সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
দেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি যে মোটেই ভালো নয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটাও অবশ্য সত্য যে অবস্থা কখনোই ভালো ছিল না। তবে এখনকার পরিস্থিতি বিশেষভাবে মন্দ মনে হচ্ছে কয়েকটি অতিরিক্ত কারণে। মানুষ আশা করেছে দেশের সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন হবে। কেবল আশা করেনি, পরিবর্তনের জন্য শ্রম দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, অংশ নিয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকার পরিবর্তনের সংগ্রামে। মানুষ এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক ক্ষুব্ধ, যে জন্য বর্তমানের অনিশ্চয়তা তাদের কাছে বিশেষভাবে অসহ্য ঠেকছে। সমাজে নির্লজ্জতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে, স্বৈরাচারী সরকারের বেহায়াপনা ও নির্লজ্জতা জাতি সহ্য করেছে। ক্ষমতার দম্ভ এবং মানুষের দুরবস্থা নিয়ে কৌতুক করার হীন রসিকতা হয়তো উপভোগও করেছে। বোঝা যাচ্ছে যে বেহায়াপনাকে ধিক্কার দেওয়ার, ধমক দেওয়ার শক্তি সমাজে এখন নেই। এও এক করুণ নিম্নগমন বটে। সমাজের সর্বত্র নৃশংসতা ভয়ংকরভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। হত্যাকাণ্ড আগেও ঘটত, কিন্তু প্রতিহিংসা চরিতার্থে সহিংসতার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটেছে। এটি ভেতরের মানসিকতারই বাইরের প্রকাশ।
মানুষ সমাজে বাস করে, সেখানে আজ কোনো নিরাপত্তা নেই। না আছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, না দৈহিক। রাষ্ট্র তার কর্তব্য পালন করতে পারছে না। উপরন্তু সে নিজেই একটি নিষ্ক্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তার পুলিশ, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ মানুষের নিরাপত্তা দিতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। মানুষের জন্য ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে রাষ্ট্রের ঔদাসীন্যে, আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায়। এদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি এগোচ্ছে অরাজকতার দিকে। সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক নৈরাশ্য। এই অরাজক পরিস্থিতির অভ্যন্তরে সমাজে যা ঘটছে তা হলো বিশেষ শ্রেণিকর্তৃত্বের আধিপত্য বৃদ্ধি। এই বিশেষ শ্রেণিকে আগে আমরা মধ্যবিত্ত বলতাম, এখন তাকে বলবান ক্ষমতাশালী বলাই সংগত; কেননা মধ্যবিত্ত এখন আর অবিচ্ছিন্ন নেই, তার একাংশ নেমে গেছে নিচে, অন্য অংশ উঠেছে উঁচুতে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের নিকট গ্রহণযোগ্যরাই এখন দেশের সর্বময় কর্তা। এরাই দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন, শিল্প-সংস্কৃতিও চলে গেছে এঁদেরই নিয়ন্ত্রণে; যদিও এঁদের সংখ্যা জনগণের তুলনায় ৫ শতাংশের বেশি হবে না। এই শ্রেণির মধ্যে দেশপ্রেম নেই, এর সদস্যরা গণতন্ত্রেও বিশ্বাস করেন না। রাষ্ট্রের উত্থান-পতন, সরকারের রদবদল—সবকিছুর ভেতরে অব্যর্থ রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের তোষণকারীদের শক্তি সঞ্চয়।
