বিধান রিবেরু
সবাই হয়তো মুখে বলছে না, কিন্তু বাস্তবতা হলো, দুনিয়ার মানুষ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছে। এর একটি যুদ্ধক্ষেত্র হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে, যেখানে ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, লেবানন ও ইরান জড়িয়ে গেছে। অপর ফ্রন্টটি হলো রাশিয়া ও ইউক্রেনে। এ দুই ফ্রন্টেই একটি পক্ষকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। তো একে আপনি বিশ্বযুদ্ধ না বলে যাবেন কোথায়? বৈশ্বিক এমন টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশে ঘটে গেল জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান। বাংলাদেশের মানুষ নতুন নতুন সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এখন রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। গত দেড় যুগে যাঁরা শাসকদের আনুকূল্য নিয়ে দুর্নীতি করে চিহ্নিত হয়ে গেছেন, তাঁরা হয় অপসারিত, নয় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তো আন্তর্জাতিক ও জাতীয় এই ওলটপালট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অবস্থাটা কেমন?
অবস্থা কেমন, সেটা তলিয়ে দেখার আগে জানা দরকার মানুষ আসলে কী চায়। মানুষ মূলত তিনটি জিনিস চায়। একটি বৈষম্যহীন অর্থনীতি, যার মধ্য দিয়ে মানুষ স্বস্তির সঙ্গে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। দ্বিতীয় জিনিসটি হলো নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন জীবন, মানুষ জানমালের নিরাপত্তা চায়, আর চায় দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড যেন বাধাবিঘ্ন ছাড়া সে করতে পারে। আর তৃতীয়টি হলো সে কথা বলার, নিজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চায়, অর্থাৎ সে চায় গণতন্ত্রের চর্চা করতে। বাংলাদেশের মানুষ এই তিনটি জিনিস একসঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে গত ৫৩ বছরে পায়নি। কাজেই এ দেশের মানুষের অবস্থা কখনোই সুখকর ছিল না।
বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছে না, কিন্তু বিশ্বের অস্থিতিশীলতার প্রভাব পড়ছে বাজারমূল্যে। দ্রব্যমূল্য সামাল দিয়ে বেঁচে থাকা হয়ে উঠছে কঠিন থেকে কঠিনতর। অতি নিম্নমানের খাবারও মানুষকে উচ্চমূল্য দিয়ে কিনতে হয়। যে ওয়াসার পানি হওয়ার কথা ছিল সরাসরি পানযোগ্য, সেটাকে পরিশুদ্ধ করতে মানুষকে গ্যাস পোড়াতে হয়, শোধনযন্ত্র কেনার মতো বাড়তি খরচ করতে হয়। এ দেশে যার অর্থ আছে, সে ভালো বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা পায়। আর যাই হোক, অন্তত চিকিৎসা ও শিক্ষাকে যদি সরকারি ব্যবস্থাপনায় উন্নতমানের করা যেত, বিনা মূল্যে দেওয়া যেত, তাহলে দ্রব্যমূল্যের কারণে নাভিশ্বাস ওঠা দরিদ্র জনগোষ্ঠী কিছুটা স্বস্তি পেত। আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশ ঘুরে এসে যে মানের প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প নির্মাণ করেন, তা হয় দুনিয়ার সবচেয়ে তলানিতে থাকা জিনিসগুলোর মতো। কিন্তু বাজেট আবার উন্নত বিশ্বের মতোই বা তার চেয়েও বেশি। এর মানে, দুর্নীতির মধ্য দিয়েও আমরা আমাদের সমাজে বিকট ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করে চলেছি। আমাদের দেশের মন্ত্রী-আমলারা নিজেদের সন্তানদের বিপুল অর্থ ব্যয় করে বাইরে থেকে লেখাপড়া করিয়ে আনেন। আর সাধারণ মানুষের সন্তানদের জন্য বরাদ্দ রাখেন নামমাত্র অর্থ।
