এম এম আকাশ
বাংলাদেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে মতভেদ চলছে। এই মতভেদকে সাধারণত দুইভাবে দেখা হয়। কেউ কেউ একে আদর্শগত দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখেন, আবার কেউ কেউ একে ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতা রক্ষার বিরোধ হিসেবে দেখেন। দুইভাবেই দেখা যেতে পারে। দুটির মধ্যেই আংশিক সত্য রয়েছে। কোন অংশটা প্রধান তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে এবং ঐতিহাসিক কারণে তা অস্বাভাবিক নয়। পঁচাত্তরের আগে-পরে আওয়ামী লীগের আদর্শ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মাত্রা অবশ্যই এক রকম নয়। আবার জিয়া-উত্তর খালেদা-তারেকের নেতৃত্বাধীন বিএনপি এবং অতীতের জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিও এক রকম নয়।
সুতরাং গতির মধ্যেই দল দুটির বিচার করা উচিত। তবে তারপরও আমরা বর্তমান মুহূর্তে এসে দেখব যে তাদের পার্থক্যগুলো ক্রমেই কমে এসেছে, কমতে কমতে তা এখন অধিকাংশ মানুষের চোখে ক্ষমতা রক্ষা ও ক্ষমতা দখলের পার্থক্যে পর্যবসিত হয়েছে। যদিও কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে বা বিশেষ প্রশ্নে মন্দের ভালো কে, তা নিয়ে চুলচেরা অনেক বিতর্ক থাকতে পারে।
আদর্শ হিসেবে আওয়ামী লীগের ইতিহাস বিএনপির ইতিহাসের থেকে আলাদা। আওয়ামী লীগ দীর্ঘকালের পুরোনো দল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে দলটি নেতৃত্ব দিয়েছে, যদিও তখনো আওয়ামী লীগে কনফেডারেশন ও আমেরিকাপন্থী একটি শক্তি উপস্থিত ছিল। অন্যদিকে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পরে সামরিক চ্যানেলের মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছে এবং তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আদর্শ হিসেবে ধারণ করে। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ বলতে আসলে কোন জাতীয়তাবাদকে বোঝানো হচ্ছে, তা অস্পষ্ট।
‘বংগ’ নামে একটি বৃহৎ এলাকা আদিকাল থেকেই বিভিন্ন ভাষা, বিভিন্ন সংস্কৃতি ও নানা ঐতিহ্যসম্পন্ন নৃগোষ্ঠী-অধ্যুষিত অঞ্চল। এই অঞ্চল ১৯৭১ সালে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর এর নাগরিকেরা তাঁদের পাসপোর্টে নিজেদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছেন। সুতরাং ‘বাংলাদেশি’ শব্দটি নাগরিকত্বের সূচক, জাতীয়তার সূচক নয়। তবে এই যুক্তি মেনে নিলে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে বিভিন্ন জাতির পার্থক্যের স্বীকৃতিও দিতে হবে। বাংলাদেশকে বহুজাতিক দেশ হিসেবে মেনে বিভিন্ন জাতিসত্তার ন্যায্য অধিকারগুলোর স্বীকৃতি দিতে হবে।
আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ; যা রাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে, আবার রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও পার্থক্য মেনে নিতে পারে। এ জন্য কেউ ভারতের নাগরিক হয়েও বাঙালি হতে পারেন। আবার কেউ বাংলাদেশি নাগরিক হয়েও অবাঙালি হতে পারেন। নাগরিকত্ব রাষ্ট্রীয় আইনের ওপর নির্ভরশীল এবং কোনো কোনো রাষ্ট্রের আইনে একাধিক নাগরিক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ জন্য প্রবাসী বাঙালিদের বাঙালি ও বাংলাদেশি দুটো পরিচয়ই সত্য ধরা হয় এবং বাংলাদেশে তাঁদের ভোটাধিকার আছে। তবে আলাদাভাবে জাতীয়তা নির্ধারিত হয় ভাষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইত্যাদি অনেক কিছুর ঐতিহাসিক বিবর্তন ও সমপাতন দ্বারা।সেই হিসেবে ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক জাতিগতভাবে বাঙালি বা অন্য কোনো জাতির সদস্য হতে পারেন। একক নাগরিক পরিচিতি যেমন নানা জাতি দ্বারা গঠিত হতে পারে, তেমনি একক জাতীয় পরিচিতির মধ্যেও নানা দেশের নাগরিক থাকতে পারেন।
