তেহরান থেকে রাজধানী সরাতে চায় ইরান, লক্ষ্য কী

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭: ৩৯
Thumbnail image
মাকরানের উপকূলে ইরানের একমাত্র মহাসাগরীয় বন্দর চাবাহার। ছবি: সংগৃহীত

ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির সরকার। নতুন রাজধানী হবে উপকূলীয় মাক্রান অঞ্চলে। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন ইরান সরকারের মুখপাত্র ফাতেমেহ মোহাজেরানি। তিনি জানান, তেহরানে জনসংখ্যা, পানি ও বিদ্যুতের চাপ বেড়ে গেছে। তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ইরান ইন্টারন্যাশনাল এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে।

ফাতেমেহ মোহাজেরানি বলেন, মাক্রানে রাজধানী স্থানান্তর করা হলে ইরান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দিক থেকে লাভবান হবে। ইতিমধ্যে রাজধানী স্থানান্তরের কাজ শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি।

ইরানের সংবাদমাধ্যম তেহরান টাইমসের খবর অনুযায়ী, তেহরানে পরিবেশগত চাপ, জনসংখ্যা, পানি ও বিদ্যুৎসংকট প্রতিদিনের সঙ্গী। তাই রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। উপকূলীয় মাক্রান অঞ্চলে রাজধানী হলে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সুফল পাবে ইরান।

ফাতেমেহ মোহাজেরানি বলেন, ‘মাক্রানে অবশ্যই আমাদের নতুন রাজধানী হবে। এতে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ ঘটবে। এরই মধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ, অভিজাত ব্যক্তিবর্গ, বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের সহযোগিতা চেয়েছি।’

অবশ্য প্রায় তিন দশক আগেই তেহরান থেকে রাজধানী স্থানান্তরের আলোচনা শুরু হয়। ২০১০ সালেও এ বিষয়ে আলোচনা উঠেছিল। পরিবেশগত ঝুঁকির কারণেই এই আলোচনার শুরু হয়। গত তিন বছরে ইরানের নতুন রাজধানী হিসেবে বিভিন্ন শহরের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিরাজ, ইসফাহান, হামেদান, সেমনান, তেহরানের দক্ষিণে পারদিস শহর, বান্দার আব্বাস ও কাশান।

ইরান সরকারের মুখপাত্র বলেন, ‘আমাদের রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নতুন নয়। তিন দশক ধরে এই আলোচনা চলছে। তেহরান প্রদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়েছে। প্রদেশটি প্রায় বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। এখানে পানিরও তীব্র সংকট। এসব কারণেই আমরা রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।’

মাকরান একটি বিশাল ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক অঞ্চল। এটি কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশাসনিক বিভাগ নয়। এটি দক্ষিণ-পূর্ব ইরান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব পাকিস্তান পর্যন্ত প্রায় এক হাজার কিলোমিটার (৬২০ মাইল) দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত। ইরানে মাকরানের উপকূল ওমান উপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত, আর পাকিস্তানি অংশটি আরব সাগরের তীরে বিস্তৃত।

ইরানের মাকরান অংশ ঐতিহাসিক এই অঞ্চলের প্রায় এক-চতুর্থাংশ দখল করে আছে এবং এটি মূলত সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। এটি ইরানের বৃহত্তম, তবে সবচেয়ে স্বল্পোন্নত এবং জনবসতিহীন অঞ্চলগুলোর একটি। এখানে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি বন্দর রয়েছে, যেমন—গুয়াতার, জাস্ক ও সিরিক। চাবাহার হলো এই উপকূলের সবচেয়ে বড় বন্দর এবং এটি ইরানের ৯টি মুক্ত বাণিজ্য-শিল্পাঞ্চলের একটি।

বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সরকার প্রথমবারের মতো মাকরান অঞ্চলকে রাজধানী স্থানান্তরের সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে প্রকাশ্যে প্রস্তাব করেছে। তবে এ প্রস্তাবে ইরানিদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গভীর সংশয় দেখা গেছে। মাকরান অঞ্চল শুষ্ক হওয়ায় বড় শহর স্থাপনের জন্য সমুদ্রের পানি লবণমুক্ত করার মতো ব্যয়বহুল প্রযুক্তি প্রয়োজন। এ জন্য এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে।

মাকরান অঞ্চলকে ইরানের নতুন রাজধানীর জন্য সম্ভাব্য স্থান হিসেবে বিবেচনা করার পেছনে কিছু ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো পানিসম্পদের সহজলভ্যতা এবং ওমান উপসাগরের (যা মাকরান সাগর নামেও পরিচিত) মাধ্যমে পারস্য উপসাগর ও হরমুজ প্রণালির বাইরের ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ।

মাকরানের উপকূলে ইরানের একমাত্র মহাসাগরীয় বন্দর চাবাহার সরাসরি আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার বাজারে পণ্য পরিবহনের সংযোগ দিতে পারে। চাবাহার ফ্রি ইকোনমিক জোনে বর্তমানে দুটি পৃথক বন্দর রয়েছে (শহীদ বেহেশতি ও শহীদ কলান্তারি), যা একসঙ্গে প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন টন কার্গো সামলানোর সক্ষমতা রাখে।

এ ছাড়া চাবাহার ভারতসহ অন্যান্য দেশের জন্য চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) এবং পাকিস্তানের গওয়াদারের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে, যা চাবাহার থেকে মাত্র ১৭০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত।

২০১৩ সালের মে মাসে ইরান ও ভারতের মধ্যে চাবাহার বন্দর উন্নয়নে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৬ সালের মধ্যে ভারত এই প্রকল্পে দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা রেলপথের মাধ্যমে চাবাহারকে মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।

এই চুক্তিটি ইরান, ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থার অংশ ছিল। এটি পাকিস্তানকে বাইপাস করে তিন দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও পরিবহন করিডর প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে করা হয়।

তবে, গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়েছে, যা ইরানের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। এর মধ্যেও ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র কিছু সীমিত ছাড় দেয়, যাতে চাবাহারের মাধ্যমে আফগানিস্তান পুনর্গঠনের জন্য সহায়তা ও মানবিক সাহায্যের পণ্য পরিবহন চালানো যায়।

তবে মাকরানের উন্মুক্ত সমুদ্র এবং পাকিস্তান সীমান্তের নিকটবর্তী অবস্থান নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করে। কেন্দ্রীয়ভাবে অবস্থিত তেহরানের তুলনায়, মাকরান সাগরপথে হুমকি এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঝুঁকির মুখে থাকতে পারে।

বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ইরানের জন্য এমন একটি অনুন্নত অঞ্চলে রাজধানী স্থানান্তর করা অনেকের কাছে অবাস্তব মনে হচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে—যা এত বড় উদ্যোগ নেওয়ার মতো অর্থ ইরানের হাতে বর্তমানে নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত