বিভুরঞ্জন সরকার
নির্বাচন ইস্যুতে মতপ্রার্থক্য দূর করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। সংলাপের প্রশ্নে বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আগাগোড়াই অনাগ্রহ দেখিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে সন্ত্রাসী ও খুনিদের দল উল্লেখ করে আলোচনায় বসার বিষয়টি বরাবর নাকচ করে আসছেন। আবার বিএনপিও ক্ষমতা না ছাড়লে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায় না। তবে ‘রাজনীতিতে শেষ কথা নেই’ বলে যে সুবিধাবাদী বাক্য চালু করা হয়েছে, এর ওপর ভরসা করেই কেউ কেউ শেষ মুহূর্তে আলোচনা বা সংলাপের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠছেন; বিশেষ করে আমেরিকার তৎপরতার কারণে সংলাপের সম্ভাবনা দেখা হচ্ছে।
গত সোমবার প্রধান তিন রাজনৈতিক দল—ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে নিঃশর্ত সংলাপে বসার তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সংলাপের তাগিদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লুর লেখা চিঠি পৌঁছে দিয়েছেন ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। দূতাবাসের মুখপাত্র বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এ ছাড়া নির্বাচনের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সহিংসতা এড়ানো ও সংযম মেনে চলারও আহ্বান জানানো হয়েছে। নির্বাচনে কোনো দলকেই যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে না উল্লেখ করে দূতাবাস বলেছে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে যে-ই বাধাগ্রস্ত করুক, তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ঘোষিত ভিসা নীতি প্রয়োগ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কেন আবারও এই সংলাপের প্রস্তাব? রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় চলে এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো কেউ কাউকে ছাড় না দেওয়ার মনোভাবে অটল থাকায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠছে এবং বড় রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া কারও কারও মধ্যে এমন ধারণাও তৈরি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিশেষ দলের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ক্ষোভ ও অবিশ্বাস থেকে রাজনৈতিক কর্মীদের কেউ কেউ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করছেন। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অতি তৎপরতা ভারতের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়নি। দিল্লিতে ১০ নভেম্বর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে টু প্লাস টু বৈঠকের পর ভারতের অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জানান, বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে দুই দেশের নেতারা আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই স্পষ্ট করে তুলে ধরেছি। তৃতীয় কোনো দেশের নীতিমালা নিয়ে আমাদের মন্তব্য করার জায়গা নেই। বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে দেশের মানুষ তাঁদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
বাংলাদেশের কেউ কেউ মনে করেন, ভারতের সঙ্গে পুরো একমত না হলেও ভূরাজনৈতিক কারণে দিল্লিকে অখুশি করার ঝুঁকিও সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র নিতে চায় না। চীন ইস্যুতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। নির্বাচন নিয়ে হস্তক্ষেপ করে ভারত যেমন বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের অবনতি চাইবে না, একইভাবে চীনের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক দিল্লিকে ছাপিয়ে যাক, সেটিও ভারতের কাম্য নয়। আবার যুক্তরাষ্ট্রও এই অঞ্চলে ভারতের মাধ্যমে তাদের প্রভাব ধরে রাখতে চায়। তাই বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের স্পষ্ট অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা।
নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার আগমুহূর্তে সংলাপের প্রস্তাব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি এটাই স্পষ্ট করতে চেয়েছে যে তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিচ্ছে? বিশেষ কোনো দলকে ক্ষমতায় আনা বা ক্ষমতা থেকে সরাতে চায় না—এটাও কী স্পষ্ট করা হলো? জামায়াতে ইসলামীকে চিঠি না দেওয়াও কী গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নয়?