রাজনৈতিক নেতৃত্বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী। বলাই বাহুল্য, বুর্জোয়া এবং চরম ডানপন্থী নেতৃত্বও বিত্তবানদের দ্বারাই গঠিত। তাঁরাই বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে ও পোশাকে রাজনীতি করেন। তাঁদের ভেতর কলহ আছে, সংঘর্ষ প্রায়ই বাধে, যেমনটা ঘটে থাকে পারিবারিক সম্পত্তির দখল নিয়ে ভাইদের মধ্যে। রাজনীতি এখন লুণ্ঠনের লোভে মত্ত বিত্তবানদের অন্তর্কলহ ভিন্ন অন্য কিছু নয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দক্ষতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্বল। কারণ, একদিক দিয়ে ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার নিয়ে প্রশ্ন আছে, অন্যদিক দিয়ে এই নেতৃত্ব একেবারেই অদক্ষ। নেতৃত্ব মোটেই সমাজসচেতন নয়, তবে পুরোপুরি আত্মসচেতন, মুনাফালোভী, ভোগলিপ্সু ও আত্মমর্যাদাহীন বটে। বুর্জোয়া শ্রেণি সরকারে আসা-যাওয়া করে সেটা অন্য কোনো যোগ্যতার কারণে নয়, নিছক বিত্ত ও ক্ষমতার বলে। দেশে এখন সরকারের দৃশ্যমানতা তেমন নেই। এই পরিস্থিতিতে আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যাদের ভেতর রয়েছে দেশপ্রেম ও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, তারা কী করতে পারি? স্বভাবতই প্রথম কাজ শত্রু কে সেটা নিরূপণ করা। শত্রু হচ্ছে সেই আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, যা বিত্তবানদের নির্মম ও অরাজক শাসনকে স্থায়ী করার তালে আছে। সংগত কারণেই শত্রু তারাও, এই ব্যবস্থার যারা রক্ষক ও বিশেষ সুবিধাভোগী।
দ্বিতীয় করণীয় এই বৈরী ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য সংঘবদ্ধ আন্দোলন করা। আন্দোলন যে নেই তা নয়। আছে। প্রয়োজন তাকে বেগবান, গভীর ও ব্যাপক করা। সরকার বদলে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি, হবে না, হচ্ছে না। সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আনা দরকার হবে, যে-পরিবর্তনটা আসেনি। আমাদের সমাজ পুরোনো ও জীর্ণ, কিন্তু সে আগের মতোই নিপীড়নকারী ও বৈষম্যমূলক। রাষ্ট্র এই সমাজকে পাহারা দেয় এবং সাধারণ মানুষকে নিপীড়ন করে।
ক্ষমতা বদলেছে আবার বদলায়ওনি, কেননা ক্ষমতা সেই আগের মতোই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে। মানুষের অভ্যুত্থান ঘটেছে, মুক্তির লক্ষ্যে; কিন্তু সমাজ রয়ে গেছে ঔপনিবেশিক আমলে যে রূপ নিয়ে গড়ে উঠেছিল সেই রকমই। সাম্রাজ্যবাদ আগেও ছিল, এখনো তারাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা; এবং আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার সাম্রাজ্যবাদের হুকুমবরদার ও তল্পিবাহক বটে।
সমাজ-পরিবর্তনের আন্দোলনকে অবশ্যই রাজনৈতিক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রশ্ন বেশ জরুরি। এক, আন্দোলন কি দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে এগোতে পারবে? মোটেই না, কেননা তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। আমাদের বিত্তবানরা সমাজের জন্য কেবল যে বোঝা তা নয়, তাঁরা দেশবাসীর শত্রুও বটে। আন্দোলন তো আসলে এঁদের বিরুদ্ধেও; সেখানে তাই মৈত্রীর প্রশ্ন অবান্তর। আন্দোলন পাশাপাশি চলতে পারে, সেটা ভিন্ন ব্যাপার; দুই, রাষ্ট্রীয় সাধারণ নির্বাচনে সমাজ-পরিবর্তনবাদী মানুষের ভূমিকা কী হবে। তারা ভোট দেবে, দুটি খারাপের মধ্যে যেটিকে কম খারাপ মনে করবে তাকে সমর্থন করবে; কিন্তু নিজেরা নির্বাচনে প্রার্থী হবে কি? না, আপাতত নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে নির্বাচন তখনই তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে, যখন পেছনে তার আন্দোলন ছিল, যেমন ১৯৪৬, ১৯৫৪ ও ১৯৭০-এ; কিন্তু এমনকি সেই সব তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচনে জয়লাভ করেও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে যে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা গেছে তা