ড. মইনুল ইসলাম
২০২৩ সালের ২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের এক মহাসমাবেশে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘোষণা সত্ত্বেও আমার সন্দেহ হচ্ছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভারতের ভেটো উপেক্ষা করে বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে আর কোনো পদক্ষেপ নেবে না। গত ২ আগস্টের ঘোষণার পর সাড়ে তিন মাস পার হয়ে গেলেও তিস্তা প্রকল্প প্রস্তাবটি একনেকে উপস্থাপিত না হওয়ায় আমার সন্দেহকে অমূলক বলা যাচ্ছে না।
বর্ষাকাল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি প্রকল্পের কাজ শুরু করা না হয়, তাহলে এর বাস্তবায়ন এক বছর পিছিয়ে যাবে। সে জন্য ২০২৪ সালের শুষ্ক মৌসুমের পুরোটাই কাজে লাগাতে চাইলে অবিলম্বে প্রকল্পটি একনেকে পাস করা ‘ফরজ’ বললে অত্যুক্তি হবে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় বহুদিন ধরে তোলপাড় করা একটি খবর, প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভারতের প্রবল আপত্তির মুখে সেটা অনুমোদনের জন্য একনেকে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। ২০২২ সালে একটি খবর সরকারি মহল থেকেই প্রচার করা হয়েছিল, ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। এরপর দীর্ঘদিন থেকে সরকারিভাবে আর কোনো নড়াচড়া পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ জানে, ভারত সরকার বাংলাদেশের নির্বাচনকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম।
তাই প্রধানমন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত আশ্বাস সত্ত্বেও ভারতীয় ভেটো যে এবারও তিস্তা প্রকল্পকে অন্ততপক্ষে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আটকে দেবে, সেটাই নিশ্চিত মনে হচ্ছে। (ইতিমধ্যে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ দিল্লিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি আলোচনার অ্যাজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি)।
কারণ, সম্প্রতি ভারত থেকে খবর বেরিয়েছে যে ২০১১ সাল থেকে ঝুলে থাকা বাংলাদেশ-ভারত তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের লোকসভার সংসদীয় কমিটিতে সর্বদলীয় একটি সভা হয়েছে। ওই সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভারতের পক্ষ থেকে তিস্তা চুক্তির নতুন প্রস্তাব উত্থাপনের কথা জানা যাচ্ছে, যেখানে বাতিল হয়ে যাওয়া ২০১১ সালের চুক্তির ৫০-৫০ শতাংশ পানির হিস্যা বাংলাদেশ ও ভারতের ভাগে দেওয়ার পরিবর্তে এখন নাকি ৫৫ শতাংশ ভারত এবং ৪৫ শতাংশ পানি বাংলাদেশকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই নতুন প্রস্তাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মতি পাওয়া গেছে। নতুন এই প্রস্তাবের ব্যাপারে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানা যায়নি। কিন্তু এই অন্যায্য ও একপক্ষীয় প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকার রাজি হলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তাই নির্বাচনের আগে এ-ব্যাপারে আর কোনো পদক্ষেপ যে গৃহীত হবে না, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
উপরন্তু গজলডোবা বাঁধের উজানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আরও দুটি খাল খননের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢোকার আগেই তিস্তার পানি যে আরও অনেক কমে যাবে, সেটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এই খাল খননের মাধ্যমে ভারত তিস্তা চুক্তির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। তাই তিস্তা চুক্তি হলেও বাংলাদেশের খুব বেশি লাভ হবে না। এর জন্য বাংলাদেশের আর অপেক্ষা করার কোনো আবশ্যকতা আছে বলে মনে করি না; বরং তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নই এখন বাংলাদেশের অগ্রাধিকার দাবি করে।
প্রায় পাঁচ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্প প্রণয়নের জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। যাতে ‘চীনের দুঃখ’ হিসেবে একদা বিশ্বের বহুল পরিচিত হোয়াংহো নদী বা ইয়েলো রিভারকে চীন যেভাবে ‘চীনের আশীর্বাদে’ পরিণত করেছে, ওই একইভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনগণের জন্য প্রতিবছর সর্বনাশ ডেকে আনা তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনাকেও একটি বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা যায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ চীনা অর্থায়নে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পর প্রকল্প-প্রস্তাবটি চীনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
একই সঙ্গে চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়, বাংলাদেশও ওই প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন চালিয়ে নদীর মাঝখানের গভীরতাকে ১০ মিটারে বাড়িয়ে ফেলা হবে এবং নদীর প্রশস্ততাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলা হবে। একই সঙ্গে রিভার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক ভূমি উদ্ধার করে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। উপযুক্ত স্থানে বেশ কয়েকটি ব্যারাজ-কাম-রোড নির্মাণ করে নদীর দুই তীরের যোগাযোগ নিশ্চিত করা হবে।
পাশাপাশি বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণের জন্য জলাধার নির্মাণ করে, সেখানে সেচের জন্য খাল খননের মাধ্যমে নদীর উভয় তীরের এলাকার চাষযোগ্য জমিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা করা হবে। নদীর উভয় তীরের সড়কের পাশে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সুবিধা গড়ে তোলা হবে। ইন্টারনেটে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির বর্ণনা জেনে আমার মনে হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সত্যি সত্যিই তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্য-পীড়িত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনজীবনে একটা যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হবে। অবশ্য একদল বিশেষজ্ঞ তিস্তা প্রকল্প ফলপ্রসূ হবে না বলে মত ব্যক্ত করেছেন। খননের পর নাকি নদী আবার ভরাট হতে দেরি হবে না; বরং নদীর প্রশস্ততা কমে যাবে।
প্রথম থেকেই এই প্রকল্পে বাগড়া দিচ্ছে ভারত। ভারত নাকি এই প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণকে তাদের দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক ঘোষণা করে বাংলাদেশকে প্রকল্প বাতিল করার জন্য সরাসরি চাপ দিয়ে চলেছে। ভারতের দাবি, তাদের শিলিগুড়ি করিডরের ‘চিকেন-নেকের’ এত কাছাকাছি তিস্তা প্রকল্পে কয়েক শ বা হাজারের বেশি চীনা নাগরিকের অবস্থানকে ভারত মেনে নেবে না।
বাংলাদেশকে এই প্রকল্প থেকে সরে আসতে বলা হচ্ছে। যে এলাকা দিয়ে তিস্তা নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে ‘শিলিগুড়ি চিকেন-নেক করিডর’ বেশ খানিকটা দূরে। তিস্তা নদীর দক্ষিণ-পূর্বদিকের ভাটিতে যতই প্রকল্পের কাজ এগোবে, ততই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে প্রকল্প এলাকার দূরত্ব বাড়তে থাকবে। একবার শোনা গেছে, ভারতের নিরাপত্তা-সম্পর্কীয় উদ্বেগকে আমলে নিয়ে সীমান্ত-নিকটবর্তী ১৬ কিলোমিটার নদীর খনন বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে করবে।
তিস্তা নদী ঐতিহাসিকভাবেই অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং খামখেয়ালি আচরণের একটি নদী, যার কারণে বন্যার কবলে পড়ে প্রায় প্রতিবছর বর্ষায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল একাধিকবার বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে তুলনামূলকভাবে খরাগ্রস্ত এই এলাকার মানুষ তিস্তা নদীর পানিস্বল্পতাহেতু সেচসুবিধা থেকেও বঞ্চিত থাকে। তিস্তা নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় ভারত একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি সম্পূর্ণভাবে আটকে দেওয়ার পর তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশ বছরের বেশির ভাগ সময় প্রায় পানিশূন্য থাকছে। ২০২৩ সালেও তিস্তার পানিস্বল্পতার ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। বলা হয়, এলাকার জনগণের জীবন ও জীবিকার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ তিস্তা নদী।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁকে বসার কারণে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। এখন তাঁর আবদার মতো নতুন অন্যায্য প্রস্তাব বাংলাদেশকে গছানোর জন্য জবরদস্তি শুরু হচ্ছে বলা যায়। অবশ্য তিস্তা চুক্তি আর প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প মোটেও সাংঘর্ষিক নয়। তিস্তা চুক্তি হোক বা না হোক তিস্তা প্রকল্প ওই অঞ্চলের জনগণের জীবন ও জীবিকায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। চুক্তি হলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহ খানিকটা হয়তো বাড়বে, কিন্তু বর্ষায় গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট খুলে দেওয়ায় এতদঞ্চলের জনগণ যে একাধিকবার বন্যায় ডুবছে, তার তো কোনো সমাধান হবে না! প্রস্তাবিত প্রকল্পের জলাধারগুলোর সংরক্ষিত পানি পরিকল্পিত সেচব্যবস্থায় ব্যবহৃত হলে হয়তো এই সমস্যার টেকসই সমাধান মিলবে।
এই প্রকল্পের বিভিন্ন ডাইমেনশনের বর্ণনা জানাজানি হওয়ার পর এলাকার জনগণের মধ্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন গেড়ে বসেছিল, খুশিতে মাতোয়ারা হয়েছিল তারা। প্রকল্পটির আশু বাস্তবায়নের জন্য দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি মানববন্ধন ও মিছিল হয়েছে। গত ২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় রংপুর অঞ্চলে খুশির বন্যা বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তাদের অপেক্ষা সহজে ফুরাবে না!