২০১৪ সালে বিএনপি এবং তার মিত্ররা বর্জন করায় একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ওই সময় বিদেশিদের মধ্যস্থতায় দেনদরবার হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি অনড় থাকায় তা ভেস্তে যায়। ২০১৮ সালে বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপ হয়েছিল। ওই নির্বাচনে সবাই অংশ নিলেও নির্বাচনের পর ভোট ডাকাতির অভিযোগ তোলে বিরোধীরা। আবার ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপিসহ অন্যরা সংসদে যোগ দেয়। তবে এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বর্জন করে বিএনপি। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপিসহ বিরোধীরা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে আসছে।
আবার যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নও বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশা জানিয়ে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতিও ঘোষণা করেছে।
সরকার নিরপেক্ষ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নাকচ করে সংবিধান অনুযায়ী আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করার পক্ষে। সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে বলেও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। রাজনীতিতে ঐকমত্যের বদলে বিভেদের পথ প্রশস্ত হয়েছে। জাতীয় স্বার্থের চেয়ে কারও কারও কাছে দলীয় স্বার্থ বড় হয়ে ওঠায় জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কেবলই দূরে চলে গেছে। দেশ শাসনে সুশাসনের ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ত্রুটি-দুর্বলতার সুযোগে স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী দল ও ব্যক্তিরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হয়েছে।
দেশ শাসনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ও জাতীয় পার্টি তথা আওয়ামী লীগবিরোধী দুই তরফের রাজনীতিই মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। মোটা দাগে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু, মোশতাক, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার শাসন মানুষ দেখেছে। কিন্তু সব শাসনকাল মানুষের মনে সমান আস্থা জাগাতে পেরেছে, তা অবশ্যই নয়।
বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের যে সমর্থন আমরা দেখি এটা দলগত, গোষ্ঠীগত ও সামাজিক দলাদলির একটা প্রকাশমাত্র। নীতিগত, আদর্শগত ও দেশপ্রেম থেকে উৎসারিত নয়। এমপি হওয়ার জন্য, ক্ষমতা ও সুবিধা ভোগ করার জন্য শক্তিমানেরা দল করে এবং দল দখল করে নেয়। নীতিমান, আদর্শবান ও দেশপ্রেমিকেরা ছিটকে পড়েছেন অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। ফলে রাজনীতির ভারসাম্য যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনি নেতৃত্বেও একটা বড় শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।
আর সে জন্যই এসেছে জাতির নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশ্ন। কিন্তু কীভাবে? কার নেতৃত্বে এই ঘুরে দাঁড়ানো?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে বাংলাদেশের জনগণ, রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তিগুলোকেই। সে জন্য প্রথমে সব পক্ষকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের পক্ষে আসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো অবকাশ নেই। বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান কিছুদিন আগে একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যে-ই বাংলাদেশে রাজনীতি করুক না কেন, তাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বাইরে কোনো রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার সুযোগ বাংলাদেশের মাটিতে দেওয়া উচিত নয়। কারণ সেটা হবে আমার রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান।’
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই ঘুরে দাঁড়ানোর কাজটি কি শুরু হতে পারে না? এক দফা ও গণ-অভ্যুত্থান ইত্যাদি বুলি না কপচে বাস্তবতার আলোকে পথ চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের আজকের পরিস্থিতির জন্য সব পক্ষেরই কমবেশি দায় আছে। বাটখারা দিয়ে শুধু অন্যের পাপ না মেপে নিজের পাপও মাপা উচিত।
আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর দেশ শাসন করলেও নিজ দলের ভালোদের সামনে আনতে না পারার ব্যর্থতার দায় আছে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। ব্যাপক অর্থ পাচার হয়েছে। ক্ষমতাবানদের ঔদ্ধত্য ও বাড়াবাড়িতে মানুষ অতিষ্ঠ হয়েছে।
বিএনপি গত ১৫ বছরে নিজেদের দলকে সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নিজেদের অবস্থানও পরিষ্কার করতে পারেনি। তারা আওয়ামী লীগবিরোধিতাকে পুঁজি করে গতানুগতিক রাজনীতি করে গেছে। এখন সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
