আবু তাহের খান
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গত ৩০ অক্টোবর ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং বিশ্বব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত জ্বালানি ব্যবহারসংক্রান্ত দুদিনব্যাপী এক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বলেছেন, ‘হাওর এলাকায় আর কোনো সড়ক নির্মাণ করা হবে না’ (আজকের পত্রিকা, ৩১ অক্টোবর ২০২৩)। পরিকল্পনামন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করার আগে এ-সংক্রান্ত কিছু তথ্য সামনে আনা যেতে পারে বলে মনে করি, যার প্রথমটি হচ্ছে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কসংক্রান্ত।
২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ উক্ত সড়কের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের সাড়ে চার বছরের কম সময়ের ব্যবধানে এবং নির্ধারিত সময়ের কয়েক মাস আগে ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর উক্ত সড়কের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মোট ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ২৯ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের উদ্বোধনকালে বলা হয়েছিল, এর মধ্য দিয়ে হাওরাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হলো।
এখন প্রশ্ন দুটি: এক. ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে ওই এলাকার সাধারণ মানুষের লালিত স্বপ্ন আসলেই পূরণ হয়েছে কি না; এবং দুই. অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ কেনই-বা হাওরে সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন? প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেতে প্রথমেই জানা দরকার, ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের যাতায়াতের কষ্ট লাঘবের জন্য আসলে কী ধরনের রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রয়োজন। জবাবে বলব, তাদের সাধারণ প্রত্যাশা হচ্ছে বিদ্যমান সেকেলে নৌযানব্যবস্থার বিপরীতে একটি মোটরযানচালিত আধুনিক যোগাযোগ অবকাঠামো।
তা সেটি সড়ক, সেতু, নাকি টানেল—সেটি মুখ্য বিবেচ্য নয়। সে ক্ষেত্রে এর মধ্যে কোনটি ওই অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত, তা নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ যে এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, তা এরই মধ্যে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আরও প্রমাণিত হয়েছে, হাওর অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ও জলাভূমির গঠন বিবেচনায় সেখানে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণ একেবারেই সমীচীন হয়নি।
আর তাই এ নিয়ে উক্ত সড়ক উদ্বোধনের আড়াই বছর পেরোতে না পেরোতেই পরিকল্পনামন্ত্রী এই বলে হতাশা ব্যক্ত করলেন যে ‘এখন টের পাচ্ছি, হাওরে সড়ক নির্মাণ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। হাওরে সড়ক বানিয়ে উপকারের চেয়ে অপকারই হয়েছে।’ (প্রথম আলো, ২০ মে ২০২৩) এবার দ্বিতীয় প্রশ্নের অর্থাৎ অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ কেন হাওরে সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সে জিজ্ঞাসার জবাব খোঁজার চেষ্টা। হাওর অঞ্চলের পশ্চাৎপদ যোগাযোগব্যবস্থার অন্যতম ভুক্তভোগী হিসেবে তাঁর কাছে হয়তো মনে হয়েছিল, সড়ক নির্মাণই হচ্ছে এর সমাধান এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় দপ্তরকে তিনি হয়তো তেমনটিই বলেছিলেন।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় দপ্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে তখন বলা দরকার ছিল যে ওই এলাকার ভূপ্রাকৃতিক গঠন ও পরিবেশের বিবেচনায় সেখানে সড়ক নির্মাণ করাটা সমীচীন হবে না; বরং তার পরিবর্তে দীর্ঘ সেতু বা বিকল্প কোনো ব্যবস্থার কথা ভাবা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ সে পথে না হেঁটে ‘রাষ্ট্রপতি চেয়েছেন’ এটাকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়েছে, যেটি বাংলাদেশের মুৎসুদ্দি আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি ঘৃণ্য ত্রুটিপূর্ণ দিক। যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাইপূর্বক তার ফলাফলের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতিকে যদি বুঝিয়ে বলা যেত, ওখানে সড়ক নির্মাণ করাটা সমীচীন হবে না বা তার পরিবর্তে বিকল্প উপায়ের কথা তাঁরা বলতেন, তাহলে নিশ্চয় তিনি মেনে নিতেন। কিন্তু এ দেশের চাটুকার আমলারা প্রায় কখনোই তা করেন না।
এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকভাবেই কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসে। ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণের আগে সত্যি কি যথাযথভাবে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল? হয়ে থাকলে তা যাচাইয়ে কেন এটি ধরা পড়ল না যে এ ধরনের সড়ক নির্মাণ করা হলে সেই অঞ্চলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হবে, নতুন করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে এবং সামগ্রিক পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এর মানে হচ্ছে, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজটি যথাযথভাবে হয়নি, যেমনটি এ দেশের অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে হয় না।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার কর্তৃক যেসব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, বলাই যায়, এগুলোর বেশির ভাগই উপযুক্ত সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিবেচনায় গ্রহণ করা হয়েছে। আর এসব বিবেচনার মধ্যে অন্তত একটি হচ্ছে বেশি বেশি নির্মাণকাজের সঙ্গে কার্যাদেশদাতা ও কার্যাদেশ লাভকারী—উভয় পক্ষের বেশি বেশি যুক্ত থাকতে পারার আনন্দ। আর এটি যে কত বেশি সত্য, তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ হচ্ছে নানা প্রতিষ্ঠানের আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা বহুসংখ্যক বহুতল ভবন ও অন্যান্য স্থাপনা অব্যবহৃত পড়ে থাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে গড়ে ওঠা এমন কয়েকটি উড়ালসড়ক সম্প্রতি নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলো যানজট নিরসনের পরিবর্তে তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এবার হাওরের বুক চিরে সড়ক নির্মাণসংক্রান্ত মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক। বাংলাদেশের মতো নিচু ভূমির দেশ ছাড়াও পৃথিবীতে এমন আরও কিছু কিছু দেশ রয়েছে, যেখানে আধুনিক নৌযানব্যবস্থাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রধান, জুতসই ও জনপ্রিয় যানবাহন হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। যেমন ইউরোপের নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, এশিয়ার থাইল্যান্ড ও মালদ্বীপ, আফ্রিকার সেনেগাল, দক্ষিণ আমেরিকার চিলি ইত্যাদি। বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলেও এ ধরনের যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবা যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে দীর্ঘ সেতু নির্মাণের কথা ভাবাটাও সমীচীন বলে মনে হয় না। বঙ্গবন্ধু সেতু বা পদ্মা সেতুর তুলনায় এ ধরনের সেতু তো একেবারেই নস্যি।তবে শেষ পর্যন্ত কী বা কোনটি করা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত প্রকৃত বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত গভীরতাপূর্ণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ভিত্তিতে—সব বিষয়ে পণ্ডিত আমলা-সদস্যের তাৎক্ষণিক মতামত বা অপরিপক্ব রাজনৈতিক সুপারিশের ভিত্তিতে নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ধ্বংস করে এরই মধ্যে যেসব সড়ক নির্মিত হয়ে গেছে, সেগুলোর কী হবে? এ প্রশ্নের বস্তুত কোনো জবাব নেই। তবে উত্তম হতো যদি এ সড়কগুলোকে হাতিরঝিলে অবৈধভাবে নির্মিত বিজিএমইএ ভবনের মতো নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু সেটি তো এখন আর সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় গত শতাব্দীর ষাটের দশকে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে রাঙামাটির বিস্তীর্ণ এলাকার হাজার হাজার মানুষকে যেমন নবসৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদের পানির নিচে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ককেও এখন তেমনটি গণ্য করা যেতে পারে, যা এখন ওই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের নতুন করে বাড়তি জলাবদ্ধতার কবলে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কী অদ্ভুত মিল! রাঙামাটি হাজার হাজার মানুষকে আবাসচ্যুত করে সৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদ যেমন এখন লক্ষ পর্যটকের আকর্ষণীয় বিনোদনস্থল, কিশোরগঞ্জ-হবিগঞ্জ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে বাড়তি জলাবদ্ধতায় ডুবিয়ে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কও এখন তেমনি আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল। আর দুটি ঘটনাই ঘটানো হয়েছে উন্নয়নের নাম করে।
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, এমন ঘটনা শুধু কিশোরগঞ্জ-হবিগঞ্জ অঞ্চলেই ঘটেনি। সাম্প্রতিক সময়ে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য জলাভূমির পানির প্রাকৃতিক প্রবাহধারাকে বন্ধ করে দিয়ে সেতু, পার্ক, সরকারি দপ্তর, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা ইত্যাদি নানা স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলোকে এখন চরম আত্মঘাতী কাজ মনে হলেও তথাকথিত উন্নয়নের তথা বিশেষ শ্রেণি কর্তৃক সম্পদ কুক্ষিগত করার নির্মম প্রয়াস হিসেবে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কীই-বা করার আছে! তবে চরম হতাশার মধ্যেও এই ভেবে সান্ত্বনা খোঁজা যে শেষ পর্যন্ত হাওর অঞ্চলের বাসিন্দা পরিকল্পনামন্ত্রীর বোধোদয় হয়েছে, পরিবেশ ও প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এভাবে দৃষ্টিনন্দন সড়ক নির্মাণ করা একেবারেই ঠিক হয়নি।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গত ৩০ অক্টোবর ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং বিশ্বব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত জ্বালানি ব্যবহারসংক্রান্ত দুদিনব্যাপী এক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বলেছেন, ‘হাওর এলাকায় আর কোনো সড়ক নির্মাণ করা হবে না’ (আজকের পত্রিকা, ৩১ অক্টোবর ২০২৩)। পরিকল্পনামন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করার আগে এ-সংক্রান্ত কিছু তথ্য সামনে আনা যেতে পারে বলে মনে করি, যার প্রথমটি হচ্ছে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কসংক্রান্ত।