‘যুদ্ধাপরাধী’দের বিচারের প্রশ্নে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, গণজাগরণ মঞ্চ হচ্ছে নাস্তিকদের মঞ্চ। অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চকে তখন আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছিল। যদিও সেখানে তাদের কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। সেই সমর্থনের কারণেই ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অনেক স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী এখনো বহাল তবিয়তে আমাদের আশপাশে আছেন, যাঁরা আইনের দৃষ্টিতে ক্রিমিনাল নন এবং সেই অর্থে প্রত্যক্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়তো করেননি, কিন্তু মনেপ্রাণে স্বাধীনতাবিরোধী বা ‘পাকিস্তানপন্থী’ রয়ে গেছেন।
একসময়ের চীনপন্থী রাজনীতিবিদ ও সাবেক মুসলিম লীগপন্থী অনেকেই স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন। স্বাধীনতার পর যখন বিএনপি তৈরি হলো, তখন তাঁদের অনেকেই বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হন। একসময় পাকিস্তানের মিত্র চীনের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। চীনের সঙ্গে তখন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা ছিল না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, চীনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে।
বিএনপির সঙ্গে হয়তো এখন চীনের এতটা ঘনিষ্ঠতা নেই। কারণ, চীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পদ্মা সেতুসহ অনেক মেগা প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে। তবে সাবেক চীনপন্থীরা এখন নানা দলে বিভক্ত হয়ে কেউ আওয়ামী সমর্থক, কেউবা বিএনপির সমর্থক, কেউ কেউ আবার পৃথক দল বানিয়ে আওয়ামী সমর্থক হয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো দলই বর্তমানে সরাসরি চীনের বিরোধিতা করছে না।
অন্যদিকে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের শক্তিশালী একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের পক্ষে রাখতে চাইছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, আমেরিকা তাঁকে ক্ষমতায় রাখতে চায় না। সুতরাং মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব এই মুহূর্তে বাড়ার দিকে। এখানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বাধীনতাসংগ্রামের বন্ধু ভারতের দূরত্ব বেড়েছে কি না, তেমন একটি প্রশ্নও উঠে আসে। এটা ঠিক যে বিএনপি যখন প্রথম ক্ষমতায় ছিল, তখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব বেড়েছিল; বিশেষ করে সীমান্ত ইস্যু নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের দ্বন্দ্ব ছিল।
ভারত একসময় মনে করত, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘সাত রাজ্য’ এলাকায় যেসব ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন রয়েছে, তাদের জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে এনে আশ্রয় দেবেন। একই সঙ্গে আমরা পরবর্তী সময়ে ১০ ট্রাক অস্ত্রের কথাও জানি। নিজস্ব স্বার্থ বিবেচনা করলে ভারত হয়তো এখনো বাংলাদেশে বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চাইবে না; বরং আওয়ামী লীগকেই দেখতে চাইবে। বিএনপি অবশ্য ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভারতকে এখন শত্রু না বলে নিরপেক্ষ ভূমিকায় দেখতে চায় (ভারত সম্পর্কে বিএনপির শেষ বিবৃতি দ্রষ্টব্য)
শুধু ইতিহাস ও বৈদেশিক নীতি নয়, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থান অভ্যন্তরীণ জাতীয় প্রশ্নেও পৃথক। এসব কারণে অনেকেই এটাকে বলেন আদর্শগত মৌলিক বিরোধ। কিন্তু আমি এটাকে মৌলিক শ্রেণি-বিরোধ হিসেবে দেখি না। কারণ যে মৌলিক অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে একটি সরকারের শ্রেণিচরিত্র নির্ধারিত হয়, সেটি উভয়েরই এক। তারা উভয়েই বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে এবং বর্তমানে দুটি দল যাঁরা পরিচালনা করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই হচ্ছেন বড় ব্যবসায়ী, ধনিক শ্রেণির সদস্য।
মধ্যবিত্ত স্তরের মানুষ তাঁদের দলে প্রচুর পরিমাণে থাকলেও তাঁরা তাঁদের দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন না অথবা এবং একে অনিবার্য বলে মেনে নিয়েছেন। ‘মিশ্র অর্থনীতি’, ‘কল্যাণ পুঁজিবাদ’ বা ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ এসব কথা আওয়ামী মহলে আগে অনেক উচ্চারিত হলেও এখন তা উচ্চারিত হচ্ছে না। এখন প্রবৃদ্ধি ও অবাধ বাজারই আওয়ামী লীগের মূল ভাবাদর্শ, সেটা বিএনপিরও বটে। দুই দলের মূল পরিচালক শক্তিও হচ্ছে সেই বড় ধনী পরিবারগুলো, রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্রের গর্ভেই যাদের জন্ম এবং এখনো রাষ্ট্রক্ষমতাকে আশ্রয় করেই টিকে আছে ও বিকশিত হতে চাইছে। তাই রাষ্ট্রক্ষমতাকে কেন্দ্র করে তাদের রয়েছে একধরনের নিরন্তর প্রতিযোগিতা।
সম্প্রতি আয়োজিত ব্যবসায়ীদের সম্মেলনে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। সেখানে বড় ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার কথাই জোরের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। এটা পরিষ্কার যে ব্যবসায়ীরা সব সময় চান সরকার তাঁদের অনুকূলে থাকুক।কারণ আমাদের এখানে মূলত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুঁজিবাদ (স্টেট স্পন্সরড ক্যাপিটালিজম) গড়ে উঠেছে। এর বৈশিষ্ট্য হলো ত্রিভুজ ক্ষমতাকাঠামো। ত্রিভুজ ক্ষমতাকাঠামো হলো সুযোগসন্ধানী ‘অসৎ ব্যবসায়ী’, ‘অসৎ রাজনীতিবিদ’ ও ‘অসৎ আমলাদের’ একটি যোগসাজশ (নেক্সাস)। সত্যিকার অর্থে তাঁরাই দেশ চালান।
আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে-ই সরকারে থাকুক না কেন এই ক্ষমতাকাঠামো একই থাকবে। কারণ তাঁরাই অর্থ সরবরাহ বা বিনিয়োগ করে দলগুলোকে চালান। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দ্বন্দ্বটা তাই বহুলাংশে ক্ষমতা রক্ষা করার এবং ক্ষমতা দখল করার দ্বন্দ্ব। এটা নতুন কিছু নয়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও এ জন্যই ধনপতি হেনরি ফোর্ড বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট যে-ই জিতুক না কেন, আমি কখনো হারি না।’
ধর্মীয় ইস্যুতেও বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের পার্থক্য কমে গেছে। আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনার এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো—ইসলামপন্থী দলগুলোকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের পক্ষে নিয়ে আসা এবং নিজেকে এমনকি ‘কওমি জননী’ হিসেবে তুলে ধরা। এখন উভয় দলের সাধারণ সমর্থকের মধ্যে নানা মৌলিক নীতিগত বিষয়ে পার্থক্য খুঁজে বের করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।
দুটি দলের সাধারণ অসচেতন সমর্থকদের মধ্যে এখন দৃশ্যমান পার্থক্য হলো—একদল শুধু বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নাম প্রচার করে, আরেক দল শুধু জিয়া, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নাম প্রচার করে। আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মনে করেন, অতীতে আদর্শের ছিটেফোঁটা যা-ই থাকুক না কেন বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্বটি দুটি ‘টোটেম’ নিয়ে দুটি ট্রাইবের ঝগড়ায় পরিণত হয়েছে।এটা এত বিস্তৃত আকার ধারণ করেছে যে রাজনৈতিক যুদ্ধে জয়-পরাজয়টা বর্তমানে জীবন-মরণ সমস্যায় এবং বৈরিতামূলক গোত্রীয় দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে দুটি দলের জন্যই। এ ক্ষেত্রে তাই সহজে কোনো মীমাংসা হবে না।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ
বাংলাদেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে মতভেদ চলছে। এই মতভেদকে সাধারণত দুইভাবে দেখা হয়। কেউ কেউ একে আদর্শগত দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখেন, আবার কেউ কেউ একে ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতা রক্ষার বিরোধ হিসেবে দেখেন। দুইভাবেই দেখা যেতে পারে। দুটির মধ্যেই আংশিক সত্য রয়েছে। কোন অংশটা প্রধান তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে এবং ঐতিহাসিক কারণে তা অস্বাভাবিক নয়। পঁচাত্তরের আগে-পরে আওয়ামী লীগের আদর্শ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মাত্রা অবশ্যই এক রকম নয়। আবার জিয়া-উত্তর খালেদা-তারেকের নেতৃত্বাধীন বিএনপি এবং অতীতের জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিও এক রকম নয়।
সুতরাং গতির মধ্যেই দল দুটির বিচার করা উচিত। তবে তারপরও আমরা বর্তমান মুহূর্তে এসে দেখব যে তাদের পার্থক্যগুলো ক্রমেই কমে এসেছে, কমতে কমতে তা এখন অধিকাংশ মানুষের চোখে ক্ষমতা রক্ষা ও ক্ষমতা দখলের পার্থক্যে পর্যবসিত হয়েছে। যদিও কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে বা বিশেষ প্রশ্নে মন্দের ভালো কে, তা নিয়ে চুলচেরা অনেক বিতর্ক থাকতে পারে।
আদর্শ হিসেবে আওয়ামী লীগের ইতিহাস বিএনপির ইতিহাসের থেকে আলাদা। আওয়ামী লীগ দীর্ঘকালের পুরোনো দল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে দলটি নেতৃত্ব দিয়েছে, যদিও তখনো আওয়ামী লীগে কনফেডারেশন ও আমেরিকাপন্থী একটি শক্তি উপস্থিত ছিল। অন্যদিকে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পরে সামরিক চ্যানেলের মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছে এবং তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আদর্শ হিসেবে ধারণ করে। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ বলতে আসলে কোন জাতীয়তাবাদকে বোঝানো হচ্ছে, তা অস্পষ্ট।
‘বংগ’ নামে একটি বৃহৎ এলাকা আদিকাল থেকেই বিভিন্ন ভাষা, বিভিন্ন সংস্কৃতি ও নানা ঐতিহ্যসম্পন্ন নৃগোষ্ঠী-অধ্যুষিত অঞ্চল। এই অঞ্চল ১৯৭১ সালে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর এর নাগরিকেরা তাঁদের পাসপোর্টে নিজেদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছেন। সুতরাং ‘বাংলাদেশি’ শব্দটি নাগরিকত্বের সূচক, জাতীয়তার সূচক নয়। তবে এই যুক্তি মেনে নিলে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে বিভিন্ন জাতির পার্থক্যের স্বীকৃতিও দিতে হবে। বাংলাদেশকে বহুজাতিক দেশ হিসেবে মেনে বিভিন্ন জাতিসত্তার ন্যায্য অধিকারগুলোর স্বীকৃতি দিতে হবে।
আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ; যা রাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে, আবার রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও পার্থক্য মেনে নিতে পারে। এ জন্য কেউ ভারতের নাগরিক হয়েও বাঙালি হতে পারেন। আবার কেউ বাংলাদেশি নাগরিক হয়েও অবাঙালি হতে পারেন। নাগরিকত্ব রাষ্ট্রীয় আইনের ওপর নির্ভরশীল এবং কোনো কোনো রাষ্ট্রের আইনে একাধিক নাগরিক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ জন্য প্রবাসী বাঙালিদের বাঙালি ও বাংলাদেশি দুটো পরিচয়ই সত্য ধরা হয় এবং বাংলাদেশে তাঁদের ভোটাধিকার আছে। তবে আলাদাভাবে জাতীয়তা নির্ধারিত হয় ভাষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইত্যাদি অনেক কিছুর ঐতিহাসিক বিবর্তন ও সমপাতন দ্বারা।সেই হিসেবে ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক জাতিগতভাবে বাঙালি বা অন্য কোনো জাতির সদস্য হতে পারেন। একক নাগরিক পরিচিতি যেমন নানা জাতি দ্বারা গঠিত হতে পারে, তেমনি একক জাতীয় পরিচিতির মধ্যেও নানা দেশের নাগরিক থাকতে পারেন।