মানুষ যদি আসলেই বিএনপিকে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো আসনে নির্বাচিত করে তারা নিশ্চয়ই ক্ষমতায় যাবে। কিন্তু নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা না দিয়ে এক দফার আন্দোলন কেন? বঙ্গবন্ধু তো সত্তর সালে ইয়াহিয়ার লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) অধীনে নির্বাচন করে জয়লাভ করেছিলেন। বিএনপিকেও শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
সব দল নির্বাচনে অংশ নিলে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য এক নতুন ইতিহাস তৈরি করবে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আর আজকের মতো থাকতে পারবে না, বিএনপির মধ্যেও পরিবর্তন আসবে। কোনো কিছুই আগের মতো থাকবে না।
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
নির্বাচন ইস্যুতে মতপ্রার্থক্য দূর করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। সংলাপের প্রশ্নে বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আগাগোড়াই অনাগ্রহ দেখিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে সন্ত্রাসী ও খুনিদের দল উল্লেখ করে আলোচনায় বসার বিষয়টি বরাবর নাকচ করে আসছেন। আবার বিএনপিও ক্ষমতা না ছাড়লে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায় না। তবে ‘রাজনীতিতে শেষ কথা নেই’ বলে যে সুবিধাবাদী বাক্য চালু করা হয়েছে, এর ওপর ভরসা করেই কেউ কেউ শেষ মুহূর্তে আলোচনা বা সংলাপের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠছেন; বিশেষ করে আমেরিকার তৎপরতার কারণে সংলাপের সম্ভাবনা দেখা হচ্ছে।
গত সোমবার প্রধান তিন রাজনৈতিক দল—ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে নিঃশর্ত সংলাপে বসার তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সংলাপের তাগিদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লুর লেখা চিঠি পৌঁছে দিয়েছেন ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। দূতাবাসের মুখপাত্র বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এ ছাড়া নির্বাচনের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সহিংসতা এড়ানো ও সংযম মেনে চলারও আহ্বান জানানো হয়েছে। নির্বাচনে কোনো দলকেই যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে না উল্লেখ করে দূতাবাস বলেছে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে যে-ই বাধাগ্রস্ত করুক, তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ঘোষিত ভিসা নীতি প্রয়োগ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কেন আবারও এই সংলাপের প্রস্তাব? রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় চলে এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো কেউ কাউকে ছাড় না দেওয়ার মনোভাবে অটল থাকায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠছে এবং বড় রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া কারও কারও মধ্যে এমন ধারণাও তৈরি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিশেষ দলের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ক্ষোভ ও অবিশ্বাস থেকে রাজনৈতিক কর্মীদের কেউ কেউ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করছেন। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অতি তৎপরতা ভারতের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়নি। দিল্লিতে ১০ নভেম্বর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে টু প্লাস টু বৈঠকের পর ভারতের অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জানান, বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে দুই দেশের নেতারা আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই স্পষ্ট করে তুলে ধরেছি। তৃতীয় কোনো দেশের নীতিমালা নিয়ে আমাদের মন্তব্য করার জায়গা নেই। বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে দেশের মানুষ তাঁদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
বাংলাদেশের কেউ কেউ মনে করেন, ভারতের সঙ্গে পুরো একমত না হলেও ভূরাজনৈতিক কারণে দিল্লিকে অখুশি করার ঝুঁকিও সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র নিতে চায় না। চীন ইস্যুতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। নির্বাচন নিয়ে হস্তক্ষেপ করে ভারত যেমন বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের অবনতি চাইবে না, একইভাবে চীনের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক দিল্লিকে ছাপিয়ে যাক, সেটিও ভারতের কাম্য নয়। আবার যুক্তরাষ্ট্রও এই অঞ্চলে ভারতের মাধ্যমে তাদের প্রভাব ধরে রাখতে চায়। তাই বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের স্পষ্ট অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা।
নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার আগমুহূর্তে সংলাপের প্রস্তাব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি এটাই স্পষ্ট করতে চেয়েছে যে তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিচ্ছে? বিশেষ কোনো দলকে ক্ষমতায় আনা বা ক্ষমতা থেকে সরাতে চায় না—এটাও কী স্পষ্ট করা হলো? জামায়াতে ইসলামীকে চিঠি না দেওয়াও কী গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নয়?