২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ উক্ত সড়কের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের সাড়ে চার বছরের কম সময়ের ব্যবধানে এবং নির্ধারিত সময়ের কয়েক মাস আগে ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর উক্ত সড়কের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মোট ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ২৯ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের উদ্বোধনকালে বলা হয়েছিল, এর মধ্য দিয়ে হাওরাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হলো।
এখন প্রশ্ন দুটি: এক. ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে ওই এলাকার সাধারণ মানুষের লালিত স্বপ্ন আসলেই পূরণ হয়েছে কি না; এবং দুই. অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ কেনই-বা হাওরে সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন? প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেতে প্রথমেই জানা দরকার, ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের যাতায়াতের কষ্ট লাঘবের জন্য আসলে কী ধরনের রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রয়োজন। জবাবে বলব, তাদের সাধারণ প্রত্যাশা হচ্ছে বিদ্যমান সেকেলে নৌযানব্যবস্থার বিপরীতে একটি মোটরযানচালিত আধুনিক যোগাযোগ অবকাঠামো।
তা সেটি সড়ক, সেতু, নাকি টানেল—সেটি মুখ্য বিবেচ্য নয়। সে ক্ষেত্রে এর মধ্যে কোনটি ওই অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত, তা নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ যে এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, তা এরই মধ্যে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আরও প্রমাণিত হয়েছে, হাওর অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ও জলাভূমির গঠন বিবেচনায় সেখানে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণ একেবারেই সমীচীন হয়নি।
আর তাই এ নিয়ে উক্ত সড়ক উদ্বোধনের আড়াই বছর পেরোতে না পেরোতেই পরিকল্পনামন্ত্রী এই বলে হতাশা ব্যক্ত করলেন যে ‘এখন টের পাচ্ছি, হাওরে সড়ক নির্মাণ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। হাওরে সড়ক বানিয়ে উপকারের চেয়ে অপকারই হয়েছে।’ (প্রথম আলো, ২০ মে ২০২৩) এবার দ্বিতীয় প্রশ্নের অর্থাৎ অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ কেন হাওরে সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সে জিজ্ঞাসার জবাব খোঁজার চেষ্টা। হাওর অঞ্চলের পশ্চাৎপদ যোগাযোগব্যবস্থার অন্যতম ভুক্তভোগী হিসেবে তাঁর কাছে হয়তো মনে হয়েছিল, সড়ক নির্মাণই হচ্ছে এর সমাধান এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় দপ্তরকে তিনি হয়তো তেমনটিই বলেছিলেন।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় দপ্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে তখন বলা দরকার ছিল যে ওই এলাকার ভূপ্রাকৃতিক গঠন ও পরিবেশের বিবেচনায় সেখানে সড়ক নির্মাণ করাটা সমীচীন হবে না; বরং তার পরিবর্তে দীর্ঘ সেতু বা বিকল্প কোনো ব্যবস্থার কথা ভাবা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ সে পথে না হেঁটে ‘রাষ্ট্রপতি চেয়েছেন’ এটাকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়েছে, যেটি বাংলাদেশের মুৎসুদ্দি আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি ঘৃণ্য ত্রুটিপূর্ণ দিক। যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাইপূর্বক তার ফলাফলের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতিকে যদি বুঝিয়ে বলা যেত, ওখানে সড়ক নির্মাণ করাটা সমীচীন হবে না বা তার পরিবর্তে বিকল্প উপায়ের কথা তাঁরা বলতেন, তাহলে নিশ্চয় তিনি মেনে নিতেন। কিন্তু এ দেশের চাটুকার আমলারা প্রায় কখনোই তা করেন না।
এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকভাবেই কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসে। ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণের আগে সত্যি কি যথাযথভাবে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল? হয়ে থাকলে তা যাচাইয়ে কেন এটি ধরা পড়ল না যে এ ধরনের সড়ক নির্মাণ করা হলে সেই অঞ্চলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হবে, নতুন করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে এবং সামগ্রিক পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এর মানে হচ্ছে, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজটি যথাযথভাবে হয়নি, যেমনটি এ দেশের অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে হয় না।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার কর্তৃক যেসব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, বলাই যায়, এগুলোর বেশির ভাগই উপযুক্ত সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিবেচনায় গ্রহণ করা হয়েছে। আর এসব বিবেচনার মধ্যে অন্তত একটি হচ্ছে বেশি বেশি নির্মাণকাজের সঙ্গে কার্যাদেশদাতা ও কার্যাদেশ লাভকারী—উভয় পক্ষের বেশি বেশি যুক্ত থাকতে পারার আনন্দ। আর এটি যে কত বেশি সত্য, তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ হচ্ছে নানা প্রতিষ্ঠানের আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা বহুসংখ্যক বহুতল ভবন ও অন্যান্য স্থাপনা অব্যবহৃত পড়ে থাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে গড়ে ওঠা এমন কয়েকটি উড়ালসড়ক সম্প্রতি নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলো যানজট নিরসনের পরিবর্তে তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এবার হাওরের বুক চিরে সড়ক নির্মাণসংক্রান্ত মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক। বাংলাদেশের মতো নিচু ভূমির দেশ ছাড়াও পৃথিবীতে এমন আরও কিছু কিছু দেশ রয়েছে, যেখানে আধুনিক নৌযানব্যবস্থাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রধান, জুতসই ও জনপ্রিয় যানবাহন হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। যেমন ইউরোপের নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, এশিয়ার থাইল্যান্ড ও মালদ্বীপ, আফ্রিকার সেনেগাল, দক্ষিণ আমেরিকার চিলি ইত্যাদি। বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলেও এ ধরনের যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবা যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে দীর্ঘ সেতু নির্মাণের কথা ভাবাটাও সমীচীন বলে মনে হয় না। বঙ্গবন্ধু সেতু বা পদ্মা সেতুর তুলনায় এ ধরনের সেতু তো একেবারেই নস্যি।তবে শেষ পর্যন্ত কী বা কোনটি করা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত প্রকৃত বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত গভীরতাপূর্ণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ভিত্তিতে—সব বিষয়ে পণ্ডিত আমলা-সদস্যের তাৎক্ষণিক মতামত বা অপরিপক্ব রাজনৈতিক সুপারিশের ভিত্তিতে নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ধ্বংস করে এরই মধ্যে যেসব সড়ক নির্মিত হয়ে গেছে, সেগুলোর কী হবে? এ প্রশ্নের বস্তুত কোনো জবাব নেই। তবে উত্তম হতো যদি এ সড়কগুলোকে হাতিরঝিলে অবৈধভাবে নির্মিত বিজিএমইএ ভবনের মতো নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু সেটি তো এখন আর সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় গত শতাব্দীর ষাটের দশকে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে রাঙামাটির বিস্তীর্ণ এলাকার হাজার হাজার মানুষকে যেমন নবসৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদের পানির নিচে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ককেও এখন তেমনটি গণ্য করা যেতে পারে, যা এখন ওই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের নতুন করে বাড়তি জলাবদ্ধতার কবলে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কী অদ্ভুত মিল! রাঙামাটি হাজার হাজার মানুষকে আবাসচ্যুত করে সৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদ যেমন এখন লক্ষ পর্যটকের আকর্ষণীয় বিনোদনস্থল, কিশোরগঞ্জ-হবিগঞ্জ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে বাড়তি জলাবদ্ধতায় ডুবিয়ে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কও এখন তেমনি আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল। আর দুটি ঘটনাই ঘটানো হয়েছে উন্নয়নের নাম করে।
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, এমন ঘটনা শুধু কিশোরগঞ্জ-হবিগঞ্জ অঞ্চলেই ঘটেনি। সাম্প্রতিক সময়ে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য জলাভূমির পানির প্রাকৃতিক প্রবাহধারাকে বন্ধ করে দিয়ে সেতু, পার্ক, সরকারি দপ্তর, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা ইত্যাদি নানা স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলোকে এখন চরম আত্মঘাতী কাজ মনে হলেও তথাকথিত উন্নয়নের তথা বিশেষ শ্রেণি কর্তৃক সম্পদ কুক্ষিগত করার নির্মম প্রয়াস হিসেবে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কীই-বা করার আছে! তবে চরম হতাশার মধ্যেও এই ভেবে সান্ত্বনা খোঁজা যে শেষ পর্যন্ত হাওর অঞ্চলের বাসিন্দা পরিকল্পনামন্ত্রীর বোধোদয় হয়েছে, পরিবেশ ও প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এভাবে দৃষ্টিনন্দন সড়ক নির্মাণ করা একেবারেই ঠিক হয়নি।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৮ ঘণ্টা আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৮ ঘণ্টা আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৯ ঘণ্টা আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৯ ঘণ্টা আগে