‘যুদ্ধাপরাধী’দের বিচারের প্রশ্নে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, গণজাগরণ মঞ্চ হচ্ছে নাস্তিকদের মঞ্চ। অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চকে তখন আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছিল। যদিও সেখানে তাদের কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। সেই সমর্থনের কারণেই ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অনেক স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী এখনো বহাল তবিয়তে আমাদের আশপাশে আছেন, যাঁরা আইনের দৃষ্টিতে ক্রিমিনাল নন এবং সেই অর্থে প্রত্যক্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়তো করেননি, কিন্তু মনেপ্রাণে স্বাধীনতাবিরোধী বা ‘পাকিস্তানপন্থী’ রয়ে গেছেন।
একসময়ের চীনপন্থী রাজনীতিবিদ ও সাবেক মুসলিম লীগপন্থী অনেকেই স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন। স্বাধীনতার পর যখন বিএনপি তৈরি হলো, তখন তাঁদের অনেকেই বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হন। একসময় পাকিস্তানের মিত্র চীনের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। চীনের সঙ্গে তখন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা ছিল না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, চীনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে।
বিএনপির সঙ্গে হয়তো এখন চীনের এতটা ঘনিষ্ঠতা নেই। কারণ, চীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পদ্মা সেতুসহ অনেক মেগা প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে। তবে সাবেক চীনপন্থীরা এখন নানা দলে বিভক্ত হয়ে কেউ আওয়ামী সমর্থক, কেউবা বিএনপির সমর্থক, কেউ কেউ আবার পৃথক দল বানিয়ে আওয়ামী সমর্থক হয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো দলই বর্তমানে সরাসরি চীনের বিরোধিতা করছে না।
অন্যদিকে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের শক্তিশালী একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের পক্ষে রাখতে চাইছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, আমেরিকা তাঁকে ক্ষমতায় রাখতে চায় না। সুতরাং মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব এই মুহূর্তে বাড়ার দিকে। এখানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বাধীনতাসংগ্রামের বন্ধু ভারতের দূরত্ব বেড়েছে কি না, তেমন একটি প্রশ্নও উঠে আসে। এটা ঠিক যে বিএনপি যখন প্রথম ক্ষমতায় ছিল, তখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব বেড়েছিল; বিশেষ করে সীমান্ত ইস্যু নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের দ্বন্দ্ব ছিল।
ভারত একসময় মনে করত, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘সাত রাজ্য’ এলাকায় যেসব ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন রয়েছে, তাদের জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে এনে আশ্রয় দেবেন। একই সঙ্গে আমরা পরবর্তী সময়ে ১০ ট্রাক অস্ত্রের কথাও জানি। নিজস্ব স্বার্থ বিবেচনা করলে ভারত হয়তো এখনো বাংলাদেশে বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চাইবে না; বরং আওয়ামী লীগকেই দেখতে চাইবে। বিএনপি অবশ্য ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভারতকে এখন শত্রু না বলে নিরপেক্ষ ভূমিকায় দেখতে চায় (ভারত সম্পর্কে বিএনপির শেষ বিবৃতি দ্রষ্টব্য)
শুধু ইতিহাস ও বৈদেশিক নীতি নয়, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থান অভ্যন্তরীণ জাতীয় প্রশ্নেও পৃথক। এসব কারণে অনেকেই এটাকে বলেন আদর্শগত মৌলিক বিরোধ। কিন্তু আমি এটাকে মৌলিক শ্রেণি-বিরোধ হিসেবে দেখি না। কারণ যে মৌলিক অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে একটি সরকারের শ্রেণিচরিত্র নির্ধারিত হয়, সেটি উভয়েরই এক। তারা উভয়েই বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে এবং বর্তমানে দুটি দল যাঁরা পরিচালনা করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই হচ্ছেন বড় ব্যবসায়ী, ধনিক শ্রেণির সদস্য।
