মামুনুর রশীদ
সড়ক দুর্ঘটনাকে এখন আমরা আর দুর্ঘটনা বলতে চাই না, বলে থাকি হত্যা। ত্রিশালে একটি পরিবারের বাবা, মা, বোন গত শনিবার ঘটনাস্থলেই নিহত হলেন। শিশুটি মায়ের পেট চিরে বেরিয়ে এল। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নায়ক গাড়ির চালক। এর আগেও এই পরিবারের দুজন, শিশুটির চাচা ও দাদার ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। শিশুটি যখন জীবনের হিসাবের খাতাটা হাতে নেবে, শুধুই দেখবে রক্ত খরচ তাতে।
এখন ২০২২ সাল। আজ থেকে কুড়ি বছর পর তার অভাবী দাদা-দাদি হয়তো বেঁচে থাকবেন না। এই নিঃসঙ্গ শিশুটি বড় হয়ে উঠবে একটি রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার চিহ্ন হিসেবে। কারা এই চালক, যাঁরা প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গায় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন? শিশুটির বাবা, মা, বোন যেদিন মারা যায়, তার আগে এবং পরে অর্ধশতাধিক মানুষকে তাঁরা হত্যা করেছেন।
একবার হিসাব করে দেখেছিলাম কোভিড-১৯-এ যত লোক মারা যায়, তার চেয়ে বেশি লোক মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনার শিকারে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটান ট্রাক ও বাসের চালকেরা। অসংখ্য গাড়িচালক বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের রক্ষাকবচ, তাঁদের সংগঠন এবং সংগঠনের অবিসংবাদিত নেতা। এই নেতার সঙ্গে আরও অনেক পাতি নেতা জুটে গেছেন। যাঁদের টেলিফোনের জোর আছে এবং একটি হত্যাকাণ্ডের বিনিময়ে টাকার ভাগাভাগি আছে। গাড়িচালকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও শারীরিক দক্ষতার কোনো বালাই নেই। দালালের মাধ্যমে লাইসেন্স নিতে চাইলে এসবের কিছু প্রয়োজন হয় না, টাকাই যথেষ্ট। আর শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য সার্টিফিকেট পাওয়া যায় রাজধানীর নীলক্ষেতে অথবা কোনো বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে এবং সেখানেও বিষয়টা হচ্ছে টাকা।
একজন চালকের হাতে যখন ৪০-৫০ জন যাত্রীর জীবন এবং সেই সঙ্গে পথে হাজার হাজার মানুষের জীবন-মরণের সারথি, তখন রাষ্ট্র এ বিষয়টির কোনো বিবেচনাই করেনি। নেতারা কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠান—বিনা পরীক্ষায় চালকের লাইসেন্স দেওয়া হোক। কর্তৃপক্ষ কখনো অসহায় হয়ে এবং কখনো অর্থের বিনিময়ে লাইসেন্সটি দিয়ে তার দায়িত্ব পালন করে। এই লাইসেন্স শুধু গাড়ি চালানোর লাইসেন্স, গাড়ি চালানোর সঙ্গে যে সহস্র জীবন যুক্ত আছে, তার জন্য কোনো প্রশিক্ষণ, কোনো ভাবনার প্রয়োজন হয় না!
