা হয়েছে সুচেতনা পাঠাগার। তোমার মেয়ে এখনই এমন কী যোগ্যতা অর্জন করেছে যে তার নামে একটা পাঠাগার রাখা হবে? যেহেতু সে তোমার মেয়ে, তাই রাখা হয়েছে।’ এখন, আপনি কী মনে করেন না, এর চেয়ে সরাসরি আক্রমণ করে লেখা—আর বড়াই করে বলি, আমাদের কোনো লেখকই লিখছেন না। লিখতে পারেন, কিন্তু লিখছেন না।
তাপস কুমার দত্ত: এত সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সমরেশ মজুমদার: থ্যাঙ্ক ইউ।
ইউনিক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত হোসেন। পর্যটনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি মনজুরুল ইসলাম।
০৩ অক্টোবর ২০২৪বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, সুফি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোনো বিভাজনমূলক এজেন্ডায় রাজনীতির দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত না হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা দৃঢ়ভাবে কোনো সাম্প্রদায়িক ফাঁদে আটকা পড়তে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করি। কোনোভাবেই তা হতে দেওয়া যাবে না।
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪‘আমি এটাকে ঠিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বলব না। আমি এটাকে বলব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সেটা আমার পারিবারিক শিক্ষা। আমাদের ঘরের ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে যেকোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পরিবারের বড়দের সাথে আমরা দ্বিমত পোষণ করতে পেরেছি। ছোট থেকে বড়, কারও কোনো কথা বা কাজ ভুল মনে হলে সেটাকে আমরা তার প্রতি স
৩১ আগস্ট ২০২৪একেক মানুষ বেছে নেন একেক পেশা। তাঁদের মধ্যে কারও কারও পেশা একটু ভিন্ন ধরনের। যেমন—মো. মুনসুর আলী ওরফে মন্টু খলিফা। বাপ-দাদার পেশাকে ভালোবেসে শিশুদের খতনা করানো বা হাজামের কাজ বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। জীবনে পার করেছেন প্রায় ৮৫ বছর। জানিয়েছেন গত ৬০ বছরে ২ লাখের বেশি শিশুর মুসলমানি বা সুন্নতে খতনা দিয়
৩০ মার্চ ২০২৪