নয়। তার কারণ, নির্বাচনী বিজয়কেই চূড়ান্ত মনে করা হয়েছে, এবং তার ডামাডোলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে বেগবান কোনো আন্দোলন নেই, সমাজ-পরিবর্তনকামীদের পক্ষে এখন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া করুণ ও হাস্যকর ফল নিয়ে আসবে, যেমনটা বিগত একাধিক নির্বাচনে ঘটেছে। তিন, তথাকথিত সুশীল বা নাগরিক সমাজের ভূমিকা কতটা কার্যকর হবে? স্পষ্ট করেই বলা যায় যে মোটেই কার্যকর হবে না। সুশীল সমাজ হচ্ছে ভদ্রলোকদের সমাবেশ, এবং পুঁজিবাদী বিশ্ব কর্তৃক উচ্চমূল্যায়িত তথাকথিত আন্তর্জাতিক সমাজের মতোই তা ভুয়া। এরা বিত্তবান শ্রেণিরই অংশ, এবং বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে সংস্কারের মধ্য দিয়ে টিকিয়ে রাখাটাই এদের অভিপ্রায়। সংস্কার মূল্যহীন নয়, কিন্তু সংস্কার আর সমাজের মৌলিক পরিবর্তন তো এক জিনিস হতে পারে না। সুশীল সমাজ মৌলিক পরিবর্তন চায় না, চাইতে পারেও না, কেননা ওই ঘটনা ঘটলে তাদের প্রতিষ্ঠিত স্বার্থ বিপন্ন হবে। তদুপরি দেশের ভদ্রলোক সমাজের কর্তাব্যক্তিরা যেভাবে শাসকশ্রেণির সঙ্গে যুক্ত, তাতেই বিলক্ষণ বোঝা যায় যে তাঁদের তৎপরতা কোন লক্ষ্যে নিয়োজিত।
আন্দোলনটি হবে সমগ্র জনগণের। তার অগ্রবাহিনী হিসেবে কাজ করবেন সচেতন মানুষ, যাঁরা দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক, যাঁরা বিশ্বাস করেন আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করতে হবে, যে-গণতান্ত্রিকতার প্রধান শর্ত হচ্ছে নাগরিকদের ভেতর অধিকার ও সুযোগের বৈষম্য দূর করা। এদের একাংশ নিজেরা বিত্তবান শ্রেণির মানুষ হতে পারে, তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু এদেরকে অবশ্যই যেতে হবে শ্রেণিস্বার্থের সংকীর্ণ ও নোংরা সীমানা পার হয়ে সমষ্টিগত স্বার্থের এলাকাতে। স্থির থাকবে লক্ষ্য, প্রচার করতে হবে বক্তব্য, সচেতন করতে হবে মানুষকে এবং সংগঠিত হতে হবে অঙ্গীকার নিয়ে। কাজ চলবে স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে, প্রতিটি পেশাতে, প্রতিষ্ঠানে এমনকি পরিবারের ভেতরও। কাজটি হবে একই সঙ্গে অন্যায় প্রতিরোধের ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার। আর এসব যে আমরা করব তা কোনো আধ্যাত্মিক সুখ বা নান্দনিক তৃপ্তি লাভের আশায় নয়, নিছক বাঁচার প্রয়োজনে।
অবস্থা এমন যে মনে হয় আমাদের কোনো আশা নেই, কেননা যা চোখে পড়ে তা হলো সমাজে আজ সবাই সবার শত্রু, পারস্পরিক মৈত্রীর সব সম্ভাবনাই বুঝি-বা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। প্রকৃত সত্য কিন্তু ভিন্ন রকমের। সমাজের অধিকাংশ মানুষই দেশপ্রেমিক এবং সেখানে গণতান্ত্রিক চেতনার যে মহা দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে তাও নয়। তারা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, ভবিষ্যতে যে ঘটাতে পারবে না তা মনে করার কারণ নেই। কিন্তু এই মানুষেরা বিচ্ছিন্ন ও বিপন্ন, তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না, তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে দেওয়া হচ্ছে না এবং তাদের ভেতরকার ঐক্যের অভাবই শত্রুপক্ষের প্রধান ভরসা।