চালকদের সাধারণত ওস্তাদ ডাকা হয়। ওস্তাদ কখনো ঘুমিয়ে যান এবং তাঁর হেলপার ডান-বাম নির্দেশ করে গাড়িটি চালিয়ে যান। আর চালকদের কাছে মুখ্য হলো ট্রিপ। ট্রিপ যত, টাকা তত। এই বৈধ-অবৈধ টাকাপয়সা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায় রাস্তার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও সমিতির নেতাদের পকেটে। পরিবহনের টাকা তাদের কাছে খুবই নিরাপদ, যা নির্দিষ্ট সময়ে তাদের ঘরে পৌঁছে যায়। গাড়ির মালিকদের কাছে টাকা ছাড়া কোনো বিবেচনা নেই। একটি গাড়ির মালিক এবং এক শ গাড়ির মালিকের কাছে বিবেচনা একটাই—টাকা চাই। চালক সাহেব অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধুরন্ধর, তাঁরা মালিককে নানামুখী প্রতারণায় নাস্তানাবুদ করে ফেলেন। ভদ্র মালিকেরা বহু টাকার ক্ষতি স্বীকার করে গাড়িটি একসময় বিক্রি করে দেন।
চালক এক অসুস্থ জীবনযাপন করেন। সারা রাত ঘুম ঘুম চোখে তিনি ঢাকা থেকে পঞ্চগড় গাড়ি চালিয়ে যান, সেখানে তাঁর জন্য বিশ্রাম, টয়লেট বা স্নানাগারের কোনো সুব্যবস্থা নেই। কোনোমতে এক অস্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে আবার গাড়িতে চেপে বসে ফিরে আসেন ঢাকায়। সেখানেও তাঁর জন্য কোনো সুব্যবস্থা নেই। পরিবারের খোঁজখবর নেওয়ার সময়ও তাঁর নেই, পরিবারের সঙ্গে তাঁর আচরণের সংস্কৃতিটাও তিনি জানেন না। তিনি চেনেন মালিক, নেতা এবং তাঁর কিছু অসুস্থ সঙ্গী। যাত্রীর কথা, পথিকের কথা, দেশের কথা—এসব বিষয় তাঁর বিবেচনাতে থাকে না। এসব অজস্র চালকের হাতে আমরা দেশের পরিবহনকে ছেড়ে দিয়েছি।
১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে রেল সংস্কারের একটা কাজ চলছিল। কিন্তু সামরিক শাসন আসার পর সেসব বন্ধ হয়ে গেল এবং সরু রাস্তায় মিনিবাস ঢুকতে শুরু করল। মিনিবাস, বাস এসবের পাল্লাপাল্লিতে এবং দুর্ঘটনায় ঢাকা-আরিচা সড়কটি যমদূতের পথ হিসেবে চিহ্নিত হলো। ভারতীয়, জাপানিজ ট্রাক-বাসে ভরে গেল সারা দেশ। ওই সময়ে চালকদের লাইসেন্সের কোনো বালাই ছিল না। গত ৫০ বছরে রাজপথের হত্যাকাণ্ডের যদি হিসাব করা যায়, তাহলে আমরা দেখব সম্ভাবনাময় অসংখ্য প্রাণ বলি হয়ে গেছে এই চালকদের কারণে।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে বাস সার্ভিস আছে, মাল পরিবহনের জন্য ট্রাকের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তা খুদে মালিকানার হাতে নয়। বড় বড় করপোরেশন এগুলোর মালিক। আবার তার একটি বিরাট অংশ সরকারি ব্যবস্থাপনায় মানুষের সেবার কাজে নিয়োজিত। আত্মঘাতী বাঙালির জীবনে তেমনি একটি ব্যবস্থা বিআরটিসি বাস। হায়রে দুর্নীতি! দুর্নীতির করালগ্রাসে তা-ও ডুবে গেল এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের অমোঘ নিয়মে তা বছরের পর বছর শুধুই ক্ষতি গুনতে থাকে। আর এসব ক্ষতির কারণ চালক, তাঁর সহকারী এবং ব্যবস্থাপনার তৃণমূল থেকে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত। এভাবেই দিন চলছে।