একদিকে আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য, অন্যদিকে জানমালেরও কোনো নিরাপত্তা নেই। রাষ্ট্রের পীড়নমূলক যন্ত্রগুলোর ভূমিকার কথা সবারই জানা। এর বাইরে শাসকগোষ্ঠীর মদদে বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কথাও কারও অজানা নয়। ঘর থেকে রাজপথ—সব জায়গাতেই অপমৃত্যুর ঘটনা বাংলাদেশে নিত্যদিনের। শুধু সড়ক দুর্ঘটনাতেই প্রতিদিন কত মানুষ মারা যাচ্ছে। এখন ডেঙ্গুর মৌসুমেও মানুষ মরছে প্রতিদিন। সরকার না পারছে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে, না পারছে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে। সিটি করপোরেশনগুলো তো বহুদিন ধরেই নগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে কিছুই করতে পারছে না, অথচ মানুষ কর দিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। ১০ মিনিটের বৃষ্টিতেই দেশের রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর ডুবে যাচ্ছে ময়লা পানিতে। কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন এভাবে কীটপতঙ্গের মতো বেঁচে থাকাই আমাদের নিয়তি। যানজটের কথা আর নতুন করে কিছু বলার নেই।
গণতন্ত্রের চর্চা গত ১০ বছরে হয়নি; এখনো দেশে সত্যি বলতে গণতন্ত্র নেই। কারণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ সরকার নির্বাচিত করেনি। মন খুলে কথা বলতে পারছে কি না, সেটাও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নজর দিলে বোঝা যাবে। অনেকেই বলছেন, দেশের সব টিভি নাকি বিটিভিতে পরিণত হয়েছে পুনর্বার।
একদিকে গণতন্ত্রের কথা বললেও আমরা সেটির পত্তন পুরোপুরি ঘটাতে পারিনি। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে পারলেও, মানুষ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। খোদ রাজধানী ঢাকা বহু বছর ধরেই বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকার শীর্ষে। অথচ এসব নিয়ে হেলদোল নেই, আমরা এত দিন শুনেছি সোনার বাংলা ও চেতনার কথা, এখন শুনছি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রের কথা। ভাবাদর্শের নামে এরা সবাই টিনের চশমা পরানোর কাজটা করছে না তো? যদি প্রশ্ন করা হয়, কাদের অন্তর্ভুক্তি? সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম জিইয়ে রেখে, পাহাড়ে সেনাশাসন অব্যাহত রেখে, সমাজে ভিন্নমত দমন করে, মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ যারা করেছে তাদের সমাদর করে, এলজিবিটি কমিউনিটির মানুষের অমর্যাদা দেখিয়ে, কোন ধরনের অন্তর্ভুক্তি চাওয়া হচ্ছে এখন? বলা হচ্ছে সভ্যতা-রাষ্ট্র বা সিভিলাইজেশন স্টেটের কথা, যার মূলে রয়েছে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে উঠে সভ্যতা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপর ভর দিয়ে নতুন ধরনের রাষ্ট্রীয় দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করা। এখন সভ্যতা-রাষ্ট্রের উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভারত, চীন ও ইরানের কথা। এসব দেশে কি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে? বাংলাদেশে হয়েছে। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতিসত্তার উন্মেষ এবং তারই ধারাবাহিকতায় জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাংলাদেশ।
এখন শাসকদের পক্ষ থেকে যখন বলা হয়, বাংলাদেশের রিসেট বাটন চেপে দিতে হবে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না, তারা জাতিরাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস মুছে দিতে চায়। কিন্তু রাজনীতিতে এভাবে কি রিসেট বাটন চাপার কোনো সুযোগ আদৌ আছে? বাংলাদেশের জন্ম ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইতিহাসকে মোকাবিলা করেই আপনাকে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে হবে। ইতিহাস নাকচের মধ্য দিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। রাজনীতি বা ইতিহাস তো কম্পিউটার নয় যে আপনি রিসেট বা রিবুট করে দেবেন। এসব অবাস্তব কথা বাদ দিয়ে আমার মনে হয়, রাষ্ট্রের জন্য যেগুলো এখনই অবশ্যকরণীয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। প্রত্যেক সরকারেরই স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা বাঞ্ছনীয়।