মধ্যবিত্ত স্তরের মানুষ তাঁদের দলে প্রচুর পরিমাণে থাকলেও তাঁরা তাঁদের দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন না অথবা এবং একে অনিবার্য বলে মেনে নিয়েছেন। ‘মিশ্র অর্থনীতি’, ‘কল্যাণ পুঁজিবাদ’ বা ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ এসব কথা আওয়ামী মহলে আগে অনেক উচ্চারিত হলেও এখন তা উচ্চারিত হচ্ছে না। এখন প্রবৃদ্ধি ও অবাধ বাজারই আওয়ামী লীগের মূল ভাবাদর্শ, সেটা বিএনপিরও বটে। দুই দলের মূল পরিচালক শক্তিও হচ্ছে সেই বড় ধনী পরিবারগুলো, রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্রের গর্ভেই যাদের জন্ম এবং এখনো রাষ্ট্রক্ষমতাকে আশ্রয় করেই টিকে আছে ও বিকশিত হতে চাইছে। তাই রাষ্ট্রক্ষমতাকে কেন্দ্র করে তাদের রয়েছে একধরনের নিরন্তর প্রতিযোগিতা।
সম্প্রতি আয়োজিত ব্যবসায়ীদের সম্মেলনে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। সেখানে বড় ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার কথাই জোরের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। এটা পরিষ্কার যে ব্যবসায়ীরা সব সময় চান সরকার তাঁদের অনুকূলে থাকুক।কারণ আমাদের এখানে মূলত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুঁজিবাদ (স্টেট স্পন্সরড ক্যাপিটালিজম) গড়ে উঠেছে। এর বৈশিষ্ট্য হলো ত্রিভুজ ক্ষমতাকাঠামো। ত্রিভুজ ক্ষমতাকাঠামো হলো সুযোগসন্ধানী ‘অসৎ ব্যবসায়ী’, ‘অসৎ রাজনীতিবিদ’ ও ‘অসৎ আমলাদের’ একটি যোগসাজশ (নেক্সাস)। সত্যিকার অর্থে তাঁরাই দেশ চালান।
আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে-ই সরকারে থাকুক না কেন এই ক্ষমতাকাঠামো একই থাকবে। কারণ তাঁরাই অর্থ সরবরাহ বা বিনিয়োগ করে দলগুলোকে চালান। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দ্বন্দ্বটা তাই বহুলাংশে ক্ষমতা রক্ষা করার এবং ক্ষমতা দখল করার দ্বন্দ্ব। এটা নতুন কিছু নয়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও এ জন্যই ধনপতি হেনরি ফোর্ড বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট যে-ই জিতুক না কেন, আমি কখনো হারি না।’
ধর্মীয় ইস্যুতেও বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের পার্থক্য কমে গেছে। আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনার এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো—ইসলামপন্থী দলগুলোকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের পক্ষে নিয়ে আসা এবং নিজেকে এমনকি ‘কওমি জননী’ হিসেবে তুলে ধরা। এখন উভয় দলের সাধারণ সমর্থকের মধ্যে নানা মৌলিক নীতিগত বিষয়ে পার্থক্য খুঁজে বের করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।
দুটি দলের সাধারণ অসচেতন সমর্থকদের মধ্যে এখন দৃশ্যমান পার্থক্য হলো—একদল শুধু বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নাম প্রচার করে, আরেক দল শুধু জিয়া, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নাম প্রচার করে। আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মনে করেন, অতীতে আদর্শের ছিটেফোঁটা যা-ই থাকুক না কেন বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্বটি দুটি ‘টোটেম’ নিয়ে দুটি ট্রাইবের ঝগড়ায় পরিণত হয়েছে।এটা এত বিস্তৃত আকার ধারণ করেছে যে রাজনৈতিক যুদ্ধে জয়-পরাজয়টা বর্তমানে জীবন-মরণ সমস্যায় এবং বৈরিতামূলক গোত্রীয় দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে দুটি দলের জন্যই। এ ক্ষেত্রে তাই সহজে কোনো মীমাংসা হবে না।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৯ ঘণ্টা আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৯ ঘণ্টা আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৯ ঘণ্টা আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
১০ ঘণ্টা আগে