এর মধ্যে ঘটনাক্রমে কালের সাক্ষী হয়ে বেঁচে রইল ত্রিশালের ওই শিশুটি। সত্যিকার অর্থেই সে মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন। এ কী করে সম্ভব! একজন ট্রাকচালক কত শক্তিশালী? একটা পরিবারকে হত্যা করলেন তিনি! এখন তিনি কোথায়? কার আশ্রয়ে আছেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের আশ্রয় তাঁর কাছে খুবই নিরাপদ। মামলা চলতে থাকবে, বেশ কিছু টাকাপয়সা খরচ হবে এবং একসময় তিনি মুক্তি পেয়ে যাবেন। আমজনতা তো দূরের কথা, দেশের সচেতন নাগরিকেরাও একের পর এক হত্যাকাণ্ডের খোঁজখবর রাখতে পারেন না। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দ্রুত বিচারের কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা-ও মনে হয় রাষ্ট্রের ভাবনার মধ্যে নেই। ঘটনাস্থলেই তাঁদের বিচার করা উচিত। ঘটনাস্থলেই সঠিকভাবে কিছু বিচার হলে এবং যদি চালকেরা বুঝতেন যে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পার পাওয়া যাবে না, তাহলে হয়তো এর একটা সুরাহা হতে পারে।
বাঙালি বড়ই অভিজাত জাতি। গাড়ি চালানোকেও তাঁরা মনে করেন হীন কাজ। একটি কেরানি-পিয়নের চাকরির জন্য লাখ লাখ টাকা নিয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াবেন, কিন্তু পরিবহনের একজন ভালো চালক হওয়ার জন্য তিনি প্রস্তুত নন, তাঁর আত্মাভিমানে লাগে। এই পরিবহনশ্রমিক ও নেতৃত্ব কী ভয়ংকর যে তারা একটি রেললাইনে রেল চলতে দিল না, ট্রেনের যাত্রীদের পাথর ছুড়ে রক্তাক্ত করে দিল! কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত ওই লাইনটি বন্ধ করতে বাধ্য হলো। এখন মনে হচ্ছে পরিবহনশ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে তারপর বিমান বা রেল চালাতে হবে।
কোনো কোনো উদ্যোগ জাতির জন্য যে কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, তার প্রমাণ আমরা বহুবার দেখেছি। অযৌক্তিকভাবে বাসভাড়া বাড়ানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলে তাঁরা সড়ক বন্ধ করে দেন, নানান ধরনের অবরোধ সৃষ্টি করে যাত্রীদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ এবং মারামারিতে লিপ্ত হয়ে পড়েন। সরকার বাধ্য হয়ে আপসের পথ বেছে নেয়। অথচ নেতারা নিজেরা কখনোই পরিবহনশ্রমিক নন, কেউ কেউ মালিকও নন। কিন্তু তাঁরা সরকারি দলের। এই অন্যায্য ঐক্যের বিরুদ্ধে তাঁরাও কোনো কথা বলেন না।
এতক্ষণ যা কিছু লিখলাম তা সবই এ দেশের শিক্ষিত মানুষের জানা। আজ থেকে ২০ বছর পরের কথা ভাবা যাক। ধরে নিই মেয়েটি কোনো না কোনোভাবে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। দেখতে সুশ্রী, ভালো ছাত্রী। কিন্তু তার আপনজন কেউ পৃথিবীতে নেই। মেয়েটি একাকিত্বে ভোগে এবং বাবা, মা, বোনের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। পত্রপত্রিকায় এই সময় ২০২২ সালের ১৭ জুলাই ঘটে যাওয়া সংবাদটি সে সংগ্রহ করেছে। তার এক বন্ধুকে সে লিখতে চায়, ২০ বছর আগের এই সময়টা যখন দুর্ঘটনায় নিহত হলো তার পিতা, মাতা, বোন, তখনকার বাংলাদেশটা কেমন ছিল? সে লিখতে পারে না, পাতাটা সাদা থেকে যায়। প্রতিদিন সে চেষ্টা করে কিছু একটা লিখতে, পারে না। অনেক দিন চেষ্টা করার পর ক্ষোভে, বেদনায়, হাহাকারে কাগজগুলোকে দুমড়েমুচড়ে ছুড়ে ফেলে দেয়।
অনাগত দিনগুলোতে আমরাও কি ওই মেয়েটির সঙ্গে দুমড়েমুচড়ে পড়ে রইব? তখন হয়তো সমাজে বিচার আসবে, শৃঙ্খলা আসবে। কিন্তু সময়টা তাদের কাছে একটা দুমড়ে যাওয়া কাগজের মতোই থাকবে।
সড়ক দুর্ঘটনাকে এখন আমরা আর দুর্ঘটনা বলতে চাই না, বলে থাকি হত্যা। ত্রিশালে একটি পরিবারের বাবা, মা, বোন গত শনিবার ঘটনাস্থলেই নিহত হলেন। শিশুটি মায়ের পেট চিরে বেরিয়ে এল। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নায়ক গাড়ির চালক। এর আগেও এই পরিবারের দুজন, শিশুটির চাচা ও দাদার ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। শিশুটি যখন জীবনের হিসাবের খাতাটা হাতে নেবে, শুধুই দেখবে রক্ত খরচ তাতে।
এখন ২০২২ সাল। আজ থেকে কুড়ি বছর পর তার অভাবী দাদা-দাদি হয়তো বেঁচে থাকবেন না। এই নিঃসঙ্গ শিশুটি বড় হয়ে উঠবে একটি রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার চিহ্ন হিসেবে। কারা এই চালক, যাঁরা প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গায় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন? শিশুটির বাবা, মা, বোন যেদিন মারা যায়, তার আগে এবং পরে অর্ধশতাধিক মানুষকে তাঁরা হত্যা করেছেন।
একবার হিসাব করে দেখেছিলাম কোভিড-১৯-এ যত লোক মারা যায়, তার চেয়ে বেশি লোক মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনার শিকারে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটান ট্রাক ও বাসের চালকেরা। অসংখ্য গাড়িচালক বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের রক্ষাকবচ, তাঁদের সংগঠন এবং সংগঠনের অবিসংবাদিত নেতা। এই নেতার সঙ্গে আরও অনেক পাতি নেতা জুটে গেছেন। যাঁদের টেলিফোনের জোর আছে এবং একটি হত্যাকাণ্ডের বিনিময়ে টাকার ভাগাভাগি আছে। গাড়িচালকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও শারীরিক দক্ষতার কোনো বালাই নেই। দালালের মাধ্যমে লাইসেন্স নিতে চাইলে এসবের কিছু প্রয়োজন হয় না, টাকাই যথেষ্ট। আর শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য সার্টিফিকেট পাওয়া যায় রাজধানীর নীলক্ষেতে অথবা কোনো বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে এবং সেখানেও বিষয়টা হচ্ছে টাকা।
একজন চালকের হাতে যখন ৪০-৫০ জন যাত্রীর জীবন এবং সেই সঙ্গে পথে হাজার হাজার মানুষের জীবন-মরণের সারথি, তখন রাষ্ট্র এ বিষয়টির কোনো বিবেচনাই করেনি। নেতারা কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠান—বিনা পরীক্ষায় চালকের লাইসেন্স দেওয়া হোক। কর্তৃপক্ষ কখনো অসহায় হয়ে এবং কখনো অর্থের বিনিময়ে লাইসেন্সটি দিয়ে তার দায়িত্ব পালন করে। এই লাইসেন্স শুধু গাড়ি চালানোর লাইসেন্স, গাড়ি চালানোর সঙ্গে যে সহস্র জীবন যুক্ত আছে, তার জন্য কোনো প্রশিক্ষণ, কোনো ভাবনার প্রয়োজন হয় না!