সাহিত্যে যেমন জীবনেও তেমনি, মন্দই চোখে পড়ে সহজে, সে-ই দৌরাত্ম্য করে, কিন্তু সব মন্দই নৈতিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল; নির্লজ্জ ও নৃশংস বলে তাকে পরাস্ত করা কঠিন অবশ্যই, কিন্তু মোটেই অসম্ভব নয়। মানুষের সংস্কৃতির যে অগ্রগতি তা ওই মন্দকে পরাভূত করেই ঘটেছে; আমাদের দেশেও তেমনটাই ঘটবে।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি যে মোটেই ভালো নয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটাও অবশ্য সত্য যে অবস্থা কখনোই ভালো ছিল না। তবে এখনকার পরিস্থিতি বিশেষভাবে মন্দ মনে হচ্ছে কয়েকটি অতিরিক্ত কারণে। মানুষ আশা করেছে দেশের সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন হবে। কেবল আশা করেনি, পরিবর্তনের জন্য শ্রম দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, অংশ নিয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকার পরিবর্তনের সংগ্রামে। মানুষ এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক ক্ষুব্ধ, যে জন্য বর্তমানের অনিশ্চয়তা তাদের কাছে বিশেষভাবে অসহ্য ঠেকছে। সমাজে নির্লজ্জতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে, স্বৈরাচারী সরকারের বেহায়াপনা ও নির্লজ্জতা জাতি সহ্য করেছে। ক্ষমতার দম্ভ এবং মানুষের দুরবস্থা নিয়ে কৌতুক করার হীন রসিকতা হয়তো উপভোগও করেছে। বোঝা যাচ্ছে যে বেহায়াপনাকে ধিক্কার দেওয়ার, ধমক দেওয়ার শক্তি সমাজে এখন নেই। এও এক করুণ নিম্নগমন বটে। সমাজের সর্বত্র নৃশংসতা ভয়ংকরভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। হত্যাকাণ্ড আগেও ঘটত, কিন্তু প্রতিহিংসা চরিতার্থে সহিংসতার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটেছে। এটি ভেতরের মানসিকতারই বাইরের প্রকাশ।
মানুষ সমাজে বাস করে, সেখানে আজ কোনো নিরাপত্তা নেই। না আছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, না দৈহিক। রাষ্ট্র তার কর্তব্য পালন করতে পারছে না। উপরন্তু সে নিজেই একটি নিষ্ক্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তার পুলিশ, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ মানুষের নিরাপত্তা দিতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। মানুষের জন্য ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে রাষ্ট্রের ঔদাসীন্যে, আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায়। এদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি এগোচ্ছে অরাজকতার দিকে। সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক নৈরাশ্য। এই অরাজক পরিস্থিতির অভ্যন্তরে সমাজে যা ঘটছে তা হলো বিশেষ শ্রেণিকর্তৃত্বের আধিপত্য বৃদ্ধি। এই বিশেষ শ্রেণিকে আগে আমরা মধ্যবিত্ত বলতাম, এখন তাকে বলবান ক্ষমতাশালী বলাই সংগত; কেননা মধ্যবিত্ত এখন আর অবিচ্ছিন্ন নেই, তার একাংশ নেমে গেছে নিচে, অন্য অংশ উঠেছে উঁচুতে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের নিকট গ্রহণযোগ্যরাই এখন দেশের সর্বময় কর্তা। এরাই দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন, শিল্প-সংস্কৃতিও চলে গেছে এঁদেরই নিয়ন্ত্রণে; যদিও এঁদের সংখ্যা জনগণের তুলনায় ৫ শতাংশের বেশি হবে না। এই শ্রেণির মধ্যে দেশপ্রেম নেই, এর সদস্যরা গণতন্ত্রেও বিশ্বাস করেন না। রাষ্ট্রের উত্থান-পতন, সরকারের রদবদল—সবকিছুর ভেতরে অব্যর্থ রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের তোষণকারীদের শক্তি সঞ্চয়।
