মৃগীরোগীর নাকে চামড়ার জুতা ধরলে খিঁচুনি সারে—বিশ্বাস নাকি বিজ্ঞান

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৪, ২১: ১৩
আপডেট : ১৯ মে ২০২৪, ১৬: ৩১

হুট করে কারও খিঁচুনি শুরু হলে চামড়ার জুতা বা চামড়াজাত জিনিস নাকে ধরার পরামর্শ দেন অনেকে। বলা হয়, চামড়াজাত জিনিসের ঘ্রাণে মৃগীরোগীর খিঁচুনি বন্ধ হয়। আবার কখনো কখনো এ ধরনের রোগীর মুখে কাঠি, কলম বা চামচ ইত্যাদি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যাতে রোগী জিহ্বা কামড়ে না ধরে। আবার বিশ্বের কোথাও কোথাও এই চর্চা করা হয় এই বিশ্বাস থেকে যে মৃগীরোগী নিজের জিহ্বা গিলে ফেলতে পারে!

চামড়ার জুতা শুকলে মৃগীরোগীর আসলেই কোনো উপকার হয়?
মৃগীরোগীর খিঁচুনি প্রশমনে চামড়ার জুতার ঘ্রাণ শুকতে দেওয়ার ধারণাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ২০১৮ সালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মৃগীরোগের ব্যাপারে সচেতনতা নিয়ে দেশটির ৪২টি স্কুলের প্রায় ৪০০ শিক্ষকের ওপর ৮ মাসের একটি জরিপ চালানো হয়। এই জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪০ শতাংশ শিক্ষক বিশ্বাস করেন, মৃগীরোগের প্রাথমিক চিকিৎসা হলো চামড়ার জুতা বা পেঁয়াজের ঘ্রাণ নেওয়া। 

বাংলাদেশে এমন কোনো জরিপ পাওয়া না গেলেও মানুষের মধ্যে যে এ ধারণা বিদ্যমান সেটির প্রমাণ পাওয়া যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। ‘RK SagaCity’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে ২০২১ সালে মৃগীরোগীকে চামড়ার জুতার ঘ্রাণ নিতে দেওয়ার একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। যেখানে দেখা যায়, রাস্তায় এক ব্যক্তির খিঁচুনি উঠেছে। ব্যক্তিটি রাস্তায় পড়ে আছেন। আশপাশের মানুষজন তাঁর নাকে জুতা, চামড়ার বেল্ট ধরার চেষ্টা করছেন। 

কেবল সাধারণ মানুষ নন, জনপ্রিয় বলিউড সিনেমা ‘দঙ্গল’-এর তারকা ফাতেমা সানা শেখকেও খিঁচুনি উপশমে চামড়ার জুতার ঘ্রাণ নিতে দেওয়া হয়েছিল। ভক্তদের সঙ্গে ইনস্টাগ্রামে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে ২০২২ সালে এমনটাই জানিয়েছিলেন তিনি। 

মৃগী রোগের চিকিৎসায় জুতার ঘ্রাণ ব্যবহার অবৈজ্ঞানিক। ছবি: নিউরো সায়েন্স ফর কিডস মৃগীরোগীকে জুতা বা চামড়াজাত পণ্যের ঘ্রাণ নিতে দেওয়ার পরামর্শটির সত্যতা যাচাইয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর নিউরোটেকনোলজির নির্বাহী পরিচালক স্নায়ুবিজ্ঞানী এরিক চুডলারের একটি ব্লগ খুঁজে পাওয়া যায়। 

ব্লগটিতে তিনি লেখেন, খিঁচুনির সময় মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি হয়। এ কারণে মৃগীরোগকে কখনো কখনো ‘বৈদ্যুতিক ব্রেন স্টর্ম’ বলা হয়। খিঁচুনি চলাকালীন মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিন্তা, নড়াচড়া, দেখা ও শোনার মতো কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এই খিঁচুনির তীব্রতা প্রতিরোধ বা কমানোর জন্য বিভিন্ন উপায় চেষ্টা করেছে। মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের খিঁচুনি উপশমে বর্তমানে অনেক কার্যকর ওষুধ পাওয়া যায়। 

ব্লগটিতে মৃগীরোগের চিকিৎসায় জুতার ঘ্রাণ নিতে দেওয়ার পরামর্শটির বর্ণনাও পাওয়া যায়। হারিন্দার জাসেজা নামে ভারতীয় চিকিৎসকের একটি নিবন্ধের বরাত দিয়ে এরিক চুডলার জানান, ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মৃগীরোগের প্রাথমিক চিকিৎসায় জুতার ঘ্রাণ শুকতে দেওয়া হয়। পদ্ধতিটি অবৈজ্ঞানিক এবং উদ্ভট। সর্বোপরি, মৃগীরোগের চিকিৎসায় জুতার গন্ধের কার্যকারিতা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। 

যদিও হারিন্দার জাসেজা দাবি করেছেন, মৃগীরোগের চিকিৎসায় এটি কাজ করে থাকতে পারে। তাঁর মতে, এটি একধরনের অ্যারোমাথেরাপি। অ্যারোমাথেরাপি হচ্ছে রোগের চিকিৎসায় ঘ্রাণের ব্যবহার। যদিও কিছু কিছু গন্ধ খিঁচুনি শুরু করতে পারে, তবে আধুনিক গবেষণা প্রমাণ করেছে, কিছু তীব্র গন্ধ খিঁচুনির তীব্রতা কমিয়ে দিতে পারে। এটা হতে পারে যে, তীব্র ঘ্রাণ খিঁচুনির সময় নিউরনের অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক উদ্দীপনায় ব্যাঘাত ঘটায়। 

মৃগীরোগকে একসময় মনে করা হতো ‘দুষ্টু আত্মা’র প্রভাব। ছবি: ভারতীয় চিকিৎসক হারিন্দার জাসেজার নিবন্ধনেদারল্যান্ডস থেকে প্রকাশিত জার্নাল এলসেভিয়ারে ২০০৮ সালে প্রকাশিত হারিন্দার জাসেজার এ-সংক্রান্ত একটি গবেষণা নিবন্ধ পাওয়া যায়। হারিন্দার জাসেজা ভারতের মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রে অবস্থিত জি আর মেডিকেল কলেজের শারীরবিদ্যা বিভাগের চিকিৎসক। তিনি গবেষণা নিবন্ধটিতে এশিয়ার দেশগুলোতে মৃগীরোগের খিঁচুনি প্রশমনে জুতার ঘ্রাণ শুকতে দেওয়ার প্রচলিত পদ্ধতিটির পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। যদিও গবেষণাটির শেষে হারিন্দার জাসেজা বলেন, তীব্র ঘ্রাণ খিঁচুনি প্রতিরোধ করতে পারে। তবে এ জন্য আরও অনেক বেশি গবেষণা প্রয়োজন। আর এ গবেষণা মৃগীরোগের খিঁচুনি প্রশমনে জুতার ঘ্রাণ ব্যবহার করার পরামর্শ দেয় না।

ধারণাটির উৎপত্তি সম্পর্কে হারিন্দার জাসেজা আরেকটি নিবন্ধে লেখেন, একসময় মৃগীরোগকে দেখা হয়েছে ‘দুষ্টু’ আত্মার আছর হিসেবে। তাই মৃগীরোগের প্রাথমিক চিকিৎসায় জুতার ঘ্রাণ প্রয়োগের ধারণা এই বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত যে জুতার বাজে গন্ধ এই ‘দুষ্টু’ আত্মাদের প্রতিহত করতে পারে। ব্যাপারটি কাটা দিয়ে কাটা তোলার মতো।

মৃগীরোগ নিয়ন্ত্রণে দুই যুগের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন ভারতের শীর্ষস্থানীয় স্নায়ু বিশেষজ্ঞ নির্মল সূর্য। মৃগীরোগের চিকিৎসায় জুতার ঘ্রাণ নিতে দেওয়ার পরামর্শটির ব্যাপারে তিনি বলেন, খিঁচুনির সময় রোগীর নাকে পেঁয়াজ বা জুতা ধরার পরামর্শটির কোনো ভিত্তি নেই। আবার অনেক সময় মৃগীরোগীর হাতে ধাতব বস্তু ধরিয়ে দেওয়া হয়। এগুলো অযৌক্তিক সংস্কার, এগুলো রোগীর চিকিৎসায় কোনো কাজে আসে না। 

মৃগীরোগীর মুখে কাঠি, কলম বা চামচ ইত্যাদি ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এটিও রোগীর কোনো উপকার করে না। বরং এভাবে রোগীর অন্যান্য সমস্যা যেমন, দাঁত, মাড়ির ক্ষতি হতে পারে। যদি মৃগীরোগীর মুখ খোলা থাকে, তাহলে সেখানে প্রয়োজনে নরম বস্তু, যেমন, রুমাল রাখা যেতে পারে। 

একই বিষয়ে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগের সঙ্গে কথা হয় খিঁচুনি বা মৃগীরোগের চিকিৎসায় কাজ করা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের স্নায়ুবিশেষজ্ঞ শাখওয়াত এমরানের সঙ্গে। খিঁচুনি রোগের চিকিৎসায় জুতার ব্যবহার নিয়ে তিনি বলেন, এটার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। আসলে মৃগীরোগীর যখন খিঁচুনি হয়, তখন জিহ্বায় কামড় পড়ে রোগীর জিহ্বা কেটে যেতে পারে। এটি প্রতিরোধে মুখের ভেতর চামচ, জুতা এগুলো ঢুকিয়ে দেয়। এটিই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আসতে আসতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মৃগীরোগীকে জুতা শুকতে দিলে রোগী ভালো হয়ে যায়।

এই চিকিৎসক বলেন, মৃগীরোগীর খিঁচুনি সাধারণত ৩০ সেকেন্ড থেকে এক মিনিট স্থায়ী হয়। এরপর রোগী বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায়। এ সময়ের মধ্যে কেউ রোগীর নাকে জুতা ধরলে মনে হতে পারে, জুতা দেওয়ার কারণেই তিনি সুস্থ হয়েছেন!

মৃগীরোগের প্রাথমিক চিকিৎসা কী
খিঁচুনি রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা সেন্টারস ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের খিঁচুনি আছে। তবে অধিকাংশ খিঁচুনি কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়। যেকোনো খিঁচুনিতে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে সাধারণত যে বিষয়গুলো অনুসরণ করতে হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছে: 

* খিঁচুনি শেষ না হওয়া এবং জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত রোগীর পাশে থাকা।
* চোখে চশমা থাকলে সরিয়ে ফেলা।
* মাথার নিচে নরম কিছু দেওয়া।
* রোগীর মুখে কিছু না রাখা। 
* রোগী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত খাবার, পানি না দেওয়া।
* রোগীকে চেপে না ধরা বা তার নড়াচড়া বন্ধ করার চেষ্টা না করা।
* খিঁচুনি শেষ হলে রোগীকে বসতে সাহায্য করা এবং স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা।
* খিঁচুনি ৫ মিনিটের বেশি স্থায়ী হলে জরুরি চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত