সাহিদুল ইসলাম চৌধুরী, রেজা করিম, তানিম আহমেদ ও ফারুক ছিদ্দিক, ঢাকা
সাংবিধানিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ চান জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কিছুটা এগিয়ে নিয়ে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী বছরের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে, এমন একটি ধারণা সম্প্রতি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্যে কোনটি কখন হতে হবে, কীভাবে হবে, সে বিষয়ে সরকার, বিএনপিসহ বড় দলগুলো এবং অভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
বিএনপি ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করে বলছে, এ সংস্কার মূলত হতে হবে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে। আর রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের কিছু পদক্ষেপ আগে নেওয়া হলেও তা সংসদের অনুমোদন সাপেক্ষে বৈধতা পাবে। এ কারণে দলটি সংসদ নির্বাচন আগে করার দাবি তুলছে। এমন দাবিতে প্রয়োজনে মাঠে নামার পরিকল্পনাও করছে দলটি।
বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানালেও সরকারের তরফ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে সম্প্রতি। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সমমনা কয়েকটি সংগঠন সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আগে করার দাবি তুলছে। ইউনিয়ন পরিষদ ও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি ফেসবুক পোস্ট একসঙ্গে নিয়ে পুরো বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি।
মাঠপর্যায়ে স্থানীয় সরকারের সর্বশেষ স্তর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান গত বৃহস্পতিবার সরকারের অন্য তিন প্রভাবশালী উপদেষ্টাকে যুক্ত করে একটি ফেসবুক পোস্ট দেন।
দুটি প্রশ্ন জুড়ে দিয়ে করা ওই পোস্টে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচনের কথা বলেছেন। দলীয় প্রতীকবিহীন প্রার্থীদের নিয়ে এসব নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের আপত্তির সুযোগ কোথায়? স্বাধীন ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ছাড়া, একদলীয় শাসন থেকে মুক্তির অন্য কোনো উপায় আছে কী?’
অন্য যে তিন উপদেষ্টাকে ফেসবুক পোস্টে যুক্ত করা হয়েছে, তাঁরা হলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, তথ্য মন্ত্রণালয়ের মো. নাহিদ ইসলাম ও আইন মন্ত্রণালয়ের আসিফ নজরুল।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা গত বুধবার ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বেয়ারকে জানান, সরকার জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি একই সঙ্গে নিচ্ছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী করার বিষয়টি সরকার নিশ্চিত করতে চায়।
বিএনপির নেতৃত্ব মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে তৈরি করা প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটির মাধ্যমে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সুবিধা ব্যবহার করে সারা দেশে নতুন রাজনৈতিক দল দাঁড় করানোর জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল নেওয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সময় নিতে সামনে আনা হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গগুলো।
বিএনপির নেতাদের অনেকের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয় দলের চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিদেশে যাওয়ার পরদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজে করা একটি পোস্ট থেকে। ৮ জানুয়ারি করা এ পোস্টে বলা হয়, ‘দুই আপামুক্ত’ এই প্রথম বাংলাদেশ। ফেসবুক পোস্টটি পরে সরিয়ে নেওয়া হলেও সেদিনই তা বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকের নজরে আসে।
খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার প্রসঙ্গটিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে জুড়ে দিয়ে মন্তব্যটি করা হয়েছে, এমনটি মনে করছে বিএনপি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ‘পদত্যাগ করে’ ৫ আগস্ট দিল্লি চলে যান। আর খালেদা জিয়া ৭ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, এ পোস্টটি সরকারের কয়েকটি প্রভাবশালী মহল ও সম্প্রতি প্রভাবশালী হয়ে ওঠা বিভিন্ন সংগঠনের অনেক নেতার দুরভিসন্ধি স্পষ্ট করে দিয়েছে। এই মহলগুলো খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে রেখে ও সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করে তাঁরা নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়।
দলটির কয়েকজন নেতা বলছেন, প্রেক্ষাপট ও কারণ ভিন্ন হলেও দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা এখন দেশের বাইরে। এমন অবস্থায় দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পোস্টটির সঙ্গে ২০০৭-০৮ সালের সেনাসমর্থিত সরকারের কুশীলবদের ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার মিল রয়েছে। তখন দুই নেত্রীকেই রাজনীতির বাইরে রাখার কথা প্রকাশ্যে আনা হলেও আসলে তা ছিল খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে (মাইনাস ওয়ান) শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসার পথ নিষ্কণ্টক করা। সরকারের একটি প্রভাবশালী সংস্থার মাধ্যমে প্রবল চাপ দিয়েও খালেদাকে তখন বিদেশে পাঠানো যায়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পোস্টটির বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা কোনো দলের বিরুদ্ধে নই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পেজে এ লেখা দেখার পর আমরা মিডিয়া সেলে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদেরকে স্ট্রিকটলি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দলকে হেয় করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।’
নির্বাচন ও সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির কৌশল কী হতে পারে, সে বিষয়টি টানা আলোচনায় আসছে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বিভিন্ন বৈঠকে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা তো বিরোধিতা করলাম। তারপরও (স্থানীয় সরকার নির্বাচন) করে ফেললে সেটার পরিণতি... দেশের মানুষ দেখবে। দেশের মানুষ ঠিক করবে।’
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে ঝুঁকি আছে, এমনটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা (স্থানীয় সরকার নির্বাচন) আগে করার কোনো অর্থ হয় না এ জন্য যে, অন্তর্বর্তী সরকারের জনগণের ম্যান্ডেট নেই। নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার এসে ওই নির্বাচন সঠিক হয়নি বলে বাতিল করলে সেটা আরও খারাপ হবে। অতীতেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে। কাজেই বিনা কারণে কেন এমন ঝুঁকিতে আমরা যাব?’
বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে চায়, এমনটি স্পষ্টভাবে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার জনগণকে ওয়াদা করেছে যে, ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেবে। ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হলে জনগণকে প্রথমে জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে। জনগণের সরকার পরবর্তী কাজগুলো করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক প্রভাবশালী সদস্য বলেন, ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সংস্কার করে আগে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপি শিগগিরই মাঠে নামবে। এ জন্য ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও রাজধানীসহ সর্বত্র দলকে সক্রিয় করা হচ্ছে। শুরুতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে। প্রয়োজনে পরে কঠোর কর্মসূচিও দেওয়া হতে পারে, এমনটি জানান তাঁরা।
বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি সারা দেশে সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাদের টানার চেষ্টা চলছে।
অন্য এক নেতা বলেন, সরকারের কয়েকটি দপ্তর নতুন নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের নেপথ্যে রয়েছে। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে এসব তৎপরতার ওপর নজর রাখতে বিএনপির হাইকমান্ড ইতিমধ্যে নির্দেশ জারি করেছে।
তবে জাতীয় নাগরিক কমিটির সহমুখপাত্র সালেহ উদ্দীন সিফাত আজকের পত্রিকাকে বলেন, অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে পুরোনো সব রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ভেঙে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়ন। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। সে লক্ষ্যে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কথা বলা হচ্ছে। নতুন সংবিধান প্রণয়ন বা সংস্কার নিশ্চিত করতে হলে গণপরিষদ নির্বাচন লাগবে। নাগরিক কমিটি অন্তর্বর্তী সরকারকে সংবিধান প্রণয়ন করতে বলছে না, এমনটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যরা সংবিধান প্রণয়ন করবেন। এরপর গণপরিষদই আইনসভায় রূপান্তরিত হবে।’
সিফাত বলেন, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে উত্তরণের প্রাথমিক ধাপ হলো স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা জনমানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। সে জন্য আগে স্থানীয় নির্বাচন প্রয়োজন।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে উপদেষ্টার বক্তব্যকে এখনই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে নারাজ বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রভাবশালী সমর্থক দল জামায়াতে ইসলামী। দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরকার যে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চায়, সে বিষয়ে তাঁদের দিক থেকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য এখনো আসেনি। তেমন বক্তব্য এলে জামায়াত তার করণীয় ঠিক করবে।
মিয়া গোলাম পরওয়ার আরও বলেন, এ বিষয়ে অনেকে অনেক কথা বলছে, যা কেবলই ‘ধারণা’। জামায়াত কোনো ‘ধারণা’ নিয়ে কথা বলতে চায় না।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে ৫৩ বছর ধরে স্থানীয় রাজনীতিতে অন্যতম বড় দল আওয়ামী লীগ। নির্বাচন নিয়ে সরকারের ভেতরে-বাইরে নানামুখী আলোচনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দলটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক গতকাল বলেন, ‘আগে তো আমাদের বসতে দিতে হবে। দলকে এক জায়গায় আসতে দিতে হবে। সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক। তারপর আমরা নির্বাচনের কথা ভাবব।’
দলের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল গতকাল বলেন, ‘তারা (সরকার) কোন দিকে পালাবে, সে চিন্তা করুক। নির্বাচনের চিন্তা করার দরকার নেই।’
সাংবিধানিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ চান জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কিছুটা এগিয়ে নিয়ে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী বছরের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে, এমন একটি ধারণা সম্প্রতি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্যে কোনটি কখন হতে হবে, কীভাবে হবে, সে বিষয়ে সরকার, বিএনপিসহ বড় দলগুলো এবং অভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
বিএনপি ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করে বলছে, এ সংস্কার মূলত হতে হবে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে। আর রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের কিছু পদক্ষেপ আগে নেওয়া হলেও তা সংসদের অনুমোদন সাপেক্ষে বৈধতা পাবে। এ কারণে দলটি সংসদ নির্বাচন আগে করার দাবি তুলছে। এমন দাবিতে প্রয়োজনে মাঠে নামার পরিকল্পনাও করছে দলটি।
বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানালেও সরকারের তরফ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে সম্প্রতি। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সমমনা কয়েকটি সংগঠন সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আগে করার দাবি তুলছে। ইউনিয়ন পরিষদ ও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি ফেসবুক পোস্ট একসঙ্গে নিয়ে পুরো বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি।
মাঠপর্যায়ে স্থানীয় সরকারের সর্বশেষ স্তর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান গত বৃহস্পতিবার সরকারের অন্য তিন প্রভাবশালী উপদেষ্টাকে যুক্ত করে একটি ফেসবুক পোস্ট দেন।
দুটি প্রশ্ন জুড়ে দিয়ে করা ওই পোস্টে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচনের কথা বলেছেন। দলীয় প্রতীকবিহীন প্রার্থীদের নিয়ে এসব নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের আপত্তির সুযোগ কোথায়? স্বাধীন ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ছাড়া, একদলীয় শাসন থেকে মুক্তির অন্য কোনো উপায় আছে কী?’