চালকদের সাধারণত ওস্তাদ ডাকা হয়। ওস্তাদ কখনো ঘুমিয়ে যান এবং তাঁর হেলপার ডান-বাম নির্দেশ করে গাড়িটি চালিয়ে যান। আর চালকদের কাছে মুখ্য হলো ট্রিপ। ট্রিপ যত, টাকা তত। এই বৈধ-অবৈধ টাকাপয়সা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায় রাস্তার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও সমিতির নেতাদের পকেটে। পরিবহনের টাকা তাদের কাছে খুবই নিরাপদ, যা নির্দিষ্ট সময়ে তাদের ঘরে পৌঁছে যায়। গাড়ির মালিকদের কাছে টাকা ছাড়া কোনো বিবেচনা নেই। একটি গাড়ির মালিক এবং এক শ গাড়ির মালিকের কাছে বিবেচনা একটাই—টাকা চাই। চালক সাহেব অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধুরন্ধর, তাঁরা মালিককে নানামুখী প্রতারণায় নাস্তানাবুদ করে ফেলেন। ভদ্র মালিকেরা বহু টাকার ক্ষতি স্বীকার করে গাড়িটি একসময় বিক্রি করে দেন।
চালক এক অসুস্থ জীবনযাপন করেন। সারা রাত ঘুম ঘুম চোখে তিনি ঢাকা থেকে পঞ্চগড় গাড়ি চালিয়ে যান, সেখানে তাঁর জন্য বিশ্রাম, টয়লেট বা স্নানাগারের কোনো সুব্যবস্থা নেই। কোনোমতে এক অস্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে আবার গাড়িতে চেপে বসে ফিরে আসেন ঢাকায়। সেখানেও তাঁর জন্য কোনো সুব্যবস্থা নেই। পরিবারের খোঁজখবর নেওয়ার সময়ও তাঁর নেই, পরিবারের সঙ্গে তাঁর আচরণের সংস্কৃতিটাও তিনি জানেন না। তিনি চেনেন মালিক, নেতা এবং তাঁর কিছু অসুস্থ সঙ্গী। যাত্রীর কথা, পথিকের কথা, দেশের কথা—এসব বিষয় তাঁর বিবেচনাতে থাকে না। এসব অজস্র চালকের হাতে আমরা দেশের পরিবহনকে ছেড়ে দিয়েছি।
১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে রেল সংস্কারের একটা কাজ চলছিল। কিন্তু সামরিক শাসন আসার পর সেসব বন্ধ হয়ে গেল এবং সরু রাস্তায় মিনিবাস ঢুকতে শুরু করল। মিনিবাস, বাস এসবের পাল্লাপাল্লিতে এবং দুর্ঘটনায় ঢাকা-আরিচা সড়কটি যমদূতের পথ হিসেবে চিহ্নিত হলো। ভারতীয়, জাপানিজ ট্রাক-বাসে ভরে গেল সারা দেশ। ওই সময়ে চালকদের লাইসেন্সের কোনো বালাই ছিল না। গত ৫০ বছরে রাজপথের হত্যাকাণ্ডের যদি হিসাব করা যায়, তাহলে আমরা দেখব সম্ভাবনাময় অসংখ্য প্রাণ বলি হয়ে গেছে এই চালকদের কারণে।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে বাস সার্ভিস আছে, মাল পরিবহনের জন্য ট্রাকের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তা খুদে মালিকানার হাতে নয়। বড় বড় করপোরেশন এগুলোর মালিক। আবার তার একটি বিরাট অংশ সরকারি ব্যবস্থাপনায় মানুষের সেবার কাজে নিয়োজিত। আত্মঘাতী বাঙালির জীবনে তেমনি একটি ব্যবস্থা বিআরটিসি বাস। হায়রে দুর্নীতি! দুর্নীতির করালগ্রাসে তা-ও ডুবে গেল এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের অমোঘ নিয়মে তা বছরের পর বছর শুধুই ক্ষতি গুনতে থাকে। আর এসব ক্ষতির কারণ চালক, তাঁর সহকারী এবং ব্যবস্থাপনার তৃণমূল থেকে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত। এভাবেই দিন চলছে।