২০১৪ সালে বিএনপি এবং তার মিত্ররা বর্জন করায় একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ওই সময় বিদেশিদের মধ্যস্থতায় দেনদরবার হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি অনড় থাকায় তা ভেস্তে যায়। ২০১৮ সালে বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপ হয়েছিল। ওই নির্বাচনে সবাই অংশ নিলেও নির্বাচনের পর ভোট ডাকাতির অভিযোগ তোলে বিরোধীরা। আবার ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপিসহ অন্যরা সংসদে যোগ দেয়। তবে এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বর্জন করে বিএনপি। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপিসহ বিরোধীরা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে আসছে।
আবার যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নও বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশা জানিয়ে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতিও ঘোষণা করেছে।
সরকার নিরপেক্ষ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নাকচ করে সংবিধান অনুযায়ী আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করার পক্ষে। সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে বলেও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। রাজনীতিতে ঐকমত্যের বদলে বিভেদের পথ প্রশস্ত হয়েছে। জাতীয় স্বার্থের চেয়ে কারও কারও কাছে দলীয় স্বার্থ বড় হয়ে ওঠায় জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কেবলই দূরে চলে গেছে। দেশ শাসনে সুশাসনের ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ত্রুটি-দুর্বলতার সুযোগে স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী দল ও ব্যক্তিরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হয়েছে।
দেশ শাসনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ও জাতীয় পার্টি তথা আওয়ামী লীগবিরোধী দুই তরফের রাজনীতিই মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। মোটা দাগে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু, মোশতাক, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার শাসন মানুষ দেখেছে। কিন্তু সব শাসনকাল মানুষের মনে সমান আস্থা জাগাতে পেরেছে, তা অবশ্যই নয়।
বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের যে সমর্থন আমরা দেখি এটা দলগত, গোষ্ঠীগত ও সামাজিক দলাদলির একটা প্রকাশমাত্র। নীতিগত, আদর্শগত ও দেশপ্রেম থেকে উৎসারিত নয়। এমপি হওয়ার জন্য, ক্ষমতা ও সুবিধা ভোগ করার জন্য শক্তিমানেরা দল করে এবং দল দখল করে নেয়। নীতিমান, আদর্শবান ও দেশপ্রেমিকেরা ছিটকে পড়েছেন অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। ফলে রাজনীতির ভারসাম্য যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনি নেতৃত্বেও একটা বড় শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।
আর সে জন্যই এসেছে জাতির নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশ্ন। কিন্তু কীভাবে? কার নেতৃত্বে এই ঘুরে দাঁড়ানো?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে বাংলাদেশের জনগণ, রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তিগুলোকেই। সে জন্য প্রথমে সব পক্ষকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের পক্ষে আসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো অবকাশ নেই। বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান কিছুদিন আগে একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যে-ই বাংলাদেশে রাজনীতি করুক না কেন, তাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বাইরে কোনো রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার সুযোগ বাংলাদেশের মাটিতে দেওয়া উচিত নয়। কারণ সেটা হবে আমার রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান।’
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই ঘুরে দাঁড়ানোর কাজটি কি শুরু হতে পারে না? এক দফা ও গণ-অভ্যুত্থান ইত্যাদি বুলি না কপচে বাস্তবতার আলোকে পথ চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের আজকের পরিস্থিতির জন্য সব পক্ষেরই কমবেশি দায় আছে। বাটখারা দিয়ে শুধু অন্যের পাপ না মেপে নিজের পাপও মাপা উচিত।
আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর দেশ শাসন করলেও নিজ দলের ভালোদের সামনে আনতে না পারার ব্যর্থতার দায় আছে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। ব্যাপক অর্থ পাচার হয়েছে। ক্ষমতাবানদের ঔদ্ধত্য ও বাড়াবাড়িতে মানুষ অতিষ্ঠ হয়েছে।
বিএনপি গত ১৫ বছরে নিজেদের দলকে সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নিজেদের অবস্থানও পরিষ্কার করতে পারেনি। তারা আওয়ামী লীগবিরোধিতাকে পুঁজি করে গতানুগতিক রাজনীতি করে গেছে। এখন সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
মানুষ যদি আসলেই বিএনপিকে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো আসনে নির্বাচিত করে তারা নিশ্চয়ই ক্ষমতায় যাবে। কিন্তু নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা না দিয়ে এক দফার আন্দোলন কেন? বঙ্গবন্ধু তো সত্তর সালে ইয়াহিয়ার লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) অধীনে নির্বাচন করে জয়লাভ করেছিলেন। বিএনপিকেও শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
সব দল নির্বাচনে অংশ নিলে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য এক নতুন ইতিহাস তৈরি করবে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আর আজকের মতো থাকতে পারবে না, বিএনপির মধ্যেও পরিবর্তন আসবে। কোনো কিছুই আগের মতো থাকবে না।
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৯ ঘণ্টা আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৯ ঘণ্টা আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৯ ঘণ্টা আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
১০ ঘণ্টা আগে