অন্য যে তিন উপদেষ্টাকে ফেসবুক পোস্টে যুক্ত করা হয়েছে, তাঁরা হলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, তথ্য মন্ত্রণালয়ের মো. নাহিদ ইসলাম ও আইন মন্ত্রণালয়ের আসিফ নজরুল।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা গত বুধবার ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বেয়ারকে জানান, সরকার জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি একই সঙ্গে নিচ্ছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী করার বিষয়টি সরকার নিশ্চিত করতে চায়।
বিএনপির নেতৃত্ব মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে তৈরি করা প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটির মাধ্যমে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সুবিধা ব্যবহার করে সারা দেশে নতুন রাজনৈতিক দল দাঁড় করানোর জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল নেওয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সময় নিতে সামনে আনা হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গগুলো।
বিএনপির নেতাদের অনেকের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয় দলের চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিদেশে যাওয়ার পরদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজে করা একটি পোস্ট থেকে। ৮ জানুয়ারি করা এ পোস্টে বলা হয়, ‘দুই আপামুক্ত’ এই প্রথম বাংলাদেশ। ফেসবুক পোস্টটি পরে সরিয়ে নেওয়া হলেও সেদিনই তা বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকের নজরে আসে।
খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার প্রসঙ্গটিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে জুড়ে দিয়ে মন্তব্যটি করা হয়েছে, এমনটি মনে করছে বিএনপি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ‘পদত্যাগ করে’ ৫ আগস্ট দিল্লি চলে যান। আর খালেদা জিয়া ৭ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, এ পোস্টটি সরকারের কয়েকটি প্রভাবশালী মহল ও সম্প্রতি প্রভাবশালী হয়ে ওঠা বিভিন্ন সংগঠনের অনেক নেতার দুরভিসন্ধি স্পষ্ট করে দিয়েছে। এই মহলগুলো খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে রেখে ও সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করে তাঁরা নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়।
দলটির কয়েকজন নেতা বলছেন, প্রেক্ষাপট ও কারণ ভিন্ন হলেও দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা এখন দেশের বাইরে। এমন অবস্থায় দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পোস্টটির সঙ্গে ২০০৭-০৮ সালের সেনাসমর্থিত সরকারের কুশীলবদের ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার মিল রয়েছে। তখন দুই নেত্রীকেই রাজনীতির বাইরে রাখার কথা প্রকাশ্যে আনা হলেও আসলে তা ছিল খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে (মাইনাস ওয়ান) শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসার পথ নিষ্কণ্টক করা। সরকারের একটি প্রভাবশালী সংস্থার মাধ্যমে প্রবল চাপ দিয়েও খালেদাকে তখন বিদেশে পাঠানো যায়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পোস্টটির বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা কোনো দলের বিরুদ্ধে নই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পেজে এ লেখা দেখার পর আমরা মিডিয়া সেলে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদেরকে স্ট্রিকটলি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দলকে হেয় করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।’
নির্বাচন ও সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির কৌশল কী হতে পারে, সে বিষয়টি টানা আলোচনায় আসছে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বিভিন্ন বৈঠকে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা তো বিরোধিতা করলাম। তারপরও (স্থানীয় সরকার নির্বাচন) করে ফেললে সেটার পরিণতি... দেশের মানুষ দেখবে। দেশের মানুষ ঠিক করবে।’
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে ঝুঁকি আছে, এমনটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা (স্থানীয় সরকার নির্বাচন) আগে করার কোনো অর্থ হয় না এ জন্য যে, অন্তর্বর্তী সরকারের জনগণের ম্যান্ডেট নেই। নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার এসে ওই নির্বাচন সঠিক হয়নি বলে বাতিল করলে সেটা আরও খারাপ হবে। অতীতেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে। কাজেই বিনা কারণে কেন এমন ঝুঁকিতে আমরা যাব?’
বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে চায়, এমনটি স্পষ্টভাবে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার জনগণকে ওয়াদা করেছে যে, ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেবে। ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হলে জনগণকে প্রথমে জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে। জনগণের সরকার পরবর্তী কাজগুলো করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক প্রভাবশালী সদস্য বলেন, ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সংস্কার করে আগে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপি শিগগিরই মাঠে নামবে। এ জন্য ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও রাজধানীসহ সর্বত্র দলকে সক্রিয় করা হচ্ছে। শুরুতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে। প্রয়োজনে পরে কঠোর কর্মসূচিও দেওয়া হতে পারে, এমনটি জানান তাঁরা।
বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি সারা দেশে সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাদের টানার চেষ্টা চলছে।
অন্য এক নেতা বলেন, সরকারের কয়েকটি দপ্তর নতুন নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের নেপথ্যে রয়েছে। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে এসব তৎপরতার ওপর নজর রাখতে বিএনপির হাইকমান্ড ইতিমধ্যে নির্দেশ জারি করেছে।
তবে জাতীয় নাগরিক কমিটির সহমুখপাত্র সালেহ উদ্দীন সিফাত আজকের পত্রিকাকে বলেন, অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে পুরোনো সব রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ভেঙে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়ন। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। সে লক্ষ্যে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কথা বলা হচ্ছে। নতুন সংবিধান প্রণয়ন বা সংস্কার নিশ্চিত করতে হলে গণপরিষদ নির্বাচন লাগবে। নাগরিক কমিটি অন্তর্বর্তী সরকারকে সংবিধান প্রণয়ন করতে বলছে না, এমনটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যরা সংবিধান প্রণয়ন করবেন। এরপর গণপরিষদই আইনসভায় রূপান্তরিত হবে।’
সিফাত বলেন, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে উত্তরণের প্রাথমিক ধাপ হলো স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা জনমানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। সে জন্য আগে স্থানীয় নির্বাচন প্রয়োজন।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে উপদেষ্টার বক্তব্যকে এখনই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে নারাজ বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রভাবশালী সমর্থক দল জামায়াতে ইসলামী। দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরকার যে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চায়, সে বিষয়ে তাঁদের দিক থেকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য এখনো আসেনি। তেমন বক্তব্য এলে জামায়াত তার করণীয় ঠিক করবে।
মিয়া গোলাম পরওয়ার আরও বলেন, এ বিষয়ে অনেকে অনেক কথা বলছে, যা কেবলই ‘ধারণা’। জামায়াত কোনো ‘ধারণা’ নিয়ে কথা বলতে চায় না।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে ৫৩ বছর ধরে স্থানীয় রাজনীতিতে অন্যতম বড় দল আওয়ামী লীগ। নির্বাচন নিয়ে সরকারের ভেতরে-বাইরে নানামুখী আলোচনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দলটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক গতকাল বলেন, ‘আগে তো আমাদের বসতে দিতে হবে। দলকে এক জায়গায় আসতে দিতে হবে। সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক। তারপর আমরা নির্বাচনের কথা ভাবব।’
দলের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল গতকাল বলেন, ‘তারা (সরকার) কোন দিকে পালাবে, সে চিন্তা করুক। নির্বাচনের চিন্তা করার দরকার নেই।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রশ্ন উঠেছে বিদ্যমান সংবিধান নিয়ে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো বলছে, বিদ্যমান সংবিধানের কারণে শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে পেরেছেন। তাই ফ্যাসিস্ট-ব্যবস্থা বিলোপে বিদ্যমান সংবিধানের পুনর্লিখন, সংশোধন প্রয়োজন। তবে নতুন সংবিধান কীভাবে প্রণয়ন করা
১৫ ঘণ্টা আগেঅন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে ভ্যাট আরোপ, টিসিবির ট্রাকসেল বন্ধ ও ৪৩ লাখ পরিবার কার্ড বাতিল করার ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। গতকাল শুক্রবার দলটি বলেছে, ‘স্বৈরাচারী সরকারের মতো জনগণের পকেট কাটার নীতি নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।’
১৯ ঘণ্টা আগেকেউ যদি এটা নিয়ে মনগড়া কথা বলে, এটা তাদের সমস্যা। এখানে মাইনাস টুর কথা যারা বলে, এটা তাদের আশা। এই আশা জীবনে পূরণ হবে না...
১ দিন আগেস্বৈরাচারের সহযোগীদের কোনো রাজনৈতিক দলে প্রবেশ করানো হলে, সেই দলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন।
১ দিন আগে