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যখন নির্বাচিত সরকার আসবে, তখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অর্থনীতিকে ঢেলে সাজিয়ে যদি খাদ্য, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকার কাজ শুরু করে, তাহলে ধীরে ধীরে এর সুফল পেতে শুরু করবে জনগণ। সরকারও প্রশংসিত হবে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে অন্তর্ভুক্তি ও সংস্কারের যে কথাবার্তা শুরু হয়েছে, সেটিকে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার মিশেল ঘটিয়ে যদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা যায়, তাহলে তার ফলও এ দেশের পরবর্তী প্রজন্ম পাবে। রাষ্ট্র পরিচালনা এক বড় রাজনৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করতে প্রয়োজন দীর্ঘদিনের চর্চা ও মনোনিবেশ। আমি মনে করি, রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য হতে হয় সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। কারণ সমাজের নাড়ি না বুঝে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় না। আবার এটাও ঠিক, সমাজে অনেক সময় অধিকাংশ লোক ভুল ও অযৌক্তিক দাবিও তুলতে পারে। সেটিকে কৌশলে যুক্তির দ্বারা পরাস্ত করাও রাষ্ট্রের কর্তব্য। কারণ রাষ্ট্রকে আপস করলে চলে না। তার কাছে সব নাগরিক সমান। তাই রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের হওয়া উচিত মেকিয়াভেলির ভাষায় একাধারে সিংহ ও শিয়াল। আর এই রূপকই লুই আলথুসারের জবানে হয়ে উঠেছে রিপ্রেসিভ স্টেট এপারেটাস ও ইডিওলজিক্যাল স্টেট এপারেটাস। বাংলাদেশ যেহেতু পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবেই আরও বিকশিত হতে চায়, তাই বলতে চাই, বিশ্বের অন্যান্য উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চেহারা যদি বাংলাদেশের অর্জন করতে হয়, তাহলে সবার আগে এ দেশের মানুষের চিন্তাকে পরিশীলিত করতে হবে। আর এটা সম্ভব অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে সংস্কৃতিকে কম গুরুত্ব দিলে হবে না। মানুষকে কূপমণ্ডূকতা থেকে বের করে, তাদের ভেতরের সুকুমারবৃত্তি জাগ্রত করতে চাইলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে প্রসারিত করতে হবে। দেশের মানুষ যদি উন্নত চিন্তা করতে শুরু করে, তাহলে দেশও উন্নত হতে শুরু করবে।
লেখক: বিধান রিবেরু
প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র শিক্ষক
সবাই হয়তো মুখে বলছে না, কিন্তু বাস্তবতা হলো, দুনিয়ার মানুষ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছে। এর একটি যুদ্ধক্ষেত্র হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে, যেখানে ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, লেবানন ও ইরান জড়িয়ে গেছে। অপর ফ্রন্টটি হলো রাশিয়া ও ইউক্রেনে। এ দুই ফ্রন্টেই একটি পক্ষকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। তো একে আপনি বিশ্বযুদ্ধ না বলে যাবেন কোথায়? বৈশ্বিক এমন টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশে ঘটে গেল জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান। বাংলাদেশের মানুষ নতুন নতুন সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এখন রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। গত দেড় যুগে যাঁরা শাসকদের আনুকূল্য নিয়ে দুর্নীতি করে চিহ্নিত হয়ে গেছেন, তাঁরা হয় অপসারিত, নয় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তো আন্তর্জাতিক ও জাতীয় এই ওলটপালট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অবস্থাটা কেমন?
অবস্থা কেমন, সেটা তলিয়ে দেখার আগে জানা দরকার মানুষ আসলে কী চায়। মানুষ মূলত তিনটি জিনিস চায়। একটি বৈষম্যহীন অর্থনীতি, যার মধ্য দিয়ে মানুষ স্বস্তির সঙ্গে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। দ্বিতীয় জিনিসটি হলো নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন জীবন, মানুষ জানমালের নিরাপত্তা চায়, আর চায় দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড যেন বাধাবিঘ্ন ছাড়া সে করতে পারে। আর তৃতীয়টি হলো সে কথা বলার, নিজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চায়, অর্থাৎ সে চায় গণতন্ত্রের চর্চা করতে। বাংলাদেশের মানুষ এই তিনটি জিনিস একসঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে গত ৫৩ বছরে পায়নি। কাজেই এ দেশের মানুষের অবস্থা কখনোই সুখকর ছিল না।
বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছে না, কিন্তু বিশ্বের অস্থিতিশীলতার প্রভাব পড়ছে বাজারমূল্যে। দ্রব্যমূল্য সামাল দিয়ে বেঁচে থাকা হয়ে উঠছে কঠিন থেকে কঠিনতর। অতি নিম্নমানের খাবারও মানুষকে উচ্চমূল্য দিয়ে কিনতে হয়। যে ওয়াসার পানি হওয়ার কথা ছিল সরাসরি পানযোগ্য, সেটাকে পরিশুদ্ধ করতে মানুষকে গ্যাস পোড়াতে হয়, শোধনযন্ত্র কেনার মতো বাড়তি খরচ করতে হয়। এ দেশে যার অর্থ আছে, সে ভালো বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা পায়। আর যাই হোক, অন্তত চিকিৎসা ও শিক্ষাকে যদি সরকারি ব্যবস্থাপনায় উন্নতমানের করা যেত, বিনা মূল্যে দেওয়া যেত, তাহলে দ্রব্যমূল্যের কারণে নাভিশ্বাস ওঠা দরিদ্র জনগোষ্ঠী কিছুটা স্বস্তি পেত। আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশ ঘুরে এসে যে মানের প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প নির্মাণ করেন, তা হয় দুনিয়ার সবচেয়ে তলানিতে থাকা জিনিসগুলোর মতো। কিন্তু বাজেট আবার উন্নত বিশ্বের মতোই বা তার চেয়েও বেশি। এর মানে, দুর্নীতির মধ্য দিয়েও আমরা আমাদের সমাজে বিকট ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করে চলেছি। আমাদের দেশের মন্ত্রী-আমলারা নিজেদের সন্তানদের বিপুল অর্থ ব্যয় করে বাইরে থেকে লেখাপড়া করিয়ে আনেন। আর সাধারণ মানুষের সন্তানদের জন্য বরাদ্দ রাখেন নামমাত্র অর্থ।
একদিকে আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য, অন্যদিকে জানমালেরও কোনো নিরাপত্তা নেই। রাষ্ট্রের পীড়নমূলক যন্ত্রগুলোর ভূমিকার কথা সবারই জানা। এর বাইরে শাসকগোষ্ঠীর মদদে বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কথাও কারও অজানা নয়। ঘর থেকে রাজপথ—সব জায়গাতেই অপমৃত্যুর ঘটনা বাংলাদেশে নিত্যদিনের। শুধু সড়ক দুর্ঘটনাতেই প্রতিদিন কত মানুষ মারা যাচ্ছে। এখন ডেঙ্গুর মৌসুমেও মানুষ মরছে প্রতিদিন। সরকার না পারছে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে, না পারছে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে। সিটি করপোরেশনগুলো তো বহুদিন ধরেই নগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে কিছুই করতে পারছে না, অথচ মানুষ কর দিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। ১০ মিনিটের বৃষ্টিতেই দেশের রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর ডুবে যাচ্ছে ময়লা পানিতে। কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন এভাবে কীটপতঙ্গের মতো বেঁচে থাকাই আমাদের নিয়তি। যানজটের কথা আর নতুন করে কিছু বলার নেই।
গণতন্ত্রের চর্চা গত ১০ বছরে হয়নি; এখনো দেশে সত্যি বলতে গণতন্ত্র নেই। কারণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ সরকার নির্বাচিত করেনি। মন খুলে কথা বলতে পারছে কি না, সেটাও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নজর দিলে বোঝা যাবে। অনেকেই বলছেন, দেশের সব টিভি নাকি বিটিভিতে পরিণত হয়েছে পুনর্বার।
একদিকে গণতন্ত্রের কথা বললেও আমরা সেটির পত্তন পুরোপুরি ঘটাতে পারিনি। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে পারলেও, মানুষ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। খোদ রাজধানী ঢাকা বহু বছর ধরেই বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকার শীর্ষে। অথচ এসব নিয়ে হেলদোল নেই, আমরা এত দিন শুনেছি সোনার বাংলা ও চেতনার কথা, এখন শুনছি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রের কথা। ভাবাদর্শের নামে এরা সবাই টিনের চশমা পরানোর কাজটা করছে না তো? যদি প্রশ্ন করা হয়, কাদের অন্তর্ভুক্তি? সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম জিইয়ে রেখে, পাহাড়ে সেনাশাসন অব্যাহত রেখে, সমাজে ভিন্নমত দমন করে, মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ যারা করেছে তাদের সমাদর করে, এলজিবিটি কমিউনিটির মানুষের অমর্যাদা দেখিয়ে, কোন ধরনের অন্তর্ভুক্তি চাওয়া হচ্ছে এখন? বলা হচ্ছে সভ্যতা-রাষ্ট্র বা সিভিলাইজেশন স্টেটের কথা, যার মূলে রয়েছে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে উঠে সভ্যতা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপর ভর দিয়ে নতুন ধরনের রাষ্ট্রীয় দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করা। এখন সভ্যতা-রাষ্ট্রের উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভারত, চীন ও ইরানের কথা। এসব দেশে কি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে? বাংলাদেশে হয়েছে। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতিসত্তার উন্মেষ এবং তারই ধারাবাহিকতায় জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাংলাদেশ।
এখন শাসকদের পক্ষ থেকে যখন বলা হয়, বাংলাদেশের রিসেট বাটন চেপে দিতে হবে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না, তারা জাতিরাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস মুছে দিতে চায়। কিন্তু রাজনীতিতে এভাবে কি রিসেট বাটন চাপার কোনো সুযোগ আদৌ আছে? বাংলাদেশের জন্ম ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইতিহাসকে মোকাবিলা করেই আপনাকে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে হবে। ইতিহাস নাকচের মধ্য দিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। রাজনীতি বা ইতিহাস তো কম্পিউটার নয় যে আপনি রিসেট বা রিবুট করে দেবেন। এসব অবাস্তব কথা বাদ দিয়ে আমার মনে হয়, রাষ্ট্রের জন্য যেগুলো এখনই অবশ্যকরণীয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। প্রত্যেক সরকারেরই স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা বাঞ্ছনীয়।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যখন নির্বাচিত সরকার আসবে, তখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অর্থনীতিকে ঢেলে সাজিয়ে যদি খাদ্য, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকার কাজ শুরু করে, তাহলে ধীরে ধীরে এর সুফল পেতে শুরু করবে জনগণ। সরকারও প্রশংসিত হবে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে অন্তর্ভুক্তি ও সংস্কারের যে কথাবার্তা শুরু হয়েছে, সেটিকে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার মিশেল ঘটিয়ে যদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা যায়, তাহলে তার ফলও এ দেশের পরবর্তী প্রজন্ম পাবে। রাষ্ট্র পরিচালনা এক বড় রাজনৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করতে প্রয়োজন দীর্ঘদিনের চর্চা ও মনোনিবেশ। আমি মনে করি, রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য হতে হয় সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। কারণ সমাজের নাড়ি না বুঝে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় না। আবার এটাও ঠিক, সমাজে অনেক সময় অধিকাংশ লোক ভুল ও অযৌক্তিক দাবিও তুলতে পারে। সেটিকে কৌশলে যুক্তির দ্বারা পরাস্ত করাও রাষ্ট্রের কর্তব্য। কারণ রাষ্ট্রকে আপস করলে চলে না। তার কাছে সব নাগরিক সমান। তাই রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের হওয়া উচিত মেকিয়াভেলির ভাষায় একাধারে সিংহ ও শিয়াল। আর এই রূপকই লুই আলথুসারের জবানে হয়ে উঠেছে রিপ্রেসিভ স্টেট এপারেটাস ও ইডিওলজিক্যাল স্টেট এপারেটাস। বাংলাদেশ যেহেতু পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবেই আরও বিকশিত হতে চায়, তাই বলতে চাই, বিশ্বের অন্যান্য উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চেহারা যদি বাংলাদেশের অর্জন করতে হয়, তাহলে সবার আগে এ দেশের মানুষের চিন্তাকে পরিশীলিত করতে হবে। আর এটা সম্ভব অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে সংস্কৃতিকে কম গুরুত্ব দিলে হবে না। মানুষকে কূপমণ্ডূকতা থেকে বের করে, তাদের ভেতরের সুকুমারবৃত্তি জাগ্রত করতে চাইলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে প্রসারিত করতে হবে। দেশের মানুষ যদি উন্নত চিন্তা করতে শুরু করে, তাহলে দেশও উন্নত হতে শুরু করবে।
লেখক: বিধান রিবেরু
প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র শিক্ষক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
১ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৪ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৮ দিন আগে