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
২০২৩ সালের ২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের এক মহাসমাবেশে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘোষণা সত্ত্বেও আমার সন্দেহ হচ্ছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভারতের ভেটো উপেক্ষা করে বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে আর কোনো পদক্ষেপ নেবে না। গত ২ আগস্টের ঘোষণার পর সাড়ে তিন মাস পার হয়ে গেলেও তিস্তা প্রকল্প প্রস্তাবটি একনেকে উপস্থাপিত না হওয়ায় আমার সন্দেহকে অমূলক বলা যাচ্ছে না।
বর্ষাকাল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি প্রকল্পের কাজ শুরু করা না হয়, তাহলে এর বাস্তবায়ন এক বছর পিছিয়ে যাবে। সে জন্য ২০২৪ সালের শুষ্ক মৌসুমের পুরোটাই কাজে লাগাতে চাইলে অবিলম্বে প্রকল্পটি একনেকে পাস করা ‘ফরজ’ বললে অত্যুক্তি হবে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় বহুদিন ধরে তোলপাড় করা একটি খবর, প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভারতের প্রবল আপত্তির মুখে সেটা অনুমোদনের জন্য একনেকে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। ২০২২ সালে একটি খবর সরকারি মহল থেকেই প্রচার করা হয়েছিল, ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। এরপর দীর্ঘদিন থেকে সরকারিভাবে আর কোনো নড়াচড়া পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ জানে, ভারত সরকার বাংলাদেশের নির্বাচনকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম।
তাই প্রধানমন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত আশ্বাস সত্ত্বেও ভারতীয় ভেটো যে এবারও তিস্তা প্রকল্পকে অন্ততপক্ষে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আটকে দেবে, সেটাই নিশ্চিত মনে হচ্ছে। (ইতিমধ্যে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ দিল্লিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি আলোচনার অ্যাজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি)।
কারণ, সম্প্রতি ভারত থেকে খবর বেরিয়েছে যে ২০১১ সাল থেকে ঝুলে থাকা বাংলাদেশ-ভারত তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের লোকসভার সংসদীয় কমিটিতে সর্বদলীয় একটি সভা হয়েছে। ওই সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভারতের পক্ষ থেকে তিস্তা চুক্তির নতুন প্রস্তাব উত্থাপনের কথা জানা যাচ্ছে, যেখানে বাতিল হয়ে যাওয়া ২০১১ সালের চুক্তির ৫০-৫০ শতাংশ পানির হিস্যা বাংলাদেশ ও ভারতের ভাগে দেওয়ার পরিবর্তে এখন নাকি ৫৫ শতাংশ ভারত এবং ৪৫ শতাংশ পানি বাংলাদেশকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই নতুন প্রস্তাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মতি পাওয়া গেছে। নতুন এই প্রস্তাবের ব্যাপারে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানা যায়নি। কিন্তু এই অন্যায্য ও একপক্ষীয় প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকার রাজি হলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তাই নির্বাচনের আগে এ-ব্যাপারে আর কোনো পদক্ষেপ যে গৃহীত হবে না, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
উপরন্তু গজলডোবা বাঁধের উজানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আরও দুটি খাল খননের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢোকার আগেই তিস্তার পানি যে আরও অনেক কমে যাবে, সেটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এই খাল খননের মাধ্যমে ভারত তিস্তা চুক্তির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। তাই তিস্তা চুক্তি হলেও বাংলাদেশের খুব বেশি লাভ হবে না। এর জন্য বাংলাদেশের আর অপেক্ষা করার কোনো আবশ্যকতা আছে বলে মনে করি না; বরং তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নই এখন বাংলাদেশের অগ্রাধিকার দাবি করে।
প্রায় পাঁচ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্প প্রণয়নের জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। যাতে ‘চীনের দুঃখ’ হিসেবে একদা বিশ্বের বহুল পরিচিত হোয়াংহো নদী বা ইয়েলো রিভারকে চীন যেভাবে ‘চীনের আশীর্বাদে’ পরিণত করেছে, ওই একইভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনগণের জন্য প্রতিবছর সর্বনাশ ডেকে আনা তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনাকেও একটি বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা যায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ চীনা অর্থায়নে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পর প্রকল্প-প্রস্তাবটি চীনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
একই সঙ্গে চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়, বাংলাদেশও ওই প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন চালিয়ে নদীর মাঝখানের গভীরতাকে ১০ মিটারে বাড়িয়ে ফেলা হবে এবং নদীর প্রশস্ততাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলা হবে। একই সঙ্গে রিভার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক ভূমি উদ্ধার করে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। উপযুক্ত স্থানে বেশ কয়েকটি ব্যারাজ-কাম-রোড নির্মাণ করে নদীর দুই তীরের যোগাযোগ নিশ্চিত করা হবে।
পাশাপাশি বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণের জন্য জলাধার নির্মাণ করে, সেখানে সেচের জন্য খাল খননের মাধ্যমে নদীর উভয় তীরের এলাকার চাষযোগ্য জমিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা করা হবে। নদীর উভয় তীরের সড়কের পাশে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সুবিধা গড়ে তোলা হবে। ইন্টারনেটে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির বর্ণনা জেনে আমার মনে হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সত্যি সত্যিই তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্য-পীড়িত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনজীবনে একটা যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হবে। অবশ্য একদল বিশেষজ্ঞ তিস্তা প্রকল্প ফলপ্রসূ হবে না বলে মত ব্যক্ত করেছেন। খননের পর নাকি নদী আবার ভরাট হতে দেরি হবে না; বরং নদীর প্রশস্ততা কমে যাবে।
প্রথম থেকেই এই প্রকল্পে বাগড়া দিচ্ছে ভারত। ভারত নাকি এই প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণকে তাদের দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক ঘোষণা করে বাংলাদেশকে প্রকল্প বাতিল করার জন্য সরাসরি চাপ দিয়ে চলেছে। ভারতের দাবি, তাদের শিলিগুড়ি করিডরের ‘চিকেন-নেকের’ এত কাছাকাছি তিস্তা প্রকল্পে কয়েক শ বা হাজারের বেশি চীনা নাগরিকের অবস্থানকে ভারত মেনে নেবে না।
বাংলাদেশকে এই প্রকল্প থেকে সরে আসতে বলা হচ্ছে। যে এলাকা দিয়ে তিস্তা নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে ‘শিলিগুড়ি চিকেন-নেক করিডর’ বেশ খানিকটা দূরে। তিস্তা নদীর দক্ষিণ-পূর্বদিকের ভাটিতে যতই প্রকল্পের কাজ এগোবে, ততই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে প্রকল্প এলাকার দূরত্ব বাড়তে থাকবে। একবার শোনা গেছে, ভারতের নিরাপত্তা-সম্পর্কীয় উদ্বেগকে আমলে নিয়ে সীমান্ত-নিকটবর্তী ১৬ কিলোমিটার নদীর খনন বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে করবে।
তিস্তা নদী ঐতিহাসিকভাবেই অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং খামখেয়ালি আচরণের একটি নদী, যার কারণে বন্যার কবলে পড়ে প্রায় প্রতিবছর বর্ষায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল একাধিকবার বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে তুলনামূলকভাবে খরাগ্রস্ত এই এলাকার মানুষ তিস্তা নদীর পানিস্বল্পতাহেতু সেচসুবিধা থেকেও বঞ্চিত থাকে। তিস্তা নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় ভারত একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি সম্পূর্ণভাবে আটকে দেওয়ার পর তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশ বছরের বেশির ভাগ সময় প্রায় পানিশূন্য থাকছে। ২০২৩ সালেও তিস্তার পানিস্বল্পতার ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। বলা হয়, এলাকার জনগণের জীবন ও জীবিকার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ তিস্তা নদী।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁকে বসার কারণে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। এখন তাঁর আবদার মতো নতুন অন্যায্য প্রস্তাব বাংলাদেশকে গছানোর জন্য জবরদস্তি শুরু হচ্ছে বলা যায়। অবশ্য তিস্তা চুক্তি আর প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প মোটেও সাংঘর্ষিক নয়। তিস্তা চুক্তি হোক বা না হোক তিস্তা প্রকল্প ওই অঞ্চলের জনগণের জীবন ও জীবিকায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। চুক্তি হলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহ খানিকটা হয়তো বাড়বে, কিন্তু বর্ষায় গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট খুলে দেওয়ায় এতদঞ্চলের জনগণ যে একাধিকবার বন্যায় ডুবছে, তার তো কোনো সমাধান হবে না! প্রস্তাবিত প্রকল্পের জলাধারগুলোর সংরক্ষিত পানি পরিকল্পিত সেচব্যবস্থায় ব্যবহৃত হলে হয়তো এই সমস্যার টেকসই সমাধান মিলবে।
এই প্রকল্পের বিভিন্ন ডাইমেনশনের বর্ণনা জানাজানি হওয়ার পর এলাকার জনগণের মধ্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন গেড়ে বসেছিল, খুশিতে মাতোয়ারা হয়েছিল তারা। প্রকল্পটির আশু বাস্তবায়নের জন্য দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি মানববন্ধন ও মিছিল হয়েছে। গত ২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় রংপুর অঞ্চলে খুশির বন্যা বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তাদের অপেক্ষা সহজে ফুরাবে না!
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৭ ঘণ্টা আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৭ ঘণ্টা আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৭ ঘণ্টা আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৮ ঘণ্টা আগে