এর মধ্যে ঘটনাক্রমে কালের সাক্ষী হয়ে বেঁচে রইল ত্রিশালের ওই শিশুটি। সত্যিকার অর্থেই সে মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন। এ কী করে সম্ভব! একজন ট্রাকচালক কত শক্তিশালী? একটা পরিবারকে হত্যা করলেন তিনি! এখন তিনি কোথায়? কার আশ্রয়ে আছেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের আশ্রয় তাঁর কাছে খুবই নিরাপদ। মামলা চলতে থাকবে, বেশ কিছু টাকাপয়সা খরচ হবে এবং একসময় তিনি মুক্তি পেয়ে যাবেন। আমজনতা তো দূরের কথা, দেশের সচেতন নাগরিকেরাও একের পর এক হত্যাকাণ্ডের খোঁজখবর রাখতে পারেন না। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দ্রুত বিচারের কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা-ও মনে হয় রাষ্ট্রের ভাবনার মধ্যে নেই। ঘটনাস্থলেই তাঁদের বিচার করা উচিত। ঘটনাস্থলেই সঠিকভাবে কিছু বিচার হলে এবং যদি চালকেরা বুঝতেন যে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পার পাওয়া যাবে না, তাহলে হয়তো এর একটা সুরাহা হতে পারে।
বাঙালি বড়ই অভিজাত জাতি। গাড়ি চালানোকেও তাঁরা মনে করেন হীন কাজ। একটি কেরানি-পিয়নের চাকরির জন্য লাখ লাখ টাকা নিয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াবেন, কিন্তু পরিবহনের একজন ভালো চালক হওয়ার জন্য তিনি প্রস্তুত নন, তাঁর আত্মাভিমানে লাগে। এই পরিবহনশ্রমিক ও নেতৃত্ব কী ভয়ংকর যে তারা একটি রেললাইনে রেল চলতে দিল না, ট্রেনের যাত্রীদের পাথর ছুড়ে রক্তাক্ত করে দিল! কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত ওই লাইনটি বন্ধ করতে বাধ্য হলো। এখন মনে হচ্ছে পরিবহনশ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে তারপর বিমান বা রেল চালাতে হবে।
কোনো কোনো উদ্যোগ জাতির জন্য যে কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, তার প্রমাণ আমরা বহুবার দেখেছি। অযৌক্তিকভাবে বাসভাড়া বাড়ানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলে তাঁরা সড়ক বন্ধ করে দেন, নানান ধরনের অবরোধ সৃষ্টি করে যাত্রীদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ এবং মারামারিতে লিপ্ত হয়ে পড়েন। সরকার বাধ্য হয়ে আপসের পথ বেছে নেয়। অথচ নেতারা নিজেরা কখনোই পরিবহনশ্রমিক নন, কেউ কেউ মালিকও নন। কিন্তু তাঁরা সরকারি দলের। এই অন্যায্য ঐক্যের বিরুদ্ধে তাঁরাও কোনো কথা বলেন না।
এতক্ষণ যা কিছু লিখলাম তা সবই এ দেশের শিক্ষিত মানুষের জানা। আজ থেকে ২০ বছর পরের কথা ভাবা যাক। ধরে নিই মেয়েটি কোনো না কোনোভাবে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। দেখতে সুশ্রী, ভালো ছাত্রী। কিন্তু তার আপনজন কেউ পৃথিবীতে নেই। মেয়েটি একাকিত্বে ভোগে এবং বাবা, মা, বোনের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। পত্রপত্রিকায় এই সময় ২০২২ সালের ১৭ জুলাই ঘটে যাওয়া সংবাদটি সে সংগ্রহ করেছে। তার এক বন্ধুকে সে লিখতে চায়, ২০ বছর আগের এই সময়টা যখন দুর্ঘটনায় নিহত হলো তার পিতা, মাতা, বোন, তখনকার বাংলাদেশটা কেমন ছিল? সে লিখতে পারে না, পাতাটা সাদা থেকে যায়। প্রতিদিন সে চেষ্টা করে কিছু একটা লিখতে, পারে না। অনেক দিন চেষ্টা করার পর ক্ষোভে, বেদনায়, হাহাকারে কাগজগুলোকে দুমড়েমুচড়ে ছুড়ে ফেলে দেয়।
অনাগত দিনগুলোতে আমরাও কি ওই মেয়েটির সঙ্গে দুমড়েমুচড়ে পড়ে রইব? তখন হয়তো সমাজে বিচার আসবে, শৃঙ্খলা আসবে। কিন্তু সময়টা তাদের কাছে একটা দুমড়ে যাওয়া কাগজের মতোই থাকবে।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৬ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৬ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৬ দিন আগে