রাজনৈতিক নেতৃত্বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী। বলাই বাহুল্য, বুর্জোয়া এবং চরম ডানপন্থী নেতৃত্বও বিত্তবানদের দ্বারাই গঠিত। তাঁরাই বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে ও পোশাকে রাজনীতি করেন। তাঁদের ভেতর কলহ আছে, সংঘর্ষ প্রায়ই বাধে, যেমনটা ঘটে থাকে পারিবারিক সম্পত্তির দখল নিয়ে ভাইদের মধ্যে। রাজনীতি এখন লুণ্ঠনের লোভে মত্ত বিত্তবানদের অন্তর্কলহ ভিন্ন অন্য কিছু নয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দক্ষতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্বল। কারণ, একদিক দিয়ে ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার নিয়ে প্রশ্ন আছে, অন্যদিক দিয়ে এই নেতৃত্ব একেবারেই অদক্ষ। নেতৃত্ব মোটেই সমাজসচেতন নয়, তবে পুরোপুরি আত্মসচেতন, মুনাফালোভী, ভোগলিপ্সু ও আত্মমর্যাদাহীন বটে। বুর্জোয়া শ্রেণি সরকারে আসা-যাওয়া করে সেটা অন্য কোনো যোগ্যতার কারণে নয়, নিছক বিত্ত ও ক্ষমতার বলে। দেশে এখন সরকারের দৃশ্যমানতা তেমন নেই। এই পরিস্থিতিতে আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যাদের ভেতর রয়েছে দেশপ্রেম ও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, তারা কী করতে পারি? স্বভাবতই প্রথম কাজ শত্রু কে সেটা নিরূপণ করা। শত্রু হচ্ছে সেই আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, যা বিত্তবানদের নির্মম ও অরাজক শাসনকে স্থায়ী করার তালে আছে। সংগত কারণেই শত্রু তারাও, এই ব্যবস্থার যারা রক্ষক ও বিশেষ সুবিধাভোগী।
দ্বিতীয় করণীয় এই বৈরী ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য সংঘবদ্ধ আন্দোলন করা। আন্দোলন যে নেই তা নয়। আছে। প্রয়োজন তাকে বেগবান, গভীর ও ব্যাপক করা। সরকার বদলে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি, হবে না, হচ্ছে না। সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আনা দরকার হবে, যে-পরিবর্তনটা আসেনি। আমাদের সমাজ পুরোনো ও জীর্ণ, কিন্তু সে আগের মতোই নিপীড়নকারী ও বৈষম্যমূলক। রাষ্ট্র এই সমাজকে পাহারা দেয় এবং সাধারণ মানুষকে নিপীড়ন করে।
ক্ষমতা বদলেছে আবার বদলায়ওনি, কেননা ক্ষমতা সেই আগের মতোই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে। মানুষের অভ্যুত্থান ঘটেছে, মুক্তির লক্ষ্যে; কিন্তু সমাজ রয়ে গেছে ঔপনিবেশিক আমলে যে রূপ নিয়ে গড়ে উঠেছিল সেই রকমই। সাম্রাজ্যবাদ আগেও ছিল, এখনো তারাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা; এবং আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার সাম্রাজ্যবাদের হুকুমবরদার ও তল্পিবাহক বটে।
সমাজ-পরিবর্তনের আন্দোলনকে অবশ্যই রাজনৈতিক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রশ্ন বেশ জরুরি। এক, আন্দোলন কি দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে এগোতে পারবে? মোটেই না, কেননা তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। আমাদের বিত্তবানরা সমাজের জন্য কেবল যে বোঝা তা নয়, তাঁরা দেশবাসীর শত্রুও বটে। আন্দোলন তো আসলে এঁদের বিরুদ্ধেও; সেখানে তাই মৈত্রীর প্রশ্ন অবান্তর। আন্দোলন পাশাপাশি চলতে পারে, সেটা ভিন্ন ব্যাপার; দুই, রাষ্ট্রীয় সাধারণ নির্বাচনে সমাজ-পরিবর্তনবাদী মানুষের ভূমিকা কী হবে। তারা ভোট দেবে, দুটি খারাপের মধ্যে যেটিকে কম খারাপ মনে করবে তাকে সমর্থন করবে; কিন্তু নিজেরা নির্বাচনে প্রার্থী হবে কি? না, আপাতত নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে নির্বাচন তখনই তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে, যখন পেছনে তার আন্দোলন ছিল, যেমন ১৯৪৬, ১৯৫৪ ও ১৯৭০-এ; কিন্তু এমনকি সেই সব তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচনে জয়লাভ করেও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে যে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা গেছে তা নয়। তার কারণ, নির্বাচনী বিজয়কেই চূড়ান্ত মনে করা হয়েছে, এবং তার ডামাডোলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে বেগবান কোনো আন্দোলন নেই, সমাজ-পরিবর্তনকামীদের পক্ষে এখন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া করুণ ও হাস্যকর ফল নিয়ে আসবে, যেমনটা বিগত একাধিক নির্বাচনে ঘটেছে। তিন, তথাকথিত সুশীল বা নাগরিক সমাজের ভূমিকা কতটা কার্যকর হবে? স্পষ্ট করেই বলা যায় যে মোটেই কার্যকর হবে না। সুশীল সমাজ হচ্ছে ভদ্রলোকদের সমাবেশ, এবং পুঁজিবাদী বিশ্ব কর্তৃক উচ্চমূল্যায়িত তথাকথিত আন্তর্জাতিক সমাজের মতোই তা ভুয়া। এরা বিত্তবান শ্রেণিরই অংশ, এবং বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে সংস্কারের মধ্য দিয়ে টিকিয়ে রাখাটাই এদের অভিপ্রায়। সংস্কার মূল্যহীন নয়, কিন্তু সংস্কার আর সমাজের মৌলিক পরিবর্তন তো এক জিনিস হতে পারে না। সুশীল সমাজ মৌলিক পরিবর্তন চায় না, চাইতে পারেও না, কেননা ওই ঘটনা ঘটলে তাদের প্রতিষ্ঠিত স্বার্থ বিপন্ন হবে। তদুপরি দেশের ভদ্রলোক সমাজের কর্তাব্যক্তিরা যেভাবে শাসকশ্রেণির সঙ্গে যুক্ত, তাতেই বিলক্ষণ বোঝা যায় যে তাঁদের তৎপরতা কোন লক্ষ্যে নিয়োজিত।
আন্দোলনটি হবে সমগ্র জনগণের। তার অগ্রবাহিনী হিসেবে কাজ করবেন সচেতন মানুষ, যাঁরা দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক, যাঁরা বিশ্বাস করেন আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করতে হবে, যে-গণতান্ত্রিকতার প্রধান শর্ত হচ্ছে নাগরিকদের ভেতর অধিকার ও সুযোগের বৈষম্য দূর করা। এদের একাংশ নিজেরা বিত্তবান শ্রেণির মানুষ হতে পারে, তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু এদেরকে অবশ্যই যেতে হবে শ্রেণিস্বার্থের সংকীর্ণ ও নোংরা সীমানা পার হয়ে সমষ্টিগত স্বার্থের এলাকাতে। স্থির থাকবে লক্ষ্য, প্রচার করতে হবে বক্তব্য, সচেতন করতে হবে মানুষকে এবং সংগঠিত হতে হবে অঙ্গীকার নিয়ে। কাজ চলবে স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে, প্রতিটি পেশাতে, প্রতিষ্ঠানে এমনকি পরিবারের ভেতরও। কাজটি হবে একই সঙ্গে অন্যায় প্রতিরোধের ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার। আর এসব যে আমরা করব তা কোনো আধ্যাত্মিক সুখ বা নান্দনিক তৃপ্তি লাভের আশায় নয়, নিছক বাঁচার প্রয়োজনে।
অবস্থা এমন যে মনে হয় আমাদের কোনো আশা নেই, কেননা যা চোখে পড়ে তা হলো সমাজে আজ সবাই সবার শত্রু, পারস্পরিক মৈত্রীর সব সম্ভাবনাই বুঝি-বা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। প্রকৃত সত্য কিন্তু ভিন্ন রকমের। সমাজের অধিকাংশ মানুষই দেশপ্রেমিক এবং সেখানে গণতান্ত্রিক চেতনার যে মহা দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে তাও নয়। তারা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, ভবিষ্যতে যে ঘটাতে পারবে না তা মনে করার কারণ নেই। কিন্তু এই মানুষেরা বিচ্ছিন্ন ও বিপন্ন, তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না, তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে দেওয়া হচ্ছে না এবং তাদের ভেতরকার ঐক্যের অভাবই শত্রুপক্ষের প্রধান ভরসা।
সাহিত্যে যেমন জীবনেও তেমনি, মন্দই চোখে পড়ে সহজে, সে-ই দৌরাত্ম্য করে, কিন্তু সব মন্দই নৈতিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল; নির্লজ্জ ও নৃশংস বলে তাকে পরাস্ত করা কঠিন অবশ্যই, কিন্তু মোটেই অসম্ভব নয়। মানুষের সংস্কৃতির যে অগ্রগতি তা ওই মন্দকে পরাভূত করেই ঘটেছে; আমাদের দেশেও তেমনটাই ঘটবে।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১৯ ঘণ্টা আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে